রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১
রিক্তা ইসলাম মায়া

থমকে যাওয়া ঘড়ির কাটার মতো যেন সকলের জীবনই থেমে আছে। ঘুরেফিরে একই কাহিনি রিপিট হচ্ছে সবার। মানুষ গুলো ভিন্ন ভিন্ন হলেও যেন সবার ব্যথা মিলে যাচ্ছে। পাওয়া না পাওয়ার গল্প থেকে বিচ্ছেদের সুর যেন বেশি। এইতো যেমন রিদ মায়াকে চাচ্ছে না। জুই আয়নকে চাচ্ছে না। এদিকে রাফা আসিফকে চাচ্ছে না। মুক্তা ফাহাদকে চাচ্ছে না। শশী রিদকে পাচ্ছে না। কেমন যেন একটা বিচ্ছেদের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে। আয়ন বিগত দু’দিন ধরেই জুইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। ফাহাদের সঙ্গে তার শশুর বাড়ি পযন্ত গিয়ে ঘুরে আসল।

না ফাহাদ মুক্তা কাছে ঠাই পেল আর না আয়ন জুইয়ের সাথে কথা বলতে পারলো। ফাহাদকে মুক্তার সঙ্গে দেখা করতে মায়ার পরিবার বাঁধা না দিলেও মুক্তা নিজেই আত্মসম্মান তাগিদে ফাহাদকে ফিরিয়ে দিল ফিরবে না বলে। আয়ন তো বেশ কয়েকবার সুযোগও পেয়েছিল জুইয়ের সঙ্গে কথা বলার কিন্তু জুই চোখ তুলে আয়নকে দেখলো না পযন্ত। দীর্ঘদিন পর দুজনের দেখা, আয়ন ভেবেছিল সে জুইয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে কিন্তু তার কিছুই হলো না। আয়ন জুইয়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে সেও সেদিন ফাহাদের সঙ্গে ফিরে এসেছিল খালি হাতে। তারপর থেকে সে রোজ জুইকে নিয়ম করে কল দেয় কিন্তু আপসোস রোজকার মতোই জুইয়ের নাম্বারটা আজও অফ দেখালো। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় হাতের ফোনটা পকেটে গুঁজে রাখতে রাখতে আয়ন রিদের বাড়িতে প্রবেশ করলো। মেইন দরজা খোলা পেয়ে সে আশেপাশে তাকাল। রাত তখন ৪ঃ০১।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গায়ে তার ফর্মাল পোশাক। ডাক্তারি অ্যাপ্রোনটা হাতের ভাজে নেওয়া। দশটা থেকে তার নাইট ডিউটি। এই অসময়ে রিদের বাসায় আয়নের আসার কথা না। রিদের মা সুফিয়া খান বাসায় নেই। তিনি আজ সকালেই চট্টগ্রামে গিয়েছেন কোনো একটা কাজে, বলেছিল মধ্যরাতের ভিতরে ফিরে আসবেন। সেজন্য উনার অবর্তমানে আয়নকে ফোন করে বলেছিল মায়ার রেগুলার চেক-আপ করে যেতে। মায়া আজ চারদিন ধরে রিদের বাসায় অথচ এই চারদিন রিদ চার পলকও বাসায় ফিরেনি। আর না মায়ার খোঁজ নিয়েছে। বলতে গেলে রিদ নিজ বাড়িতে ফিরে না মায়ার জন্য। এতোদিন সুফিয়া খান মায়ার খেয়াল রাখলেও আজ রিদের বাসায় রাফা একা মায়াকে সামলাচ্ছে বাসার সার্ভেন্টদের নিয়ে। সারাদিন রাদিফ বাসায় থাকলেও দুপুর করে সেও কাজে বেড়িয়েছে ইমার্জেন্সি বলে। আয়ন খালি ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে এগোল নিচে ঘরটায়। কাজের মেয়ে রুজিকে পানি দিতে বলে সুফিয়া খানের ঘরে সামনের দাঁড়াল সে। বন্ধ দরজায় নক করতে খানিকটা ইতস্তত বোধ করলো। খালি বাড়িতে, এভাবে সে দুটো মেয়ের ঘরে একা প্রবেশ করতে খানিকটা সংকোচ বোধও করলো। যদিও সে একজন প্রফেশনাল ডাক্তার, তারপরও খানিকটা ইতস্তত বোধ করে অল্প আওয়াজে দরজায় নক করতেই ঘরে ভিতরে হতে ভেসে আসলো রাফার কন্ঠ….

‘ দরজা খোলা আছে ভাইয়া। ভিতরে আসুন।
চাপিয়ে রাখা দরজাটা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করতে করতে দেখতে পেলে অল্প আলোয় মায়াকে কোলে শুয়ে বিছানায় বসে আছে রাফা। অসুস্থ মায়া রাফার কোলে মাথা রেখে গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে বটে ঘুমিয়ে। মায়ার চুল জুড়ে বিচরণ করছে রাফার দু’টো হাত। মায়ার অসময়ে বলতে গেলে একমাত্র রাফা ছাড়া কেউ ছিল না। না আজও কেউ আছে। সুফিয়া খানের মতোন শাশুড়ী ছিল বলে মায়া আজ স্বামীর বাড়িতে ঠায় পেয়েছে নয়তো মায়ার আপন বলতে স্বামী, ওর পরিবার কেউ ছিল না। আয়ন বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে ধীর স্বরে রাফা থেকে জানতে চাইল মায়ার কথা…
‘ এখন কেমন আছে মায়া? পরে আর কোনো সমস্যা হয়েছিল?
ইতস্তত রাফা মায়াকে বালিশে শুয়ে দিতে দিতে বলল…

‘ নাহ ভাইয়া! তবে গায়ে অনেক জ্বর ওর। দুপুরেও কিছু খাইনি। আমি অনেক চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারি নি কিছু। আন্টি বাসায় থাকলে উনার ভয়ে এতোদিন কিছু হলেও খেতো। আমার সাথে জেদ করে খেতে চাই না।
রাফার কথায় আয়ন মায়ার মস্তিষ্ক বরাবর দাঁড়াতে দাঁড়াতে চিন্তিত স্বরে বলল…
‘ কি বলো? ঔষধ না খেয়ে ঘুমিয়েছে ওহ?
‘ জ্বি!
আয়ন খানিকটা অধৈর্য্য গলায় শুধালো রাফাকে বলল….
‘ তুমি জানো না ওর ঔষধ গুলো কতো জরুরি?
তাহলে কেন খাওয়ালে না? এই মূহুর্তে মায়ার ঔষধ মিস করা মানে ওর মস্তিষ্কে উত্তেজিত করা।
আয়নের কথায় রাফা অপরাধী গলায় বলল….

‘ আমি অনেক চেষ্টা করছি ভাইয়া কিন্তু শেষ পযন্ত পেরে উঠেনি। আমি বাসার সার্ভেন্টদের নিয়ে মায়াকে জোর করে ঔষধ খাওয়াতে চেয়েছিলাম কিন্তু মায়া ভয় পেয়ে সবার উপর এটাসেটা ছুড়ে মারে। রুজিখালা কপালে আঘাত পেয়েছে। আমার হাতেও কামল। মায়া নিজেকেও আঘাত করেছে অনেক। ওর হাতটা দেখুন কালসিটে হয়ে গেছে বারবার একই জায়গায় কামড়াতে কামড়াতে। সেজন্য আমি ভয়ে পেয়ে গেছিলাম তাই ওকে আর জোর করি নাই। মায়া বাহিরের মানুষ দেখলে ভয় পাই ভাইয়া, তৎক্ষনাৎ অ্যাটাক করে বসে। সেজন্য ওকে নিয়ে আমি রুমে বসে আছি। দুপুর থেকে মায়ার গায়ের জ্বরটা বাড়ালে সুফিরা আন্টিকে কল করে জানায় সেটা। আন্টি আমাকে বলেছিল আপনাকে পাঠাবেন সেজন্য আপনার অপেক্ষা করছিলাম আমি।

রাফার কথায় আয়ন শান্ত চোখে মায়ার শুকনো মুখটা দিকে তাকাল। খুব সুন্দর আদলের মায়ার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে অসুস্থতায়। আজ মায়ার এই দূর্দশা পিছনে আয়ন নিজেও দায়ি। তারা সবাই মিলে একটা সুস্থ মেয়েকে একটু একটু করে মানসিক অশান্তিতে পাগল বানিয়েছে। একটা সুন্দর ফুলকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিয়েছে। তাদের ভুলের জন্য মায়া কি না হারিয়েছে? স্বামী, সংসার, এমনকি নিজের পরিবারকেও। সবকিছু হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন বিছানায় শুয়ে। এখন মায়া মানুষ দেখলে ভয় পাই অথচ যে মেয়েটা সারাক্ষণ মানুষের ভিড়ে থাকতে পছন্দ করতো সে আজ একা থাকে। সারাক্ষণ কথা বলা মেয়েটা হুট করেই কেমন চুপ হয়ে গেল। মায়ার চঞ্চলতা হারিয়ে, মায়াকে নিঃস্ব শূন্য করার পিছনে আয়নও একজন অপরাধী। তীব্র অপরাধ বোধে আয়নের বুকটাও কেমন চিন চিন ব্যথা করলো। খুব প্রিয় মানুষের অসহায়তা দেখে আয়নের বুকটাও কেমন হা হা করলো। আয়ন দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে হা করে নিশ্বাস টানতে চাইল কিন্তু বাতাসে মিশে মায়াময় গন্ধ। আয়নের আটকে থাকা নিশ্বাসটা আরও আঁটকে গেল। কম্পিত হাতটা কোনো রকম মায়ার উত্তপ্ত কাপলে রাখতে সেটা তৎক্ষনাৎ সরিয়ে নিলো। অস্থির উত্তেজিত গলায় বলল…

‘ মায়ার গায়ে ভিষণ জ্বর রাফা। শরীরের টেম্পারে ওর ব্রেইনে চাপ পরতে পারে। ওকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে আমি গাড়ি বের করছি তুমি ওকে রেডি করো।
কথাটা বলেই আয়ন কেমন দম বন্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইল। হা করে নিশ্বাস টানতে চাইল খোলা বাতাসে। মায়ার দূর্দশায় তার বুকে ব্যথা অনুভব করলো। ড্রয়িংরুম হতে বেড়িয়ে সোজা
গাড়িতে এসে বসল। হাতের অ্যাপ্রোনটা ঢিল মেরে পাশের সিটে ফেলে পরপর শার্টের দুটো বোতাম খোলে দুপাশে ছড়িয়ে দিল। আটকে রাখা নিশ্বাসটা টানতে চাইল। বুক ফুলিয়ে পরপর নিশ্বাস টেনে স্টিয়ারিং চেপে তাতে কপাল ঠেকাল তীব্র অপরাধ বোধে। আয়ন কখনো এতটা অপরাধ বোধে ভোগেনি আজ যতটা নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। আয়ন চাইলে রিদের অনুপস্থিতিতে সবকিছু ঠিক রাখতে পারতো। মায়ার খোঁজ করতে পারতো। কিন্তু সে করেনি। আসলে রিদ ঠিকই বলে, রিদ ছিল না বলে তার বউয়ের মর্যাদাও কেউ করেনি। সবাই রিদের উপস্থিতে তার বউয়ের মর্যাদা বাড়ায়, রিদের আড়ালে নয়। আজ সবার অবহেলায় মায়াকে হারাতে বসেছে। এইভাবে চলতে থাকলে মায়া মারা যাবে যেকোনো সময়। মায়াকে বাঁচানো মুসকিল হয়ে যাবে। মন্ত আয়ন সেইভাবেই কিছুক্ষণ বসে রইল। খানিকটা সময় পর স্টেয়ারিং থেকে মাথা উঠিয়ে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো গাড়ির ডেস্ক হতে। মেসেজ অপশনে রিদের নাম্বারে ছোট করে বার্তা লিখল….

‘ মায়াকে তোর বড্ড প্রয়োজন রিদ। প্লিজ চলে আয়। মেয়েটা মরে যাবে তোর অবহেলায়। ফিরে আয় প্লিজ।
মেসেজটি সেন্ট করে আয়ন খানিকটা সময় নিলো উত্তরের আশায় কিন্তু ফোনের ওপাশ হতে কোনো উত্তর না আশায় আয়ন পুনরায় একই ভাবে মেসেজ লিখল রিদের নাম্বারে…
‘ তোর বউ ভিষণ অসুস্থ রিদ। দ্রুত হসপিটালের নিতে হবে। স্বামী হিসাবে না পারিস অন্তত মানুষ হিসাবে দায়িত্ব পালন কর নয়তো মরে যেতে দে মায়াকে। আমি হসপিটালে অপেক্ষা করবো।

আয়ন রিদের নাম্বারে পরপর দুটো মেসেজ পাঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। আয়নের জানা নেই রিদ আয়নের মেসেজ গুলো পড়বে কি পড়বে না। সে মায়ার টানে বাড়িতে ফিরবে কি ফিরবে না। তবে আয়ন মায়াকে একা রেখেই হসপিটালে চলে গেল। আজ সেও দেখতে চাই মায়ার জন্য রিদের মনে কতোটা ঘৃণা জম্মেছে। ভালোবাসার মানুষকে চাইলেই ঘৃণা করা যায় না। মায়ার অসুস্থতার সম্পর্কে সব জানা রিদের। সব জেনেও যদি মায়ার থেকে রিদ মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আয়ন নিজে রিদের মা সঙ্গে কথা বলে মায়াকে আলাদা বাড়িতে রাখার জন্য। সবকিছুর আগে মায়ার সুস্থতা প্রয়োজন। রিদের আশেপাশে থাকলে মায়া সুস্থ হবে না। রিদের ঘৃণা, অবহেলা বরং মায়ার মানসিক চাপ বাড়াবে। আয়ন চলে গেল রাত আটটা। সেই আটটা থেকে নয়টা হলো, নয়টা থেকে দশটা গড়িয়ে ঘড়ির কাটা এগারোটায় পৌঁছাল। মায়ার শরীর আরও খারাপ হলো। গাঁয়ের জ্বর খিঁচনি দিয়ে শরীরে কম্পন ধরলো। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে মায়া আবারও প্যানিক অ্যাটাক করলো। অসহায় রাফার চিৎকার দেখার মতোন ছিল। খালি বাসায় অচেনা শহরে মায়াকে নিয়ে কোথায় যাবে সেই ভয়ে চিৎকার করতে লাগল মায়াকে জড়িয়ে। আয়ন মায়াকে হসপিটালে নিবে বলেও সে নিরুদ্দেশ।

রাফা বাসার সার্ভেন্টদের নিয়ে মায়াকে হসপিটালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বয়সে রাফা মায়ার সমবয়সী। সে নিজেও কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরেনি। অচেনা শহরে মায়াকে নিয়ে কোন পথে যাবে আয়নের হসপিটালের সেটাও জানে না। শুধু জানে মায়াকে এই মূহুর্তে হসপিটালে নিতে হবে। কোথায় কার কাছে গেলে সাহায্য পাবে তাও জানে না রাফা। রিদের ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে রাফা পরপর কল মিলাল সুফিয়া খানকে। তারপর রাদিফ, আয়ন তিনজনকে পরপর কল দিল রাফা। প্রথমবার সুফিয়া খান কল রিসিভ না করলেও রাফার আয়নকে কল দেওয়ার মধ্যেই সুফিয়া খান কল আসলো রাফার হাতের ফোনে।

রাফা তৎক্ষনাৎ সুফিয়া খানের কল রিসিভ করে অস্থির উত্তেজিত ভঙ্গিতে কাঁদতে কাঁদতে মায়ার কথা জানাতে জানাতে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো রিদ।রাফার চিল্লাচিল্লিতে শক্ত গম্ভীর রিদের পা থামে কাজের মহিলা রুজিনা গায়ে ঢলে পরা মায়ার দিকে তাকিয়ে। হাত-পা খিঁচে নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে মায়ার। ফর্সা মুখটা কালো হয়ে আছে মুখ দিয়ে ঝাঁঝ বের হয়ে। রিদ কেমন শক্ত হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল মায়ার দিকে তাকিয়ে। রিদের মুখ দেখে ভিতরকার অনূভুতি বলা দায়। রাফা কান্নাকাটি করে সুফিয়া খানকে সবটা বলতে বলতে চোখে পরলো মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিদের উপর। আশার আলো দেখার মতো তৎক্ষনাৎ ছুটে গেল সেদিকে। কল না কেটে দুহাতের মুঠোয় ফোনটি চেপে রিদের কাছে মিনতি করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল…

‘ ভাইয়া প্লিজ মায়াকে একটু হসপিটালে নিয়ে যান না প্লিজ। আপনার পায়ে ধরছি আমি, প্লিজ মায়াকে বাঁচান। ওহ অনেকক্ষণ ধরে এমন করছে। আমি একা এই শহরের কিছু চিনি না ওকে নিয়ে কোথায় যাব? প্লিজ আপনি ওকে বাঁচান ভাইয়া প্লিজ। মায়াতো আপনাকে ভালোবাসে। ওহ আপনার জন্য সু*ইসা*ইড পযন্ত করতে গিয়েছিল। প্লিজ ভাইয়া ওকে হসপিটালের নিয়ে যান । প্লিজ!
মায়ার সু*ইসা*ইডের কথাটা কানে যেতেই রিদ তাড়াক করে তাকাল রাফার দিকে। চোখ মুখ তখনো কেমন শক্ত আর কঠিন। রাফা বুঝতে পারলো না রিদের কঠিন দৃষ্টির কারণ। রাফা বারবার মায়াকে বাঁচানোর আকুতি মিনতি করছে রিদের কাছে। সেকেন্ডের মাঝে রিদ দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাহিরের দিকে চলে যেতে যেতে গম্ভীর মুখে রাফার উদ্দেশ্যে বলল…

‘ কাম উইথ মি!
রিদকে বাহিরের দিকে চলে যেতে দেখে রাফা দৌড়ে মায়ার দিকে এগিয়ে আসলো। কাজের মহিলা রুজিনাকে নিয়ে মায়াকে ধরাধরি করে বসাল হুইল চেয়ারে। রিদের অনুসরণ করে মায়াকে নিয়ে দ্রুত পৌঁছাল গাড়ি অবধি। রিদ গাড়িতেই বসা ছিল। আসিফকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। তবে রিদের গাড়ির দরজা খোলা পেয়ে রাফা রুজিনা বেগমকে নিয়ে মায়াকে নিয়ে বসল গাড়ির পিছনের সিটে। ওদের বসতেই রিদ তৎক্ষনাৎ গাড়ি টানলো খালি রাস্তায়। রাফা থেকে থেকে বেহুশ মায়াকে জড়িয়ে কাঁদছে। রিদের শক্ত মতিগতি তখনো বুঝার দায়। রাফা মায়াকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রিদের উদ্দেশ্যে বলল….
‘ আর কতক্ষণ লাগবে আমরা হসপিটালের পৌঁছাতে ভাইয়া?

রাফা কথা গুলো বলতে বলতে গাড়ির মিরর দিয়ে দূর রাস্তা দিকে তাকাল। ওরা কোথায় আছে কিছুই জানে না রাফা। দূর রাস্তা হতে দৃষ্টি সরাতে গিয়ে চোখ পড়ল গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরাতে থাকা রিদের কম্পিত হাতে দিকে। কেমন থরথর করে কাঁপছে স্টেয়ারিংয়ে থাকা রিদের দুটো হাত। অথচ রিদের মুখ ভঙ্গিমা কেমন শক্ত আর কঠিন করে রাখা। গাড়ির এসির মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রিদের কপালে। রাফা বুঝতে পারলো না রিদের অস্থির কম্পিত হাতে কারণ। রিদ কি অসুস্থ মায়ার মতোন নাকি তার অন্য কোনো ভয়? রাফার রিদকে দেখে মনে হলো না সে অসুস্থ। তারপরও রাফা রিদকে নিয়ে আর ঘাটাল না মায়ার চিন্তায়। দশ থেকে পনেরো মিনিটে মধ্যে রিদের গাড়িটি এসে থামল হসপিটালের সম্মুখে। রিদ শব্দ করে গাড়ির দরজা খোলে দাঁড়াল পাশে। হসপিটালের বাহিরে আগ থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল আয়ন নার্সদের নিয়ে। রিদের গাড়ি থামাতে আয়ন তৎক্ষনাৎ নার্সদের দিয়ে মায়াকে নামাল। নার্সদের সাহায্যে মায়াকে কেবিনেও দেওয়া হলো সঙ্গে সঙ্গেই। মায়ার চিকিৎসা চলল

মূহুর্তে। রাফা মায়ার কেবিনে বাহিরে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। রিদ এই পুরোটা সময় নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে তার ভূমিকা অদেখা মতোন। ঘন্টা দেড়েক সময় নিয়ে মায়াকে চিকিৎসা দিয়ে কেবিনে শুয়ানো হলে ডক্টর সাজিদার সঙ্গে বেড়িয়ে আসল আয়ন। আয়নের চোখ মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। রিদকে পেল মায়ার কেবিনের পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আয়ন দূর থেকে রিদের শান্ত ভঙ্গি দেখে ঠাহর করতে পারলো রিদের অশান্ত মনের তোলপাড়টা। রিদ হয়তো আশা করেনি মায়া সত্যি সত্যি এতোটা অসুস্থতা হবে। আয়ন রিদের মুখোমুখি হতে হতে ক্লান্তিময় হতাশার গলায় বলল….

‘ আমার সাথে কেবিন আয় তুই।
জায়গা ছেড়ে রিদকে নড়তে না দেখে আয়ন রিদের হাত টেনে মিনতি স্বরে বলল…
‘ মায়ার রিপোর্ট এসেছে। প্লিজ আমার সাথে আয় ভাই। ডক্টর সাজিদা কথা বলতে চাই মায়ার গার্ডিয়ানের সঙ্গে। তুই ছাড়া আপাতত মায়ার এখানে কেউ নেই। মামীও ঢাকা নেই। প্লিজ আয়।
আয়নের হাতটা ঝটকা মেরে ফেলে রিদ এগিয়ে গেল ডক্টর সাজিদার কেবিনে। কাউকে কিছু না বলে ঠাস করে বসে পরলো ডক্টর সাজিদার মুখোমুখি চেয়ারটায়। আয়ন রিদের পাশাপাশি চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল…
‘ আপনি বলুন ডক্টর সাজিদা। আমরা শুনছি।
মধ্য বয়স্কর ডক্টর সাজিদা সুফিয়া খানের অনুসন্ধান করে বলল….
‘ মিসেস সুফিয়া খান আসেননি ডক্টর আয়ন?
আয়ন স্বভাব স্বরুপ বলল…

‘ না ডক্টর! মামী ঢাকার বাহিরে আছেন কাল সকালে আসবেন, আপনি আমাদের বলুন।
ডক্টর সাজিদাকে মায়ার ব্যক্তিগত ডাক্তার হিসাবে রেখেছেন সুফিয়া খান। তাই তিনি মায়ার সকল রিপোর্ট সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত ছিল বলে ডক্টর সাজিদা আবারও আয়নের উদ্দেশ্য বলল…..
‘ দেখুন পেশেন্টের মানসিক ব্যাপারটা আগেই ক্লিয়ার করে বলেছিলাম মিসেস খানকে। তিনি বলেছিল পেশেন্টের যত্ন নিবেন। সেখানে পেশেন্ট আবারও প্যানিক অ্যাটাক করলো? সেজন্য বলছিলাম সুফিয়া খানের অনুপস্থিতিতে আমার পেশেন্টের ব্যক্তিগত গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন ডক্টর আয়ন আশা করছি আপনি বুঝতে পারছেন।
ডক্টর সাজিদার ঘুরেফিরে একই কথায় তৎক্ষনাৎ রেগে যায় রিদ। অধৈর্য্যের নেয় ডক্টর সাজিদার টেবিলে হঠাৎ থাপ্পড়িয়ে গর্জনে বলল…
‘ বালের ডক্টর আপনি আমার। সামনে বসে আছি চোখে পরছে আমাকে? ডিগ্রি অর্জন করছেন কিভাবে ভন্ডামী করে?
রিদের হঠাৎ গর্জনে ডক্টরসহ আয়নও ভয়ে চমকে উঠলো। আয়ন তৎক্ষনাৎ রিদকে থামাতে চেয়ে ডক্টর সাজিদাকে শুধিয়ে বলল…

‘ আপনি প্রশ্ন না করে রিপোর্ট বলুন প্লিজ। রিদ খান পেশেন্টের হাসবেন্ড হয়। আপনি বলুন।
ডক্টর সাজিদা থমথমে মুখে রিদের দিকে তাকাল। রিদ খানকে তিনি ভালো করেই চিনেন। এই শহরে প্রভাবশালীদের একজন। এদের ক্ষমতা আর দাপটের কথা শুনেছেন তিনি আগেই। তবে বিগত কয়েকদিন ধরে সচক্ষে সবটা দেখছেন তিনি। যেমন মা তেমন ছেলে। দুজনই অধৈর্য। তারপরও সুফিয়া খান যেমন তেমন উনাকে বুঝানো যায় কিন্তু উনার ছেলে রিদ খানতো আরও গরম। অধৈর্য মানুষ। ডক্টর সাজিদা থমথমে মুখে বলল…

‘দেখুন মিস্টার খান পেশেন্টের অবস্থা খুবই সূচনীয়। পেশেন্ট মানসিক ডিসঅর্ডারের রোগী। এতো ঔষধাদি মধ্যেও এতোদিন ধরে পেশেন্টের জ্বর কমছে না। বারবার প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। মানসিক চাপ বাড়ছে। পেশেন্ট হয়তো কোনো কিছু নিয়ে তীব্র ড্রিপশনে ভোগছে যার জন্য বারবার প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। আমার মনে হয় পেশেন্টের চারপাশে পরিবেশ ঠিক নেই। পেশেন্টকে সুস্থ করতে চাইলে আগে পেশেন্টকে একটা সুস্থ পরিবেশ দিন। যথাসম্ভব সবাই পেশেন্টের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। পেশেন্টকে হাসিখুশি রাখুন। ঔষধের চেয়ে পেশেন্টের পরিবেশ পরিবর্তন করা জরুরি তাহলে পেশেন্টের মস্তিষ্কে পড়া প্রভাব এমনই কমে আসবে।
নয়তো আমরা পেশেন্টকে খুব দ্রুত পাবনার ডক্টরের
কাছে সাজেস্ট কর…

ডক্টরের বাকি কথা শেষ করার আগেই রিদের হাত উঠে গেল টেবিল ভর্তি ফাইলে। এক থাবায় ঝরঝর করে টেবিলের সবকিছু ফেলে দিল ফ্লোরে। খালি টেবিলে থাবা মেরে ডক্টর সাজিদার উদ্দেশ্য চোখ মুখ শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল…
‘ ডাক্তারি শেখান আমারে? পাবনায় পাঠাবেন? ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে পাগল বানিয়ে পাবনায় সরকারি চিকিৎসা দিব আপনারে যাবেন?
রিদকে টেনে থামাতে চেয়ে আয়ন বলল…
‘ রিদ কি করছিস তুই। এখানে ডক্টর সাজিদা কি করেছে? উনিতো মায়ার বর্তমান পরিস্থিতি কথায় জানালো তোকে। আর তুই…
আয়নকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে দূরে সরাতে সরাতে রিদ খিটখিটে মেজাজে বলল…
‘ সর সামনে থেকে। বালের ডাক্তার তোরা আমার। সর!
রিদ কেবিন ছেড়ে বেড়িয়ে সোজা হাঁটল করিডোর ধরে। উদ্দেশ্য হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে যাওয়া। রিদকে চলে যেতে দেখে রাফা দৌড়ে আসল রিদের পিছনে। রিদের পিছন ডেকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রাফা…
‘ আপনার সাথে আমার কথা ছিল ভাইয়া। একটু শুনবেন প্লিজ?
রিদ থামল না। বরং রাফার কথা না শুনার মতো করে চলে যেতে নিলে রাফা পুনরায় রিদের পিছন ডেকে অধৈর্য গলায় বলল…

‘ আমি বেশ কয়েকদিন ধরে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম ভাইয়া। কিন্তু আপনি বাড়িতে আসে না বলে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। প্লিজ ভাইয়া আমার কথাটা অন্তত শুনুন। প্লিজ!
রিদ রাফাকে এরিয়ে অদেখার মতো করে চলে যেতে লাগলে রাফা ফের রিদের পিছন দৌড়িয়ে অস্থির উত্তেজিত গলায় খানিকটা উঁচু স্বরে বলল….
‘ আপনার অনুপস্থিতিতে মায়া সুইসাইড করতে গিয়েছিল ভাইয়া। সেদিন আমরা না থাকলে হয়তো মরে যেতো ওহ।
রাফার কথায় সঙ্গে সঙ্গে রিদের পা থামে কিন্তু রাফার দিকে ঘুরে তাকাল না রিদ। রাফা রিদকে দাঁড়াতে দেখে পরপর অস্থির গলায় বলল…

‘ মায়া আপনাকে অনেক ভালোবাসে ভাইয়া। আপনাকে ভালোবাসে বলেই আজ মায়া পাগল হয়ে বিছানায় পরে। প্লিজ ভাইয়া মায়াকে আর অবহেলা করবেন না। ওহ নির্দোষ। মায়া আপনার সাথে বেঈমানী করতে চাইনি ওকে দিয়ে এসব করানো হয়েছে। মায়ার বিয়েটা তো ছ….
রাফাকে বলতে না দিয়ে রিদ এক প্রকার জেদ করেই চলে গেল রাফার কথা না শুনে। শেষ পযন্ত রাফা কি বলতে চেয়েছিল সেটাও শুনলো না রিদ। রিদকে চলে যেতে দেখে রাফা আগ বাড়িয়ে আর কিছুই রিদকে জানাতে চাইল না। বরং উল্টো পায়ে হেঁটে মায়ার কেবিনে গেল। রাফা বুঝতে পারছে রিদ ইচ্ছা করেই মায়াকে এরিয়ে যাচ্ছে। হয়তো মায়াকে আর চাচ্ছে না বলে তাই।

রাত প্রায় ১ঃ৪৫ ঘরে। অন্ধকার কারাগারে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসা কেউ। মাথার উপর হলুদ আলোর লাইট ঝুলছে। সামনেই চৌদ্দ শিকলের জেল। সন্ধ্যার পথ থেকে লোকটা এখানে একইভাবে হাত পা বেঁধে বসিয়ে রেখেছে থানার পুলিশরা। বসে থাকতে থাকতে একটা সময় ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো চেয়ারে বসা লোকটা। হঠাৎই কোনো কিছুর টংটং শব্দ কানে যেতেই চেয়ারে বসা লোকটা ঘুমন্ত চোখ মেলে তাকাতে চাইলে ঘুমের তাড়নায় ঝাপসা চোখে দেখলো শিকলের তালা খোলছে বয়স্ক পুলিশ। লোকটার হেলিয়ে পড়া ঘাড়টা মূহুর্তে সোজা করতে করতে দেখল পুলিশ নয় বরং একজন ভদ্র মহিলা মাথা নুইয়ে জেলে প্রবেশ করছে। চেয়ারে বাঁধা লোকটার ঘুম তৎক্ষনাৎ ছুটে গেল। চোখ টেনে সামনে তাকাতে খুব পরিচিত একটা মুখ চোখে পরলো। লোকটার কপাল কুঁচকে আসে ভদ্র মহিলাটি কে তা স্বরণ করতে চাইলে মহিলাটি লোকটার দিকে এগিয়ে এসে চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসতে বসতে মাধুর্য হেঁসে কৌতুক করে বলল…

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬০

‘ কিরে জসিম? কি অবস্থা তোর? আগের মতোই হারিমি আছিস নাকি আরও লেভেল বাড়িয়ে উন্নতি করেছিস কোনটা? আমাকে তোর সামনে হাজির করেছিস মানে অবশ্যই তোর হারামির লেভেল বেড়েছে। শুনলাম আমাকে নাকি খুব মিস করছিলি তাই চলে আসলাম। নাইস টু মিট ইউ এগেইন দোস্ত।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬১ (২)