হামিংবার্ড পর্ব ৩

হামিংবার্ড পর্ব ৩
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

অরার নিথর শরীরটা বিছানায় পড়ে আছে। গায়ের উপর পাতলা চাদর দেয়া থাকলেও কাঁপছে ও, শরীরের ভেতর যেন শীত আর আগুন একসঙ্গে লড়াই করছে। কপালের ঠিক মাঝখানে জ্বরের তীব্রতা জমাট বেঁধেছে, তামান্না হাত রাখতেই যেন তাপের ধাক্কায় পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। মেয়েটা ঘেমে গেছে, তবুও সারা শরীর হিমশীতল লাগছে।
তার ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে গেছে, নিঃশ্বাস ভারী, বুক ওঠানামা করছে অনিয়মিত ছন্দে। অচেতনভাবেই কপট গোঙানি বেরিয়ে আসছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। মাঝে মাঝে কিছু অস্পষ্ট শব্দ বলে উঠছে, যেন তীব্র ঘোরের মধ্যে কাউকে ডাকার চেষ্টা করছে, আবার মুহূর্তের মধ্যে শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে নিস্তব্ধতার মাঝে।

তামান্নার হাত কাঁপছে। একবার ভাবল, ঠান্ডা পানি এনে মাথায় দেয়, আবার মনে হলো ওষুধ ছাড়া হবে না। ফোনটা হাতে নিয়েও দ্বিধায় পড়ল—আরিশকে ফোন করবে কি না। অফিসে থাকাকালীন সময়ে বিরক্ত করা অপছন্দ করে সে। কিন্তু এখন কল না করলে যদি কিছু হয়? জ্বরটা নরমাল না, শরীর এতটা নিস্তেজ দেখাচ্ছে যে মনে হচ্ছে এই বুঝি আর নিশ্বাস নেবে না! দোটানায় পড়ে গেছে তামান্না। মেয়েটার বয়সও খুব বেশি নয়, সবে একুশ! অভাবের তাড়নায় লোকের বাসায় কাজ করত আগে। কিন্তু বেশিরভাগ বাড়িতেই যৌ*ন হয়রানির শিকার হতে হয় বলে রাগে-দুঃখে একদিন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল তামান্না। কিন্তু আরিশ তাকে বাঁচায় এবং নিজের বাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
গ্রীষ্মের দুপুর। শহর যেন উত্তপ্ত কড়াইয়ের মতো দগদগে। ফুটপাতে গাছের ছায়া ছোট হয়ে এসেছে, পাতাগুলো নিস্তব্ধ, নড়ারও শক্তি নেই। মানুষজন ছাতা মাথায় বা গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে হাঁটছে। রাস্তার ধারে ঠেলাগাড়িতে রাখা তরমুজের টুকরোগুলো যেন তৃষ্ণার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তালের শাঁসও বিক্রেতার হাঁকডাকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রেতা টানছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ক্লান্ত শহর একটু শান্তির আশায় ছায়া খোঁজে। বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে, দোকানিরা পানির বোতল ঠান্ডা রাখতে বারবার বরফ দিচ্ছে। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা বাস আর রিকশার চাকার নিচের পিচ গলতে চায় যেন।
বিল্ডিংয়ের উঁচু কাঁচের জানালাগুলোয় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চকচক করছে। কোথাও একটা চিল চক্রাকারে ঘুরছে, যেন উত্তাপের মধ্যেই নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। স্কুল ছুটির পর বাচ্চারা দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটছে, কেউ কেউ রাস্তার পাশে আইসক্রিম হাতে নিয়ে চুষে খাচ্ছে।
শহরের অলিগলিতে দুপুরের এই অসহ্য গরমের সঙ্গে যেন একটা নিস্তব্ধতা মিশে আছে, কিন্তু এর মাঝেও দূরে কোথাও একটা ফ্যানের কর্কশ ঘোরার শব্দ শোনা যাচ্ছে, অথবা হঠাৎ কোনো গাড়ির হর্ন সেই নিস্তব্ধতাকে খানিকটা ভেঙে দেয়। শহর হাঁসফাঁস করছে, বৃষ্টি চাই, একটু স্বস্তি চাই। কিন্তু বৃষ্টি কবে হবে কেউ জানে না, না শহর আর না এই শহরের লোকজন!

মাত্র মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে এলো আরিশ। লোকটা জানালার পাশে দাঁড়াল। বাইরে উত্তপ্ত শহর, কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে লাগছে তার, কিন্তু আরিশের মন অন্য কোথাও।কিছু ভালো লাগছে না। অরার কথা ভাবছে। মেয়েটা এত ভীতু কেনো? কোনো টুঁশব্দ করে না। ভীষণ ভয় পায় কেবল৷ অরার মা-ও নিশ্চয়ই এমন নরম মানুষ? তাহলে অরার খালা অর্থাৎ আরিশের মা এমন ছিলেন কেনো? আরিশ শুকনো ঢোক গিলল। আজও মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। অস্থির লাগছে ওর। বাড়ি ফিরতে হবে।
সে চোখ বন্ধ করল। অদ্ভুতভাবে অরার মুখটা মনে পড়ে গেল । ছোট্ট পাখির মতো চঞ্চল, অথচ যেন ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে গুটিয়ে থাকা।
“ও কি ঠিক আছে?”
নিজেকেই প্রশ্ন করল আরিশ। নিজের ভাবনায় অবাক হলো। অরার বিষয় নিয়ে ওর তো কিছু যায় আসে না। ধীরপায়ে চেয়ারে এসে বসল আরিশ। বিয়ে হওয়ার পর অরার সাথে একটু বেশিই রাগারাগি করা হয়েছে। ছোটো মেয়ে, শরীরও নিশ্চয়ই এতটা নিতে পারেনি। খারাপ লাগছে আরিশের। মাঝে মধ্যে কী যে হয় নিজেও বুঝতে পারে না। পকেট থেকে ফোন বের করল, আবার রেখে দিলো।

“তামান্না নিশ্চয়ই দেখছে ওকে, হয়তো খুব বেশি অসুবিধা হয়নি। আর আমি যদি এখন ফোন করি, সেটা কি ভালো হবে?”
গলা খাঁকারি দিয়ে নড়েচড়ে উঠল আরিশ। ওই মেয়েটাকে নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই। মেয়েদের বেশি ভালোবাসলে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। আরিশ কিছুতেই তার নিজ স্ত্রীকে ছাড়তে প্রস্তুত না। ভালোবাসা না থাকলেও অরাকে তার সাথে থাকতেই হবে।
এরকম আরো নানানরকম কথা ভাবতে ভাবতে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো আরিশ।
” মা আপু কল রিসিভ করেছে?”
নয়নার কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রোকসানা। নয়না অরার ছোটো বোন। ক্লাস এইটে পড়ে এবার।
” না রে। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া স্বত্তে একবারও কল দেয়নি অরা, এমনকি কল রিসিভ পর্যন্ত করেনি। আরিশকে কল দিলাম, তা-ও ধরেনি। ”
রোকসানা মল্লিক অরাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। অরা চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে, তবে ভীতু। চড়ুই পাখির মতো উড়ে বেড়াতে পছন্দ করে মেয়েটা। বন্ধ ঘরে এক মুহুর্তও থাকতে পারে না। নয়না মা’কে কিছু বলতে পারছে না। সত্যি বলতে নয়নারও এ বিয়েতে মত ছিলো না। আরিশের এমন জেদ, অহংকার খুব খারাপ লেগেছে ওর।

” আমি কি কাল একবার আপুর সাথে দেখা করতে যাবো? বেশিদূর তো না! ”
” না। আমি আরিশের সাথে কথা বলার চেষ্টা করবো, না পারলে আমি নিজেই যাবো। তোকে যেতে হবে না। এই বয়সে এত সাহস ভালো না, একা একা সব জায়গায় যেতে চাওয়া বন্ধ করো। ”
মায়ের বকাঝকা খেয়ে চুপ করে রইলো নয়না৷ ঘরের ছোটো সদস্য হলে এই একটা অসুবিধা, কেউ কোনো কথার গুরুত্ব দেয়না! মনে মনে এসব ভেবে নিজের ঘরের দিকে এগোল মেয়েটা।
নয়না জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মায়ের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। “এই বয়সে এত সাহস ভালো না, একা একা সব জায়গায় যেতে চাওয়া বন্ধ করো।”
মা বুঝতে চান না, কিন্তু অরার জন্য ভয় হচ্ছে তার। আপু এমন মানুষ না যে নিজের পরিবার ছেড়ে গেলে ভুলে যাবে! তাহলে একবারও ফোন দেয়নি কেন? এমনকি মায়ের ফোনও রিসিভ করেনি!
“ও কি ইচ্ছা করে কথা বলছে না, নাকি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না?”

নয়নার গলা শুকিয়ে এলো। মনে মনে আরিশকে ভয় পায় সে। তার চোখের দৃষ্টি, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুতেই কেমন একটা চাপা কঠোরতা। নয়না জানে, অরা কখনো জোর করে কিছু মেনে নেয়নি। তাহলে এ বিয়ে মেনে নিল কেন? কীসের জন্য? অবশ্য অরা আরিশের কর্মকাণ্ডের কথা জানতোই না। সোলাইমান মল্লিকের চাকরি নষ্ট করা, অপমান জরা এসবও কিছু জানতোই না।
“কী জানি, হয়তো ভালো আছে। হয়তো আমি বেশি ভাবছি। কিন্তু যদি না থাকে?”
নয়না নিজের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। রোকসানা বলেছে, সে যাবে না। কিন্তু নয়নার মনে হচ্ছে যেতেই হবে। নিজে চোখে না দেখলে শান্তি পাবে না। যদি অরার সত্যিই সাহায্য দরকার হয়?
“আমি কি কাল ওর কাছে যাবো?”
নিজের মনেই প্রশ্ন করল নয়না। তারপর হালকা মাথা নাড়ল।
যেতে হবে। যেভাবেই হোক, দেখতে হবে অরা আপি ঠিক আছে কি না।
কলিংবেলের শব্দে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে এলো তামান্না। দরজা খুলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আরিশ বিষয়টা খেয়াল করে শুধালো,

” কী হয়েছে? ”
” ভাবির খুব জ্বর এসেছে ভাইয়া। কোনো হুঁশ নেই দুপুর থেকে। ”
আরিশের বুকের ভেতর হালকা ধাক্কা লাগল। হাতের আঙুল মুঠো হলো। আর ভাবতে পারল না কিছু। তার অত্যাচারের জন্যই যে হামিংবার্ডের এই হাল সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে। তামান্নাকে কিছু না বলে বেডরুমের দিকে দৌড়াল আরিশ। বেচারি তামান্না ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। আরিশকে কখনো এত উতলা হতে দেখেনি তামান্না। ভালোবেসে হোক কিংবা অধিকারের জন্য হোক, অরাকে নিয়ে চিন্তিত আরিশ– এটুকু ভালো করে বুঝতে পেরেছে তামান্না।

রুমে ঢুকেই বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করলো আরিশ। বিছানার এককোনায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে তার ছোট্ট পাখিটা। আরিশ এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে। অরার চোখমুখ কেমন অচেনা লাগছে। একদিনের অসুস্থতায় কী হাল হয়েছে মেয়েটার! আরিশ ওর কপালে হাত রেখে জ্বরের তীব্রতা বুঝতে চেষ্টা করলো। জ্বর মারাত্মক। পকেট থেকে ফোন করে ডাক্তারকে কল দিয়ে কথা বলা শেষে অরার পাশে বসল। এরমধ্যে তামান্নাও রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে।
” তামান্না তোকে বাসায় রেখেছি কী করতে?”
আঁতকে উঠল মেয়েটা। আরিশ রেগে গেছে। তামান্না কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

হামিংবার্ড পর্ব ২

” কাজের মধ্যে কল করলে যদি রেগে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেন, সেই ভয়ে কল করিনি ভাইয়া। ”
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল আরিশ। রুমে এসি বন্ধ, সেজন্য কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার।
” সেটা বুঝলাম। কিন্তু সেবাযত্ন করিসনি কেনো? গতকাল রাতের পোশাক পরে আছে এখনো ও। শরীর খারাপ, পোশাক বদলে দিতিস? কপালে একটু জলপট্টি দিতিস? ”
তামান্না কী বলবে বুঝতে পারছে না। যেহেতু ঘাম ছাড়েনি সেজন্য পোশাক বদলানোর কথা মাথায় আসেনি। আর এতটাই ভয় পেয়ে গেছিল জলপট্টির কথাও খেয়াল হয়নি তামান্নার।

হামিংবার্ড পর্ব ৪