ছায়ার মুখোশ পর্ব ২

ছায়ার মুখোশ পর্ব ২
তাজরীন খন্দকার

কি বুঝাতে চাইলো? বিয়ে করে নতুন বউ এনেছে ছেলের আগের বউয়ের বাচ্চা পালার জন্য নাকি?ছেলের বউ ছেলের সাথে থাকবে এটা নিয়ে যদি শাশুড়ীর আপত্তি থাকে তাহলে অযথাই বিয়ে করানোর কি ছিলো? রাশেদের বোন ফাইজা তো ভালোই দেখাশোনা করছিলো ওদের। অজান্তেই এমন প্রশ্নগুলো আরিদার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো! তার শাশুড়ী মানুষটা কি খুব খারাপ নাকি? আগের বউ কীভাবে মারা গেলো? তার অত্যাচা…
ভাবনাটা শেষ করার আগেই তার সেই শাশুড়ী হাঁক ছাড়লো,
‘ বউ তোমার শ্বশুরকে দুইটা রুটি আর একবাটি ভাজি দিয়ে এসো।
আরিদা গ্যাসের আঁচটা একদম লো করে রুটি আর ভাজি নিয়ে রাশেদের পেছন দিয়ে তার শাশুড়ীর রুমের দিকে যেতে লাগলো, আড়চোখে খেয়াল করলো রাশেদ তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তার মার জন্য পারছেনা৷ আরিদা রুমে ঢুকতেই তার শ্বশুর খ্যাক খ্যাক করে কাশতে কাশতে বললো,

‘ নতুন বউ দেহি খাওন লইয়া আইছে, আইয়ো আইয়ো।
আরিদা আস্তে করে গিয়ে তার হাঁটাচলায় অক্ষম শ্বশুরের পাশে বসলো। রুম থেকে ঝাঁঝালো উদ্ভট গন্ধ আসছে, তার শ্বশুর যে রুমের মধ্যেই যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। আরিদা হাত ধুইয়ে সবকিছু রেখে বললো,
‘ আব্বা আপনে খান আমি চুলায় রুটি দিয়া আইছি, পুইড়া যাইবো।
কাশ গড়গড়ে স্বরে বললো,
‘ যাও পানিটানি সবই এইহানে আছে, আমি খাইতে পারুম, পরে সুযোগ কইরা আইয়া এগুলা নিয়া যাইয়ো।
আরিদা মাথা নেড়ে চলে আসলো। রুম থেকে বের হয়ে টেবিলে নজর দিয়ে দেখলো রাশেদ ততক্ষণে খাবার টেবিল থেকে উঠে গেছে। রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো তার শাশুড়ী হাতে পোড়া রুটি নিয়ে তার সামনে ধরে আছে, আরিদা ঘাবড়ে গিয়ে বললো আমি তো চুলার আঁচ অনেক কম দিয়েছিলাম!
আরিদার শাশুড়ীর গম্ভীর মুখটা মূহুর্তেই পাল্টে গেলো,হুহু করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন,
‘ আরে অইছে, রুটিই তো পুড়ছে কপাল এহনো পুড়ে নাই! ঘাবড়ানোর কিছু নাই।
আরিদা এমন অদ্ভুত হাসি দেখে জোর করেই হাসি আনার চেষ্টা করলো মুখে। কিন্তু তিনি কি বুঝালেন আরিদা একদমই বুঝেনি। তাই মুখটা হাসি দুঃখের মাঝামাঝি অবস্থানে আটকে রইলো। রুটির বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ইঙ্গিত দিলেন নাতো? আরিদা অবশিষ্ট দুইটা রুটি সেঁকার জন্য উল্টানিটা হাতে নিতেই আরিদার শাশুড়ী সেটা নিজের কাছে নিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমরার খাওন শেষ, তুমি গিয়া ফাইজার লগে বইসা খাইয়া লও। আমি এদিকে দেখতাছি।
এহেন ভালো ব্যবহারে আরিদা খুশিই হলো, আস্তে করে গিয়ে টেবিলে বসলো৷ফাইজার দিকে একবার তাকালো এরপর খেতে লাগলো। খাওয়ার মধ্যে দরজার আওয়াজ এলো,
‘ ফাইজা দরজা লাগাইয়া দিস, আমি চলে গেলাম।
বাচ্চা তিনটা দৌঁড়ে গিয়ে দরজায় বললো,
‘ আব্বু আসার সময় মজার খাওন আর খেলনা আইনেন।
ওইপাশের জবাব আরিদা শুনেনি। তবে বাবার সাথে বাচ্চাদের এই লেপ্টে থাকার ব্যপারটা তার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে! নেহাৎ ভালো মানুষ বটে! আরিদার লাজুক মৃদু হাসির মধ্যে ফাইজা বিরবির বলে উঠলো,
‘ এতদিনে ঢং!
আরিদার মুখটা মূহুর্তে মলিন হয়ে গেলো, ঢং কি আরিদাকে বললো? তাকে কি ফাইজা খেয়াল করছিলো? নাকি তার চোখে আটকানোর মতো কোনো অঙ্গভঙ্গি আরিদার মুখে ফুটে উঠেছিলো?যেটা তার ঢং মনে হয়েছে? নাকি তার ভাইকে বলেছে? তার ভাইকে কেন বলবে? মনে হয় তাকেই বলেছে।

সাহস করে জিজ্ঞাসা করলোনা, আবার হয়তো ভাবতে পারে বিয়ের পরদিনই জবাবদিহি করছে।
দ্বিতীয় বিয়ের পর মেয়েদেরকে মেনে নেওয়ার ব্যপারে কেউ শিখিয়ে দিতে হয়না, তাদের ধৈর্য্য থাকে কয়েকগুণ বেশি। তারা ভালোমতোই জানে কি থেকে কি করলে তাড়াতাড়ি বদনাম হয়ে যায়! এখানে শুধুমাত্র চুপ থাকাটাই সবচেয়ে বড় গুণ!আর এর চেয়ে বড় অবলম্বন হলো হাতের কাজ, যত বেশি সংসারে কাজ করবে ততই সবার মন জয় করতে পারবে! আরিদার ভেতরেও সবাইকে মনপুত করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
পরেরদিন খুব ভোর বেলা আরিদা উঠে নামাজ পড়ে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। মনটা বেশ ফুরফুরে, গতকাল সারাদিন বাচ্চাদের সাথে তার ভালো সময় কেটেছে, রাতে রাহাদকে দুইবার উঠে সে নিজে দুধ বানিয়ে খাইয়েছে। যদিও সকালের পর রাশেদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। হয়তো অনেক রাতে বাড়ি এসেছে ততক্ষণে ফাইজার সাথে এসে শুয়ে পড়েছিলো। তার শাশুড়ী বলেছে রাশেদ রাতে খায়না,তাই অপেক্ষা করার দরকার নেই। সত্য মিথ্যা জানেনা,হতে পারে দূরত্ব রাখতে বলেছে অথবা সত্যিই খায়না। তবে তারও এই হালাল সম্পর্কে হালকা লুকোচুরি, মনে মনে ব্যকুলতা বেশ লাগছে। চলুক এভাবে যতদিন চলার। তার জীবনে দুঃখ নামক কিছু নেই, এটাতে থাকতে থাকতে এতই বিরক্ত হয়ে হয়ে গেছে যে সে এখন সবকিছু উপভোগ করে।

আরিদার আনমনা চিন্তাভাবনার ভেতর হঠাৎই দেখলো নিচ থেকে কে যেন হাত দিয়ে বারান্দা ছুঁতে চাচ্ছে, বিল্ডিংয়ের ভিট যেহেতু অনেক উঁচু তাই নাগাল পাচ্ছেনা। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে সরে যেতে চাইলেও চারপাশে হালকা হালকা আলো ফুটেছে দেখে সাহস করলো এমন সময় চোর আসতে পারেনা। সে আস্তে করে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু বরাবর দাঁড়িয়ে থাকায় গ্রিল ভেদ করে দেখতে পেলোনা, আস্তে করে প্রশ্ন করলো,
‘ কে? কি চান?
গম্ভীর স্বরটাকে যত সম্ভব ক্ষীণ করে আওয়াজ এলো,
‘ তোমার অভাগা স্বামী আমি! এইটা ধরো। হাত বাড়াও?
আরিদা হাত বাড়াতেই তার হাতে একটা চারকোনা আকারের বক্স দিলো, সে নিয়েই খুলে দেখলো দুইটা স্বর্ণের চুরি, দারুণ ডিজাইন।
আবারও আরিদা উঁকি দিয়ে বললো,
‘ এইটা ক্যান?
রাশেদ জবাব দিলো,
‘ বাসর ঘরেই দেওয়ার কথা আছিলো, সেই কপাল তো হইলোনা তাই চুরের মতো দিতে আইলাম। এছাড়া আর উপায় দেখতাছিনা। এইটা পইরা নিও।
আরিদা ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগলো, যেন আওয়াজ না হয়! তারপর রসিকতার সহিত প্রশ্ন করলো,

‘ আম্মাকে বেশিই ভয় পান?
রাশেদ বলতেই যাচ্ছিলো কিছু একটা কিন্তু থেমে গেলো। কেননা তখনি ভেতর থেকে জোরে আওয়াজ কানে এলো,
‘ বউ আদা দিয়া রঙ চা করো তো। তোমার শ্বশুরে খাইবো, কাশটা বেশি বাইড়া গেছে।
সাথে সাথে ধপ ধপ করে আওয়াজ এলো, দ্রুততার সাথে রাশেদ এখান থেকে চলে যাচ্ছে বুঝা যাচ্ছে। আরিদা চুরির দিকে তাকিয়ে হাসছে। চুরিগুলো বেশি মোটা নয়, রেগুলার পরার জন্য মাঝামাঝি সাইজের যেসব চুরি মুসলিম বউরা পরে থাকে ঠিক তেমন। খেয়াল না করলে স্বর্ণ যে সেটাও বুঝা যায়না, আরিদাও বুঝতোনা যদি না জুয়েলার্সের নাম আর চুরির ভেতরে 916 লেখাটা না দেখতো! আরিদা হাতে পরে নিলো আর হাতেরগুলো খুলে বক্সে রেখে ফাইজার রুমে গিয়ে নিজের কাপড়চোপড়ের আড়ালে রেখে দিলো। ফাইজা নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ দেখেনি, আশা করা যায় এটা কেউ বুঝবেনা, যেহেতু তার স্বামী লুকিয়ে দিয়েছে তাই নিজ ইচ্ছেতে কাউকে বলার দরকার নেই।

তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চা বসালো। আর নাস্তার আয়োজন করতে লাগলো। এরই মধ্যে ঘর থেকে রাহাদের কান্নার আওয়াজ এলো। আরিদা দৌঁড়ে আবার রুমে এলো। রাহাদের কান্নায় ফাইজার ঘুম ভেঙে গেছে। ফাইজা কোলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, এর মধ্যে আরিদা গিয়ে বললো,
‘ দাও দাও আমারে দাও, তুমি আরেকটু ঘুমাও।
হাত বাড়াতেই ফাইজা হাতে ধরে ফেললো। আসামী ধরার মতো করে বললো,

ছায়ার মুখোশ পর্ব ১

‘ শিরিন ভাবির চুরি তুমি কোথায় পেলে?
আরিদা চমকে উঠলো, শিরিন ভাবি মানে? তার স্বামীর আগের বউ? চুড়িগুলো তাহলে নতুন নয়? তার আগের বউয়ের জিনিস এভাবে নয়ছয় দেখিয়ে দিয়েছে? কতোই না খুশি হয়েছিলো আরিদা

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৩