চেকমেট পর্ব ৫

চেকমেট পর্ব ৫
সারিকা হোসাইন

মুষলধারে যেই ভারী বর্ষণ হচ্ছিলো তা ধীরে ধীরে কমে এলো।কিন্তু বিদ্যুৎ চমকানো থামলো না।এখনো থেকে থেকে আকাশ গুড় গুড় শব্দে ডেকে উঠছে।দূর হতে দলবাধা কুকুরের ঘেউ ঘেউ কর্কশ স্বর ভেসে আসছে ক্ষীণ ভাবে।সব কিছু কেমন ভুতুড়ে গা ছমছমে।বৃষ্টির আভাস পেলেই আজকাল ইলেক্ট্রিসিটি দৌড়ে পালায়।চারিধারে কোথাও এক ফোটা আলোর অস্তিত্ব নেই।এক হাত কাছের জিনিস ও ভালো মতো দেখা যাচ্ছে না ।বিদ্যুতের চমকে সিদ্দিকের এলোমেলো দৌড়ে পালানো দেখে উন্মাদের ন্যয় হেসে উঠলো সারফরাজ।পারেনি সে তার বেঈমান বিশ্বাস ঘাতক বন্ধুকে মারতে।বিবেক যেনো কোথাও একটা বাধা দিয়ে ধিক্কার দিয়ে বলে উঠলো
“একদিন এর জন্য হলেও ও তোর সুখের সঙ্গী ছিলো।কিভাবে মারবি ওকে?

বৃষ্টির জলের সাথে সিদ্দিকের পদযুগল এর সঙ্ঘর্ষে এতোক্ষন ধরে যেই ছপছপ আওয়াজ কানে লাগছিলো তা এখন আর শোনা যাচ্ছে না।হয়তো প্রানের ভয়ে দিদ্দিক সুবহান এর হাবেলীর ত্রিসীমানা থেকে বহু দূরে পালিয়ে গেছে।সিদ্দিকের যাবার পথের পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে ধপ করে উঠোনে বসে গেলো সারফরাজ।শরীর জুড়ে রক্তের গন্ধ।যেই ভয়াবহ অপরাধ দেহে এক বিন্দু প্রাণ থাকতে করতে চায়নি তাই ই যেনো করতে হলো।মাসুদ কে দিয়েই যেনো নির্দয় ভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবার হাতেখড়ি হলো।এখন কেমন যেনো হাত দুখানা নিশপিশ করছে।আরো আরো রক্ত ছুঁতে চাইছে হাত দুটো।
“মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবার নেশা বুঝি এতটাই প্রকট?এই নেশা কি করে দামাবো আমি?
হাতের দা টাকে শক্ত করে ধরে তাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সারফরাজ। বিদ্যুতের ঝলকে কাবিরের অনাদরে পরে থাকা দেহ হীন মুন্ডু চুলের ঝুটি ধরে হাতে তুলে নিলো।এরপর ধীরে ধীরে ক্লান্ত শরীরে হাটতে লাগলো হাবেলী অভিমুখে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হাবেলীর মোজাইক করা মেঝেতে ঘষে ঘষে রাম দা টেনে নিয়ে যাচ্ছে সারফরাজ।পাথর আর লোহার ঘর্ষণে ভয়ানক স্ফুলিঙ্গের উৎপন্ন হচ্ছে।আর কেমন গা শিউরে উঠা শব্দ।এলোমেলো বাতাসের দাপটে হাবেলীর কাঠের দরজা জানালা চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলেছে।সুবহান গং এর কক্ষের দরজার ফাক গলিয়ে অল্প হলদেটে মোমের শিখা দেখা যাচ্ছে।সেই শিখা অনুসরণ করে হেটে চললো সারফরাজ।কয়েক সেকেন্ড এর ব্যবধানে সুবহান এর দরজার সামনে এসে থামলো সারফরাজ।এরপর দায়ের মাথা দিয়ে অল্প ধাক্কা দিয়ে খুললো দরজা।
কক্ষের এক কোনে নিজে নিজেই দাবার গুটি সাজিয়ে খেলায় মজেছেন সুবহান।কিন্তু চোখে মুখে কোনো আনন্দের আভাস নেই।কিন্তু কেনো?

দরজায় অল্প শব্দ হতেই দাবার বোর্ড ছেড়ে দরজায় দৃষ্টি পাতলো সুবহান।দরজায় সারফরাজ দাঁড়িয়ে।সদ্য রক্ত স্নানে শরীর ভিজিয়েছে সে।সুবহান তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো।এরপর চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে এলো।কাবির এর মুন্ডু থেকে চুইয়ে চুয়ে রক্ত ঝরে সুবহান এর ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে।সুবহান যেনো পূর্ব থেকেই কাবিরের পরিণতি জানতেন।তাই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।সারফরাজ দা আর মুন্ডু নিয়ে সুবহান এর সাজিয়ে রাখা দাবার টেবিলে রাখলো এরপর চেয়ারে গা এলিয়ে বসে ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলো
“খুব ক্লান্ত লাগছে দাদাজান।নয় জন মানুষের ধর কাটা চাট্টি খানি ব্যাপার নয়।
সুবহান গ্লাসে করে এক গ্লাস জল সারফরাজ এর সামনে রেখে গম্ভীর গলায় বললেন
“রক্তের পিপাসা কেমন সারফরাজ?
ঢকঢক করে পুরো জল এক নিঃশ্বাসে খেয়ে টেবিলে ভর দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে সারফরাজ বললো
“পিপাসা এখনো মিটেনি দাদাজান।আরো রক্ত মাখাতে ইচ্ছে করছে।
সারফরাজ এর কেটে যাওয়া হাত থেকে এখনো রক্তের ধারা ঝরছে।গভীর ক্ষত সেই হাতে।কপালের কাছেও বেশ খানিক কেটে গিয়েছে।পা দুটো রক্তাক্ত জখমে ভর্তি।মোমের ক্ষীণ আলোয় সারফরাজ কে একবার খুঁটিয়ে দেখে সারফরাজ এর সামনের চেয়ারে বসলেন সুবহান।এরপর একটা কয়েন এগিয়ে বললেন

“হেড অর টেইল?
সারফরাজ বাঁকা হেসে বললো
“টেইল।
টচে হেড উঠলো।সুবহান এর বাঁকা গোঁফ হাসির রেখায় আরেকটু বাঁকা হলো ।সাদা গুটি নিজের ঘরে সাজাতে সাজাতে ঠান্ডা ভয়ানক গলায় বলে উঠলেন
“দাবায় সাদা গুটির জয় নিশ্চিত তা জানিস তো নাকি?
কালো গুটি নিয়ে মন্ত্রী ঘোড়া আর নৌকা সাজাতে সাজাতে সারফরাজ বললো
“হয় আপনি মারবেন নয়তো আমি।প্রাণ কিন্তু একটাই যাবে দাদাজান।
সুবহান প্রশস্ত হাসলেন।বদ্ধ ঘরের প্রতিটি দেয়ালে বাড়ি খেলো সেই হাসি।কিন্তু নির্বিকার সারফরাজ।এরপর হাসি থামিয়ে সুবহান প্রথম চাল চাললেন
ধীরে ধীরে সামনে এগুতে থাকলো দুই জনের গুটি।দুজনের চোখেই দুজন কে শেষ করার আকাঙ্ক্ষা।এক পর্যায়ে সারফরাজ এর সৈন্য খেয়ে ফেললেন সুবহান।এতে যেনো সুবহান এর দম্ভ আরেকটু বাড়লো।হুঁশিয়ারি দিয়ে সারফরাজ এর উদ্দেশ্যে বললেন
“কেনো বেঘোরে প্রাণ হারাতে চাইছিস?

প্রত্যুত্তর করলো না সারফরাজ।রক্তাক্ত হাতে নিজের গুটি পাশ কাটিয়ে খেলায় মনোযোগ দিলো।এক পর্যায়ে নিজের ঘোড়া দিয়ে সুবহান এর একটা গুটি খেয়ে আরেকটা গুটির দিকে অগ্রসর হলো সারফরাজ।সুবহান যখন নিজেকে বাঁচানোর চিন্তায় মগ্ন তখন সারফরাজ শীতল গলায় বলে উঠলো
“আমার মা কে কোথায় রেখেছেন দাদাজান?
সারফরাজ এর প্রশ্নে থেমে গেলো সুবহান এর হাত।মস্তিষ্ক হলো বিক্ষিপ্ত।গুলিয়ে উঠলো সব কিছু।কিন্তু সারফরাজ খেলা থামাতে কঠিন হুঁশিয়ারি দিলো।এলোমেলো হাতে একটা গুটি চেলে সুবহান বললো
“কে তোর মা?
নিজের নৌকা দিয়ে সুবহান এর আরেকটি গুটি টার্গেট করে সারফরাজ বললো
“আপনি জানতেন আমি আপনার নাতি তাই না দাদাজান?সব জেনে শুনেও কেনো এই অভিনয়?
সারফরাজ এর হাত থেকে যেনো আজ নিস্তার নেই সুবহান এর।তবুও নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন সুবহান।সুবহান এর চোখের পানে তাকিয়ে সারফরাজ গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো

“চোখ যে মনের কথা বলে…
সুবহান নাকের পাটা ফুলিয়ে ভারী গলায় বললো
“এমন কঠিন মুহূর্তে তোর গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে?
খিলখিলিয়ে হাসলো সারফরাজ সুবহান এর এহেন প্রশ্নে।এরপর খেলায় মনোযোগী হয়ে শুধালো
“নিজের নাতিকে খুন করবার জন্য দলের সবচেয়ে নির্দয় মানুষকে পাঠালেন?বয়সে যে কিনা আপনার নাতীর দ্বিগুন।যদি সত্যিই কিছু হয়ে যেতো তখন মেয়ের সামনে মুখ দেখাতেন কি করে নানাজান?
সারফরাজ এর নানা জান সম্বোধনে সুবহান এর পুরো চোখ মুখ অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো।হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সুবহান চিৎকার করে উঠলো
“তোর ওই মুখে আমাকে নানা জান বলে সম্বোধন করবি না সারফরাজ।আমি তোর নানা নই।না আমার কোনো মেয়ে ছিলো না আছে।
সারফরাজ অমায়িক হাসলো।সেই হাসিতে বুকে জমানো কষ্ট ফুটে উঠলো।নিজের রক্তাক্ত হাতে সুবহান এর হাত চেপে ধরে সারফরাজ ব্যথিত স্বরে বললো

“মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছে বলে এতো ঘৃণা?ভালোবাসা কি মহা পাপ নানা জান?
হাতের ঝটকায় সারফরাজ এর হাত ছাড়িয়ে সুবহান বলে উঠলো
“ভালোবাসা পাপ নয়।কিন্তু মাঝে মধ্যে পাপের চাইতেও বেশি।তোর মা নিজের ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে বাকি সবার ভালোবাসা পায়ে পিষে হত্যা করেছে।সমাজের মানুষের সামনে আমাকে করেছে অপমান অপদস্থ।বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে তোর বাবার হাত ধরেছে।তোর নানী একমাত্র মেয়ের দেয়া আঘাত,সমাজের মানুষের কটু কথা আর বর যাত্রীর করা অপমান সইতে না পেরে হার্ট এটাকে মারা গেছে।এতেই কি শেষ?তোর বাপ আমার একমাত্র ছেলেকে সীমান্তে ক্রস ফায়ারে মেরেছে।আমাকে সব দিক থেকে করেছে নিঃস্ব আর অসুখী।এর পরেও ওই মেয়ের জন্য বুকে দরদ থাকবার কথা?
সুবহান এর পাল্টা প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষন নিশ্চুপ বসে থেকে নিজের দমিয়ে রাখা ব্যাথা গিলে খেয়ে সারফরাজ কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলো

“এজন্য আমার বাবা কেও আপনি নৃশংস ভাবে হত্যা করেছেন নানা জান।লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাদাফ শাহজাইন এর টুকরো টুকরো লাশ আপনি আপনার মেয়েকেই বাক্সে করে উপহার পাঠালেন।কোনো স্ত্রী নিজের স্বামীর এমন নৃশংস অবস্থা সইতে পারে নানা জান?
সুবহান গং কোনো উত্তর খুজে পেলেন না।সারফরাজ শুকনো হাসলো।এরপর বললো
“মামা অস্ত্র পাচার এর সাথে জড়িত ছিলো।আমার বাবা দেশের একজন সেবক।দেশ রক্ষায় সে তার ডিউটি পালন করেছে মাত্র।জেনে বুঝে কেনো নিজের মেয়েকে বিধবা করলেন?ধরেই নিলাম আমার বাবা মা দুজনেই অপরাধী।কিন্তু আমার কি অপরাধ ছিলো নানা জান?আমাকে এতিম করলেন কেনো?
সুবহান কঠিন মুখশ্রী করে সারফরাজ এর পানে অনিমেষ তাকিয়ে রইলেন।জীবনে আজ প্রথম ছেলেটাকে বিধস্ত ঠেকলো সুবহান এর কাছে।নিজের মন্ত্রীর গুটি চেলে সুবহান উত্তর করলেন

“তোর মাকে আমি সত্যিই ধরে আনি নি।আর আনলে মোটেও বাঁচিয়ে রাখতাম না।
সুবহান এর উত্তরে চোখের জল ছেড়ে দিলো সারফরাজ।এরপর ভাঙা অস্ফুট স্বরে বললো
“আপনার মেয়ে হারিয়ে গেছে নানা জান।নয়টি বছর ধরে তাকে খুঁজে চলেছি আমি ।কিন্তু বিশ্বাস করুন কোত্থাও পাইনি।যেই বয়সে বাবা মায়ের বুকে ঘুমানোর কথা আমার।সেই বয়সে তাদের হারিয়ে এতিম আমি।আমার মাকে খুঁজে দেবেন নানা জান?একটু জড়িয়ে ধরে বুকের কষ্ট গুলো উজাড় করবো!
সারফরাজ এর আবদারে সুবহান এর কঠিন হৃদয় কেমন গলতে চাইলো।কিন্তু প্রশ্রয় দিলো না সুবহান।মেয়ে,মেয়ের জামাই,নাতি এসবের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই তার।এদের কারনেই আজ সে নিঃস্ব।তার জীবনটাও এমন হবার কথা ছিলো না।কিন্তু হয়েছে।
নিজের গুটি দিয়ে সারফরাজ এর রাজা ঘিরে ধরে সুবহান বললেন

“চেক।নিজের জীবন আমার জন্য উৎস্বর্গ কর সারফরাজ।বিশ্বাস কর আমি আর মানুষ নেই।পশুর চাইতেও হৃদয়হীন হয়ে গেছি আমি।তোকে বাঁচিয়ে রাখলে এক সময় ভয়ানক ছোবল দিবি তুই আমাকে।সব কিছু হারিয়ে এই সাম্রাজ্যে নিজের সুখ গুছিয়ে নিয়েছি আমি।তোর কারনে এই সুখ নষ্ট করতে পারবো না আমি।
কথাটি বলেই টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা রিভলরার বের করে সারফরাজ এর পানে তাকে করলেন সুবহান।নিজের নানার নিষ্ঠুর রূপে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সারফরাজ।এরপর দাবার বোর্ডের পানে তাকিয়ে খুব সহজেই চেক কাটিয়ে নিলো।শুরু হলো পাল্টা পাল্টি আক্রমন।সময় গড়ালো পলকে পলকে।শেষমেশ নিজের বুদ্ধিমত্তায় সুবহান এর রানী ঘিরে ধরলো সারফরাজ।সব চেয়ে শক্তিশালী গুটির এমন পরিণতি তে সুবহান এর হাত থেকে খসে পরলো রিভলরার।বাঁকা হেসে সারফরাজ বললো

“চেক কাটান নয়তো মাথা নত করুন।
কথাটা বোধ হয় সুবহানের ইগোতে লাগলো।ছো মেরে রিভলরার তুলে উঠে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন
“আমি কখনো হারিনি আজ ও হারবো না।তোকে আমি বাঁচতে দেবো না সারফরাজ।
কথাটি বলেই ট্রিগার চাপতে চাইলো সুবহান।সুবহান কে সেই সুযোগ না দিয়ে খপ করে রাম দা তুলে নিয়ে এক কোপ বসিয়ে দিলো সারফরাজ।মুহূর্তেই মাটিতে ঢলে পরলো সুবহান এর খন্ডিত দেহ।সুবহান এর পতিত দেহের পানে তাকিয়ে সারফরাজ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে কম্পিত স্বরে বলে উঠলো
“চেকমেট নানা জান।সম্পর্কের মূল্য আপনি না দিলে আমি একা দেবো কেনো?

ভোরের আলো ফুটলো একদম অন্যভাবে।সকাল থেকেই সূর্য খানা তির্যক আলো বিলিয়ে চলেছে।পাখির কলতানের বিপরীতে কাকের কাকা ধ্বনি কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।চারপাশে রক্তের পঁচে যাওয়া গন্ধ আর মাছির ভনভনানী শব্দে পেট গুলিয়ে উঠার উপক্রম।হাবেলীর আঙিনায় কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ শব্দে উত্তাল করে তুলেছে পুরো বাড়ি
সবগুলো লাশ স্তুপ করে তার উপর উঠে এক পা ঝুলিয়ে আরেক পা ভাঁজ করে হাঁটুতে মাথা রেখে চোখ বুজে বসে আছে সারফরাজ।হাতে এখনো সেই রক্তাক্ত ভয়ানক দা।সারফরাজ এর তন্দ্রা ভাব ছুটলো পুলিশের গাড়ির সাইরেনে।তবুও উঠে দাঁড়ালো না।মিনিট দুইয়ের ব্যবধানে খাকী পোশাকে ভরে গেলো চারপাশ।ইন্সপেক্টর নিয়াজ মোর্শেদ আদেশ করলেন
“এরেস্ট হিম
সারফরাজ তখনো নির্বিকার।একজন হাবিলদার ভয়ে ভয়ে গিয়ে হাতকড়া পরালো সারফরাজ এর হাতে।এরপর টেনে হিচড়ে নামালো লাশের স্তূপের উপর থেকে।নিয়াজ মোর্শেদ আদেশ দিলো

” চারপাশে তল্লাশি চালাও
এমন সময় ভেসে এলো বাচ্চার কান্না।এবার সারফরাজ মুখ খুললো।বলে উঠলো
“সমস্ত মনস্টার বধ করেছি আমি।আর ভয় নেই রূপকথা।এবার তুমি নিরাপদ।
কথাটি বলেই পকেট থেকে চাবি এগিয়ে দিলো।সেই চাবি নিয়ে দৌড়ে গিয়ে একজন কনস্টেবল খুলে দিলো রূপকথার কক্ষের দরজা।ছাড়া পেয়ে দৌড়ে এসে সারফরাজ এর কোমর জড়িয়ে ভয়ার্ত স্বরে রূপকথা বললো
“তোমার শরীরে কিসের রক্ত?
উত্তর করবার আগেই নিয়াজ মোর্শেদ আদেশ দিলেন
“এই নিয়ে চলো একে।কোনো মানুষ নয় এই ছেলে।আস্ত এক রাক্ষস।
টানতে টানতে সারফরাজ কে নিয়ে গেলো কনস্টেবল।কিন্তু রূপকথা চেপে ধরে রইলো সারফরাজ এর হাত।আর কেঁদে কেঁদে পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?ওকে বেঁধেছ কেনো?আমি ওকে কোত্থাও নিয়ে যেতে দেবো না।
নিয়াজ মোর্শেদ রাগী স্বরে শুধালো

“এই খুনী কি হয় তোর?
রূপকথাকে তুই সম্বোধন পছন্দ হলো না সারফরাজ এর।ধমকে জবাব দিলো
“একটা বাচ্চার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা এখনো শিখেন নি অফিসার?
সারফরাজ এর তিরস্কারে নিয়াজ মোর্শেদ এর পায়ের রক্ত মাথায় উঠলো।সারফরাজ এর শার্টের কলার চেপে ধরে নাক মুখ বরাবর তিন চারটে শক্ত ঘুষি বসিয়ে বলে উঠলো
‘রিমান্ডে নিয়ে একজন পুলিশ অফিসারের সাথে কি করে কথা বলতে হয় তোকে শেখাবো আমি।
কথাটি বলেই চোখ গরম করে বলে উঠলেন
“কুকুরের মতো ধরে বেঁধে নিয়ে চলো একে ।

সারফরাজ এর এহেন অসহায় অবস্থায় জোরে জোরে কেঁদে উঠলো রূপকথা।সে কিছুতেই ছাড়লো না সারফরাজ কে ।কনস্টেবল হাজার চেষ্টা করেও সরাতে পারলো না তাকে।সে সারফরাজ এর কোমর চেপে সারফরাজ এর সাথে সেটে রইলো।শেষমেশ উপায় না পেয়ে রূপকথা কে সহ থানায় নিয়ে চললেন নিয়াজ মোর্শেদ।
সুবহান গংবের মৃত্যুকে কেন্দ্র হয়ে পুলিশ স্টেশনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।রিপোর্টাররা থানার সামনে ভীড় করেছে ক্যামেরা নিয়ে।বিশেষ শেল্টারে সারফরাজ কে গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে পৌঁছানোর আগেই রিপোর্টাররা ঝেঁকে ধরলো তাকে।নিজেদের উত্তেজনা আর কৌতূহল থামাতে না পেরে একজন রিপোর্টার শুধালো
“এতগুলো মানুষের হত্যা এই টুকু বয়সে কীভাবে করলে তুমি?তোমার পরিচয় কি?নিশ্চয় তোমার বাবা কোনো হৃদয় হীন খুনি তাই না?গায়ে খুনির রক্ত বইছে বলেই ঠান্ডা মাথায় এত গুলো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েও সুস্থ মস্তিষ্কে দাঁড়িয়ে আছো।

চেকমেট পর্ব ৪

রিপোর্টার এর কথায় গায়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো সারফরাজ এর।হ্যান্ডকাফ ওয়ালা হাতেই ছো মেরে রিপোর্টার এর গলা টিপে ধরে ভয়ানক চোখে তাকিয়ে গর্জে বলে উঠলো
“মাই ফাদার ওয়াজ নট এ মার্ডারার।হি ওয়াজ এন আর্মি অফিসার।লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাদাফ শাহজাইন।লিসেন ওয়ান মোর টাইম।হি ওয়াজ এন আর্মি অফিসার।নট এ কিলার।এন্ড ডিজ বাস্টার্ড কিলড হিম।

চেকমেট পর্ব ৬