রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৯
রিক্তা ইসলাম মায়া
‘ রিদ ফিরেছে?
‘ না ম্যাডাম।
ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক ড্রয়িংরুমের বড় ঘুড়িটায় সময় দেখে সুফিয়া খান। রাত প্রায় বারোটা ঘরে। মায়া খোঁজ এখনো পাইনি নাকি? উনার জানামতে রিদ তার বউকে আনতে গিয়েছিল আশুগঞ্জ। বিকাল থেকে এতোটা সময় লাগবে দুজনের ফিরতে? নাকি কোনো সমস্যা হলো?
‘ কফি দাও।
‘ জ্বি ম্যাডাম!
সার্ভেন্ট সম্মতি জানিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। চিন্তিত সুফিয়া খান গম্ভীর মুখে সোফার দিকে এগিয়ে গেল। হাতের মুঠোফোনটায় রিদকে কল লাগাল। ওপাশ থেকে রিদের ফোন অফ বলাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে আবারও দেয়াল ঘুড়িটাতে সময় দেখে নিলো। রিদের কল কেটে মূহুর্তে কল মিলাল আসিফকে। পরপর বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরও যখন আসিফের কলটা রিসিভ হলো না তাতে মূহুর্তে কপাল কুঁচকে আসে সুফিয়া খানের। উনার ছেলের শরীর ভালো না। অসুস্থ শরীর নিয়ে ত্যাড়ামী করে কাল রাতের ফ্লাইটে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরেছিল রিদ। সকালে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেই নাকি বউয়ের খোঁজে সারাদিন পার করলো সে। অবশ্য উনিও সারাদিন রিদের খবর নিতে পারেন নি। কারণ উনার ফ্লাইট ছিল আজ তাই ছেলের খবর নিতে হয়েছিল বাংলাদেশে ফিরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তিনি নিজের বাসায় না গিয়ে রিদের বাসায় উঠেছেন কিন্তু এখানে এসে জানতে পারে রিদ নাকি সকাল থেকে মায়ার খোজ করে সন্ধ্যার দিকে লোক নিয়ে বেড়িয়ে যায় মায়াকে আনতে। ছেলে ছেলের বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে সেটা ভালো কথা কিন্তু কেউ উনার ফোন ধরছে না কেন? সুফিয়া খান চিন্তিত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। হাতের ফোনটা টি-টেবিলের উপর রেখে বসতে কয়েক মিনিটের মধ্যে সার্ভেন্ট কফি দিয়ে গেলে তিনি তাতে চুমুক বসান। আপাতত কয়েকদিন তিনি রিদের সঙ্গে থাকবে এই বাড়িতে। যতদিন রিদের মেডিসিন চলবে ততদিন এখান থেকেই তিনি কোর্টে যাবেন। তাছাড়া উনার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের চট্টগ্রামের যাওয়া দরকার। কিছু হিসাব নিকাশ বাকি আছে কারও সাথে। সুফিয়া খানের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝেই তপ্ত আগুনের মতোন দাউদাউ করে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো রিদ। কোনো দিক না তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে অগ্নিশিয়ার নেয় চলে যেতে দেখে সুফিয়া খানের চোখে পরলো রিদকে। তিনি হাতের কফিটা রাখতে রাখতে তৎক্ষনাৎ রিদের পিছনে তাকাল মায়ার সন্ধানে। কিন্তু আশেপাশে মায়াকে কোথাও দেখতে না পেয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রিদের পিছন ডেকে মায়ার সন্ধান করে বলল….
‘ তুমি একা কেন? মায়া কোথায় রিদ?
মায়া নামটা কানে যেতেই রিদের কদম দুই সেকেন্ডের জন্য থামে। দুহাত মুষ্টি বদ্ধ করে আবারও চলে যেতে নিলে একই ভাবে রিদের পিছন ডাকল সুফিয়া খান…
‘ রিদ! তোমাকে কিছু বলছি আমি। একা কেন তুমি? মায়া কই?
মায়ের কথায় হিংস্রত্ব রক্তিম চোখে রিদ ঘুরে তাকাতেই আতংকে উঠল সুফিয়া খান। রিদের চোখে মুখে শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্তের ছিটা। কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। রিদের মাথায় পরপর দুটো সার্জারী হয়েছে সবেমাত্র। বেশকিছু অস্ত্র পাচার করা হয়েছে তাতে। এই অবস্থায় রিদের মাথায় পুনরায় আঘাত পাওয়া মানে রিদের কন্ডিশন খারাপের দিকে যাওয়া। আল্লাহ না করুক যদি দ্বিতীয় বার কোনো কারণে রিদের ব্রেইনে রক্ত ক্ষরণ হয় তাহলে রিদকে বাঁচানো মুসকিল হয়ে যাবে। তিনি রিদের সাদা পাঞ্জাবিটা রক্তের ছিটায় রক্তিম হয়ে যেতে দেখে আতংকিত গলায় বললেন….
‘ তোমার এই অবস্থা কেন রিদ? কি হয়েছে? মায়া কোথায়?
সুফিয়া খানের কথা শেষ হতে হতে রিদ মূহুর্তে সিঁড়ি গোঁড়ায় থাকা ফ্লাওয়ার প্যাশনটা দু’হাতে মাথার উপর তুলে আছাড় মারতে মারতে চিৎকার করে বলল….
‘ এই বেঈমান নারীর নাম আমার সামনে নিবা না কেউ। আই হেড হার! আই জাস্ট হেড হার।
বলতে বলতে রিদ জেদ্দে তোপে সিঁড়ি গোঁড়ার অপর পাশের টপটাও ছুড়ে মারলো। মূহুর্তের মাঝে ভেঙ্গে ছিটকে গেল ড্রয়িংরুমে জুড়ে। রিদের তোলপাড়ে আসিফসহ বেশ কয়েকজন দৌড়ে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলো। সুফিয়া খান কেমন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। উত্তেজিত পরিস্থিতিতে তিনি রিদের কাছে যাচ্ছে না। কারণ এই মূহুর্তে রিদকে থামানোর চেষ্টা করা মানে রাগের বশে রিদকে আরও হাইপার করে দেওয়া, যেটা মোটেও রিদের জন্য ভালো হবে না। ছেলের রাগ সম্পর্কে উনার ধারণা আছে। তবে এই পরিস্থিতিতে রিদের রাগটা রিদকে ক্ষতি করছে। সুফিয়া খান জায়গায় পাথর মূর্তি নেয় দাঁড়িয়ে থাকতে আসিফ দৌড়ে রিদকে আটকাতে চাইলে মূহুর্তে হাতের ইশারায় নিষেধ করেন তিনি। আসিফ কাচুমাচু করল রিদের তোলপাড় ভাঙচুর দেখতে, সুফিয়া খান রিদের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় আসিফকে আদেশ করে বলল….
‘ আসিফ গাড়ি বের করো। কুইক!
আসিফ দৌড়ে বাহির দিকে যেতেই রিদ কয়েক মিনিটের মাঝে গোছানো পরিপাটি সুন্দর ড্রয়িংরুমটাতে ভাঙচুরের তোলপাড় বয়ে দিল। ফ্লোরের কাঁচ ভাঙ্গার টুকরো নেয় রিদের মন মস্তিষ্ক দুটোই বিখন্ডিত হয়ে গেল। সারারাতের ফ্লাইট, তারপর সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি, সন্ধ্যায় মায়ার বিয়ে নিয়ে হাঙ্গামা আর এখনকার ভাঙচুরের দখল রিদের শরীর আর নিতে পারলো না। নিস্তেজ শরীরের কেমন দূর্বল হয়ে পরলো। সারাদিন পেটে কিছু পরেনি সেই সাথে চিকিৎসারত মেডিসিনও নেওয়া হলো না। অস্থির উত্তেজিত রিদের নাক কান বেয়ে র’ক্ত ঝরলো। চোখের পাতা বুঝে আসলেও সে শক্তি খাটিয়ে ভাঙচুর করতে চাইলো। সুফিয়া খান দৌড়ে রিদকে ঝাপটে ধরেন। মায়ের বক্ষ পেয়ে রিদের হাতের লাঠিটা ফ্লোরে গড়িয়ে পরল। জ্ঞান হারানোর আগে মাথা ছেড়ে সুফিয়া খানের কাধে লুটিয়ে পরতে পরতে বিরবির করে বলল….
‘ রিত তো আমার ছিল আম্মু তাহলে অন্য কারও কেন হলো। আই হেড হার। আই হেড হার। আমার ওকে আর চাই না। চাই না।
রিদের গড়িয়ে পড়া নাকের র’ক্তে সুফিয়ার কাঁধ ভিজে উঠলো। রিদের শক্তপোক্ত শরীরের ভার সুফিয়া খানের উপর ছেড়ে দিতেই তিনি রিদকে সামলাতে হিমসিম খেলো। তাল সামলাতে না পেরে রিদকে নিয়ে ফ্লোরে কাঁচের উপর পরতে নিলেই বাসার সার্ভেন্টরা দৌড়ে আসে এলোমেলো ভাবে রিদসহ সুফিয়াকে ধরলো। দু’হাতে তখনো রিদকে ঝাপটে জড়িয়ে সুফিয়া খান। বুঝতে পারেন ছেলের মন ভালো নেই। কিছু একটা হয়েছে যার জন্য উনার শক্তপোক্ত ছেলেটাকে মানসিক ভাবে ভেঙে দিয়েছেন। উনার শক্ত চেহারায় আবারও অশ্রু জড়াল। রিদকে ধরাধরি করে রাতের আধারের তৎক্ষনাৎ নেওয়া হলো হসপিটালে। রিদকে আইসিওতে রেখে অক্সিজেন মাক্স পড়াল। ইউরোপীয়ান ডক্টরের সাথে কনফারেন্স কলে থেকে টিটমেন্ট দিল। টানা পয়তাল্লিশ দিন কোমায় থাকার পর রিদের জ্ঞান ফিরেছিল সবেমাত্র তিনদিন আগে।
এই অবস্থায় রিদ মানসিক চাপ নেওয়া মানে নিজের জীবন ঝুঁকিতে রাখা। ডাক্তার রিদের বেইন শান্ত রাখার জন্য ঘুমের ইনজেকশন পুশ করলো। ডক্টরা সুফিয়া খানকে জানায় রিদকে কয়েকদিন ঘুমের মধ্যে রাখতে হবে তাতে রিদের মস্তিষ্ক শান্ত থাকবে নয়তো পেশেন্ট অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। সুফিয়া খান নিরব সম্মতিতে ডক্টরদের কথা মেনে নেন। উনি ছেলের ভালো চাই। উনার ছেলেটা সুস্থ হোক তাতেই হবে। রিদের আইসিওর বাহিরে চেয়ারে মাথা ঝুঁকে বসে ছিলেন সুফিয়া খান। রাত তখন দেড়টার ঘরে। আসিফ নিজের হাতের ফোনটা সুফিয়া খানের দিকে এগিয়ে দিতেই মাথা তুলে তাকান তিনি। ফোনের দিকে তাকাতেই আসিফ ছোট গলায় বলে…
‘ গুলশান থানার ওসি ফোন করেছে ম্যাডাম।
অসময়ে পুলিশের চক্রে বিরক্তির প্রকাশ করেন সুফিয়া খান। বিরক্তি গলায় বলল…
‘ কি চাই?
সুফিয়া খানের বিরক্তি কাচুমাচু করেন আসিফ। রিদের মা সঙ্গে তার কমই উঠা-বসা। কেমন রাগী আর জেদ্দি মানুষ এই মহিলা। দৃষ্টিও কেমন বাজপাখি নেয়। কথা বলেও কেমন তীক্ষ্ণ।
‘ আপনার সাথে কথা বলতে চাই। জুরুরি ছিল একটু।
বিরক্তি তৎক্ষনাৎ উত্তর আসলো সুফিয়া খানের….
‘ নট নাউ! পরে কথা বলবো! রেখে দাও।
আসিফ সুফিয়া খানকে পুনরায় ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল….
‘ একটা ঝামেলা হয়েছে ম্যাডাম। রিদ ভাইয়ের নামে কে*স ফাইল হয়েছে তিনটা। ওসি বলেছে, নারীর নির্যাতন মামলা, গাড়ি ভাঙচুরসহ দশলাখ টাকার গহনা-পাতি চু*রি নিয়ে মোট ষাটলাখ টাকার ম*মলা করেছে, সাথে মা*র্ডার কেসও আছে একটা। তিনটা মা*মলা নাকি আশুগঞ্জ থানা থেকে গুলশান থানায় ট্রান্সফার হয়েছে এই রাতে। সেজন্য ওসি সাহেব আমাদের কল করে বিষয়টা জানাচ্ছেন। রিদ ভাইতো অসুস্থ। আপনি যদি দেখতেন বিষয়টা।
আসিফের কথায় কেমন তেতে উঠলো সুফিয়া খান। একটা পর একটা ঝামেলা উনার ছেলের পিছনও ছাড়ছে না। উনার ছেলেটাকেও সুস্থ হতে দিচ্ছে না। এখন আবার উঠকো ঝামেলা।
‘ শালার বেড়ারা মরার আর জায়গা পেল না। ভাবছিলাম হাত নষ্ট করবো না। আমারে মাঠে না নামাইলে কারও শান্তি নাই। দে ফোন দে!
কথা গুলো বলতে বলতে আসিফের হাত থেকে ফোনটা এক প্রকার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো করে কানে তুলল তিনি। থানার ওসিকে কিছু বলতে না দিতে সুফিয়া খান বললেন….
‘ শুনেন ওসি সাহেব আপনার কাছে রিদ খান নামে কোনো মা*মলায় আসে নাই এখনো পযন্ত। বাকিটা কি করতে হবে সেটা আপনি ভালো জানেন। বুদ্ধিমান লোককে কিছু বলতে হয়না আশা করছি।
ফোনের ওপাশ থেকে ওসি সাহেবের গমগমে উত্তরের বলল…
‘ জ্বি মিসেস খান বুঝতে পেরেছি কিছু বলতে হবে না। আসলে আপনি না বললেও আমরা এই মা*মলা গুলো হাতে নিতাম না। দোয়া করবেন তাতেই হবে। রিদ খানকে সালাম দিবেন আমার। রাখছি।
কল কেটে যাওয়ার আগেই সুফিয়া খান ওসির উদ্দেশ্য বলল…
‘ শুনেন ওসি সাহেব। ফোন রাখলে হবে না আপনার কাজ শেষ হয়নি। আসলে আমার ছেলেটা একটু অসুস্থ। আর অসুস্থ ছেলেটা আমার ইমোশন। এখন কেউ যদি আমার ইমোশন নিইয়া টানাটানি করে তাহলে সেটা আমার মোটেও ভালো লাগবে না। আপনি এক কাজ করেন আশুগঞ্জ থানার নাম্বারটা আমাকে সেন্ট করেন। সেই সাথে থানায় ফোন করে জানাবেন মা*মলাদায় করা বাধি জনাব জামাল শওকত চেয়ারম্যান একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। তাঁকে যেন থানায় আটকে রাখা হয়। আসলে আমি উনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। বুঝেছেন?
সুফিয়া খানের কথায় তৎক্ষনাৎ সম্মতি জানান ফোনের ওপাশের থাকা ওসি সাহেব….
‘ জ্বি ম্যাডাম হয়ে যাবে।
‘ ধন্যবাদ ওসি। তবে আপনার খেয়ালও রাখা হবে চিন্তা করবেন না। আমার লোক যাবে আপনাকে খেদমতে।
ওপাশের ওসি সাহেব খুশিতে উৎফুল্লতা দেখিয়ে বললেন….
‘ আপনার দোয়াই আছি ম্যাডাম।
কল কেটে যেতেই আসিফের হাতে ফোনটা তুলে দিতে দিতে সুফিয়া খান কপাল কুঁচকে তাকান আসিফের দিকে। কিছু একটা ভেবে বললেন…
‘ তুই আমার সাথে যাবি নাকি হসপিটালের থাকবি রিদের সঙ্গে? কোনটা?
আসিফ সুফিয়া খানের কথায় দ্বি মনা করে বলল…
‘ আমি আপনার সাথে যায় ম্যাডাম? রাদিফ ভাইতো বলেছেন তিনি আসছে রিদ ভাইয়ের সঙ্গে রাত্রে থাকবে এখানে। আপনার হয়তো আমাকে প্রয়োজন পরতে পারে।
সুফিয়া খান হাতে ফোনটা আসিফের দিয়ে বলল….
‘ তোর আরও বড় হতে হবে আসিফ। অল্প বেইনে রিদকে কিভাবে হ্যান্ডেল করিস? যায়হোক তোর প্রয়োজন আপাতত আমার ছেলে অবধি থাক। সকালে দেখা হবে। খেয়াল রাখিস। আসছি।
সুফিয়া খানকে হসপিটালের করিডোর ধরে চলে যেতে দেখেই আসিফ সেদিকে কেমন হতভম্ব হয়ে তাকায়। রিদ ভাইয়ের মা তার কাছে সাধারণ কোনো নারী মনে হয় না। উনার চালচলন, কথাবার্তা, শান্ত মস্তিষ্কের ডিসিশনে যেকোনো মানুষকে মে*রে ফেলার ক্ষমতাও রাখেন তিনি। ছেলের নামে মা*মলা গুলো কেমন মূহুর্তে দামাচাপা দিয়ে দিল তিনি, উল্টো মা*মলাদায়ি করা বাধি চেয়ারম্যানকেও ফাঁসিয়ে দিল মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল বলে। এরা মা-ছেলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। এদের পিছনে থেকে মাঝেমধ্যে আসিফের রুহ কেঁপে উঠে এদের কর্মকাণ্ডে। আল্লাহ জানে এবার চেয়ারম্যান পরিবারের কি হয়। সুফিয়া খান আশুগঞ্জ যাওয়ার মানে চেয়ারম্যান পরিবারের কপালে শনি লটকানো।
রাত সাড়ে তিনটার ঘরে। অন্ধকার রাতে সাদা গাড়িটি এসে থামলো আশুগঞ্জ থানার সামনে। তাড়াহুড়ো ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা টেনে ধরতেই গাড়ি থেকে বের হন পরিপাটি সুন্দর সুফিয়া খান। বয়স্ক ডাইভারের হাইটে সুফিয়া খানকেই লম্বা দেখাল। তিনি আশেপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোজা হাঁটল থানার ভিতরের দিকে। ডাইভার শব্দ করে গাড়ির দরজা আটকাতেই সুফিয়া খানের পিছন পিছন আরও দুজন লোক হাঁটল সেদিকে। একজন সুফিয়া খানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট তারেক। বয়স রিদের পাশাপাশিই হবে। তবে হাল্কা-পাতলা ছেলেটি খুবই মেধাবী। প্রফেশনাল উকিল হলেও গোপনে সে একজন দক্ষ হ্যাকার। হাতের চালানে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তারেক নামক ছেলেটিকে আপাতত সবাই সুফিয়া খানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসাবেই চিনে সবাই। এই মূহুর্তে চোখে মোটা চশমা পড়ে হাতে মোটা ফাইল গুলো নিয়ে সেও সুফিয়া খানের পিছন পিছন যাচ্ছে পুলিশ স্টেশনের ভিতর। অপর পাশে আর্মির মেজর নওয়াজ হাসান। মধ্য রাতে তিনজন পুলিশ স্টেশন প্রবেশ করতেই থানার পুলিশ এগিয়ে আসেন সেদিকে। সুফিয়া খানের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের করার মাঝে সুফিয়া খানের চোখে পড়েন চেয়ারের বসা চেয়ারম্যান সাহেবকে। সুফিয়া খান সবাইকে এরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যান। পাশের চেয়ারটা টেনে জামাল চেয়ারম্যানের মুখোমুখি বসতে বসতে হেয়ালি করে বলেন….
‘ আরে চেয়ারম্যান সাহেব যে? কেমন আছেন আপনি? আপনার টানে আশুগঞ্জ অবধি চলে আসলাম। তা ভালো আছেন আপনি? সব ঠিকঠাক?
সুফিয়া খানের হেয়ালি কথায় কেমন তেতে উঠলো জামাল সাহেব। তিনি এসেছিল উনার ছেলে আর ছেলের বউকে মারার দায়ে মামলা করতে কিন্তু এখানে আসার পর উল্টো উনাকে আটকে রেখেছে ক্রিমিনাল বলে। উনি বুঝতে পারছে এই মহিলার কথায় উনাকে আর উনার লোকদের এতো রাত অবধি থানায় আটকে রাখা হয়েছে। ঐদিকে উনার অসুস্থ ছেলেটা জীবন মৃত্যু মুখে পরে লড়াই করছে উনি সেখানেও যেতে পারছে না এই মহিলার জন্য। আর এখানে এসে এই মহিলা উনার সাথে হেয়ালি করছে? জামাল সাহেব তেতে উঠে বললেন…
‘ আমাকে আটকে রাখলে ভেবেছেন আমি ভয় পাবো? আপনার গুন্ডা ছেলেকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বো আমি।
জামাল সাহেব কথায় সুফিয়া গা ছেড়ে চেয়ারে বসতে বসতে পায়ের উপর পা তুলল। হেয়ালি করে বলল…
‘ কি চেয়ারম্যান সাহেব? এটা কেমন কথা? আমি আপনার সাথে কথা বলছি আর আপনি আমার ছেলেকে টানছেন। দিস ইজ নট ডান। মা এসেছে তার সাথে কথা বলুন না, শুধু শুধু এসবে ছেলেকে কেন টানছেন?
সুফিয়া খানের হেয়ালি কথা গুলো যেন জামাল সাহেবকে উত্তেজিত করছেন বারবার। তিনি রেগে চিল্লিয়ে বললেন….
‘ কারণ আপনার ছেলে একটা গুন্ডা সন্ত্রাসী তাই।
সুফিয়া খান আগের নেয় হেয়ালি করে বলল…
‘ আপনি আমার ছেলের বউকে নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন আর আমার ছেলে গুন্ডামী করলেই দোষ? ধরেন আপনার বউকে যদি আমার স্বামী বিয়ে করতে চাই তাহলে আপনি কি করবেন? আপনা..
সুফিয়া খানের কথা শেষ হওয়ার আগেই জামাল সাহেব চেতে উঠে চিৎকার করে বলল…
‘ আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।
জামাল সাহেবকে উত্তেজিত হয়ে যেতে দেখে দারুণ হাসলো সুফিয়া খান। হেয়ালি করে বলল…
‘ আপনার বুড়ো রক্ত এতো গরম হলে আমার ছেলের জোয়ান রক্ত কতটা গরম হওয়ার দরকার চেয়ারম্যান সাহেব? আপনি বুইড়া বয়সে বউয়ের ভাগ বসাতে চান না তাহলে আমার জোয়ান ছেলে কেমনে পারবে? আচ্ছা ধরেন, আপনার ভালো ছেলেটা যদি হঠাৎ করে হসপিটাল থেকে ঘায়েব হয়ে যায় তাহলে এতো ভালো মানুষি দিয়ে কি করবেন? শুনেন চেয়ারম্যান সাহেব জীবনে কিছু সময় গুন্ডা হওয়া খারাপ কিছু না। আপনাকে একটা কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। বারবার রিপিট করবো না কিন্তু। একবারই মনোযোগ দিবেন কেম…
সুফিয়া খানকে শেষ করতে না দিয়ে থানার মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুরু করলো জামাল চেয়ারম্যান। তিনি টাকার দাপট দেখাতে লাগল সুফিয়া খানের সামনে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে থাকিয়ে শান্ত থাকলেন সুফিয়া খান। চেয়ারম্যান সাহেব বলতে লাগলেন….
‘ আপনাদের মতোন মানুষদের আমার চেনা আছে। বারো বছর ধরে চেয়ারম্যানি করছি আমি, আপনাদের মতো দুই চারটে টাকা ওয়ালা মানুষকে উড়াই দিবার মতোন ক্ষমতা আমিও রাখি। মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মতোন থাকেন অথযা একটা পুরুষের সাথে কুলাতে পারবেন না। আপনাকে ছেলেকে তো আমি ছেলের ভাত খাইয়েই ছাড়ব।
চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় তিনি কেমন সুন্দর হাসলো যেন মজার কিছু শুনতে পেয়েছেন তিনি। পা নামিয়ে তিনি কনস্টেবল এগিয়ে দেয়া চা কাপটি হাতে তুলতে তুলতে বলল…
‘ আপনি আমার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াবেন ভালো কথা। কিন্তু তার জন্য তো আপনাকে আগে একটা কেস ফাইল করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আপনি কোনো কে*স না করে কাউকে জেলে ভাত খাওয়াতে পারবেন না এটা আইনে নেই। তাছাড়া আপনাকে তো থানায় আটকে রাখা হয়েছে ড্রাগস মা*মলার দায়ে। আপনি নাকি নারী পাচার করেন? দেশের নাবালক স্টুডেন্টের হাতে ড্রাগ সাপ্লাই করেন? আপনার আর আপনার ছেলের নামে নাকি ১৫৬টি এটেম টু মা*র্ডার কে*স ফাইল পাওয়া গেছে? শুনলাম আপনি নাকি এলাকায় দূর্নীতি করে চেয়ারম্যান হইছেন? সত্যি? আপনাকে এতো ভালো মানুষ মনে করেছিলাম আমি অথচ শেষ পযন্ত আপনি আর আপনার ছেলেরা সন্ত্রাসীর গডফাদার বের হয়েছেন। এই করে বেড়ান বুঝি এলাকায়? ছোটবড় ১৫৬টা মা*মলা ফাইল খোঁজে পাওয়া গেছে আপনাদের নামে। সব ফ্লেভারের মামলাই আছে দেখি। ছিঃ ছিঃ এসব করে বেড়ান আপনারা?
সুফিয়া খানের কথায় কেমন হতভম্ব আর হতবাক হয়ে যায় জামাল সাহেব। উনার জীবনে কোনো মামলা নেই। উনার পরিবার যথেষ্ট ভালো আর রক্ষণশীল পরিবার। সেখানে এতোগুলো মামলা আসবে কোথায় থেকে? জামাল সাহেবের বুঝতে দেরি নেই এসব যে সুফিয়া খানের কারসাজি। তিনি রেগেমেগে চেয়ারে বসা অবস্থায় টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে চেতে উঠে বলল….
‘ আপনি মিথ্যা মামলা কাহিনি সাজাচ্ছেন আমার পরিবারের নামে। মনে করছেন আমি ভয় পাবো আপনার কথায়? আপনার যা খুশি করেন আমিও এর শেষ দেখে ছাড়ব।
চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় হাতের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবারও আগের নেয় সুফিয়া খান বলল….
‘ আপনার এই মনে হলো আমি আপনাকে মিথ্যা বলবো? আমাকে আপনার এতো ছোট মস্তিষ্কের মনে হয়? তারেক! চেয়ারম্যান সাহেবকে উনার বিরুদ্ধে মামলা অভিযোগ গুলোর কাগজ দেখাত।
কথা গুলো বলতে বলতে তৎক্ষনাৎ তারেক নামক ছেলেটি হাতের ফাইল থেকে কিছু কাগজ বের করে সামনে রাখতে সেগুলো হাতে নেয় চেয়ারম্যান সাহেব। সাজানো গুছানো প্রত্যেকটা মা*মলাই উনার আর উনার ছেলেরদের বিরুদ্ধে করা। দপদপ করা জ্বলতে থাকা চেয়ারম্যান সাহেব হঠাৎ কেমন ভয়ে চুপ করে যায়। সুফিয়া খান সেদিকে তাকিয়ে হাতের চা-টা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে চেয়ারম্যান সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল…
‘ শুনেন চেয়ারম্যান সাহেব। এলাকায় চেয়ারম্যানি করছেন তো মানুষের সেবা পযন্ত সীমাবদ্ধ থাকুন। শুধু শুধু আমার ছেলে পযন্ত কি টানছেন। আমার ছেলে আপনার বাজেটের বাইরে। ছেলেটা অসুস্থ বলে মা এসেছি। ভাবুন মা যদি এতটুকু পযন্ত আসে তাহলে ছেলের বাবাও তো আসবে তাই না? আপনি আমাকে সামাল দিতে পারবেন না, বাবা-ছেলে অবধি যাবেন তো দূর। আমি যাওয়ার পর আমার স্বামী আসবে আপনি এতো চাপ নিতে পারবেন না। সেজন্য বলছি আমাদের থেকে দূরে থাকুন। শুনেন চেয়ারম্যান সাহেব ছোট মানুষের উপর ক্ষমতা প্রভাব দেখানোটা আমার পছন্দ না। ক্ষমতা খেলা জমে সমানে সমানে। তারপরও আপনার ভালোর জন্য একটা ড্যামো দেয়। আপনি আমার ছেলের নামে মা*মলা দিলে আমি আপনাকে রোজ একটা করে নতুন নতুন মা*মলায় ঠুকবো। আপনার হিসাবে খাতা ভুল হয়ে যাবে, টাকা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমার মা*মলা করা শেষ হবে না।
আপনি যদি মনে করেন পালিয়ে বাঁচবেন তাহলে বলে রাখি আপনি আর আপনার ছেলে দুটোকে মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী বানিয়ে পেপার চাপিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা থানায় অভিযোগ দেওয়া হবে। এরপর যদি মনে করেন আপনারা দেশ ছেড়ে পালাবেন তাহলেও বলে রাখি এয়ারপোর্ট আমার বাপের রাজ্যত্ব চলে আপনাদের পালানোর পথ বন্ধ। ছেলের আমেরিকার ভিসা দিয়ে কি করবেন? যদি ছেলেটাই না বাঁচে? আমার ছেলেটা অনেক দিন অসুস্থতা পর বাংলাদেশে ফিরেছি বউয়ের টানে। সেই বউকে নাকি আপনার ছেলে বিয়ে করে নিলো। স্বামীর জীবিত অবস্থায় বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ে করা জায়েজ না। আইনগত দিক থেকেও অপরাধ। আপনি কয়টা মা*মলা সামলাবেন? কার কার কাছে যাবেন? আপনি যার কাছেই যান না কেন সে আমারই লোক হবে। তারপরও আপনার সান্ত্বনা জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারে। তারপরও একটু চোখ ঘুরিয়ে দেখেন, আপনার এলাকায়, আপনার থানায়, আপনার পুলিশের সামনে বসে যদি আমাকে পিষে ফেলার ক্ষমতা রাখি তাহলে ভাবুন এরপরও যদি আপনি আমার ছেলের পিছনে লাগেন তাহলে কি করবো?
দীর্ঘ কথা বলে সুফিয়া খান থামেন। চেয়ারম্যান সাহেবের কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে এই শীতের রাতেও। সুফিয়া খান টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা জামাল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে শান্ত কন্ঠে বললেন….
‘ দেখেন চেয়ারম্যান সাহেব আমি এই পলিটিক্স পলিটিক্স খেলতে চাইনি। আমার সন্তানের জন্য নামতে হয়েছে এই মাঠে। আসলে আমার মুখ থেকে ব্রেইন চলে বেশি সেজন্য এসব নোংরামিতে হাত নষ্ট করতে চাইনি বলে অনেক বছর আগেই নিজের ব্রেইন খরচ করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আসলে আমি বিশ্বাস করি যেখানে মন ইনভেস্ট হয় সেখানে ব্রেইন ইউস করা চলে না। সেজন্য আপনাকেও বলছি
এরপরও যদি আপনার মনে হয় আপনি আমার ছেলেকে টানবেন? তাহলে আমি আপনার বংশ ধরে টানবো। আশা করছি আপনি এবার বুঝতে পারছেন। এবার বাসায় যান নিজের ছেলের যত্ন নেন। ভালো থাকুন। যান।
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৫৮
কথা গুলো বলতে বলতে সুফিয়া খান উঠে দাঁড়ান। উনার আশুগঞ্জে আরও একটা কাজ বাকি সেটাই করতে হবে। তারপর সকাল হতে হতে আবার ছেলের কাছে ফিরতে হবে। কাল আবার একটু চট্টগ্রামেও যাবে। এই মাঠ পুরাতন। কিন্তু খেলার মানুষ গুলো নতুন। কেন যেন তিনি এসব মানুষের উপর ক্ষমতা দেখিয়ে মজা পাচ্ছে না। হয়তো সমানে সমান কাউকে পাচ্ছেন না বলে।