রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৪

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৪
রিক্তা ইসলাম মায়া

কোলাহলময় একটি অস্থির উত্তেজিত পরিবেশ। দিনের শেষে সন্ধ্যার আবেশ ধরনী জুড়ে। সময়টা প্রায় ছয়টা ত্রিশের ঘরে। অবস্থান চট্টগ্রাম মেডিকেল হসপিটাল। রিদের এক্সিডেন্ট হয়েছিল প্রায় চারটের নাগাদ। বিগত আড়াই ঘণ্টা যাবত রিদকে নিয়ে ওটিতে ডক্টররা। ইমার্জেন্সি চলছে। সেখানে উপস্থিত আয়ন নিজেও। প্রফেশনাল ডাক্তার হয়েও আজ তার বুক হাত উভয় কাঁপছে রিদকে শয্যাশায়ী দেখে। আয়নের দেখা এই প্রথম রিদ খান নিস্তব্ধ আর নিশ্চুপ শুয়ে আছে। মাথা একপাশ থেঁতলে যাওয়ায় সেখানটায় ট্রিটমেন্ট চলছে। আয়ন প্রফেশনাল ডাক্তার হওয়ায় সে বুঝতে পারছে এসব চিকিৎসা রিদের তেমন কাজে দিবে না।

রিদের শ্বাস খুবই ধীর গতিতে ফেলছে। বলতে গেলে থেমে থেমে। মস্তিষ্কে আ*ঘাত পেয়েছে ভিষণ। সেজন্য শরীর রেস্পন্স করছে না। মৃ*ত্যু দেহের নেয় নেতিয়ে রিদের শক্তপোক্ত শরীরটা। রিপোর্টে এসেছে এক্সিডেন্টের ফেলে রিদের মস্তিষ্কে র*ক্ত*ক্ষ*রণ হয়েছে বেশ। যার জন্য রিদের নাক-কান উভয় পথে র*ক্ত ঝরেছে। মস্তিষ্কে র*ক্ত জমাট বাঁধার কারণে এটা রিদকে কোমায় নিয়ে যাওয়ার চান্স বেশি। আয়নের দুচোখ সিক্ত হলো নোনা জ্বলে। সে ইতিমধ্যে রিদের সকল রিপোর্ট দেখেছে। সেখানে স্পষ্ট লেখা পেশেন্টের লাইফ চান্স ১০%। যার জন্য আয়নের বুক কাঁপছে রিদের বর্তমান পরিস্থিতি কথা ভেবে। অসহায়, হাহাকার বুকে দু’হাতে মুঠোয় রিদের হাতটা চেপে ডাক্তার সঙ্গে ওটিতে দাঁড়িয়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে নিজে ডাক্তার হয়েও রিদকে চিকিৎসা করার মতোন শক্ত মনোবল আয়নের এই মূহুর্তে নেই। তার চেয়ে যেটা আয়নকে বেশি ঘায়েল করছে সেটা হলো রিদের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। বাহিরে দেশে কোথাও নিতে হবে। কিন্তু বাহিরে দেশে নেওয়া অব্দি রিদের শ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে কিনা সেই আশঙ্কার ভয়ে আয়নসহ গোটা ডক্টর টিম। ভঙ্গ হৃদয়ে আয়নের চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইল। কারণ এই মূহুর্তে রিদের জন্য করার মতোন কারোও হাতে কিছু নেই। আয়ন চেয়েও রিদের জন্য কিছু করতে পারছে না।

ডক্টররা যারা ইমার্জেন্সিতে রিদের ট্রিটমেন্ট করছে তারা একটু পর ট্রিটমেন্ট শেষে আয়নকে কি বলবে সেটা আগ থেকেই জানা আয়নের। নিরাশ আয়নের বারবার চোখের পাতা ভিজে উঠলো নোনাজলে। ছেলেদের কাঁদতে নেই অথচ আয়ন আজ চেয়েও নিজের চোখের পানি থামাতে পারছে না। বুক ফাটা কষ্টে তীব্র কান্না পারছে ওর। ওটির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা আপনজনদের কি জবাব দিবে সে? যখন জানতে চাইবে রিদ কেমন আছে? কি বলবে? রিদ ভালো নেই? রিদের বাঁচার সম্ভবনা ১০% বা তারও কম? আয়নের চিন্তা ভাবনার মাঝেই বাকি ডক্টরা রিদের মাথার আঘাত প্রাপ্ত যায়গা গুলোতে ওয়াশ করে প্রাথমিক সেলাই করে পিছন ঘুরতে ঘুরতে ডক্টর রাশেদ আয়নের উদ্দেশ্যে বলল…

‘ পেশেন্টের মাথার অবস্থা খুবই খারাপ ডক্টর আয়ন। আমাদের ধারণা বাকি চিকিৎসা সম্ভব নয়। যত দ্রুত সম্ভব পেশেন্টকে ঢাকা ট্রান্সফার করুন প্লিজ। উনার বাঁচা খুব কম। বাকিটা আপনি হয়তো রিপোর্টে দেখেছেন ডক্টর আয়ন।
ডক্টর রাশেদ কথা গুলো বলেই আবারও রিদের রিপোর্ট গুলো চেক করতে বেড়িয়ে যেতেই আয়ন হাঁটু গেঁড়ে বসে গেলো ফ্লোরে। দু’হাতে মুঠোয় রিদের নিস্তেজ হাতটা চেপে কপালে ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল বুক ফাটা আর্তনাদে…
‘ আই এম সরি ভাই। আই এম সরি! তোর জন্য কিছু করতে পারছি না। কিছু না।

আয়নের কান্না বলে দিচ্ছে রিদকে ইমার্জেন্সিতে ঢাকা ট্রান্সফার করালেও সেখানে ডক্টরাও তাই বলবে যা এই মূহুর্তে ডক্টর রাশেদ বলে গেল। তাঁরাও হয়তো ডক্টর রাশেদ মতোন দু’ঘন্টা চেষ্টার পর জানাবে তাদের ধারণা সম্ভব নয় পেশেন্টের সুস্থতা নিশ্চিত করা। অথচ ওটির বাহির থেকে আপনজনদের হাহাকার আর কান্নার গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। তাদের কি উত্তর দিবে আয়ন? কি বলবে? আয়নের কান্নার মাঝেই হসপিটালের তীব্রস্বরের যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এলো বাহির থেকে। তীব্র কম্পনে শাঁ শাঁ শব্দে আয়ন রিদের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সে জানে শব্দ কিসের। কার আগমন ঘটেছে চট্টগ্রামের মাটিতে। আয়ন অশ্রু সিক্ত চোখে গিয়ে দাঁড়ালো ওটির জ্বানালার পাশে। থাই গ্লাস দিয়ে নিচে তাকাতেই চোখে পড়লো শতশত মানুষের ভিড় হসপিটালের চত্বরে। সকলেই রিদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে হসপিটালের চত্বরে। মন্ত্রী নিহাল খানের ছেলে রিদ খানের এক্সিডেন্ট বলে কথা হসপিটালের ভিড়তো এমনি হতো। তবে প্রশাসনের পুলিশ ভিড়ও দেখা গেল সেখানে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জায়গায় জায়গায় পুলিশ দাঁড়িয়ে। কিন্তু অস্থির উত্তেজিত পরিস্থিতির জন্য হসপিটালের অন্যান্য রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে সেটা জেনেও কারও হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার মতোন কিছুই নেই। প্রতিনিয়ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নিহাল খানের রাজনৈতিক দলের লোক থেকে শুরু করে বড় বড় নেতৃবৃন্দসহ উপস্থিত আজ হসপিটালের চত্বরে। আয়ন চোখ ঘুরিয়ে তাকাল শূন্য আকাশ থেকে নামা হেলিকপ্টারটির দিকে। গোল গোল পাখা ঘুরিয়ে হেলিকপ্টারটি নামলো হসপিটালের থেকে বেশ দূরে খালি মাঠে। যেখানে আগ থেকেই উপস্থিত ছিল রিদের বেশ কিছু বডিগার্ড। ক্যাপ্টেন হেলিকপ্টারের দরজার লক খুলে দিতেই দুজন বডিগার্ড এগিয়ে এসে দরজা টেনে খুলতেই বেড়িয়ে আসল রিদের মা সুফিয়া খান। তিনি হেলিকপ্টার থেকে বেড়িয়ে সোজা হাঁটল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আজ প্রায় পনেরো বছর পর এই চট্টগ্রামের মাটিতে পা পরেছে উনার।

সেই পনেরো বছর আগে এক কাপড়ে স্বামী ঘর ছেড়েছিলেন তিনি ,আর আজ পনেরো বছর পর ফিরছেন ছেলের এক্সিডেন্টের খবর শুনে। বিগত পনেরো বছর আগে যখন এই দিনে স্বামীর ঘর ছেড়েছিলো সেদিন উনার চোখে জল ছিল না। ছিল শুধু রাগ আর জেদের বশবতী হয়ে স্বামী ও সংসার ছেড়েছিলো তিনি কিন্তু আজ চোখ ভরতি মমতার। শক্ত মানুষ গুলো নাকি কাঁদলে মানায় না। যেমনটা সুফিয়া খানকে দেখলে যেকেউ বলবে সেটা। আজ অবধি কখনো কেউ সুফিয়া খানকে কাঁদতে দেখেছে কিনা জানে না। নিহাল খান নিজেও হয়তো কখনো নিজের বউকে কাঁদতে দেখেনি। এমনকি সুফিয়া খানের বাবা-মার মারা যাওয়ার সময়কালেও তিনি দেখেনি সুফিয়া খান কাঁদতে। অথচ আজ উনার চোখের পাতাসহ লাল হয়ে ফুলে আছে অতিরিক্ত কান্নার ফলে।

শক্ত মানুষ গুলো কাঁদলে শব্দ হয়না। নিশ্চুপে শুধু চোখে জলই ঝরে যায়। এই মূহুর্তে সুফিয়া খানের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে অতিরিক্ত রাগে অথচ চোখসহ গাল অনবরত ভিজে উঠছে কান্নায়। সুফিয়া খান হসপিটালের করিডোরে পা রাখতেই আপনজনের কান্নার শব্দ ভেসে এলো কানে। রিদের তিন ফুপির দুই ফুপিও উনাদের স্বামী সন্তানেরা সকলেই উপস্থিত হসপিটালে। আয়নের বাবা-মা বাদে। উনারা লন্ডনের বাসিন্দা সেজন্য আজ এই মূহুর্তে এখানে নেই। তবে শশী ও তার মা-বাবা দুজন অশ্রু সিক্ত চোখে খান বাড়ির সকলের সাথে দাঁড়িয়ে। বলতে গেলে খান বাড়ির হাতেগোনা কয়েকজন কর্মচারী বাদে সকলেই উপস্থিত হসপিটালে রিদের খবর জানতে। সুফিয়া খান পরিচিত মানুষের মুখ সেই নিচ তলা হতে তৃতীয় ফ্লোরে উঠা অবধি দেখা পেয়েছে।

সকলের দৃষ্টি কেন্দ্র বিন্দু ছিল রিদের মা সুফিয়া খান। হসপিটালের করিডোরের পরিচিত অপরিচিত অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে থাকায় হাঁটা রাস্তা নেই। তবে সুফিয়া খানের আগমন সকলেই করিডোরে দুপাশে হয়ে দাঁড়াল রাস্তা করে। অপারেশন থিয়েটার সম্মুখে মাথা ঝুঁকে ফ্লোরে বসেছিল নিহাল খান। হঠাৎ পায়ের খটখট শব্দে সামনে তাকাতে চোখে পরলো একটা প্রিয় মুখ। নিস্তব্ধ নিশ্চুপ পলকে তিনি সেদিকেই তাকিয়ে রইল তেজে হেঁটে আসা রাগান্বিত মহিলাটির দিকে। অতি আপনজনে অতি প্রিয় একটা মুখ নিহাল খানের। অথচ আজ কতোটা বছর পর সামনে থেকে দেখা পেল তিনি। নিহাল খানকে একই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রথম রাদিফ পরে সকলেই তাকাল সুফিয়া খানের দিকে। সুফিয়া খানকে দেখে অতি আবেগ ভালোবাসা দেখিয়ে শশীর মা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরতে চাইলে সুফিয়া খান হাতের ইশারায় বাধা দিয়ে সামনে হাঁটালো। উপস্থিত সবাইকে এরিয়ে মুখোমুখি হলো ডক্টরের সঙ্গে। ডক্টর রাশেদ সবেমাত্র ওটি থেকে বেড়িয়ে ছিল সবার সঙ্গে কথা বলবে বলে। কিন্তু তার আগেই মুখোমুখি হলো সুফিয়া খান। ডক্টর রাশেদ কিছু বলবে তার আগেই অস্থির উত্তেজিত ব্যাকুলতায় প্রশ্ন করলো সুফিয়া খান…

‘ ডক্টর আমার ছেলের কি অবস্থা? ওকে দেখতে পারবো একটু?
সুফিয়া খানের সম্পর্কে বেশ ধারণা ছিল না ডক্টর রাশেদের। তিনি মন্ত্রী নিহাল খানকে চিনলেও উনার বউ হিসাবে সুফিয়া খানকে চিনেন না। আর না কখনো দেখেছে। ডক্টর রাশেদ সুফিয়া খানের কথার উত্তর করলো না মেয়ে মানুষ বলে তিনি সরাসরি কোনো পুরুষের সাথে কথা বলতে চাই। বিশেষ করে রিদের বাবা নিহাল খানের সঙ্গে। সেজন্য তিনি আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে নিহাল খানের খোঁজ করলো রিদের কন্ডিশন জানাতে। পেয়েও গেল নিচে ফ্লোরে বসা নিরুপায় বিধস্ত নিহাল খানকে। ডক্টর রাশেদ সুফিয়া খানকে এরিয়ে নিহাল খানের দিকে ঘুরে বলতে চাইল…
‘ স্যার পেশেন্টের কন্ডিশন স্টেবল না। প্রচুর র*ক্ত*পাত হয়েছে মাথা থেকে…

ডক্টর রাশেদ বাকি কথা শেষ করার আগেই সুফিয়া খান অস্থির উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডক্টরের উদ্দেশ্য বলল….
‘ আমাকে বলুন যা বলার ডক্টর। পেশেন্টের অবস্থান সম্পর্কে আমাকে জানান। আমি গার্ডিয়ান পেশেন্টের।
সুফিয়া খানকে না চিনায় এবারও ডক্টর রাশেদ সুফিয়া খানকে অপেক্ষা করে পুনরায় ঘুরে গেল নিহাল খানের দিকে। যেখানে স্বয়ং মন্ত্রী নিহাল খান দাঁড়িয়ে আছে সেখানে অন্য কারও সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না ডক্টর রাশেদ। ততক্ষণে নিহাল খানও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল ডক্টরের সঙ্গে কথা বলতে। উনার চোখ মুখ ফুলে আছে অতিরিক্ত কান্নায়। উপস্থিত সকলের চোখে নোনাপানি। ডক্টর রাশেদ নিহাল খানের উদ্দেশ্য আবারও বলতে চাইল…
‘ স্যার পে….
ডক্টর রাশেদ বাকি কথা শেষ করার আগেই শক্ত হাতে উনার কর্লার চেপে ধরলো সুফিয়া খান। গর্জে উঠার মতোন রাগে তিরতির মেজাজে বলল…

‘ আমাকে চোখে পরে না? আমি কথা বলছি কানে যায় না? কই টাকার ডাক্তার তুই? আমাকে উপেক্ষা করিস। সাহস দেখাস? আমাকে চিনিস?
সুফিয়া খানকে ক্ষেপে যেতে দেখে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে আসল রাদিফ, আসিফ আর হেনা খান। আসিফ সুফিয়া খান কে টাচ্ না করলেও রাদিফ নিজের মাকে শান্ত করার জন্য হাত টানলো পরিস্থিতি সামাল দিতে। ভাঙ্গা গলায় ডক্টর রাশেদের উদ্দেশ্যে বলল….
‘ উনি আমাদের মা ডক্টর। যা বলার আম্মুকে বলুন। আমরা শুনব।
সুফিয়া খানের বগল থাবাই যতটা না ভয় পেয়েছিল এখন আসল পরিচয় পেয়ে ভিতরকার ভয়টা আরও বেড়ে গেল ডক্টর রাশেদের। তিনি এবার সুফিয়া খানকে বলতে লাগল…

‘ আসলে পেশেন্টের মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে। মাথার বাম পাশটা পুরো থেঁতলে যাওয়ার কারণে পেশেন্টের মস্তিষ্কের রক্ত উঠে গেছে যার জন্য পেশেন্টের লাইফ চান্স ১০%। এতো রিস্কের মধ্যে ট্রিটমেন্ট করা আমাদের ধারণা সম্ভব নয়। আমরা ঢাকা ট্রান্সফার করালেও সেখানেও সেইম কথাটাই বলবে। বলতে পারেন পেশেন্টের কন্ডিশন অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশ কোথাও সম্ভব নয় এই মূহুর্তে। বাংলাদেশের ডক্টর পারবে না পেশেন্টের মাথার সেনসেটিভ পার্টে সার্জারী সঠিকভাবে করতে। আমরা….

ডক্টর রাশেদের কথায় শেষ না হতেই পুনরায় তেতে উঠলো সুফিয়া খান। তাঁরা যদি সঠিক ট্রিটমেন্ট করতে না পারে তাহলে এতক্ষণ পযন্ত তাদের কাছে পেশেন্টটা আটকিয়ে রাখল কেনো এই হসপিটালে? এতে পেশেন্টের চিকিৎসার অভাবে লাইফ চান্স কমছে না প্রতিনিয়ত? তেতে উঠা সুফিয়া বেগম পুনরায় নিজের মেজাজ হারিয়ে একই ভাবে কর্লার চেপে ধরলো ডক্টর রাশেদের। রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলল….
‘ কিছু করতে না পারলে আমার ছেলেকে এতক্ষণ কেন রেখেছেন হসপিটালের মধ্যে ? আমার ছেলের কিছু হলে এর দ্বায়ভার কে নিবে? আপনি? বলেন আপনি?

সুফিয়া খান নিজের অতিরিক্ত রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আবারও বলল….
‘ আমার ছেলের যদি কিছু হয় তোর মতোন শত ডাক্তারের ঠিকানা আমি একাই লাগাবো ডক্টর।
করিডোরে ভিড়ে জমে থাকা অসংখ্য মানুষ গুলো হঠাৎ কেমন নিশ্চুপ আর ভয়ে চুপ হয়ে গেলো সুফিয়া খানের তেজ দেখে। উপস্থিত সকলেই কেমন অবাক চোখে তাকালো সুফিয়া খানের দিকে। সকলেই জানতো রিদ খানের মা আছেন কিন্তু তিনি কে? বা কেমন সেটা কেউ জানতো না। আর যারা জানে সুফিয়া খানের সম্পর্কে তাঁরা সকলেই চুপ। নিহাল খানের সঙ্গে উনার দলের লোকসহ থানার ওসি, এসআই বেশ কিছু পোষাকদারি পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। সুফিয়া খানের রাগ দেখে তারাও বোকার মতোন তাকিয়ে আছে। মেয়ে মানুষের এতো রাগ হতে পারে সেটা জানা ছিল না কারোও। এ যেনো রিদের প্রতিচ্ছবি যেটা আজ দেখলো। নিহাল খান নিজের বউয়ের সম্পর্কে ধারণা থাকায় তিনি উত্তেজিত পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসতে চাইল সুফিয়া খানের দিকে। আজ বিগত পনেরো বছরের মনমালিন্যতা পিছনে ফেলে প্রথমবারের মতোন নিজের বউয়ের মুখোমুখি হতে চেয়ে কথা বলতে চাইল। সুফিয়া খানকে বাঁধা দিয়ে এগিয়ে এসে বলতে চাইল…

‘ তুমি প্লিজ শান্ত হও সুফ….
নিহাল খানের বাকিটা শেষ করার আগেই ঠাস করে থাপ্পড় পরলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাদিফের গালে। এই পরিস্থিতিতে মায়ের হাতের থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াল বাবার দিকে তাকিয়ে। রাগে কটমট করছে সুফিয়া খান। রাদিফকে মারতে দেখে হাই হাই করে উঠলো হেনা খান। আরাফ খান এই হসপিটালেই এডমিট। তিনি অসুস্থ হয়ে পরেছেন রিদের খবর শুনে। বয়স্ক মানুষ হওয়ায় রিদের এক্সিডেন্টের খবর শুনে অতিরিক্ত কান্নার ফলে জ্ঞান হারিয়ে একই হসপিটালের অন্য কেবিনে শুয়ে আছে। নিহাল খান রাদিফকে মারতে দেখে তিনি সুফিয়া খানকে আবারও বাঁধা দিয়ে বলতে চাইল…
‘ ওকে কেন মারছো? ওহ….

পুনরায় ঠাস শব্দে রাদিফের অপর গালে থাপ্পড় পরলো সুফিয়া খানের। নিশ্চুপ পরিস্থিতি আরও নিশ্চুপ হয়ে গেল পরপর দুটো থাপ্পড়ের শব্দে। নিহাল খান বুঝতে পারলো রাদিফের গালে পড়া থাপ্পড় দুটো রাদিফের গালে নয় বরং অদৃশ্য ভাবে উনার গালে মেরেছে সুফিয়া খান। কারণ রিদের আজ এই পরিস্থিতির জন্য উনার বউ সরাসরি উনাকেই দ্বায়ী করছে সেজন্য উনার রাগটা রাদিফের উপর দিয়ে যাচ্ছে এখন। রাদিফ পরপর দু’গালে হাত দিয়ে অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে, রাদিফের অসহায় দৃষ্টি বলছে, বাবা তুমি এই মূহুর্তে চুপ থাকো প্লিজ। নিহাল খান চুপ করে গেলেও হেনা খান সুফিয়া খানের হাত টেনে নিজের দিকে ফেরাতে ফেরাতে বলল….
‘ কি করছো তুমি সুফিয়া? সবাই দেখছে তোমাকে। এটা হসপিটাল বাড়ি নয়।
হেনা খানের কথায় তৎক্ষনাৎ সুফিয়া খান রাগে তেতে উঠে বলল…

‘ আপনার ছেলের জন্য আজ আমার ছেলের এই অবস্থা হয়েছে মা। আজ যদি আমার ছেলের কিছু হয় আপনার ছেলের জন্য তাহলে আমি আপনার ছেলেকে ছাড়বো না মা। পনেরো বছর আগে যে কারণে আপনার ছেলেকে আমি ছেড়েছিলাম আজ ঠিক একই কারণে আমার ছেলে মরতে বসেছে। আজ আপনি কি বলবেন?
সুফিয়া খানের কথায় নরম হয়ে আসল হেনা খানের সুর। তিনি বলল…
‘ নিহাল কি ওর ছেলের ক্ষতি করবে সুফিয়া?
‘ দোষ গুণ জানি না মা। আমার ছেলের কিছু হলে আমি আপনার ছেলেকে ছাড়বো না। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব।
কথাটা বলতে বলতে তিনি তৎক্ষনাৎ তেজি স্বরে ডাকল আয়নকে….
‘ আয়ন। আয়ন!
ওটি থেকে কয়েক সেকেন্ড মধ্যে বেড়িয়ে আসল আয়ন। গায়ে ওটির পোষাক। মুখে মাক্স খুলে সুফিয়া খানের মুখোমুখি হতে হতে নরম গলায় বলল…

‘ জ্বি মামী।
‘ কি করতে হবে বলো? কোন দেশে নিতে হবে আমার ছেলেকে। ১০ % কেনো? ১% চান্স হলেও আমি ছেলেকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে আনব ইনশাআল্লাহ। দ্রুত বলো কোথায় নিতে হবে বাকিটা আমি সামলে নিবো। আমি আমার ছেলের সুস্থ্যতা নিশ্চিত করতে চাই।এ্যাট এনি কস্ট।
‘ মামী রিদের কন্ডিশন স্টেবল না। এই অবস্থায় ওকে আগে চব্বিশ ঘণ্টা ট্রিটমেন্টের মধ্যে রাখতে হবে নয়তো বিপদে পরে যাবো আমরা।
‘ তাহলে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ডাক্তারসহ নিয়ে নাও আয়ন। কোন দেশে নিতে হবে বলো। আমরা এখান থেকে রিদকে ট্রিটমেন্ট দিতে দিতে নিয়ে যাবো বাহিরে। সময় কম দ্রুত বলো কোন দেশ ভালো হবে।

‘ ডক্টররা সিঙ্গাপুর কথা বলছে। তবে আমার মনে হয় লন্ডনে গেলে রিদের ট্রিটমেন্টের জন্য বেস্ট হবে। সেখানে আমাদের পরিবারের সবাইও আছে। হসপিটাল থেকে শুরু করে ডক্টরদের সঙ্গে আমার রিদের রাদিফের তিনজনেরই পরিচিত ভালো আছে।
সবটা সহজে সামলে নেওয়া যাবে।চিকিৎসার জন্য উত্তম হবে।
‘ ওকে ডান। আসিফ!
সুফিয়া খান ডাকতেই তৎক্ষনাৎ উত্তর আসলো আসিফের…

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৩

‘ জ্বি ম্যাডাম।
‘ ইমার্জেন্সি এয়ারলাইনসের জন্য যা যা করা লাগে সব ঠিক কর। দরকার হলে পুরো ফ্লাইংজেট বুকিং কর। আজ রাতের মধ্যেও লন্ডন যেতে চাই।
‘ জ্বি ম্যাডাম সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৪ (২)