রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৩
রিক্তা ইসলাম মায়া
বুকে মধ্যে উষ্ণ তাপে ঘুম ভেঙে যায় সুফিয়া খানের। খুব নরম কিছু সিটিয়ে আছে উনার বুকে। সুফিয়া খান বন্ধ চোখের পাতা টেনে খোলতে খোলতে হাতড়াল বুকে সিটিয়া থাকা বস্তুটির উপর। হাতে লাগল কারও উষ্ণ উত্তপ্ত শরীর। অন্ধকার কক্ষে সুফিয়া খান ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল নিজের বক্ষে থাকা শরীরটার দিকে। বিড়াল ছানার নেয় সুফিয়া খানের বুকে গুঁজে ঘুমিয়ে মায়া। সুফিয়া খান মায়ার কপালে হাত রাখতে বুঝতে পারলো মায়ার শরীর পুরছে জ্বরে। তিনি তৎক্ষনাৎ হাত বাড়িয়ে অন্ধকার রুমে আলো জ্বালাল ল্যাম্পপোস্টে সুইচবোর্ড চেপে। উজ্জ্বল কক্ষে তিনি পুনরায় মায়ার গায়ে হাত বুলাল। রাতে ঘুমানোর সময়ও মায়ার শরীরে তাপমাত্রা ঠিক ছিল কিন্তু মধ্যরাত হতে হতে মায়ার গা কাঁপিয়ে জ্বর উঠার কারণটা তিনি বুঝল না।
বিগত দেড়মাসে উনার বেশ অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে মায়াকে স্বাভাবিক আনতে। যদিও মায়া পুরোপুরি সুস্থ নয় তারপরও সুফিয়া খানের সঙ্গ মায়ার বেশ পছন্দ। উনার কথা শুনেন। উনার মতো কাজও করে মায়া। বিগত একমাসে মায়ার প্যানিক অ্যাটাক হয়নি আর। জ্বরটাও তিনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। মায়ার খাবার-দাবার, ঘুম, মেডিসিন, পরিচর্যা, সবকিছু তিনিই দেখা শুনা করেন। উনার নিয়মতান্ত্রিক মধ্যে দিয়ে মায়ার অস্বাভাবিক মাত্রার জ্বর পুনরায় মায়াকে মানসিক চাপে ফেলতে পারে বলে চিন্তিত হলেন সুফিয়া খান। কপালে চিন্তিত ভাজ ফেলে উঠে বসতে বসতে মায়ার বাহু টেনে বালিশে শুয়াল। রিমোট চেপে এসির পাওয়ার বন্ধ করতে করতে মায়ার গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট জড়াল। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মায়ার মেডিসিন হতে জ্বর মাপার থার্মোমিটার নিতে। ড্রয়ার খোলে থার্মোমিটার নিয়ে মায়ার মুখে পুরতে তিনি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় নিয়ে অপেক্ষা করলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পুনরায় মায়া মুখ থেকে থার্মোমিটারটি বের করতে দেখল মায়ার গায়ের জ্বর ১০৪° ডিগ্রিতে। তিনি থার্মোমিটারটি হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল মায়ার দিকে। মায়ার জ্বরের কারণ খোঁজতে গিয়ে মনে পরলো সন্ধ্যারাতে কথা। ডাইভার হাশেমের লা*শের সঙ্গে রিদকে র*ক্তাক্ত অবস্থায় দেখে অতিরিক্ত ভয় থেকে জ্বর এসেছে মায়ার। মানসিক রোগীদের জন্য এসব খু*ন-খা*রাবি র*ক্ত দেখাটা ঠিক নয় তাঁরা অল্পতে উত্তেজিত হয়ে পরে। সেখানে মায়া র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় গোটা লা*শ দেখেছে রিদকে ছু*রি হাতে। মায়ার গায়ের জ্বর আসাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সুফিয়া খান ভয় পাচ্ছেন এই জ্বরে ঘোরে মায়ার না আবার প্যানিক অ্যাটাক করে বসে। তাহলে উনার বিগত দেড়মাসে মায়াকে খানিকটা সুস্থ করার চেষ্টাটা পুরোটায় বৃথা যাবে।
চিন্তিত সুফিয়া খান নিজের ফোন খোঁজল এইরাতে মায়াকে নিয়ে হসপিটালের যাবে বলে। বেড সাইটের টেবিল হতে নিজের ফোন উঠাতে উঠাতে খট করে শব্দ করলো দরজায়। এই রাতে উনার রুমে কে হতে পারে সেটা দেখতে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দরজা দিকে, দেখল রিদকে গম্ভীর মুখে উনার রুমে প্রবেশ করতে। রিদকে অসময়ে উনার রুমে দেখে কপাল কুঁচকে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াল ফোন হাতে নিয়ে। রিদের পিছন পিছন ডক্টর সাজিদাকেও দেখল কক্ষে প্রবেশ করতে। সুফিয়া খান বুঝল রিদের কাছে মায়ার অসুস্থতার খবর উনার আগেই পৌঁছিয়ে। মায়াতো আর যাবে না নিজের অসুস্থতা খবর জানাতে রিদকে তারমানে উনার ছেলে রিদ নিজে এসে দেখে গেছে মায়াকে। চিন্তিত সুফিয়া খানের কঁপালের ভাজ শিথিল হলো। হাতে ফোনটা জায়গায় রাখতে রাখতে দুহাত বুকে বেঁধে দাঁড়াল রিদের পরবর্তী পদক্ষেপ দেখতে। রিদ মায়ার শিরধারার কাছটায় দাঁড়াল বিছানা অপর পাশে। ডক্টর সাজিদা বেগম সুফিয়া খানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বসলো মায়ার পেট বরাবর। মায়ার কপালে হাত রেখে বলল….
‘ গায়ে তো অনেক জ্বর পেশেন্টের! এতো জ্বর হলো কিভাবে?
ডক্টর সাজিদা বেগমের কথায় সুফিয়া খান কিছু বলবে তার আগেই রিদ গম্ভীর গলায় বলল…
‘ ১০৪° ডিগ্রি আছে।
রিদের কথায় সুফিয়া খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল রিদের দিকে। উনার সন্দেহই ঠিক হলো। রিদের কাছে মায়ার জ্বরের ধারণা আছে তারমানে উনার ঘুমন্ত অবস্থায় রিদ এসেছিল এইকক্ষে। হয়তো তখনই মায়ার জ্বর মেপে ডক্টর সাজিদাকে এইরাতে ডেকে পাঠিয়েছেন। সুফিয়া খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিদের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলো। রিদের নিজের মায়ের দৃষ্টি অপেক্ষা করে তাকাল মায়ার জ্বরের ফ্যাকাসে মুখটার দিকে। ডক্টর সাজিদা বেগম সবে জ্বর মাপার থার্মোমিটারটা ব্যাগ থেকে বের করতে চেয়েছিল কিন্তু রিদকে মায়ার জ্বরের তাপমাত্রা বলে দিতে দেখে তিনি হাত গুটিয়ে মায়ার পার্লস রেট চেক করতে করতে বলল….
‘ পেশেন্ট তো এতোদিন ভালোই ছিল। রেগুলার চেক-আপ করাতে আসতো। আজ দুপুরেও তো দেখলাম মিসেস খানের সঙ্গে সুস্থসবল ঘুরাফেরা করছে। তাহলে রাত হতে হতে হঠাৎ এতো জ্বর উঠার কারণ কি?
ডক্টর সাজিদার কথায় সুফিয়া খান চুপ রইল। তিনি জানেন উনাকে কষ্ট করে কিছু বলতে হবে না যার বউ সেই বলবে কেন এতোটা জ্বর হলো তার বউয়ের। সুফিয়া খানের ভাবনা সত্যি ঘটিয়ে রিদ সত্যি সত্যি ডক্টর সাজিদাকে জানাল….
‘ অতিরিক্ত ভয় থেকে জ্বর উঠেছে। রাতে কোনো কারণে ভয় পেয়েছিল তারপর থেকে এই জ্বর।
রিদের কথায় ডক্টর সাজিদা বলল…
‘ আপনারা জানেন পেশেন্ট ভয় পাই এমন কিছু থেকে পেশেন্টকে দূরে রাখতে হবে। তারপরও কেন পেশেন্টকে এমন…
ডক্টর সাজিদা বেগমের কথা শেষ করার আগেই রিদ
শক্ত মেজাজে বলল…
‘ জ্ঞান না দিয়ে রোগী দেখুন। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। প্রশ্ন করবেন না। ট্রিটমেন্ট করুন।
রিদের কথায় ডক্টর সাজিদা বেগম থমথমে মুখে তাকাল সুফিয়া খানের দিকে। ডক্টর হয়ে তিনি পেশেন্টের ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না? পেশেন্টের অবস্থা না জেনে কিভাবে ট্রিটমেন্ট দিবে? এজন্য তিনি এই বাড়িতে আসতে ভয় পান। মা-ছেলে দু’টোই ত্যাড়া। একটা কথা বেশি দুটো প্রশ্ন করলে কেমন যেন চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে যায় এদের। এদের সঙ্গে ভালো মানুষ থাকলে পাগল হয়ে যায়। পাগল মানুষ তো ডাবল পাগল হয়ে যাবে। উনার ধারণা এজন্য হয়তো মায়া নামের মেয়েটি সুস্থ হচ্ছে না এই মা ছেলের প্যারায় পরে। ডক্টর সাজিদা বাকিটা সময় চুপচাপ মায়াকে দেখে প্রয়োজনীয় ঔষধ লিখল। হাতের কাগজটা সুফিয়া খানের দিকে বাড়িয়ে দিতে তিনি আসিফকে ডাকল। আসিফ দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল সুফিয়া খানের ডাকাতে সে দ্রুত কক্ষে আসলে সুফিয়া খান হাত বাড়িয়ে আসিফকে মায়ার ঔষুধের প্রেসক্রিপশনটা দিল। ডক্টর সাজিদাকে ক্লিনিকে নামিয়ে দেওয়ার আদেশও করলো। আসিফ সম্মতি জানিয়ে ডক্টর সাজিদাকে নিয়ে বেড়িয়ে যেতেই সুফিয়া খান চোখ ঘুরাল রিদের দিকে। রিদ তখনো মায়ার দিকে তাকিয়ে। নিরবতা ভেঙ্গে সুফিয়া খান বলল…
‘ তুমি কি করে জানলে মায়া অসুস্থ? তুই এসেছিলে এই রুমে?
রিদ ত্যাড়ামি করে উত্তর করলো না। আর না কিছু বলল। রিদের নিরবতাকে সুফিয়া খান সম্মতি ধরে নিয়ে বলল….
‘ তুমি খাবে কিছু? খাবার দিবো? রাতেও কিছু খাওনি।
বরাবরই সুফিয়া খানের প্রশ্নে রিদ নিরুত্তর রইল। আর না জায়গা ছেড়ে নড়লো। সুফিয়া খান রিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়। রিদ রাতে কিছু খাইনি জেদ করে। উনি এতো করে ডাকল তারপরও রুম হতে বেরুল না। রিদের এখনো মেডিসিন চলে। না খেয়ে এতো পাওয়ারফুল ঔষধ খাওয়াটা রিদের শরীরের জন্য খুব রিস্ক। তাছাড়া রিদের সুগারের সমস্যা আছে। না খেয়ে থাকলে সুগারফল হয়। সুফিয়া খান ধৈর্য নিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো রিদকে বলল…
‘ মেডিসিন নিয়েছিলে তুমি?
রিদ উত্তর না করায় সুফিয়া খান গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল…
‘ তুমি রুমে যাও রিদ। আমি আছি মায়ার পাশে।
সুফিয়া খানের কথা উপেক্ষা করে রিদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল জেদ ধরে। ততক্ষণে বাসার একজন কেয়ারটেকার বাটি হাতে জল নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে সুফিয়া খান সেদিনকে তাকাল। মায়াকে জলপট্টি দেওয়ার কাপড় ভিজিয়ে রেখেছে পানিতে। কেয়ারটেকার মহিলাটি মায়ার পাশে বেড সাইটের টেবিল বাটি-টি রাখতে সেখান থেকে ভেজা কাপড়টি হাত নিলো মায়ার কপাল জলপট্টি দিতে, সুফিয়া খান বাঁধা দিয়ে মহিলাটিকে বলল…
‘ আপনি যান খালা! আমি পারব বাকিটা।
রিদের দিকে তাকিয়ে মহিলাটি আমতা আমতা করলো চলে যেতে। রাতের বিষয়টি নিয়ে মহিলাটি বেশ ভয় পাচ্ছে রিদকে। যদিও উনার সহকর্মী রহিমাকে হাশেমের হাতে ধ*র্ষি*ত হতে হয়েছে তারপরও রিদ হাতে হাশেমের নৃশংসভাবে হ*ত্যাটা ছিল ভয়ংকর। তাজা লা*শের র*ক্ত স্রোত মনে করলে এখনো উনার শরীরে কাটা দিয়ে উঠে ভয়ে। এই রক্তে দেখেই তো পাগল মাইয়াটা অসুস্থ হইলো। সারারাত তিনিও ঘুমাতে পারেনি রহিমার জন্য। রিদ খানের আদেশ পেয়ে সে এখানে এসেছিল। এখন যদি রিদ খানের কাজ না করে আবার চলে যায় তাহলে নিশ্চয়ই স্যার রাগ করবেন? কাজের মহিলাটিকে আমতা আমতা করে বলল….
‘ আমি আপনার লগে থাকি ম্যাডাম। কোনো সম….
মহিলাটিকে বলতে না দিয়ে সুফিয়া খান গম্ভীর স্বরে বলল…
‘ নো নিড! আপনি যান।
কাজের মহিলাটি আর দ্বিমনা করলো না। ভয়ে ভয়ে সম্মতি দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইলে পিছন ডাকল সুফিয়া খান। কাজের মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলল…
‘ খালা,ফ্রিজে খাবার রাখা আছে। আপনি সেটা গরম করে এই ঘরে দিয়ে যান।
‘ আচ্ছা ম্যাডাম।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে কাজির মহিলাটি দ্রুত বেড়িয়ে যেতেই সুফিয়া খান মায়ার মাথায় জলপট্টি দিতে লাগল। খানিক সময় নিয়ে রিদের খাবারও চলে আসল সুফিয়া খানের ঘরে। জেদ্দি রিদ চুপচাপ খেয়েও নিলো মায়ের ঘরে সোফায় বসে। খাওয়া দাওয়া শেষে কক্ষে হতে বেড়িয়ে গিয়ে পুনরায় ফিরেও আসল কিছুসময় পর। সুফিয়া খান বুঝতে পারল রিদ নিজের মেডিসিন নিতে গিয়েছিল কক্ষে। ততক্ষণে আসিফও মায়ার ঔষধ নিয়ে আসলে সুফিয়া খান মায়াকে সেসব খাওয়াল সময় নিয়ে। এই পুরোটা সময় রিদ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। শেষ রাতের দিকে মায়ার জ্বর কমে আসতে রিদ সুফিয়া খানের কক্ষ ছাড়ল।
~~
সকাল আটটা। এলোমেলো মায়া গায়ে চাদর টেনে
ডাইনিংয়ে টেবিলের চেয়ারে পা তুলে বসে। সারা রাতভর জ্বরের তোপে শরীর বেশ দূর্বল মায়ার। সুফিয়া খান রাতভর জেগে মায়ার খেয়াল রেখেছেন। শেষ রাতে দিকে মায়ার গায়ের জ্বর কমে আসলে তিনি মায়ার ঘামন্ত শরীরটা মুছে দেন অসুস্থতা কাটাতে। দূর্বল মায়ার টেবিলে মাথা ফেলে বসে। সুফিয়া খান বাটিতে করে মায়ার জন্য নুডলস রাখতে মায়া মাথা তুলে বসল। জ্বরের শুকনো মুখে বাটির দিকে তাকিয়ে বলল…
‘ আমি খাব না আম্মু।
সুফিয়া খান মায়ার কপালে হাত রেখে শরীরের জ্বর মাপলো। জ্বর নেই। তবে শরীরের দূর্বলতার রেশ কাটাতে কিছুটা সময় লাগবে মায়ার। খাবার খাইয়ে মায়াকে মেডিসিন দিতে হবে বলে সুফিয়া খান নরম সুরে বলল….
‘ তুমি আম্মুর কথা শুনবে না?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে বলল…
‘ শুনব!
‘ গুড গার্ল! এবার খাবারটা ফিনিশড করো তারপর আমরা ঘুরতে যাব কেমন?
মায়া মাথা কাত করে পুনরায় সম্মতি দিল। সুফিয়া খান মায়ার সম্মুখে নুডলসের বাটি এগিয়ে দিতে তিনি মায়ার এলোমেলো খোলা চুল গুছিয়ে হাত খোঁপা করতে লাগলে মায়া চামচ নাড়িয়ে বাটি হতে অল্প নুডলস মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে নাক মুখ কুঁচকে বলল….
‘ আম্মু এই গুলো কেমন যেন তেঁতো তেঁতো, খেতে পারি না, ফেলে দেয়?
মায়ার কথায় সুফিয়া খান বুঝলেন জ্বরের তোপে মায়ার মুখ তেতো হয়ে আছে তাই খাবারের স্বাদ পাচ্ছে না। তিনি মায়াকে কিছু বললেন না। আর না ধমকালেন। বরং তিনি মায়ার ব্যাপারে খুবই নমনীয় আর ধৈর্য্যশীল হলেন। উনার বেশ শখ ছিল একটা মেয়ের। রিদের পরে রাদিফকে জম্মই দিয়েছিল একটা মেয়ের আশায় কিন্তু উনার মেয়ে না হয়ে ছেলে হওয়াতে উনি আর তৃতীয়বার সন্তান নেননি। তবে এই শেষ বয়সে এসে মায়ার মতো করে একটা মেয়ে পেয়ে যাবেন সেটা তিনিও ভাবতে পারেন নি। যদিও মায়ার মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই। অতিরিক্ত মানুষ ভয় পাই তবে সে সুফিয়া খানকে কথা খুব মেনে চলে। বলতে গেলে মায়া সুফিয়া খানকে ছাড়া কিছু বুঝে না।
সার্বক্ষণিক উনার পিছন পিছন ঘুরতে দেখা যায় মায়াকে। উনার মনে হয় উনি সেই প্রথমবারের মতোন আবারও মেয়ের মা হয়েছেন মায়াকে পেয়ে। যদি মেয়েরা বাবার নেওটা থাকে কিন্তু মায়া যেন পুরোপুরি সুফিয়া খানের নেওটা মেয়ে হয়েছে আছে। শক্তপোক্ত সুফিয়া খান কেমন কেমন করে জানি মায়ার উপর বেশ দূর্বল হয়ে গেছেন। চোখে হারানোর মতো মায়াকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখেন তিনি। উনার ছেলে রিদ মায়াকে মেনে না নিলেও তিনি মায়াকে সারাজীবন নিজের কাছে রাখবেন বলে মনস্থিরও করে রেখেছেন। এই মেয়ে উনার কাছেই যত্নে থাকবে। উনার মেয়ে হয়ে। সুফিয়া খান মায়ার গালে আসা চুল গুলো কানে গুঁজে আদুরে হাত বুলাল মায়ার মাথায়। আদুরে স্বরে বলল…
‘ পছন্দের খাবার ফেলতে নেই আম্মু। আল্লাহ নারাজ হয়। আস্তে আস্তে খাও তাহলে দেখবে সব শেষ হয়ে গেছে। এই খাবার গুলো আমি কষ্ট করে তোমার জন্য বানিয়েছি, তুমি না খেয়ে ফেলে দিলে আমি কষ্ট পাব। তুমি কি চাও আম্মু কষ্ট পাক?
মায়া ভাসা ভাসা দুচোখে সুফিয়া খানের দিকে তাকিয়ে অসম্মতি জানাল। যার অর্থ সে চাই না ওর আম্মুকে কষ্ট দিতে। সুফিয়া খান ঝুঁকে মায়ার মাথায় চুমু খেতে খেতে বলল…
‘ তুমি খাবারটা শেষ করো আম্মু আসছি কেমন?
মায়া পুনরায় ঘাড় কাত করে সম্মতিতে দিতে সুফিয়া খান কিচেনে দিকে এগোল রিদের খাবার রেডি করতে। যদিও রিদ বিগত দেড়মাসে বাড়িতে কারও সঙ্গে বসে খাইনি তবে আজ রিদ উনাদের সঙ্গে বসে নাস্তা করবে। শুধু নাস্তা নয়, উনার ধারণা মতে রিদের তিন বেলায় উনাদের সঙ্গে খাওয়া কথা। কারণ তিনি দেখেছেন ছেলের চোখে মায়াকে হারানোর ভয়। আর এই ভয়ই রিদকে মায়ার আশেপাশে রাখবে। সুফিয়া খান চলে যেতেই মায়া বাটির দিকে তাকাল। নুডলসের চেয়ে চিংড়ি মাছ আর মাসরুম বেশি। মায়ার পছন্দের খাবারের মধ্যে চিংড়ি মাছ একটা। সেইগুলোই একে একে মুখে তুলছিল সবে, হঠাৎই চেয়ার টানার শব্দে মায়া খেতে খেতে চোখ তুলে সামনে তাকাতে দেখল রিদ মায়ার পাশের চেয়ারটা টেনে বসেছে। রিদকে দেখেই মায়া অস্থির উত্তেজিত হলো ভয়ে। রাতে কথা মনে করতে চিৎকার করলো সুফিয়া খানের উদ্দেশ্যে। মায়ার চিৎকারে তৎক্ষনাৎ ছুটে আসলো সুফিয়া খান। মায়াকে আতঙ্কিত হতে দেখে তিনি নিজেও ভয় পেলেন। ভেজা হাতে ছুটে এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরতে মায়া ভয়ার্ত মুখ লুকাল সুফিয়া খানের বুকে। অধৈর্য্যের সুফিয়া খান রিদকে শাসিয়ে বলল….
‘ কি করেছো তুমি ওর সাথে?
রিদ সবে মাত্র বসেছিল। সে কিছু করার আগেই বদনাম হয়ে গেলে এই মেয়ের চিৎকারে। এখন সবদোষ তাঁর। কিছু করার পর দোষ দিলে নাহয় মানা যেত কিন্তু এই মেয়ে তাঁকে সেই সুযোগটায় দিল না। তার আগেই তাঁকে দেখে চিৎকার করে বসলো। রিদ বিরক্তি গলায় বলল….
‘ আমি আবার কি করবো?
‘ তাহলে কাঁদছে কেন ওহ?
‘ চোখে পানি বেশি সেজন্য।
বরাবরই রিদের ত্যাড়া উত্তর। সুফিয়া খান রিদকে কিছু না বলে মায়াকে নিয়ে চলে যেতে চাইল। মায়া একহাতে সুফিয়া খানকে জড়িয়ে অন্যহাতে নিজের নুডলসের বাটি চেপে দাঁড়াতে চাইলে বাটিতে টান পরলো রিদের। একহাতে মায়া নিজের বাটি টানছে তো অপরহাতে রিদ মায়ার বাটি চেপে বসে আছে দিবে না বলে। মায়ার অর্ধ খাওয়া বাটিতে রিদের হাত দেখে মায়া পুনরায় কাঁদল নিজের বাটি ছাড়াতে চেয়ে। সুফিয়া খান সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তির সহিত রিদকে শুধিয়ে বলল….
‘ কি সমস্যা তোমার? ওর বাটি ছাড়ছো না কেন? ছাড়ো এটা।
রিদ দু’হাতে মায়ার থেকে বাটি কেঁড়ে নিলো নিজের কাছে। মায়ার মুখ লাগানো চামচটা দিয়ে নিজের মুখে নুডলস তুলতে তুলতে বলল…
‘ এটা আমার তাই ছাড়ছি না।
মা হয়ে তিনি রিদকে কখনো এসব নুডলস খেতে দেখেছে কিনা সন্দেহ। রিদের এসব মশল্লা জাতীয় খাবার পছন্দ নয়। সে সবসময় হেলদি খাবার খেয়ে পছন্দ করে। বলতে গেলে উনার পরিবারের সবাই হেলদি খাবারই খেয়ে থাকেন। শুধু মায়া বাদে। পরপর রিদকে মায়ার খাওয়া নুডলস মুখে তুলতে দেখে কপাল কুঁচকাল সুফিয়া খান। তীক্ষ্ণ গলায় রিদকে শুধিয়ে বলল….
‘ তোমার তো এসব খাবার পছন্দ না রাইট? তাহলে খাচ্ছো কেন?
‘ আজ পছন্দ হয়েছে তাই খাচ্ছি।
রিদের কথায় সুফিয়া খান চুপ রইল। বেশি কথা বাড়াল না। অনেক দিন পর রিদ উনার সঙ্গে একটু স্বাভাবিক কথা বলছে এটাই অনেক। মায়ার জন্য না-হয় উনি পুনরায় খাবার বানিয়ে দিবেন। মায়াকে নিয়ে সুফিয়া খান কিচেন রুমের দিকে যেতেই রিদ নুডলস মুখে তুলতে তুলতে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল কিচেনের দিকে। ডাইনিং হতে কিচেন স্পষ্ট দেখা যায়। সেখানে সুফিয়া খানের আঁচল ধরে মায়া দাঁড়িয়ে। হাতে একটা আপেল। কিছু সময় পরপর তাতে কামড় বসাচ্ছে চিবোতে চিবোতে। রিদ শান্ত দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে বাকি খাবারটা শেষ করলো। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। টেবিল ছেড়ে চলে যেতে গিয়ে পুনরায় মায়ার দিকে তাকাল। মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে ততক্ষণে এইদিকেই তাকিয়ে ছিল, এতে দুজনের চোখাচোখি হলো মূহুর্তে। ভয়ার্ত মায়া তৎক্ষনাৎ রিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই রিদ প্রস্থান করলো ডাইনিং হতে।
রিদকে চলে যেতে দেখে পিছন পিছন সুফিয়া খানও আসল রিদের খাবার নিয়ে। প্লেটভতি খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে দেখল রিদ মায়া রাখা অল্প খাবার খেয়েই বেড়িয়েছে। সুফিয়া খান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মায়ার দিকে তাকাল। উনার শরীর ঘেঁষে মায়া দাঁড়িয়ে। মা ছেলের অদৃশ্য দূর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মেয়ে। রিদ চাচ্ছে মায়ার অসুস্থতার পাশে দাঁড়াতে কিন্তু কোনো কিছু উনার ছেলেকে আটকাচ্ছে মায়ার কাছে আসতে। কিন্তু কি? মায়ার বিয়ে? নাকি অন্য কিছু? যদি মায়ার বিয়েটা রিদকে তার বউ থেকে দূরে রাখে তাহলে সেটাও সঠিক নয়। প্রথম স্বামী জীবিত অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে জায়েজ নয় সেটা রিদ নিজেও জানে। জেনে বুঝে সে নিশ্চয়ই অবুঝপনা করবে না? অবশ্যই অসুস্থ মায়া পাশে দাঁড়াবে? আর যদি সত্যি মায়ার বিয়ে নিয়ে রিদ দ্বিধায় থাকে তাহলে সেটা রিদ চাইলে সে নিজে ক্লিয়ার হতে পারে। খোঁজ করতে পারে মায়ার বিয়েটার ব্যাপারে। যেটা রিদ নিজ থেকে করছে না তারমানে রিদ সেচ্ছায় চাচ্ছে না মায়ার বিষয়টা ক্লিয়ার হতে। হয়তো রিদ মায়ার সুস্থতা অপেক্ষা করছে সত্যিটা জানার? মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার সুফিয়া খানের মনে হলো রিদের দ্বিধা দূর করতে হলেও উনার কোনো আলেমের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। দরকার হলে দুজনের পুনরায় বিয়ে দিবে তারপরও উনার ছেলের সকল দ্বিধা দূর করে মায়াকে হালাল করবে রিদের জন্য।
তপ্ত রোদে উত্তপ্ত শহর। আরিফ সবে দোকানে ঘাঁটি হতে বাসায় ফিরল। ক্লান্তিতে বাসার কলিংবেলের চেপে দাঁড়াল গায়ের শার্টটা দু’বার ঝাঁকিয়ে। শরীরের ঘামে শার্ট ভিজে লেপ্টে। এই সময়ে গোসল না করলেই নয়। বড্ড অসহ্য লাগছে নিজেকে। আরিফে কলিংবেল বাজানোর দশ-পনেরো সেকেন্ডে মাঝে দরজা খোলা দিল কেউ। আরিফ ক্লান্তিময় চোখে সামনে তাকাতে তার চোখ শিথিল হলো কারও স্নিগ্ধ মুখ দেখে। ফুটফুটে লাজুক হেঁসে দরজা ধরে দাঁড়াল সে। যেন এতক্ষণ সে আরিফের অপেক্ষায় বসে ছিল। আরিফ ঘরে প্রবেশ করতে করতে আরও একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাল মেয়েটির দিকে। মূহুর্তে দুজনের চোখাচোখি হলো। সংকোচে আরিফ চোখ নামিয়ে নিলেও মেয়েটি নিলো না। বরং দরজা লাগিয়ে আরিফের পিছন পিছন রুম অবধি যেতে যেতে বলল….
‘ আজ এতো বেশি দেরি হলো কেন তোমার ফিরতে?
প্রশ্নে গাঢ় অধিকারবোধ জমা মেয়েটির। আরিফ সেই অধিকারকে সম্মান জানিয়ে রুমে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বসার ঘরের দেয়াল ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাটা ৩ঃ১৫ মিনিটে দেখে সে খানিকটা চিন্তিত স্বরে বলল….
‘ বেশি দেরি হয়েছে আমার?
আরিফের দৃষ্টি ধরে মেয়েটিও এক পলক তাকাল সময়ের কাটার দিকে। আরিফের কথার সম্মতি দিয়ে বলল….
‘ হুম! হয়েছে একটু তবে ব্যাপার না।
‘ আম্মু কই? দুপুরে খেয়েছে কিছু?
‘ হুম খেয়েছে। কিন্তু আম্মু মায়াকে দেখার জন্য রোজ কান্নাকাটি করে। তুমি আম্মুকে মায়ার কাছে নিয়ে গেলেই তো পারো।
ফিহার কথায় আরিফ চুপ রইল। মায়ার অসুস্থতার কথা সবার জানা। কিন্তু মায়া কতো ভারসাম্যহীন রোগী সেটা রেহেনা বেগম বা ফিহা তারা কেউ জানে না। আরিফ মায়ার বিষয়টা ওর মাকে জানাতে চাই না বলেই ফিহাকে কিছু বলে না। যদিও ফিহা সত্যিটা জানলে ওর মাকে বলবে না তারপরও আরিফ রিস্ক নিতে চাইনা তার মাকে নিয়ে। মায়ার সত্যিটা জানলে রেহেনা বেগম আরও অসুস্থ হয়ে পরবেন বলেই আরিফ সত্যিটা জানাতে চাইনা নিজের মাকে। তাছাড়া আরিফ ইন্ডিয়া থেকে ফেরার পর বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছিল মায়ার সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু রিদ খানের কর্ড়া সিকিউরিটি ভেঙ্গে সে আজও সক্ষম হয়নি মায়ার সঙ্গে দেখা করার। বলতে গেলে মায়ার জন্য ওর পরিবারকে নিষেধ করে দিয়েছে রিদ খান। তবে আসিফের সঙ্গে আরিফের রোজ কথা হয় রিদের অগোচরে। আসিফ থেকে জানতে পাই মায়ার মানসিকতার সম্পর্কে। তার পরিবার কতোটা মানসিক চাপে ফেললে তার হাসিখুশি চঞ্চল বোনটা এভাবে পাগল হয়ে যায় সেটা ধারণা আরিফও করতে পারে না।
মায়ার কথা মনে পরলে আরিফের তীব্র বুক ব্যথা করে অপরাধ বোধে। বড়ো ভাই হয়ে সে বোনকে হেফাজত করতে পারেনি। আরিফের অনুপস্থিতিতে ওদের পরিবারের সবাই মায়াকে অন্যত্রে বিয়ে দিবে সেটা সত্যি আরিফের কাছে অকল্পনীয় ছিল। আরিফের এতোবার করে বলার পরও বিবাহিত মায়াকে আবারও বিয়ে দেয়াটা শুধু অন্যায় নয় পাপও হয়েছে। সে ইন্ডিয়া থেকে ফিরে মায়ার বিয়ের খবরটা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতোন শকট হয়েছিল। তারপর এই নিয়ে পরিবারের সকলের সঙ্গে আরিফের ঝামেলাও হলো। বাপ-চাচা ফুফিরা সবাইকে এড়িয়ে মায়ের হাত ধরে সে সেই রাতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসল তার অসুস্থ পরিবারকে ত্যাগ করে। যে পরিবারে সন্তানদের জীবনের কোনো মূল নেই সেই পরিবারের আরিফও থাকবে না বলে ঠিক করলো। মায়ের হাত ধরে চট্টগ্রামে তার বাসায় এসে উঠলো। একা বাড়িতে আরিফ আর ওর মা-ই থাকতো।
কিন্তু দিনদিন মায়ার জন্য রেহেনা বেগমের অসুস্থতা বাড়তে থাকলে সে হিমসিম খেতো নিজের মা আর নতুন নতুন বড়ো করা ব্যবসাটাকে একত্রে সামলাতে। এবার সে সবে মাত্র ব্যবসাটা বড়ো করে তুলেছে। না চাইতেও সারাদিন রাত তার গোডাউনে পরে থাকতে হতো বলে, তার মা অযত্নে অসুস্থতায় বাসায় পরে থাকত একা একা, এজন্য সে এক সন্ধ্যায় নিজের মাকে নিয়ে ফিহার হোস্টেলে হাজির হয়। ঘামন্ত শরীরে ময়লা শার্টে ফিহাকে ফোন করে নিচে নামতে বলে সে গাড়ি বাহিরের দাঁড়ায়। ফিহার গায়েও সাদামাটা পোষাক ছিল সবসময়ের মতোন। কিন্তু ফিহা নিচে নেমে আসতে আরিফ ফিহাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে তৎক্ষনাৎ। সেদিন ফিহা প্রচুর শকট হয়েছিল। যদিও দুজনের মাঝে তাদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল কিন্তু আরিফ হুট করে এসে ফিহাকে বিয়ে করতে চাইবে এমনটা জানতো না ফিহা। আরিফের প্রস্তাবে প্রথমে ফিহা না করতে চাইল নিজের পরিবারের অনুপস্থিত দেখে।
কিন্তু পাঁচে রেহেনা বেগমের অসুস্থতা কথা চিন্তা করে সেই রাতেই আরিফের হাত ধরে বিয়ে করে এই বাসায় এসে উঠে। তারপর থেকে ফিহা এবাড়িতেই থাকছে আরিফের বউ হয়ে। রেহেনা বেগমের শরীরও আগে থেকে অনেকটা সুস্থ। শুধু মায়ার জন্যই কান্নাকাটি করে সবসময়। যা আরিফ চাইলেও নিজের মাকে মায়ার অবধি নিয়ে যেতে পারে না। কারণ রিদ খান মায়ার সঙ্গে কারও দেখা করতে দিবে না। হয়তো রিদের জায়গায় আরিফ থাকলে তাই করতো। নিজের বউয়ের বিয়ে জোর করে অন্য কোথাও দেওয়া হলে সেও ঠিক এমন করেই সবাইকে নিষেধ করতো ফিহা সঙ্গে দেখা করতে। তাই আরিফের ধারণা মতে রিদ খান নিজের জায়গায় ঠিক বলে সেও কোনো কিছুতে বাড়াবাড়ি করে না। বরং চুপ থাকে। আপাতত তার মায়ার ব্যাপার কি করা উচিত সে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারলেও হয়তো রিদ খান আরিফকে কিছু করতে দিবে না। মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মাঝে আরিফ রুমে প্রবেশ করে গায়ের শার্টটা খোলতে খোলতে বলল…
‘ তুমি খেয়েছ কিছু?
ফিহা বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে বলল…
‘ না তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
‘ এতো বেলা অবধি অপেক্ষা না করলেই পারো ফিহা। আমার আসতে মাঝেমধ্যে দেরি হতে পারে তুমি খেয়ে নিয়ো।
‘ বিয়ের আগেই তোমাকে দুপুরে না খাইয়ে খাইনি কখনো, এখন বিয়ের পর খাবো?
আরিফ বেশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল ফিহার সুন্দর আদলের মুখটার দিকে। ফিহার অবদান তার জীবনে অনেক। সবসময় আরিফ সুখে-দুঃখে ফিহাকে পাশে পেয়েছে সে। বিয়ের আগে তাদের সম্পর্ক ছিল এক বছরের। কিন্তু দুজন পরিচিত ছিল দুই বছরের। এই দুই বছরের ফিহা রোজ তার জন্য দুপুরে খাবার পাঠাতো টিফিন করে কোচিং সেন্টারে। মাঝেমধ্যে রাতেও পাঠাত যদি আরিফ ব্যস্ত হয়ে বাসায় ফিরতে না পারতো তাহলে। এই দুই বছরের আরিফ ফিহাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে সে, ফিহা ভালোবাসার থেকে ভালোবাসার মানুষকে যত্ন করতে পারে বেশি। আর আরিফ ফিহার যত্নে আটকিয়েছে। যখন আরিফের সবচেয়ে বিপদের সময় কাউকে প্রয়োজন ছিল তখন ফিহা এক কাপড়ে আরিফকে বিয়ে করে এই বাসায় এসে উঠেছে। তার মা খেয়াল রাখছে অথচ আরিফ কখনো মুখ ফুটে জানতে চাইনি ফিহা আদৌও আরিফের কাছে ভালো আছে কিনা….
‘ তুমি আমার কাছে ভালো আছো তো ফিহা?
আরিফের কথায় ফিহা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিয়ে বলল….
‘ আরে তোমার কাছে আমি বিন্দাস আছি জান। তোমার মতো সুন্দর আর দায়িত্বশীল স্বামী পেয়ে আমি খুশি হবো না বলো? তোমার জায়গায় যদি আমি কোনো মোটা ভুঁড়িওয়ালা, টাক মাথার কাউকে বিয়ে করতাম তাহলে হয়তো সমস্যা হতো। ব্যাডা কিস করতে আসলে আমি তো ভয়ে ফিট হয়ে যেতাম। কিন্তু তোমাকে দেখলে আমার ভয় লাগে না বরং আদর আদর লাগে।
ফিহার চঞ্চলতায় ইতস্ততবোধ করল আরিফ। যদিও তাঁরা এখন হাসবেন্ড -ওয়াইফ। এর পূর্বে রিলেশনে ছিল একবছর তারপরও আরিফ এসব বিষয়ে ফিহার সঙ্গে সহজ হতে পারেনি। কিন্তু চঞ্চল ফিহা প্রায় আরিফকে এটাসেটা বলে ইতস্ততায় ফেলে দেয়। আরিফ কথা ঘুরাতে চেয়ে বলল…
‘ তুমি খাবার দাও, আমি গোসল করে আসছি।
আরিফকে ইতস্ততবোধ করতে দেখে ফিহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
‘ তুমি কি কিসের ব্যাপারটায় লজ্জা পাচ্ছো জান?
আরিফ ফিহাকে অপেক্ষা করে ঘামন্ত শার্টটা ময়লার ঝুড়িতে রেখে হাতে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে ফিহার উদ্দেশ্যে বলল…
‘ সারাক্ষণ তোমার মাথায় এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনা ঘুরে কেন?
আরিফকে পালাতে দেখে ফিহা তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাঁড়াল আরিফের পথ আঁটকে বলল…
‘ তুমি আমার কথায় লজ্জা পাচ্ছো রাইট?
আরিফ থমথমে গলায় অসম্মতি দিয়ে বলল…
‘ না পাচ্ছি না সরো!
ফিহা তৎক্ষনাৎ নিজের ডান গাল আরিফের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল…
‘ তাহলে একটা কিস করে দেখাও তো তুমি লজ্জা পাচ্ছো কি না সেটা।
আরিফ থমথমে মুখে ফিহাকে শুধিয়ে বলল…
‘ ফিহা আমি ঘেমে আছি, সরো। গোসল করবো।
‘ তুমি ঘামলে আমার সমস্যা নাই। ঘামন্ত শরীরে চুমুটা লবনাক্ত লাগবে এই যা। লবন আমার পছন্দ, তুমি করো তো।
ফিহা পুনরায় গাল বাড়িয়ে দিতে চাইল আরিফের ঠোঁটের সামনে। কিন্তু ফিহার দু’পা উঁচিয়ে আসায় কারণে শরীরের খেই হারিয়ে পরে যেতে নিলে একহাতে আরিফের খালি বুক আঁকড়ে ধরতে চাইল পরে যাওয়া থেকে বাঁচতে, কিন্তু আরিফের শরীরের কাপড় না থাকায় হাত ফস্কে যেতে আরিফ তৎক্ষনাৎ দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো ফিহাকে। ফিহার পিঠ ঠেকে গেল ওয়াশরুমের দরজায় আর আরিফের মুখ ফিহার গলায়। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ফিহার গলায় চিনচিন ব্যথা অনুভব করতে ফিহা চমকে উঠার মতোন আরিফকে দু’হাতে ঠেলে দূরে সরাতে চেয়ে বলল….
‘ আরিফ ছাড়ো ব্যথা পাচ্ছি আমি।
আরিফ তৎক্ষনাৎ ফিহাকে ছাড়লো না। বরং সময় নিয়ে ফিহা থেকে সরে দাঁড়াতে মূহুর্তে ফিহার হাত চলে যায় ব্যথিত গলায়। কামড়ের জায়গাটা ভিষণ জ্বলছে। ফিহা বিরক্তি চোখে আরিফের দিকে তাকাতে আরিফ বলল….
‘ এটা চলবে? নাকি আরও একটা লাগবে তোমার?
আরিফের কথায় ফিহাও দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে আরিফকে ঠেলে সরিয়ে দিল নিজের থেকে। রুম হতে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল….
‘ কাইস্টা লোক! বউকে কিস করবে তাতেও হিসাব করে বলে তোমার একটা লাগবে নাকি দুইটা? পারলে আমার কাছে আইসো আনলিমিটিডে বন্যা বয়ে দিব।
ফিহা কথা গুলো ভেঙ্গ করেই বললো আরিফকে। আরিফ ফিহার ভেঙ্গ ভঙ্গি ভঙ্গিমা দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। ফিহা সবার সাথে ভালো ভদ্র মেয়ে হলেও আরিফের বেলায় সে প্রচন্ড চঞ্চল আর বাঁদর টাইপ। আরিফের অবশ্য মন্দ লাগে না ফিহা চালচলনে। বরং খানিকক্ষণের জন্য হলেও আনন্দ দেয় শত কষ্টের মাঝে।
জুই নিজের কক্ষে শুয়ে। একা একঘেয়েমি জীবনটা যেন ছন্ন ছাড়া হয়ে গেছে। বাসায় বলতে ওরা পাঁচ সদস্য রয়েছে। জুই, ওর মা-বাবা, বড়ো চাচা, আর মুক্তা। ওদের এতো সুন্দর পরিবারটা যেন কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। আগের মতোন প্রাণচাঞ্চল্যতা নেই কারও মাঝে। মায়ার অসুস্থতা ঘিরে যাবতীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে মায়ার বাবাও কষ্ট পাচ্ছেন। দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে অসুস্থতায়। তারউপর আবার আরিফ তার মাকে নিয়ে ঘর ছাড়লো। জুইরা শুনেছে আরিফ নাকি চট্টগ্রামে বিয়েও করেছে কাকে। সেই বউ নিয়ে থাকছে বড়ো চাচীকে নিয়ে। এসবের মাঝে জুইরাই ভালো নেই। কেমন নিস্তব্ধ আর হাহাকার এই পরিবার জুড়ে। জুইয়ের মাঝেমধ্যে মনে হয় সে এই পরিবার ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। নয়তো এই অসুস্থ পরিবেশে থেকে সেও একদিন মায়ার মতো অসুস্থ হয়ে পরবে। ওর পড়াশোনা বন্ধ। হাতে ফোন নেই। কোথাও যেতে পারে না। কেমন ঘরবন্দী হয়ে আছে সে। মায়া কেমন আছে সেটাও জানতে পারে না।
সব মিলিয়ে কেমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে আছে জুই। মায়াকেও ভিষণ মিস করছে কিন্তু মায়ার সঙ্গে দেখা করা বা কথা বলার উপায় নেই জুইয়ের। ওর বাবা নিষেধ করেছে কেউ ঐ পরিবারের নাম না নিতে। হয়তো রিদের জুইয়ের বাবাকে করা আঘাত থেকেই জুইয়ের বাবা সাজিদুল ইসলাম ক্ষিপ্ত ঐ পরিবারের সঙ্গে। জুইয়ের চিন্তা ভাবনার মাঝেই সাজিদুল ইসলাম হাক ছেড়ে গলা ফাটিয়ে ডাকল জুইকে। হঠাৎ করে জুইয়ের নাম ধরে সাজিদুল ইসলামকে চিৎকার করতে দেখে ধড়ফড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো জুই। গায়ের ওড়নাটা টেনে দৌড়াল বাবার উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়ো দৌড়ে জুই সাজিদুল ইসলামের কাছে পৌঁছাতে ওর কিছু বলার আগে সাপটে থাপ্পড় পরলো জুইয়ের গালে। ছিটকে পরার মতোন ফ্লোরে পরলো জুই। জুইয়ের মা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ জুইকে থাপ্পড় মারতে দেখে তিনি আহাজারি করে জুইকে টেনে ধরতে সাজিদুল ইসলাম হুংকার ছেড়ে বলল….
‘ ঐ বাড়ির ছেলে আমাকে তোর জন্য ফোন দেয় কেন? আমার মেয়ের বিষয়ে ঐ বাড়ির ছেলের কি কথা থাকতে পারে? আমি মানা করছিলাম না ঐ বাড়ির সঙ্গে কেউ যোগাযোগ না করতে? তারপরও কেন ঐবাড়ি থেকে কল আসে তোর নামে?
বাবার কথায় জুই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পরেছে। জুই বুঝতে পারে ঐ বাড়ির থেকে হয়তো আয়নের কল এসেছিল ওর বাবার ফোনে। যার জন্য সাজিদুল ইসলাম এতোটা রেগেছেন। কিন্তু জুইয়ের মা বুঝল না উনার স্বামী কার কথা বলছেন তাই তিনি মেয়েকে বুকে জড়াতে জড়াতে আহাজারি করে বলল….
‘ ঐ বাড়ি থেকে কার না কার ফোন এসেছে বলে আপনি আমার মেয়েটাকে মারবেন? ওরা কি এমন বলেছে আমার মেয়ে নামে? কি করেছে আমার মেয়ে? সত্যিটা না জেনে আপনি আমার মেয়েকে মারলেন কেন?
‘ তর্ক করবা না সালেহা। তোমার মেয়ের জন্য ঐ বাড়ির ছেলে ফোন করেছে মানে ওহ নিশ্চয়ই ঐ বাড়িতে যোগাযোগ করেছে। যদি ওর বাকি বোনদের মতোন ওর ও ঐবাড়ির ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার মেয়েকে আমি কেটে নদীতে ভাসায় দিব। যে মেয়ে বাবার সম্মান নষ্ট করে সেই মেয়ের দরকার নেই আমার মনে রাইখো।
কথাটা বলে সাজিদুল ইসলাম বাহিরের দিকে চলে গেল। জুই মায়ের বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে লাগল। আয়ন হঠাৎ করে জুইয়ের বাবাকে কল দিবে সেটা বুঝতে পারেনি জুই। তবে আয়ন যে ওদের দুজনের সম্পর্কে কথাটা জুইয়ের বাবাকে বলেনি সেটা সাজিদুল ইসলামের কথায় বুঝেছে জুই। তবে আয়ন বলতে কতক্ষণ? ভয়ার্ত জুই আরও ভয়ার্ত হলো। মাকে জড়িয়ে ফুপাতে লাগলো অঝোরে।
মায়ার খোঁজে খোঁজে রিদ সুফিয়া খানের কক্ষে এসে দাঁড়াল। কিন্তু খালি ঘরটা দেখে অস্থির পা চালাল বারান্দার দিকে। রিদের এতক্ষণে পুরো বাড়ি খোঁজা হয়ে গেছে মায়াকে। কিন্তু কোথাও কোনো রেশ নেই মায়া। হঠাৎ মায়া কোথায় যেতে পারে ভেবেই অস্থির রিদ আরও অস্থির হলো। সুফিয়া খান বাড়িতে নেই সেটা শুনেই সে বাড়িতে এসেছিল মায়ার খোঁজে। কিন্তু মায়াকে কোথাও না পেয়ে তার ভিতরকার ভয়টা যেন আরও বাড়ল। অস্থির পা বারান্দার দরজা সম্মুখে যেতে যেতে থেমে গেল সামনের দৃশ্য দেখে। মায়া পা গুটিয়ে ফ্লোরে বসে। সুফিয়া খান চেয়ারে বসে মায়ার খোলা চুলে তেল জাতীয় কিছু দিচ্ছেন। রিদের উপস্থিতি পেয়ে দুজন পিছন ফিরে তাকাতে দেখলো রিদকে। মায়ার চোখে ভয় নেই কিন্তু সুফিয়া খানের কপাল কুঁচকে আসল রিদের অস্থির উত্তেজিত মুখটা দেখে। তিনি এই অসময়ে রিদকে বাড়িতে দেখে বলল…
‘ কি হয়েছে বাবু? কোনো সমস্যা?
মাতৃত্বের ভালোবাসায় সুফিয়া খান রিদকে বাবু বলেই সম্মোধন করে প্রায়শই। রিদ মায়ের কথায় স্বস্তির শ্বাস ফেলে চোখ ঘুরাল মায়ার দিকে। মায়াকে হেফাজতে দেখে ছোট করে বলল…
‘ না!
কথাটা বলে রিদ চলে যেতে নিলে পিছন ডাকল সুফিয়া খান বলল…
‘ দুপুরে খেয়েছিস? নাকি খাবার দিব?
‘ দাও!
মায়ার অর্ধ মাথায় তেল দেওয়া অবস্থায় সুফিয়া খান উঠে দাঁড়াল মায়াকে নিয়ে। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে। যদিও মায়াকে আগেই খাওয়ানো হয়েছে তবে তিনি ভেবেছিল মায়ার মাথার তেলটা শেষ করেই তিনি খাবেন। এখন রিদের উপস্থিতিতে ভালোই হলো। অন্তত রিদ নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছে। সুফিয়া খান মায়ার চুল গুলো পেঁচিয়ে হাত খোঁপা করে মায়াকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেল। রিদের গোসল করতে করতে সুফিয়া খান ততক্ষণে খাবার রেডি করলো সার্ভেন্ডদের নিয়ে। মায়ার হাতে এক বাটি চিজ পাস্তা তুলে দিতে মায়া সেগুলো খেতে খেতে ডাইনিং পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে দরজার সামনে দাঁড়াল। বাগানে পাকা ফলের দিকে তাকিয়ে মুখের খাবার চিবোল। রিদ গোসল শেষ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে মায়াকে একা পেল। বিগত দেড়মাসে সে মায়াকে একা দেখেছে কিনা সন্দেহ। সারাক্ষণ সুফিয়া খানের পিছন পিছন ঘুরে মায়া। আজ একা পেয়েই রিদ সেদিকে হাঁটল। মায়ার পিঠে তাঁর বুক ছুঁই ছুঁই করে দাঁড়িয়ে মায়ার উদ্দেশ্যে বলল…
‘ আমি থাকতে বিয়েটা কেন করলে রিত?
রিদের হঠাৎ কথায় চমকে উঠার মতোন মায়া তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে পিছন ফেরতে মায়া মুখ বাজল রিদের বুকে। দ্রুত পিছন হাঁটতে চাইলে রিদ সামনে এগিয়ে মায়ার সঙ্গে দূরত্ব গোছাল। মায়া রিদের ভয়ে তৎক্ষনাৎ হাতে বাটি পিছনে লুকাল। মায়ার ধারণা রিদ সকালের মতোন করে আবারও মায়ার খাবার চিনিয়ে খেয়ে ফেলবে। মায়াকে নিজের খাবার লুকাতে দেখে রিদ কপাল কুঁচকে তাকাল মায়ার দিকে মূহুর্তে তার চোখ শিথিল হয়ে গেল মায়ার নতুন রুপ দেখে। মায়ার নাকে ছোট পাথরের নাকফুলটা চকচক করে উঠলো রিদের চোখে। রিদ মোহিত চোখ ঘুরাল মায়ার মুখে। দেখল কানে দু’টো ডায়মন্ডে পাথরের দুল দেওয়া। গলায় চেইন, হাতে স্বর্ণের চুড়ি। রিদ দৃষ্টি নত করে মায়ার পায়েও তাকাল। দেখল দুটো স্বর্ণের পায়েল জড়িয়ে মায়ার দু’পায়ে। রিদ ফের নিজের মোহিত দৃষ্টি ঘুরাল মায়ার আদলের নিষ্পাপ মুখটার দিকে। কেমন ডাগর ডাগর ভয়ার্ত চোখে রিদের দিকে তাকিয়ে সে। রিদ হাত বাড়িয়ে মায়ার নাকের ফুলটা ছুঁতে মায়া রিদের ভয়ে আরও সিটিয়ে গেল। মায়া আশেপাশে তাকিয়ে সুফিয়া খানকে খোঁজল রিদের থেকে বাঁচতে চেয়ে। রিদ মায়ার ভয়ার্ত মুখ দেখে মোহিত গলায় বলল….
‘ এসব কে দিয়েছে তোমায়?
রিদের আঙ্গুল ঘুরলো মায়ার নাকফুলে,
মায়া ভয়ার্ত মুখে মিনমিন করে বলল…
‘ আম্মু!
রিদ মায়ার মুখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে কানে তাকাল। দুই আঙ্গুলে মায়ার কানের দুলে ঠুকা দিতে দিতে একই গলায় বলল…
‘ সুন্দর!
মায়া রিদের ভয়ে ভয়ার্ত গলায় পুনরায় মিনমিন করে বলল…
‘ আমি যাই?
‘ না!
মায়াকে দাঁড়ায় করিয়ে রেখে রিদ ফের মায়াতে দৃষ্টি বুলাল। সে কখনো মায়াকে এইভাবে কল্পনা করেনি। মূলত রিদ বুঝে না মেয়েদের কিভাবে সাজালে বউ বউ লাগে। রিদের অবুঝ হৃদয়ে বুঝ যেন সুফিয়া খান দিল মায়াকে বউয়ের মতো করে গহনাপত্র পড়িয়ে। দেখতেও মায়াকে বেশ বউ বউ লাগছে। রিদ একবার নয় দু’বার নয় বারবার মায়ার উপর দৃষ্টি ঘুরাল। মন ব্যাকুল হলো মায়াকে ছুঁয়ে দেখার। কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে রিদকে। হয়তো মায়ার অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা। রিদ মায়ার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে খানিকটা শক্ত গলায় বলল….
‘ আমার অসুস্থতা সুযোগ নিয়ে অন্য কাউকে কবুল কেন বললে রিত?
‘ বাবু খেতে আয়।
মায়ের ডাকে নড়লো না রিদ। বরং দৃষ্টি স্থির মায়ার উপর উত্তরের আশায়। যদিও সে জানে মায়া অসুস্থতার কারণে রিদকে উত্তর দিবে না। তারপরও রিদ মায়ার থেকেই তার সকল প্রশ্নের উত্তর চাই। সে তৃতীয় পক্ষ হতে তার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো উত্তর চাই না। দরকার হলে রিদ অপেক্ষা করবে মায়ার সুস্থতার তারপরও তৃতীয় পক্ষ নয়। রিদ চাইলে তার সব প্রশ্নের উত্তর তৃতীয় পক্ষ হতে জানতে পারতো। কিন্তু সে অন্যের কথা শুনে বিশ্বাস করার মতোন মানুষ নয়। তার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা তার ব্যক্তিগত মানুষ থেকেই শুনবে নয়তো না। সুফিয়া খানের দেখা পেয়ে মায়া রিদ থেকে পালিয়ে গেল।
রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬২
রিদ চেয়েও মায়াকে আটকাল না। বরং যেতে দিল। রিদের কেন জানি মনে হচ্ছে মায়া রিদকে একেবারে ভুলে যানি। যদিও মায়া অসুস্থ এটা সত্য তারপরও মায়া রিদকে একেবারে ভুলে যায়নি। বরং অসুস্থতার মাঝে অল্প হলেও রিদকে মনে রেখেছে মায়ার। আচ্ছা কোনো কারণে কি মায়া রিদকে এরিয়ে যেতে চাচ্ছে? নাকি রিদের মনের সন্দেহ এটা? কোনটা?