চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৫

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৫
ইশরাত জাহান জেরিন

আজকের বিকেলটা কেমন যেন মন মরা। তিন তলার করিডরের সামনে দাঁড়ালে শেষ মাথায় তালাবদ্ধ একটা ঘর দেখতে পাওয়া যায়। ফারাজ ব্যতিত সেখানে কারো যাওয়ার অনুমতি নেই। পিয়াস জানে সেখানে কি আছে। হ্যাঁ খুব ভালো করেই জানে। সেখানে ধুলোপড়া স্তুপের নিচে ফারাজ এলাহীর দাফন করা অতীত আজও তিলে তিলে মরছে। তার সেইঘরে মরছে,জীবিত হচ্ছে আবার মরছে। খেলার বয়সে সেও তো খেলতেই চেয়েছিল তবে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বন্দুক। খেলতে চেয়েছিল খেলনা গাড়ি দিয়ে তবে খেলতে শেখানো হয়েছে মানুষের জীবনকে নিয়ে। যেই দুনিয়ায় ফারাজ এলাহীর পাপের কথা বর্ননা করা হয়েছে সেই দুনিয়ায় ফারাজের একটা হৃদয়বিদারক অতীতও ছিল। মানুষ সেই অতীত ছুঁয়ে দেখে নি,জানতে চায় নি শুধুই পাপের বর্ননা শুনে ঘৃণা করেছে তাকে। ভয় পেয়েছে, দূরে থেকেছে। পিয়াসের মাঝে মাঝে মন চায় ঘৃণা করতে,ফারাজকে তীব্র ঘৃণা করতে। তবে বার বার অতীতের দৃশ্য গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে। কানে আজও হোঁচট খায় এগারো বছরের নিষ্পাপ ফারাজ এলাহীর আর্তনাদ। সেই আর্তনাদের কারনেই আজও পিয়াস ফারাজকে ঘৃণা করতে পারে নি। বরঞ্চ মায়া হয়,ত্রিশ বছরের এই পাপিষ্ঠ পুরুষকে দেখতে আজও চোখের সামনে ভেসে উঠে এগারো বছরের সেই ছোট্ট নিষ্পাপ চোখ। যার চোখ গুলো কালো বাদামীর মিশ্রনে গড়া।

পিয়াস ডিভানে এসে বসে। বিছানাশ নিশি গভীর ঘুমে ডুবে আছে একটুও নড়ছে না। সে শিশুর মতো শান্ত। নিষ্পাপ মুখখানা দেখে বুকের ভিতর একরাশ অস্থিরতা জন্ম নেয় পিয়াসের। বয়সটাও তো খুব বেশি না মেয়েটার। অথচ এই অল্প বয়সেই জীবনের নির্মমতায় কতটা ভেঙে গেছে সে। পিয়াসের এক বন্ধু এখন খুলনা থানার অফিসার। সেখান থেকেই মেয়েটির পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছে সে। ইচ্ছে করলে সেদিন রাতেই নিশিকে ফেলে আসতে পারত নিকলীতে। একরকম গা বাঁচানোর মতো করে। কিন্তু নিশির মুখে তার জীবনের ভাঙাগড়ার কাহিনি শুনে সে আর পারল না। কালেমা পড়ে, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী যে সম্পর্ক সে মেনে নিয়েছে সেই সম্পর্ক থেকে পিছু হটার কথা ভাবলেও শিউরে ওঠে সে। হাশরের ময়দানে খোদার সামনে দাঁড়িয়ে এই মেয়েটিকে অস্বীকার করার সাহস তার নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পিয়াস জানে নিশির অতীত,অভিজ্ঞতা এত সহজে মুছে যাবে না। তাদের ভালোবাসা গড়ে উঠতেও সময় লাগবে। কিন্তু সে হাল ছাড়বে না। একবার যেহেতু এই মেয়েটি তার জীবনে বউ হয়ে এসেছে তাই সে স্বামী হিসেবে তার দায়িত্ব থেকে পিছপা হবে না। নিশিকে ভালোবাসতে শিখাবে, হাসাতে শিখাবে, এমনকি জীবনের প্রতি নতুন করে ভরসা করতে শিখাবে। তবে এখনই তাকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ওখানকার পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত। সেখানে গেলে হয়তো নিশির ভেতরে চাপা পড়ে থাকা যন্ত্রণা আবার জেগে উঠবে নতুন করে তাকে দগ্ধ করবে।

চিত্রার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়েছে। এসেই গোসল করেছে। কারো সঙ্গে কথা বলছে না। খাচ্ছে না। ফারাজ এসে খাইয়ে দেয়। এলোমেলো চুল গুলো আঁচড়ে বেনী বেঁধে দেয়। কারো সঙ্গেই কথা বলছে না। আয়েশার অবস্থাও ভালো না। এত কাঁদলে কোন মানুষটি ঠিক থাকে? ফারাজের বাহিরে যেতেই হবে। রাতে ফিরবে না। ফিরলেও ভোর হবে। জমেলাকে চিত্রার পাশে সারারাত থাকার কথা বলেছে। জমেলা আয়েশাকে নিয়ে রাতে চিত্রার কাছে থাকবে বলেই ঠিক করে। ফারাজ বাড়ি এসে গোসল করেই অভ্রকে নিয়ে তারাহুরোয় বেড়িয়ে পরে। যাওয়ার আগে মোহনাকে পই পই করে জানিয়ে দেয়,এসে যেন কলিজা ভুনা রান্না করা পায়। মোহনার বুঝতে বাকি রয় না আজকেও ফারাজ হাত রাঙিয়ে বাড়ি ফিরবে। তবে মনে মনে কি ভেবে খুশীও হয়। আজকে আবারও দুনিয়া থেকে পাপ কমবে। কারন ফারাজ আজ অব্দি নিদোর্ষ কাউকে খুন করেই নি। কখনও করবেও না। সেই ভরসা আছে। ভেতর থেকে মন সেই ভরসার যোগান দেয়। কিন্তু তবুও মানুষ মারা কি ভালো কাজ? পাপ তো পাপই হয়। ছোট হোক কিংবা বড়।

ভোরে বাড়ি ফিরতেই দরজা খুলে দেয় জান্নাত। মাহাদী কখনও তার দিকে ভালো করে তাকায়নি। আজ তাড়াহুড়োর মাঝে জান্নাতের মাথার ঘোমটা পড়ে যায়। চোখ মুহূর্তের জন্য আটকে যায় জান্নাতের মুখে। তবে পরক্ষণেই সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ঘরের ভেতরে সেই কখন থেকে মারিয়া অপেক্ষায় ছিল। অপেক্ষা করতে করতে শরীরটা যেন আরও ঝিমিয়ে পড়ে। ভেতরে কোথাও এক অজানা অস্তিত্বের সাড়া টের পায় সে। ইদানীং কী হচ্ছে তার শরীরে, নিজেও বোঝে না। বমি পায়, খেতে ইচ্ছে করে না। সোহাগ বলেছিল, একবার চেক-আপ করিয়ে নিতে। কিন্তু সেই ভয়েই হাসপাতাল মুখো হয়নি মারিয়া। ওই ছেলেটা আর কতটুকুই বা রোজগার করে? নিজের সংসার সামলাতেই যেখানে হিমশিম। অন্যের খরচের বোঝা কে বইবে?

মাহাদী রুমে গিয়ে দেখে মারিয়া আধোঘুমে। পাশে বসে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সে। ক’দিন আগের মারিয়া আর আজকের এই ক্লান্ত মুখ এক নয় ভিন্ন । তখনও তো চিত্রার সঙ্গে কতটা রুক্ষ ব্যবহার করত সে। অথচ আজ বুঝতে পারছে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে না পড়লে বোঝা যায় না, ছোট্ট চিত্রা কতটা কষ্ট চেপে আগলে রেখেছিল এই ঘর। মারিয়া বদলে গেছে। এটাই সত্য। হয়তো সময়ই বদলে দিয়েছে তাকে। খারাপ অতীতের ভার টেনে লাভ নেই।
ভোরেই মাহাদী বাজার থেকে তাজা গরুর মাংস কিনে এনেছে। শেষবার গরুর মাংস খাওয়া হয়েছিল সোহাগের বিয়ের অনুষ্ঠানে। কিন্তু ওর তেমন আয় তো নেই তবে এত খরচের টাকা এলো কোথা থেকে? ভাই হিসেবে মাহাদীর তো প্রশ্ন করা উচিত ছিল, নতুন বউ নিয়ে সংসার গড়ছে যখন। কিন্তু সময়ই তো হয়ে উঠল না। এখন তো আরো সময় নেই। আসলে অভাব খুব খারাপ জিনিস,হোক না সময়ের কিংবা টাকার। তবুও একদিন একাকী বসতে হবে সোহাগের সঙ্গে।

মাহাদীর ঘুমের প্রয়োজন। সে শার্ট খুলে সেন্ডো গেঞ্জি পরে নেয়। প্যান্ট বদলে পরে লুঙ্গি। হাত মুখ দিয়ে মারিয়ার পাশে শুয়ে পরে। ঘুমের প্রয়োজন তার। রাতে আবারও শিকারের তল্লাশে বেরোতে হবে। মাহাদী কপালের ওপর হাত রেখে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়। হুট করে কর্ণে মারিয়া নীরব স্বর ভেসে আসে,
“এই বাড়ি ফিরার সময় হইল।”
“ঘুম ভাঙ্গল কখন।”
“পাশে বসছিলা যখন।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম।”
“জান্নাত আর সোহাগের সম্পর্ক ঠিকঠাক আছে নাকি?”
মারিয়া এবার মাহাদীর দিকে পাশ ফিরে শোয়।কৌতুহলী কন্ঠে বলে,” কি জানি মনে তো হয়। ওদের দুইটার মধ্যে মোহাব্বত নাই। আমিও তো ভালোবাসছি। চোখ দেইখাই মানুষ চিনবার পারি। সোহাগের চোখে কেন জানি মনে হয় আজও চিত্রার জন্য একটা টান আছে। এতই যেহেতু টান ছিল তাহলে চিত্রারে ফালাইয়া হাওয়া হইছিল কেন?”
“তার মানে জান্নাত আর সোহাগের মধ্যে ঝামেলা চলতাছে।” মাহাদী দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে। মাথায় তার আবারও কুবুদ্ধি আঁটছে। এবার তবে শিকার কে হবে? বাড়ির মানুষ?

সেই রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরে ফারাজ। টেবিলে পড়ে থাকা কলিজা ভুনা ছুঁয়েও দেখেনি। এমন তো কখনও হয়নি। । ভোরে এসে নিজের রুমেও যায়নি সে। নিজের রুমে না গিয়ে স্টাডি রুমের সোফায় রাত কাটিয়েছে। চোখে ক্লান্তির ছাপ, তবু ঘুম আসেনি এক মুহূর্তের জন্য। মনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে।এখানে থেকে যাবে, নাকি ডেনমার্ক ফিরে যাওয়া উত্তম? যদি থেকে যায়, তবে একদিন না একদিন এই বাড়ির কেউ না কেউ চিত্রার সামনে তুলে ধরবে তার সব গোপন সত্য। অন্যদিকে ডেনমার্কে ফিরে গেলে হয়তো আবার গুছিয়ে নেওয়া যাবে একটুকরো শান্তির সংসার। মাথা কিছুই ভাবতে পারছে না। চিত্রা যদি এখানেই থাকে, তাহলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে জানতে পারবে এই বাড়ির অন্ধকার মুখ,পাপ আর নিষ্ঠুরতার চেহারা। তাদের আসল রুপ বাহিরে চলে আসলে কি তারা চিত্রাকে ছেড়ে দিবে? ফারাজ এও জানে সে নিজের পাপ কখনও লুকাতে পারবে না। তবে দুনিয়া তোলপাড় হোক সে চিত্রাকে না জানতে দিবে কখনও তার অতীত না পাপের ছোঁয়া স্পর্শ করতে গায়ে।

সারা রাত ফুর্তি করেছে রোশান আর বাকিরা। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে সকালের দিকে বাড়ি ফেরে বাড়ির সব পুরুষেরা। রোশান রুমে ঢুকতেই চোখ আটকে যায় মোহনার দিকে। সে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে আছে। কাকে আকৃষ্ট করার জন্য এই সাজ? রোশান কি তা বোঝে না? সিগারেট জ্বালিয়ে টানা কয়েকটা টান দেয় সে। ঘরের ভেতর ধোঁয়া ভরিয়ে তোলে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মোহনার দিকে। কপালে চিন্তার রেখা। তারপর আচমকা ঘুমিয়ে থাকা মোহনার বাহুতে চেপে ধরে জ্বলন্ত সিগারেট। এক লাফে ব্যথায় উঠে বসে মোহনা। আর্তনাদ করতে যাবে ঠিক তখনই রোশান তার মুখ চেপে ধরে।
” শুন নডি তোরে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসছিলাম। সেই ভালোবাসার খাতিরেই আজও এই বাড়িতে পইড়া জায়গা পাইতাছোস। না হইলে কবেই সওদা করতাম তোরে। নিলামে তুলতাম। আজকে আমার জীবনটা নষ্ট করার জন্য তুই দায়ী। শুধুই তুই।”
সিগারেটটা আরও জোরে চেপে ধরে রোশান। গলা কাঁপছে তার। চোখের কোণে জল। পাষাণের চোখেও কি জল জমে?

“কেন মোহনা তুই আমারে ভালোবাসলি না? কেন? এই রোশান এলাহী তো তোর জন্য নিজের কলিজা বাহির করতেও প্রস্তুত ছিল। তাও এমন প্রতারণা কেন করলি? তুই আমার ছোট ভাইরে ভালোবাসতে পারলি,পাপীরে হৃদয়ে জায়গা দিতে পারলি অথচ আমারে পারলি না কেন? আমি তো পাপী ছিলাম নারে মোহনা? তুই পাপীরে ভালোবাইসা আমারে কেন বরবাদ করছোত? আমারে কেন পাপের দুয়ারে ঠেইলা দিছোত?”
মোহনার চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। রোশান সিগারেটটা ফেলে দেয়। মলম এনে হাতে লাগায়। তারপর সেই ক্ষতস্থানে একের পর এক চুমু খায়। ভাঙা কণ্ঠে বলে, “আমারে একটু ভালোবাস মোহনা। আমি তোর থেকে মন চাই,ভালোবাসা চাই।”
মোহনা ছলছল চোখে চেয়ে থাকে। কোনো জবাব নেই তার। রোশান তার পাশে শুয়ে পড়ে। শিশুর মতো আহত হাতটা নিজের বুকের কাছে আগলে রাখে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে কত কী ভাবে!যেই নারীর কাছে এখনও সে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইছে, পরজনমে যাকে আবারও চাইছে সে হয়তো মনে মনে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে মিনতি করে বলছে,

❝পরজনমে সখা
তোমার সঙ্গে যেন মোর
আর না হয় দেখা।❞
রোশান তবু বুকে আগলে রাখে তার ক্ষত।যে ক্ষত সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। মোহনা মেঝেতে ফেলা সিগারেটটার দিকে চেয়ে মনে মনে আওড়ায়,”আমাকে একটুখানি ঘৃণা করতে পারেন না এলাহী? একটুখানি ঘৃণা করলে হয়ত আপনিও আজকে সুখী হতে পারতেন। কিন্তু আপনি বড্ড হিংসুটে। আমি আগুনে ডুব দিয়েছি বলে সহ্য হয় নি আপনার,আমার পেছন পেছন ঝাপ দিয়েছেন আপনি। এত হিংসুটে মানুষ হয়?”

পরপর দু’দিন কেটে যায়। চিত্রা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। হয়তো পারত না, যদি ফারাজ এত যত্ন করে তাকে আগলে না রাখত। এই লোকটা সত্যিই পারে। চিত্রা বাগানে সময় কাটাচ্ছে। আয়েশা তার আশপাশে ঘুরছে।
“কিরে, কিছু বলবি?” চিত্রা চোখ সরু করে তাকায়।
“মা…নে…” আয়েশা নিচু গলায় বলে।
“বলে ফেল আয়েশা। কাল নাও বাঁচতে পারি। যা বলার এখনই বল!” চিত্রা মাথা একপাশে হেলিয়ে ঠোঁট কষে হাসে।
“ছোটলোকি কথা বলো না, আপা!” আয়েশা চোখ বড় করে কপালে ভাঁজ ফেলে প্রতিবাদ করে।
“আসছে আমার ফারাজ ভাইয়ের চেলা!” চিত্রা মুখ বাঁকিয়ে বলে।
আয়েশা মুখ ভেংচি কাটে। তারপর গা এলিয়ে পাশে বসে পড়ে। ঠিক তখনই মোহনার দিকে তাদের নজর যায়। সে ফুলির কাছ থেকে ফিরছে। চিত্রার চোখ পড়ে তার দিকে।

“ভাবী, এদিকে আসেন!” চিত্রা খানিক চিৎকার করে ডাকে।ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট করে তাকায়।
মোহনা একটু থমকে দাঁড়ায়। তারপর পায়ে পায়ে সামনে আসে। ঠিক সেই মুহূর্তে উত্তরের হাওয়ায় তার আঁচল সরে যায়। চিত্রার দৃষ্টি আটকে যায় তার হাতে থাকা দাগগুলোর ওপর। চোখ কপালে তুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। মোহনা আঁচল টেনে মুখ নিচু করে তাড়াতাড়ি বলে,
“আমার কাজ আছে, আসি আমি।” গলায় কাঁপন।
চিত্রা কিছু বলার আগেই সে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। “আমি যা দেখেছি, তুইও দেখেছিস?” চিত্রা ধীরে ধীরে বলে।
“জ্বে আপা।” আয়েশা মাথা হেঁট করে জবাব দেয়।
“দাগগুলো কিসের হতে পারে?” চিত্রার কণ্ঠ এবার কষাঘাতের মতো দগদগ করছে।
“সিগারেটের।” আয়েশা গলায় কম্পন নিয়ে মাথা নাড়ে।
“চল, বাড়ির ভেতর চল।”

দু’জনেই তাড়াতাড়ি উঠে যায়। চিত্রা যখন সদর দরজার দিকে পা রাখে তখন আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। জোহান দৌড়ে আসে ধরতে কিন্তু তার আগেই কেউ একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। চিত্রা পড়ে যাওয়ার আগেই জড়িয়ে ধরে ফেলে তাকে। ভয়ে চোখ বুঁজে ফেলে চিত্রা। তখনই পরিচিত কন্ঠ ও গায়ের গন্ধ তাকে আশ্বাস দেয়। সে চোখ মেলে তাকায়। নিজের স্বামীকে দেখতে পায়।
“তুমি ঠিক আছো?” ফারাজ নিঃশব্দ গলায় জিজ্ঞেস করে। কপালে ভাঁজ।
“জ্বী।” চিত্রা একটু হেসে মাথা নাড়ে।
জোহান থমকে যায়।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ঠোঁট কামড়ে বলে,
“আমি তো ধরতেই যাচ্ছিলাম ভাই।”
ফারাজ চোখে চোখ রাখে। গম্ভীর গলায় বলে, “প্রয়োজন নেই। আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন আমার বউকে আমিই বাঁচাবো। আমার বউ মরেও গেলে বাঁচাতে আসবি না।”
জোহান চোখ কুঁচকে ফারাজের দিকে তাকায়। মুঠি শক্ত করে বলে মনে মনে সুধায়,
“তাহলে আগে তোমাকে মারতে হবে দেখছি।”

বাড়ির বাইরে হেঁটে চলেছে ফারাজ আর চিত্রা। রাতের আকাশ মেঘে ঢাকা। চারপাশে অন্ধকার। রাস্তার বাতিগুলোর ক্ষীণ আলোয় তাদের ছায়া কাঁপছে। চিত্রার পায়ের নুপুর থেকে ঝনঝন শব্দ উঠছে প্রতিটি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে। ফারাজ হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করে,
“কোথাও লাগেনি তো?”
চিত্রা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে, “আপনি লাগতে দিলে তো!”
“লাগতে দিবো কেন? তোমার গায়ে টোকা লাগলে আঘাত দিয়ে সরাসরি আমার বুকে সজোরে ধাক্কা দেয়।”
চিত্রা চোখ কুঁচকে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
“এই দারাজ এলাচী!”
ফারাজ গলা ভারী করে বলে, “হোপ ডাব্বাওয়ালী আবুলের নাতনী তোর ভবিষ্যৎ গেডার আব্বা লাগি। মুখে লাগাম টান।”
চিত্রা হেসে ফেলে। “না টানলে?”

“তোমায় কাছে টেনে সোজা রুমে গিয়ে দরজা দিবো। ” ফারাজ থামে। পুনরায় বলে, “কাল কলেজে যাবে প্রস্তুতি নিয়েছো তো?” ফারাজের স্বর একটু গম্ভীর হয়।
চিত্রা নাক সিঁটকে বলে, “পায়ে পড়ে বলি আমাকে মেরে ফেলুন তাও কলেজ পাঠাবেন না!”
“এত ভয় পাও কেন? কোন সাবজেক্টের আগুন আমার আগুন সুন্দরীর আগুন নিভিয়ে দিচ্ছে?”
চিত্রা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে, “হিসাববিজ্ঞান। ওই সাবজেক্টের নাম শুনলেই লিভারে টান পড়ে!”
ফারাজ মাথা নাড়িয়ে বলে, “চিন্তার কিছু নেই, বজ্র তো আছেই। ওকে দেখিয়ে ঔষধ আনিয়ে দেব।”
“ধূর! আপনি বুঝছেন না আমার কষ্টটা!”
“দেখো, আবুলগিরি বাদ দাও। পড়ালেখা ঠিক করে না করলে আমি ফারাজ তোমাকে রাতের বেলা সূর্য দেখাবো!”
চিত্রা চোখ গোল করে বলে, “আমি সিনেমায় দেখেছি নায়িকা পড়তে বসলে নায়ক বই-খাতা কেড়ে নিয়ে তাকে আদর করে। কিন্তু আপনি ভালোবাসার বদলে পড়ালেখা দিতে করতে বলেন খালি!”
ফারাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়াটাকে আমি ঘৃণা করি। তুমি ডাব্বা মার্কা হলে আমার বাচ্চাগুলোও ওই পদেরই হবে। জেসা মা, ওয়াইসি ওয়ালাদ!”
চিত্রা মুখ ভেংচে মাথা সরিয়ে নেয়। হঠাৎ একটা মৃদু আলোয় চোখ পড়ে প্রতিবেশীর পেয়ারা গাছে। একটিমাত্র পেয়ারা নিচের ডালে প্রায় লটকে আছে।

“এই, ওদিকে চলুন তো!” চিত্রার চোখ চকচক করছে।
“কেন? হঠাৎ ওদিকে কেন?” ফারাজ কপাল কুঁচকে।
“আগে আসুন তো!”
চিত্রা টেনে ফারাজকে নিয়ে যায় গাছটার সামনে। “আমাকে গাছে উঠতে সাহায্য করুন।”
ফারাজ চমকে উঠে বলে, “কি!!!!!”
“হ্যাঁ, করুন না!” চিত্রা কন্ঠে অনুনয় ঝরে।
“কিন্তু কেন?”
“ভালো করে দেখুন এই গাছে পেয়ারা আছে!”
“তাতে?”
“আপনার মাথা! বুঝেন না কিছু। ওই পেয়ারা আমার চাই।”
“চুরি করবে?!”
“না না, গাছ ভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেব!”
“বউ, তুমি কি নেশা করেছো?”
“হ্যাঁ, আপনার চোখে তাকিয়ে আমার নেশা হয়ে গেছে! এখন ঢং না করে সাহায্য করুন!”
“আমাদের বাড়িতেই তো পেয়ারা আছে। পেয়ারা গাছও আছে। অন্যেরটা চুরি করতে হবে কেন?”
“চোরাই জিনিসে আলাদা স্বাদ!”

ফারাজ কপাল চাপড়ে বলে, “আমি পারবো না সাহায্য করতে। ছোটোলোকি কারবার পছন্দ করি না।”
চিত্রা মুখ গম্ভীর করে বলে, “ছোটোলোক গিরিতে সাহায্য না করলে কিন্তু রাতে গিয়ে ফারুর সঙ্গে ঘুমাবো!”
ফারাজ চোখ ছোট করে বলে, “বেডি ব্ল্যাকমেইল করো! বলো, কী করতে হবে?”
“আমাকে প্রথম ডালটায় উঠতে সাহায্য করুন। পেছন থেকে ঠেলুন। আস্তে কথা বলবেন। তা না হলে ধরা খেয়ে যাব!”
“তোমার নুপুরের ঝনঝন শব্দ হচ্ছে বউ। নিশ্চিত ধরা খাবো!”
“এতটাও জোরে হচ্ছে না। ঠেলুন উপরে, জলদি!”
ফারাজ একটু এগিয়ে আসে। তখনই চিত্রা নড়ে উঠতেই নুপুরের ঝনঝন শব্দ বেড়ে যায়।
ফারাজ থেমে গিয়ে বলে, “নুপুরটা খুলে করি বিবিজান? বেশি শব্দ হচ্ছে।”
সে চিত্রার পায়ের দিকে হাত বাড়াতেই… একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ বাতাস চিরে ভেসে আসে বৃদ্ধর কন্ঠ,
“কেডারে! নুপুর খুইলা কী করবি রে? খাড়া আইতাছি! হালার নষ্টামি করার জায়গায় পাও না। খাড়া কইলাম খাড়া।”
চিত্রা ফারাজের হাত শক্ত করে ধরে।চোখ বড় করে বলে, “সর্বনাশ দারাজ এলাচী বাঁচতে হলে জলদি পালান!”

রাত গাঢ় হয়ে এসেছে। সোহানের আড্ডাখানায় আজ বিশাল খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেছে রাজন। সব আয়োজন তার পক্ষ থেকে। কারণ সে যা চেয়েছিল তাই হয়েছে। চারপাশে মেয়েদের ঘিরে নাচানাচি করছে সে। কিন্তু সেই দৃশ্য অস্বস্তিকর।কুৎসিতভাবে বিকৃত। বাইরে থেকে কল কেটে সোহান ভেতরে এসে বসে। তার গা থেকে ঘন আতরের গন্ধ ছড়াচ্ছে। রাজন চোখ মেলে বলে,
“আরে ভাই, কেমন ব্যাটা মানুষ তুমি? এত সুন্দর মাইয়া সামনে অথচ চোখে কোনো আগ্রহই নাই!”
সোহান ঠাণ্ডা গলায় জবাব দেয়, “এসব বৈশ্যাগো জন্যে মন কামরায় না। মন কামরাইবো সেই একজনের জন্য। যারে মরণ ছাড়া মন থিকা কেউ মুছতে পারবো না।”
রাজন হেসে ওঠে, “বাবারে, আধুনিক যুগের মজনু দেখি!”
সোহান গম্ভীর হয়,”একটা খবর আছে।”

“কি খবর?”
“দুই দিন ধরে আকরাম আর ডা. ফারুক নিখোঁজ। কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। খেয়াল আছে?”
রাজন গা-ছাড়া ভঙ্গিতে বলে, “আছে তো। কোথাও হয়তো ফুর্তি করতেছে আমাগো মতোই।”
“রসিকতা না করলেই নয় কি?ব্যাপারটা মোটেও হালকা না।”
রাজনের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। কিছু বলবে, এমন সময় আকবর হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলে, “ভাই, আপনার নামে একটা পার্সেল আইছে।”
পার্সেলের কথা শুনেই সোহানের শরীর কেঁপে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেই ঘটনার কথা। যেদিন হঠাৎ একদিন একটা পার্সেল এসেছিল তার ঠিকানায়।তাজা কলিজা ভুনা ছিল তাতে। আজও জানে না কে পাঠিয়েছিল সেই সব। সেই স্মৃতি মনে পড়তেই চোখ লাল হয়ে ওঠে তার। রাজন তখনও ফুর্তিতে মোজে আছে। কাবাব মাখানো নানরুটি মুখে পুরে বলে,

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৪ (২)

“এই দ্যাখ! কার এত ভালোবাসা টসটস করতাছে আমারে জন্য?কত বড় পার্সেল পাঠাইছে!”
সে গুনগুন করতে করতে পার্সেলের দড়ি খোলে। ভেতরে একটা বড় বাক্স। ঢাকনা খুলতেই সবাই হঠাৎ থমকে যায়। বাক্সের ভেতরে রয়েছে দুটো পচা, বিকৃত, মানুষের কাটা মাথা। রাজনের হাত থেকে বাক্সটা ছিটকে পড়ে যায়। ঘরে ছড়িয়ে পড়ে পচা মাংসের দুর্গন্ধ। সোহান তৎক্ষণাৎ নাকে হাত চেপে ধরে। রাজনের গলা শুকিয়ে আসে। সে ঢোক গিলে বলে ওঠে,”মাথা…! আকরাম আর ফারুক…রে কেডা মারল?”

চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৬