শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৬
ইনায়া রোজ
কয়েকদিন থেকে ভার্সিটি যাচ্ছেনা মেঘ। শরীর খারাপ থাকায় আপাতত ভার্সিটি যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই তার। আর তাছাড়া শ্রাবণ ভার্সিটি চলে গেলে শান্তি মত বাড়িতে থাকতে পারে সে। না হলে শ্রাবণের বা’চ্চা সারাদিন তাকে বডিগার্ডের মতো পাহারা দিতে থাকে। মেঘ বলেছিলো সে অসুস্থ তাই ভার্সিটি যাচ্ছে না এইজন্য আজ তাকে বাড়িতে দেখতে আসছে মেঘের একমাত্র প্রাণপ্রিয় বান্দবী রুহি।
শান্তিনিকেতনের সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালা মামার ভাড়া মিটিয়ে সবেমাত্র ঘরে প্রবেশ করে রুহি। তখনই রাহেলা বেগম এসে দাঁড়ায় সামনে। রুহি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রাহেলা বেগমকে।
– কেমন আছো আন্টি?
– ভালো আছি মা তুমি কেমন আছো?
– আমিও ভালো আছি। মেঘ কোথায় আন্টি?
– ওর ঘরেই আছে।
– ঠিক আছে আন্টি।
বলেই যেই না রুহি উল্টো করে যেতে যাবে তখনই আচমকা ধাক্কা লাগে মাহিদের সাথে। মাহিদ তাড়াহুড়ো করে কোথা থেকে জানি আসছিলো, তৎক্ষণাৎ সজোরে ধাক্কা লাগায় ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যায় রুহি। চোখ মুখ কুচকে কঁকিয়ে উঠে সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– সরি সরি আমি খেয়াল করিনি।
মাহিদের কথায় তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় রুহি। তেঁতিয়ে বলে উঠে,
– কানা নাকি চোখে দেখতে পান না?
– সরি বললাম তো, আশ্চর্য!
উঠে দাঁড়ায় রুহি। এবার আবারও কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠে,
– সরি বললেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় নাকি? কে আপনি যত্তসব!
রুহির কথায় ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায় মাহিদ।
– তুমি কে মেয়ে? এভাবে কথা কেনো বলছো আমার সাথে।
নিঃশ্বাস ছেড়ে তাচ্ছিল্য হেসে উঠে রুহি।
– হাহ্! আমি মেঘের বেস্ট ফ্রেন্ড, এই পরিবারের খুবই কাছের একজন। আর এটা আপনার বাবার বাড়ি না যে এভাবে কথা বলবেন আমার সাথে।
– আমার বাবারই বাড়ি এটা। মা বলে দাও এই ঝগড়াটে মেয়েটাকে।
বলেই হনহনিয়ে ঘরের ভিতরে চলে যায় মাহিদ। রুহি হেসে তাকায় রাহেলা বেগমের দিকে।
– পাগল নাকি এই লোক আন্টি? আপনাকে মা ডাকছেছেয়য়য়,,,,
হঠাৎই ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই তব্দা খেয়ে যায় রুহি। রাহেলা বেগম মুখ টিপে হেসে বলে ওঠে,
– ওর বাবারই বাড়ি এটা মা, যাও মেঘ উপরে তার ঘরে আছে।
রুহি যেন টুপ করে মহাশূন্য থেকে পড়ে গেলো। ভিষণ লজ্জা পেল সে। কাচুমাচু করতে করতে হত বুদ্ধির ন্যায় ভ্যাবলার মতো হেসে সে এক দৌড় দেয় মেঘে রুমের উদ্দেশ্যে।
খাটে আরামে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন চালাচ্ছে মেঘ। ফোন চালাচ্ছে বললে ভুল হবে আরামসে নিজের পছন্দের ড্রামা দেখে চলেছে সে। যখন সে বাড়িতে থাকে আর শ্রাবন থাকে না তখন যেন দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ মেঘ। না হলে নিজের ঘরেও চোরের মত চলাফেরা করতে হয় তাকে।
মেঘ বুঝতে পারেনা শ্রাবণ তার সাথে এমন কেন করে? একটা ঘটনার জন্য আজকে তাদের সম্পর্কের এই পরিণতি। না হলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। কিন্তু অন্যরকম হলেও বা কি হতো তাও তো শ্রাবণ তাকে সব সময় বকাঝকা আর মারের উপর রাখে।
তখনই আচমকা হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করে রুহি। রুহিকে এভাবে ঘরে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক হয় মেঘ।
লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে।
– কিরে রুহি কখন এলি তুই? আসবি আমাকে জানালি না কেন?
রুহি খাটে বসতে বসতে বসতে বলে উঠে,
– রাখ সেসব কথা আগে আমাকে এটা বল, তোর ধাম’ড়া ভাই যে বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে বললি না কেন? আমাকে বললে তো আজ এমন বিব্রতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত না।
– কেন কি হয়েছে?
এর পর একটু আগের ঘটনা মেঘকে খুলে বলে রুহি। রুহির কথা শুনে খাটে গড়িয়ে গড়িয়ে হাসতে শুরু করে মেঘ।
– মেঘের বাচ্চা তোর মুখ আমি ভে’ঙ্গে দিব। আমার করুন অবস্থার মজা নিচ্ছিস তুই।
বহু কষ্টে নিজের হাসি দমিয়ে সোজা হয়ে বসে মেঘ।
– যা হয়েছে ভুলে যা বনু। ভাব এই মুহূর্ত তোর জীবনে কখনো আসেনি দেখবি সব আবারো ঝাকানাকা।
এরপর আরো নানারকম কথা বলতে থাকে তারা দুজনে।
বিকেলবেলা,,
রাব্বি আহমেদ এর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা এসেছে। তারা ঢাকায় থাকে তাই মাহিদের আসার খবর শুনে বেড়াতে এসেছে। একই পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও দূরে থাকায় এখন তারা এই পরিবারের নিকট কুটুম স্বরূপ হয়ে গিয়েছে। তবে তাদের মধ্যেকার মিল এখনো অটুট।
রাব্বি আহমেদ এর স্ত্রী সুইটি বেগম। তাদের এক মেয়ে দুই ছেলে। বড় ছেলে আহিল আহমেদ অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মেয়ে আদিবা আহমেদ ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে বর্তমানে ভার্সিটির এডমিশন এর জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। আর তাদের ছোট ছেলে আরজ আহমেদ ক্লাস ফোরে পড়ে। পুরো আহামেদ পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হলো আরজ।
যেমন দুষ্টু তেমনই পাকা সে। তার কার্যকলাপ রীতিমতো সবাইকে আশ্চর্যের সাথে সাথে তব্দা খাইয়ে দেয়। তারা সকলে আসতেই যেন বাড়িতে এক হৈহুল্লোড় পড়ে যায়।
সোফায় এক কোণে বসে ফোন চালাচ্ছে শ্রেয়া। তখনই তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নেয় আহিল। তাকে দেখে একগাল হেসে শ্রেয়া বলে ওঠে,
– আরে আহিল ভাই যে কেমন আছো?
শ্রেয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আহিল। নিরেট কণ্ঠে বলে ওঠে,
– আগে যেমন ছিলাম তেমনি আছি, একেবারে জাআআলিমমমম,,,
শেষের কথাটা কিছুটা টেনে টেনে বলে আহিল। কথাটা শুনেই তৎক্ষণাৎ মাথার রক্ত চটে যায় শ্রেয়ার।
– হ’নুমানের বাচ্চা কখনো কি একটু সুন্দর করে কথা বলতে পারিস না।
– সুন্দর কথা আর তুই? ছ্যাহ্! নিজের চেহারা দেখেছিস?
– অবশ্যই দেখেছি এমন সুন্দর চেহারা দেখে নিশ্চয়ই ফিদা হয়ে গেছো তুমি।
– ওয়াক্ থুউউউ,, ফিদা হব তাও তোর উপর আল্লাহ মাফ করুক।
– আহিল ভাই এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।
– আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম, আল্লাহ এমন বিশ্রী শয়তান থেকে আমাকে রক্ষা করো।
আহিলের এমন কথা শুনতেই সোফায় থাকা একটা কুশন সজরে আহিলের মুখে ছুড়ে মেরে গটগট করে সেখান থেকে চলে যায় শ্রেয়া।
– ডা’ইনির বা’চ্চা তোর খবর আছে।
বলেই কুশনটা সোফায় ছুড়ে আহিলও গটগট করে হেঁটে চলে যায়।
হেলে দুলে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল মেঘ। হঠাৎই তার পা জোড়া থমকে যায় সামনে থাকা মানুষ দুটোকে দেখে। অতিশয় সুন্দরী এক রমণী পরনে গোলাপী কালার একটা চুড়িদার। দোতালায় অবস্থিত ছাদখোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে শ্রাবণের সাথে। এই সুন্দরী রমণী আর কেউই নয় তার ছোট চাচ্চুর মেয়ে আদিবা।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে শ্রাবন নিজেও দাঁত কেলিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে আদিবার সাথে। যা দেখে সহসাই আশ্চর্য হয় মেঘ। এই লোক হাসতেও জানে? জানতো না মেঘ। কখনো দেখেছে বলেও মনে পড়ছে না তার।
হঠাৎই মেঘের অন্তরে কেমন যেন চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল সে। কই তার সাথে তো কখনো এমন হেসে হেসে কথা বলেনি, উল্টো আরো উদোম ক্যালানি দেয় যখন তখন। আর এখন কি সুন্দর চকচকে দাঁতগুলো নিয়ে হেসে চলেছে। হঠাৎই মেঘের চোখ জোড়া কেমন যেন টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। অজানা ব্যথায় অন্তর যেন লাফিয়ে উঠছে তার।
নাহ্ আর এই দৃশ্য চাক্ষুষ অবলোকন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে না থেকে হনহনিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে নিজের রুমে চলে যায় মেঘ। গিয়েই ধরাম করে লাগিয়ে দেয় দরজার কপাট। মেঘের যাওয়ার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আবারো নিজের চিরাচরিত রূপে ফিরে আসে শ্রাবণ।
শ্রাবণ মেঘের রোদ্দুর পর্ব ৫
মুলত এতক্ষণ আদিবা তাকে এডমিশনের সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলো। কিন্তু মেঘ কে আসতে দেখেই শ্রাবণ ইচ্ছে করে আদিবার সাথে এমন হেসে হেসে কথা বলছিলো।