দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশান ও নিশীথের মনে হলো এর চেয়ে রোমাঞ্চকর কাহিনি ওরা আর কখনো শুনেনি। ছোটবেলা থেকেই দাদুর কাছে হরেকরকম কাহিনি শুনে বড় হয়েছে ওরা দুই ভাই। কিন্তু তার একটাও আজকের এ কাহিনির ধারেকাছেও নেই। অবশ্য এর কারণ আছে, এর আগে ওরা যা শুনেছিলো তা সবই ছিলো অবাস্তব আর এবার যা শুনছে তা পুরোটাই বাস্তব জীবনে ঘটা। তাও এমন এক ব্যক্তির জীবনে ঘটা, যার সাথে ওদের পুরো অস্তিত্ব জুড়ে আছে! ওরা অধীর আগ্রহে পুনরায় গল্পে মনোযোগ দিলো।
ইউনুস সাহেব বললেন,
—আয়মান ভেঙে পড়ে বললো “আব্বা, আমি একজনকে ভালোবাসি। আমি ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবোনা!”
ছেলের কথা শুনে আমার মাথায় তখন সত্যিই আকাশ ভেঙে পড়লো! বারবার মাথায় এলো, এত এত মানুষ বাসায়, এত মেহমান এসেছে আর যার জন্য এত আয়োজন সেই কিনা বিয়ে করতে অস্বীকার করছে? আজ যদি আয়মান বিয়ে না করে আমার মান-সম্মানের কি হবে? এত বছর ধরে তিল তিল করে কামানো ইজ্জত আমার মাটিতে মিশে যাবে! রাগে-দুঃখে আমি থরথর করে কাপতে লাগলাম। ২৫ বছরের জীবনে আয়মান প্রথম আমার হাতে চড় খেলো। ওকে কষে এক থাপ্পড় মেরে বললাম,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ফাইজলামি পেয়েছিস নাকি? বিয়ের কথা বলার আগে একশবার তোকে জিজ্ঞেস করেছি তোর পছন্দের কেউ আছে কিনা, তখন তো একটাবার তোর মুখে বুলি ফোটেনি! মেয়ে দেখতে গিয়েও হ্যাঁ, না কিছুই বলিসনি। মাথা নেড়ে বিয়েতে স্বীকৃতি দিয়েছিস। আর আজ যখন তোর জন্য এত আয়োজন করলাম পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে হুলস্থুল অবস্থা তখন কিনা তুই নির্লজ্জের মতো নিজের প্রেমের কথা বলতে এসেছিস?”
আয়মান কাদতে কাদতেই বললো,
“আমি সব স্বীকার করছি, আব্বা। সব দোষ মানছি। এর জন্য তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে মেনে নেবো। শুধু আমায় বিয়েটা করা থেকে বাচাও!”
আমি ধমক দিয়ে বললাম, “এখন আর বাচানোর উপায় নেই, আয়মান। সবকিছু প্রস্তুত। তোকে বিয়ে করতেই হবে!”
“আমি বিয়ে করলে ও মরে যাবে, আব্বা! ও কিছুতেই আমার বিয়ে মেনে নিতে পারবেনা! ও পাগল হয়ে যাবে!”
“কে পাগল হয়ে যাবে? তোর ওই প্রেমিকা? আরে চোখের সামনে দুইদিন না দেখলেই সব প্রেম জানলা দিয়ে পালাবে। তুই শুধু বিয়েটা কর একবার”
“বিয়ে করলে তো সারাজীবনই চোখের সামনে দেখবে। তখন কিভাবে ভুলবে, আব্বা? বরং সারাজীবনই আমরা দুইজন কষ্টের আগুনে পুড়তে থাকব একজন আরেকজনকে দেখে!”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“বিয়ে করলে সারাজীবন চোখের সামনে দেখবে মানে? এসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? মেয়েটা কে, আয়মান? কোথায় থাকে ও?”
এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে আয়মান বললো,
“ওর নাম সালমা। তুমি যেই বাসায় আমায় বিয়ে দিচ্ছো ওই বাসাতেই থাকে সে!”
ইউনুস সাহেব কথা শেষ করে থামলেন। এতক্ষণ পুরনো স্মৃতিচারণ করে তাকে বেশ উদ্ভ্রান্ত দেখালো। তিনি সামনে তাকিয়ে দেখলেন মাটিতে বসে থাকা দুই ভাইয়ের অবস্থাও একিরকম। তারাও পুরোপুরি স্তব্ধ! নিশীথ বেশ কয়েকবার কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলোনা। তখন পাশ থেকে নিশান মুখ খুলে বললো,
—এই সালমা কি আমাদের ব-বড়খালা?
ইউনুস সাহেব হতাশার সাথে মাথা নাড়লেন। নিশান ও নিশীথ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দাদুর দিকে তাকালো! কিছুক্ষণের জন্য রুমজুড়ে অদ্ভুত এক নিরবতা বিরাজ করলো। নাতিদের এহেন মূর্তির ন্যায় বসে থাকতে দেখে ইউনুস সাহেব বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একা একাই আবারও বললেন,
—স্তব্ধ হয়েছিস? আমার অবস্থাও সেদিন তোদের মতোই ছিলো। কি করবো, কি বুঝবো কিছুই মাথায় আসছিলোনা। কোনোমতে নিজেকে সামলে কৌতুহল বশে আয়মানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে তুই এ ব্যাপারে আগে বলিসনি কেন? তুই তো মেয়ে দেখতে গিয়েছিলি। যদি সালমা তোর প্রেমিকা হতো তুই ওর বাসা চিনতি না? তুই কি জানতিনা ওর বোনের বিয়ের কথা চলছে?
আয়মান বললো, “সালমার বাবাকে তো চেনোই তোমার বন্ধু হয়। উনি মেয়েদের ব্যাপারে কেমন কড়া এটাও নিশ্চয়ই জানতে? এসব কারণে সালমা ও আমার প্রেমের কথা কোনোদিন কাউকে জানাতে পারিনি পাছে ওর বাবা যাতে জেনে না যায় এ ভয়ে! এমনকি ওকে এগিয়ে দিতে সবসময় ওর বাসার গলির মুখেই ওকে রেখে এসেছি ওর বাসা অব্দি যাওয়ার সাহস কখনো তাই জানতাম না সেদিন যে বাসায় মেয়ে দেখতে যাচ্ছি ওটা ওদেরই বাসা! আর তোমার মনে হয় আমি আসমাকে ওইভাবে দেখেছি বা ওর সম্পর্কে কিছু শুনেছি? আমি রাগের বশে কোনোকিছু না বুঝেশুনেই তোমায় বিয়ের জন্য কথা দিয়ে ফেলেছি”
“তাহলে আজ কিভাবে জানলি? আর তোর যদি প্রেমিকা থেকেই থাকে তবে বিয়ের জন্য রাজিই বা কেন হয়েছিলি?”
আয়মান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “সালমা বেশ রাগি ও অভিমানী মেয়ে। ওর স্বভাব-চরিত্রও বলতে গেলে আমারই মতো। তুমি বিয়ের কথা তোলার আগে আমাদের তুমুল কথা-কাটাকাটি হয়েছিলো। সেই থেকে সপ্তাহখানেকের বেশি রাগ-অভিমান ও আমাদের সকল যোগাযোগ বন্ধ। আমি ভেবেছিলাম আমাদের সম্পর্ক শেষ। ও আর আমার সাথে কখনো যোগাযোগ করবেনা। তাই রাগে-অভিমানে তোমায় বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দেই। এতদিন আমাদের কোনোরুপ যোগাযোগ হয়নি। কাল হঠাৎ মাঝরাতে ও টেলিফোন করলো। কাদতে কাদতে বললো, “আয়মান তুমি বিয়ে করছো?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি কিভাবে জানলে?”
এরপর সালমা জানালো ও এতদিন নানিবাড়ি গিয়েছিলো। ওর পালিত বোন আসমার বিয়ে উপলক্ষেই বাসায় ফিরেছে আগের দিন। ছেলের সম্বন্ধে জানার পর ও বুঝে ওটা আমি। আমার বিয়ের কথা শুনে ও রাগ-অভিমান সব ভুলে এ মাঝরাতে আমায় ফোন দেয়। আমাকে ওর সাথে পালিয়ে যেতে বলে!”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে আয়মান থামলো। পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে আমি অবাক চোখে তাকাতেই ও মিনতি করে বললো, “আপনাকে না বলে পালিয়ে যাওয়ার সাহস আমার নেই, আব্বা। মা ছাড়া এত বছর আপনি একা আমাদের মানুষ করেছেন এখন কিভাবে আপনাকে রেখে পালিয়ে যাই বলুন? তাই আমি ওকে বলেছি আমি পালাবোনা। আমি আপনার সাথে কথা বলব, বলে এই বিয়ে ভাংবো।”
“তোদের এসবের কথা সালমার পরিবার জানে?”
আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম। আয়মান মাথা নেড়ে বললো, “না, ওর আব্বা যে রাগী। হয়তো আমাদের কথা জানলে ওকে রুমে বন্দি করে রাখবে। আর উনি তার পালিত মেয়ে আসমাকে নিয়ে বেশ সিরিয়াস। ওকে ভালো পরিবারে বিয়ে দেওয়ার আগে কিছুতেই সালমাকে বিয়ে দেবেন না!”
“ও যখন ওর বাবাকে বলার সাহস করেনি তখন তুমি কোন সাহসে আমাকে বলতে আসছো? ওর বাবার একার মান-সম্মান আছে, তোমার বাবার নেই?”
“আমি তা বলিনি, আব্বা। আমি শুধু বলছিলাম..”
“মেয়েটা ভীষণ চালাক। তুমি জানো ও কেন ওর বাবাকে বলেনি? যাতে তুমি এদিক থেকে বিয়ে ভেঙে দাও আর সব দোষ পড়ে আমাদের উপর। যে ছেলেপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। মেয়েপক্ষ নির্দোষ। এতে তোমাদের দুজনের স্বার্থ ঠিকি হাসিল হবে। কিন্তু তোমাদের এ স্বার্থপরতার বলি কে হবে জানো? ওই নিরপরাধ মেয়েটা, আসমা। যার কোনো দোষ নেই, কোনো অপরাধ নেই। বাবা-মা ছাড়া দুনিয়ায় বড় হয়েছে, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্বপ্ন বুনেছে মনে। ওই মেয়েটার মন ভাঙলে সে অভিশাপ নিয়ে তোমরা সুখে থাকতে পারবে?”
“নিজের ছেলের সুখের চেয়ে কি ওই অনাথ মেয়ের সুখ তোমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট, আব্বা?”
“কথাটা এখানে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ সেটার নয়, আয়মান। কথা এখানে ন্যায় ও অন্যায়ের। যদি তুমি বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেও বলতে আমি হয়তো রাজি হলেও হতাম কিন্তু বিয়ে ঠিক করে একদম বের হওয়ার আগ দিয়ে এসে যদি তুমি বিয়ে ভাঙতে বলো তাহলে আমি কেন দুনিয়ার কোনো পিতাই কোনোদিন রাজি হবেনা!”
ইউনুস সাহেব আবারো থামলেন। নিশীথ মলিন মুখে বললো,
—তারপর কি বাবা রাজি হয়ে গিয়েছিল, দাদু?
—তোদের বাপ কি এত সহজেই রাজি হয়?
—তাহলে? তুমি বাবাকে কিভাবে রাজি করালে?
নিশান প্রশ্ন করলো। ইউনুস সাহেব মৃদু হাসলেন। খাট থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
—আমি জানতাম আয়মান আমার প্রতি দূর্বল। পিতা ও স্বামী হিসেবে সে ১০০ তে ১০ হলেও ছেলে হিসেবে সে সদা ১০০ তে ১০০০। তাই আমিও তখন গতানুগতিক পিতার মতো আল্টিমেটাম দিলাম যাতে ওর সামনে বিয়েতে হ্যাঁ বলা ছাড়া আর কোনো উপায়ই না থাকে!
—মানে?
দুই ভাই একসাথে চিল্লিয়ে উঠলো। ইউনুস সাহেব থমথমে মুখে বললেন,
—এ কথাটা আমি কোনোদিন কাউকে বলিনি। আজ শুধুই তোদের দুই ভাইকে বলছি। সেদিন আয়মানকে যখন কোনোভাবেই রাজি করানো যাচ্ছিলোনা তখন আমি বাধ্য হয়ে বুকে ব্যাথার অভিনয় করি। আমায় ওই অবস্থায় দেখে আয়মান মুহুর্তে নরম হয়ে যায়। পাগলের মতো চিল্লিয়ে আমায় শান্ত করার চেষ্টা করে। আমি ওকে বলেছিলাম, “আজ যদি আমার কিছু হয় তবে এর জন্য সম্পূর্ণ তুই দায়ী থাকবি। এটা মাথায় রাখিস” এরপর তোদের বাপ আর কোনো কথা বলেনা। আমার কথা মেনে নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সেদিনের পর থেকে আমার ছেলেটা পুরোপুরি বদলে যায়। আমার হাস্যোজ্জ্বল আয়মান পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে যায়।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬ (৩)
কথা বলা শেষ করে ইউনুস সাহেব চশমার আড়ালে দুই হাতে চোখ মুছে পেছন ফিরেন যাতে তার নাতিরা তার চোখের অশ্রু দেখতে না পায়। অথচ তিনি পেছন ফিরতেই দেখলেন, তার দুই নাতির চোখ দিয়েই অশ্রু ঝড়ছে অনর্গল!