নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩
সিনথিয়া
“আমরা কিডন্যাপারদেরকে ফারদার ইনকোয়ারির জন্য পাঠিয়েছি! তবে ওদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে-”
শেহজাদের বাবা মেহমেদ হাসান বরাবরই শক্ত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু আজ যে তিনি একজন সন্তান হারা বাবা। ভেঙে পড়া গলায় পশ্চিমা ভাষায় বললেন,
“কথাটা শেষ করুন অফিসার!”
অফিসার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মাথা নিচু করে
আওড়ালেন,
“আ’ম সরি মিস্টার মেহমেদ। কিন্তু আমার মনে হয় না, আমরা আপনার মেয়েকে জীবিত উদ্ধার করতে পারবো! কারণ ওদের উপর নাকি অর্ডার এসেছিল, মিস্টার ইব্রাহিম চৌধূরীর মেয়ে আরশি চৌধুরীকে কিডন্যাপ করার।
সেখানে ভুলবশত ওরা আপনার মেয়ে রুশাকে কিডন্যাপ করে। কিন্তু পরে যখন বিষয়টা ওরা বুঝতে পারে, ততক্ষণে আমরা আমাদের টিমকে ভিকটিমের খোঁজে পাঠিয়ে দিয়েছি।
আর ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়তে ওরা আপনার মেয়ে রুশাকে…নদীতে ফেলে দেয়।”
কথাগুলো শুনে নিজের স্ত্রীর পাশে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন মেহমেদ। স্ত্রীর মরিয়মের জ্ঞান নেই বললেই চলে। তাকে ধরে আছেন আরশির মা জেয়নেব চৌধুরী। ভদ্র মহিলা নিজেও কাঁদছেন। উপরওয়ালা সহায় না হলে আজ যে মরিয়মের মেয়ের জায়গায় তার মেয়ে থাকতো।
দুই বছরের আরশি তখন ওর বাবার কোলে। আলুঢালু চোখে বাবার কাঁধে মাথা রাখা। ইব্রাহিম চৌধুরী মেয়েকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
বারো বছরের শেহজাদ বাব-মা’র পাশে দাঁড়ানো। চোখ ফুলে লাল। বোঝায় যাচ্ছে, একমাত্র বোনের শোকে সেও পাথর৷
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইব্রাহিমের খারাপ লাগছে পুরো পরিবারটাকে
এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে। না সে তাদের বাংলাদেশে বেড়াতে আসতে বলতো, না এমন একটা ঘটনা ঘটতো!
ভদ্রলোক শান্তনা দিতে এগিয়ে গেলেন শেহজাদের দিকে। বললেন,
“পুলিশ তো খুঁজছে, দেখবে ঠিক ওনারা রুশার একটা খোঁজ পাবে।”
শেহজাদ শীতল চোখে তাকালো ইব্রাহিম চৌধুরীর দিকে। ভদ্রলোক ভড়কে গেলেন কিছুটা।
বারো বছর বয়সী ছেলেটা, যে কি না দু’বছর আগেও মরিয়মকে বলেছিল,
“আম্মু আমার বোনু কি তোমার মতো হয়েছে? কই দেখি তো একটু? আমার কোলে দেও না একটু বনুকে!”
সেই ছেলেটাই আজ কঠিন কন্ঠে বলল-
“আমার বোনের হারিয়ে যাবার পিছনে আপনার মেয়ে দায়ী। আমি কক্ষনও ক্ষমা করবো না ওকে। কক্ষনো না। কক্ষনো না!”
বিছানায় ধরফরিয়ে উঠে বসলো আরশি। চোখ মুখ ঘেমে নিয়ে একাকার। এতক্ষন দুঃস্বপ্ন দেখছিল বোধ হয়।
আজকে আবারও সেই একই স্বপ্ন। ওর সামনে থেকে রুশাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে মাস্ক পড়া একটা লোক।
এই একই স্বপ্ন আগেও দেখেছে ও। আর যখনই দেখেছে, তখনই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে।
আজকেও শরীরটা বেশ সুবিধের ঠেকছে না আরশির কাছে। তবুও আর বসে থাকলো না। তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে ঘড়ি ধরতেই দেখলো আটটা বাজে।
“ইশ! এতো দেরি হয়ে গেছে? আরো দেরি করে বের হলে তো আর ভার্সিটির যাওয়ার বাসটাও পাবো না!”
কথাগুলো বলেই মেয়েটা ছুট লাগালো ফ্রেশ হতে।
ওভারসাইজ জিন্সের প্যান্টের সাথে কালো রঙা টি-শার্ট আর সাথে একটা ডার্ক ব্রাউন রঙের ওভারকোট পড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো আরশি। কাঁধের টোট ব্যাগটা আপতত হাতে।
কোমর অবধি ওয়েভি চুলগুলো বরাবরের মতোই ছেড়ে রাখা।
এতো সাধারণ সাজগোজেও আর পাঁচটা মেয়ের থেকে এই বিশ বছরের মেয়েটা একটু বেশিই মনোরম, মনোমুগ্ধকর। পাতলা ঠোঁটের উপর কালো তিলটা সেই সৌন্দর্য যেনো আরো কয়েকশত গুণ বাড়িয়ে দেয় ওর।
রুম থেকে বের হতেই খাবার টেবিলের দিকে চোখ গেলো ওর। সেখানে রাখা ধোঁয়া ওঠা স্যুপ আর গরম গরম ডিম পোঁচ দেখেই পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো আরশির।
রাতের খাবার তো জাম্বুবানটার বকুনির ঠেলা সামলাতে সামলাতেই হজম হয়ে গেছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এই জন্যই কি সকাল সকাল জাম্বুবানটা ওর জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়ে রেখে গেলো?
আরশি আর সময় নষ্ট করলো না। খাবার সামনে থাকলে বেশি ভাবতে নেই। তাই তো বসেই খাওয়া শুরু করলো মেয়েটা।
এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়েই চোখ বড় বড় করে বলল,
“জাম্বুবানটা আসলেই এতো ভালো রান্না করে? অবিশ্বাস্য”
পরপর ডিম পোঁচটাও একটু খেয়ে বলল-
“এভাবে সবসময় বউয়ের জন্য খাবার টাবার রান্না করলেও তো পারে জাম্বুবানটা, কিন্তু না সারাক্ষণ শুধু খ্যাঁকখ্যাঁক খ্যাঁকখ্যাঁক করবে! সাধে কি আমি ডিপজল আর জাম্বুবান বলে ডাকি?”
আর তখনই ঘড়ি আর কাফলিংক পড়তে পড়তে রুম থেকে বেরিয়ে এলো শেহজাদ। পরনের সাদা শার্ট আর নীল রঙা ব্লেজার, প্যান্টে একেবারে পারফেক্ট জেন্টেলম্যান।
মূহুর্তেই আরশির মনে পড়লো রাতের কথা। বিভোর হলো রাতে শেহজাদের ওর কোমর জড়িয়ে ধরার ভাবনায়। পরে যে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছিল সেটা অবশ্য আলাদা কথা।
“ভার্সিটি যাবে না? নাকি তাকিয়েই থাকবে?”
থতমত খেলো আরশি। এতক্ষণ যে আরশি তাকিয়েছিল ওনার দিকে সেটাও খেয়াল করেছে জাম্বুবানটা?
“যা-যাবো তো!”
মাথা নিচু করে কোনোমতে উত্তর দিলো আরশি।
জুতো পড়ে গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে আরশির দিকে তাকালো শেহজাদ।
আবারো রাতের মতো সেই ধুকপুকোনি শুরু হলো বুকের ভিতর মেয়েটার। মানুষটা ওর দিকে তাকালেও যেনো খামচে ধরে ওর বুকের ভিতর।
“আমার ক্লাসে আমি দেরি করে আসলে কিন্তু ঢুকতে দেই না! মাইন্ড ইট!”
ঢোক গিলল আরশি। কথাগুলো বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো শেহজাদ।
ঊনিশ বছর বয়সী মেয়েটা আবারও তার এই রহস্যে ঘেরা বলিষ্ঠ পুরুষটির প্রস্থান পানে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ।
সকালটা শুরু হলো পূবের আকাশে লাল, কমলা ও গোলাপি রঙা সূর্যের আভা ছড়িয়ে।
যে রঙের প্রতিফলন ঘটলো জারার রুমের কাঁচের দেয়ালে।
চোখ ডলতে ডলতে ঘুম ভাঙলো মেয়েটার। ঘাড় অবধি ছোট ছোট চুলগুলোকে হাত দিয়ে আরো এলোমেলো করে নেমে পড়লো বিছানা থেকে। গন্তব্য ফ্রেশ হতে হবে, ভার্সিটি যেতে হবে, তারউপর পার্ট টাইম একটা জবও খুঁজতে হবে।
জমানো টাকা প্রায় শেষের পথে। আপতত একটা কফি শপ বা কেক- পেস্ট্রির দোকানে পার্ট টাইম কাজ করতে পারলেও লাভ।
এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম চোখে রুমের বাইরে বের হতেই বাঁধলো বিপত্তি।
কিচেনে কোনো এক ভীষণ ফর্সা বিদেশি বাঁদর শুধু একটা নিম্নবস্ত্র পড়ে লাফাচ্ছে।
পুরো শরীরে কাপড়ের আর কোনো ছিঁটে ফোঁটা নেই।
দিনের আলো চোখে সয়ে আসতেই চোখ পিটপিট করে জারা আবার দেখলো কিচেনের সামনেটা।
মানুষটার পিছনে দাঁড়িয়ে বুঝলো এটা বাঁদর নয়, মানুষ। যেকিনা বর্তমানে গানের তালে তালে তার পশ্চাদ্দেশও ঢুলিয়ে দেখানো শুরু করেছে জারাকে।
মেজাজ খারাপ হলো মেয়েটার। সাউন্ড বক্সের বিকট শব্দে বাজতে থাকা বিদেশি গানটা জারা বন্ধ করে দিতেই সামনে থাকা মানুষটারও পশ্চাদ্দেশ দোলানো বন্ধ হলো।
সাউন্ড বক্স বন্ধ হওয়ার হেতু খুঁজতেই নাক মুখ কুঁচকে পিছন ফিরলো লোকটা। আর তখনই প্রথমবারের মতো এক জোড়া সোনালী চোখ গিয়ে পড়লো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালি মেয়েটির উপর।
ছোট ছোট চুল আর নীল চোখের জারাকে প্রথম দেখেই উন্মুক্ত বুকের বা পাশে হাত রাখলো মানুষটা।
পুরো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঠিকরে থেমে থেমে বের হলো জারার রূপের প্রশংসা।
“মাই গুডনেস! হোয়াট -অ্যা- বিউটি!”
পরপর কাউন্টার টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বলল-
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২
“হ্যালো! আ’ম আইয়ান। দ্যা গ্রেট আইয়ান হান্টার। “নাম তো সুনাহি হোগা”! “বাই দ্যা ওয়ে” তোমার নাম? অর মে আই কল ইউ “মাই বাটারফ্লাই” ?”
জারা কিছুটা অবাক হয়েই আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরপর মনে মনে ভাবলো-
“এই বিদেশি বানরটা বাঙালি?”