হামিংবার্ড পর্ব ৯

হামিংবার্ড পর্ব ৯
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

দুপুরের খাবার শেষে ধীর পায়ে নিজের কেবিনে ঢুকল আরিশ। অফিসের একঘেয়ে ব্যস্ততা শেষে কিছুটা একা সময় কাটাতে এমন নীরব কেবিনটাই যেন তার নির্ভরতার জায়গা। পরনে কালো রঙের ফিটেড শার্ট, নিখুঁতভাবে পরা ফর্মাল প্যান্ট, পকেট থেকে মোবাইল বের করার সময় ঝুলে থাকা হাতঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল যেন। চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপাল ছুঁয়ে আছে, চোখে হালকা শেডের সানগ্লাস, যেন সূর্যের আলো নয়—মানুষের দৃষ্টিকে আড়াল করতেই তার এই বর্ম।
চেয়ারে বসেই সামনে রাখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উল্টাতে শুরু করল সে। চোখ ছিল কাগজে, কিন্তু মন যেন অন্য কোথাও। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্ত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে তাকাল স্ক্রিনের দিকে। পরিচিত নামটা দেখেই খানিক থমকে গেল—চাচি কল করেছেন! এক মুহূর্ত থেমে, গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কলটা রিসিভ করল আরিশ।
” হ্যালো কাকি, কেমন আছেন? ”
আরিশের গলা শুনে মুচকি হাসলেন তাসলিমা খাতুন। সাবিহা মায়ের পাশেই বসে আছে। তালহা খাওয়া শেষে একটু বেরোলো।

” আল্লাহর রহমতে ভালো আছি, তুই কেমন আছিস? ”
” আমি সব সময় ভালো থাকি কাকি। ”
” তা জানি, কেমন থাকিস!”
” কিছু বলবেন? হঠাৎ কল দিলেন? ”
” হ্যাঁ। তালহার তো মাস্টার্স শেষ হলো কবেই। এবার তো একটা কাজকর্ম করতে হবে ওকে। আর কতদিন বসে বসে খাবে! ”
আরিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। রুম জুড়ে ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলো।
” ঢাকায় পাঠিয়ে দিন তালহাকে। কোম্পানির হাল ধরুক। শিখতে হবে তো। ”
তাসলিমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। এ যেন জল না চাইতেই বৃষ্টি!
” আমিও তাই ভাবছিলাম আরিশ। আমরা সবাই ঢাকা চলে যাবো। কী বলিস? ”
” ঠিক আছে। চলে আসুন। ”
” আচ্ছা বাবা।”
” রাখছি। ”
আরিশ আরকিছু না বলে কল কেটে দেওয়াতে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন তাসলিমা খাতুন। সাবিহা আগ্রহ নিয়ে শুধালো,
” কী বলল আরিশ? ”
চোখ পাকালেন তাসলিমা। বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আরিশ ভাইয়া বল। আমরা আগামীকাল ঢাকায় যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে আরিশের সাথে বুঝেশুনে কথা বলিস। জানিসই তো, মাথার তার ছিঁড়া ওর। ”
সাবিহা কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসল। তার বিরক্ত লাগছে। তবে আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছে, এটা শুনে বেশ আনন্দও লাগছে। আর মাত্র একটা রাত! তারপর আরিশকে দেখতে পাবে সে।
” তোমার মা কল দিয়েছেন। ”
অকস্মাৎ আরিশের আগমনে হকচকিয়ে গেলো অরা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ছিলো সে । ক’দিন ধরে ঠিকমতো আয়নাও দেখা হয়না। সেজন্য চেহারার হাল দেখার জন্য আয়নার সামনে বসেছিল মেয়েটা। কিন্তু আরিশ আজ এত জলদি বাসায় ফিরবে বুঝতে পারেনি।

” কথা বলুন। ”
” ইচ্ছে করছে না, হামিংবার্ড। ”
অরা কী বলবে বুঝতে পারছে না। মানুষ এমন হয় কীভাবে? গতকাল থেকে কল করে যাচ্ছেন রোকসানা, অথচ আরিশ কলও রিসিভ করছে না।
” মাঝে মধ্যে ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও অনেক কাজ করতে হয়। ”
আরিশ গভীর দৃষ্টিতে তাকাল অরার দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” তুমি তো খুব ভালো কথা বলতে পারো। ”
ম্লান হাসল অরা। আরিশ কল ব্যাক করলো। রিং হওয়ার সাথে সাথে কল রিসিভ করলেন রোকসানা।
” হ্যালো, আরিশ!”
” জি, বলুন। ”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অরার মা। আরিশের আচরণ খারাপ লাগে উনার। কিন্তু কিছু করার নেই।
” আরিশ এখন আমি তোমার শ্বাশুড়িও বটে, কেবল খালামনি নই। একটু হলেও বিহেভিয়ার চেঞ্জ করো। ”
” প্রয়োজনবোধ করছি না। ওই মহিলার বোন আপনি, এটাই আপনার একমাত্র পরিচয়। ”
” তাহলে অরাও তো আমার মেয়ে। ”
” শি ইজ মাই ওয়াইফ নাউ। হুজ ডটার অর সিস্টার শি ইজ ডাজ়ন’ট ম্যাটার এনি-মোর।
কী বলার জন্য কল করেছিলেন সেটা বলুন প্লিজ। ”
সোলাইমান মল্লিক স্নেহভরে রোকসানার কাঁধে হাত রাখলেন। চোখের পাতায় ভরসার ছায়া টেনে ইশারায় বোঝালেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রোকসানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—একটা ভার যেন বুক চিরে বেরিয়ে এল।
” তোমাদের বিয়ের তিনদিন হয়ে গেছে। আগামীকাল অরাকে নিয়ে এসো একবার, দেখা করে যাবে। ”
” কী দরকার? মাত্র তিনদিন হলো! এরমধ্যে দেখা করার দরকার নেই। ”
আরিশের কথোপকথন শুনে অরার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। লোকটা মায়ের সাথে এভাবে কেন কথা বলছে!
” ঠিক আছে। যেদিন তোমার ইচ্ছে হবে সেদিনই এসো। আমি জানি, তুমি আসবে আরিশ। ”
” বায়। ”
” কী হলো? আসবে না বলল?”

স্বামীর প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন রোকসানা? রোকসানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চোখ নামিয়ে নিঃশ্বাস নিলেন ধীরে। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
“ছেলেটা জেদি, ঠিক আছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস—ভালোবাসা আর ধৈর্য থাকলে, সবচেয়ে একগুঁয়ে মানুষটাকেও বদলানো যায়। অরা পারবে… ও যদি ওর ভেতরের মানুষটাকে ছুঁতে পারে।”
মৃদু হাসলেন সোলাইমান।
” তাই যেনো হয় রোকসানা। ”
” হুম। ঘুমাও তুমি, আমিও ঘুমাচ্ছি। ”

রোকসানা চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। সোলাইমানও চোখ বন্ধ করলেন, ঘুমানোর উদ্দেশ্যে।
বিছানার উপর ফোনটা রেখে ধীরে ধীরে জামাকাপড় খুলতে লাগল আরিশ। শরীরে তখন কেবল একটা আন্ডারওয়্যার। অরা একপলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল, মুখে তীব্র বিরক্তি—ক্ষোভে তার বুক ধুকধুক করছে। ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এমন এক উন্মাদ, জেদি, খামখেয়ালি মানুষের সঙ্গে থাকা—শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠেছে।
চুলগুলো তাড়াতাড়ি বিনুনি করে বিছানার দিকে এগোল অরা। চুপচাপ। অভিমান তার চলনে। আরিশ চুপচাপ তাকিয়ে রইল ওর দিকে—এই মেয়েটাকে দেখলেই বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার। যেন নরম মেঘের মতো—ফোলা ফোলা গাল, আর সেই গালেই একটা টোল।
ছোটখাটো গড়নের মেয়েটা দেখে অনেক সময় বাচ্চা মনে হয় আরিশের।

” এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? ”
আরিশকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুধালো অরা। ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো আরিশ। অরার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। অরা চুপচাপ বসে আছে। ফের কিছু করলেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে সে। যে ভদ্রলোক অরার মা’কে অসম্মান করেছে তার সাথে অরা থাকবে না। কিছুতেই না। এই ক’দিন ভয়ে ভয়ে ছিলো সে। এখন কিছুটা হলেও ভয় কেটেছে।
” তোমার সমস্যা হচ্ছে? ”
” না। ”
” তবে?”
” নাথিং। ”
অরা কিছু বোঝার আগেই আরিশ তাকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল। চমকাল অরা। রেগে বলল,
” কী করছেন? ”
আরিশও অবাক হলো অরার আচরণে। মেয়েটার এতটা সাহস হলো কীভাবে হঠাৎ? আরিশ অরার শরীরের ওপর ঝুঁকে, ওর কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলে,
” দু-তিন দিনেই ভয় কেটে গেছে? ”
শুকনো ঢোক গিলল অরা। আরিশের হিংস্র আচরণগুলো মনে পড়ে গেলো।

” প্লিজ, সরুন। ”
” কেনো? ”
” আমার ভালো লাগে না এসব। ”
❝ ভালো লাগে না! ❞ আরিশের কানে বারবার কথাটা বাজতে লাগলো। অরার তাকে, তার স্পর্শ ভালো লাগে না? কিন্তু কেনো? অরা যেনো আরিশের সাথে থাকে, সেজন্যই তো এতটা আদর করে সে। যদি কখনো অরা তাকে, অক্ষম বলে চলে যায় – সেই শংকা থেকেই আরিশের এত পাগলামি।
” সত্যি ভালো লাগে না? না-কি অন্য কেউ আছে? ”
আচমকাই আরিশের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। অরা বেশ বুঝতে পারছে, আরিশ আবারও হিংস্রতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তার শরীরটাই বেছে নিবে।
” কেউ নেই, আপনি ছাড়া। ”
অরার কথায় থমকে গেলো আরিশ। অরার দুই গালে হাত রাখল সে। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেছে সে।

” সত্যি তো? ”
” তিন সত্যি। ”
মুচকি হাসল আরিশ। অরার কপালে কিস করলো একটা। অরার চোখ ছলছল করে উঠল। আরিশ যদি সব সময় এমন থাকত, তবে কতোই না ভালো হতো।
” শাওয়ার নিয়ে আসি। তুমি এভাবেই থেকো। ”
” এভাবে শুয়ে? ”
” হ্যাঁ। ”
অরা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আরিশ ওয়াশরুমের দিকে এগোল। বিয়ের পর এই প্রথম আরিশকে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ মনে হলো অরার। একেবারে শান্ত, কেয়ারিং একটা মানুষ। অরা ভেবে পায় না আরিশের এমন হুটহাট বদলে যাওয়ার কারণ কী! লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে, নিজেকে বোঝাতে লাগল সে। আরিশকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে, হয়তো একসাথে থাকতে থাকতে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। মা হয়তো ঠিকই বলেন, ছোটো থেকে একা থেকে, মায়ের থেকে অবহেলা পেয়েই আরিশ এমন হয়ে গেছে।
অরার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু সে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছে না। আরিশের আচরণ যেন এক ধরণের বিপর্যয়।

হামিংবার্ড পর্ব ৮

ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। অরা একে একে সমস্ত অনুভূতিগুলো অগ্রাহ্য করে সোজা হয়ে শুয়ে রইল। একাকী হয়ে যাওয়া অনুভূতি তার ভেতর ঢুকতে থাকল, যেন এই ঘরটায়, এই মুহূর্তে, সে একা। কিন্তু তারপরে মনে পড়ল, আরিশ কি আদৌ কখনো তাকে একা থাকতে দেবে? আরিশ প্রায় পাঁচ মিনিট পর ফিরে এলো।

হামিংবার্ড পর্ব ১০