তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ২
ফারহানা নিঝুম
সকাল, যখন সূর্যের আলো ধীরে ধীরে উঁচু হতে শুরু করে। প্রকৃতি নতুনভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে, পাখিরা গান গায় এবং শীতল বাতাসে সতেজতা ভরে উঠেছে। গ্রামের সুন্দর এই দৃশ্য যে দেখবে সেই মোহিত হবে। সারোয়ার স্যুট পড়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফারাহ, সঙ্গী আছে কলেজের বান্ধবী আর বড় মামার মেয়ে স্নেহা।
কলেজে আজকে পরীক্ষা আছে দু’জনের। আপাতত কলেজে যেতেই হবে। দু’দিন ধরে ধুম জ্বর থাকার কারণে খুব একটা পড়তে পারেনি ফারাহ, এখন হাঁটতে হাঁটতে বইয়ে চোখ বোলাতে লাগলো।
“কী রে ফারাহ এখন কী পড়ছিস?”
স্নেহার কথায় দুম করে বইটা বন্ধ করে দিল ফারাহ।
“পড়ব না তো আর কীইবা করব?তুই কি আমাকে দেখাবি? নিজে তো একটা শব্দও পারিস না!”
স্নেহা বত্রিশ পাটি দাঁত দেখালো। পড়াশোনা কোনো কালেই মাথায় ঢুকে আর।
কলেজ গেটের কাছাকাছি আসা মাত্র নজরে এলো সায়র।তাদের ব্যাচমেট।সায়র কে দেখে নাক ছিটকায় ফারাহ।যখনই দেখে তখনই বলবে।
“ও ফারাহ তোমার কী অবস্থা? পড়াশোনার কী খবর? আচ্ছা তুমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে তো?”
ভেংচি কাট’লো ফারাহ।সে পড়াশোনা করবে না, পরীক্ষা দেবে না তাতে ওর কী? সবসময় ছুঁকছুঁক করে খালি।স্নেহা কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল ফারাহ কে। ফিসফিসিয়ে বললো।
“ওই দেখ ফারাহ সায়র ভাইয়া।”
ফারাহ ফের নাক কুঁচকে নিল।
“কিসের ভাইয়া?ওই স্নেহা ও আমাদের বয়সী বুঝলি? ভাইয়া ডাকার কী আছে?”
দাঁত বের করে হেসে ফেলল স্নেহা।সায়র শক্তপোক্ত এক যুবক।তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।যেমন চেহারা তার ঠিক উল্টো মন। মেয়েদের সাথে গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব করতে চায়।ফারাহ এক প্রকার পাশ কা’টিয়ে চলে যেতে নিল,সায়র অল্প বিস্তর দৌড়ে এগিয়ে এলো।
“এই ফারাহ চলে যাচ্ছো যে!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফারাহ মেকি হেসে দেখিয়ে আওড়ালো।
“আরে যাচ্ছিলাম তো অফিস রুমে। আজকে ফ্রি জমা দিতে হবে।”
সায়র হাসলো।হাসি দেখে গা পিত্তি জ্ব’লে ওঠে ফারাহর!স্নেহা ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠে।
“চল চল দেরি হয়ে যাবে তো!”
ফারাহ একই টুনে বলল।
“হ্যা সায়র আমরা বরং আসি কেমন? আমাদের ফ্রি দিয়ে আবার হল খুঁজতে হবে।”
সায়র বেশ বুঝতে পারছে তাকে পাত্তা দিচ্ছে না ফারাহ।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার, মস্তিষ্কে জানান দিলো সে তো এই মেয়ে কে প’টিয়ে ছাড়বে।
অফিস রুমে ফ্রি জমা দিয়ে হল রুমে চলে গেল ফারাহ।সিট খুঁজে নিল নিজের। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আরো ত্রিশ মিনিট বাকি আছে। এতক্ষণ ক্লাসে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না।
“এই স্নেহা চল বাইরে যাই।”
নিজের পছন্দের একজন ফ্রেন্ডের সাথে গল্প জুড়েছে স্নেহা।এহেন মূহুর্তে ব্যা’ঘাত ঘটায় বিরক্ত হলো বোধহয়।
“যা তো এখন পারব না।”
বগলদাবা করে স্নেহা কে নিয়ে বেরিয়ে এলো ফারাহ। বেচারি স্নেহা তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে।তার পছন্দের মানুষ বলতে গেলে ক্রাশ তাকে রেখে এই ফাজিল টার সঙ্গে এখন ঘুরঘুর করতে হচ্ছে?
গাল ফুলিয়ে হাঁটছে স্নেহা। একটু দূরে যেতেই নজরে এলো ওদের এলাকায় থাকা চেয়ারম্যানের বড় ছেলের বউকে। মহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করেছে ফারাহর পানে। ফারাহ ওনাকে দেখেও কিছু বলল না, উল্টো মুখ বাঁকিয়ে যেতে লাগল।পাশে থাকা আরেকজন কে চেয়ারম্যানের বউ ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলেন।
“এই তো সেই মাইয়াটা টা না যারে জামাই বিয়ে করে ফালাইয়া গেছে।”
অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যগুলো কর্ণকুহু হওয়া মাত্র রাগে ফেটে পড়ে ফারাহ।পা জোড়া থামে তার, তাদের কথোপকথন চলছে।
“আরে হ্যাঁ এই মেয়েটাই তো।দেখো কেমন নি’র্লজ্জের মতো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে,ছিহ!”
চুপ থাকতে পারলো না ফারাহ, রাগের দুমদাম পা ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল।
“আমাকে আমার জামাই বিয়ে করে ফেলে যাক বা নিয়ে যাক তাতে আপনাদের কী? আপনাদের তো আর বিয়ে করে ফেলে যায়নি? পর সমালোচনা না করে নিজের চরকায় তেল দিন।আর যদি আমাকে নিয়ে কানাঘুষা করতে শুনি? তাহলে চুল গুলো আর একটাও মাথায় থাকবে না।”
মহিলা দু’জন থতমত খেয়ে গেলেন। একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চেয়ারম্যানের বউ বলে উঠে।
“ছিহ্ ছিহ্ কী বেহায়া মেয়ে গো তুমি! লজ্জা বলতে নেই কিছু?”
“না নেই।
মুখের উপর উত্তর দিয়ে পা বাড়ায় ফারাহ। পরীক্ষা দেবে না সে।এক বছর পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগল। একটা অচেনা পুরুষ যার জন্য আজকেও তাকে কথা শুনতে হয়, আচ্ছা সে কেন চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি গুলো নিয়ে গেলেন না?ফারাহ-ই বা কেন লোকটার নামে নাক ফুল,হাতে নোয়া পড়ে বেড়ায়।ফাইল পত্র রেখে বাইরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল ফারাহ।স্নেহা জিনিস গুলো নিয়ে ছুটতে লাগল তার পিছু পিছু। ফারাহ বেরিয়ে গেছে অনেক আগেই,তাকে খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই।
বাড়ির দালানে এসে কুয়া থেকে পানি নিয়ে মাথায় ঢাললো ফারাহ।বাড়ির কাজের মেয়ে সুরাইয়া আঁ’তকে উঠে, দৌড়ে ভেতরে গেল।
“বড় চাচী ও বড় চাচী দেইখা যাও ফারাহ আপা কী করতাছে?বড় চাচী ও বড় চাচী!”
রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিলেন আরিফা আহমেদ।সাথে ছিলো জয়নাল আহমেদের স্ত্রী শায়লা আহমেদ। সুরাইয়ার চিৎকার শুনে বেরিয়ে এলেন ওনারা।বাড়ির পুরুষরা আপাতত কাজে বেরিয়েছেন। আরিফা সুরাইয়া কে এক ধমক লাগিয়ে বলল।
“কী হইছে এমনে চিৎকার করছিস কেন?”
সুরাইয়া রিতিমত হাঁপাচ্ছে।
“ছোট চাচী গিয়ে দেখো ফারাহ আপা কি করতাছে!”
ফারাহর নামটা শুনে বক্ষপৃষ্ঠে ধক করে উঠল আরিফা আহমেদের। দ্রুত পায়ে বাইরে দালানে গেলেন।কুয়া থেকে একের পর এক বালতি পানি নিয়ে মাথায় ঢালতে ব্যস্ত ফারাহ।শায়লা তাড়াতাড়ি গিয়ে বালতি টেনে ধরলো।
“ফারাহ এসব কী করতেছিস?”
বালতি ফেলে দিল শায়লা আহমেদ।আরিফা গিয়ে ঠাস করে একটা চড় বসালানে ফারাহর গালে।
“কী করছিস এগুলো? দু’দিন হলো জ্বর কমেছে আর তুই আজকে আবার এভাবে পানি ঢেলেই চলেছিস? তাও আবার কুয়ার ঠান্ডা পানি!”
নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ, বারংবার মস্তিষ্কে মহিলা গুলোর বাজে মন্তব্য গুলো মাথা নাড়া দিচ্ছে।বিনা বাক্যব্যয়ে গডগড করে বাড়ির ভেতরে পা রাখলো সে। চুপচাপ এগিয়ে যেতে লাগলো উপরের দিকে। সালোয়ার স্যুট থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে মেঝেতে। তাও সে থেমে নেই,উপরে সিঁড়ি বেয়ে দুতলার ঘরে গেল।আরিফা আহমেদ চিন্তিত হলেন। ফারাহ তো শুধু শুধু এমন করবে না!
শায়লা আহমেদ সুরাইয়া কে তাড়া দিল।
“সুরাইয়া পানি গুলো মুছে নে তো। এখুনি তোর চাচারা কাজ থেকে চলে আসবো।”
সুরাইয়া রাগলো, ইস্ এই ফারাহ আপার লাইগা তারে ডাবল কাম করতে হইতেছে, ভাল্লাগে না।
মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল সুরাইয়া।
রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে জানালার কাছে চুপটি করে বসে রইল ফারাহ। বুকের ধুকপুকানি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।সতেরো বছর বয়সে কত কী দেখে নিল।কত মানুষ চিনে নিল।পুরোটা জীবন তো এখনো বাকি আর কি কি দেখতে হবে আল্লাহ মালুম!
উঠে গিয়ে বাথরুমে জামা ছেড়ে বেরিয়ে এলো ফারাহ। বিছানায় মাথা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে হা’না দিল আঁখি পটে।
আরিফা আহমেদ উঁকি দিয়ে দেখে গিয়েছেন এক নজর। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে তাই আর বিরক্ত করছেন না। স্নেহা আসলেই জানতে পারবে কী হয়েছিল?দরজা আলগোছে বন্ধ করে চলে গেলেন আরিফা আহমেদ।
সমুদ্রের উত্তাল ও ভয়ং’কর রূপ প্রকৃতির এক অদ্ভুত শক্তি প্রদর্শন করে। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে ইতিমধ্যে, সূর্যের আলো একদম ম্লান।মেঘের ভেতর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যেন আকাশ নিজেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
জাহাজ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে,টহল দিচ্ছে।
বিশাল বিশাল ঢেউ বাতাসের দাপটে সাগরের বুক চিরে উঠে আসছে একটু পর পর।ঢেউগুলো একে অপরের ওপর আছড়ে পড়ছে জাহাজের দিকে, যেন বিশাল জলদৈত্য নাচছে।সফেদ ইউনিফর্ম,মাথায় সাদা রঙের টুপি, যেখানে গোল্ডেন ব্রেইড লাগানো। কাঁধে লাগালো ব্যাজ লাগালো।হাতেও ব্যাজ লাগানো,কালো রঙের পালিশ করা বুট জুতো পড়া।
ধীরে ধীরে জাহানের শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়ালো লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ।ঈগল পাখির চক্ষুদয় আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
“কমান্ডার আমাদের রওয়ানা দেওয়ার সময় হয়েছে।”
তাশফিনের আন্ডারে কাজ করা একজন লেফটেন্যান্ট নাইম ইসলাম।তাশফিন আরো একবার সমুদ্র বক্ষে দৃষ্টি বুলিয়ে আওড়ালো।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১
“লেফটেন্যান্ট আমাদের কি এই মূহুর্তে যাওয়াটা ঠিক হবে!”
মৃদু হাসলো নাইম ইসলাম।
“কমান্ডার আপনি চিন্তা করবেন না এদিকটা বাকিরা সামলে নেবে।”
তাশফিন বিশেষ কিছু বলল না।বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে গেল জাহাজের ভেতরের দিকে। অনেক গুলো দিন পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ।সেই যে একটি বছর পূর্বে একটি অনাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য সব ছেড়ে ছুড়ে এসেছিল তারপর আর যাওয়া হয়নি। বিশেষ দিন গুলোতে ছুটি পাওয়ার পরেও সে অন ডিউটিতে ছিল।
