দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭০

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭০
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ এর মনে চিন্তার ডালপালা গজানোর মাঝে নিশান আবারো শুধালো,
—কিরে কথা বলছিস না কেন? বল না আমি মা’তাল হয়ে কি এমন করেছি যার জন্য পুলিশ ধরেছিলো? আমার যতদূর মনে পড়ে তেমন কিছু তো করিনি। গাড়ি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছিলাম ভীষণ টায়ার্ড লাগছিলো দেখে। রাস্তায় আবার কোনো এক্সি’ডেন্ট করে ফেলিনি তো?
—হুম
নিশীথ গম্ভীর মুখে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলে। ওর কথায় আতংকে নিশানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়! তোতলানো সুরে বলে,

—ক,কি এক্সি’ডেন্ট করেছি? কেউ ম’রেটরে যায়নি তো আবার?
ওর চোখেমুখে ভয়ের রেশ দেখে নিশীথ বুঝে এটাই ভাইয়ের থেকে কথা বের করে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ তাই মাথা নেড়ে আরও গম্ভীরমুখে বলে,
—করেছো। বেশ বড়সড়ই এক্সি’ডেন্ট করেছো। এমনভাবে গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছো যে একজন মারা গেছে এবং তার ওয়াইফ কেইস করেছে তোমার উপর মা’র্ডারের। এখনো এ কথা আমি মা-বাবাকে বলিনি। এখন ভাবছি জলদিই বলে দেবো। এমনিতেই তুমি কাউকে না বলে বিদেশে যেয়ে কি না কি করেছো তার মধ্যে দেশে এসেও যদি এসব করো তাহলে তো বাবা-মা কে জানানোই উচিত বলে আমি মনে করি!
এবার নিশীথের কথা শুনে নিশান এর পা থেকে মাথা অব্দি ঘুরে উঠে। ও চোখে অন্ধকার দেখে। অস্থিরমুখে তড়িঘড়ি করে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—এভাবে বলিসনা, নিশীথ। তুই তো আমার ছোটভাই। তুই এমন দুঃসময়ে আমার পাশে না থাকলে আর কে থাকবে?
নিশীথ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,
—এখন মনে পড়লো আমি তোমার ছোটভাই? এতকিছু লুকিয়ে রাখার সময় মনে পড়েনি ভাইয়ের কথা?
—কসম আমি তেমন কিছু লুকোইনি। ড্রিংকস আমি হালকা-পাতলা ভার্সিটি লাইফ থেকেই করতাম কানাডায় যেয়ে কিন্তু তাও সেটা লিমিটে। নিজের উপর মোটামুটি ভালো গ্রিপ থাকে আমার। খুব একটা না পান করলে আশেপাশের কেউ বুঝেওনা তাই এটা বলার প্রয়োজন মনে করিনি। শুধু একটা জিনিস জানানো দরকার ছিল যেটা তোকে বলিনি। ইনফ্যাক্ট কাউকেই বলিনি…
—সেটা কি?
নিশীথ শ্বাসরোধ করে প্রশ্ন করে। ওর ভয় লাগতে শুরু করছে। নিশান একটা শ্বাস নিয়ে বলে,

—আমি বিয়ে করেছি, নিশীথ।
নিশীথ বুকে চেপে রাখা শ্বাস ছেড়ে দেয়। ওর কেন যেন মনে হচ্ছিলো নিশান এমন কিছুই বলবে এবং এই প্রথম নিজের সন্দেহ সত্যি প্রমাণ হওয়ায় নিশীথের কষ্ট লাগে। তবে কষ্ট লাগে ভাই বিয়ে করেছে শুনে নয়, এটা তো খুশির খবর। ওর কষ্ট লাগে এটা ভেবে যে, এতবড় একটা খুশির খবর কেন বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করলোনা নিশান। যে বাবা-মা এত কষ্ট করে ওকে বড় করেছে অনেক আশা নিয়ে ওকে বিদেশে পাঠিয়েছে, তাদের অন্তত জানালেও পারতো বিয়ের আগে! এমন তো নয় যে কেউ মানা করতো আর মানা করবেই বা কিভাবে। কানাডায় যদি নিশান বিয়েও করে সেটা বাংলাদেশ থেকে তো এমনিতেও আটকাতে পারবেনা কেউ! তবে কেন নিশান এমন করলো?
নিশীথ প্রশ্ন করলো,

—ভাইয়া তুমি এডাল্ট। যাকে ভালো লাগে বিয়ে করতেই পারো এ বয়সে। সে রাইট তোমার আছে। কিন্তু একটাবারও কি বাবা-মাকে বলার প্রয়োজন মনে করোনি?
নিশান হাসলো। বললো,
—জানতাম তুই এটাই বলবি। এজন্য তোকেও বলিনি বাবা-মাকে বলবি সে ভয়ে এতদিন!
নিশীথের খুব অদ্ভুত লাগলো ভাইয়ের কথায়। ওর মনে হলো ওর ভাই যেন পুরোপুরি বদলে গেছে বিদেশ যেয়ে। কোথায় ছোটবেলায় দুই ভাই একে অন্যজনের সাথে সবকিছু শেয়ার না করে থাকতে পারতোনা আজ সে ভাই কিনা নিজের জীবনের এত বড় খবর ওর থেকে লুকিয়ে রেখেছে ও বাবা-মাকে বলে দেবে ভেবে? এটুকু বিশ্বাসও কি করেনা নিশান ওকে এখন? নিশীথ হতাশ হয়ে বলে,

—আমার উপর এটুকু ভরসা নেই তোমার? তুমি মানা করলে কি আমি বলে দিতাম মনে করো?
—বিশ্বাস করিনা এমন না। না করলে এখনো বলতাম না তোকে। তুই বরাবর মায়ের বাধ্য ছেলে, কোনোকিছু লুকিয়ে রাখতে পারিসনা মায়ের থেকে তাই তোকে বলিনি তখন। আর রইলো বাবা-মার কথা তাহলে কথা হচ্ছে আমি তাদের জানিয়েই বিয়ে করতে চাইছিলাম! কিন্তু…
—কিন্তু কি?
—আমি যেদিন বিয়ের কথা বলার জন্য ফোন দেই ওইদিন বাসায় তোর বিয়ে নিয়ে তুমুল ঝড় চলছিলো বাসায়। আমি ভাবলাম, অলরেডি তোর প্রেমের বিয়ে নিয়ে এত কাহিনি হচ্ছে বাসায় সেখানে যদি আমি আমার বিয়ের কথা বলি তাহলে বাবা পাগল হয়ে যাবে। দেখা যেতো কানাডায় চলে এসেছে তখনি। আমার আর বিয়েটা করা হতোনা তাহলে!
নিশীথ বিদ্রুপের সহিত বললো,
—কেন বিয়ে হতোনা তোমার? বাবার চোখে আমি আর তুমি কি এক হলাম নাকি? তুমি বাবার ফেবারিট ছেলে। তোমার বিয়ের জন্য কখনো মানা করতোনা সে। উল্টো দুই পায়ে রাজি হতো।

—রাজি হতোনা দেখেই বলিনি, নিশীথ।
—কেন হতোনা বলো?
—তুই বুঝবিনা, নিশীথ!
—বুঝিয়ে বললেই বুঝবো। তুমি বলো
—আমি যাকে বিয়ে করেছি ওর নাম ক্যাথেরিন।
নিশীথের জিদের চো’টে নিশান হঠাৎ নিচু স্বরে বলে উঠে। নিশীথ চমকায়। চোখ বড় করে বলে,
—ভাবি খ্রিষ্টান?
—হুম

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯ (৩)

নিশান মাথা নামিয়ে ফেলে। নিশীথ কি বলবে বুঝতে পারেনা। নিশানের মতো ও নিজেও চোকজে অন্ধকার দেখে। কিছুক্ষণ দুই ভাইয়ের মাঝে আর কোনো কথোপকথন হয়না। অশান্ত নিরবতা ভেদ করে খানিকবাদে রুমের দরজায় টোকা পড়ে। ওদের ধ্যান ভেঙে যায়। দরজার ওপাশ থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসে,
—তোদের দুই ভাইয়ের গল্প করা শেষ হলে নাস্তা করতে আয়। নিশীথ বাবা আমার বড় ছেলেকে নিয়ে জলদি টেবিলে নিয়ে আয়। ওর পছন্দের ঘি দিয়ে গরম গরম আলু পরোটা বানিয়েছি আজকে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
আসমা বেগমের কথা শুনে নিশান নিশীথের মুখপানে চায়। নিশীথ চোখ তুলে তাকাতেই সামনে বসা ভাইয়ের চেহারায় যেন স্পষ্ট অপরাধবোধ দেখতে পায়!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭১