শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ২
ইনায়া রোজ
নিস্তব্ধ ভয়ংকর গভীর রাত, এক বিবিষিকাময় অনুভূতির পৃষ্ঠপোষক। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। কোথাও কোন তারা নেই। চাঁদের আলো যেন কোথাও লুকিয়ে গেছে আর অন্ধকার এক ঠান্ডা কম্বলের মতো সবকিছু ঢেকে রেখেছে। চারপাশে গভীর নীরবতা এতটাই তীব্র যে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস কেও ভারী মনে হবে।
হঠাৎ হঠাৎ দূরে কোথাও থেকে ম*রা পাতার উপর কারো পায়ের আওয়াজ যেন গোপনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝিঝি পোকা আর রাতের পাখিরাও যেন ভয়ে থেমে গেছে। বাতাস অদ্ভুত স্থির।
এই নির্জন নিরিবিলি রাতে নিলয় কে বেধড়ক পি*টিয়ে যাচ্ছে শ্রাবণ। যেনো তার সমস্ত ক্ষোভ মিটিয়ে দিতে চাইছে নিলয়ের উপর।
– কু*ত্তা*র বাচ্চা তোর জন্য আমি আমার ফুলের গায়ে হাত তুলেছি। আজকে তুই শেষ।
বলেই আরো কয়ঘাত দিতে থাকলো নিলয়ের শরীরে। ব্যথায় আর্তনাদ করতে থাকলো নিলয়।
– শ্রাবণ ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে আমি তো মেঘকে এমনি ডেকেছি।
– তুই ডাকবি কেন ওকে? কু*ত্তা*র বাচ্চা তুই জানিস না ও শুধু আমার।
– মাফ করে দাও শ্রাবণ ভাই আর ডাকবো না।
নিলয়ের কোনো কথাই শুনছে না শ্রাবণ। একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে তাকে। তখনই শ্রাবণকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে নিহাল।
– ছেড়ে দে শ্রাবণ আর মারলে তো মরেই যাবে।
নিহাল এর কোন কথাও শুনছে না শ্রাবণ। যেন তার শরীরে কোন অশুভ আ*ত্মা প্রবেশ করেছে আর সে এখনই নিলয়কে দুনিয়া ছাড়া করবে। নিহাল এবার আরো শক্ত করে ঝাপটে ধরে শ্রাবণকে।
এরপর টেনে হিচড়ে কিছুটা পিছিয়ে আনে। সুঠাম দেহি শ্রাবণের সাথে পেরে উঠতে কিছুটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে নিহালের পক্ষে। তবুও সে চেষ্টা করছে সিংহকে রুখবার জন্য। শ্রাবণকে নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে নিলয়ের উদ্দেশ্যে নিহাল বলে ওঠে,
– শা*লা এখনো সময় আছে অকালে মরতে না চাইলে পালা এখান থেকে।
নিহাল এর কথায় কোনরকমে নিজের জীবন হাতে নিয়ে উঠে সেখান থেকে পালিয়ে যায় নিলয়। তবে মনে মনে সে ভীষণ ক্ষুব্দ। আজকের ঘটনার প্রতিশোধ সে অবশ্যই নিবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাত প্রায় ২ টা, মেইন দরজা ডিঙ্গিয়ে ঘরে প্রবেশ করে শ্রাবণ। ঢুকেই দেখতে পায় সোফায় বসে আছে আফসানা বেগম। শ্রাবণের দিকে এক পলক তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নেন তিনি। তা দেখে তাচ্ছিল্য হেসে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয় শ্রাবণ। তা দেখে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে শ্রাবণের সামনে এসে দাঁড়ায় আফসানা বেগম। মাথা নুইয়ে বলে ওঠে,
– টেবিলে খাবার রাখা আছে খেয়ে নে।
– আমি খাব না।
বলে আবারও পা বাড়ায় শ্রাবণ। তৎক্ষণাৎ শ্রাবণের বাহু জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে আফসানা বেগম।
– ক্ষমা করে দে বাপ তখন মেঘকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আর কি থেকে কি করে ফেলেছি নিজেও বুঝতে পারিনি।
মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে এতক্ষণের সকল রাগ ক্ষোভ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল শ্রাবনের। মাকে বুকের কাছে আগলে নিয়ে শ্রাবণ বলে উঠে,
– হয়েছে এত কান্না করার দরকার নেই। ভুল করেছি তাই শাসন করেছো, কাঁদলে আবারো একই ভুল করবো।
– না না কাঁদবো না তাও আমার মেঘ মাকে আর কষ্ট দিস না।
মেঘের কথা শুনতেই নীরবতা ঘিরে ধরে শ্রাবণকে। কতটা পাগল হলে সে নিজের কলিজায় আঘাত করতে পারে। ধীর কণ্ঠে শ্রাবণ বলে ওঠে,
– মেঘ কোথায় মা?
মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকায় আফসানা বেগম। মুখটা ছোট করে দুঃখিত কন্ঠে বলে ওঠে,
– নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। মেয়েটাকে এইভাবে না মারলেও পারতি বাবা।
নিজের এক হাত চুলের ভিতর গলিয়ে সজোরে তা চেপে ধরে শ্রাবণ। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার নিজের উপর। কেন যে এমন করতে গেল সে। এরপর আগ পিছ না ভেবে শ্রাবণ বলে ওঠে,
– মা আমি মেঘের কাছে যাচ্ছি।
– খাবিনা না?
– না, তুমি খেয়ে নাও।
বলেই আর এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করে না শ্রাবণ।
গভীর রাত, অন্ধকার চারদিকে যেন কোন এক অজানা পাপের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ ধীরে ধীরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। হাত দুটো হঠাৎই তার কেমন থর থর করে কাঁপছে। যেন পরবর্তী দৃশ্য চাক্ষুষ অবলোকন করতে অক্ষম সে।
নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে দরজার কপাট ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে শ্রাবণ। ঘরের বাতাস অদ্ভুত ভারী অনুভূতি। জানালার পর্দা গুলো হালকা বাতাসে কাঁপছে। কিন্তু তাতে কোনো স্বস্তি নেই। ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়াবহ দৃশ্য উন্মোচিত হলো শ্রাবণের সামনে।
মেঘ অচেতন হয়ে শুয়ে আছে সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে। তার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। তার নিঃশ্বাস ভারী আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা যেন প্রতিটা শ্বাস নেওয়া তার জন্য যুদ্ধের মত ঠেকছে।
মেঘকে এই অবস্থায় দেখে সম্পূর্ণ থমকে গেলো শ্রাবণ। তার দৃষ্টি মেঘের দিকে স্থির কিন্তু তার হৃদয় বৃদ্ধ হচ্ছে এক অনন্ত অপরাধবোধে। কয়েক ঘণ্টা আগেই সেই মুহূর্তটা ঘটেছিল যখন রাগের বসে সে মেঘকে আঘাত করেছিল। মেঘের মুখে ভয়ের সেই চিহ্ন কাঁধে ক্ষত আর কন্ঠে সেই আকুতি সব কিছু এখনো শ্রাবণের মনে জ্বলজ্বল করছে।
– ফুল!
শ্রাবণের কন্ঠ ভাঙলো। দরজা লাগিয়ে অতি ধীরে সে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো। এরপর একেবারে শান্ত ভঙ্গিতে বসলো মেঘের পাশে। হাত রাখলো মেঘের কপালে। ঝাপসা চোখে পিটপিট করে তাকালো মেঘ। তার দৃষ্টি ক্লান্ত কিন্তু তাতে স্পষ্ট তীব্র কষ্ট আর অভিমান।
– কেন এসেছো তুমি?
মেঘের কন্ঠ ছিল অত্যন্ত মৃদু আর ভাঙা তবুও তাতে ছিল অভিযোগের ধার।
– আমি ভুল করেছি ফুল, আমাকে ক্ষমা করে দে না।
শ্রাবনের কন্ঠে অনুতাপ স্পষ্ট ছিল কিন্তু তা মেঘের কষ্ট লাগব করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। মেঘ ধীরে ধীরে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। তার কথা বলার কোন শক্তি নেই। তার পুরো শরীর জ্বরে কাঁপছে। শ্রাবণ অসহায়ের মতো উল্টো পাশে গিয়ে মেঘের মুখোমুখি আবারও বসে পড়লো।
ঘর জুড়ে কেবল মেঘের শ্বাসের ভারী শব্দ। রাতের নিস্তব্ধতায় শ্রাবণের মনে চলছিল দহন। তার আঘাতই আজ তার ফুলকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। হঠাৎই নীরবতা ভেঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠলো মেঘ। আচমকা মেঘের কান্নায় ভোড়কে গেল শ্রাবণ।
এক হাত বাড়িয়ে মেঘের গালে হাত রাখল। শ্রাবণের সেই হাত ধরে মেঘ আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো।
– আমাকে এত কষ্ট দাও কেন তুমি? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমার?
বিড়বিড় করে ভাঙ্গা কন্ঠে বিলাপ করতে লাগলো মেঘ। শ্রাবণ বুঝতে পারছে মেঘ তার হিতাহিত জ্ঞানে নেই। এবার শ্রাবণকে আরো অবাক করে দিয়ে মেঘ বলে উঠলো,
– আমাকে জড়িয়ে ধরো শ্রাবণ ভাই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ১
মেঘের এমন আকুতি শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে মেঘের পাশে শুয়ে পড়লো শ্রাবণ। চাদর উঠিয়ে নিজের গায়ে এবং মেঘের গায়ে জড়িয়ে দিল। শ্রাবণ মেঘের পাশে শুতেই মেঘ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল শ্রাবণকে।
মেঘের গরম নিঃশ্বাস শ্রাবণের সারা বুকে আছড়ে পড়তে লাগলো। মেঘের কপালে এক গভীর চুমু দিয়ে শ্রাবণ বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
– ফুল আমার, আমাকে ক্ষমা করে দে জান। আর কখনো এমন হবে না।
বলে সেও আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মেঘকে। শ্রাবণের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় মেঘ।