অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৬

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৬
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশির জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করল৷ চোখ তুলে তাকাতেই ফিনাইলের তীব্র গন্ধ এলো নাকে। মাথায় হাত দিয়ে আরুশি মনে করার চেষ্টা করল জ্ঞান হারানোর আগের মুহুর্তটা। সাথে সাথেই তার মনে পড়ে গেলো সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের কথা। আরুশি নিজেকে ধরে রাখতে পারল না যেন। শুরু হলো তার ছটফটানি। সে দ্রুত হাসপাতাল বেড থেকে ওঠার চেষ্টা করল। এমন সময় আরহাম দৌড়ে এসে আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”আরুশি..শান্ত হও।”

আরুশি বলে ওঠে,”আমার পাপা..পাপা ঐ অফিসেই ছিল..ওখানে আগুন…আমি কিছু ভাবতে পারছি না।”
আরহাম আরুশির দিকে অসহায় চোখে তাকায়। তার নিজের চোখও পানিতে পরিপূর্ণ। আরুশি আরহামকে বলে,”পাপা ঠিক আছে তো? পাপার কিছু হয় নি তো? আর আম্মুই বা কোথায়?”
আরহাম আরুশিকে বলে,”ডাক্তার তোমায় বিশ্রাম নিতে বলেছে।”
“আমি পরে বিশ্রাম নেব। আগে বলুন আমার পাপার কিছু হয় নি তো না? আর আম্মু এখন কেমন আছে? আম্মুকে তো আমি আটকাতেই পারলাম না। আমার কথা না শুনেই আম্মু দৌড়ে চলে এলো। নিশ্চয়ই পাপার জন্য অনেক চিন্তা করছে আম্মুও।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহাম বলে,”আরুশি..তুমি নিজেকে শক্ত করো।”
“কেন? নিজেকে শক্ত করতে হবে কেন। আর আপনি আমায় কিছু বলছেন না কেন? আমায় পাপা আর আম্মুর খোঁজ দিন প্লিজ।”
“আমি তোমাকে ওনাদের কাছে নিয়ে যাব কথা দিচ্ছি। তবে তুমি আমায় কথা দাও, তুমি নিজেকে শক্ত রাখবে।”
“আপনার কথা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। বেশ, চলুন।”
আরহাম আরুশির হাত ধরে ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যেতে থাকে। আরুশির বুক ভীষণ কাপছিল অজানা আশংকায়। সে নিজের বুকে হাত দিতে বলে,”কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে আমার? পাপা-আম্মু সবাই ঠিক আছে তো?”
হঠাৎ করেই আরহাম আরুশিকে মর্গের সামনে এনে দাঁড় করায়। আরুশি হতবাক হয়ে যায়। তার সব সাহস যেন শেষ হয়ে যায়। আরহাম আরুশির অবস্থাটা বুঝতে পেরে তাকে শক্ত করে চেপে ধরে। আরুশি বলে,”আমায় এখানে কেন নিয়ে এলেন আপনি? আমাকে আমার আম্মু আর পাপার কাছে নিয়ে চলুন।”

আরহাম কিছু না বলে আরুশিকে শক্ত করে ধরে মর্গের ভেতর প্রবেশ করে। অতঃপর তাকে একটি লাশের সামনে নিয়ে যায়। আরুশি তখন অব্দি নিজেকে সামলে রাখছিল। হঠাৎ করে লাশের উপর থেকে কাপড় সরানো হয়। মুখটা হালকা ঝলসে গেছে কিন্তু চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা জাঈদ শেখ। আরুশি এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। জাঈদ শেখের নিথর দেহের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। অতঃপর ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করল।
“পাপা..তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে যেতে পারো না। তুমি তো বলেছিলে..ফিরে এসে আমাদের সাথে একসাথে লাঞ্চ করবে। তোমাকে এই কথা রাখতে হবে। চোখ খোলো পাপা। তুমি এভাবে নিজের প্রিন্সেসকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারো না। প্লিজ পাপা চোখ খোলো..”
আরহাম আরুশির কাধে হাত রেখে বলে,”নিজেকে সামলাও আরুশি। এভাবে কেঁদো না। আমার খুব খারাপ লাগছে তোমায় এভাবে কাঁদতে দেখে।”

“কি বলছেন আপনি? আমার পাপা আর কখনো আমার মাথায় হাত বুলাবে না..আমায় প্রিন্সেস বলে ডেকে আমায় নিজের বুকে জড়িয়ে ধরবে না..আমি আর ভাবতে পারছি না।”
এমন সময় হঠাৎ পাশের লাশটির উপর থেকেও কাপড় সরে যায়। সেদিকে নজর পড়তেই আরুশি একদম পাথর হয়ে যায়। হতবাক স্বরে বলে ওঠে,”আম্মু!”
আরহামও এবার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কাঁদতে শুরু করে। আরুশি ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আরিশা খন্দকারের নিথর দেহের দিকে। নিজের মাকে এই অবস্থায় দেখবে সেটা কখনো কল্পনা করে নি আরুশি। একটু আগে সে ভেবেছিল শুধু নিজের বাবাকে হারিয়েছে কিন্তু এই মুহুর্তে সে একটা চরম নিষ্ঠুরতম সত্য আবিষ্কার করল যে, এখন এই দুনিয়ার তার আপন বলে আর কেউ নেই। আরুশি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আরুশির সামনে গিয়ে তার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরল। অতঃপর বলল,”তুমিও আমায় ছেড়ে চলে গেলে আম্মু! এই দিন দেখার জন্যই কি আমাকে অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিলে? আমাকে একটা পরিবার দিতেই তো তোমরা নিয়ে এসেছিলে নিজেদের সাথে তাই না? তাহলে আজ কেন আমায় আবারো একা করে চলে গেলে তোমরা? এতটা নির্দয় কেন হলে তোমরা? তোমরা জানো না তোমরা ছাড়া এই দুনিয়ায় তোমাদের আরুর আর কেউ নেই৷ এখন আমি বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাবো? আমাকেও কেন নিয়ে গেলে না তোমাদের সাথে? আমি একা বেঁচে আর কি করব? আমাকেও নিয়ে চলো তোমাদের সাথে। আমিও আর বাঁচতে চাই না..”

বলেই আরুশি হঠাৎ কয়েক ধাপ পিছিয়ে আসে। অতঃপর দৌড়াতে শুরু করে। আরহাম তাকে এভাবে পাগলের মতো দৌড়াতে দেখে তার পেছনে ছুটতে থাকে। আরুশি একদম হাসপাতালের ছাদে পৌঁছে যায়। অতঃপর বলে,”তোমরা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে কি ভেবেছ আমাকে এই দুনিয়ায় একা রেখে যাবে? তা হবে না। আমিও আসছি তোমাদের কাছে।”
বলেই আরুশি ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে যাবে এমন সময় আরহাম এসে আরুশিকে আগলে নেয়। অতঃপর রাগী কন্ঠে বলে,”কিসব পাগলামো করছ আরুশি? আজ যদি তোমার মা-বাবা বেচে থাকতেন তাহলে কি তারা এসব দেখে খুশি হতেন?”
“ওনারা তো আমায় ছেড়ে চলে গেছেন। আমি কেন ওনাদের কথা ভাবব। আমি আর কারো কথা ভাবব না। আমার আর এই দুনিয়ায় কেউ নেই।”
“কে বলেছে কেউ নেই। আমি আছি তোমার কাছে। তোমার স্বামী। আমি থাকতে তুমি নিজেকে আর কখনো একা দাবি করবে না।”
“কেউ আমার আপন না। সবাই আমায় ছেড়ে চলে যায়। জন্মের পর আমার জন্মদাতারা আমায় অনাথ আশ্রমে ফেলে রেখে গেছে। এখন আমার আম্মু-পাপাও আমায় ছেড়ে চলে গেল। আপনিও আমায় ছেড়ে যাবেন…আমার আর কোন আশা নেই এই জীবন নিয়ে..কোন আশা নেই।”
বলেই সে আবার ঝাপ দিতে যাবে কিন্তু এবার আরহাম তাকে আরো কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি আছি তোমার জন্য সবসময়। কখনো তোমায় ছেড়ে যাব না। কথা দিলাম।”

আনিকা খান, আফিফা খান দুজনেই কাঁদতে কাঁদতে অসহায় হয়ে পড়েছেন। আরিশা খন্দকার ও জাঈদের মৃত্যুর খবর পেয়েই তারা ঢাকা থেকে ছুটে চলে এসেছেন। বিশেষ করে আফিফা খান নিজেকে কোনভাবেই সামলাতে পারছেন না। ছোটবেলা থেকেই নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন নিজের বোনকে;আরিশা ছিল তার কলিজার টুকরা ছিল। যেই কলিজার টুকরা আজ বিছিন্ন হয়ে গেছে। আর আনিকা খান আরিশাকে জন্ম না দিলেও নিজের মেয়ের মতো বড় করেছেন তাকে। তাই তো মেয়ের মৃত্যুতে আজ তিনি অসহায়। আফিফা খান বলে ওঠেন,”এটা তুই কিভাবে কর‍তে পারলি বোনু? একবারো নিজের আপ্পির কথা মনে পড়ল না তোর? এভাবে আমায় ছেড়ে চলে যেতে পারলি তুই?”

বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন আরিশা খন্দকারের নিথর দেহের সামনে। নিঝুম খানও অশ্রু বিসর্জন করছেন। নির্ঝর খানও এককোণে দাঁড়িয়ে আছেন।
জানাজার সময় ঘনিয়ে আসতেই আরিশা খন্দকার ও জাঈদের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। নির্ঝর, আরহাম, আমান সহ জাঈদের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহযোগী তাদের খাটিয়া বহন করছিল। সেই সময় হঠাৎ দৌড়ে চলে আসে আরুশি। সে এসেই বলে ওঠে,”আমার আম্মু পাপাকে নিয়ে যাবেন না প্লিজ..আমি ওনাদের ছাড়া বাঁচব না। প্লিজ ওনাদের আমার থেকে দূর করবেন না।”
আফিফা খান আরুশিকে সামলাতে বলেন,”পাগলামী করিস না আরু…ওরা আর নেই। ওদেরকে ওদের শেষ গন্তব্যে যেতে দে।”
“নাহ, আমি ওদের কোথাও যেতে দেবো না।”
আরহাম এবার এগিয়ে এসে আরুশিকে আগলে নিয়ে বলে,”এরকম করো না আরুশি। সত্যটাকে মেনে নাও৷ নিজেকে শক্ত করো।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৫

আরুশি আরহামে জড়িয়ে ধরে আবারো ছোট্ট বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে রাজীব। সে এসেছিল আরুশির এই শোকের সময়ে তার পাশে থাকতে। কিন্তু বুঝল, আরুশির পাশে থাকার জন্য অন্য কেউ আছে। এতে তার খারাপ লাগলেও সে রাগ করল না। বরং প্রার্থনা করল,”আরু আমার হোক বা অন্য কারো, ও যেন এই দুঃখ সামলে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। তোমার কাছে শুধু এটাই চাওয়া আল্লাহ।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৭