চেকমেট পর্ব ৬

চেকমেট পর্ব ৬
সারিকা হোসাইন

রূপকথার চিৎকারে থানায় উপস্থিত প্রত্যেকের নাজেহাল অবস্থা।মাটিতে গড়াগড়ি দেবার জোগাড় হয়েছে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার।সারফরাজ কে কিছুতেই লকাপে ভরতে দেবে না সে।একদিকে বাইরের কৌতূহলী রিপোর্টার এর চাপ অন্যদিকে এই বাচ্চার অহেতুক কান্নায় নিয়াজ মোর্শেদ নিজের ক্রোধ আর সংবরন করতে পারলেন না।বোধ বৃদ্ধি হিনের মতো সারফরাজ কে নিজের রোলার স্টিক দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বেধড়ক পেটালেন।এহেন নিষ্ঠুর দৃশ্যে রূপকথা লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করে উঠলো।কিন্তু নির্বিকার নির্ভার হয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সারফরাজ। রূপকথা শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারলো না এই নির্মম দৃশ্য।ক্ষিপ্ত হয়ে নিয়াজ মোর্শেদকে এলোপাতাড়ি কিল খামচি দিয়ে হাতে কামড় বসিয়ে নিয়াজ মোর্শেদ এর বাহুতে এক প্রকার ঝুলে রইলো সে।ব্যাথায় নিয়াজ মোর্শেদ হাত ঝটকা দিতেই দূরে ছিটকে পরলো রূপকথা।পাশের কাঠের চেয়ারের সাথে লেগে কপালের কাছে বেশ খানিকটা কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো।ক্লান্ত ব্যাথার্ত সারফরাজ গুঙিয়ে বলে উঠলো

“আপনাকে আমি ছাড়বো না অফিসার।ও আমার আমানত।ওকে আঘাত করে বড্ড ভুল করে ফেলেছেন আপনি।এর জন্য চরম মূল্য চুকাতে হবে আপনাকে।
নিয়াজ মোর্শেদ দাঁতে দাঁত পিষে সারফরাজ এর মুখে এক ঘুসিয়ে বসিয়ে ধম্কে শুধালো
“কি করবি তুই?শরীরের গরম রক্ত রিমান্ডে নিয়ে একদম ঠান্ডা করে দেবো।পাছায় যখন গরম ডিম ঢুকবে তখন এতো তেজ থাকবে তো?সালা জানোয়ার কোথাকার।
নিয়াজ মোর্শেদ এর ঘুষির আঘাতে ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো সারফরাজ এর।পুরো মুখ ভর্তি রক্ত ।সফেদ দাঁত গুলো কেমন রঙিন হয়ে রাক্ষসের মতো দেখাচ্ছে সারফরাজ কে।থু করে সেই রক্ত মেঝেতে ফেলো বিদঘুটে হাসলো সারফরাজ।এরপর ফিসফিস করে পুনরায় বললো

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি তোকে খেয়ে ফেলবো অফিসার।জাস্ট খেয়ে ফেলবো।পারলে আমাকে মেরে ফেলিস।নয়তো তুই বাচবি না।
এবার যেনো নিয়াজ মোর্শেদ এর রক্ত ছলকে উঠলো।নিজের গান বেল্ট এর খাবলি থেকে রিভলবার নিয়ে সারফরাজ এর কপালে চেপে ধরতেই পুরো থানা পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো।মেঝেতে বুট ঠুকে স্যালুটের শব্দে পেছন ফিরলো নিয়াজ।পেছনে কমিশনার দাঁড়ানো।ভীত হয়ে গান সরাতেই পুলিশ কমিশনার রূপকথাকে মাটি থেকে তুলে কোলে নিলেন এরপর ভারী গলায় শুধালেন
“এই বাচ্চাকে আঘাত কে করেছে?
সারফরাজ নিয়াজ মোর্শেদ এর দিকে আঙ্গুল তাক করে বললো
“এই মানুষরূপী জানোয়ার টা ওকে আঘাত করেছে।
কমিশনার সারফরাজ এর চেহারার পানে নজর দিলো এবার।ছেলেটার চেহারা দেখেই ভয় লাগছে।পুরো শরীর রক্তে মাখামাখি।নিয়াজ তাকে এভাবে মেরেছে তা নিয়াজের এলোমেলো ইউনিফর্ম দেখেই বোঝা যাচ্ছে।কমিশনার মুখে কাঠিন্য ভাব এনে নিয়াজ মোরশেদ এর সামনে দাঁড়িয়ে শাসালেন

“নিজের লিমিটে থাকুন নিয়াজ সাহেব।দুটো অপরাধ একসাথে করেছেন আপনি।প্রথমত এই বাচ্চাটাকে আঘাত করে দ্বিতীয়ত আসামিকে বেধড়ক পিটিয়ে।রিমান্ড জারি হবার আগে আপনি তাকে এভাবে মারধর করতে পারেন না।তাছাড়া বয়স এখনো আঠারো হয়নি।কিশোর।যেখানে আদালত নিজেই ওর শাস্তি নিয়ে কনফিউজড থাকবে সেখানে আপনি শাস্তি দেবার কে?
নিয়াজ মোর্শেদ মাথা নত করে চুপ রইলো।কিন্তু কমিশনার উত্তেরের আশায় আবার ও ধমকে উঠলো
“কি হলো?এনসার দিন।
নিয়াজ আমতা আমতা করে বললো
“স্যার ও আমাকে হুমকি দিচ্ছিলো বারবার।

“হুমকি দিলেই এভাবে মারবেন?আর সে অযথা আপনাকে হুমকি কেনো দিতে যাবে?এখানে উপস্থিত এতগুলো পুলিশ কে সে হুমকি দিচ্ছে না।আপনাকে কেনো দিবে?আগের থানাতেও আপনার রিপোর্ট খুব খারাপ দেখেছি আমি।আসামি দের প্রতি একটু সদয় হোন।ওরাও মানুষ।
নিয়াজ মোর্শেদ চোরা চোখে সারফরাজ এর পানে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে উত্তর করলো
‘সরি স্যার।
কমিশনার নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে রূপকথার কপাল মুছতে মুছতে শুধালো
“ও তোমার ভাই হয়?
কান্না থামিয়ে মাথা নাড়ালো রূপকথা।কমিশনার নরম গলায় শুধালেন
“তবে কি হয় তোমার?এভাবে কাদঁছিলে কেনো ওর জন্য?
রূপকথা পুলিশ কমিশনার এর দুই হাত চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বললো
“ও আমার স্যাভিয়ের।ওকে ছেড়ে দাও।ওকে নিয়ে আমি বাড়ি চলে যাবো।প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও।এখানে ওই আংকেল ওকে খুব মারছে।আমার ভয় করছে।এভাবে মারলে সারফরাজ মরে যাবে না?
মেয়েটির কান্নায় কমিশনার এর বুকে চিনচিনে ব্যাথার উদ্রেক হলো।মেয়েটির গোটা গোটা হাতের স্পর্শে চোখে জল জমলো।পলক ঝাপটিয়ে সেই জল লুকিয়ে বলে উঠলো
“ও অপরাধ করেছে।ও তো বাড়ি যেতে পারবে না মামুনি।তোমার ঠিকানা বলো আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবো।

“আমার বাড়ি আমি চিনিনা।
রূপকথার উত্তরে অবাক হলো কমিশনার।চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধালো
“তোমার বাবা মা কোথায় থাকেন?
দুই হাতে চোখের জল মুছে আধো বুলিতে রূপকথা বললো
“আকাশের তারা হয়ে গেছে।আমি ওর কাছে থাকি।
কমিশনার ঘটনা বুঝতে পেরে কিছুক্ষন স্তব্ধ রইলেন।এরপর কোমল স্বরে বললেন
“তুমি আমার সাথে যাবে?
তড়িৎ মাথা নেড়ে রূপকথা সারফরাজ এর পানে আঙ্গুল নির্দেশ করে বললো
“আমি ওর কাছে থাকবো।আর কোত্থাও যাবো না
কমিশনার বুঝলেন পুরো বিষয়।তাই আর না ঘাঁটিয়ে নিয়াজ মোর্শেদ কে আদেশ দিলেন
“মেয়েটাকে সহ লকাপে রেখে দিন।আজ রাত টুকু মেডিকেল সেল এ থাকার ব্যবস্থা করুন ওদের।আর বাচ্চাটাকে ভয় ভীতি দেখিয়ে ডিস্টার্ব করবেন না কেউ।যদি মেয়েটির কান্না আবার আমার কানে যায় তবে সবাই এর জন্য জবাবদিহিতা করতে বাধ্য থাকবেন।
নিয়াজ মোর্শেদ বাঁধ সেধে বলে উঠলেন
“কাল সকালেই ওকে কোর্টে চালান করতে হবে স্যার।মেয়েটা কিছুতেই ওকে ছাড়ছে না।এভাবে একটা বাচ্চা এমন ভয়ানক ক্রিমিনাল এর কাছে কিভাবে রাখবো স্যার?
কমিশনার শুকনো হাসলেন।এরপর বললেন
“শিশুরা ভালোবাসার কদর সব চাইতে ভালো বুঝে নিয়াজ সাহেব।আমরা যাকে ভয়ানক খুনি ভাবছি সে এই মেয়েটির রক্ষাকর্তা।তাই বেশি না বুঝে যা করতে বলেছি তাই করুন।

নিজ কার্যালয়ে বসে বসে রূপকথার কথা এক মনে ভেবে চলেছেন কমিশনার।মেয়েটির বড় বড় চোখ গোলাপি ঠোঁট , শ্বেত শুভ্র গায়ের রঙ আর মায়াবী চেহারা তার হৃদয় কে ক্ষতবিক্ষত করছে।নিজের সন্তানের কথা মনে পড়তেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু পুরুষ চাইলেই কাঁদতে পারেনা।হৃদয় ব্যাথায় টনটনে হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে চলতে হয়।নইলে মানুষ খেতাব দেয় কাপুরুষ।
হঠাৎ সেলফোনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার।স্ক্রিনে মেইড সার্ভেন্ট এর নম্বর দেখে হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে ফোন তুললেন তিনি।ওপাশ থেকে অল্প বয়সী মেইড এর উত্তেজিত আওয়াজ পাওয়া মাত্রই কমিশনার বললেন
“আমি আসছি।
ফোন কেটে সমস্ত চিন্তা ভুলে ছুটে চললেন বাংলো অভিমুখে।থানার কাছাকাছি হওয়ায় বেশি সময় লাগলো না বাসায় পৌঁছাতে।ঘরে ঢুকে এলোমেলো ভাঙচুর করা জিনিসের ছড়াছড়ি দেখতে পেলেন মেঝে জুড়ে।ড্রয়িং রুমে এখনো ভুল ভলিউমে টিভি চলছে।দৌড়ে যেতে নিলেই সিরামিক এর একটা মগ ছুটে এসে তার কপাল বরাবর লাগলো।কপাল চেপে ধরেই দৌড়ে বেড রুমে গিয়ে ডেকে উঠলেন

“রেখা!
স্বামীর গলা পেয়ে সার্ভেন্ট কে ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে কমিশনার এর শার্টের কলার টেনে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলে উঠলেন
“ওখানে আমার বাচ্চা।আমার বাচ্চাকে এনে দাও সুফিয়ান।ও ভয় পাচ্ছে।ও কাঁদছে।আমার ছোট বাচ্চাটা কাঁদছে।আমাকে এক্ষুনি এনে দাও।এনে দাও।
সহধর্মীনির এমন উন্মাদনা দীর্ঘ আটটি বছর ধরে সহ্য করতে করতে সুফিয়ান চৌধুরী যেনো পাথরে পরিণত হয়েছেন।অধিক আদরের একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মস্তিষ্ক বিকল রোগে ভুগছেন রেখা।সুন্দর কোনো মেয়ে বাচ্চা দেখলেই উন্মাদ হয়ে উঠেন ।কোনো ভাবেই এই হাইপার একটিভিটি কমানো যায়না।শেষমেশ উপায় হিসেবে হাই ডোজের ঘুমের ওষধ নয়তো ইলেকট্রিক শক।কতোদিন চলবে এই বেদনার্ত খেলা?
রেখাকে বুকে চেপে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করলেন সুফিয়ান চৌধুরী।এরপর আহত মেইড এসে বললো
“টিভিতে সুবহান গং হত্যার নিউজ দেখতে দেখতে উনি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন আমার বাচ্চা বলে।এরপর থেকেই এমন চলছে স্যার।কোনো ভাবেই ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।
সুফিয়ান কি মনে করে স্ত্রী কে বললেন
“আমার সাথে থানায় যাবে রেখা?
চকচকে চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে রেখা বাচ্চাদের মতো বললো
“ওখানে তুনতুন আছে?
চোখের জল আড়াল করে সুফিয়ান বললেন
“হ্যা।
রেখা আর অপেক্ষা করতে চাইলো না।সুফিয়ান কে বগল দাবা করে থানা অভিমুখে ছুটলো।

মেডিকেল সেল এর বেডে সারফরাজ কে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে রূপকথা।বাবা মায়ের পর এই মানুষটি তার আশ্রয়স্থল।মানুষটির সাথে তার কি সম্পর্ক রূপকথা জানে না।সে শুধু জানে মানুষটি তাকে আগলে নিয়ে রক্ষা করতে জানে।সারফরাজ ছাড়া রূপকথার যাবার কোনো জায়গা নেই।রূপকথা যেতেও চায় না।সারফরাজ যেখানে যাবে সেও সেখানেই যাবে।মা ছাড়া যেমন সন্তানের চলে না সারফরাজ ছাড়াও রূপকথার চলবে না।কিন্তু নিয়তি কি লিখে রেখেছে তার জন্য?
রূপকথার কাটা জায়গায় হাত বুলিয়ে গভীর নজরে পরখ করে চলেছে সারফরাজ।অজানা ব্যাথায় বুকটা কেমন যেনো করে উঠছে মেয়েটার সামান্য ক্ষততে।কি নাম এই ব্যাথার।
নিজের রক্তাক্ত কেটে যাওয়া হাত রূপকথার মাথায় বুলিয়ে সারফরাজ নরম গলায় শুধালো
“অনেক লেগেছে তাই না?
মাথা দুলিয়ে রূপকথা বললো

“আমার লাগেনি।তোমার অনেক লেগেছে তাই না?
স্মিত হেসে সারফরাজ রূপকথার গাল টিপে বললো
“আমারও লাগেনি।
সারফরাজ এর ঠোঁটের ক্ষততে উৎসুক হয়ে ছোট বাচ্চা সুলভ অল্প হাত বুলালো রূপকথা।ব্যাথায় চোখ বুজে ফেললো সারফরাজ।সেটা দেখে দ্রুত হাত সরিয়ে রূপকথা বললো
“আমরা বাড়ি যাবো কবে?
সারফরাজ জানে সে আর বাড়ি ফিরবে না।আজীবন তাকে সাজা ভোগ করতে হবে।একটা নয় দুটো নয় অনেক গুলো মানুষের প্রাণ নিয়েছে সে।আইন এতোটাও উদার নয় যে তাকে কিশোর বলে সহজেই মাফ করবে।তপ্ত কম্পিত শ্বাস ছেড়ে সারফরাজ রূপকথার পানে নজর দিল।এরপর ব্যাথিত স্বরে বললো
“আমি আর এই কঠিন দেয়ালের ভেতর থেকে বের হতে পারবো না রূপকথা।
“তাহলে আমিও এখানে থাকবো।
“এখানে সব দৈত্য দানবের বসবাস।তুমি তো রাজকুমারী।রাজকুমারী কি করে দৈত্যের সাথে বাস করবে বলো তো?
“তুমি তাহলে সব দৈত্য মেরে দাও।

এবার গলা ধরে এলো সারফরাজ এর।রূপকথার এলোমেলো চুলের ঝুটি বেঁধে দিতে দিতে সারফরাজ বললো
“আমি নিজেই তো একটা দৈত্য রূপকথা!
ছোট রূপকথা সারফরাজ এর কথার গভীরতা পরিমাপ করতে পারলো না।তার কাছে কথাটা মজার মনে হলো ।ছোট গোল গোল হাত দুটো দিয়ে মুখ চেপে খিল খিল করে হাসলো রূপকথা।সেই হাসির পানে তাকিয়ে সারফরাজ শুধালো
“আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে তুমি রূপকথা?
নিজের ছোট হাতের আজলায় সারফরাজ এর দুই গাল ধরে রূপকথা আদুরে ভঙ্গিতে বললো
“আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না সারফরাজ।
এমন সময় একজন কনস্টেবল এসে সারফরাজ কে ডেকে বলে উঠলো
“কমিশনার আসছেন।

সারফরাজ ভীতি হীন রূপকথার হাত চেপে ধরে বসে রইলো।কনস্টেবল বিদায় নিতেই দৌড়ে সেলের ভেতর প্রবেশ করলো রেখা।চোখে মুখে অনন্য খুশির দ্যুতি তার।এসেই রূপকথা কে বুকে জড়িয়ে চোখে মুখে হাজারো চুমু আকলো।আকস্মিক এমন কাণ্ডে ভড়কে গেলো রূপকথা।সারফরাজ ভাবলো হয়তো রূপকথার আত্মীয়।কোনো কিছু বুঝে উঠবার আগেই রেখা বলে উঠলো
“এখানে এমন ভয়ানক মানুষের কাছে কেনো বসে আছো তুনতুন?বাড়ি চলো।কখন থেকে খুঁজে চলেছি তোমায়।
বলেই টেনে হিরহির করে রূপকথা কে নিয়ে যেতে চাইলো রেখা।কিন্তু সারফরাজ এর হাত খামচে ধরে কেঁদে উঠলো রূপকথা।
“আপনাকে আমি চিনি না।আমি যাব না।
রেখা কিছু বলার আগেই সুফিয়ান চৌধুরী বলে উঠলো
“ওকে ছেড়ে দাও রেখা।ওকে আমরা রাতে বাড়িতে নিয়ে যাবো।
এবার রিয়াক্ট করে উঠলো রেখা।চিৎকার করে বলে উঠলো
“সারাদিন পর বাচ্চাকে খুঁজে পেলাম।আমার মানিক আমি ফেলে কিচ্ছুতেই যাবো না।
“পাগলামো করো না রেখা।
চিৎকার করে রেখা বলে উঠলো

“আমার মেয়েকে ফেলে আমি কিছুতেই যাবো না সুফিয়ান।আর এই ছেলেটা তো খুনি।টিভিতে দেখেছি ওকে আমি।আমার মেয়ে এর সাথে কি করছে এখানে?
কথাটি বলেই আবার টানা হ্যাচড়া শুরু করলো রূপকথা কে।সারফরাজ বুঝলো পুরো ঘটনা।রেখার চোখে মুখে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট।কথা বার্তায় স্বাভাবিক নয়।যেখানে সারফরাজ নিজে রূপকথার বাবা মা কে মরতে দেখেছে সেখানে এই মহিলা কিছুতেই রূপকথার মা হতে পারে না।
কমিশনার কিছু বলার আগেই সারফরাজ বললো
“উনি তোমার খালামণি রূপকথা।উনাকে ভয় পেও না।
সারফরাজ এর কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো রেখা।সারফরাজ কে ধমকে বলে উঠলো
“আমি ওর মা।পাগল হয়ে গেছো তুমি?
পরিস্থিতি ঘোলা বুঝতে পেরে রেখাকে বহু কষ্টে সামলে নানান বুঝ দিয়ে বের করে নিয়ে গেলো সুফিয়ান চৌধুরী।কিন্তু রেখা বার বার বললো
“প্রমিস করো সুফিয়ান রাতে ওকে বাড়িতে নিয়ে আসবে।
সুফিয়ান মিথ্যে শান্তনা দিয়ে বললো
“ঠিক আছে নিয়ে যাবো।

রাতের আধার এসে গ্রাস করেছে ধরণী।ঘড়ির সময় জানা নেই সারফরাজ এর।হাজতের কঠিন দেয়াল পাড় করে এখানে বাইরের কোনো সাড়াশব্দ আসে না।চারপাশে শুধু পুলিশের বুটের শব্দ ব্যতীত সব কেমন ধোঁয়াশা।
রূপকথা কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে।কমিশনার স্পেশাল খাবার পাঠিয়েছে তার জন্য।মুখের আঘাতের কারনে সারফরাজ কিছু খেতে পারেনি।থেকে থেকেই মেয়েটি ঘুমের ঘোরে বলে উঠছে
“আমি সারফরাজ কে ছেড়ে যাবো না।
মেয়েটির মুখের মায়ায় সারফরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে
“সম্পর্কে তুমি আমার কেউ না।অথচ টান যেনো জনম জনমের।
কথাটি বলেই রূপকথার কপালের আঘাতের স্থানে অল্প হাত ছুঁইয়ে আদর করলো সারফরাজ।
হঠাৎ ভারী বুটের শব্দে নড়ে চড়ে উঠলো সারফরাজ।সারফরাজ ধরেই নিলো নিয়াজ মোর্শেদ তাকে শায়েস্তা করার জন্য আসছে বোধ হয়।কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে কমিশনার সুফিয়ান চৌধুরী ভেতরে প্রবেশ করে বলে উঠলো
“বাচ্চাটা আমাকে দিবি সারফরাজ?

সরফরাজ যেনো কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুফিয়ান চৌধুরীর পানে।সুফিয়ান চৌধুরী আবারো অসহায়ের ন্যয় বলে উঠলো
“দুপুরে যাকে দেখলি ও আমার স্ত্রী।ভালোবেসে বিয়ে করেছি।টাকা পয়সা ক্ষমতা কিচ্ছুটির অভাব নেই।অভাব কিসের জানিস একটা সন্তানের।
সারফরাজ অবাক হয়ে শুনতে লাগলো কমিশনার এর কথা গুলো।কমিশনার রূপকথার ঘুমন্ত মুখের পানে তাকিয়ে আবার বললো
“বিয়ের চৌদ্দ বছর পর মা হয়েছিলো রেখা।মা হতে পেরে কি খুশি ই না হয়েছিলো সেদিন।দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রেখার কোল আলো করে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান এলো আমাদের।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পাঁচ বছর বয়সে মেয়েটা রোড এক্সিডেন্ট এ আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।রেখার সামনেই ঘটেছে এই দুর্ঘটনা।চোখের সামনে নিজ সন্তানের নির্মম মৃত্যু সইতে পারেনি সে।সাথে সাথেই ব্রেন শর্ট হয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে।এরপর থেকে আগের হাসি খুশি শান্ত স্থির রেখা হারিয়ে গেছে। যেই রেখা বেঁচে আছে সে বদ্ধ উন্মাদ,বিক্ষিপ্ত, চঞ্চল।
কথা গুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন কমিশনার।সে সারফরাজ এর হাত চেপে ধরে সিক্ত গলায় আবারো বললেন

“তোর কোনো ভবিষ্যত নেই সারফরাজ।মেয়েটার যাবার কোনো জায়গা নেই তোর অবর্তমানে।তোর জেল হবে যাবজ্জীবন।এতগুলো বছর কে দেখবে এই বাচ্চা টাকে?তোর সাথে সাথে এই ফুটফুটে বাচ্চাকে কতোদিন জেলে রাখতে পারবি তুই?কোর্টে রায় হলে তোকে পাঠানো হবে সংশোধনাগারে আর এই বাচ্চাকে দেয়া হবে কারো হেফাজতে।মেয়েটা হুট করে মানিয়ে নিতে পারবে সেসব?বিবেক বুদ্ধি দিয়ে একবার মেয়েটার ভবিষৎ ভেবে দেখ।
সারফরাজ মাথা নত করে নীরব রইলো।মন এতো ভার কেনো হচ্ছে এসব শুনে?রূপকথা তার কেউ না।তবুও তাকে ছাড়তে মন সায় দেয়না কেনো?
“মেয়েটাকে দেখার পর থেকে রেখা স্বাভাবিক আচরণ করছে বাসায়।বাচ্চার জন্য রান্না করছে,ঘর গুছাচ্ছে,তুনতুনের কাপড় বের করে গুছিয়ে রাখছে।আচরণ একদম স্বাভাবিক।নিজের স্ত্রীকে দীর্ঘ আট বছর পর এমন হাসিখুশি দেখে বড্ড লোভ হচ্ছে জানিস?উহু মোটেও এমনি এমনি মেয়েটাকে নিয়ে যাবো না।তোকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাবো।

কথাটি বলেই সারফরাজ এর পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসে গেলেন সুফিয়ান চৌধুরী।আকস্মিক এমন কাণ্ডে সরে দাঁড়ালো সারফরাজ।সুফিয়ান ব্যথিত কন্ঠে বললেন
“দীর্ঘ জীবনের দায়িত্বে আজ অসৎ হতে চলেছি।গায়ের উর্দিতে কলঙ্ক লাগাতে চলেছি।শুধুমাত্র প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের হাসি আর তার স্বভাবিক জীবন যাপনের জন্য।কোর্টে চালানের পথে তোকে পালানোর সমস্ত পথ আমি খুলে দেবো সারফরাজ।শুধু তাই নয় এই দেশ থেকে অন্য কোথাও তোকে পাঠিয়ে দেবো।যেখানে তোর অপরাধ সম্পর্কে কেউ জানবে না।কেউ অপরাধী খুনি বলে তোর দিকে আঙ্গুল এ তুলবে না।শুধু মেয়েটাকে ভিক্ষে দে আমাকে।দেখ বয়সে কতবড় হয়ে তোর পায়ের কাছে বসে আছি আমি।দিবি?
সারফরাজ চোখ বুজে নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে নিলো।সত্যি তার এই অনিশ্চিত জীবনে মেয়েটি কে জড়িয়ে শুধু শুধু কষ্ট বৈ আর কিছুই দেয়া হবে না।এর চাইতে রূপকথা কমিশনার এর পরিবারের কাছে থাকলে ভালো থাকবে।ওর সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে।রূপকথার ভবিষ্যত চিন্তা করে মাথা ঝাঁকালো সারফরাজ।এরপর বুক পকেটে থেকে একটা রক্তাক্ত ছবি বের করে কম্পিত হাতে সুফিয়ান চৌধুরীর পানে এগিয়ে বললো

চেকমেট পর্ব ৫

“আমার মাকে খুঁজে দেবেন?
দ্রুত হাতে ছবি নিয়ে সুফিয়ান বললো
“দেবো।
সারফরাজ একবার রূপকথার মাথায় হাত বুলালো।এরপর বললো
“আগলে রাখবেন।বড় লোকের মেয়ে।বাবা জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলো।আমার সামনেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তারা।
মাথা ঝাকিয়ে সায় জানিয়ে ঘুমন্ত রূপকথাকে কোলে তুলে বুকে জড়ালো সুফিয়ান।এরপর চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো।
সারফরাজ ব্যাথিত স্বরে বললেন
“কাল একবার নিয়ে আসবেন।শেষ দেখা দেখবো।

চেকমেট পর্ব ৭