ছায়ার মুখোশ পর্ব ৪

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৪
তাজরীন খন্দকার

অপ্রত্যাশিতভাবে মামলা প্রসঙ্গ উঠে আসতেই আরিদার শাশুড়ী থতমত চেহারায় আরিদার দিকে তাকালেন,নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টায় বললেন,
‘ বউ রফিকের লাইগা চা বানায়া নিয়া আও যাও৷
আরিদা শুনেও যেন শুনলোনা। স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। তার শাশুড়ী বুঝতে পারলো সে এই মামলার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায়। রফিককে ইতোমধ্যে ইশারায় থামিয়ে দিয়েছে,সে চুপ করে আছে। আরিদাকে এবার বিরক্তির সাথে বললেন,
‘ আরে কি! দাঁড়ায়া আছে দেহি? বেডা মানুষ কতো ঝামেলাতই পড়ে, এইডা মিথ্যা মামলা কয়েকদিনেই শেষ হইয়া যাইবো। চিন্তা করনের কিছু নাই, যাওতো।

আরিদার ভাত মাখানো হাতটা শুকনো খড়খড়ে হয়ে গেছে, রাইসা খাওয়া ছেড়ে খেলায় মেতে গেছে। অবশিষ্ট খাবারের প্লেটটা নিয়ে ধীর পায়ে আরিদা রান্নাঘরের দিকে গেলো। অচেনা একটা পরিবার, মুখোশ পরা সব মানুষ। কোনটা যে তাদের আসল চরিত্র বুঝে উঠতে পারছেনা। কেন তার মতো অসহায় একজনকে এসবে জড়ালো? বাবার বাড়ির এক জাহান্নাম থেকে এসে এখন আরেক জাহান্নামে পড়েছে৷
ইমরানের কথা খুব মনে পড়ছে আরিদার। কি হতো মানুষটা যদি বেঁচে থাকতো? একটা শপে কাজ করে ১৫ হাজার টাকা সেলারি পেয়ে পরিবার চালিয়েও তাকে কেমন রানীর মতো রেখেছিলো। কতো যত্ন আর মায়ায় তাকে আগলে রেখেছিলো। কি হতো যদি তার সেই বাচ্চাটাও বেঁচে থাকতো? স্বামী সন্তান অল্প চাহিদা আর সুখের সংসার, তা কি হতে পারতোনা? আরিদা তো ব্যস এইটুকুই চেয়েছিলো জীবনে। তার আত্মার মানুষগুলো তাকে রেখে চলে গেলো, তাকেও নিয়ে যেতো! কেন তাকে আগুনে ঢেলে দিয়ে চলে গেলো?
বেসিনে হাত ধুতে ধুতে ডুকরে কেঁদে উঠলো আরিদা!
পায়ের কাছে একটা ফুটবল গড়াতে গড়াতে এসে আটকালো। আরিদা তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে পেছনে তাকাতেই দেখলো রাফি বল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বল হাতে নিতে নিতে রাফি বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আপনি কানতাছেন ক্যান?
আরিদা দাঁত বের করে হেসে মাথা নিচু করে রাফির গাল ছুঁয়ে বললো,
‘ কই কান্দি? বড়রা কান্দেনা বাবা৷ যাও খেলো।
রাফি মুখের দিকে আবার তাকিয়ে বললো,
‘ আপনেও দেখি আম্মার মতো মিছা কথা কন।
বলেই রাফি বল হাতে নিয়ে ছুটে চলে গেলো।
আরিদার বুকে কেমন একটা ধাক্কা লাগলো। ওদের মা কাঁদতো? কেন কাঁদতো? তখনি আবার মাথায় এলো আচ্ছা সে মারা গেলো কি করে? এটা তো সে জানেনা, অস্থির হয়ে উঠলো তার পুরো ভেতরটা। চায়ের পানি চুলায় বসিয়ে আরিদা দ্রুত পায়ে তার শ্বশুরের ঘরে গেলো, গিয়ে দেখলো নাক ডেকে তিনি ঘুমাচ্ছেন। উদ্ভট গন্ধ নাক দিয়ে যেন ভেতর পর্যন্ত চলে যায়৷ একমাত্র ভরসাযোগ্য এই মানুষটাই আছে, তাকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো কিছু জানা যেতে পারে। কিন্তু এই মূহুর্তে কীভাবে জিজ্ঞাসা করবে?
আরিদার ভেতরে জানার অস্থিরতা কিলবিল করছে। ঘুম থেকে জাগিয়ে তো কিছু জিজ্ঞাসা করা যায়না, হতাশ হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যাবে তখন কাশতে লাগলো তার শ্বশুর, কাশতে কাশতে মাথা উঁচু করে কফ ফেলতে গিয়ে দেখলো আরিদাকে, কফটা ফেলে জিজ্ঞাসা করলো,

‘ কি গো তুমি এনে?
আরিদা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। পাশে বসে বললো,
‘ আব্বা চা খাইবেন?কাশটা তো বেশি।
মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ না ঘুমামু অহন৷
আরিদা থতমত করছে, বলবে নাকি বলবেনা। বসা থেকে উঠে আস্তে আস্তে দুই কদম আগালো, এরপর পিছিয়ে গিয়ে দ্রুত বললো,
‘ আব্বা রাফি রাফানদের মা কেমনে মরলো?
গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
‘ ওই কি জানি একটা জ্বর আইছিলো, আউলাঝাউলা হইয়া গেছিলো,হাসপাতাল গেলো অইহানতে লাশ লইয়া আইলো। আমি বিছনাত পড়া তিন বছর, লগেও যাইতে পারি নাই,জানাজাও করতে পারি নাই, বড় ভালা মানুষ আছিলো। হায়াত নাই, অল্প বয়সে পোলাপানডিরে এতিম কইরা গেলোগা।
আরিদা আস্তে করে বললো,

‘ অঅ।
প্রশ্ন অনেক মনে, তবে করার সাহস হলোনা। কীভাবে মারা গেছে জানাটা তাকে বেশি পীড়া দিচ্ছিল,এইটুকু আপাতত জেনেছে ব্যস। উনি যে মিথ্যা বলবেন না সেটাতে আরিদা পুরোপুরি ভরসা করতে পারে। শ্বশুরকে ঘুমাতে বলে সে আবার রান্নাঘরে গেলো। চা বানিয়ে রফিককে দিয়ে আসলো। তারা খুব আস্তে আস্তে কথা বলেই যাচ্ছে। আরিদাকে দেখে প্রসঙ্গ বদলে অন্য কথা বলছিলো তার শাশুড়ী। আরিদা সেটার ধরন শুনেই বুঝতে পারছিলো।বলুক যা খুশি!
আরিদা টিপটিপ পায়ে ফাইজার রুমে গেলো, দেখলো সে রাহাদকে ঘুম পাড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে কারো সাথে চ্যাটিং করছে। আরিদা কিছু না বলে চলে গেলো বাচ্চাদের কাছে। ওদেরকে ঘুম পাড়িয়ে এরপর ঘুমুবে। কিন্তু কেউই খেলা ছাড়ছেনা। দিনে দুইবার টিচার আসা ছাড়া ওরা পড়তেও বসেনা। আরিদা নতুন বলে ওদেরকে ওদের মতোই থাকতে দিচ্ছে, আগে ওরা তাকে মেনে নিক তারপর নাহয় হাই স্কুল শেষ করতে না পারা আরিদাও বই নিয়ে ওদের পাশে বসবে। ভালো পড়াতে না পারলেও ওদের পাশে ছায়া হওয়াটা জরুরী।

ঘড়ির কাঁটার টকটক আওয়াজ কানে ঢোলের আওয়াজের মতো ঠেকছে। অন্য সময় তো এমন হয়না। আরিদা চোখ খুলে তাকালো, কি যেন একটা আলো জ্বলছে রুমে, তার বরাবরই ঘড়ি, দেখলো চারটা বাজে। এতদিন তো ঘড়ি ছিলোনা। হঠাৎই মনে হলো বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে ওদের সাথে সেও এই রুমে ঘুমিয়ে গেছে। লাফ দিয়ে উঠলো! উঠে আবারো আরেকটা লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেলো। বুকে হাত দিয়ে বললো,
‘ আপনি? আপনি বাড়িতে আইছেন কবে?
‘ হ্যাঁ আইলাম। বাচ্চাদের জন্য মন কেমন করতাছিলো,তোমারে দেখুম ভাবি নাই।
‘ আসলে ওরা ঘুমাইতে দেরি করছিলো, ঘুম পাড়াইতে গিয়া আমিও ঘুমাইয়া পড়ছি। আপনি ঘুমান আমি গেলাম,রাহাদকে..
‘ বারান্দায় যাইবা?
ঘড়ির কাঁটার সাথে আরিদার বুকের মধ্যেও দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হচ্ছে, হাতের কব্জিতে কেমন যেন কাঁপন ধরেছে। কি বলবে বুঝবে পারছেনা। আরিদার উত্তর হ্যাঁ নাতে পাত্তা না দিয়ে রাশেদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

‘ চলো এখানে কথা বললে বাচ্চারা উঠে যাবে।
আরিদা ধীরপায়ে রাশেদের পেছন পেছন গেলো। আকাশে চাঁদ নেই, তারাগুলো একা একাই আকাশে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। রাশেদ বারান্দায় গিয়ে পেছনে আরিদার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ মানুষ মইরা গেলে আকাশের তারা হইতো যদি!
আরিদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তাইলে আমি দুইটা তারার দিকে তাকিয়ে জীবন পার কইরা দিতাম।
রাশেদ হয়তো আরিদার কথা কিঞ্চিৎ বুঝলো,বিস্তারিত বুঝার আগ্রহ দেখালোনা,অতীত উঠে আসলে বর্তমানটা বিভীষিকাময় হয়ে যাবে! প্রসঙ্গ বদলাতে বলে উঠলো,
‘ আমি আইছি এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট হইছে।
অবাক চোখে আরিদা রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ কি কন, ডাকলেন না ক্যান। কাল রাইতে কই না কই ছিলেন, ঘুমাইতে পারেন নাই মনে হয়।
রাশেদ হেসে বললো,

‘ ঘুম সবসময় জরুরী না আরিদা। এই যে আইয়া দেখলাম তুমি আমার বাচ্চাগুলিরে আগলাইয়া ঘুমাইয়া আছো,এই দৃশ্য দেইখা কি দুই চোখের পাতা এক হইতে চায়বো?
আরিদার কোমল মনটা অদ্ভুত ভালো লাগায় নেচে উঠলো। সবকিছু ভুলে গেছে যেন। সে শিরিনের মতো ফর্সা হলে বোধহয় গালদুটো গোলাপি আভা ধারণ করতো। যদিও এতো অল্প আলোতে রাশেদ তা দেখতে পেতোনা। আরিদা বিষয়টা সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ রাতে যদি বাড়িত পুলিশ আইয়ে?
রাশেদ চমকে উঠলো,
‘ তুমি জানো কেমনে?
‘ শুনছি।
‘ কি শুনছো?
‘ মামলার ব্যপারডা।
রাশেদ একটু চুপ করে রইলো। এরপর থতমত করতে করতে বললো,
‘ দেখো এইসব মিথ্যা মামলা, এইসবের কোনো ভিত্তি নাই।

—বারান্দায় কথা কয় কেডায় রে?
ডাইনিং রুম থেকে আচমকা এই কথা শুনে আরিদা ভয়ে চুপসে গেলো। তার শাশুড়ী মনে হয় নামাজের জন্য উঠে গেছে। আরিদা সামনে যেতে চাইলো, রাশেদ আরিদার ডান কাঁধে হাত রেখে ইশারায় দাঁড়াতে বললো। তাকে পেছনে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘ আইসোনা এখন৷
রাশেদ ফোন কানে দিয়ে কথা বলার ভান করে তার মার সামনে এসে বললো,
‘ আম্মা আমি আইছিলাম, বারান্দায় ফোনে কথা কইতেছিলাম।
‘ কেরে আইলি, পুলিশ নজর দিয়া রাখছে বাড়িত,ধরা পড়লে?
রাশেদ জবাব দিলো,
‘ আম্মা ডরায়েন না, কিছু হইবোনা। পোলাপাইনগুলোরে দেখতে মন ছটপট করছিলো, আপনি ওজু করলে করেন আগে, আমিও করুম। নামাজ পইড়া আবার যামুগা।
রাশেদের মা আইচ্ছা বলে ওয়াশরুমে ঢুকলো। আরিদা এবার বারান্দা থেকে উঁকি দিলো। রাশেদ ইশারা করলো বেড়িয়ে আসতে। আরিদা তাড়াহুড়া করে বেড়িয়ে গিয়ে ফাইজার রুমে শুয়ে পড়লো। ফাইজা এখনো উঠেনি, তার শাশুড়ীও কিছু বুঝেনি তাই একটু স্বস্তি পেলো। একটু শুয়ে থাকা যাক। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠেছে ভান করা যাবে।

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৩

নাস্তার টেবিলে আরিদার শাশুড়ী ননদ আর বাচ্চাকাচ্চারা সবাই একসাথে বসেছে। তার শ্বশুরকে রুমে খাবার দিয়ে এসেছে। আরিদাও বসলো, এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে দেখলো জগে পানি কম, সে পানি আনতে রান্নাঘরে যেতে যেতে শুনলো তার শাশুড়ী ফাইজাকে রাশেদের রাতে বাড়ি আসা নিয়ে বলছে। জগ হাতে নিয়ে এসে টেবিলে বসতেই ফাইজা বললো,
‘ ভাবি আপনে তো কাল রাইতে ভাইয়ের রুমে আছিলেন। রুমে আইছেন কয়টায়?
এটা শুনতেই আরিদার শাশুড়ীর চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেলো।

ছায়ার মুখোশ পর্ব ৫