চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৪ (২)

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৪ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন

❝মানুষ জন্ম নেয় কেবল মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে বলেই।❞
লাশঘরের নিস্তব্ধতা সময়কেও স্তব্ধ করে রেখেছে। নিথর হয়ে পড়ে আছে মিতালির লাশ। কাঁটার মতো কঠিন চিত্রা আজ ভেঙে পড়েছে অজান্তেই। তার চোখে কোনো ভয় নেই। আছে কেবল নিঃশেষ একটা শোক। মিতালির নিষ্পাপ মুখখানিতে সে বারবার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই মুখেও ভয়ংকর, নির্মম ব্লেডের আঁচড়। চিত্রার কাতর দৃষ্টিতে জমে আছে অসহায়তা। লাশঘরের মেঝেতে পড়ে অঝোরে কাঁদছে আয়েশা। এমন ভাবে কাঁদছে যা অন্তর বিদীর্ণ করে দেয়। চিত্রা এর আগে আয়েশার চোখে জল দেখেনি কখনও। আয়েশা সবসময় পাহাড়ের মতো অটল ও সাহসের প্রতিমা ছিল। আজ সে হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে পড়ে বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। এই দৃশ্য ভাবাই যায় না। অভ্র চুপচাপ পাশে বসে আয়েশাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে জানে, এই শোকের কোনো ভাষা হয় না। আয়েশার চোখের জলের উত্তাপে অভ্রর ভেতরটাও পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার বন্ধন গড়ে ওঠে। সেই বন্ধন এতটাই গভীর হয় যা সারা জীবন আমাদের মায়ায় জড়িয়ে রাখে।

ফারাজ চিত্রার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কোনো ভাষা তো যথেষ্ট নয় এই শোকের সামনে। তবে তার একটাই চাওয়া চিত্রা যেন কাঁদে। বুক চিরে কান্না এলে অন্তত ব্যথার ভার কিছুটা হালকা হবে। বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রাখলে যন্ত্রণাটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আর সেই তীব্র ব্যথা আজীবন মানুষদের অন্তস্থলকে ধুঁকে ধুঁকে শেষ করে।
ফারাজ অপেক্ষা না করে পুলিশের সঙ্গে দেখা করে। সেখানে ডাক্তারও ছিল। কিছু মুহুর্তে যেতে না যেতেই বজ্র এসে উপস্থিত হয়। লাশ দেখেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একের পর এক লোমহর্ষক দৃশ্য।
সে নিউরোসার্জন। কাটা-ছেঁড়ার কাজ তার নিত্যদিনের অভ্যেস।তবু এই লাশের ক্ষত তাকে কাঁপিয়ে দেয় ভেতর থেকে। ভিক্টিমকে শারীরিক আর মানসিকভাবে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে।
মাথার অর্ধেক চুল কেটে ফেলা, সারা দেহে ব্লেডের আঁচড়,দগ্ধ চামড়ায় আগুনের ছেঁকা,বারবার ধর্ষণের অসংখ্য চিহ্ন। একজন না, বহুজন। একবার নয়, বহুবার। আর এসবের পরও ফারাজ যখন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে নেয় তখন সে থমকে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আত্মহত্যা।” এই একটি শব্দই লেখা রিপোর্টের সারাংশ। ধর্ষণের কোনো কথাই উল্লেখ নেই।
শুধু লেখা, “মৃত্যুর আগে ভিক্টিম একই ব্যক্তির সঙ্গে বারবার যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছে।”
ফারাজের চোখ লাল হয়ে ওঠে। বুকের ভেতর আগুন জ্বলে। ঠিক তখনই পুলিশ অফিসার আকরাম প্রবেশ করে। ফারাজ তাকে আলাদা কক্ষে নিয়ে যায়। রুমের ভেতর ডাক্তারও ছিল। বজ্রও সেখানে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট পরখ করে দেখে। মানুষ কতটা খারাপ হলে একটা খুনকে এভাবে দামা-চাপা দিতে পারে। ফারাজ পকেটে হাত গুঁজে গম্ভীর গলায় পুলিশ অফিসার আকরামকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“আয়েশার নম্বর কোথায় পেয়েছেন মিস্টার আকরাম?”
আকরাম নিস্তরঙ্গ স্বরে উত্তর দেয়,“ভিক্টিমের ফোনে শেষ কল এসেছিল ওই নম্বর থেকেই। সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছি।”

ফারাজ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করে,”লাশ কোথায় পেয়েছেন? একটু শুনি কি করে মরল মিতালি।”
“ব্রিজের নিচে পেয়েছি। আর লাশের হাবভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে মেয়ের অন্য কারো সঙ্গে চক্কর ছিল। হয়তো প্রেমিক ছেড়ে চলে গিয়েছে বিধায় আত্মহত্যা করেছে। আবার এমনও হতে পারে প্রেমিকই তাকে খুন করেছে।”
ফারাজ চোখ সরু করে বলে,”তারমানে কিছুই সিউর না। সিউর না হয়ে আত্মহত্যা লিখে দিলেন কেন? এখানে ফাতরামি চলছে নাকি?”
আকরাম একটা ঢোক গিলে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”মা..নে আত্মহত্যার চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। এমনও তো হতে পারে মেয়ে নিজে আত্মহত্যা করে অন্যকাউকে ফাসানোর চেষ্টা করছে।”
“আর শরীরের ক্ষত?”
“মেয়ে সাইকো হয়ে থাকলে নিজের গায়ে ক্ষত সৃষ্টি করা কোনো ব্যাপার? আর আমরা তদন্ত শুরু করেছি তো। খুন হয়ে থাকলে খুনীকে খুঁজে বের করব। আপনি চিন্তা করবেন না এলাহী।”
ফারাজের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে।ফারাজের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। “চক্রান্তের মধ্যেও চক্রান্ত।”চোখের সামনে দেখছে একটা খুন হয়েছে অথচ শালা ঘুষখোরের দল আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছে। এদের মাথায়ও তো গোবরেও নেই। সাধারণ কাহিনিও সাজাতে পারছে না। আবার এসেছে এত্ত বড় একটা মামলা ধামাচাপা দিতে। ফারাজ নিজের রাগকে সংযত করে। এখানে তার বউ আছে। বউয়ের সামনে নিয়ন্ত্রণ হারালে হবে না। এমনিতেই চিত্রার অবস্থা ভালো না। সে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পুলিশকে বলে,

“সাবধান খুনীকে ধরতে দিয়ে আবার আপনি যেন খুন না হয়ে যান।”
ফারাজ ঘাড় চুলকে ডাক্তার এবং পুলিশকে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে বলে। তারা চলে যায়। বজ্রর কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ। হঠাৎই লাশঘরের দিক থেকে ভেসে আসে দমবন্ধ কান্নার আওয়াজ।
ভেতর থেকে গুমরে ওঠা আর্তি চারপাশের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে হাহাকারে রূপ নেয়। ফারাজ চোখ বন্ধ করে বুঝে নেয় চিত্রা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ভেতরে তার সব বাঁধ ভেঙে গেছে।
“তোর ভাবীর কাছে যাওয়া উচিত।”ধীর গলায় বলে বজ্র।
ফারাজ মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়,”ওকে একটু কাঁদতে দে। বুক ভার হয়ে আছে। হালকা না হলে নিজেই থেমে যাবে। সময়ের দরকার শুধু।”

বজ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,”ভাবীকে কি বলবি?”
“বলবার কিছু নেই। লাশটা দেখলেই বোঝা যায় কী নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছে মিতালি। চিত্রা লাশ দেখেই বুঝে গিয়েছে লাশের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্মমতা।”
“কিন্তু কারা এই কাজ করতে পারে? আমি যতটুকু জানি মিতালি মেয়েটা হাওর অঞ্চলের। একেবারে সিধে সাদা। এই মেয়ের এমন ক্ষতি কে করেছে? খুনের বিবরণ দেখে মনে তো হচ্ছে প্রতিশোধ, ভেতরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ মিটাতে এতকিছু করা। কিন্তু মিতালির আছেই বা কি যে তার ওপর ক্ষোভ মিটানো হয়েছে?”
ফারাজ চোখ সরু করে বলে,”বুঝিস নি বজ্র এখানে কারও ওপর ক্ষোভ নয় বরং একজনের রাগ ঝাড়া হয়েছে অন্যের গায়ে। একটা নিষ্পাপ মেয়ে হয়ে উঠেছে ছায়াশত্রুর শাস্তির পাত্র। তবে মনে হচ্ছে খুনীর রক্তের গন্ধ বহুবার শুঁকে দেখা হয়েছে।
বজ্র স্তব্ধ হয়ে তাকায়। “মানে?”
ফারাজ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দেয়,”সময় হলে দেখতে পাবি।”
বজ্র বিস্ময়ে ফারাজের মুখ দেখে।”এই পুলিশ আর ডাক্তার কিন্তু টাকা সাবার করেছে। ওদের ছেড়ে দিবি? সব বুঝতে পারার পরও চুপ কেমনে রইলি তাই বুঝতে পারলাম না।”
ফারাজের চোয়াল শক্ত করে বলে, “চিত্রার জন্য চুপ আছি। ও পাশের ঘরে আছে। না হলে এই রুমেই আজ শালাদের লাশ পড়ে থাকত।”

সে নিঃশ্বাস ফেলে জানালার দিকে তাকায়। বাইরে গাঢ় মেঘ। “ওরা ভাবে আজরাইল ফিরে গেছে
না বজ্র, আজরাইল ফিরে যায়নি।
ও এখনো ঘুরছে… মৃত্যুর দূত হয়ে… ওদের চারপাশেই।”
ফারাজ রুম থেকে বের হতেই চিত্রা ছুটে আসে তার দিকে।আজ আগুন সুন্দরীর সেই দীপ্তি কোথাও নেই। চোখ মুখ সবজায়গায় শুধুই অসহনীয় ব্যথার ছাপ।
ফারাজকে দেখামাত্রই চিত্রার কান্না নতুন করে জ্বলে উঠে। সে জড়িয়ে ধরে তাকে।চোখের জলে ফারাজের শার্ট ভিজে যায়। চিত্রা ফারাজের কলার আঁকড়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “বিশ্বাস করুন ফারাজ, মিতালি এমন মেয়ে ছিল না। ও আত্মহত্যা করতে পারে না। ওকে খুন করা হয়েছে!

ফারাজ ওদের খুঁজে বের করুন… ওদের বাঁচার অধিকার নেই!মিতুকে কেন মারলো ওরা? কী অপরাধ ছিল ওর?”
চিত্রা হেঁপিয়ে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে ফারাজের বুকে মাথা রাখে,”ফিরিয়ে আনুন মিতুকে… ফারাজ, ফিরিয়ে আনুন…”
ফারাজ এক হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে, গলা ভার করে বলে,
“দেখো, যা হওয়ার হয়ে গেছে। মৃত্যু তো উপরের সিদ্ধান্ত। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন।”
চিত্রা হঠাৎ দৃষ্টি তুলে ফারাজের চোখে চোখ রাখে।তার চোখের ভেতর আগুন জ্বলছে, “মৃত্যু? না খুন, ফারাজ?” তার আর্তনাদ চারপাশ কাঁপিয়ে দেয়।
চিত্রার আহাজারি করছে। আজকাল আপন মানুষ মরলেও তো মানুষ এনন করে না? বাবা-মা মরলে সন্তান কাঁদে না। কথায় আছে না, ❝করিয়া দাফন পর হয়ে যায় আপন।❞

” ফারাজ…মিতুকে জাগান ফারাজ। ও আর আপনাকে ভাই বলে ডাকবে না ফারাজ। ও চলে গেলে আপনাকে খালু বলে কে ডাকবে ফারা..জ?”দম ফুরিয়ে আসে চিত্রার। আয়েশার ভেতর ফাটছে। কষ্ট গিলে, শুঁকিয়ে যাওয়া জল মুখে চিত্রার কাছে হামাগুড়ি দিয়ে আসে। চিত্রাকে ফারাজের বুক থেকে কেড়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে গলা উঁচিয়ে কেঁদে উঠে চিত্রা। হেঁচকি উঠে গিয়েছে,”আয়েশা মিতু তো লাশ দেখতে গিয়েছিল,বলেছিল জলদি ফিরবে। কেন বলল না লাশ হয়ে ফিরবে?”
“পানি এনে দাও তো আয়েশা।” বলল ফারাজ।
চিত্রাকে রেখে আয়েশা পানি আনার জন্য ছুটে। অভ্র তার পেছন পেছন যায়। আয়েশাকে এক মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে পারবে না সে। আয়েশা অবস্থা যে চিত্রার থেকে ভালো না বললে ভুল হবে।
ফারাজ চিত্রাকে কোলে তুলে নেয়। চিত্রার চোখমুখ ফুলে গিয়েছে। হয়তো প্রেসার লো। শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
“আমি আছি তো বউ। কিচ্ছু হবে না। ঠিক হয়ে যাবে সব। ধর্য্য ধরো।”
জ্ঞান হারানোর আগে কেবল চিত্রার মুখ দিয়ে একটি বাক্যই বেরিয়ে আসে,”মি..তু কে ফি…রিয়ে… আনুন। খু…নের বি..চার চাই।”

মাইজচরে ঝড় বইছে। নদীর ঘা ঘেঁষে মিতালিদের বাড়ি। হাসপাতাল থেকে লাশ ছেড়ে দেওয়ার পরই মিতালির লাশ এম্বুল্যান্সে উঠানো হয়। এভাবে একা লাশকে কি করে পাঠাবো আপন ঠিকানায়। চিত্রা জেদ ধরেছে সে মিতালির সঙ্গে যাবেই যাবে। ফারাজ নিষেধ করতে পারে নি। সঙ্গে ড্রাইভার আনে নি। অভ্র গাড়ি চলাচ্ছে। আয়েশা মরার মতো জানালার গ্লাসে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সকাল হয়ে গিয়েছে। চিত্রাকে সেলাইন দেওয়া হয়েছিল। সে ব্যাক সিটে ফারাজের উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে নিজের অজান্তেই চোখ বুঁজে এসেছে।

সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে মাইজচরে। দিন নাকি রাত বুঝা মুশকিল। সেই বৃষ্টির মধ্যেই বাবার কবরের পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে মিতালিকে। শেষ সব। মাটির আরেকটা শরীর মাটিতে মিশে গেল। মাটি মানুষ গিলে খেতে এত পছন্দ করে? এ কেমন পৃথিবী? এত অবিচার কেনো এখানে? মেয়েটা বাবাকে শেষবার দেখতে বেড়িয়েছিল। এখন দেখো ভাগ্য কেমন! পাশাপাশি বাবা-মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মিতালি এবার সারাজীবন হয়ত বাবার কাছে নালিশ করবে, বলবে দুনিয়ার মানুষ রুপী শকুন গুলো আমাকে বাঁচতে দেই নি বাবা। তোমাকে শেষ বার দেখতে দেয় নি। বিদায় দেওয়ার সুযোগও দেয় নি। অথচ তারা বাঁচবে, বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াবে। কারন তাদের টাকা আছে। টাকার কাছে তো মোমের পুতুলও হা করে। ওরা টাকা দিয়ে এই দুনিয়াটা কিনে নিলো বাবা আর আমরা অভাবের কাছে পিষে মরলাম।

মিতালির মা, ভাই-বোনদের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। একটি সংসারের দু’টি মূল স্তম্ভ স্বামী আর কন্যাদুজনেই হারিয়ে গেছে। যার হারায় সে বুঝে হারানোর যন্ত্রণা কতখানি ভয়ানক। এই নারী সব হারিয়েছে। বাড়িটাও নদীর একেবারে গা ঘেঁষে। বুক চিরে ধেয়ে আসা নদীর স্রোত প্রতিনিয়ত গ্রাস করে নিচ্ছে তার জীবনের সমস্ত আশ্রয়। নদী ভাঙ্গনে সব যাচ্ছে। যে কোনো সময় এই ভাঙ্গা বাড়িটিও চলে যাবে। বাড়ির সঙ্গে কবর। নদী নিঃসীম নিষ্ঠুরতায় লালায়িত। মৃত্যুর পরেও নিস্তার নেই এই ভূমিতে। নদী এতই নিষ্ঠুর যে কোনো মুহুর্তে কবরটাও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। চিত্রা মিতালির মাকে এলাহী বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেছিল।সেখানে গেলে সন্তানগুলোকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করতে পারবেম। তবে মহিলা রাজি হন নি। মরলে স্বামীর কাছেই মরবে। মেয়ের পাশেই মরবে। মৃত্যুর শেষ অব্দি এখানেই রয়ে যাবে।

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৪

এই জীবন নিয়ে এখন আর তার কোনো আশা ভরসা নেই। জীবন নামের অধ্যায়ের পাতাগুলো তার একে একে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘন্টা খানেক কবরের খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল চিত্রা। দূর থেকে কবরের দিকে চেয়ে কি ভাবছিল সে? সারে তিনহাত মাটির ঘরের কথা? নাকি পৃথিবীর ন্যায় বিচারের মৃত্যু ঘটে যাওয়ার আক্ষেপ জমেছে তার বুকে? ফারাজও তার সঙ্গে ভিজে। ভিজে অভ্র, ভিজে আয়েশা। ফারাজ চিত্রার কাঁধে হাত দেখে আশ্রয় হয়। চিত্রা হাওয়ায় মোড়ানো দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “আপনি দেখে নিয়েন পৃথিবীতে আবারও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই দিন দেখার জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে হবে ফারাজ। খুনীদের শাস্তি হবেই। আপনি দেখে নিয়েন।”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৫