নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১
সিনথিয়া
“ ভার্সিটির প্রথম দিনই নিজের প্রফেসরকে ধরে চুমু খাওয়া কোন ধরনের ভদ্রতা মিস আরশি?”
হোয়াইট ফুল স্লিভ শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুই অবধি আনতে আনতে ইংরেজিতে কথাগুলো বলল শেহজাদ। তার নীলাভ চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা লাগানো।
বয়স ত্রিশের কোঠায় হলেও হলিউডের যেকোনো সুদর্শন পুরুষদের ভীরে এই নীলাভ চোখের মানুষটির চেহারাই যেনো সবার আগে নজর কাড়বে।
নিউইয়র্ক ইউনির্ভাসিটির মতো একটি সুবিশাল প্রাইভেট ভার্সিটির লেকচারার শায়ান শেহজাদ। মা বাঙালি হলেও বাবা একজন পাক্কা আমেরিকান। তাই ছেলেকেও ছোট থেকে বিদেশি আদব-কায়দায় বড় করেছেন তিনি।
মায়ের থেকে বাংলা ভাষাটা কোনোরকম রপ্ত করলেও বাঙালিয়ানার ছিটেফোঁটা টুকুও নেই ছেলের ভিতর।
শেহজাদ তার সরু নাকের ওপর থেকে চশমাটা ঠেলে ওপরে ওঠালো । পরপর দুহাত বুকে গুঁজে দুপা এগিয়ে আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো।
ক্লাসে পিনপতন নীরবতা।
কারো মুখে টুঁ-শব্দটিও নেই, অথচ সবাই জানে আরশি কি কারনে তাকে চুমু খেয়েছিল তখন।
যারা আরশিকে “বুলি” করার জন্য এমন একটা কাজ ওকে করতে বলেছিল, তাদের মধ্যে থেকেই একটা আমেরিকান মেয়ে বসে থেকে ইংরেজিতে বলে উঠলো –
“প্রফেসর, আমার মনে হয় আপনাকে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি বেচারি।
যতসব থার্ড ক্লাস আনকালচার্ড ছেলেমেয়েদের এতো বড় ভার্সিটিতে পড়াশুনোর সু্যোগ করে দেয়ার মাশুল হিসেবে ফিউচারে আরো কত কি যে দেখতে হবে “গড নোজ”!”
আমেরিকান মেয়েটার বিদ্রুপ মেশানো কথায় সহসাই চোয়াল শক্ত হলো শেহজাদের। কিন্তু ঐ মেয়েকে কিছু না বলে, পুরো রাগটা ঝাড়লো আরশির উপর। পশ্চিমা ভাষায় খেঁকিয়ে বলে উঠলো –
“কি কারণে এমনটা করেছো, সেটার উত্তর না দিতে পারলে ভবিষ্যতে আমার ক্লাসে ঢোকার দুঃসাহস দেখাতে এসো না কখনো!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এতো কিছু শোনার পরও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আরশি। মুখ থেকে একটা শব্দও বের করলো না।
কিন্তু বেঞ্চের উপরে রাখা ওর মুষ্টি বদ্ধ হাতের পিঠ মূহুর্তেই ভিজলো চোখের পানিতে। যেটা সবার চক্ষু এড়ালেও আরশির পাশে বসে থাকা মেয়েটার চক্ষু এড়ালো না।
আর কেউ কিছু না বললেও, ঐ মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো! শুধু শুধু নিরপরাধ কাউকে
তো এভাবে কষ্ট পেতে দেখা যায় না।
তাই সাহস করে নিজেই বলল-
“প্রফেসর, আরশির কোনো দোষ নেই! ঐ মেয়েগুলোই ক্লাসে আসার পর থেকে আরশির পেছনে লেগেছে। আপনাকে চুমুটাও ওরাই খেতে বলেছিল আরশিকে! এমনকি ওদের কথা মতো কাজ না করলে, এখানে আরশিকে পড়তে দেবে না বলে থ্রেট পর্যন্ত
দিয়েছিল ওরা!”
মেয়েটার সাহস দেখেই হয়তো ক্লাসের আরো কয়েকজন ওর কথায় সমর্থন জানালো। জানালো আরশি নিজে থেকে কিছুই করেনি, ওকে দিয়ে করানো হয়েছে সবটা আর যারা করিয়েছে এমনটা, তাদেরকেও ধরিয়ে দিলো সবাই।
শেহজাদ শীতল দৃষ্টি ফেললো সেই মেয়েগুলোর দিকে।
ঠান্ডা কন্ঠে শুধু বলল-
“ ক্লাস শেষে প্রিন্সিপালের রুমে দেখা করবে আমার সাথে! অল অফ ইউ!”
কিছুক্ষণ আগে আরশিকে অপমান করা মেয়েটা হাসফাস করে উঠলো যেনো! নিজের দোষ ঢাকতে নিজের বন্ধুদের ফাঁসিয়ে দিতে চাইলেও সুযোগ দিলো না শেহজাদ।
বা হাতে গলার টাই ঠিক করতে করতে ওদের সামনে গেলো! বাঁকা হেসে নিজের স্বভাবসুলভ পশ্চিমা ভাষায় বলল-
“ আসলে হয়েছে কি জানো তো, আমার তোমাদের মতো হাই-সোসাইটিতে মারাত্মক এলার্জি আছে।”
পরপর থুতনিতে হাত দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করার ভঙ্গিমায় ওদের থেকে হেঁটে গিয়ে ক্লাসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল-
“ তাই ঠিক করলাম, তোমাদের মতো হাই-সোসাইটির ছেলেমেয়েদের আমি আমার ক্লাসে কেনো, এই ভার্সিটিতেই রাখবো না! যারা ক্ষনিকের আনন্দের জন্য অন্যকে বিপদে ফেলার কথা চিন্তা করে তাদের আমি ঘৃণা করি!”
আঁতকে উঠলো মেয়েগুলো! কিন্তু নিজেদের হয়ে সাফাই গাওয়ার আগেই ক্লাস শেষের সাইরেন বেজে উঠলো করিডর থেকে।
নিজের ওভার কোটটা হাতে চাপিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরশির পাশাপাশি দাঁড়ালো শেহজাদ।
সবাই যখন যে যার ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ব্যস্ত তখন আরশির কানের কাছে ঝুঁকে আসলো পুরুষালী খাদে নামানো কন্ঠ!
“আজকের চুমুর জন্য শাস্তি তো তুমি পাবে, তবে এখানে নয়, বাসায় ফিরে সেই শাস্তি দেবো তোমাকে! বি রেডি মাই ডিয়ার ওয়াইফ!”
কেপে উঠলো মেয়েটা। ভীত চোখে পাশ ফিরে তাকানোর আগেই রুম ছাড়লো সেই কন্ঠের অধিকারী।
ক্লাস শেষে করিডোরের পথ ধরেছে স্টুডেন্টরা। আরশি তড়িঘড়ি করে বের হয়ে ওর পাশে বসা সেই মেয়েটার কাছে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল-
“থ্যা-থ্যাংক ইউ! ফর হ্যাল্পিং মি আর্লিয়ার!”
“জারা!”
আরশি থমকালো। “থ্যাংক ইউ”র প্রতি উত্তর শুনে অপ্রস্তুত হেসে নিজেও জারার মতো করে বলল-
“আরশি। আমেরিকান?”
“উহু! খাঁটি বাঙালি!”
আরেক দফা চমকালো আরশি। ওর চমকে যাওয়া মুখ দেখে হেসে ফেললো জারা। বলল-
“অবাক হলে তো?”
আরশি ওপর নিচ মাথা দোলালো। কিন্তু অবাক হওয়ার চাইতেও একজন দেশীয়
মানুষ পাওয়ায় আনন্দ বেশি হচ্ছে ওর।
জারা মেয়েটা বেশ ভালো। নীল চোখের এই অধিকারিনীর বেশভূষা কিন্তু বেশ ছিমছাম আর ব্যবহার? সে তো অমায়িক! মনে মনে ভাবলো আরশি। যাক! এই ভিনদেশে ভালো মনের কেউ অন্তত আছে।
“কোথায় থাকতে বাংলাদেশের?”
জারার প্রশ্নে ধ্যান ভাঙলো আরশির।
“ উমম, গাজীপুরে ! তুমি?”
“আরেহ! আমিও তো গাজীপুরেই থাকতাম! দেখলে গাজীপুরের মতো মফস্বলে থাকতে দেখা হলো না, কিন্তু আমেরিকার মতো এতো বড় একটা দেশে এসে ঠিকই দেখা হয়ে গেলো! ”
হাসলো আরশি। বলল-
“না মানে, তুমি না বললে আমি হয়তো বিশ্বাসই করতে পারতাম না, যে তুমি আমেরিকান নও!”
হাসিখুশি মুখের আড়ালে থাকা মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো সহসা জারার। কিন্তু আরশি এই বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন করার আগেই কথা ঘুরিয়ে ফেলল সে। বলল-
“তা এখানে কোথায় থাকছো?!”
এ দফায় মুখ ভার হলো আরশির। কোথায় থাকছো না জিজ্ঞেস করে, কোন জাম্বুবানের গুহায় থাকছো জিজ্ঞেস করলে, ওর জন্য উত্তর দিতে বোধ হয় বেশি সুবিধা হতো!
তবুও ধরে আসা গলায় কোনমতে বলল-
“ বেশি দূরে নয়! “ম্যানহাটনে”ই থাকি! একটু হেঁটে গেলেই আমার আর আমার হাজবেন্ডের বাসা! আর তুমি?”
আরশি বিবাহিত শুনে জারা প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও মূহুর্তেই সামলে নিলো নিজেকে। কম বয়সে বিয়ে হতেই পারে। এটা তো স্বাভাবিক। সবাই কি আর ওর মতো বিয়ে বিদ্বেষী নাকি? আর এতো বড় শহরে নিজের বলতে আরশির যে কেউ আছে এটা ভেবেই ভালো লাগলো জারার।
“প্রথমে হোটেলে থেকেছি। কিন্তু যা বুঝলাম, তাতে হোটেলে থাকতে গেলে, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগেই আমার ফকির হয়ে যাওয়া লাগবে!
তাই আজকেই সকালে একটা ভাড়া বাসা ঠিক করে ভার্সিটি এসেছি। “চেলসি”তে। তবে একটা সমস্যা হয়েছে জানো তো! আমার ফ্লাটমেট নাকি ছেলে! কিন্তু এই মূহুর্তে আমার পক্ষে এর থেকে বেশি ভাড়া দিয়ে অন্য কোথাও থাকা পসিবলও নয়। তাই আর না করিনি এখানে!”
আরশি ছেলে ফ্লাটমেটের কথা শুনেই আঁতকে উঠলো। বলল-
“সে কি! পড়ে যদি কোনো বিপদ-”
আরশি শেষ করার আগে জারাই বলে উঠলো –
“ তায়কোয়ান্দোতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া আমি! উল্টো পাল্টা করলে জায়গা মতো লাথি দিয়ে সারাজীবনের জন্য শুইয়ে দিতে পারবো!”
জারার এই কথাটাতে না চাইতেও হেসে ফেলল আরশি। তবুও জারার জন্য ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলে!
ইশ! মেয়েটাকে কত স্ট্রাগল করে থাকতে হচ্ছে এই অচেনা জায়গায়। ও যদি নিজে ঐ জাম্বুবানটার সাথে না থাকতো, তাহলে তো জারাকে ওর সাথেই থাকতে বলতে পারতো!
আরশির ভাবনার মধ্যেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরলো ওরা। দুজনের রাস্তা আলাদা হওয়ার আগেই জারা হাত বাড়ালো আরশির দিকে। মুচকি হাসি বলল-
“তাহলে আজ থেকে আমরা ফ্রেন্ডস্? তাই তো?”
আরশিও হেসে জারার সাথে হাত মিলিয়ে বলল-
“একদম!”
রাতের “ম্যানহাটন” সিটি যেনো এক জাদুর শহর। লাল, নীল সবুজ আলোয় আলোকিত সুউচ্চ সব ইমারত সাথে সুবিশাল আকাশ।
সন্ধ্যার পরপরই রেস্তোরাঁ গুলোতে মানুষের ভীর হট্টগোল, রাস্তায় সাই সাই করে ছুটে চলা বাস, টেক্সি সবকিছুই যেনো উপভোগ করার মতো।
আরশি এসব দেখতে দেখতে বাসায় ফিরলো।
বসার ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ব্যাগ রেখেই নেমে পড়লো কাজে। নিজে ফ্রেশ হওয়ার আগে ঘর পরিষ্কার করে, রাতের খাবার রান্না করে একটা লম্বা শাওয়ার নিতে শাওয়ার রুমে ঢুকলো মেয়েটা।
গত দুসপ্তাহ ধরে এটাই ওর রুটিন। ঘরের কাজ করো, কিছু লাগলে সুপারমার্কেট থেকে নিয়ে আসো, একা একা খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়ো।
কারণ আরশির জাম্বুবান কোনোদিনও সময় মতো বাসায় ফেরে না। আর যদিও কোনোদিন ফেরে, সেটা আরশি দেখেও না দেখার ভান ধরে থাকে। নিজে থেকে টুঁ-শব্দটিও করেনা। মানে শুধু শুধু কথা বলতে গিয়ে কারো ধমক খাওয়ার তো কোনো মানে হয় না!
কিন্তু বিধিবাম! আজকে আরশির গোসল শেষ হতে না হতেই বাসার গেট খুলে ভিতরে ঢুকলো ক্লান্ত শ্রান্ত একটা মুখ।
দরজা খোলার আওয়াজ শুনেই হৃদপিন্ড যেনো মূহুর্তের জন্য থেমে গেলো আরশির।
কোনোমতে গায়ে টাওয়াল পেঁচানোতে বুকের ওপর থেকে ওটা পড়ে যেতে নিলো সহসা।
অমনি পেছন থেকে আচমকাই সেটা শক্ত হাতে ধরে ফেলল কেউ একজন।
মূহুর্তেই “ক্রিড এভেনটাসে”র ফ্রুটি, উডি এবং মসকি একটা সুগন্ধে ভরে গেলো আরশির আশপাশ।
পরিচিত পারফিউমের গন্ধে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো আরশি। এক হাত দিয়ে আরশির গায়ের টাওয়াল ধরে রেখে ওর উন্মুক্ত ঘাড়ে উষ্ণ শ্বাস ফেলল কেউ একজন।
“বলেছিলাম না? আমাকে কিস করার শাস্তি বাসায় ফিরে তোমাকে পেতে হবে ?”
আরশি বরফের ন্যায় জমে রইলো শেহজাদের কথা শুনে। কিন্তু মানুষটা সেসব পরোয়া করলে তো!
পেছন থেকেই গভীর চুমু বসালো আরশির খোলা পিঠে। নিশ্বাস আটকে আসলো মেয়েটার। পরপর চুমু খেলো ওর গলায়, তারপর কানে। তারপর চিবুকের উপরের অংশে। মানুষটার প্রতিটা স্পর্শে
উষ্ণ গোঙানির মতো আওয়াজ করলো আরশি। তখনই কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে লোকটা বলল-
“শায়ান শেহজাদ সত্যি সত্যি শাস্তি দিলে, সহ্য করতে পারবে তো?”
অসম্ভব! কি করে পারবে ও? এটুকুতেই নাভিশ্বাস ওঠার পালা! আর কি শাস্তি দেয়ার বাকি আছে জাম্বুবানটার ওকে?