চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৪
ইশরাত জাহান জেরিন
জমেলার গলা শোনা মাত্রই অভ্র হকচকিয়ে যায়। দোলনায় বসে থাকা আয়েশাকে তড়িঘড়ি করে টেনে তোলে। হাত ধরে দৌড় দেয়। পালিয়ে কোথায় যাবে, কিছু বুঝে না পেয়ে একটা ঝোপের ভেতরে গিয়ে লুকায়।
আয়েশা গলা নামিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে, “এইখানে এত মশা কেন রে! কুদ্দুসের আব্বা তুমি আমাকে মশার কামড়ে খাওয়াতে ঝোপে এনেছো?”
“আরে হবু বউ একটু সহ্য করে নাও।”
আয়েশা গা চুলকে বলে,” সহ্য করো মানে? মশাগুলো তো আমার রক্তে টাইপ লাগিয়ে আঙুলের জুস ভেবে চুষে খাচ্ছে!
অভ্র দম ধরে হাসি চেপে বলে,” আহা, প্রেমে একটু মশার কামড় সহ্য করাও একপ্রকার রোমান্স।”
“রোমান্স গিলে পানি খাও।”
“আরে ঘরনী চুপ কর খোদার উছিলায়। তোর ওই তার ছিঁড়া দাদি যদি একবার আমায় খুঁজে পায় তাহলে বেডির ইংরেজি শুরু হয়ে যাবে। ওই ইংলিশ বুড়ির ইংলিশ শুনলে মনে হয় এখনও তোমায় বিষ খাইয়ে আমি মরে যাই।”
“আমাদের বিয়ে হবে কবে?”
“ভাইকে আগে মুডে আসতে তো দাও। দেখছো না তার চান্দের মতো মুখের উজ্জ্বলতা কেমন যেন ফিউজ হয়ে গিয়েছে?”
“হুম কি হলো তার। ”
“কিন্তু কেউ যদি আমাদের বিয়েতে রাজি না হয়?বাঁধা দেয়?”
অভ্র ভাবলেশহীন ভাবে গান ধরে,আরে ধূর তুমি রাজি আমি রাজি কেয়া কারেগা কাজি? বিয়ের মত দুজন মিলে ভাজবো ডিম ভাজি।”
হঠাৎ করে ঝোপের পেছন থেকে জমেলা বুড়ি অভ্রর শার্ট ধরে টেনে বলে,”ওরে আমার হাজি ইউ একটা পাঁজি”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাতের খাবার শেষ হতেই চিত্রা আবদার করে বাগানে যাওয়ার। খাওয়াদাওয়ার পর থেকেই সে আয়েশাকে খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটা যে কোথায় গেল, কিছুই বুঝতে পারছে না। ফারাজ চিত্রার হাত ধরে বাইরে আসে। ধীরে ধীরে বাগানের পথে হাঁটে তারা।
চিত্রা ফারাজের হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করে, “দোলনায় বসবেন?”
ফারাজ মুচকি হেসে বলে, “তুমি বসলে না হয় বসব।”
দু’জনে গিয়ে বিশাল দোলনায় বসে। তিন-চারজন অনায়াসে বসতে পারবে এমন দোলনাটা। ফারাজ বসতেই চিত্রা মাথা রাখে ওর উরুতে। আকাশে আজ মেঘ নেই, নেই বৃষ্টির কোনো গন্ধ। হালকা গরম। গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে চিত্রা। ফারাজের কোলে মাথা রেখে তারার দিকে চেয়ে গুনতে শুরু করে। কিন্তু শেষ হয় না গোনা। হঠাৎ শরীর-মন ভার হয়ে ওঠে চিত্রার। আকাশের ওই দুটি উজ্জ্বল তারা হয়তো আজও ভারাক্রান্ত। কেন বাবা-মা তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল না? তাহলে তো সেও হতো রাতের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে অভিমানহীন।আলোঝলমলে। তার নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে,
“তারার ভিড়ে হারিয়ে যারা,
তারাও কি হয় সর্বহারা?”
ফারাজ চিত্রার কপালে চুমু খেয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চিত্রা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। একসময় এই আকাশই তাকে বারবার মনে করিয়ে দিত।সে নিঃস্ব যেমন নিঃস্ব ওই রাতের চাঁদ। আচ্ছা নিঃসঙ্গ চাঁদও কি তার মতোই একা? পৃথিবীর নিঃসঙ্গ মানুষদের দিকে তাকিয়ে কি চাঁদেরও কখনো কখনো দুঃখ হয়? বাতাসে ভেসে বেড়ানো হাহাকারের মতো কি সেও কখনো নিঃশ্বাস ফেলে?
“সেই রাতে তালুকদার বাড়িতে কী হয়েছিল, চিত্রাঙ্গনা?”ফারাজ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে।
চিত্রার দৃষ্টি তখনও আকাশে নিবদ্ধ। সে মৃদু স্বরে বলল, “জানেন, তখন আমার বয়স কতই বা হবে? মাত্র আট বছর। সেই রাতে আমাদের তালুকদার বাড়িতে আমার ছোট ফুফুর বিয়ের আয়োজন চলছিল। খুব ঘরোয়া পরিবেশ, পরিবারের আপনজনরাই শুধু উপস্থিত ছিল। আশপাশের কিছু প্রতিবেশীও এসেছিলেন। কিন্তু রাতের খাবার খেয়ে তারা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যান। শামসুল মামা আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। তাঁর নিজের কোনো মেয়ে ছিল না বলেই আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। সেদিন তিনি মা-বাবার কাছে অনুরোধ করেন যেন এক রাতের জন্য আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন।”
“শামসুলই কি মার্জিয়া মাদার-ইন-ল’র পাতিদেব?”ফারাজ জিজ্ঞেস করল।
“জ্বী। তার….”
“তারপর মা-বাবা তোমাকে নিয়ে যেতো দিলেন তাই তো?”
“আপনি কী করে জানলেন?”চিত্রা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আন্দাজ করেছি।”
“ওহ।”
“হুম।”
“তারপর?”
“সেই রাতে মা-বাবা আমাকে মামার হাতে তুলে দেন। মা জানতেন আমি অন্ধকারে ঘুমাতে পারি না তবু মামার অনুরোধ ফেলতে পারেননি। আমি যেতে চাইনি। রাতে মাকে জড়িয়ে না ঘুমালে আমার ঘুম হতো না। সেদিন প্রথম এবং শেষবারের মতো যাওয়ার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলেছিলাম, ‘মা, আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না।’ মা শুনল না। বলল, ‘কাল সকালে মামা তোমাকে নিয়ে আসবে। তুমি এলে তোমাকে নতুন পুতুল কিনে দেব, চকোলেট দেব। বাবা বলল ঘুরতে নিয়ে যাবে।’
চিত্রা গভীর শ্বাস নিয়ে থামল। তারপর ধীরে বলে,
“কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমাদের দেখা হয়েছিল ঠিকই, তবে আমি আমার মাকে চিনতে পারিনি। বাবাকেও না। তাঁদের চেহারাগুলো এক রাতেই ছাই হয়ে গিয়েছিল। আট বছরের আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। সাজানো গোছানো বাড়ি কেমন করে এক রাতে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল, আনন্দের বাড়ি কেন হঠাৎ শোকস্তব্ধ হয়ে গেল কিছুই বোঝার বয়স হয়নি আমার। শুধু এটুকু জানি সেদিন আমি সব হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজও সেই শূন্যতা আমাকে ঘুমাতে দেয় না।”
চিত্রার চোখে জল চলে আসে। ফারাজ তখনও গভীর মনোযোগে শুনছে। তার মুখ গম্ভীর, কিন্তু দৃষ্টি চঞ্চল । সে আবার জিজ্ঞেস করে,
“সাতাশ জন কে কে ছিল, মনে আছে?”
“আমার দাদা-দাদী, তাঁদের সাত ছেলে এবং ছেলেদের বউরা।”
“আর বাকি এগারজন?”
“তালুকদার বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলাম আমি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাকিদের মধ্যে ছিল ছয় চাচার ছয় ছেলে, বড় চাচার দুটি ছেলে। তার মধ্যে একজনের স্ত্রীও ছিল।”
“আর?”
“আর ছিল ছোট ফুফু ও বড় ফুফু। বড় ফুফুর ছেলেও ছিল।”
“এবার হিসাব মেলান। সাতাশজন হয়?”
“হয়। তবে সংখ্যা অনুযায়ী আটাশজন হওয়ার কথা ছিল। সেই রাতে সংখ্যার অঙ্কে গড়মিল না হলে তুমিও ঝলসে যেতে আগুন-সুন্দরী।”
চিত্রা নীরবে তাকিয়ে রইল। ধীরে বলল, “আপনি কী যে বলেন! আগুন কখনো আগুনকে পোড়াতে পারে না বরং আগুনে আগুনের ছোঁয়া লাগলে তা আরও তীব্র হয়। তবে হ্যাঁ সেদিন মা যদি জোর করে না আমাকে পাঠাতেন তাহলে আজ হয়তো কবরের সংখ্যা আরেকটা বেড়ে যেত।”
ফারাজ চিত্রাকে আস্তে করে তুলে বসায়। তারপর বুকের মাঝে আগলে ধরে বলে “কথা দিলাম, তোমার চোখে আর জল আসতে দেব না। তবে আর সেই জলের কারন আমি হওয়ার আগেই যেন মরন হয় আমার।”
চিত্রা গলা আটকে আসে। কেঁপে উঠা কণ্ঠে বলে,”দয়া করে এসব বলবেন না। আমার আর কেউ নেই আপনি ছাড়া।”
ফারাজ তাকে আরও শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরে। যেন সত্যের পাহারা এসে তাকে কেড়ে নিয়ে যাবে। তার ভেতরটা কেমন করে ওঠে। চোখ বুঁজে বলে, “মৃত্যুটা যেন তোমার আগেই হয়। কারণ তোমার খাটিয়ার ওজন বহন করার মতো সক্ষমতা তোমার স্বামীর নেই যে বিবিজান।”
চিত্রা নিজেকে সামলায়। একটি ইমারত ধসে পড়ার জন্য সামান্য খুঁটিই যথেষ্ট। সে চোখের জল মুছে, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “পিয়াস ভাইকে দেখেছেন? তিনি কীভাবে নিজের স্ত্রীর হয়ে প্রতিবাদ করেছেন? আচ্ছা কেউ যদি আমাকে কিছু বলে, আপনিও কি তখন এভাবেই আমার হয়ে রুখে দাঁড়াবেন?”
ফারাজ চিত্রার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “আগে তো কেউ সাহস করুক তোমাকে কিছু বলার!”
সে চিত্রার কপালে চুমু দিয়ে মনে মনে বলে,”পিয়াস প্রতিবাদ করেছে মুখে। কিন্তু সেখানে যদি নিশির বদলে চিত্রা তুমি থাকতে তবে এতক্ষণে র*ক্তের বন্যা বইয়ে দিতাম আমি। ওদের জিভ ছিঁড়ে পথের কুকুরকে খাওয়াতাম। কারণ আমার মুখের চেয়ে হাত চলে বেশি। তোমার হৃদয়ে আঘাত করা মানে আমার হৃদয় জখম হওয়া। আর ফারাজ এলাহী হৃদয়ে জখমকারীকে আঘাত করে বরং টেনে হিঁচড়ে একেবারে তার হৃদয়টাই ছিঁড়ে আনে।”
অনেক রাত করে বজ্র বাসায় ফিরে। ফারাজ তখন নিজ কক্ষে নিদ্রাচ্ছন্ন। চিত্রার পানির এত তৃষ্ণা পেয়েছিল যে সোজা সে রান্নাঘরে চলে আসে। পানির জগ নিয়ে উপরে যাবে এমন সময় রান্নাঘরের দরজার সামনে অস্ফুট দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা নেশাগ্রস্ত বজ্রকে দেখতে পায়। চিত্রা বিচলিত হয়ে পরে।
“আরে ভাই আপনার কি হয়েছে।”চিত্রার কণ্ঠে উদ্বেগ।
কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে বজ্র। চোখের কোণে জমে ওঠে জল। তবুও শক্ত হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে সে বলে,”যা আমার ছিল তা আমার চিরজীবনই থাকবে। ছিনিয়ে নিতে হলে প্রয়োজনে তাই করবো।”
“আপনাকে ঠিক লাগছে না। জল খাবেন?” চিত্রা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।
বজ্র কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে সুধায়, “বিষ খেয়ে ফেলেছিল আমি। জল খেলে কি বিষের প্রতিক্রিয়া সেরে যাবে?”
“আপনি নেশা করেছেন ভাই….য়া?”চিত্রার চোখে এবার স্পষ্ট ভয়।
বজ্র কিছুক্ষণ থেমে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তারপর চোয়াল শক্ত করে ফ্রিজ খুলে এক মুঠো তেঁতুল তুলে নেয়। চলে যেতে গিয়েও হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে চিত্রার চোখে চোখ রাখে। “কোনো একদিন হাত কেটে দেখবেন। আপনার আর আমার কিন্তু একই রক্ত। তাই অনন্ত নিজের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করবেন না ভাবীজা…..ন।
চিত্রা জবাব দেয় না। স্তব্ধও স্থির তাকিয়ে থাকে বজ্রর যাওয়ার পথে। চুপ করে থাকলেও চোখে তার প্রশ্ন। সন্দেহের ঘনঘটা। বজ্র যা বলেছে তার কোনো মানে খুঁজে পায় না চিত্রা। কিন্তু তার কপালে পড়া ভাঁজ ক্রমশ গাঢ় হয়। গাঢ় থেকে আরো গাঢ়।
রাত ঘন হয়ে এসেছে। আকাশে চাঁদ নেই। তারা নেই আছে কেবল পুরু একটা অন্ধকার আর তার বুক চিরে এগিয়ে চলা বেকারির ভ্যানের কর্কশ ক্যাচক্যাচ শব্দ। মরচে ধরা লোহার গায়ে আঁচ। কিন্তু ইঞ্জিনটা শক্ত। ভ্যানটি রাত ফুঁড়ে যাওয়ার জেদে এগিয়ে চলছে। বেকারির পুরনো ভ্যানটা রাতের জন্য ভাড়া করেছে মাহাদী। চাল বসানো ভ্যানে সে নিজেই চালক। ভেতরে পেছনের দিকে অচেতন পড়ে আছে এক নারী, নাম তার স্মৃতি। দুই মাসের সন্তান গর্ভে। নিরীহ একটা মেয়ে। তাকে চুপচাপ কৌশলে বেহুঁশ করে ভ্যানে তুলেছে মাহাদী। চাল খাটিয়েছে, সময় দিয়েছে, ধৈর্য ধরেছে। এতদিন ‘মাল’ পৌঁছে দিতে হতো নিকলীর হাওরে। তবে এখন আর নয়। শহরের এক কোণে নদীর কিনারায় বসে আছে সোহান পালোয়ান। তার অন্ধকার বাণিজ্যের নতুন ঠিকানা সোহান পালোয়ানের আস্তানা। সেখানেই যাচ্ছে মাহাদী।মাহাদী খুশি। চেহারায় স্পষ্ট প্রশান্তি। আজকের ডেলিভারি ঠিকঠাক হলে হাতে আসবে টাকা। সেই টাকায় বউয়ের জন্য এবার কি কেনা যায়? সোনার বালা? নাকি জামদানি শাড়ি? ভ্যান এগিয়ে চলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে মাহাদী আপন মনে গুনগুন করে,
“পরের জায়গা, পরের জমিন, ঘর বানাইয়া আমি রই…
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই…”
রাতের নীরবতা চিড়ে ধীরে ধীরে এসে থামে ভ্যানটা পুরান ঘাটের ঠিক সামনেই। এক সময়ের জমজমাট এই ঘাট এখন মৃতপ্রায়। নৌকা ওঠে না, নামে না, শুধু পড়ে থাকে কঙ্কালের মতো কিছু বিশাল আকারের ট্রলার।মাছ ধরার নয়, অন্যরকমের কাজেই ব্যবহৃত হয় এসব। মাহাদী স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে একবার চারপাশে তাকায়। বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। আশপাশ শুনশান। সিগারেটের শেষ ধোঁয়ার মতো সন্দেহ তার মনে পাক খেতে থাকে। বিপদ বলে কয়ে আসে না। সে নেমে পরে। তারপর ভ্যানের পেছন দিক খুলে টেনে তোলে মেয়েটিকে। বেহুঁশ নিস্তেজ দেহ তবুও ভারী। শরীর ছেড়ে দিয়েছে পুরোপুরি। এক হাতে কোমর, আরেক হাতে কাঁধ ধরে মাহাদী টানতে টানতে ট্রলারের দিকে এগোয়। হাঁপাচ্ছে, কিন্তু থামে না। ট্রলারের ভেতর আলো ম্লান। একটা মানুষ বসে আছে সামনের দিকে। নাম তার সোহান পালোয়ান। তার দিকে চোখ যেতেই থমকে যায় মাহাদী। কদাকার কালো শরীর। ঠোঁট রক্তিম পানের রসে। দশ আঙুলে মোটা মোটা সোনার আংটি। গলা থেকে কব্জি পর্যন্ত সোনায় মোড়ানো। মুখ চকচক করছে সরিষার তেলে। চোখে কুয়াশার মতো নিষ্ঠুরতা। কালো চাপদাড়ি, মোটা গোঁফে আটকে আছে চায়ের দুধের ফোঁটা। চায়ের কাপটায় আঙুল ডুবিয়ে সোহান সর চেটে নিচ্ছে যত্ন করে। কালো ফতুয়া, কালো লুঙ্গি পুরোটাই একটা ছায়াসত্তা। এমন মানুষকে কি বলে ডাকা যায়? অন্ধকারের রাজা?
মাহাদী ভয়ে গলা খাঁরা করে। সে কিছু বলে না। কেবল সালাম দিয়ে জানায়,”মেয়ে হাজির।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিফাত কথাটা পুনরাবৃত্তি করে সোহানকে উদ্দেশ করে। মাহাদীর কপাল দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ে। কারণ সামনে বসা এই লোকটা মানুষ নয় নৃশংস কোনো নরপিশাচ।
নির্জন ঘরটা নিঃশব্দ। সোহান ধাতব কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। চোখেমুখে বিরক্তি মাখা ক্লান্তি। হাতের উল্টো পাশে মুখ মুছে ধীরে তাকাল ছটফট করা মেয়েটির দিকে। চেহারায় এখনও সৌন্দর্যের ছাপ রয়ে গেছে। তবে তাতে এখন আর কোনো মানবিকতা জাগে না তার চোখে। সোহান একপলক মাহাদীর দিকে তাকাল। তারপর সিফাতকে বলল,
“ওরে টাকা বুঝায়া দে।”
সিফাত মাথা নাড়ল। উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে সোহান এক বোতল পানি তুলে মুখের সামনে এনে খুলে ফেলল। তারপর মেয়েটির মুখে ছুঁড়ে দিল ঠাণ্ডা জল। মেয়েটি হুঁশ ফিরল। কেঁপে উঠল সে।দম নিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল চারপাশে। পরিচিত কিছু নেই। এই ঘর তার নিজের নয়। কিছুটা স্মৃতি ফিরে এলো। তার চিৎকার, ধস্তাধস্তি, তারপর অন্ধকারের তলিয়ে যাওয়া সেই ভয়ানক দৃশ্য। বুঝতে বাকি রইল না সে অপহৃত। ঘাড় ঘুরিয়ে, মুখ তুলে চেঁচিয়ে উঠল সে আতঙ্কে। “বাঁচান! কেউ আছেন?”
তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেদ করে কান ফাটানো আর্তনাদ জায়গাটিকে কাঁপিয়ে দিল।
“চুপ!” ধমকে উঠল সিফাত। মেয়েটি থামল না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।“দয়া করেন ভাই, আমি কিছু বলমু না। দয়া করেন…”
সোহান তখনও নীরব। গা থেকে একটা অলস বিরক্তি ঝরে পড়ছে তার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সিফাতকে বলল, “কানে লাগতাছে ভীষণ। এরে চুপ করা।”
সিফাত দেরি করল না। এগিয়ে গিয়ে সজোরে লাথি মারল মেয়েটার পেটে। একটা ভাঙা খেলনার মতো গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ব্যথায় মুখ কুঁচকে উঠল। হাত দিয়ে পেট চেপে ধরল সে।
“আমার বাচ্চা…” কণ্ঠটা ভেঙে গেল, “আমার বাচ্চার জন্যে হলেও ছাইড়া দেন ভাই… দোহাই লাগে… সারাজীবন ঋণী হইয়া থাকুম… আমি কাউরে কিছু কইমু না, কাউরে কিছু জানামু না… ছাইড়া দেন…”
শব্দগুলো ঘরের ভেতরে রক্তমাখা মিনতির মতো লটকে রইল। দেয়ালের চোখ ছিল না বলে সে দেখতেন পায় নি,আর যাদের কান ছিল তারা শুনতে পায় নি।
ঘরের বাতাসটা আবারও থমথমে হয়ে গেল। সিফাত এগিয়ে এসে মেয়েটার এলোমেলো চুলের মুঠি চেপে ধরে মুখে কষে এক চড় বসাল।
“নডির ঘরের নডি, মুখ এত চলে কেন? চুপ কর। চুপ না করলে পেটের বাচ্চারে টাইনা বাহির কইরা আনমু।”
মেয়েটার চোখ বড় হয়ে গেল ভয়ে। কণ্ঠ হারিয়ে গুটিয়ে গেল এক কোণে। ফ্যাকাসে মুখে কাঁপতে কাঁপতে ট্রলার লোহার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। মুহূর্ত পর সিফাত টাকা গুনে বুঝিয়ে দিল মাহাদীকে। মাহাদী সালাম দিয়ে ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াতেই মেয়েটি ছিটকে এসে তার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। কান্নায় ভেঙে পড়ল।
“ভাই… ভাই, নিয়া যান আমারে… বাঁচান… আপনার ঘরেও মা বইন আছে না ভাই? বউ আছে তো? আপনার সন্তানের কথা ভাইবা হইলেও… ভাই বাঁচান আমারে। এইটা আমার প্রথম বাচ্চা… ওরে দুনিয়া দেখতে দেন ভাই… ওরে একবার দুনিয়া দেখতে দেন…” ভেজা কণ্ঠে পাগলের মতো আকুতি। শরীর কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে।
মাহাদী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যায়। এক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল কপাল বেয়ে। কণ্ঠে কোনো শব্দ এল না। চোখ উঠিয়ে সোহানের দিকে তাকাতেই দেখল লাল হয়ে থাকা দুটো চোখ তাকে গিলে খাচ্ছে। বুকটা ঠক করে কেঁপে উঠল তার। সে জলদি পা ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু পা চলছে না। যেন কাঁদা জলে তলিয়ে গিয়েছে সে। তলিয়ে গিয়েছে তার পা দুটো। ভেতরে থেকে শোনা যাচ্ছে মেয়েটির আর্তনাদ। ব্যথায় ছটফট করার শব্দ। সিফাত হয়তো থেমে নেই। মাহাদী তখন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। পেছনে ফিরে তাকায় বারবার। তার তো খুশি হওয়ার কথা।অত টাকা একসাথে পেয়েছে।
তবু কেন এই ভার? কেন বারবার কানে ঝাঁঝড়া মেরে বাজে মেয়েটির আর্তি?
“ভাই আমার বাচ্চার দোহাই বাঁচান… আমার প্রথম বাচ্চা… ওরে দুনিয়া দেখবার দেন…”
নিশুতি রাত। চিত্রা স্বামীর বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তবু শরীরজুড়ে অস্থিরতা। চোখ বুঁজেও ঘুম আসছে না। হঠাৎ কেন এমন অনাহুত কষ্ট? কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা খুব খারাপ হতে যাচ্ছে?
নিশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। উল্টো গুনে ঘুম আনতে চায়। আটানব্বইতে৷ পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ধড়াস করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চোখদুটো ছলকে ওঠে ভয়ে। এত রাতে? কে হতে পারে? চিত্রা সাহস হয় না একা উঠে গিয়ে দরজা খোলার।
“এই শুনছেন? উঠুন না… দরজায় কে যেন করাঘাত করছে।”চিত্রার গলা কাঁপছে।
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৩
ফারাজ চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে।তারপর উঠে দাঁড়ায়। নগ্ন বুক, এলোমেলো চুলে দরজার দিকে এগোয়। চিত্রা গায়ে ওড়না জড়িয়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে পেছনে পেছনে আসে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই স্থির হয়ে যায় সময়। সামনে দাঁড়িয়ে আয়েশা।চুল এলোমেলো, চোখ ফুলে আছে কান্নায়, ওড়না এক পাশে সরে গেছে। চিত্রার পা হিম হয়ে আসে। এক ঝাঁক ভয় নিয়ে দৌড়ে যায় আয়েশার কাছে।
“কি হয়েছে আয়েশা?” ভয় আর উদ্বেগে গলা শুকিয়ে আসে তার। ফারাজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। মুখটা তার থমথমে। চিত্রা আয়েশাকে ঘরে টেনে আনে। বসাতে যাবে এমন সময় আয়েশা তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
“খুন… খুন হয়েছে।”