মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৩
মুসতারিন মুসাররাত
হাতের ইটটা তড়িৎ ছুঁ’ড়ে ফেলে প্রত্যাশা ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপর হালকা কেশে নিল। পরপর গলা চ’ড়ি’য়ে বলল,
-” এই যে, আপনি চালান কীভাবে! চোখে দেখেন না? স্কুটিতে ধাক্কা মে”রে জানালা বন্ধ করে দিব্যি বসে ছিলেন?”
প্রত্যাশার কথায় ছেলেটির সম্বিৎ ফেরে। ফোনটা কানে চেপে রেখেই কপালটা কুঁচকে তাকাল। তারপর আস্তে করে কল কে’টে রেখে বলল শান্ত গলায়,
-” স্যরি! স্যরি! এক্সট্রিমলি স্যরি। আসলে ফোন কানে ছিল। ব্রেক চাপতে নিলে গাড়িটার হঠাৎ ব্রেকে কাজ করা বন্ধ করে দিল। আমি চেষ্টা করছিলাম কন্ট্রোল করতে…ব্যাড লাক, ধা’ক্কা লেগে যায়।”
প্রত্যাশা এক ভ্রু তুলে রীতিমতো ধ’মকেই বলল,
-” তাই বলে পিছন থেকে এসে ধা’ক্কা দেবেন? একটুও দেখলেন না যে সামনেই স্কুটি যাচ্ছে? আর দেখেন স্কুটিটার কী দশা করেছেন! লুকিং গ্লাসটা একেবারে গুঁড়ো করে দিলেন!”
মুখাবয়বে অপরাধ বোধ টেনে নম্র স্বরে বলল,
-” কিছু মনে না করলে আমি পুরো দায় নিচ্ছি। স্কুটির ক্ষ’তি যা হয়েছে, আমি ঠিক করিয়ে দেব। কিন্তু আগে বলুন আপনি ঠিক আছেন তো?”
প্রত্যাশা ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বলল,
-” ঠিক থাকার কথা নয়। আপনার ইনটেনশন তো ছিলো হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি করানো। পেশেন্ট বাড়ানোর এই তো নতুন ধান্দা? ঠিক বলেছি না?”
ছেলেটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। পরপর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে বলল,
-” আপনার রাগের কারনটা তো দারুণ! ধরণটা সত্যি একেবারে ইউনিক!”
এক মূহুর্ত থেমে পকেট থেকে একটা সাদা, ছিমছাম কার্ড বের করে জানালার ধারে এগিয়ে দিল,
-” এই নিন, আমার কার্ড। যদি কোনো প্রব্লেম হয়, কখনও দরকার পড়ে, চলে আসবেন। আমি দেখিয়ে নেব।”
ডক্টর প্রিতম হাসান সার্থক [মেডিসিন বিশেষজ্ঞ] এতটুকুই নজরে আসে প্রত্যাশার। বাকি লেখা দেখার আগেই প্রত্যাশা তেতে উঠল। চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। চেঁচিয়ে বলল,
-” তাহলে আপনিই চাইছেন, আমি আবার আপনার কাছে গিয়ে আপনার পকেট ভারী করি, তাই না?”
ছেলেটা একটু মাথা ঝাঁকালো, মুখে প্রশান্তির ছায়া,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” স্যরি মিস ভুল বুঝছেন। আমি চাই আপনি সুস্থ থাকুন। আর যদি আসেন, সেটা শুধুই রেগুলার চেকআপ নয়…দেখা করার কারণেও তো হতে পারে।”
প্রত্যাশার মুখ গম্ভীর থেকে সরাসরি বি’স্ফো’রণের পথে,
-” আপনি ঠিক বলছেন? শুনুন, আমি কিন্তু থানায় গিয়ে কেস ঠুকতেও পারি।”
চোখে সানগ্লাসটা একটু ঠিকঠাক করে বলল,
-” তখনও দেখা হবে, তবে হয়তো কোর্টে। আমি সাক্ষী দিতেও রাজি।”
হ্যাপি পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যাশার কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিসাল,
-” প্রত্যাশা… মনে হচ্ছে লোকটার মাথায় কিছু গোলমাল আছে।”
প্রত্যাশা দাঁত চেপে মৃদুস্বরে বলল,
-” শিওর! এখন মনে হচ্ছে ইটের বারিটা এর মাথার গোলমাল ঠিক করার জন্য হলেও দরকার ছিলো।”
ছেলেটার কথায় দু’জনেই সামনে দৃষ্টি ফেলল। হালকা হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” আপনার রাগ আর কথাবার্তা—একদম পেনসিল স্কেচের মতো শার্প। খুব সহজে ভুলে যাবার মতো না।”
প্রত্যাশা থমকে গেল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
-” কি বললেন আপনি?”
ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা টেনে বলল,
-” কিছু না মিস। বললাম, আমি দুঃখিত। আর আপনি খুব সুন্দরভাবে রাগ করেন।”
প্রত্যাশার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মে’জা’জ চটল। আচ্ছা ফা’জি’ল তো। ফ্লার্টিং শুরু করল। ফ্লার্ট করা ছেলেদের হাজারটা গা’লি দিলেও গায়ে লাগবে না। এরা আরো উল্টো একের পর এক রসের রসের কথা বলে আলাপ জুড়তে চাইবে। প্রত্যাশার অত সময় নেই আলাপ করার। ও আর কথা বাড়াল না। বিড়বিড় করে–” যত্তসব!” বলে, গজগজ করতে করতে হ্যাপিকে নিয়ে ফিরে গেল স্কুটির দিকে। প্রিতম একহাত স্টেয়ারিংয়ে রেখে অন্যহাতে মাথার পিছুনের চুলের ভাঁজে চুলকায়। মেয়েটির রাগি ফেস, আ’গু’ন দৃষ্টি, ঝগড়া করা সব কেমন যেনো মনের এককোণে গেঁথে রইল।
পৌর পার্কের বেঞ্চিতে বসে দুই বান্ধবী। দু’জনের হাতে দু’টো চকবার আইসক্রিম। রাস্তায় ঘটা ছোট্ট দূ’র্ঘ’টনা তারপর ঝ’গ’ড়া সব মিলিয়ে পনেরো মিনিট দেরি হওয়াতে আজ আর প্রাইভেট পড়তে যায় না ওরা। দেরি করে গেলে ফিজিক্সের তারের মতো সোজা কট্টর তারেকুল স্যার হাজারটা প্রশ্ন করবে। উপযুক্ত কারন দর্শানো না গেলে পানিশমেন্ট স্বরুপ দাঁড় করিয়ে রাখবে, সাথে হাজারটা উপদেশ বাণী শোনাবে। যা প্রত্যাশার কাছে চরম বি’র’ক্তিকর। তাই প্রাইভেটে না গিয়ে পার্কে বসে সময় কা’টাতে থাকে। সময়ের আগে বাড়ি ফিরলেও আবার আরেক সমস্যা। আম্মু হাজারটা প্রশ্ন তুলবে, প্রাইভেট মিস দেওয়ায় ব’ক’বে। সেইজন্য এভাবে দুদিকেই ম্যানেজ করতে অদ্ভুত সুন্দর বুদ্ধিটা প্রত্যাশার মস্তিষ্ক থেকে বেরোয়।
খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া পাখি যেমন ডানা ঝাপটে মুক্ত বিহঙ্গে উড়তে থাকে। ঠিক তেমনি ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটি খোলা পরিবেশ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মুক্ত পাখির মতন উড়ে বেড়াচ্ছে। এতএত মানুষ, ছোট-বড়, তারপর সম বয়সী বাচ্চাদের দেখে ওর আনন্দ বাঁধন হারা। পার্কের সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে দৌড়ে চলেছে। পিছুন থেকে ডাক আসছে। থামতে বলছে। পরে গেলে লাগবে। হাজারটা নিষেধ আজ আর বাচ্চাটিকে এতটুকু টলাতে পারছে না। পিছুনে ঘাড় ফিরিয়ে দৌড়তে দৌড়তে খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
-” আমাকে ধলো..দেকি…দেকি ধলো তো।”
আনন্দের তুফানে দুলতে দুলতেই হঠাৎ– ধপাস!
ছোট্ট শরীরটা পড়ে গেল মাটিতে। প্রত্যাশাদের থেকে দু’হাত দূরত্বে। বাচ্চা মেয়েটি জমিনে পরে, এই দেখে প্রত্যাশা তড়িঘড়ি উঠাল। দুই হাতে মেয়েটির ফ্রকে জড়ানো ধূলোবালি ঝাড়তে ঝাড়তে উদ্বিগ্ন গলায় শুধাল,
-” তোমার লেগেছে কোথাও?”
মুখটা গম্ভীর করে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
-” নাহ।”
আকস্মিক পরে গিয়ে বাচ্চা মেয়েটি বেশ ভ’য় পেয়েছে। চোখেমুখে আ’তংকের ছাপ। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। হ্যাপি বলল,
-” ও মনে হচ্ছে ভ’য় পেয়েছে। দ্যাখ প্রত্যাশা ওর শরীর কাঁপছে।”
-” হুম।”
প্রত্যাশা দু’হাতে মেয়েটিকে শুণ্যে তুলে বেঞ্চিতে বসিয়ে দিল। নির্ভয় দিতে আদুরে স্বরে বলল,
-” কিচ্ছু হয়নি বেবি গার্ল। ভ’য় পেয়ো না, কেমন? তুমি তো ঠিকই আছো।”
মনার শরীর স্বাস্থ্য ভালো হওয়ায় দৌড়াতে পারে না। লম্বা পা ফেলে এতক্ষণে এগিয়ে আসলো। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-” ব-ব্যথা পেয়েছো? নিষেধ করেছিলাম দৌড়াদৌড়ি করো না। পরে যাবে। গেলে তো পরে।”
দৃষ্টি জমিনে রেখে গম্ভীর মুখে ধীরেধীরে বলল,
-” স্যলি মনা। আর হবে না।”
প্রত্যাশা একপাশে বসে অন্যপাশে হ্যাপি। মাঝে বসা মিষ্টি বাচ্চাটিকে দেখছে প্রত্যাশা। ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা। প্রত্যাশা আবার বাচ্চাদের সাথে অল্প সময়েই ভাব জমাতে পটু। বাচ্চাদের খুব আদর করে, একদম সাথে মিশে যায়। মাখনের মত তুলতুলে গালে একহাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
-” হ্যালো স্নো হোয়াইট, তোমার নাম কী?”
-” ইচ্ছে।”
-” ওয়াও দারুণ নাম তো। এখন বলো তোমার কী করতে ইচ্ছে হচ্ছে? তারপর কী খেতে ইচ্ছে করছে?”
ইচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে না বোঝায়। তারমানে কিছুই না। প্রত্যাশা ফের প্রশ্ন ছুঁ’ড়’ল,
-” কিছুই না?”
-” উঁহুম।”
প্রত্যাশা একগাল হেসে বলল,
-” বাহ্! চমৎকার তো! তুমিও তো দেখছি আমার মতো। যেমন; আমি কক্ষনো কারো কাছে কোন প্রত্যাশা রাখি না। অথচ আমার নামটাই প্রত্যাশা। আবার তুমি; তোমার কোনো কিছুর ইচ্ছে নেই–অথচ তোমার নামটাই ইচ্ছে। দারুণ না!”
মনা কপাল কুঁচকে বি’র’ক্ত চোখে প্রত্যাশার দিকে চাইল। অপরিচিত কারো সাথে ইচ্ছেকে বসিয়ে এভাবে দেখলে নিশ্চিত ম্যাডাম ব’ক’বে। এখানে আসার পর কী মনে করে আজ প্রথম ইচ্ছেকে বাইরে বের করতে বলেছে, তা আল্লাহ মালুম! মনা ব্যস্ত স্বরে বলল,
-” ইচ্ছে সোনা, চল…চল এবার বাসায় ফিরে যাই। দেরি করলে মাম্মা ব’ক’বে।”
যাওয়ার কথা শুনেই ইচ্ছের মন খা’রা’প হলো। ইচ্ছে থম মে’রে মুখটা এইটুকুন করে রাখল। মনা ইচ্ছেকে তাড়া দিতে থাকে। ইচ্ছে টু শব্দটি করে না। দুই হাত কোলের উপর রেখে ঠাঁই নিশ্চুপ বসে রয়। প্রত্যাশা গম্ভীর মুখটা দেখে হাসল। হঠাৎ প্রত্যাশার কিছু মনে হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-” তোমার জোড়া ভ্রুটা বেশ সুন্দর। জোড়া ভ্রু, তারপর চোখ দু’টো কেমন যেনো আমার কাছে পরিচিত পরিচিত। তোমার ফেসটাই যেনো পরিচিত লাগছে।”
ম্যাডাম রাগ করবে, হ্যানোত্যানো বলে মনা ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিয়ে প্রস্থান করতে থাকে। মনার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ইচ্ছে। প্রত্যাশা হাত নাড়িয়ে বলল,
-” টাটা কিউটিপাই। আবার এসো…দেখা হবে। আমরা এখানে প্রায়ই আসি। তুমিও এসো…একসাথে খেলব কেমন?”
খেলার কথা শুনে ইচ্ছের চোখ চকচক করে ওঠে।চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে পরে। হাত নাড়িয়ে বলে,
-” তাতা..বা..বাই। ওকে।”
.
.
কিছুক্ষণ পর…হ্যাপি বলল,
-” নাহিদের কাছে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বল। স্যার যা যা করিয়েছে খাতায় তুলে নিবো।”
প্রত্যাশা ফোন বের করতে করতে বলল,
-” রোহান আর কোয়েলের ব্যাপার কী রে? জানিস কিছু? শুনলাম ওদের দুজনের মধ্যে ইটিস-পিটিস চলছে।”
-” জানি না শিওর! তুই যতটুকু জানিস… অতটুকুই।”
হঠাৎ হ্যাপির কিছু মনে পড়তেই কৌতুহলবশত বলে উঠল,
-” দোস্ত..যাই বলিস না কেনো, ডক্টরটা কিন্তু হেব্বি দেখতে ছিলো! ব্যাটা তোর উপর ক্রাশ-টাশ খেলো নাকি? কথায় তো সেরকমই মনে হলো। তুই কিন্তু দোস্ত একবার ভেবে দেখতে পারিস।”
প্রত্যাশা মাছি তাড়ানোর ভঙিতে বলল,
-” আরে ধূর!”
অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হওয়া বিয়ের কথা এখনো বন্ধুমহলে জানায়নি প্রত্যাশা। নিকট আত্মীয় স্বজন ছাড়া তেমন কেউই জানে না। বন্ধুমহলে এখনই বিয়ের কথা বললে —নানান বিপদ। যে বিচ্ছুটে বন্ধু। সবসময় মাথায় কাঁঠাল ভাঙার ধান্দায় থাকবে। এই বিয়ে হয়েছে ট্রিট দে, রোজরোজ আইসক্রিমের বিল দে, এটা কর-ওটা কর। একের পর এক লেগেই থাকবে। এতো গেলো খাওয়ানো নিয়ে। আবার তো এটাসেটা বলে লজ্জায় ফেলবে। বরের সাথে ফোনে কী কথা হলো! আরো কত কি! নানা ওই নীরব ঘা’ত’ক লোকটা তো একবারও ফোন দিয়ে কার্টেসি করল না। লোকটার মনে আছে কী না সন্দেহ! যে প্রত্যাশাকে সে কবুল বলে বিয়ে করেছে। তাই প্রত্যাশা আর আদিখ্যেতা করে বিয়ের কথা আগ বাড়িয়ে বন্ধুদের বলতে যাবে না। আবার ওদিকে কাল বিয়ের পর মামা সতর্ক করেন। চিন্তার রোগী মামা। সবকিছুতেই তার বেশি বেশি চিন্তা। কাটকাট গলায় বললেন– ওদের কেবল ইসলামীক ভাবে বিয়ে হয়েছে। আঠারো হতে আরো তিনমাস বাকি আছে বিধায় রেজিঃ হয়নি। ছেলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে বাল্য বিবাহ করেছে এটা নিয়ে কেউ শ’ত্রুতা করে কেস-টেস দিলে চাকরিতে সমস্যা হবে। তাই এখনই বেশি জানাজানি না করাই ভালো। আম্মুও মামার সাথে সহমত পোষণ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিলেন।
ঘরটা নিঃশব্দ। আলো-আঁধারিতে ঢাকা একটি কেবিন। দেয়ালে হালকা ধূসর রঙ, জানালায় মোটা সফেদ পর্দা; একপাশ দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়ে বিছানার ধারে। কোণায় একটি ছোটো টেবিলে সারি সারি ওষুধ আর ইনজেকশনের ট্রে। বেডে ঘুমিয়ে আছে একজন– রোগী। শুকনো মুখ, নিস্তেজ শরীর, চুল এলোমেলো, ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। পুরনো ইনজেকশনের দাগ, ফর্সা হাতে কিছুটা নীলচে হয়ে জ্বলজ্বল করছে।
বেডের সামনে বরাবর দাঁড়িয়ে নীরব। গাঢ় নীল শার্ট পরনে, চোখে স্থির, কঠিন দৃষ্টি। তার পাশে দু’জন নার্স। একজন অভিজ্ঞ বেশ পুরনো নার্স, আরেকজন সদ্য নিয়োগ পাওয়া নতুন নার্স–অল্প বয়সী। নতুন জন চোখে বিস্ময় নিয়ে নীরবের দিকে চাইছে তো ফের বেডের পেশেন্টের দিকে! মেয়েটির চোখে প্রশ্ন খেলে যায়। নার্স শাহানা হালকা গলায়, ভাঙাভাঙা শব্দে বলল,
-” স্যার, ইনজেকশন পুশ করে পেশেন্টকে আবার ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল… কাঁপছিল, চিৎকার করছিল।”
নীরব চোখ সরায় না পেশেন্টের থেকে। ওভাবে চেয়েই গলার স্বর কঠিন করেই জিজ্ঞেস করল,
-” এরমধ্যে কেউ এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে?”
-” জ্বী, স্যার। ওই ম্যাম এসেছিলেন।”
-” হু ইস সী?”
শাহানা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভ’য়ে ভ’য়ে বলল,
-” স্যার ভর্তির দিন যে ম্যাম আপনার সঙ্গে এসেছিলেন..
উনিই এসেছিলেন।”
নীরবের কণ্ঠের দৃঢ়তার রেষ কঠিন হলো,
-” আমি ছাড়া আর কেউ যেন পেশেন্টের সঙ্গে দেখা না করে। যতই বলুক, যত প্রমাণই দিক কাছের কেউ…আমি অনুমতি না দিলে কেউ না।”
-” ওই ম্যামও নয়?”
নীরব শান্ত চোখে শাহানার দিকে চাইল। বলল রুক্ষ স্বরে,
-” বাংলা কথা বোঝেন না? কেউ না মানে… কেউ না। ক্লিয়ার?”
নার্স অনুতপ্ত স্বরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-” ঠিক আছে, স্যার। আমি বলে দেব।”
-” ওকে, এবার আপনি আসতে পারেন।”
নীরব স্পেস চাইতেই শাহানা রিসেন্টলি জয়েন করা নার্সকে বলল,
-” চলো।”
মেয়েটার চোখে এখনও বিস্ময়। শাহানার কথা কানে ঢুকেনি। শাহানা বাহুতে মৃদু চাপ দিতেই মেয়েটির সম্বিৎ ফেরে। শাহানা ইশারা করতেই মেয়েটি পিছু পিছু প্রস্থান করে, আর কিছু ভাবে!
কেবিনটা যেন মূহুর্তেই আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নীরব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে পেশেন্টের বিছানার পাশে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চুপচাপ। চোখে ভর করে একরাশ অনুভূতি। ওর দৃষ্টি ঘুমন্ত মুখে; শুকনো ঠোঁট, শান্ত নিঃশ্বাস, এলোমেলো চুল। নীরব নিঃশব্দে হাত বাড়ায়…আলতো করে মাথায় হাত রাখে। এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ যেন বুকটা হু হু করে ওঠে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ঠোঁট ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে। পরপর চোখের সামনে ভেসে ওঠে কয়েকটা মুখ–প্রতিটা মুখ যেন এক একটা ছু/রি। নীরবের বাঁ হাতটা ধীরে ধীরে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে। আঙুলের গাঁটে কটকট করে শব্দ হয়। চোখে আ”গু”নের মতো একঝলক রা’গ জ্ব’লে ওঠে– শান্ত কিন্তু তীব্র। দৃষ্টির গভীরে জ্ব’লতে থাকে একটাই প্রতিজ্ঞা,
-” যাদের জন্য আজ এই অবস্থা….তাদের কাউকে একচুলও ছাড়ব না।”
সবশেষে ডক্টরের সাথে কথা বলে নীরব বেরিয়ে যায়।
কয়েকদিন পর…
আজকে শুক্রবার। নীলার মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে বলে বাবার বাড়িতে আছে। নিভানকে লাঞ্চের দাওয়াত করা হয়েছে। সেই সময় শফিক সাহেব ছোট জামাইকেও ফোন করে দাওয়াত দেন। তবে নীরব কাজের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যায়। গরমের দুপুরে কিচেনে অধরা ব্যস্ত বিভিন্ন পদ রান্না করতে। সাথে প্রত্যাশা মা’কে হাতে হাতে সাহায্য করছে। দেশি মুরগি ঝোলঝোল করে সেই রাঁধল। ছোট বেলা থেকে লাফিয়ে-লাফিয়ে বেড়ালেও ঘরকন্নার কাজ টুকটাক ভালোই পারে। ছোট থেকে একে-ওকে নিয়ে পিকনিক করত। নিজেই রান্না করত। সেই থেকে রান্নার ক্ষেত্রে বেশ অভিজ্ঞ। রান্নাবান্না প্রায় শেষের দিকে। অধরা ডিশওয়াশারে থাকা বাসন গুলো ধুতে ধুতে প্রত্যাশার দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল,
-” প্রত্যাশা, শুনলাম তুই নাকি সেদিন প্রাইভেট মিস দিয়ে বন্ধুদের সাথে পার্কে বসে আড্ডা দিয়েছিস?”
প্যানে ভাঁজি নাড়ছিল প্রত্যাশা। হঠাৎ এহেন কথায় ওর পিলে চমকে উঠার জোগার। খুন্তি সমেত হাতটা মৃদু কেঁপে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে তৎক্ষণাৎ বলল,
-” ক-কে বলল?”
-” কে বলল সেটা বড় কথা নয়? যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে।”
প্রত্যাশা আমতা আমতা করতে থাকে। অধরা কড়া চাউনিতে চেয়ে বলল,
-” রুমা ভাবি একটু আগে লেবু নিতে এসেছিলেন। উনিই বললেন।”
প্রত্যাশার কপালে বি’র’ক্তি’র ছাঁট পরল। ভাবল– রুমা আন্টি তো আবার পাড়ার সিসিটিভি ক্যামেরা। কোনো কিছু তার নজর এড়ায় না। শুধু কী তাই? এতেই ক্ষ্যান্ত দেয় না; তথ্য সংগ্রহ করে ঠিক যায়গা মত ডেলিভারি করার দায়িত্বও বিনে পয়সায়, স্বইচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যত্তসব!
অধরা রাগ করতে লাগল,
-” কী রে তুই! কবে তোর বুদ্ধি শুদ্ধি হবে? ক’দিন পর যার পরীক্ষা সে কী না পড়ার ধারই ধারে না। বই ছুঁয়ে ধরা যেন পা”প। বন্ধুদের সাথে আড্ডা করে বেড়ানো, ফোন নিয়ে থাকা; এতে এক্সপার্ট। রেজাল্ট খা’রাপ হলে, শ্বশুর বাড়ির লোকজন কী বলবে? এখন অন্তত একটু সিরিয়াস হ। তোকে এত করে বলি–এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিস। কোনো কথা গায়েই লাগে না তোর। উফ্ফ! কী দিয়ে যে তৈরি তুই? আল্লাহ মালুম!”
-” কেনো, তুমি জানো না আম্মু। আল্লাহ তো মাটি দিয়ে মানুষকে বানিয়েছে। তাই আমি মাটির তৈরি।”
দাঁত কেলিয়ে বলে প্রত্যাশা। অধরা মোটামোটা চোখে চাইল। রাগি স্বরে বলল,
-” নাহ, তুই বোধহয় লোহা দিয়ে তৈরি। এইজন্য হাজার কথা বললে, ব’কলেও তোর গায়ে লাগে না।”
-” ও আম্মু লোহাও কিন্তু মাটিরই একটা উপাদান। আমাকে তৈরির মাটিতে অন্যান্য উপাদানের চেয়ে লোহার পরিমাণ বোধহয় একটু বেশিই পড়েছিল…”
অধরা চোখ গরম করে চাইতেই প্রত্যাশা মুখে আঙুল তুলে ক্ষমা চাওয়ার ভঙি করল। বলল,
-” স্যরি..স্যরি! নাও আর উল্টাপাল্টা কথা বলে তোমার মাথা খাবো না, কেমন?”
কালো রঙের শাড়ি পরনে নীলার, শ্যাম্পু করা ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে রাখা। শাড়ির কুচি একহাতে ধরে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-” আম্মু নিভান এসেছে। এদিকে রান্নাবান্না কত দূর?”
-” নীরব আসেনি?”
মায়ের প্রশ্নের জবাবে নীলা বলল,
-” নাহ। নিভান ফোন করছে দেখলাম। তবে শুনিনি কী বলেছে নীরব। আসবে কী, আসবে না! নিভানের জন্য শরবত করতে তাড়াহুড়ো করে এখানে আসলাম। তাই..শুনে আসতে পারিনি।”
অধরা বলল,
-” ওহ। তোর বাবাকে বলেছিল, কী একটা কাজ আছে আজ হবে না। অন্যদিন আসবে। আজ মনেহয় আসতে পারবে না।”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ২
প্রত্যাশা আড়ালে মুখ বাঁকাল। বিড়বিড় করল–কাজ না ছাই! ফ্রাইডেতে এমন কী মহাকাজ! আসবে না, তাই অজুহাত। জানি জানি! একমাত্র বিয়ে ছাড়া ওই লোকের এ বাড়িতে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। এক ভাইয়ের বিয়ের দিন এসেছিল। আর দুই নিজের বিয়ের দিন। তবে বেয়াই সাহেব ওরফে বর মহাশয়ের সাথে একবার সাক্ষাৎ এর প্রয়োজন অনুভব করছি। সামনে পেলে জিজ্ঞেস করতাম– বেয়াই সাহেবের কী স্মরণে আছে—এ লং টাইম অ্যাগো, ওয়ান সাইলেন্ট নাইট; ইউ হ্যাড সেইড ‘কাবুল হাই’।