হামিংবার্ড পর্ব ১২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
” বলার সুযোগ পেলে তো বলবে, মা? এমন আগুন সুন্দরী ভাবি পেয়ে, ভাইয়া আর ডানে-বামে না তাকিয়েই তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেড়ে ফেলেছে। তাই না ভাইয়া?”
অরা মৃদু হাসল। আরিশের দৃষ্টি আটকে আছে অরার চোখে। সেই দৃষ্টিতেই আটকে থেকেও সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তালহার দিকে। অরার বুক ধকধক করতে লাগল । অরা ভয় পাচ্ছে। এই লোক কি তালহাকে কিছু বলবে? আতংকে অরার চোখমুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তালহার সামনে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল আরিশ।
“একদম ঠিক বলেছিস, তালহা। তোর ভাবিকে হারিয়ে ফেরার রিস্ক নিইনি!”
“হেহে! জানতাম!”
“গুড বয়। আজ থেকে অরাকে ‘ভাবি’ না, ‘ভাবি মা’ বলে ডাকবি তুই।”
“ভাবি মা? এটা আবার কেমন ডাক!”
তালহা অবাক চোখে অরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। অরা গলা একটু খাদে নামিয়ে শান্তভাবে বলল,
“জানি না… উনিই জানেন।”
এইবার আরিশ তালহার থুতনি ধরে মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরাল,
“আমার দিকে দেখ ব্যাটা! আমি বলছি—আমার বউয়ের দিকে কম কম দেখবি। বড়ো ভাবি মানেই মায়ের সমান। তাই ভাবি মা। ঠিক আছে?”
তালহা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে একটু দুঃখী মুখে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি যা বলবে তাই ঠিক। বউ তোমার, কথাও তোমার। আমরা সিঙ্গেল মানুষ… আমাদের আর কী আছে জীবনে!”
তালহার কথায় তামান্না খিক করে হেসে উঠল। অরাও মিটিমিটি হেসে ফেলল। যাক! যে ভয়টা অরা পাচ্ছিল, তেমন কিছুই হলো না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এনিওয়ে, চাচি, সাবিহা—তোমরা নিজেদের ঘরে যাও। লং জার্নি করেছ, রেস্ট নাও। ডিনারে দেখা হবে।”
সাবিহা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে গা টান টান হয়ে আছে মেয়েটার, কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। তাসলিমা খাতুন হালকা হেসে বললেন,
“ঠিক আছে।”
“চলুন, আপনাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দিই।”
সাবিহা আর তাসলিমা তামান্নার পেছন পেছন হাঁটা শুরু করল। যাবার আগে তালহা দাঁড়িয়ে হেসে বলল,
“ভাবি মা, রুমে গেলাম। রাতে জমিয়ে আড্ডা হবে, কেমন?”
আরিশ তখনও সংযত চোখে চুপচাপ অরার দিকে তাকিয়ে আছে। তালহার কথায় অরা কিছু না বলে শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। এরপর তালহাও নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল—পেছনে ফেলে গেল একটা ভরাট অথচ নিরব মুহূর্ত।
রাত অনেক গভীর। গোটা শহর ঘুমের আবরণে ঢেকে গেছে—নিঃসাড়, নিস্তব্ধ। আকাশের চাঁদ নেই আজ, কেবল ঘন কালো মেঘের দল ছেঁকে আছে চারদিক। আবহাওয়া অধিদপ্তর সতর্ক করেছে—কালবৈশাখীর সম্ভাবনা প্রবল। সারাদিনের তীব্র রোদের তাপদহনে গোটা শহর হাসফাস করছে । এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষায় গোটা শহর ও শহরের মানুষজন।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত শহর দেখছে আকাশ। চোখে ঘুম নেই তার। ঘুম হারিয়ে গেছে ছেলেটার। নিজের ভালোবাসার নারী অন্য কারো বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে ভাবতে গেলেই আকাশের ঘুম উড়ে যায়। এই ভাবনাটাই আকাশকে ভিতর থেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেয়। বুকের ভেতর কেমন অসহ্য এক শূন্যতা—যন্ত্রণার মতো নয়, আগুনের মতো—নীরব অথচ সবকিছু ছারখার করে দেয়। হাউমাউ করে কাঁদে। সময় গেলে সাধন হয় না। কেনো যে অরাকে মনের কথা বলতে এতটা দেরি করে ফেলল, সেই আফসোস আজীবন থেকে যাবে আকাশের।
এই শহরে আকাশের মতো হাজারো প্রেমিক আছে। যারা ঠিক এমন রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অথচ সেই নিশ্বাস কোনোদিন পৌঁছায় না প্রেমিকার কানে।
তারা শুধু হারায়—প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে।
ভালোবাসা পায় না, পায় কেবল স্মৃতির যন্ত্রণাদায়ক ছায়া।
মাঝরাতে পেটের ওপর প্রচণ্ড ভারী কিছু অনুভব করায় ঘুমন্ত অবস্থায় ছটফট করে উঠল অরা। সারা শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে—মাথা ঘোরাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, বাইরে শুরু হয়েছে ভয়ানক ঝড়। মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠছে যেন পুরো পৃথিবী। জানালার পর্দা ঝড়ো হাওয়ায় একটানা নড়ছে, সাথে সাথে বৃষ্টির হালকা ফোঁটা জানালার ফাঁক গলে ঘরে এসে পড়ছে।
তীব্র অস্বস্তি আর ভয়ের মধ্যে অরা অবশেষে চোখ মেলে তাকাল। আধো আঁধারে দেখতে পেল—একটা ছায়ামূর্তি তার বুকের ওপর বসে আছে, দু’পাশে পা ছড়িয়ে। মুহূর্তে নিঃশ্বাস আটকে গেল অরার। চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট কাঁপছে। ভয় যেন জমে বরফ হয়ে গেছে রক্তে। চিৎকার করতে যাচ্ছিল সে, ঠিক তখনই ছায়ামূর্তিটা হঠাৎই ঝুঁকে তার মুখ চেপে ধরল শক্ত করে। ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাতাস আটকে গেল। হিসহিসিয়ে কানে কানে বলল—
” দিস ইজ ইয়র হাজবেন্ড, হামিংবার্ড। ভয় পেও না। ”
অরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে এটা আরিশ, চোর-ডাকাত অন্তত নয়। আরিশ অরার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই অরা উত্তেজিত হয়ে শুধালো ,
” আপ..আপনি এটা কী করছিলেন? এভাবে কেউ গায়ের ওপর…..”
” ইশশশ! চুপপ! একদম চুপপ! ”
দুই গালে হাত রেখে বলল সে। আরিশের ফিসফিসে কণ্ঠে এক ধরনের গা ছমছমে অনুভব লুকিয়ে আছে। অরা সেটা স্পষ্টই টের পাচ্ছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে মেয়েটার, সত্যিই চুপ করে গেলো সে।
বিদ্যুৎ চকমকানোর আলোতে মাঝে মধ্যে ঘর আলোকিত হচ্ছে। অরা আরিশকে দেখছে, অর্ধনগ্ন অবস্থায় আছে সে। পরনে কেবল একটা হাফ প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো, কপালে পড়ে আছে। কপালে, বুকে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জলজল করছে। চোখমুখ কেমন লাগছে আরিশের। রেগে আছে না-কি শান্ত হয়ে আছে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ছোট্ট পাখিটা। কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছে।
” তালহাকে কেমন লাগে হামিংবার্ড? আমার থেকে বেশি চার্মিং? হ্যান্ডসাম? তুমি ওর দিকে ওভাবে হেসে তাকিয়েছিলে কেন, বলো তো? ”
আরিশের এমন কথায় বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো অরা। কী বলছে এই লোকটা? তালহা তো তার নিজের কাজিন! অরা এতটা অবাক হয়ে গেছে যে কী বলবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। অবশেষে, কিছু না বলে শুধু চুপ করে আরিশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন পুরো দৃশ্যটিই এক বিভ্রান্তি। আরিশ আবার বলল,
” কী হলো লিটল বার্ড? অ্যাংসার মি! কেনো তাকিয়ে ছিলে🫠,হুম? কই আমার দিকে তো কখনো মিটিমিটি হেসে তাকালে না! ”
” দেখুন আমি এমনি এমি হেসছিলাম কেবল। আপনারই তো আত্মাীয়! সেজন্য….. ”
আচমকা গলা চেপে ধরার ভঙ্গিতে গলায় হাত রাখল আরিশ। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে অরার।
” আমি বলেছি,আমার আত্মীয় স্বজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে হবে? বলিনি তো হামিংবার্ড। তাহলে কেন হাসলে? ”
” আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো….. ”
” ভুলের শাস্তি পেতে হবে তো। বিনা শাস্তিতে কাউকে ছেড়ে দিলে সে আবারও একই কাজ করে লিটল বার্ড। বুঝতে পেরেছ? ”
আরিশ কী করতে চলেছে? অরার শরীর কাঁপছে। বাইরের ঝড়ের থেকেও বড়ো ঝড় অরার মনে বইছে। এ তো বদ্ধ উন্মাদ! এই লোকের সাথে কিছুতেই থাকবে না অরা। মনে মনে নিজেকে এসব বলে শান্ত করতে চাচ্ছে সে। আরিশ মুচকি হাসল, ঠোঁটের কোণে তার রহস্য। অরার চোখ বড়সড় হয়ে গেছে। আরিশ ধীরে ধীরে অরার ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অরা ছটফট করতে করতে বলল,
” প্লিজ ক্ষমা করে দিন। আর করবোনা আমি, প্লিজ!”
” আই ওয়োন্ট হার্ট ইউ, হামিংবার্ড।শুধু সবকিছু অসহ্যকর করে তুলব তোমার কাছে। এটাই তোমার শাস্তি! ”
অরা ঠিক বুঝল না আরিশের কথা। আবারও জোর করে মিলন করবে সে? না-কি অন্য কিছু? অরার ভাবনার গতির চেয়েও আরিশের ক্ষিপ্রতা যেন বেশি। অরার কোমল ঠোঁট জোড়া আরিশ তার নিজের দখলে নিয়ে ফেলল। সে অরার দু’হাতে হাত রেখে সমস্ত শরীরের নড়াচড়াও বন্ধ করে দিয়েছে। আরিশের আগ্রাসী চুম্বন সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে অরার। ঠিকমতো নিঃশ্বাস না নিতে পারার ফলে দম বন্ধ হয়ে আসছে– এমন অনুভূত হচ্ছে । তবে ঠোঁটে ব্যথা পাচ্ছে না। এভাবে কতক্ষণ চলল অরা জানে না, বুঝতে পারছে না৷ যখন অরার চোখে জল ছলছল করে উঠল ঠিক তখুনি আরিশ তাকে মুক্ত করলো। ফাঁসির আসামি ছাড়া পেলে যেমন ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে অরাও তেমনভাবে হা করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আরিশ মুচকি হেসে অরার পাশে শুয়ে পড়ে, তাকে হাতের ওপর শুইয়ে দিলো। অরা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে ।
” আমি আমার কথা রেখেছি। ঠোঁটে কোনো ব্যথা দেইনি, কেটে যায়নি। শুধু…… ”
আরিশের হাসিটা বড্ড বিশ্রী, ভয়ংকর মনে হচ্ছে অরার। যেনো মানুষরূপী কোনো শয়তানের হাসি! আরিশ আবার বলতে লাগলো,
” শুধু কিস করেছি। এই ঠোঁট দিয়ে হেসেছিলে তখন? হুহ্। সেজন্য শাস্তিটা ঠোঁটের জন্য বরাদ্দ ছিলো। শান্ত হও হামিংবার্ড। একটা কিস ছিলো শুধু, আরকিছুই না। ”
অরা থরথর করে কাঁপছে। আরিশকে এক ফোটাও বিশ্বাস করে না সে। শুধু কিস করে থেমে থাকবে বলে মনে হয় না তার।
হামিংবার্ড পর্ব ১১
” মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি পাখি। ঘুমিয়ে যাও। কালকে শপিং করতে নিয়ে যাবো। সাবিহা কী বলল, শুনলে তো? তোমার সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলেছে সে। জবাবটা তো দিতে হবে! ”
অরার কানে অন্য কোনো কথা ঢুকছে না এখন। ছোট্ট পাখির মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে কেবল। শরীরে ক্লান্তি, মনে ভয়। সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে ফেলেছে সে।
” ঘুমাও হামিংবার্ড। ঘুমাও….. ”
অরা চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার ফলে একটা সময় পর আরিশের হাতের ওপরই ঘুমিয়ে পড়লো সে।