ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫০

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫০
মিথুবুড়ি

‘ব্যস্ত রাস্তার বাঁক পেরিয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে ছুটে চলেছে কয়েকটি মার্সিডিস। পিছনে ফেলে দিয়েছে সব গাড়িকে। দূর আকাশ থেকে দেখলে মনে হয় বিশাল এক অ্যানাকোন্ডা শহরের বুক চিরে সাঁতরে যাচ্ছে। অথচ নিচ থেকে তাদের বেগ দেখলে মনে হয় এক দল ক্ষুধার্ত হায়েনা শিকারের সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে থামল তাকবীরের গাড়িটা। দরজা খুলতেই এলিজাবেথ এক নিশ্বাসে বেরিয়ে এল শূন্য হাতে। পেছনে তাকবীর নিঃশব্দে ওর লাগেজ টেনে আনল। সময় থমকে আছে। শ্বাস ভারী। এলিজাবেথ রাশিয়া ফিরে যাচ্ছে সব প্রতীক্ষার সমাপ্তি টেনে। ইমিগ্রেশন ডেস্কের সামনে নির্ভার মুখে দাঁড়িয়ে আছে এলিজাবেথ। পাশে তাকবীর এক পা এগিয়ে আবার পিছু হটে। কাল রাতের সবটুকু কেবল তার হ্যালুশিনেশন ছিল। সে আটকায়নি ওকে। হয়তো এটাই ভালো। সে চায়নি এলিজাবেথ আবার রিচার্ডের ছায়ায় ঢুকে পড়ুক।
‘হঠাৎ এয়ারপোর্ট প্রাঙ্গণজুড়ে বইল গরম হাওয়া। অদ্ভুত থমথমে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল। পরপর কয়েকটা মার্সিডিস শাঁই করে এসে সারি সারি দাঁড়াল প্রবেশদ্বারের সামনে। গাড়ির দরজা খুলতেই কালো পোশাকধারী গার্ডরা গম্ভীর মুখে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সিকিউরিটি ইনচার্জ দ্রুত হাতে ওয়ারলেসে কিছু বলল অথচ তেমন বাধা দেওয়ার সাহস করল না। প্রথম গাড়ি থেকে নামল ন্যাসো, লুকাস। বরাবরের মতো পরণে কালো শার্ট, কালো ট্রেঞ্চ কোট। হালকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাকডোর খুলল লুকাস।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘গাড়ির ভিতর থেকে গম্ভীর ভারি পদক্ষেপে বেরিয়ে এল রিচার্ড। নেমেই ধীর অথচ স্থির এক রাজকীয় গতিতে হাঁটতে লাগল সে। মুখে কোনো অনুভূতি নেই, ঠোঁট কঠিনভাবে বন্ধ। চোখে সেই চিরচেনা অন্ধকার। চারপাশে কেউ দম নিতেও ভুলে গেল যেন।এয়ারপোর্টের গ্লাসের দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল রিচার্ড। পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে বিশালদেহী গার্ডরা। একাধিক পায়ের ভারি শব্দে এলিজাবেথ পিছন ফিরল। পিছন ঘুরতেই অবলোকন হল তীক্ষ্ণ চোয়াল। নীল আর নিকোষ কালো আঁখিদ্বয়ের চোখাচোখি হতেই এক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সময়। সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিচার্ড। তীক্ষ্ণ চোয়াল। বরফশীতল চোখ। শ্বাসরুদ্ধকর উপস্থিতি। রিচার্ড গিয়ে দাঁড়াল এলিজাবেথের মুখোমুখি। ভ্রু নাচাল সে।
“এতো সোজা?”

‘ঠান্ডা কণ্ঠের ওজন এমনও হতে পারে? সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। তার কণ্ঠে শব্দরা দলা বাঁধল অথচ চোখ তৃষ্ণায় ছটফট করছে। লোকটার এমন অবস্থা কেন? কোথায় গেল সেই কঠোর কাঠামো, সেই রাজকীয় ঔজ্জ্বল্য?রিচার্ড এলিজাবেথের বিহ্বল চোখে চেয়ে রাশভারি স্বরে বলল,
“কাম অন ওয়াইফি। আমাদের এখনো একসাথে সংসার করা বাকি। তুমি কোথাও যাচ্ছো না।”
‘পাশ থেকে তাকবীর কিছু বলতে গিয়েছিল কিন্তু রিচার্ডের কঠিন কণ্ঠ তাকে থামিয়ে দিল,
“তুই আরেকবার আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়াবি, আমি তোর কলিজার দিকে হাত বাড়াবো। খোদার কসম এক টানে ছিঁড়ে আনবো না, একটু একটু করে টেনে ছিঁড়ে আনবো।”
‘এলিজাবেথ তখনও একগুঁয়ে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রিচার্ডের দিকে। তার চোখের তৃষ্ণা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। রিচার্ড গভীর দৃষ্টিতে একবার দেখে নিল তার অবাধ্য নারীর আপাদমস্তক। দু’কদম এগোতেই তাকবীর সামনে এসে দাঁড়াল,তবে পরক্ষনেই কাঁধে তীব্র এক থাবায় ছিটকে দু’কদম পিছিয়ে গেল।

“স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আসলে গেঁড়ে দেবো।”সুনামির পূর্বাভাস যেন কণ্ঠে ধ্বনিত হলো।
“এই জনমে আমাদের বিচ্ছেদ হচ্ছে না মিসেস কায়নাত।”
‘এই বলে রিচার্ড এগিয়ে এল। এলিজাবেথের হাত ধরতে যাবে ঠিক তখনই এক তীব্র চড় আঁচড়ে পড়ল তার চোয়ালে। কিন্তু রিচার্ডের মুখভঙ্গিতে এক বিন্দু পরিবর্তন নেই। ঠান্ডা, নির্লিপ্ত। ধীর গতিতে গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাল এলিজাবেথের দিকে।
“এলি জান।”
‘মাত্র দুটো শব্দ অথচ এলিজাবেথের প্রতিক্রিয়া ছিল আগুনের মতো। তার তপ্ত থুতু এসে ছিটকে পড়ল রিচার্ডের গালে।
“কাপুরুষ!”
‘রিচার্ড স্থির।
“কাপুরুষ?”
‘মূহুর্তেই এলিজাবেথ ফুঁসে উঠল,”হ্যাঁ, কাপুরুষ! যে পুরুষ প্রিয়তমার দুঃখে পাশে থাকে না, সে কাপুরুষ। যে পুরুষ দুঃখের মুখোমুখি হতে ভয় পায়, সে কাপুরুষ!”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে চাপা বিস্ফোরণ, “রেড!”

‘এলিজাবেথ তর্জনী তুলে কড়াভাবে বলল,”খবরদার! আমাকে এই নামে ডাকবেন না!”
‘সে তাকবীরের দিকে একবার তাকাল তারপর শক্ত হাতে লাগেজ ধরে সামনে এগিয়ে গেল। পাসপোর্ট জমা দিতে গেলে দেখতে পেল অযাচিত কারণে গার্ডের পা কাঁপছে।বিস্মিত হয়ে গার্ডের ভয়ভরা দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল—রিচার্ড ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় বাঁকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
“কোথায় যাচ্ছো ওয়াইফি?পুরো এয়ারপোর্ট তো সিল করা।”
‘তাকবীর তীব্র গলায় বলল,”মানে? সকল যাত্রী তো এখানে!”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে হাসল। ধীর গতিতে ঘাড় উঁচিয়ে মটমট শব্দ করল। সেই মুহূর্তেই আশেপাশের যাত্রীরা তাদের ব্যাগ ফেলে দিল। তাকবীরের আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। সে নিজেও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। ইশারা করতেই ভিতরে ঢুকে পড়ল একদল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তবে পরের দৃশ্য হল আরো ভয়াবহ। যাত্রী বেশে থাকা সকলে অস্ত্র বের করে তাক করল আইনশৃঙ্খলার লোকদের দিকে। বড় বড় শট গানের ট্রিগার প্রেসের শব্দে কেঁপে উঠল প্রাঙ্গণ। তাকবীরের চিবুক শক্ত হয়ে গেল। এলিজাবেথ হতভম্ব। রিচার্ড ধীর পায়ে এগিয়ে এলে তাকবীর বাধা দিতে চাইলে তার গার্ডরা মুহূর্তেই তাকবীরকে ধরে ফেলল। এলিজাবেথ ছুটে পালাতে চাইল৷ তার আগেই রিচার্ড খপ করে ওর হাত চেপে ধরল।

“আমাকে ছেড়ে যাওয়ার ক্ষমতা তুমি এখনো অর্জন করোনি মাই ফাকিং ডার্ক রেড।”
‘বলে একটানে তাকে কাঁধে তুলে নিল এলিজাবেথকে। এগিয়ে যেতে যেতে রাশভারি আওয়াজ তুলে বলল,
“আই’ম নো হিরো হু ওয়েল স্যাক্রিফাইস ফর লাভ। আই’ম দ্য ভিলেন হু ওয়েল সেট দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাব্লেইজ ইফ দ্যাট’স হোয়াট ইট টেইকস টু হ্যাভ ইউ।”

‘চারপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা নিঃশব্দ। অসহায়। তাকবীর, এলিজাবেথ সমান তালে চেঁচাচ্ছে, ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু চারপাশে যে রিচার্ডের তৈরি খাঁচা, তা এত সহজে ভাঙার নয়। এলিজাবেথ চেঁচাচ্ছে।কণ্ঠস্বরে জেদ আর ক্ষোভের ঝাঁজ। লুকাস হেসে রিচার্ডের পিছু নিল। সে এই উত্তেজনায় বেশ মজা খুঁজে পেয়েছে। চারপাশে গার্ডরা পুলিশ ও তাকবীরের লোকদের ঘিরে রেখেছে। উত্তাপ জমাট বাঁধছে মুহূর্তে মুহূর্তে। ন্যাসো তাকবীরের দিকে এক চাহনি ছুড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা এলিজাবেথের স্কার্ফ তুলে নিল ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা রেখে। তারপর সেও পিছু নিল রিচার্ডদের। রিচার্ড এক মুহূর্তের জন্যও এলিজাবেথকে ছাড়ল না। তার কানের পাশটা লাল হয়ে উঠেছে এলিজাবেথের ধারালো নখের আঁচড়ে। তবুও সে নির্বিকার। মেয়েটার ছটফটে পায়ের আঘাত পেটে লাগলেও তার শক্ত বাঁধনে শিথিলতা এল না। গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই ফ্রন্ট ডোর খুলে দেওয়া হলো। রিচার্ড নিঃশব্দে এলিজাবেথকে ভেতরে বসিয়ে সিট বেল্টের ভেতর তার হাতসহ আটকে দিল। যেন পালাবার পথ একেবারে রুদ্ধ। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসতে যাওয়ার ঠিক আগে ওপাশ থেকে এলিজাবেথের স্কার্ফ তার দিকে ছুঁড়ে দিল ন্যাসো। রিচার্ড নিখুঁত ভঙ্গিতে সেটি ধরে নিয়ে ভিতরে বসল আর পিছনের সিটে ঠাঁই নিল ন্যাসো ও লুকাস। গাড়ির দরজা বন্ধ হতেই যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল পরিস্থিতির রহস্যময়তা। এলিজাবেথ গালি দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে।ওদের গাড়িতে উঠতে দেখেই রিচার্ডের কপালে ভাঁজ পড়ে। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

“হোয়াইট রাবিস!কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
‘লুকাস শিশুসুলভ ভঙ্গিতে মুখ বানিয়ে বলল,”বস আমরা তো বরযাত্রী!”
‘এলিজাবেথের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। কড়া স্বরে বলল,
“বরযাত্রী মানে?”
‘লুকাস হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ, আমরা তো পাত্রপক্ষ! আজ আপনার আর স্যারের বিয়ে হচ্ছে! এমা এখনো জানেন না? ওদিকে বাসরঘরও নাকি সাজানো শেষ!”
‘এলিজাবেথের ধৈর্য তখন তলানিতে। তীব্র গর্জনে বলে উঠল,”কি-ই-ই?”
‘রিচার্ড সামনের সিট থেকে গভীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে নির্দেশ দিল,”গেট আউট ফ্রম দ্য ফাকিং কার।”
“কিন্তু বস,,,চ”
“কোনো কিন্তু নয়। নামো বলছি।”

‘ন্যাসো ঠোঁট বাঁকিয়ে কুটিল হাসি হাসল, “বাহ, বিয়ের আগেই প্রাইভেসি চাইছেন?”
‘রিচার্ড ন্যাসোর কথায় এক ঝলক এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল,
“গাড়িতেই বাসর সেরে ফেলার মতো এতটা অধৈর্য নই রিচার্ড কায়নাত। আমি শিকারের মতো ধরি ধীরস্থিরভাবে আর ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে তবেই ছাড়ি।”
‘ন্যাসো মনে মনে তওবা কাটল। কাকে কি জিজ্ঞাসা করে সে?নিঃশব্দে ওরা নেমে গেল গাড়ি থেকে।
‘এলিজাবেথের চোখে যেন বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। গলায় রাগে কাঁপুনি,”আর একটা বাজে কথা বললে মেরে ফেলব আপনাকে!”

‘রিচার্ড হঠাৎই ঝুঁকে পড়ে ওর রক্তিম ঠোঁটে ছোট্ট এক চুমু এঁকে দিল।
“কবুল বউ। বাকি দু’টো কাজির সামনে বসে বলব। লেটস গো ওয়াইফি, আমি নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছি।”
“আপনি একটা জানোয়ার!”
‘রিচার্ড চোখ টিপে হাসল, “রাতে আরো হবো। নিতে পারবে তো?”
“রিচার্ড কায়নাত আই উইল কিল ইউ!”
‘গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রিচার্ড মজার কণ্ঠে গাইতে লাগল,
“Before I die, I’m tryna fk you, baby,
Hopefully, we have no babies…”
‘”আপনি… আপনি—”
‘এলিজাবেথ চিবিয়ে চিবিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রিচার্ড গাড়ি থামিয়ে সিটবেল্ট খুলে ঝট করে ওকে জাপটে ধরল। হতভম্ব এলিজাবেথের মাথা গিয়ে ঠেকল শক্ত, পুরুষালী বুকে। অস্বাভাবিক ভাবে রিচার্ডের বুকের ভিতরে কম্পন হচ্ছে। এলিজাবেথ মুহূর্তের মনে স্তব্ধ হয়ে গেল।

“অনুভব করতে পারছিস এলি জান?”
“কি?”
“ভিতরের অস্থিরতা। এমন করিস না এলি জান… সহ্য হয় না।”
“কেন?”
“তুই আমার কাছ থেকে হারাতে পারিস না।”
“কেন?”
“কারণ তুই আমার।”
“আমি ঘৃণা করি আপনাকে।”
“আমি জানি।”
“তাও কেন ঘৃণার পাত্র হতে চাচ্ছেন?”

“অপাত্রে সুপাত্র ঢালতে নেই। কিন্তু তুই তো ফেঁসে যাসনি, আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিস এলি জান। আমার কাছ থেকে তোর মুক্তি নেই এই জনমে।”
‘কোনো সুযোগই দিল না রিচার্ড। হঠাৎই সিটবেল্ট খুলে ওকে টেনে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে নিল। শক্ত হাতে ওর পিঠ চেপে ধরে গালের ওপর আঁচড়ে থাকা লাল চুল সরিয়ে গভীর চোখে তাকাল। কণ্ঠে অন্ধকারের গুঞ্জন,
“তোমার চোখে; আমার প্রতিশোধ।
তোমার বুকে; আমার প্রতি ঘৃণা।
আমার কাঁধ; তোমার অশান্তি।
আমার হাসি; তোমার সুখ।
তোমার অস্ত্র: আমি বরবাদ।
তোমার ভালোবাসা; আমি যোগ্য নই।”
‘এলিজাবেথ শ্বাস আটকে নিভু কণ্ঠে বলল, “তাহলে কেন জোর করে রাখতে চাচ্ছেন আমাকে?”
‘ওকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল রিচার্ড।
“থাকতে পারব না তাই।”
“রিচার্ড কায়নাত পারে না এমন কিছু আছে?”

‘রিচার্ডের ঠোঁট বাঁকা হলো।কণ্ঠে ভয়ঙ্কর কোমলতা। লাল চুলের ভাঁজে ভাঁজে অধরের ছোঁয়া একেঁ দিয়ে বলতে থাকল,
“উমহু,এমন কিছুই নেই। রিচার্ড কায়নাত সব পারে—শুধু পারে না তার এলি জানের ভাগ কাউকে দিতে, পারে না এই আল্লাহর বান্দীকে ভুলতে, পারে না এই ছলনাময়ীর দিকে তাকানো চোখগুলো না উপড়ে ফেলে থাকতে, পারে না তার রেড’কে কল্পনায় না রেখে ঘুমাতে, পারে না এই অবাধ্য নারীকে না ভেবে থাকতে। রিচার্ড কায়নাত অনেক কিছুই পারে না এই নারীর ক্ষেত্রে।”
‘শীতের বৃষ্টির মতোই অপ্রত্যাশিত কান্ড করে বসল এলিজাবেথ। নিজের দুই হাঁটু রিচার্ডের উরুর দু’পাশে রেখে ঝুঁকে পড়ল ওর ওপর। হাত চেপে রাখল বুকের বা পাশে।
“তবে এই এলিজাবেথ এখন অনেক কিছুই পারে, জানেন?”
‘রিচার্ড বাঁকা হাসল। ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গা এলিয়ে দিল সিটে! শরীর ছেড়ে দিল পুরোপুরি। সঙ্গে শার্টের একটা বোতাম খুলে দিল নিজেই। চোখে খেলা করছে আলিঙ্গনের সুবাস। ঘন হতে থাকে নিশ্বাস। রিচার্ড ঢোক গিলতেই এডামস অ্যাপল স্পষ্ট হলো! পুরুষালী উত্তরণ জ্বলজ্বল করে উঠল। এটুকু দৃশ্যেই এলিজাবেথের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। গলায় শুষ্ক ঢোঁক গিলল অথচ আজ টলল না।ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের হাঁটু ঠেকাল রিচার্ডের স্পর্শকাতর স্থানে। কণ্ঠে হিসহিসে ঝাঁজ,

“এই এলি জান এখন কারোর জানও নিতে পারবে। সন্তান হারিয়ে সে এতটাই নিঃস্ব যে এখন আর মৃত্যুকে ভয় পায় না।এই আল্লাহর বান্দী এখন পারবে ভালোবাসা ভুলে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে। এই ছলনাময়ী এখন পারবে তার প্রিয় মানুষটার জন্য না কেঁদে থাকতে। এই রেড পারবে কল্পনার কাল্পনিক চিত্রকে ভালো না বেসে। এই অবাধ্য নারী এখন আরও অবাধ্য হবে। সব পারবে… এই সন্তান-হারানো মা।”
‘রিচার্ড কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চোখে অদ্ভুত শিথিলতা। অনড়ভাবে চেয়ে আছে এলিজাবেথের মুখাবয়বে। দৃষ্টিতে বহু বছরের তৃষ্ণা। হঠাৎ ওর উঁচু হয়ে থাকা শরীর কোমরে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। চুল পরিমাণ জায়গা থাকল না তাদের মাঝে।রিচার্ড আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিল এলিজাবেথের গালে। চোখে গাঢ় গভীরতা, কণ্ঠে নিদারুণ সুর,
“তোমাকে চাই।।
ঝলসানো রাতের…
এ পোড়া বরাতে;
তুমি আমার অন্ধকার
আর রোশনাই।।
কার্নিশে আলতা মাখানো~
দিনেরা ঢলে পড়ে রাতে;
তারপরে রাত্রি জাগানো‌
বাকি টা তোমার ই তো হাতে।।
তোমাকে চাই।।

‘এলিজাবেথ মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল। রিচার্ডের কণ্ঠ এতটা সুরেলা হতে পারে, এটা কি কল্পনাও করা গিয়েছিল?সে ওঠার চেষ্টা করতেই রিচার্ড আরো শক্ত করে চেপে ধরল, নিজের সাথে আরও মিশিয়ে নিল। হঠাৎ পাশে চোখ যেতেই দেখতে পেল এক মেয়ে পাশের গাড়ি থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ভিতর থেকে এই মুহূর্তটা যতটা স্বাভাবিক, বাইরে থেকে দেখলে নিঃসন্দেহে ভয়ংকর অন্তরঙ্গ লাগছে। রিচার্ডের মেজাজ এক নিমেষে চড়ে গেল। চোখ রাঙিয়ে মেয়েটার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কণ্ঠ,
“ইউ ফাকিং বিচ, বউ কোলে দেখতে পাচ্ছিস না?”

‘মেয়েটা থতমত খেয়ে গেল। মুহূর্তেই গাড়ি নিয়ে স্থান ত্যাগ করল। এলিজাবেথ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিচার্ডের চোখ পড়ল মিররে। পেছন থেকে ডজনখানেক গাড়ি ধেয়ে আসছে। হেডলাইটের তীব্র আলো শীতল অ্যালার্মের মতো ঝলসে উঠল মস্তিষ্কে। বিপদের সংকেত বুঝে রিচার্ড এক ঝটকায় এলিজাবেথকে সিটে বসিয়ে ওর স্কার্ফ দিয়ে হাত বেঁধে দ্রুত সিটবেল্ট পরিয়ে দিল। তারপর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে এলিজাবেথ চিৎকার করল,
“আপনি পাগল!”
‘শহরের আঁধার আকাশ বিদীর্ণ করে সারেনের বিকট শব্দ ছুটে আসছে পিছন থেকে। পুলিশের কালো গাড়ির সারি, মাঝে মিশে থাকা সন্ত্রাসীদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—সমস্ত আক্রোশ নিবদ্ধ এক ব্যক্তির উপর। রিচার্ড কায়নাত। স্টিয়ারিং চেপে ধরল রিচার্ড, শিরদাঁড়া সোজা, চোখে নিস্পৃহ দৃঢ়তা। ব্যাকভিউ মিররে এক ঝলক দেখে নিয়ে গ্যাস প্যাডেলে চাপ দিল দানবের মতো। কালো মার্সিডিজ গর্জন তুলে ছুটল গতির সূচক ছুঁয়ে ফেলল শেষ সীমা। ইঞ্জিনের গর্জনে কম্পিত হল বাতাস! রাস্তার আলোগুলো ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গেল পিছনের অন্ধকারে।

“গাড়ি থামান! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
‘পাশের সিটে এলিজাবেথ ভয় আর ক্ষোভে কাঁপছে৷ শক্ত হাতে দরজার হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরেছে। শরীর শীতল ঘামে ভিজে গেছে।রিচার্ডের চোখে এক চিলতে পরিবর্তন নেই। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
“গাড়ি থামবে ম্যানশনের সামনে। এর আগে নয়।”
“আমি যাব না! আমাকে নামান!”
“সম্ভব নয়।”
‘কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রথম গুলির আওয়াজ কানে এল। ধাতব চিৎকার তুলে ঝাঁঝরা হয়ে গেল মার্সিডিজের পেছনের উইন্ডশিল্ড। ছিন্ন কাঁচের টুকরো ঝরে পড়ল ভিতরে। এলিজাবেথ আতঙ্কে সিটে লুটিয়ে পড়ল। তবে রিচার্ডের ভ্রূক্ষেপ নেই। আয়নার এক ঝলক দৃষ্টি দিয়ে শিকলের মতো শক্ত হয়ে উঠল তার আঙুল। বাঁকা হাসল ভয়ের বিপরীতে।

“ওরা গুলি চালাচ্ছে? তবে আমিও নিয়ম মানছি না।”
‘স্পিডোমিটারের সূচক কাঁপতে কাঁপতে পৌঁছে গেল সর্বোচ্চ সীমায়। সামনে একের পর এক গাড়ির সারি তবুও রিচার্ড থামল না। স্টিয়ারিং এক ঝটকায় বাঁকিয়ে দিল ডানে। মার্সিডিজ ফুটপাত ঘেঁষে উঠে গেল রেলিংয়ের উপর।সামনের গাড়িগুলো এড়িয়ে দিল উড়ন্ত গতিতে। গাড়ির ঝাকিতে এলিজাবেথের শরীরে উপরে ওঠে যায়, মাথায় আঘাত লাগার আগেই রিচার্ড ওর তালুর উপর হাত রাখে রক্ষাকবচের ন্যায়। এক মুহূর্তের জন্য চারপাশ নিস্তব্ধ। বাতাসে ভাসল মার্সিডিজ তারপর প্রচণ্ড ধাক্কায় নামল রাস্তায়। ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল পুরো গাড়ি, চাকা ঘষটে উঠল সড়কের উপর, পেছনের গাড়িগুলো মুহূর্তে ছিটকে পড়ল দূরে। রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে তাচ্ছিল্যের হাসি। পেছনে ধেয়ে আসছে শত্রুর দল, অস্ত্রের নল তাক করা সামনে। রিচার্ডের ঠৌঁট থেকে বাঁকা হাসি সরছে না। কারণ সে জানে তারা ভুল জায়গায় বাজি ধরেছে। এখন শুধুই গতি, আগুন আর মৃত্যুর খেলা। ওদিকে জবুথবু করে কাঁপছে এলিজাবেথ।
“আপনি প্লিজ গাড়ি থামান, আমি ভয় পাচ্ছি।”

‘এলিজাবেথের ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে! নিঃশ্বাসে আতঙ্কের কম্পন। রিচার্ড এক ঝলক তাকাল ওর দিকে। সেই মুহূর্তেই ভেতরে এক ধরণের উন্মত্ত শিখা দপ করে জ্বলে উঠল। ওর কাঁপতে থাকা ঠোঁট দেখে নিজের শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল সে। ভয় পেলে মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে। তার পিছনে যে মৃত্যু ধেয়ে আসছে তবে সেদিকে একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই। এখন যেন সে রেস ট্র্যাকে আছে আর তার পাশে বসে আছে এক অভিশপ্ত লাস্যময়ী যার আতঙ্ক মিশ্রিত সৌন্দর্য রক্তে অগ্নিসঞ্চার করছে। এই ভয়ংকর উত্তেজিত মুহুর্তেও রিচার্ড হাস্কি টোনে বলল,
“এলি জান প্লিজ আমাকে উত্তেজিত করে দিও না, অন্তত এই মুহূর্তে না। ঠোঁট কাঁপানো বন্ধ কর। আমি এখনও সেকেন্ড বেবির কথা ভাবছি না। কিন্তু যদি নিয়ন্ত্রণ হারাই, তাহলে জল, স্থল, আকাশ—সব ভুলে যাবো। এক্ষুনি জ্বলে উঠব তোমার সর্বাঙ্গে গভীর থেকে গভীরতম স্পর্শে।”
‘এলিজাবেথ কিছু বলার আগেই সামনের রাস্তা ছেয়ে গেল উল্টে পড়া গাড়ির ধ্বংসস্তূপে। রিচার্ডের চোখ চকচক করল।
চিবিয়ে চিবিয়ে বিরবির করল,

“শালারা যদি ভাবে আমি থামব, তবে ভুল করছে।”
‘হঠাৎই গাড়ি একঝটকায় বাঁক নিল।ইঞ্জিনের গর্জনে আকাশ কেঁপে উঠল। আতঙ্কে এলিজাবেথ চোখ বন্ধ করে ফেলল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। রিচার্ডের ঠোঁটের কোণে খেলে গেল এক ভয়ানক তৃপ্তির হাসি। রিচার্ড বাঁক নিচ্ছিল ঠিক তখনই,
‘ঠাস!’
‘পেছনের কাচ ভেদ করে ছুটে আসা গুলি বিঁধল কাঁধে, তারপর সামনের কাচ ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে গেল। তীব্র যন্ত্রণায় রিচার্ডের অবয়ব শক্ত হয়ে গেল কিন্তু একটুও দমে গেল না। গলগল করে রক্ত ছুটল। এলিজাবেথ চিৎকার করে উঠল। কী জানি কী হলো ওর হঠাৎ। দাঁত দিয়ে হাতের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলল। অতঃপর নিজের স্কার্ফ দিয়ে চেপে ধরল রক্তাক্ত জায়গাটা। রিচার্ড এক ঝলক তাকাল ওর দিকে। ওর চোখে আতঙ্ক, কিন্তু স্পর্শে দৃঢ়তা। মেয়েটা কাঁদছে তার জন্য আবারও।

‘রিচার্ডের রক্ত এবার মাথায় উঠল। সে বন্দুক তুলে নিল।
চারপাশ থেকে ওদের ঘিরে ফেলছে গাড়িগুলো। প্রতিটি জানালার আড়ালে তাক করা বন্দুক, প্রতিটি ইঞ্জিনে গর্জে ওঠার প্রতিশ্রুতি। রিচার্ড গাড়ি অটো মোডে দিয়ে অর্ধেক শরীর বাইরে বের করল। তারপর,,,
‘ঠাস! ঠাস! ঠাস!’
‘গুলির শব্দে বিদীর্ণ হতে লাগল রাতের বাতাস। একটা একটা করে গাড়ি ব্রেক ফেল করে বিস্ফোরিত হতে থাকল, আগুনের শিখায় আলোকিত হলো অন্ধকার রাস্তা। উল্টে পড়া ধ্বংসস্তূপের মাঝে ওর প্রতিটি গুলি কারও না কারও শরীর ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। এদিকে এলিজাবেথ ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। কান্নায় চোখ লাল কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে রিচার্ডের রক্তক্ষরণ দেখে। রিচার্ড আরেকটা গাড়ির টায়ারে গুলি করল। সেটা উল্টে গেল ধাক্কা খেয়ে। সে আবারও সিটে বসল, স্টিয়ারিংয়ে চাপ দিল। ঠিক তখনই অপর পাশ থেকে ছুটে এল একটা গাড়ি। প্রচণ্ড ধাক্কা! এলিজাবেথের পাশের দরজা ছিটকে খুলে গেল। তীব্র ঝাঁকুনিতে শরীর বাইরে বেরিয়ে গেল ওর। বাতাসে উড়তে লাগল চুল। চারপাশ যেন স্থির হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। ওপাশে তাক করা বন্দুক। এলিজাবেথ চিৎকার করে উঠল।
“রেড!”

‘রিচার্ড চকিতে ফিরল ওর দিকে। স্টিয়ারিং ছেড়ে দিল একঝটকায়। বজ্রের মতো খপ করে ধরল এলিজাবেথের হাত। মুহুর্তেই একটানে টেনে এনে আঁচড়ে ফেলল নিজের বুকে। গাড়ির দরজা বন্ধ করার মুহুর্তে ঠান্ডা চোখে দেখে নিল সেই মানুষটাকে যার ধাক্কায় এলিজাবেথ মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এল। রাগে শিরদাঁড়া টনটন করে উঠল। দু’হাতে বন্দুক তুলে নিল রিচার্ড।
‘ঠাস! ঠাস! ঠাস! ঠাস!’
‘নিমেষেই বন্দুকের ঝাঁঝরায় সেই লোকটার মাথা উড়ে গেল। শরীর ধপ করে পড়ে রইল চলন্ত গাড়ির উপর। রিচার্ডের বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। এতোক্ষণের এই টানটান মুহূর্তে প্রথমবার ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু নিজের জন্য নয়। ভয় পেয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য। এলিজাবেথকে আর সিটে বসিয়ে রাখল না সে। নিজের কোলে তুলে নিল। এক হাতে শক্ত করে কোমর চেপে ধরল, আরেক হাতে স্টিয়ারিংয়ে চাপ দিল। এগিয়ে আসা গাড়িগুলোকে তোয়াক্কা না করে, একটা একটা করে উল্টে দিতে থাকল। পেছনে পড়ে থাকল বিধ্বস্ত ধ্বংসাবশেষের সারি। আগুনের শিখায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাত। এখন আর ওদের থামানোর কেউ নেই।
‘হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই রিচার্ড দ্রুত ফোন গাড়ির ব্লুটুথে কানেক্ট করল। স্ক্রীনে কল কানেক্টের সিগনাল আসতেই ওপাশ থেকে ন্যাসোর উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এলো,

“বস আপনি ঠিক আছেন? ম্যাম! ইজ শি ওকে?”
‘রিচার্ডের কণ্ঠ তাদের থেকেও অস্থির শোনাল।
“আমি থাকতে ওর কি হবে ড্যামেট? তোমরা কোথায়? আর ইউ গায়েজ ওকে?”
‘লুকাস বিরক্ত গলায় বলল,”শ্লারা আমাদের কৌশলে জ্যামে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। চারদিক থেকে গাড়ি ব্লক, নড়ার জায়গাও নেই।”
‘রিচার্ডের কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, ব্যথায় শরীর আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছে। তবুও সে সেসব আমলে না নিয়ে এলিজাবেথের মাথায় ঠোঁট ছোঁয়াল ভিতরের আতঙ্ক খানিকটা কমানোর জন্য। একটু আগের কয়েক সেকেন্ডের কথা মনে হলে এখনও বুকে তীব্র চাপ অনুভূত হয়।
“ড্রাগন ট্রিমে অ্যালার্ট পাঠিয়েছ?”

‘ন্যাসো নাক কুঁচকালো। লুকাস ব্যাকসিট থেকে অস্ত্র বের করতে করতে বলল,
“উফফ, বস আপনিও না। কয়েকটা চুনোপুঁটির জন্য লোক ডাকতে হবে? এবার নিজ পায়ে মাঠে নামছি। আমাদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনার জন্য প্ল্যান থ্রি রেডি।”
‘রিচার্ড সামান্য হেসে উঠল।
“সাব্বাস! আমার বাঘের বাচ্চারা।”
‘ন্যাসো হাসতে হাসতে বলল,”ব্রেক আ লেগ, বস! আপনার বিয়েতে থাকতে পারব না, কিন্তু দোয়ার কমতি থাকবে না।”
‘ঠিক তখনই ওপাশ থেকে দরজা ভাঙার শব্দ ভেসে এলো। লুকাসের একটা লাথিই যথেষ্ট ছিল। রিচার্ড লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
“লোকা, লিসেন। বি কেয়ারফুল মাই বয়েজ। আমি তোমাদের হারাতে চাই না।”
“আজ রাতে একসাথে পার্টি হবে, বস!”

‘ওপাশ থেকে দুজনেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। তাদের অস্ত্র তাক করে শিকার বেছে নিল তৎক্ষনাৎ। পরক্ষণেই ভেসে এলো গুলির শব্দ। রিচার্ড ফোন কেটে দিল। এলিজাবেথ এখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে তার কাঁধ। রিচার্ড একচিলতে হাসল। আজ রাত শেষ হওয়ার আগে ওদের দুনিয়া কেঁপে উঠবে।
‘এলিজাবেথ ছোটবার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করল।

মোচড়ামুচড়িতে রিচার্ডের শরীর ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। ওর প্রতিটি ছটফটানি যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল শিরায় শিরায়। রিচার্ড অনবরত শুকনো ঢোক গিলছিল নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে।বেগ হারিয়ে যখন সে ধীরগতিতে এলিজাবেথের ঠোঁটের দিকে এগোলে এলিজাবেথ মুখ সরিয়ে নিল। ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,
“ছুবেন না আমায়।”
‘রিচার্ড এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি টানল। ফিসফিস করে বলল,
“ছুবো না?”
“না।”
“একটুও না?”
‘এলিজাবেথ এবার মাথা নুইয়ে ফেলল। ঠোঁট শক্ত করে চেপে বলল,”না।”

“কোথাও না?”
“না!”
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে হাসল। ওর কোমরে পেঁচানো হাত বাঁকিয়ে উদরে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। তারপর ধীরগতিতে কাপড়ের ফাঁক গলে সরে গেল উন্মুক্ত উষ্ণতায়। এলিজাবেথের পায়ের তলানি শিরশির করে উঠল। শক্ত হাতটা ওর অন্তবের্দী প্রদেশে আঁকাবাঁকা ভঙ্গিমায় বিচরন করল কিছুক্ষণ। অতঃপর রিচার্ড ওর রক্তার্জিত কানের লতির কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“আমি ওখানে পৌঁছেছি বলেই কিন্তু ও এখানে এসেছিল।”
‘তারপরই দাঁতে দাঁত চেপে হাতের অভিমুখ বদল করল রিচার্ড। সাথে সাথে এলিজাবেথ সন্ত্রস্ত হয়ে কেঁপে উঠে রিচার্ডের গলা খামচে ধরল।

‘নিঃশ্বাস ভারী, এলোমেলো। বুকের গভীর থেকে উঠে আসছে হাহাকার যেন দমবন্ধ এক ঘরের ভিতর আটকে আছে চিৎকার। শরীর জুড়ে ভয়ার্ত ঘাম তার সাথে চুইয়ে পড়ছে উষ্ণ রক্ত। এলিজাবেথ ছুটছে, প্রাণপণে ছুটছে। অন্ধকার জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো পথ, ভেজা মাটির উপর পড়ে থাকছে তার পায়ের অস্পষ্ট চিহ্ন! ধোঁয়াটে সাক্ষী হয়ে। শরীরে লেগে থাকা বেল্টের আঘাত এখনও দগদগে। প্রতিটি নড়াচড়ায় যন্ত্রণার সুতোর মতো টান দিচ্ছে কিন্তু থামা চলবে না। থামলেই শেষ। চারপাশে গাছের ছায়া, কালো রাতের মধ্যে আরও কালো। পাতার ফাঁকে ফাঁকে কোথাও কোথাও চাঁদের ফ্যাকাশে আলো কিন্তু আশ্রয় নয়। যেন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কোনো নিষ্প্রাণ দর্শক।মস্তিষ্ক, নিউরন,শ্রবণ ইন্দ্রিয় ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে সেই কথাগুলো।

“পালা এলিজাবেথ, পালা। আজকে যদি তুই পালাতে পারিস, তবে তোর মুক্তি এই নরক থেকে চিরদিনের জন্য। আর যদি আমি ধরতে পারি, তোর রক্ত চুষে খাবে বন্দিত্ব।”
‘শরীর শিউরে ওঠে। কানের মধ্যে রিচার্ডের কণ্ঠস্বর এখনো বাজছে।ঠিক পিছন থেকে বলা কথা মনে হয় যেন ছায়ার মতো এখনও লেগে আছে ওর সাথেই। আতঙ্কের ঝড় বুকের মধ্যে তাণ্ডব চালাচ্ছে। পালাতে হবে, যে করেই হোক পালাতে হবে। ধ্বংস, পাপ, বিভীষিকার এক অন্তহীন মরিচীকা থেকেরিয়ে আসতেই হবে।
‘হঠাৎ, সেই ভয়াল কণ্ঠস্বর,
“পালা, এলিজাবেথ, পালা! আজ যদি পিছনে তাকাস, রাজার লৌহমুষ্টি তোর গলা চেপে ধ্বংস করে দেবে! যদি পালাতে পারিস, তো বাঁচবি; মুক্তি পাবি এই অভিশপ্ত রাজার কাছ থেকে।”
‘এলিজাবেথের শরীর ঝাঁকুনি খেলো। শব্দ যেন কোথাও নেই অথচ আছে। অরণ্যের নিস্তব্ধতায় কেবল তার তীব্র শ্বাসের প্রতিধ্বনি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল এদিক-ওদিক। কেউ নেই।তাহলে? কোথা থেকে আসছে এই ভয়াল কথাগুলো৷
“আজ পিছনে তাকালেই ঘটবে তোমার সর্বনাশ।”

‘এলিজাবেথের বুক চিরে উঠল ফুঁপিয়ে কান্না। হাতের আঙুলগুলো জড়সড়, শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু সময় নেই, ভয় তাকে থামতে দেবে না। আবার দৌড় দিল সে। রক্তাক্ত পা পেছনে ফেলে আসা অতীতের সাক্ষী রেখে ছুটে চলল গভীর, আরও গভীর অন্ধকারে। ঝোপঝাড়ের কাঁটায় লেগে এলিজাবেথের কাঁধের অংশের কাপড় ছিঁড়ে যায়। ক্ষতস্থান থেকে গাঢ় লাল ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। ও ব্যথা টের পাচ্ছে কিন্তু অনুভব করার সময় নেই। সামনে একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে৷
‘আশার আলো। গতি বাড়িয়ে ছুটে যেতে লাগল, কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে শক্ত এক জোড়া হাত কোমর পেঁচিয়ে ধরল! বুকের ভেতর শূন্যতা গেয়ে উঠল! শরীরটা মুহূর্তের জন্য জমে গেল। নিঃশ্বাস আটকে আসে এলিজাবেথের। কারোর গরম নিঃশ্বাস ওর গলার কাছে লাগছে। কেউ একজন কানের ঠিক পাশে ফিসফিস করে বলল, সেই চিরপরিচিত ভারিক্কি স্বরে—
“I will do anything to find you, my love… Nothing can stop me… because you are mine, and I take what’s mine. You are my everything, jaan.”

‘শরীর শিউরে উঠল এলিজাবেথ। ভয়, আতঙ্ক, আর এক অজানা অনুভূতির একযোগে বিস্ফোরণ ঘটল ওর মধ্যে। হুড়মুড়িয়ে কেঁদে ফেলল। একটা পরিচিত ছোঁয়া ওর উন্মুক্ত কাঁধ স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে দিল। অতঃপর এলিজাবেথ অবাক হয়ে তাকানোর আগেই সেই অস্তিত্ব আবারও আঁধারে মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য এলিজাবেথ সেখানেই স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এক ধ্বংসস্তূপের মতো ঠুকরে কেঁদে ফেলল। কিন্তু থামার সময় নেই। সে ছুটে গেল রাস্তায়। কিন্তু—শূন্যতা। কোনো গাড়ি নেই। কেউ নেই।

এলিজাবেথ দিশেহারা হয়ে চারপাশে তাকাল। চারদিক নিঃশব্দ, অন্ধকারে ঢাকা। ঠিক তখনই ওর চোখ পড়ল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিশাল, পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের দিকে। এক মুহূর্ত ভাবল না। ছুটে গেল সেদিকে।
‘পুরো ভবনজুড়ে একটিও কক্ষ নেই। দেয়ালগুলো দীর্ঘ, নির্জন, অথচ কোথাও প্রবেশের পথ নেই। এলিজাবেথ দিশেহারা হয়ে ছুটল ছাদের দিকে।কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুরতম পরিহাস ছাদেও কোনো দরজা নেই। এলিজাবেথ উন্মত্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাল। বাতাসে হালকা শিরশির শব্দ। রাতের আঁধারে সময়ও স্তব্ধ হয়ে আছে। হঠাৎ পিছন থেকে ভারী পায়ের শব্দ কানে এল। সেই শব্দে হৃদপিণ্ড যেন এক মুহূর্ত থমকে গেল। এলিজাবেথ দ্রুত ছুটে গেল রেলিংয়ের কিনারে৷
‘ধীরে ধীরে ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রিচার্ড। চোখেমুখে হিংস্র শীতলতা! ধারালো চোয়ালে জমাট বাঁধা ক্রোধ। বাতাসে ওর ভারী কোট উড়ছে। এলিজাবেথ ওঠে দাঁড়াল রেলিঙের ওপর৷
“একদম কাছে আসবেন না! এক কদমও এগোলেই আমি ঝাঁপ দেব!”

‘রিচার্ডের মুখে সামান্যতম উদ্বেগের রেখা নেই। ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর এক বাঁকা হাসি। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে।এলিজাবেথের আর ভয় লাগল না। মৃত্যু, যা এতদিন অজানা আশঙ্কা হয়ে ছিল, এখন এটাই একমাত্র মুক্তির পথ। চোখ বন্ধ করল সে, হৃদয়ের গভীরে সর্বশেষ শ্বাস নিল, তারপর ঝাঁপ দিল শূন্যে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে কালেমা পাঠ করে নেয় সে। তবে মৃত্যু তাকে গ্রহণের আগেই এক অপ্রত্যাশিত শক্তি ওর হাত চেপে ধরল। এলিজাবেথ তাকাল ওপরে। রিচার্ড! রেলিঙের ওপর ঝুঁকে ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৯

“বিশ্বাস কর এই নরপিশাচেরও কষ্ট হয়। নাহয় সত্যিই তোর হাত আজ ছেড়ে দিতাম।”
‘এক ঝটকায় তুলে আনল ওকে। মুহূর্তের ধাক্কায় এলিজাবেথ ওর বুকের মধ্যে পড়ে গেল। সাথে সাথে রিচার্ডের বুকে ঢলে পড়ল এলিজাবেথ।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫১