তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১
ফারহানা নিঝুম
সদ্য বিয়ে করা এক ষোড়শী কন্যা কে রেখে ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ। নতুন বধূর মুখ দর্শন পর্যন্ত করে নি। ছেলে কে আটকাতে দৌড়ে গেলেন রুবেনা শেখ, হাত টেনে ধরল তাশফিনের।
“এটা কি করিস তুই তাশফিন? বিয়ে করা বউ ফেলে তুই এভাবে চলে যাচ্ছিস?”
শক্তপোক্ত পুরুষটি,ভারী স্বরে বলল।
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম মা। তুমি আমাকে বলেছিলে বিয়ে করতে,করেছি বিয়ে। এখন প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও।”
এক পল অপেক্ষা করলো না তাশফিন। বেরিয়ে এলো গাড়ির দিকে, সঙ্গী হলো তার ছোট ভাই সৌহার্দ্য শেখ।”ছেলের এহেন কান্ডে হতভম্ব রুবেনা শেখ। গাড়ি বেরিয়ে গেল দ্রুত গতিতে।এক বারের জন্য থামলো না তা।
বিয়ে বাড়িতে ইতিমধ্যেই কানাঘুষা শুরু হয়েছে। নতুন বর এভাবে মেয়ে কে ফেলে চলে গেল কেন? আচ্ছা তবে কি মেয়ের মাঝে কোনো খুঁ’ত রয়েছে?
একের পর এক বাজে মন্তব্য শুনতে পাচ্ছে ফারাহ আহমেদ।
সদ্য মেহেদি রঙা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে ফারাহ আহমেদ। বিয়ের বেনারসি পরিহিত এই রমণীর বয়স সবে যোলো। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট আসার পর পরই নিজের বিয়ের কথা শুনে চমকে ছিল মেয়েটা।বড় মামা জয়নাল আহমেদর বন্ধুর ছেলে তাশফিন শেখ,ওনার মা রুবেনা শেখ এক দেখাতেই পছন্দ করেছেন ফারাহ কে।ছেলে মাসে ছয় মাসে একবার বাড়ি মুখো হয়।এবারেও তাই হলো।
ছেলে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের জন্য ম’রিয়া হয়ে উঠেন রুবেনা শেখ এবং রিজুয়ান শেখ। নিজের বিয়ে নিয়ে মা বাবা কে ব্যস্ত হতে দেখে রেগেছিল তাশফিন। এখুনি সে বিয়ে নামক প্যারা নিতে চাচ্ছিল না।অথচ রুবেনা শেখ মানতে নারাজ, ছেলে কে বিয়ে দিবেন মানে দিবেন।নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে হসপিটালে ভর্তি পর্যন্ত হয়েছেন তিনি। মায়ের এমন কান্ড দেখে হতাশ হয় তাশফিন। এক প্রকার বাধ্য হয়েই বিয়েতে মত দিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার তার দু’টো শর্ত ছিল।এক সে মেয়েকে দেখবে না, ডিরেক্ট বিয়ে করবে। দুই বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে সে সমুদ্রে ফিরে যাবে।
রুবেনা শেখ প্রথমত ব্যাপার টা আমলে নিলেন না। কিন্তু যখন দেখলেন সত্যি সত্যি ছেলে তার বিয়ে করে চলে গেছে তখনই আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিজের কথা গুলো ভেবে ভেবে হতাশ হচ্ছে ফারাহ। কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইছে আঁখিদয়। টুপটাপ করে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ছে রঙা হাতের তালুতে।সে কাঁদছে তার ভাগ্য নিয়ে।এভাবে একটা মানুষ তাকে অপমান করলো?
“এটা কী হচ্ছে ভাইজান? আপনি তো বলেছিলেন আপনার বন্ধুর ছেলে ভদ্র সভ্য।এক কথায় আমি মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। এখন কী হচ্ছে এগুলো?”
আরিফা আহমেদের কথায় নিজের উপর হতাশ হচ্ছে জয়নাল আহমেদ। এগিয়ে গেলেন তাশফিনের বাবা মায়ের দিকে।
“এটা কি হলো রিজুয়ান?তোর ছেলে ওভাবে…
হাত জোড় করে ধরলেন রিজুয়ান শেখ।
“সত্যি ভাই আমরা বুঝতেই পারিনি তাশফিন এরকম কিছু করবে!”
রুবেনা শেখ আকুতির স্বরে বললেন।
“দেখো জয়নাল ভাই আপনি যদি বলেন আমি আমার ছেলের বউ কে নিয়ে যেতে চাই। মেয়েটা আমাদের সঙ্গেই থাকুক।”
তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন আরিফা আহমেদ।
“না আমার মেয়ে কে পাঠাবো না ওখানে?”
রুবেনা শেখ এগিয়ে এসে হাত দুটো ধরলেন আরিফা আহমেদের।
“আপা এরকম করবেন না।ফারাহ তো এখন আমার ছেলের বউ।ওকে নিয়ে যেতে দিন।”
আরিফা আহমেদ শুনতে নারাজ। গম্ভীর স্বরে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন।
“না আপা এটা সম্ভব নয়। আপনার ছেলে যখন ফেলেই চলে গেছে তাই আমার মেয়ে কে আমি এমন ভাবে তো বিদায় দেব না!যদি কখনো আপনার ছেলে নিজ থেকে এসে মেয়ের হাত চায় তবেই ফারাহ যাবে আর নয়ত না।”
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রুবেনা শেখ।তাশফিন কবে ফিরবে তার-ই নিশ্চয়তা নেই, সেখানে ফারাহ কে এসে নিয়ে যাবে সেটা ভাবা বিলাসীতা!
“আপা আরেকটি বার কী ভাবা যায় না?”
আরিফা আহমেদ চুপ রইলেন, অর্থাৎ তিনি যা বলেছেন তাই হবে।
রাতের শেষ প্রহরে আকাশ এখনো ঘুমন্ত, কালচে নীল আঁধারে মোড়া। দূর থেকে মৃদু হাওয়া বয়ে আসছে গাছের পাতাগুলো অলসভাবে দুলতে থাকে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে সেই মৃদু হাওয়া।হঠাৎই পূর্ব দিগন্তে একটা ফিকে আলো ফুটে ওঠে একটা হালকা নীলচে আভা, যেন অন্ধকারের গায়ে প্রথম স্পর্শ রাখল ভোর।ধীরে ধীরে সূর্য মামা উঁকি দিতে লাগলো। জানালার কাছে টাঙানো সফেদ পর্দা হাওয়ায় দুলছে। সাঁঝের এই ঈষৎ আলো এসে মুখশ্রী জুড়ে আলোকিত করছে ফারাহর।সদ্য লেগে আসা ঘুমটা ভেঙে গেল,উঠতে ইচ্ছে করলো না তার।চুপটি করে বসে রইল বিছানার পাশে ।রাতের বেনারসি জড়ানো,চোখের কাজল লেপ্টে আছে।রাতের ঘটনাটা মিটতে মিটতে ভোর মধ্য প্রহর।শেষ বেলায় রুবেনা শেখ এসেছিলেন ফারাহর কাছে।চোখে মুখে মলিনতা ছিল।মায়ের পরশে ছুঁয়ে ছিলেন ললাট। ছোট্ট করে বলেছেন।
“আমি খুব শিঘ্রই নিয়ে যাবো তোকে।”
প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেনি ফারাহ।রুবেনা শেখ বেরিয়ে যেতেই হাউমাউ করে কেঁদেছে ফারাহ । লোকটি তাকে রেখে চলেই যাবে যেহেতু তাহলে বিয়ে করেছিল কেন?
মস্তিষ্ক জোড়ে হাজারো প্রশ্ন, অথচ উত্তর মেলাতে পারছে না সে। শেষমেষ একটু ঘুম লেগেছিল অথচ ভোরের আলো ছুঁয়ে দিয়েছে তার নেত্র পল্লব। তন্দ্রা কে টে গিয়েছে তার।
দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন আরিফা আহমেদ, পিছন পিছন এলেন সাজ্জাদুল আহমেদ। পঙ্গু’ত্বের অভিশাপে আজ তিনি উইলচেয়ারে বসে। তারপরেও মেয়ের এমনতর অবস্থায় আসবেন না তা কি হতে পারে?
মুখশ্রী জুড়ে বিষণ্নতাথ ছাপ স্পষ্ট।বুকটা হো হো করে কেঁদে উঠলো আরিফা আহমেদের। সাজ্জাদুল আহমেদের বড় জয়নাল আহমেদ বলেছিল বলেই আরিফা আহমেদ দ্বিমত করেন নি বিয়েতে।এক বাক্যে রাজি হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ মেয়েটার কী অবস্থা হয়েছে?
কাছে গিয়ে মাথাটা বক্ষে চেপে ধরেন তিনি।
“ফারাহ কষ্ট পাস না মা।দেখবি জামাই এসে ঠিক তোকে নিয়ে যাবে।”
তাশফিন এসে তাকে নিয়ে যাবে কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না ফারাহ।তবে সে আশাও রাখে না, চলে গেছে বলে কি সে নিজেকে ভাসিয়ে দেবে?এটা তো হতে পারে না!চেয়ার ঠেলে ঠেলে এগিয়ে এলেন সাজ্জাদুল আহমেদ।
“দেখ মা ফারাহ তুই এসব নিয়ে ভাবিস না ওতটা।আর তুই তো কোনো কালেই মানুষের কথা তেমন একটা ধরিস না। আজকেও ধরবি না।”
মৃদু হাসলো ফারাহ, স্বভাব সুলভ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে।
“আচ্ছা মা বাবা তোমরা কেন এত চিন্তা করছো? আমি একবারও বলেছি আমার কষ্ট হচ্ছে? না তো।দেখো লোকটি ছেড়ে চলে গেছে কেন তা তো আমি জানি। তবে যদি কখনো ফিরে তখনো কী হবে আমার জানা নেই। কিন্তু কিন্তু তাই বলে যে বাঁচা ছেড়ে দেব তা তো হতে পারে না!এই তো এইচএসসি রেজাল্ট দিল,এখন কলেজের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করতে হবে তো।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আরিফা আহমেদ।যাক মেয়ের মনের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি ঘটনা গুলো।
“আমার লক্ষী মেয়েটা।”
ফারাহ ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালো। অস্থির কন্ঠে বলল ।
“মা বাবা যাও না আমাকে এখন একটু বেনারসি টা ছাড়তে দাও।এত ভারী জিনিস গুলো আমি রাখতে পারছি না।”
হেসে ফেললেন আরিফা আহমেদ। সাজ্জাদুল আহমেদ কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলো ফারাহ। বধূর সাজে সেজেছিল এক পুরুষের জন্য।যাকে সে চেনে না, জানে না অথচ তার নামে কবুল করেছে। আচ্ছা লোকটা তাকে কী একবারো দেখেনি?হয়তো বা না,যদি দেখতো তাহলে কি চলে যেতে পারতো? পাশের ফোনটি তুলে নিজের দু’টো ছবি তুলে রাখলো সে। কখনো যদি সেই অচেনা পুরুষ তার সামনে আসে তবে দেখাবে। বলবে দেখুন আপনার জন্য বধূ সেজে ছিলাম। কিন্তু আপনি তো দেখলেন না আর আমাকে বধূ বেসে আপন করে নিলেন।