ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৫

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৫
মিথুবুড়ি

“পা-পা-পাপ-পাপ্পা,,,
“পা-পাপা,,
‘পাতলা কণ্ঠের আধভাঙা স্বর ঘুমঘোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে চলেছে। ছোট ছোট হাত-পা ছুঁড়ো-ছুঁড়ি, দস্তাদস্তির মৃদু শব্দ বিছানার নরম কাপড় ছুঁয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। রিচার্ড কপাল কুঁচকে চোখ মেলে। ঢেউ খেলানো বুক থেকে গুটিশুটি মেরে আড়ম্বরে ঘুমিয়ে থাকা এলিজাবেথকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে ওর নগ্ন শরীরটা কম্ফোর্টার দিয়ে ভালো করে মুড়ে দিল। ঘুম আজ বেশ গাঢ়, বালিশে মাথা রাখতেই এলিজাবেথ ঘুরে ছোট মেয়েটাকে বুকে মিশিয়ে আবারও ঘুম রাজ্যে পাড়ি দিল। কাল রাতে তিনজনই শেষরাতে জায়গা পেয়েছিল মাম্মা পাপার মাঝে। রিচার্ড স্মিত হেসে পাশে ঘুরতেই দেখতে পেল তার বড় পরি ওঠে পড়েছে। ছোট ছোট আঙুল গুলো মুখের ভিতর ঢুকিয়ে রেখেছে,ক্ষিধে পেয়েছে সম্ভবত। গলা প্রসারিত করে হাসল রিচার্ড। কনুই বিছানায় ঠেকিয়ে হাতের তালুতে মাথা রেখে মেয়ের মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিল আলতো করে। পাশে ছেলেটা এখনও ঘুমাচ্ছে নির্বিঘ্নে, একদম নিশ্চিন্তভাবে।
‘রিচার্ডকে দেখামাত্রই বাচ্চাটার চোখ জ্বলে উঠল। উচ্ছ্বাসে হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে কচি গোলাপি ঠোঁট নাড়িয়ে একনাগাড়ে বলতে লাগল,

“পাপ… পাপ্পা…!”
‘রিচার্ডের হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে গেল মেয়ের মুখ থেকে ‘পাপা’ ডাক শুনে। ঝুঁকে মেয়ের লাল টুকটুকে গালে ঠোঁট ছোঁয়াল। বাবার স্পর্শে যেন শিশুটির শরীরে এক মিষ্টি শিহরণ বয়ে যায়। সে থামতে জানে না, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”পা… পা… পাপ্পা…!”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে হাসল। মেয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “নো প্রিন্সেস, শব্দ করে না। মাম্মা ঘুমাচ্ছে। কাল সারারাত পাপার জন্য মাম্মা একটুও ঘুমাতে পারেনি। মাম্মাকে একটু ঘুমাতে দাও সুইটহার্ট।”
‘অবুঝ ছোট্ট মন বোঝে না এসব সংযত কথাবার্তা। তার মুখ ততক্ষণে বিরতিহীন চলতে থাকল। এদিকে ছেলেও তার শব্দে ঘুম থেকে ওঠে যায়। ঘাড় কাত করে পাপাকে দেখতে পেয়ে ই হাত-পা ছোড়াছুড়ি শুরু করল। ঠিক তখনই এলার্ম বেজে উঠে। রিচার্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলগোছে বেড থেকে উঠল। এখন তার জিম টাইম আর বাচ্চাদেরও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। রিচার্ড একবার ফিরে তাকাল এলিজাবেথের দিকে। মা-মেয়ে আরামে ঘুমিয়ে আছে। ওদের ঘুম নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না তার। তাই নিঃশব্দে উঠে দুই সন্তানের জন্য ফর্মুলা মিল্ক বানিয়ে নিল। বড় দুজন কে খাইয়ে ছোট মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য কাছে যেতেই দেখল, সে ইতিমধ্যেই মায়ের বুক থেকে দুগ্ধপান করছে,সাথে ছোট্ট মুখে চপচপ শব্দ তুলছে। সকালের কি এক অপূর্ব দৃশ্য!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘রিচার্ড মুচকি হাসল। নুইয়ে মেয়ের কপালে স্নেহের চুমু এঁকে দিল,অতঃপর আলতোভাবে বৌয়ের কপালেও ছুঁয়ে দিল ভালোবাসায়। পরপরই বাকি দুই জনকে স্ট্রলারে বসিয়ে বেরিয়ে পড়ল তার ব্যক্তিগত জিমের উদ্দেশ্য। রুফটপে সুইমিং পুলের পাশে তৈরি নিজের ব্যক্তিগত জিমনেসিয়ামে গিয়ে থামল রিচার্ড। বাচ্চাদের বয়স এখন সাড়ে সাত মাস। তাদের মধ্যে ছোট মেয়েটা জন্ম থেকেই একটু শারীরিকভাবে দুর্বল, তাই তাকে নিয়ে খাটতেও হয় বেশি। সারাদিন এলিজাবেথকে মেয়ের পাশে থাকতে হয়।
‘সকালের কোমল আলোয় জীবনে এক টুকরো প্রশান্তি ধরা দেয় রিচার্ডের কাছে। ট্রেডমিলের ওপর ছন্দোবদ্ধ পদক্ষেপে শরীরচর্চায় নিমগ্ন থাকলেও দৃষ্টি তেরচা হয়ে আছে সামনে। এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরে না—দুই সন্তানের নিষ্পাপ উচ্ছ্বাসে মুগ্ধ হয়ে রয়েছে রিচার্ড। ছোট্ট দুটি উজ্জ্বল মুখের খিলখিল হাসিতে ভরে ওঠেছে চারিধার। রিচার্ডের সুঠাম, প্রশস্ত বুকে ঘামের কণা ঝরে, সূর্যের আলোয় সেগুলো মুক্তোর মতো ঝিলমিল করে ওঠে। বিস্ময়ে হতবাক গোলগোল চোখগুলো পিটপিট করে তাকিয়ে তাকিয়ে আছে পাপার বলিষ্ঠ শরীরের দিকে। ছেলে ব্যাকুল হয়ে দু’হাত বাড়ায়, যেন এখনই সেও বাবার সঙ্গে দৌড়তে চায়।

‘রিচার্ড ট্রেডমিল থেকে নেমে সাদা মখমলের তোয়ালে দিয়ে মুখের,শরীরের ঘাম মুছে নেয়। অতঃপর সন্তানের আকুল আহ্বানে এগিয়ে যায়।দু’জনকেই এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল। শিশুরা আনন্দে হাত-পা ছোঁড়ে, বাতাস কাঁপে তাদের রিনঝিনে হাসিতে। রিচার্ড আবার ওঠে ট্রেডমিলে। এবার একা নয়, বুকের মাঝে আটকে রাখা তার সবচেয়ে বড় অহংকার, সবচেয়ে গর্বের সম্পদ। সতর্ক পদক্ষেপে দু’জনকে দু’বাহুতে নিয়ে দৌড়াতে থাকে। বাচ্চারা মহা খুশি,তাদের খুশিতে খুশি পাপা।
‘শরীরচর্চা শেষে ওদের নিয়ে রুমে এল রিচার্ড। পশ্চিমের আকাশে সূর্য তখন তির্যক রশ্মি ছড়াচ্ছে৷ সোনালি আভায় ভরে উঠেছে ঘর। ব্যায়ামের মাঝেই বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে পাপার কোলে। রিচার্ড রুমে এসে দেখল তার ছোট্ট পরিটা তখনও গভীর ঘুমে। মৃদু হাসল সে। বাকি দু’জনকেও স্নেহভরে পাশে শুইয়ে দিল।৷ ঘুমন্ত শিশুদের চেহারায় যেন স্বর্গীয় স্নিগ্ধতা। নিষ্পাপ মুখগুলোয় শান্তির ছাপ। পুরোই নিখুঁত কোনো চিত্রকর্ম। ওরা পেয়েছে মায়ের মতো লাল টুকটুকে গাল, টসটসে পলাশফুলের পাপড়ির মতো গায়ের রং। চেহারা বাবার অনুরূপ হলেও ছেলে পেয়েছে মায়ের চুলের ঢেউ, স্বর্ণাকেশ আর মেয়ে দু’জন যেন বাপের কার্বন কপি। নীল চোখ থেকে শুরু করে প্রতিটি ভঙ্গিতে রিচার্ডের প্রতিচ্ছবি।

‘রিচার্ড আলতো করে ওদের ছোট ছোট হাতের আঙুলে নিজের আঙুল বুলিয়ে দেয়, উলটেপালটে দেখে মায়াভরা চোখে। হা করে ঘুমানো নিষ্পাপ মুখগুলোর কোনায় একচিলতে লালা বেয়ে পড়ছে। রিচার্ড স্নেহভরে হাত দিয়ে মুছে দিল৷ সে সারাক্ষণ ই ভালোবাসার কোমল পরশে জড়িয়ে রাখে নিজের ধনেদের।
“কে জানি বলেছিল আমি ঘর করার ছেলে না। এখন এই তিনটে আসলো কোথা থেকে হুহ?”
‘পিছন ঘুরল রিচার্ড। এলিজাবেথ বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছে। রিচার্ড ঠৌঁট কামড়ে হেসে ভ্রু নাচাতে নাচাতে উঠে দাঁড়াল।
“কি জানি রাত হলে কি হয়ে যায়।” বলেই খোপ করে এলিজাবেথ কোমর আঁকড়ে ধরল রিচার্ড। সকাল সকালই এহেন কান্ডে ভরকে যায় এলিজাবেথ। পরক্ষণেই সয়ে নিল তার স্বামী অভদ্র জনিত কাজকর্ম,এখন রয়েসয়ে গিয়েছে এসব। ওর কপালের বেবি হেয়ার গুলো কানের পাশে গুঁজে দিল রিচার্ড। ঝুঁকে কানের লতিতে ঠৌঁট ছুঁইয়ে হিসহিসিয়ে জানতে চাইল,

“পজিটিভ?”
‘এলিজাবেথ চমকে উঠল। ঘাড় তুলে রিচার্ডের চওড়া তামুকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে নৈঃশব্দে দু’পাশে মাথা নাড়াল। চ’শব্দ উচ্চারণ করে রিচার্ড নাকমুখ কুঁচকে ফেলল রিচার্ড। বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
“উফসসস!! আমার ঘাম গুলোই বৃথা গেল।”
‘ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো খেঁকিয়ে উঠল এলিজাবেথ,”কিহ! আপনি জানতেন? তার মানে আপনি ইচ্ছে করে এমন করতেন-এতো বাড়াবাড়ি? চাইতেন এমনটা হোক তাই নাহ?”
‘চাপা হাসল রিচার্ড। আবারও ওর কানের লতির কাছে ঠৌঁট নিয়ে শীতল স্পর্শ দিয়ে বলল,”হ্যাঁ। আমি আরো দু’টো মেয়ে চাই। দিবে না আমায়?”
‘এলিজাবেথের বুকে মৃদু স্নিগ্ধ কম্পন হল। লাজুকতার লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ল অবয়বে৷ গালেপথে সরব হাসি রেখে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরল রিচার্ডের ঘাড়। সমুদ্রের নীলাম্বরে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলল,
“দেখলেন, আপনি মেয়ে জাত ঘৃণা করতেন। তাই উপরওয়ালা প্রথমেই দু’দুটো কন্যা সন্তান দিয়েছে আপনাকে। এখন আরও চাইছেন।”

‘রিচার্ড ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। সবেগে অবিলম্বে আওড়াল,”অল ক্রেডিট গোস টু ইউ ওয়াইফি।”
‘এলিজাবেথ হাসল, মাথা ঠেকাল রিচার্ডের বুকে। তার চিরস্থায়ী প্রাচীরসদৃশ উষ্ণ আশ্রয়ে। কিছুক্ষণ নীরব বোঝাপড়া চলল দু’জনের মধ্যে। রিচার্ডের হাত এলোমেলো পথে হাঁটতে শুরু করল, সুখের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিলেমিশে। প্রতিটি আঙুল ভালোবাসা, প্রতিটি ছোঁয়ায় মিশে আছে নিবিড় অধিকার। এলিজাবেথ কেঁপে উঠে বারবার,প্রতিটি ছোঁয়ায়। ঘনিষ্ট নিরবতায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকল নীরব শ্বাস-প্রশ্বাসের মিষ্টি সংগীত। তবে ভর সকালে এতো উন্মাদনা? এলিজাবেথ ছটফট করে নিজের ওষ্ঠ ছাড়িয়ে নিল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ছাড়ুন প্লিজ। সকাল সকালই কি শুরু করেছেন। মাত্র শাওয়ার নিয়ে এলাম।”
‘রিচার্ড ভ্রু বাঁকাল,”আমাকে ছাড়া? মানতে পারলাম না, চলো আবার একসাথে করি।”
‘রিচার্ড ওকে টেনে বাথরুমে ঢুকে পড়তে চাইলে এলিজাবেথ দরজা আঁকড়ে ধরে। গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে বলল,”আরে কি করছেন?বাচ্চাদের ঠান্ডা লেগে যাবে তো৷”
‘বাচ্চাদের কথা শুনে রিচার্ড এক মুহূর্তেই গম্ভীর হল রিচার্ড। ছেড়ে দিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,”আমাকে আরেকটু ডেডিকেটেড হতে হবে। বুঝলে, রেড?”

‘এলিজাবেথ চোখ কপালে তুলে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”এতদিন বুঝি ডেডিকেশন ছিল না, তাই না?”
‘রিচার্ড বাঁকা হাসল। হঠাৎ এক ঝটকায় ওকে টেনে নিয়ে বুকের ওপর ফেলে দিল। লালচে আভাময় নাকের ডগায় টুস করে একটা চুমু খেয়ে হাস্কি গলায় বলল,
“ছিল! অবশ্যই ছিল। তবে এবার মনে হচ্ছে একটু গাফিলতি হয়েছে। বুঝেছি আমাকে আরেকটু হার্ড ওয়ার্ক করতে হবে।”
‘এলিজাবেথের বুক শুকিয়ে গেল। তড়িঘড়ি মাথা নাড়িয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
“প্লিজ না! আমি মরে যাবো। আপনার এই ডেডিকেশনই আমার জন্য আতঙ্ক!”
‘রিচার্ড অম্লান মুখে বলল,
“এইরকম ডেডিকেশন প্রতিটি প্রেমিক পুরুষের থাকা উচিত। তাহলেই দেশের জনসংখ্যা বাড়বে। ভাবছি পরের বছর নির্বাচনে দাঁড়াব। অর্ধেক সংখ্যক ভোট তো নিজ গৃহ থেকেই পাওয়া যাবে, তাই না?”
‘এলিজাবেথ রিচার্ডের বুকে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল,
“দিনকে দিন অসভ্যতার ওপর পিএইচডি করছেন আপনি!”
‘রিচার্ড নাক সেটকানো। বাচ্চাদের মতো মুখ বানিয়ে বলে,

“এভাবে বল না ওয়াইফি। তোমার মা হওয়ার পেছনে আমার অবদান তুমি অস্বীকার করতে পারো না।”
‘এলিজাবেথ হতাশায় মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠোঁট কাটা স্বভাব এবার বর্জন করুন। তিন সন্তানের বাবা হয়েছেন।”
‘রিচার্ড ভ্রুকুটি করল, গলায় ক্রুর অথচ বিদ্রূপাত্মক সুর।
“ঠোঁট কাটা স্বভাব ব্যক্তিত্বহীনদের থাকে। আমি রিচার্ড কায়নাত, অর্থহীন কথা বলে জোকারের সম্মাননা নেব কেন? আমি কাজের মানুষ, একশনে বিশ্বাসী। বিশ্বাস হচ্ছে না? বিছানায় তাকাও—দেখো, তিনজন কত শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।”
‘এলিজাবেথ তাকাল। নিঃশ্বাস গভীর হলো তিন নিষ্পাপ মুখের প্রশান্তিতে। চোখ ঘুরতেই দৃষ্টি গেল দেয়াল ঘড়িতে। মুহূর্তেই বুক চেপে এল। রিচার্ডের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“হয়েছে এবার, ছাড়ুন। বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে।”
‘কে শোনে কার কথা? রিচার্ড কায়নাত শুনেছিল কবে কার কথা? সে অনড় অবস্থায় নাক ঘষতে থাকে এলিজাবেথের গ্রীবায়। ছোট ছোট উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিতে দিতে জড়িয়ে আসা কণ্ঠে বলল,”লেট মি ইট ফার্স্ট।”
“প্লিজ। ওদের খাওয়ানোর সময় হয়ে গিয়েছে।”
“ফ্যাক্টরি ইজ মোর ইম্পটেন্ট দ্যন প্রোডাক্টস।”
“মানে?”

‘মুখ তুলল রিচার্ড। ভেবাচেকা খেয়ে যাওয়া অবয়বে চেয়ে চোখ টিপল,”ফ্যাক্টরি সচল থাকলে প্রোডাক্টস যতখুশি ততো উৎপাদন করা যাবে।”
‘কান দিয়ে গরম বাষ্প বের হল কয়েক দফা। এবার বেশ শক্ত হল এলিজাবেথের কণ্ঠ,”আই সেইড স্টপ।”
‘থামার বিপরীতে নতুন উদ্যমে সংযম হারা হল রিচার্ড। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ফিসফিসিয়ে ওঠে,”ইট’স টু লেট টু সে দ্যট।”
‘কিছু বলতে যাবে তখনই রিচার্ডের ফোন ভেজে উঠে। এলিজাবেথ অসহায় স্বরে বলে,”আপনার ফোন রিং হচ্ছে। এখন তো ছাড়ুন।”
‘রিচার্ড কেবিনেট থেকে ফোন নিয়ে এলিজাবেথের হাত দিয়ে শুদ্ধতার এক মৃদু স্রোতে ডুব দিল।
“আন্সার ইট এন্ড টেল দ্যাট মাদার ফাকার, ইউ আর মাই ওয়াইফ, এন্ড আম’ম বিজি উইথ মাই ওয়াইফ।”
“উফপপ! ক্ষিদে পেয়েছে আমার।” বিরক্তে মৃদু চেঁচাল এলিজাবেথ। ওর রক্ত জবার অঞ্জলির ন্যায় ঠৌঁটে ঠান্ডা বরফ বৃদ্ধাঙ্গুল রেখে থামিয়ে দিল রিচার্ড। ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারায় বলল,
“লেটস কুক টুগেদার ইন মাই বেজমেন্ট। কথা দিচ্ছি স্বাদের কমতি হবে না।”

“ওয়াও, ওয়াও, ওয়াও!” কচি কণ্ঠের তিনটা ক্রন্দন প্রতিধ্বনি হতে না হতেই রিচার্ড ছুটে গেল বেডের কাছে। ছোট্ট মেয়েটা উঠে পড়েছে, পাশে কাউকে না পেয়ে কান্না জুড়ে বসে। তবে তার পাপা মুহূর্তেই তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কোমল ফিসফিসে আশ্বাসে কান্না মুছে দিলো। এলিজাবেথ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সন্তানদের প্রতি রিচার্ডের নিখাদ ভালোবাসা তার হৃদয় উষ্ণ করে দেয়। চোখ গেল হাতের তালুতে রাখা রিচার্ডের ফোনে,স্ক্রিনে ফুটে আছে এক সুন্দর পারিবারিক ছবি, তাদেরই প্রতিচ্ছবি।
‘ছবিটা আরও দু’মাস আগের। ওরা প্রথম ফ্যামিলি ভেকেশনে মালদ্বীপে গিয়েছিল। মালদ্বীপের সোনালি সূর্যের নিচে, সাগরের ঢেউয়ের মৃদু সঙ্গতে, ফুলে সাজানো বালির ওপর শুয়ে ছিল ওরা—একটি নিখুঁত পারিবারিক মুহূর্ত। এলিজাবেথের বুকের ওপর ছেলে বাবু আর রিচার্ডের বুকে মেয়ে বাবু, পায়ের কাছে আরেকটি ছোট্ট মেয়েটা—তিনটি নিষ্পাপ মুখ প্রশান্ত ঘুমে। ভালোবাসায় মোড়া সে দৃশ্য তখনই পেছন থেকে ক্যামেরায় বন্দি হয়েছিল এক স্বপ্নময় স্মৃতি হয়ে।

‘শুক্রবার মানেই তাদের জন্য একান্ত সময়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ম্যানশনের গার্ড, মেড সবাই ছুটিতে। রিচার্ডের অফিসও বন্ধ। বাচ্চারা রুমে পাপার সঙ্গে দস্যিপনায় মেতে আছে, আর ছোট মেয়ে এলিজাবেথের সঙ্গে কিচেনে, স্ট্রলারে ঘুমিয়ে। রিচার্ড থাকলে রান্নার দায়িত্ব নেয় এলিজাবেথ, আর বাচ্চাদের সামলায় সে। গুনগুন সুরে গান গাইতে গাইতে সবজি কাটছিল এলিজাবেথ। দুপুরের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভালোবাসায় মোড়া এই একান্ত দিনের জন্য।
“আই লাইক ব্যাড বয়’স, লাইক ইউ৷”
“নো ওয়াইফি! ইট সুড বি আই লাইক ব্যাড বয়, লাইক ইউ। এন্ড ইউ নিউ ইট, হাউ মাচ ব্যাড আই ওয়াজ।”
‘থমকাল এলিজাবেথ, গতি থামল হাতের। দু’টি হাত পিছন থেকে ধীরে ধীরে কাপড়ের ভাঁজ গলিয়ে উন্মুক্ত উদলে বিচরণ শুরু করে। পুরুষালি রুক্ষ থুতনি পড়ল কাঁধে। নিকোটিনের ধোঁয়ায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ওষ্ঠ কান ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,
“প্লিজ সে ইটস নট জাস্ট বিকজ আই মেইক ইউ স্ক্রিম এভরি নাইট দ্যাট আই’ম আ ব্যাড বয়।”
“চুপ।”
“হবে নাকি একবার?”
“কিহ?”
“মিসেস কায়নাত একটু কিছু হোক? প্লিজ! বাচ্চারা তো ঘুমাচ্ছে, চলুন না এই ফাঁকে আমরা একটু বেজমেন্ট থেকে ঘুরে আসি কয়েক ঘন্টার জন্য। ডোয়ান্ট ওয়ানি, একদম সাউন্ড প্রুফ৷ আজকে আপনার চিৎকার, চেঁচামিতে বাচ্চারা উঠে পড়বে না৷”
‘ঠৌঁট কামড়ে হেসে পিছন ফিরল এলিজাবেথ। ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে একই টোনে বলল,”আই লাইক ইউর লিপ’স মি.কায়নাত।”

‘রিচার্ড ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্ষুধার্ত এক বুনো পশুর মতো, বিপরীত ওষ্ঠ কামড়ে ধরল তীব্র আকাঙ্ক্ষায়। এলিজাবেথের আঙুল কাঁপতে কাঁপতে খামচে ধরল তার বুকের পেশল মাংস। রিচার্ডের মোলায়েম ছোঁয়ায় এলিজাবেথের কায়া গলে আসতে থাকল ধীরে ধীরে। ভালোবাসার নিঃশব্দ ভাষা ক্রন্দনে রূপ নিল, অথচ কোনো অশ্রুর সাক্ষ্য রইল না। ঘন নিঃশ্বাসের ছন্দে ভারী হয়ে উঠল চারপাশের আবহাওয়া। বাতাসও তাদের উন্মত্ততায় মত্ত হয়ে উঠেছে। একে অপরকে আঁকড়ে ধরে, ছুঁয়ে, খুঁজে নিতে থাকল গভীরতার শেষ প্রান্ত। সময়ের হিসেব থমকে গেল। মিনিট কয়েক পর অবশেষে ক্লান্ত হয়ে এলিজাবেথ মাথা রাখল রিচার্ডের বুকে। দুজনের শ্বাস একসাথে হাঁপাতে থাকল, সময়ের চেয়েও গভীর এক বোঝাপড়ায়।
“মাই লিপস আর মোর প্যাশোনেট হোয়েন ইটস কাম টু ইউ, রেড।”

‘ঘন নিঃশ্বাস নিসরাত অবস্থায় এলিজাবেথ তাকাল রিচার্ডের দিকে। লজ্জার পীড়নে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে অবয়ব। অনুভূতির জোয়ারে ভাসছে অম্তকঃকরণ। দুটো খাদযুক্ত দৃষ্টিতে মিশে গেল, স্বকীয়তা খোয়ালো। অলিন্দের গুপ্ত প্রেম জোয়ারে ন্যায় ভেসে ওঠল চোখে৷ রিচার্ডের উষ্ণ হাতের উপর হাত ছোয়ালো এলিজাবেথ। রিচার্ড তড়িৎ বেগে ওর কোমর শক্ত করে চেপে ধরে সিঙ্কের উপর বসিয়ে দিল। আলিঙ্গনে গভীরে হারিয়ে যাওয়ার তীব্র অনুভূতি স্পষ্ট নীল চোখ দু’টোতে। অভ্যন্তরীণ আত্মসমর্পণ জানিয়ে এলিজাবেথ দু’পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল রিচার্ডের দন্ডায়মান কোমর। সিঙ্কে তালু ঠেকিয়ে, ভর দিয়ে মাঝখানের শূন্যতা মোছন করে আরও দৃঢ় করল বাঁধন। শরীরে উন্মাদনার স্রোত ঝড়ের বেগে বইতে শুরু করল। রিচার্ড এলিজাবেথের দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলল। কোমরের বেল্ট একটানে খুলে ছুড়ে মারল ওয়েস্টবিনে৷
“ওয়াইফি মে আই?”
“রেসপেক্ট মি.কায়নাত।”

‘ঠৌঁট কামড়ে তুষ্ট হাসল রিচার্ড। সিঙ্কের উপর অসাড় হয়ে পড়ে থাকা লাল্যময়ীর উপর ঝুঁকে নাকের ডগায় নাক ঘষতে ঘষতে গাঢ় স্বরে বলল,
“মাই অনারেবল ওয়াইফ, প্লিজ কিন্ডলি ওপেন ইয়োর রিস্পেকটেড লেগ’স ফর মি। ইট উইল বি ইজিয়ার ফর মি। উই হ্যাভ লিমিটেড টাইম; দ্য কিডস মাইট ওয়েক আপ এনিটাইম।”
‘এলিজাবেথ টুপ করে একটা চুমু খেল রিচার্ডের অধরে। অনিয়ন্ত্রিত মুহূর্তে আবেশিত স্বরে ডাকল,”ড্যাডি।”
“ইয়েস প্রিন্সেস৷”
‘সঙ্গী হওয়ার একান্ত মুহুর্তে বাতাসে ভেসে এল আধ ভাঙা স্বর,”ড্যা -ডা-ড্যাডি।”
‘এলিজাবেথ ঠৌঁট কামড়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। রিচার্ড তপ্ত ফেলে সোজা হল। গায়ে শার্ট পরতে পরতে প্রত্যুত্তর করল মেয়ের ডাকের,”ইয়েস, লিটল প্রিন্সেস।”
“বাচ্চারা মনে হয় ওঠে পড়েছে। কান্নার শব্দ আসছে উপর থেকে।”
‘রিচার্ড তার চতুর বৌয়ের দিকে চেয়ে ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ছাড়ল শব্দ করে। অতঃপর মেয়েকে কোলে তুলে উপরে যেতে যেতে শোকময় ভঙ্গিতে বলতে থাকল,
“এরা দেশের নয়, জনগণের নয়, বাপের শত্রু।”

‘পেট ফেটে হাসি আসছিল এলিজাবেথের। ঘুমের মধ্যেই ফিক করে হেসে উঠল। তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুমের তোড় কেটে গেল মুহূর্তেই। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল সে চাচার বাড়িতে। পুরোটাই স্বপ্ন ছিল। করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিজাবেথ। তবে আশাবাদী, একদিন এই স্বপ্ন বাস্তবে ফিরবেই। ভোরের স্বপ্নগুলো আর আজানের প্রতিধ্বনির সাথে মিলিয়ে যাবে না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ওয়াশরুমে গেল এলিজাবেথ। বের হতেই হঠাৎ পেটে হাত চেপে ধরে ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে।
‘ইকবাল সাহেব গভীর ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠলেন এলিজাবেথের চিৎকারে। ছুটে ইবরাতের রুমে গিয়ে দেখলেন এলিজাবেথ মেঝেতে পেট চেপে ধরে কাতরাচ্ছে, কান্নায় গলা আটকে আসছে। তিনি দৌড়ে গেলেন এলিজাবেথের দিকে।
“এলিজাবেথ, মা আমার! কী হয়েছে তোর?”

‘কথা বলার অবস্থায় নেই এলিজাবেথ। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে! চেহারায় নীলাভ ছায়া ফুটে উঠেছে। ইকবাল সাহেবের মুখও রক্তশূন্য হয়ে এল এলিজাবেথের যন্ত্রণা আর কান্না দেখে।
“এই মা, বল না! কী হয়েছে তোর?”
‘পেট চেপে ছটফট করতে করতে ভাঙা গলায় এলিজাবেথ অস্পষ্ট স্বরে বলল, “চাচা, আমি মরে যাচ্ছি! আমার বাচ্চা… খুব যন্ত্রণা হচ্ছে পেটে…”
‘আঁতকে উঠলেন ইকবাল সাহেব,”কি! পেটে ব্যথা? সন্ধ্যায় তো সব ঠিক ছিল!”
‘এলিজাবেথ আর কিছু বলতে পারল না। শুধু অঝোরে কাঁদতে লাগল। ইকবাল সাহেব দৌড়ে গিয়ে ফোন হাতে নিলেন, বারবার তাকবীরকে কল দিতে থাকলেন। কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করল না। এদিকে এলিজাবেথের অবস্থা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে! নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ইকবাল সাহেব পাগলের মতো পুরো ঘর জুড়ে পায়চারি করতে লাগল, কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
“ফোন ধরছে না মিনিস্টার বাবু।”
‘ইকবাল সাহেবের কণ্ঠে অসহায়তা ফুটে উঠে। এলিজাবেথের কাতরানো, ধূসর হয়ে আসা মুখটা দেখে বুকটা আরও ধক করে উঠল ভদ্র লোকের।

“চাচা ঐ মানুষটাকে আর কত জ্বালাবেন? ওনাকে একা থাকতে দিন। অন্তত আজ ওনার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে।”
‘এই মুহূর্তে তাকবীরের ব্যক্তিগত শোকের চেয়ে অনেক বড় এক জীবন-মৃত্যুর শোক ঝুলে আছে এই ঘরের বাতাসে। ইকবাল সাহেব ছুটে এলিজাবেথের কাছে গেলেন। ভাজিতীর এই করুণ দশা দেখে আর কান্না চেপে রাখতে পারলেন না। হুরহুর করে কেঁদে ফেলল। এলিজাবেথের শরীর শীতল হয়ে আসছে, ব্যথার তীব্রতায় গলা ছেড়ে আর্তনাদ করছে। সহ্য করতে, করতে একটা সময় কণ্ঠ ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে আসে। চোখের নিচে কালচে ছায়া ফুটে ঠোঁট ফ্যাকাশে রূপ ধারন করে।
“মা রে, এই রাত আমি এখন কী করব?”
“ওর বাপকে ফোন করুন! লোকটা কোথায়? তাকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে!”মেঝেতে ছটফট করতে করতে, মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলল এলিজাবেথ। থমকে গেলেন ইকবাল সাহেব এক মুহুর্তের জন্য। তবে দ্বিমত করলেন না। এলিজাবেথের ফোন থেকে রিচার্ডের নাম্বারে ফোন দিলেন। কান লাগিয়ে অপেক্ষা করলেন… কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস! আজ কেউ ফোন ধরছে না!এদিকে গুমোট পরিবেশ শোকে ভারী হয়ে উঠছে। কেবল এলিজাবেথের শোকে গলে যাওয়া কান্নাই সেই নিস্তব্ধতাকে চিরে যাচ্ছে। ওর চিৎকারে পাশের বাড়ির লোকজন ছুটে আসে, কিন্তু সাহায্যের জন্য কেউ এগিয়ে এল না।

“অপয়া!”
“অলক্ষ্মী!”
“কলঙ্কের বোঝা পেটে নিয়ে রেখেছে!”
‘এসব ফিসফাস একসাথে কানে বাজতে লাগল। অথচ কেউ হাত বাড়িয়ে দিল না, কেউ পাশে দাঁড়াল না। উল্টে কানাকানি করতে থাকে একে-অপরের সাথে।
“কেউ তো ফোন তুলছে না!” ইকবাল সাহেব হাল ছেড়ে দিলেন।
“চাচা… আমি আর পারছি না… আমার সন্তানকে বাঁচাও, দয়া করে…”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠ নিস্তেজ হয়ে আসছে। শরীরের সব শক্তি ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এল। তখনও আশেপাশের মানুষজন শুধু দাঁড়িয়ে দেখছে। দেখছে, কিভাবে একটা গর্ভবতী মেয়ে মেঝেতে পড়ে ছটফট করছে, মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ইকবাল সাহেব হাতজোড় করে একের পর এক মানুষের কাছে ছুটতে লাগলেন। হাঁটু গেড়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।
“আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করুন! মেয়েটা মরে যাবে!
ওর গর্ভে নিষ্পাপ একটা শিশু রয়েছে।”

‘চোখেমুখে কান্না গড়িয়ে পড়ছে লোকটার। তবুও কেউ এগিয়ে এল না। সদয় হল শুধু একজন। এক বৃদ্ধ, যিনি পেশায় একজন সিএনজি চালক। তিনিই একমাত্র এগিয়ে এলেন। দৌড়ে গিয়ে তার সিএনজি নিয়ে এলেন। তবে সমস্যা এখানেই শেষ হয় না। একজন পুরুষ হয়ে একা হাতে একটা ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া মেয়েকে তুলতে হবে গাড়িতে, প্রকৃত পক্ষে খুব অস্বস্তিকর প্রকৃত পুরুষদের জন্য। এই ব্যাখাটা আর কেউ না বুঝলেও নারীদের বোঝার কথা, এবং তারা বোঝে। তারপরেও আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের কেউ এগিয়ে এল না। কেউ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখল না এলিজাবেথকে।
‘ইকবাল সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটার নিথর হয়ে আসা শরীর ধরে তুললেন সিএনজিতে। এলিজাবেথ তখনও ব্যথায় শিউরে উঠছে, তবুও শক্তি নেই কণ্ঠে। গাড়িতে উঠিয়ে দরজা লাগানোর সময়, একবার পিছনে ফিরে তাকালেন ইকবাল সাহেব। সেখানে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ। তাদের অসহায় চোখে দেখল ইকবাল সাহেব, যারা সাহায্যের হাত বাড়াল না, শুধু দু’টি মৃত্যুর অপেক্ষা দেখল চুপচাপ।

‘গ্রাম্য সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে—যার সময় খারাপ যায়, তার সব দিক দিয়েই অন্ধকার নামে। সিএনজির ইঞ্জিন খটখট শব্দ তুলে ছুটছে হাসপাতালের দিকে। ইকবাল সাহেবের ছোট্ট শান্তিনিকেতন থেকে পথটা নেহাত কম নয়। এলিজাবেথের অবস্থা ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে। ব্যথার তীব্রতায় চিৎকার করে কাঁদছে আর বারবার মাকে ডাকছে। নিজেকে ভুলে সে ছটফট করছে সন্তানটিকে নিয়ে। আকাশও যেন তার যন্ত্রণার সাথী। কালো মেঘের ভারে নুয়ে পড়েছে দিগন্ত, বিদ্যুৎ চমকে উঠছে ঘন ঘন। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। ইকবাল সাহেব এলিজাবেথের মাথাটা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে রেখেছেন।

‘ব্যথায় দেহের রগগুলো টগবগ করছে। তার ওপর আচমকা প্রবল ঝাঁকুনিতে গাড়িটি থমকে গেল। এলিজাবেথ প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু চাচার হাতে আটকে গেল শেষ মুহূর্তে। গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে সামনে স্পষ্ট হলো কালো একটি জিপ। বৃদ্ধ লোকটি শুকনো ঢোঁক গিলল! আতঙ্ক তার চোখে সুস্পষ্ট। ইকবাল সাহেব এলিজাবেথকে সিটে শুইয়ে রেখে সিএনজি থেকে নামলো। দেখতে পেল সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী কয়েকজন,পালোয়ানের মতো চেহারা। একজন মধ্যবয়স্ক লোক জিপের উপর রাজকীয় ভঙ্গিতে শুয়ে সিঙ্গার টানছে, ঠৌঁটের কোণে শয়তানি হাসি। এদের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব মোটেও সুবিধাজনক লাগল না ইকবাল সাহেবের কাছে। পিছনে একবার তাকালেন, এলিজাবেথ গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে। বুকের মধ্যে সাহসের শেষ কণাটুকু জড়ো করে সামনে এগোতেই জিপ থেকে এক লোক নামল। কোনো কথা না বলেই আচমকা ছুরি চালিয়ে দিল ইকবাল সাহেবের পেটে। মুহূর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে বৃদ্ধ লোকটি আর ভাবল না। প্রাণপণে ছুটে পালিয়ে গেল অন্ধকার গলিপথ ধরে, মৃত্যুর ছায়া পেছনে ফেলে, ফেলে গেল অসহায় এলিজাবেথ’কে।

‘এলিজাবেথ আচানক চারপাশের নৈঃশব্দ্যে দমবন্ধ অনুভব করল। সামনে তাকাতেই হৃদস্পন্দন শিথিল হয়ে এল। কয়েকজন পালোয়ানকায় লোক ভারী পায়ে এগিয়ে আসছে, মুখে বিকৃত পৈশাচিক হাসি ঝুলিশে। তাদের ছায়া চারপাশের আঁধারে মিশে অশুভ এক আবরণ তৈরি করেছে। সংকীর্ণতা কামড়ে ধরল এলিজাবেথের ভিতর। সাহায্যের আশায় এদিক-সেদিক তাকাতেই চোখ পড়ল মাটিতে রক্তাক্ত ইকবাল সাহেবের নিথর দেহের ওপর। আর বুঝতে বাকি রইল না ওর জন্য কী অপেক্ষা করছে। সিটে অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনের দিকে হাত বাড়াল এলিজাবেথ। আঙুল থরথর করে কাঁপছে, নিশ্বাস ছোট হয়ে আসছে। একমাত্র ভরসা রিচার্ড—তার সন্তানের বাবা। দ্রুত নম্বর চাপল সে, কানপেতে থাকল… কিন্তু রিচার্ড ফোন ধরল না। স্ত্রী-সন্তানের কথা ভুলে সে কোথায়?

‘ওরা যত কাছে আসছে, এলিজাবেথের ভয় ততই গাঢ় হচ্ছে। সে এখন আর একা নয়—তার গর্ভের সন্তান তার শক্তি। সন্তানের জন্য হলেও তাকে পালাতে হবে। গতি হারা হৃদস্পন্দনে নিজের অসাড় শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে সিএনজি থেকে নামল এলিজাবেথ। ছুটে পেছনের রাস্তা দিয়ে পালানোর শেষ চেষ্টা করল। কিন্তু শিকারের যে পালানোর সুযোগ নেই। এক ঘাতক শিকারীর ক্ষিপ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, শক্ত হাতে ওর চুলের মুঠি চেপে ধরল। এলিজাবেথের শরীর ছিটকে গেল পেছনে, ভয় আর যন্ত্রণায় ওর ঠোঁট কাঁপল, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোল না…
‘নরখাদকরা চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেল তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে। নিষ্প্রাণ দেহটাকে ছুঁড়ে ফেলল জিপের ওপর বসে থাকা লোকটার পায়ের কাছে। ভয়াল নিস্তব্ধতা গমগম করে উঠল এক ভারী কণ্ঠের শব্দে। লোকটা জিপ থেকে এক লাফে নেমে এল। লোকটার নাম আসলাম। নিঃসঙ্গ রাতের মতো শীতল চোখে চুল ধরে টেনে তুলল এলিজাবেথকে। ভয় গুলো কুণ্ডলী পাকিয়েছে কণ্ঠগহ্বরে। আসলাম ফোন বের করে কাউকে কল দিল। ওপর প্রান্তের লোকটা আর কেউ ছিল না–কাদের। আসলাম পর্দায় এলিজাবেথকে দেখিয়ে বলল, “বস, পাখিটা এটাই তো?”
‘ওপাশ থেকে বিদঘুটে এক হাসি ভেসে এল।

“হুম! একদম খাপেখাপ।”
‘ওদের হাসিতে এলিজাবেথের বুকের ভেতর আতঙ্কের ঝংকার বাজতে থাকল। আসলাম ফোনটা সুন্দর করে রাখল জিপের উপর। ফুঁ দিয়ে কামড় দিয়ে ধরে রাখা সিঙ্গার টা ফেলে দিল আসলাম। এলিজাবেথ কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তীব্র এক চড় এসে ঝাপটা মারল গালে। শরীর ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। যন্ত্রণা আর ভয় একসঙ্গে গলায় দলা পাকিয়ে আহাজারি হয়ে বেরিয়ে এল।
“আমাকে ছেড়ে দিন… দয়া করে…”
‘নারীর দুর্বলতা দেখে হোহো করে হেসে উঠল সবাই। আসলামের চোখ এলিজাবেথের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সরীসৃপের মতো গড়িয়ে গেল। স্ক্রিনে দর্শক হিসেবে বসে থাকা কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বস, খালাস তো করবই। তার আগে একটু পার্টি করলে মন্দ হয় না। ঝাক্কাস মাল!”
‘কাদেরের চোখ হঠাৎই কঠোর হয়ে উঠল। চোখ রাঙিয়ে বলল,”হুম… প্রাণে মারলে চলবে না। প্রতিশোধ এবার সমানে-সমানে হবে।”

‘আসলাম ধীরে ধীরে এগিয়ে এলে এলিজাবেথ আতঙ্কে হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে যেতে থাকল। সে শিশু নয়। ওদের কথার অর্থ স্পষ্ট বুঝতে পারছে।
“কা-কাছে আসবেন না! একদম কাছে আসবেন না!”
‘পিছন থেকে উচ্চস্বরে হেসে উঠল কাদের। এলিজাবেথ চিৎকার করে উঠল,
“আমি বলেছি, কাছে আসবেন না! কী করতে চাইছেন আপনারা?”
‘আসলাম পা দিয়ে চেপে ধরল এলিজাবেথের পা।
“তোকে কিছু করব না, শুধু তোর গর্ভের সন্তানের সাথে একটা খেলা খেলব আমরা।”
‘এলিজাবেথ আঁতকে উঠল। মাটি থেকে ভাঙা ইট তুলে সজোরে ছুড়ে মারল আসলামের কপালে।
“জানে মেরে ফেলব আমার সন্তানের দিকে হাত বাড়ালে!”
‘আসলামের কপাল থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। সে খপ করে টেনে ধরল এলিজাবেথের পা, হিংস্র গর্জন দিল,
“শালির বাচ্চা! এবার দেখি কে তোকে বাঁচায়! আগের বার ভাগ্য সহায় ছিল, এবার রক্ষা নেই!”
‘এক ঝটকায় এলিজাবেথকে মাটিতে ফেলে দিল।
“ওর বাবা জানলে সব কয়টাকে জীবন্ত কবর দেবে! নিজের কবর নিজেরাই খুঁড়ছিস তোরা।”
‘এত কিছু সহ্য করার পরও এলিজাবেথের মধ্যে এই তেজ দেখে আসলাম ক্ষিপ্ত হয়ে আরেকটা চড় বসাল। কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বস, শুরু করে দেব?”
‘কাদের মাথা ঝাঁকাল। এলিজাবেথ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে মাটিতে পড়ে অঝোরে কাঁদছিল। হঠাৎ আসলাম বুট পরা পা তুলে সজোরে লাথি মারল তার তলপেটে। প্রাঙ্গণ কেঁপে উঠল এলিজাবেথের বিকট চিৎকারে। দুনিয়াটা যেন ঝড়ের ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। এলিজাবেথের চোখের সামনে সবকিছু দুলছে, দপদপ করছে কালো ফোঁটার মতো। হাত-পা কাঁপছে! নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি। কার্নিশের কোণ ধরে অঝোর বারিধারা ছুটছে। গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে ধুলোমাখা মাটিতে। সে ছটফট করে চারপাশে তাকায়। রিচার্ড… কোথায় রিচার্ড?
‘ঠিক তখনই আরেকটা লাথি! তলপেটে বাজ পড়ার মতো আঘাত। শরীর ধনুকের মতো বেঁকে যায়। চিৎকার আকাশ ফাটিয়ে ওঠে।

“আল্লাহর দোহাই লাগে, ওকে মারবেন না! ও নিষ্পাপ!”
‘ওর কাতর কান্নার সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে কাদেরের বিকট হাসি। সেই হাসির ঝংকার শয়ে শয়ে তীর হয়ে বুকে বিদ্ধ হচ্ছে। মুখের কোণে গলগল করে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।পেটের ভেতর মোচড় দিচ্ছে একটা অপরিসীম যন্ত্রণা। অনুধাবন হচ্ছিল জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে…
‘কণ্ঠে কর্কশ গোঙানি, কাঁপা গলায় এলিজাবেথ বলল,
“ও যে আমার শেষ সম্বল… কেউ নেই আমার… ছেড়ে দিন আমাদের… আমরা চলে যাবো… অনেক দূরে…”
‘কাদের নির্বিকার। সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,
“আসলাম!”
“জি, বস!”
“আমার ছেলেকে কয় টুকরো করেছিল?”
“চার।”
“তাহলে এই জানোয়ারের অস্তিত্বও চার ধাপে নিঃশেষ করা হোক।”

‘আসলাম মাথা নাড়িয়ে বিকৃত হাসল। আবারও এগিয়ে গেল এলিজাবেথের দিকে। এলিজাবেথ পেট চেপে পড়ে আছে। যন্ত্রনায় ছটফট করছে মৃগীরোগীর মতো। হাত সরছে না পেট থেকে। শেষ চেষ্টা করে আঁকড়ে ধরে আছে নিজের সন্তানকে। কিন্তু নরখাদকদের হাত থেকে কি বাঁচানো যায় তাকে? তার বেহায়া চোখ এখনও খুঁজছে কাউকে—রিচার্ড…লোকটা তো সব বিপদে ছুটে আসে। আজ আসছে না কেন? কোথায় সে? কোনো দায়িত্ব নেই তার? তার রক্ত আজ রাক্ষসদের কবলে। অথচ রক্ষক কোথায়?
‘আসলাম তার পা তুলল হাঁটু পর্যন্ত।স্থির দৃষ্টি রাখল সেই কোমল জায়গাটায়, যেখানে চুপটি মেরে আছে একটা নিষ্পাপ ফুল। যে ছিল না এই শত্রুতায়, ছিল না এই রক্তের খেলায়। আসলামের পা বজ্রের মতো নেমে এল। পাথরের আঘাতে ভেঙে গেল নিষ্পাপ কুঁড়িটা। এলিজাবেথের হাত ছিটকে গিয়ে পড়ল মাটিতে। শরীর কেঁপে উঠল। তীব্র যন্ত্রণায় মাটি খামচে ধরল। ওর চিৎকার যেন পাথরের দেশে হারিয়ে গেল, কেউ শুনল না। শুধু আকাশ…আকাশ তার সাথে কাঁদছে! দিগন্তজোড়া চিৎকার তুলেছে। বিজলীর ঝলকানিতে মুহূর্তের জন্য আলোকিত হল চারপাশ। সেই আলোতে দেখা গেল রক্তশূন্য এলিজাবেথের মুখ, ওর ফ্যাকাশে ঠোঁট, কপালে মৃত্যুর ছায়া।

“ও খোদা, রহম কর! তোমার সৃষ্টি ধ্বংস করে ফেলছে ওরা! তোমার ফুলকে বাঁচাও!”
‘ সত্যিই তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! কেউ আসছে না কেন?সৃষ্টিকর্তা সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন না কেন? কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে এই পবিত্র সত্তা? আর লোকটা-সে কোথায়? সে তো দক্ষিণের দমকা বাতাসের মতো হুটহাট এসে দাঁড়াত! আজ কেন এতো নীরব? সে কি পাপী বলে নিষ্পাপ ফুলকে বাঁচাতে আসছে না? এলিজাবেথ অনুভব করছে, সে কিছু একটা হারিয়ে ফেলছে। অমূল্য কিছু! কিন্তু ধরে রাখতে পারছে না। আর কি হতে পারে এর চেয়ে বড় কষ্ট এক মায়ের জন্য? এলিজাবেথ শরীরের ব্যাথায় কাঁদছে না। না, একটুও না। মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে অবশিষ্ট শক্তি একত্র করে চিৎকার করে উঠল,
“এভাবে একটা মায়ের মাতৃত্বের স্বাদ ছিনিয়ে নিও না খোদা। আমার সন্তানকে নিও না তোমার কাছে!”
‘সেই সামান্য শক্তিটুকুও ধরে রাখতে দিল না জানোয়ারটা।
চতুর্থ লাথি।
আর সেই এক আঘাতেই সমস্ত দুনিয়া থমকে গেল। এলিজাবেথ অনুভব করল তার নিম্নদেশ বেয়ে উষ্ণ কিছু একটা অঝোরে গড়িয়ে আসছে..
‘শেষ…অস্তিত্বের অবসান।
‘পাপের জয়, পবিত্রতার পরাজয়।
‘এবার আর কোনো শব্দ বের হলো না এলিজাবেথের কণ্ঠ দিয়ে। শুধু কাঁপতে থাকা হাত ধীরে ধীরে চলে গেল উরুর ওপরে। সেখানে…
‘তাজা রক্ত।
‘কাপড় ভিজে গিয়েছে গাঢ় লাল রক্তে।
‘এলিজাবেথ হাতটা তুলল, সামনে আনল…
‘রক্ত’…

‘ বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল।একটা অনুভূতি, যা ব্যাখ্যা করা যায় না। যা অনুভব করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আঙুলগুলো ঢিলে হয়ে এলো। হাতটা পড়ে গেল মাটিতে। তাজা রক্তে ভিজে উঠল পৃথিবী। নির্মম শত্রুতার বলি হল এক নিষ্পাপ প্রাণ। সে ছিল এক অনন্য শক্তি, এক কালজয়ী অস্তিত্ব। কেউ ভাবেনি যে সে আসবে, তবুও সে এসেছিল। কিন্তু এই নিষ্ঠুর দুনিয়া তাকে থাকতে দেয়নি। এলিজাবেথের মাথায় আবার ঘুরতে থাকে ডক্টর সাবিহার কথাগুলো। অন্তিম মুহূর্তে শুধু নিঃস্বার্থ বিরবির হয়ে ওঠে,
“সোনা, তুমি তো অনেক স্ট্রং ছিলে। কত বাধা, বিপত্তি পেরিয়ে আমরা এতদূর এসেছিলাম। তবে আজ যে তুমি চলে গেলে, খুব কষ্ট পেয়েছ বুঝি?”

‘বেহায়া চোখ আর তাকাল না এদিকে। এলিজাবেথ আর আশা করল না আর, লোকটার দিকে তাকাল না। নিম্নদেশের গলগল রক্তের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছিল ওর বাঁচার শেষ ইচ্ছেটি। আরও একবার ওর স্বপ্নটা ফজরের আজানের মতো দূরে মিলিয়ে গেল। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল এলিজাবেথের রক্তাক্ত দেহ। আকাশ ভেঙে পড়ল। শুরু হল এক অঝোর বৃষ্টি। আকাশও ভাগ নিয়ে নিচ্ছে ওর কষ্টের। জিপ নিয়ে চলে গেল ঘাতক শিকারীরা।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৪

‘আজকের এই দুর্দিনে খোলা আকাশই ছিল ওর পাশে, আর কেউ ছিল না। কেউ এগিয়ে আসেনি। বৃষ্টির পানির সাথে বেসে যেতে থাকে রিচার্ড, এলিজাবেথের অস্তিত্ব। এভাবেই যন্ত্রণা নিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেল একটা পবিত্র ফুল। যে খুব করে চেয়েছিল এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটাকে দেখতে।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৬