তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৭
ফারহানা নিঝুম
রাত গভীর। সড়ক ফাঁকা, শুধু স্ট্রিটলাইটের ক্ষীণ আলো পড়ে আছে কালো পিচের উপর। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে, আশেপাশে নিস্তব্ধতা।
তাশফিন স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে আছে। তার চোখ সামনে, কিন্তু মন কোথাও হারিয়ে গেছে। ফারাহর মুখটাই বারবার চোখে ভাসছে সেই অপেক্ষারত চোখ, অভিমানের আড়াল যা তাশফিন সেদিন এড়িয়ে গিয়েছিল।
গাড়ির গতিবেগ একটু বেশি। মাথার ভেতর চিন্তার ঝড়। সে কি ঠিক করেছিল? এক বছর আগের সেই ভুল কি আর ফিরে ঠিক করা যাবে না?
হঠাৎ!
কোথা থেকে যেন একটা চিৎকার ভেসে এল! সামনে এক ঝলক আলো একটা ট্রাক!
তাশফিনের দুই হাত স্টিয়ারিংয়ে শক্ত হয়ে চেপে ধরল, ব্রেক চাপতে গিয়েও যেন দেরি হয়ে গেল।
ধাক্কা!
একটা প্রচণ্ড শব্দ! শরীরটা ঝাঁকিয়ে উঠে গেল। পৃথিবী যেন উল্টে যেতে লাগল!
রাতের নীরবতা চিত্তে এক পশলা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। শহরের এক ফাঁকা রাস্তায় তাশফিন দ্রুত হাঁটছিল। প্রচন্ড রকম আ’ঘাত পেয়েছে ইতিমধ্যেই ।পায়ের গতি দ্রুত ,কিছুই ঠিক লাগছে না তার কাছে।আপাতত রিসোর্টে পৌঁছাতে হবে তাকে।
চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু তার জুতোর শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ফাঁকা রাস্তায়।তখনই একটা চাপা আওয়াজ!সসস… প্যাঁক!
তাশফিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকের বাঁ দিকে প্রচণ্ড এক আ’ঘাত! শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে কয়েক কদম টলতে টলতে পড়ে গেল রাস্তার পাশে।
চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে, মাথার ভেতর তীব্র ঘূর্ণি। বুকের কাছে গরম, আঙুলে ছুঁয়ে সে অনুভব করল র’ক্ত!
দূরে কোথাও একটা গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, তারপর দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া ইঞ্জিনের গর্জন।
তাশফিন নিঃশ্বাস নিতে চাইল, কিন্তু বাতাস যেন আটকে গেছে কোথাও। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“শুনতে পাচ্ছেন? লেফটেন্যান্ট সাহেব? লেফটেন্যান্ট সাহেব কথা বলুন? আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন না?”
আধো আধো চোখ মেলে তাকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাশফিন।চোখের সামনে অস্থির কন্ঠে তাকে ডেকে চলেছে ফারাহ কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা।
“আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? শুনুন না?”
এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে ফারাহ। কন্ঠে অস্থিরতা, দৃষ্টি এলোমেলো।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহা থরথর করে কাঁপছে। ফিসফিসিয়ে বলল।
“ফারাহ চল চল আমরা যাই। শুধু শুধু নিজেদের বিপদ…
“চুপ কর।”
কথার পিঠে থামিয়ে দিল ফারাহ।এই তো বেলী এসেছিল নাইওরি হয়ে।তারা গিয়েছিল দেখা করতে।ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে আসে, চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আকস্মিক প্যাচ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ কর্ণ কুহু হওয়া মাত্র থামতে হলো তাদের। ঝোপঝাড়ের পিছনে পড়ে ছিল তাশফিন।তাকে দেখে আঁ’তকে উঠে ফারাহ। গরম গরম তরল পদার্থ বেরিয়ে আসছে বক্ষপট হতে। ফারাহর বুঝতে বাকি রইল না ব্যাপারটা কি।
“তুই কি পাগল স্নেহা?এই একজন গুলি খাওয়া ব্যক্তি কে ফেলে চলে যাবো?”
নিঃশ্বাস থেমে থেমে চলছে তাশফিনের। মেয়েলি কন্ঠস্বর টা বার বার কর্ণে ভারী খাচ্ছে তার।
রক্তে মাখামাখি হয়ে উঠেছে ফারাহ,টেনে তোলার চেষ্টা করছে তাশফিন কে।
“একটু উঠুন প্লিজ।”
শক্তপোক্ত দেহের পুরুষ কে টেনে তুলতে হাঁপিয়ে যাচ্ছে ফারাহ।তাকে সাহায্য করছে স্নেহা।
টিপটিপ বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর চারপাশে একটা ভিজে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে শেষ কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল মাটিতে।যেন প্রকৃতি ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। মাটি ভিজে গিয়ে এক ধরনের সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত।পথের ধারে ছোট ছোট পানির গর্ত জমে যায়, যেখানে বৃষ্টির ফোঁটার মৃদু দুলছে।
বাড়ির পিছনে চিলেকোঠার ঘরটায় টেনে নিয়ে গেল ফারাহ তাশফিন কে।এই ঘরটা তাদের ভাই বোনের জন্য বরাদ্দকৃত।যখন সবাই একসাথে হয় তখন মাঝে মাঝে আড্ডা দেয় ঘরটায়।বড় বিছানা এক পাশে, বাল্ব লাইটা জ্বালিয়ে দিল স্নেহা। ভয়ে কাঁপছে সে,সবটা কেমন হঠাৎ করে ঘটে গেল। ফারাহ মানবিকতার খাতিরে এখানে নিয়ে এসেছে তাকে। অথচ বাড়ির কেউ জানতে পারলে কি হবে তা ভেবেছে ফারাহ?
বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে আছে তাশফিন তার র’ক্তে মাখামাখি ফারাহ।সফেদ জামাটা লালচে হয়ে উঠেছে।এবারে মন পাড়ায় ক্ষীণ ভয় উদয় হলো। আবেগের বশে নিয়ে তো চলে এসেছে। কিন্তু এখন কি হবে?ভীত নয়নে এক পলক দেখে স্নেহা কে।তাশফিনের বুক থেকে এখনো র’ক্ত বের হচ্ছে।গুলিটা বের করতে হবে, না হলে র’ক্ত বন্ধ হবে না তো!
“স্নেহা এবার কি করব?”
“আমি জানি না।তুই জানিস কি করবি! ভুলে যাস না উনি একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কিন্তু..
অন্তর আ’ত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে ফারাহর।
“র’ক্ত বন্ধ করতে হবে তো।”
স্নেহা পারে না কেঁদে দিক।
“এসব পারি না তো!”
নিম্নাষ্ট কাম’ড়ে ধরে ফারাহ।চট করে ছোট্ট মস্তিষ্ক কিছু একটা ভেবে ফেলল। ব্যস্ত কন্ঠে তাড়া দিয়ে বলল।
“তুই …তুই এক কাজ কর স্নেহা।যা যা গিয়ে দ্রুত গরম পানি এইটা ছু’ড়ি নিয়ে আয়।”
আহাম্মক বনে গেল স্নেহা। এগুলো দিয়ে কী করবে?
“কী রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
স্নেহা আনমনে দৌড়ে গেল চুপিচুপি।আপাতত কাউকে বুঝতে দিলে চলবে না বাড়িতে নেভি আছে।
কম্পিত হাতে শার্ট খুলে ফারাহ।হাত দুটো থরথর করে কাঁপছে।তার কাঁপুনি থামছিল না। উষ্ণ র’ক্তের স্রোত ফারাহর আঙুল ভিজিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু তাশফিনের মুখ একেবারে নিস্তেজ। আতঙ্কে তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছিল।
“লেফটেন্যান্ট সাহেব চোখ খুলো… প্লিজ!”
তাশফিনের পাতলা চোখের পাতা একটু কেঁপে উঠল, যেন খুব কষ্ট করে শব্দগুলো শুনতে পেয়েছে। ফারাহর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও পারছিল না।তার কেন কান্না পাচ্ছে? অপরিচিত লোকটা ব্যথায় অস্ফুট স্বর গুলো কানে বিঁ’ধছে তার
সে বুকের কাছটায় চাপ দিয়ে র’ক্ত আটকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু র’ক্ত তার হাত ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ফারাহর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আমি আপনার কিছু হতে দেব না… কিছুতেই না! আপনি একটু ধৈর্য ধরুন আল্লাহর ওয়াস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কন্ঠে অস্থিরতা কাজ করছে ফারাহর।চোখ মেলে তাকানোর বৃথা প্রয়াস চালায় তাশফিন।
টিক টিক করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে,কিয়ৎক্ষণ পর দরজা ঠেলে ভেতরে এলো স্নেহা। ফিসফিসানির ন্যায় বলল।
“এই নে ফারাহ তুই যা যা বলেছিলি সব নিয়ে এসেছি।”
হাতে একটি ছোট আকারের ছু’ড়ি, একটা বড় বাটিতে গরম পানি সাথে ব্যান্ডেজ।
পাশের টেবিলের ড্রয়ারে থাকা মোমবাতি বের করে জ্বা’লিয়ে ফেলল ফারাহ।
এবারে স্নেহার উদ্দেশ্যে আওড়ালো।
“ছু’ড়ি টা দে!”
স্নেহা চকিতে শুধোয়।
“তুই কি করতে চাইছিস ফারাহ?একটু খুলে বল প্লিজ।”
শুকনো ঢোক গিললো ফারাহ।
“দেখ এই মূহুর্তে তো ডক্টরের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়।আর বাড়ির কেউ জানতে পারলে খবর আছে।তাই আমি ভাবছিলাম যে..
“যে তুই নিজেই ডক্টরি শুরু করে দিবি তাই তো?”
কথার পিঠে থামিয়ে বলে উঠে স্নেহা। দাঁত কে’লিয়ে হাসে ফারাহ।
“তুই কি কখনো এসব করেছিস? পারিস তুই?”
ফারাহ চট করে বলল।
“মুভিতে তো দেখেছি।কী ভাবে কী করতে হয়! আমি পারি।”
কপাল চাপড়াচ্ছে স্নেহা।মুভি দেখে সে নাকি বের করবে গু’লি!”
“দেখ ফারাহ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস!
“উফ্ তুই চুপ কর,আপাতত ওনাকে বাঁচানো জরুরি।”
স্নেহা কিছু বলতে চাইলো,অথচ শুনলো না ফারাহ। মোমবাতির আগুনে ছু’ড়িটা গরম করে নিচ্ছে সে।
বক্ষপৃষ্ঠ হতে শার্টের উপরিভাগের অংশ টুকু উন্মুক্ত করে ফারাহ। র’ক্ত বের হচ্ছে এখান থেকেই।হাত দুটো অঝোরে কাঁপছে।স্নেহাও কাঁপছে,ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। গর্ত হওয়া জায়গাটা গরম ছুড়ি টা একটু স্পর্শ করা মাত্র অস্ফুট স্বরে গোঙাতে লাগলো তাশফিন।ত্বরিতে সরিয়ে নিল ফারাহ।স্নেহা আঁতকে উঠে, অস্থির কন্ঠে বলল।
“তুই যা ইচ্ছে কর আমি বাইরে যাচ্ছি। আমার ভয় করছে।”
স্নেহা কে আটকালো না ফারাহ। ছোট্ট করে জবাব দিল।
“ঠিক আছে,তবে খেয়াল রাখিস কেউ যাতে না আসে।”
স্নেহা চলে গেল। ফারাহ বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিল।
এবারে সত্যি কিছুটা করতেই হবে ভয় পেলে চলবে না একদম। ধীরে ধীরে ছু’ড়িটা বুকে ঢুকিয়ে দিল ফারাহ, সশব্দে চেঁচিয়ে উঠলো তাশফিন।কোমল হাতে মুখ চেপে ধরে ফারাহ।
“চেঁচাবেন না আল্লাহ। একটু স’হ্য করে নিন।”
তাশফিন অস’হ্য ব্যাথায় ক’কিয়ে উঠছে।আধো আধো মেলে তাকালো দৃষ্টি। সামনে বসা কিশোরী মেয়ের দিকে,যার কোমল হাত বিচরণ করছে অধর ভাঁজে।
“চেঁচামেচি করলে সর্বনা’শ হবে, আমি হাত সরাচ্ছি একটু স’হ্য করে নিন।”
তাশফিন মাথা দুলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো।কানের পিঠ হতে নোনা জল গড়িয়ে গেল তাশফিনের, ঘর্মাক্ত শরীরে হাত লাগালো ফারাহ।ধীরে ধীরে ছু’ড়িটা দিয়ে গু’লিটা বের করে নিল সে।শেষ বারের মতো বুকের ভেতর চাপা থাকা নিঃশ্বাসটুকু ছাড়লো তাশফিন। শক্তপোক্ত দেহ খানা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। গরম পানি দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে কোনো রকমে ব্যান্ডেজ করে দিল ফারাহ।এবারে যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে।তাশফিন তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ ফারাহর আদল পানে। স্নিগ্ধ আদল খানি।চোখে একরাশ বিস্ময়, হৃদয়ে একটুকরো অজানা অনুভূতি।
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৬
ফারাহর চোখে গভীর এক সমুদ্র, যেখানে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। হাওয়ার মৃদু স্পর্শে ওড়ানো চুলগুলোর মাঝে,
তাশফিন খুঁজে পায় এক হারিয়ে যাওয়ার অনূভুতি।এই কন্যা তার স্ত্রী, স্ত্রী ভাবা মাত্র মস্তিষ্কে কিছু দুষ্টু ইচ্ছেরা জেঁ’কে বসতে চাইছে।তাশফিনের দৃষ্টি আটকে আছে ফারাহর মুখে, যেন কোনো শিল্পী নিখুঁত তুলির আঁচড়ে এঁকেছে তাকে। ফারাহর চোখে এক অদ্ভুত মায়া,
যা একবার দেখলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। আচ্ছা তাশফিন যদি ওর দিকে হাত বাড়ায় তাহলে এখন কি ক্ষ’তি হবে?