মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২
মুসতারিন মুসাররাত
-” আমিই বোধহয় প্রথম মেয়ে, যার বর অন ডিউটিরত অবস্থায় ইউনিফর্ম গায়েই ঠাসঠাস কবুল পড়ে নিল! আহা, এ যেন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের চেয়েও দুর্লভ এক মুহূর্ত!”
সময়টা রাত দশটার কাছাকাছি। পুরো রুমে এক ধরনের নীরবতা। নীলাশা খাটের এক কোণে বসে, ফোনের স্ক্রীনে চোখ গোঁজে চ্যাট করছিল। নীরবতা চিঁড়ে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বলে প্রত্যাশা। নীলা বি’রক্তির এক সূক্ষ্ম ছোঁয়ায় ফোন থেকে চোখ তুলে প্রত্যাশার দিকে এক ঝলক তাকাল। ঠেস দিয়ে ত্যাড়া করে বলল,
-” যা গ্রিনিজ শহরের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখ। সবকিছুতেই যত নাটক, আর ন্যাকামি! যত্তসব! জবর তো আশ্চর্যের ব্যাপার, হাহ!
প্রত্যাশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” ওহহো, তুমি তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! যাই বলি, সবেতেই তোমার সমস্যা!”
-” সমস্যা তোর আচরণে। নিজের দিকে তাকা। মুখটা খুললেই যেন ঝাঁঝালো মরিচের ধোঁয়া বেরোয়! অলওয়েজ মুখেমুখে তর্ক করিস।”
-” আর তোর মুখ খুললেই ঠান্ডা বরফ। ঠিক যেন দক্ষিণ মেরুর বাসিন্দা!”
নীলা বি’রক্ত ভঙ্গিতে বলল,
-” তোর সঙ্গে কথা বলাই বৃথা! একটাই অনুরোধ, প্লিজ, আমার থেকে দূরে থাক।”
প্রত্যাশা আফসোসের সুরে বলল,
-” আহা, যদি সত্যিই দূরে থাকতে পারতাম! দুর্ভাগ্য যে তুই আমার বোন। আবার এখন জা। না চাইতেও সারাজীবন এক বাড়িতে দু’জনকে থাকতে হবে।”
-” সেটাই তো আমার পোড়া কপাল। চিন্তায় আছি, ও বাড়িতে গিয়ে সবার কাছ থেকে আমার জায়গাটা কেড়ে না নিস। তোর তো আবার জন্ম থেকেই এই স্বভাব। উড়ে এসে জুড়ে বসা।”
প্রত্যাশা নাকমুখ কুঁচকে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” অ্যাই আপু, তুই সবসময় এভাবে কেনো বলিস? উড়ে এসে জুড়ে বসা মানে? আমি কী আকাশ থেকে টুপ করে পড়েছি? আর নাকি মাটি ফেটে বেরিয়েছি?”
নীলা বিড়বিড় করে বলল,
-” সেরকমই…”
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-” কিছু বললি?”
নীলা তিরিক্ষি গলায় বলল,
-” এমনিতেই মে’জাজ খা’রা’প আছে। তাই বলছি মুখটা বন্ধ রাখ। উল্টাপাল্টা বলে মে’জাজ বিগড়ে দিস না আর।”
টু শব্দটি না করে জোড়াল নিঃশ্বাস ফেলে প্রত্যাশা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। পা দু’টো বেডের বাইরে ঝুলছে। শুণ্যে দৃষ্টিজোড়া মেলে ধরে কিছু ভাবল। মনমস্তিষ্ক বারবার নীরবের কথা ভাবাচ্ছে। লোকটা ছাদে ডাকল। কই কিছুই বলল না তো! ফোন কলের পর কেমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্যস্ত ভঙিতে বিয়ের সবটা সারল। না খেয়েই জরুরী কাজ আছে বলে চলে গেল। নানান চিন্তাভাবনা শেষে প্রত্যাশা নিজের মনকে বুঝ দেয় ওই ছবির মেয়েটা নীরবের গার্লফ্রেন্ড না হয়ে জাস্ট ফ্রেন্ডও তো হতে পারে। কিছুপল পর.. প্রত্যাশা দুষ্টুমি করে কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস ঢেলে বলে উঠল,
-” আজকে সোহাগ রাতে মৃদুমন্দ আলো অন্ধকারে; যেখানে নববধূর হাতে হাত রেখে মিষ্টি মিষ্টি প্রেমালাপনের কথা ছিলো। সেখানে কীনা বর মহাশয় চো’র-ডা’কাতের পিছুপিছু ঘুরছে। জানি না জনাব ডিউটির অজুহাতে রাত-বিরাতে কোন মেয়ের হাত ধরে বসে আছে, আল্লাহ মালুম!”
কপট বিরহের, নিদারুণ অসহায়ত্বের ছাপ বদনখানিতে ফুটিয়ে তুলে প্রত্যাশা। নীলা চোখ পাকিয়ে তাকাল। তৎক্ষণাৎ তীব্র প্রতিবাদ করে ব্যগ্র সুরে বলল,
-” মোটেই আ’জেবা’জে বলবি না। নীরব ওরকম নয়।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” বাহবা! দেবরের প্রতি এত টান। কোথায় বোনের বিরহ ব্যাথায় একটু হলেও ব্যথিত হয়ে সমবেদনা জানাবি। তা না কিছু বলতে না বলতেই রাগ দেখাচ্ছিস; আবার সাফাই গাইছিস। তোর দ্বারাই এমন সম্ভব! নিজের বোনের থেকে অন্যের প্রতি বেশি দরদ।”
-” জানিসই তো, তাহলে বেহুদা কথা কেনো বলছিস? আর শোন, আমি যতটা জানি তাই বলেছি। শুনেছি নীরব খুবই লয়াল।”
প্রত্যাশা উঠে বসে একটা বালিশ কোলের উপর তুলে নেয়। ভ্রু-ট্রু কুঁচকে সন্দিহান স্বরে বলল,
-” তোর দেবর আমার বর মহাশয় লয়াল নাকি দয়াল আর নাকি ফ্র’ড! সেটা তো সময়ই বলে দিবে। তবে আমার ওভার থিংকিং বলছে, নীরব ঘা’ত’ক লোকটা মোটেই সুবিধার নয়, হুম।”
নীলাশা চোখ দিয়ে বোনকে শাসায়। ফের আ’জে’বা’জে বললে মা’র একটাও মাটিতে পরবে না। সব কটা পরবে প্রত্যাশার পিঠে। বোনের দৃষ্টি দেখে এতটুকু আঁচ করতেই বন্ধ হয় প্রত্যাশার মুখ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বিছানায় সটান শুয়ে পরে প্রত্যাশা। মাথার উপর শব্দ তুলে ঘুরা ফ্যানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। কিছুভেবে হতাশা প্রকাশ করে আফসোস নামায় কণ্ঠস্বরে,
-” চারিদিকে ভাতের ফ্যানের মতো উথলে পরা ভালোবাসাকে পাত্তা দেইনি। পাত্তা না পাওয়া সেই সব অপ্রেমিকদের বদদোয়ায় এমন একটা বর জুটেছে কপালে। যে কী না বাসর রাতেও বউ রেখে ডিউটিতে থাকে। পাশের বিল্ডিংয়ের রুমা আন্টির ছেলে রোহান। আহা! বেচারার পাঠানো প্রেমপত্র পড়ে মনে হতো, ব্যা’ডার জন্মই হয়েছে আমার জন্য। গলির মোড়ে চায়ের দোকানে বিকেলে ক্যারাম খেলার নাম করে আমার দিকে চেয়ে থাকা ছেলেটি, কোচিংয়ের নতুন ক্লাস নেওয়া ভাইয়া পড়া ধরার নাম করে বারবার আমার নাম নেওয়া, ক্লাসের সুদর্শন ছেলেটির সবার অলক্ষ্যে আমার দিকে চোরা চোখে চাওয়া। চার রাস্তার মোড়ে গোলাপ হাতে প্রপোজ করতে গিয়ে হাঁটু কাঁপা ছেলেটির গালে ঠাস চ’ড় পরা। এতএত প্রেম উপেক্ষা আর প্রত্যাখ্যানের ফল এমন রসকষহীন তৃণভোজী বর।”
বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ির ঝলমলে লিভিংরুম সোনালি বেলুনে সজ্জিত। বড় টেবিলের মাঝখানে রাখা সাদা কেক তার উপর জ্বলজ্বল করছে মোমবাতির আলো। অথচ এত আড়ম্বরের মাঝেও যেন একরাশ নিরবতা। বাড়ির সদস্যদের মুখে হাসি নেই, পুরো বাড়িজুড়ে সদা গুমোট ভাব বিরাজ করে। বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড আর সার্ভেন্টের থেকে বাড়ির সদস্য সংখ্যা নগণ্য।
চার বছরে পা দেওয়া ছোট্ট নুসাইবা আনায়া ইচ্ছে, তার মুখটা ভার। গোমড়া মুখে সে বসে আছে, দুই হাত বুকের কাছে গুটিয়ে রেখেছে, দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝের মার্বেলে। পাশেই বসা প্রীতি, অনেকক্ষণ ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু মেয়েটি একরোখা। প্রীতি মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে, অনেক রাত হলো সোনা; এবার একটু খাবার খেয়ে নাও। রাতে তো ওষুধও খেতে হবে।”
ইচ্ছে তাকায় না, চিবুক বুকে গুঁজে রেখে ধীর ধীরে অভিমানী সুরে বলে,
-” মাম্মা, আমি কাবো না! কিচ্ছু কাবো না! পাপা না আসলে আমি ওথুধও কাবো না!”
প্রীতি মেয়ের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইচ্ছে অভিমানী চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” সবার পাপা কত্ত ভালো! সবসময় থাকে। আমার পাপা ইখুন কম আদর করে। থাকিউ না।”
মাথাটা তুলে মায়ের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” মাম্মা, পাপা কিনো ইখুন আর আমাদের সাথে থাকে না?”
প্রীতি মেয়ের নরম গাল দু’হাতে আলতো করে ছুঁয়ে কপালে চুমু আঁকল। কোমল কণ্ঠে বলল,
-” ইচ্ছে, তোমার পাপা খুব ব্যস্ত থাকে, তাই সবসময় তোমার সাথে থাকতে পারে না। তাঁর অনেক দায়িত্ব আছে। দেখো না, তোমার ফ্রেন্ড নাফির পাপাও তো ওদের সাথে থাকে না। কাজের জন্য বাইরে থাকে। সেইম তোমার পাপাও। তাই এতে মন খা’রাপ করবে না, বেবি।”
ইচ্ছে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” কিনটু নাফি তো যখন ইচ্ছে তখন ওর পাপার সাথে কথা বলে!”
-” তুমিও তো কথা বলো, তাই না?”
ইচ্ছে ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে বলল,
-” উল্প! এইতুকু বুলি আমি!”
প্রীতি হেসে ফেলল। ইচ্ছে আবদারের সুরে বলল,
-” আমিও নাফির মতো পাপার সাথে সবসময় কটা বুলিতে চাই। পাপাকে ফোনের ভেতর আসতে বলবে, আমি ফোনে থাকা পাপাকে দেকে দেকে কথা বুলব।”
তন্মধ্যে আদুরে গলায় ডাক এলো,
-” ইচ্ছে!”
ডাক শুনে মা-মেয়ে একসঙ্গে মুখ তুলল। ইচ্ছের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে গেল। মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে উজ্জ্বল হাসিতে বলে উঠল,
-” পাপা!”
তারপর ছোট্ট পায়ে দৌড়ে গিয়ে সামনের মানুষটার কোমর জড়িয়ে ধরল, মুখ গুঁজল তার পেটে। হাতে থাকা ব্যাগ মেঝেতে রেখে এক ঝটকায় ইচ্ছেকে তুলে নিল কোলে। কপালে গভীর এক চুমু খেয়ে বলল,
-” স্যরি, লিটল প্রিন্সেস! দেরি হয়ে গেল। হ্যাপি বার্থডে, সোনা!”
খোঁচা খোঁচা দাড়ির গালে আলতো চুমু খেয়ে ইচ্ছে খিলখিল করে বলল,
-” থ্যাংকিউ, পাপা!”
প্রীতি কিছুটা কটাক্ষের সুরে বলল,
-” যাক! শেষমেষ তুমি এসেছো।”
কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা ইচ্ছেকে সোফায় বসাল। ব্যাগ থেকে একে একে বের করল একটি রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার, একটি ছোট্ট গাড়ি, আর চকোলেট ভর্তি বাক্স। সবকিছু পাশে রেখে, ইচ্ছের হাতে নরম তুলতুলে একটি টেডি বিয়ার তুলে দিয়ে বলল,
-” এগুলো তোমার জন্মদিনের উপহার!”
ইচ্ছে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। আনন্দে লাফিয়ে উঠে চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল,
-” ইয়েএএএ! কটটো কিউত!”
প্রীতি খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
-” নীরব, ইচ্ছে এখনো ডিনার করেনি। ওষুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তুমি না আসায়…”
প্রীতির কথার মাঝেই নীরবের দৃষ্টি চলে যায় টেবিলে রাখা কেকটার দিকে। ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে সোনা, চলো কেক কা’টি। লিটল প্রিন্সেস কেক কা’টা’র পর কিন্তু ডিনার করবে, তাই তো?”
ইচ্ছে খুশিতে ঘাড় কাত করে ঝুমঝুম করে ওঠে বলল,
-” ওকে….ওকে পাপা!”
কেক কা’টা’র পর প্রীতি ইচ্ছেকে খাবার খাইয়ে দিল। ইচ্ছে নীরবের কোলে শান্ত, নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। কিন্তু যখনই তাকে সবসময় দেখভাল করা মেয়েটিকে ডেকে রুমে নিয়ে যেতে বলা হলো, ইচ্ছের মন খা’রাপ হয়ে গেল। সে নীরবের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-” আমি ঘুম গেলেই তুমি চলে যাবে, পাপা! আমি ঘুমিব না।”
নীরব ইচ্ছের ছোট্ট মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করল,
-” ইচ্ছে মামণি মন খারাপ করো না। আমার একটু কাজ আছে, কিন্তু প্রমিজ করছি, কাজ শেষ হলে তোমাকে রেখে কোথাও যাব না। আমি সবসময় তোমার সাথেই থাকব, ঠিক আছে?”
-” সত্যি?”
-” হ্যাঁ, একদম।”
প্রীতি ইশারায় মনাকে ডেকে নিল। মনা ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল। নীরব এক হাতে চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে দ্বিধাভরা কণ্ঠে প্রীতি বলল,
-” অনেক রাত হয়েছে… ডিনার করে যাও।”
নীরব নির্বিকার ভঙ্গিতে গম্ভীর স্বরে জবাব দিল,
-” নো থ্যাংকস।”
এরই মাঝে তানিয়া খাঁন ধীরে ধীরে হুইলচেয়ারের হাতলে হাত রেখে সামনের দিকে ঠেলে দিলেন। চাকার রিমে দৃঢ়ভাবে আঙুল রেখে নিজের শক্তিতেই এক এক করে চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে নীরবকে ডেকে বললেন,
-” রাত অনেক হয়েছে, ডিনার করে যাও বাবা।”
নীরবের পা জোড়া থেমে যায়। পিছু ঘুরে নম্র স্বরে বলল,
-” স্যরি আন্টি, একটু তাড়া আছে।”
তনিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জোরাজুরি করে আর কিছু বললেন না। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বললেন,
-” বাবা প্রীতির এখানকার অফিসে জয়েনিং নিয়ে কী একটা প্রবলেম হয়েছে! তুমি একটু সময় করে দেখো তো।”
-” ঠিক আছে।”
-” সার্থকেই বলতাম। ছেলেটা সারাদিন হসপিটাল, চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই প্রীতি ওকে বলেনি। তোমাকেও বলতে চায়নি প্রীতি। আমিই বললাম আরকি। আর এসব প্রশাসনিক ব্যাপারে তোমার তো ক্ষমতা আছে, তাই।”
নীরব সৌজন্যমূলক বলল,
-” ইটস্ ওকে আন্টি। আমি ট্রাই করব। আমি এখন আসছি।”
-” আচ্ছা। দেখেশুনে যেয়ো বাবা।”
পরেরদিন……
বিকেলের নরম আলো পিচের রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে। আবাসিক এলাকার সরু, যানজটমুক্ত পথ ধরে স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছে প্রত্যাশা। পেছনে হ্যাপি বসে। ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছে। হঠাৎ প্রত্যাশা গতি বাড়িয়ে দেওয়াতে হ্যাপি আঁতকে উঠে একহাতে প্রত্যাশার পেট জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে,
-” ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! রক্ষে করো। অ্যাই অ্যাই আস্তে চালা! এক্সিডেন্ট হবে তো। এত স্পিডে চালালে যেকোনো মুহূর্তে পটল তুলতে পারি, নাহলে সোজা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে হবে!”
প্রত্যাশার ঝুঁটি করে বাঁধা চুল বাতাসে উড়ছে। মাঝেমাঝে হ্যাপির মুখে পড়তেই হ্যাপি ফাঁকা হাতে সরিয়ে দিছে। আর আস্তে চালাতে বলে হইহই করছে। হ্যাপির অকস্মাৎ পেট পেঁচিয়ে ধরায় নড়েচড়ে ওঠে প্রত্যাশা। চেঁচিয়ে বলল,
-” এই! হাত সরা… ফাস্ট সরা বলছি! আর ফাঁকে বস, কাতুকুতু লাগছে!”
হ্যাপি সুযোগ পেয়ে বাঁকা হেসে বলল,
-” আগে স্পিড কমা… নাহলে আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরব বলে রাখলাম।”
এই বলে সত্যি সত্যিই হ্যাপি বাহুর বাঁধন আরও দৃঢ় করে ফেলে। প্রত্যাশা সুড়সুড়ি লাগার জন্য ঠিকঠাক চালাতে পারছিলো না। অবশেষে স্পিড কমিয়ে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে হ্যাপির দিকে এক ঝলক চেয়ে শাসালো,
-” হ্যাপির বাচ্চা। আগে নেমে নেই। তারপর তোকে ভর্তা বানাব। হামাল দিস্তাতে পিষে একদম আম ভর্তা করে ছাড়ব।”
হ্যাপি ভেংচি কা’ট’ল। হেসে বলল,
-” ব্যাপার না জানু, আম ভর্তা হেব্বি টেস্টি। আমাকেও একটু ভাগ দিও। ইশশ্! আ’ম সো হ্যাপি!”
প্রত্যাশা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
-” আ’ম সো হ্যাপি! আরে গ’র্দ’ভ সবাই জানে তোর নাম হ্যাপি। তোকে আর এরকম করে বলতে হবে না।”
এমন সময় স্কুটির পিছন থেকে হঠাৎ ধা’ক্কা আসতেই ব্যালান্স রাখতে না পেরে; স্কুটি এক পাশে কাত হয়ে পড়ল। প্রত্যাশা আর হ্যাপি রাস্তায় পড়ে গেল। প্রত্যাশা হাতের তালুতে ভর দিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। তবুও হাঁটুতে হালকা জ্বা’লা অনুভব করল–বোধহয় ছুঁলে গেছে। স্কুটি সোজা করতে গিয়ে ওর চোখ পড়ল লুকিং গ্লাসের দিকে–গ্লাসটা ফে’টে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। গভীর শ্বাস ফেলে হ্যাপির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল,
-” বেশি লেগেছে তোর?”
হ্যাপি ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে বলল,
-” নাহ! একটু।”
এদিকে ধা’ক্কা দেওয়া গাড়িটি রাস্তার পাশে থেমে আছে। প্রত্যাশা রাগী চোখে তাকিয়ে দেখল, সামনের কাঁচের ওপরে লাল অর্ধচন্দ্রের চিহ্ন–নিঃসন্দেহে কোনো ডাক্তারের গাড়ি! প্রত্যাশা নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
-” ওহহো! এবার বুঝেছি। ব্যাটা ডাক্তার, ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিল! চায় হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হই, আর ওর রোগী বাড়ে। টাকা কামানোর কী চমৎকার ধান্দা!”
এই কথা বলেই প্রত্যাশা গাড়িটার দিকে এগোতে নিলে, হ্যাপি দুশ্চিন্তাভরা কণ্ঠে বাধা দিল,
-” অ্যাই… অ্যাই ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”
-” ব্যা’টার মুখটা দেখে আসি একবার!”
হ্যাপি আ’ত’ঙ্কিত হয়ে বলল,
-” ঝগড়া বাঁধিয়ে নিস না ইয়ার! সেদিনের ঘটনা ভুলে গেছিস? অটোওয়ালার সঙ্গে ক্যাচাল করেছিলি, আব্বু দেখে আম্মুকে নালিশ করল, তারপর তোর জন্য কত ব’কা শুনতে হলো!”
প্রত্যাশা হ্যাপির কথা কানে না তুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে সাদা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির জানালার কাঁচ বন্ধ, ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কয়েকবার টোকা দিয়েও সাড়া না পেয়ে প্রত্যাশার রাগ বাড়ল বৈ কমল না। স্কুটির লুকিং গ্লাসের করুণ দৃশ্য চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতেই রাগটা দপ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ইট চোখে পড়তেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসল। যাক! এভাবেই শোধ তোলা যাবে! দু’হাতে ইট তুলে জানালায় আঘাত হানতে গিয়েই হঠাৎ কাঁচ নামতে শুরু করল। ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটা মাত্র মাথা বাড়িয়ে দেখতে নিচ্ছিল…এমন অবস্থায় মানুষটার মাথায় আ’ঘাত লাগতে লাগতে রক্ষা পেল! প্রত্যাশা তুরন্ত হাত থামিয়ে সরিয়ে নিল। নিজের এহেন কর্মকান্ডে প্রত্যাশা থমকে গেল। জিভে কা’মড় দিয়ে ভাবল–ইশশ! আরেকটু হলেই মা°র্ডা°র কেসের আসামি হয়ে যেতাম। থ্যাংক গড!
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১
ড্রাইভিং সিটে বসা মানব একহাতে ফোন কানে চেপে সামনের মেয়েটির দিকে নিটোল চাহনিতে চেয়ে। এ্যাশ কালারের কুর্তির ওপর নেভি ব্লু লেডিস কটি, চুলগুলো ঝুটি করে বাঁধা, একপাশ দিয়ে কাঁধের ওপর নেমে এসেছে কয়েকটা লম্বা গোছা। সরু ভ্রু, টানাটানা চোখের গভীরে যেন কিছু লুকোনো আছে। কপালের কাছটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। মানবটি তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে। তার দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য থমকায়।