রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৭ (২)

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৭ (২)
রিক্তা ইসলাম মায়া

মায়ার থামে। থামে নয়, ওহ থামতে বাধ্য হয়, কারণ এর মাঝে নাদিম বলে উঠলো…
“তোমার সাথে বিয়ে তো আমার হয়েছিল মায়া। সেক্ষেত্রে আমি তোমার…
নাদিমকে বলতে না দিয়ে মায়া বেশ শক্ত গলায় শুধালো…
“আমার আপনার সাথে কোনো বিয়ে-টিয়ে হয়নি। সেদিন আমি কবুল বলিনি। আমি শুরু থেকে রিদ খানের বউ ছিলাম, আছি, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও থাকব, অন্তত যতদিন বেঁচে আছি ততদিন।

মায়া শক্ত চোয়াল। মাস্কের উপরে ভাসা দুটো চোখে নিদারুণ নিষ্ঠুর তেজ। নাদিম মায়ার কথায় ধাতস্থ হলো। দৃষ্টি নমনীয় হয়ে এলো মায়ার রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে। নাদিম এই প্রথম মায়াকে কোনো কিছুতে রাগান্বিত হতে দেখেছে, নয়তো নাদিমের চেনা সেই অল্প বয়সী মায়া থেকে তরুণী হওয়া মায়াকে সে কখনো রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেনি। সবসময় মায়া ছিল প্রাণচঞ্চল আর উজ্জীবিত। নাদিম আজ থেকে নয়, সেই স্কুল জীবন থেকে মায়াকে একতরফা ভালোবেসে এসেছে। এতকাল সে অপেক্ষা ছিল মায়ার বড়ো হওয়ার, কিন্তু নাদিমের ধারণাতে ছিল না ওর ভালোবাসার মানুষ বড়ো হতে হতে অন্য কারও ঘরের ঘরওয়ালী হয়ে যাবে। নাদিম যদি আগে বুঝতো তাকে তাঁর ভালোবাসার মানুষ হারাতে হবে, তাহলে সে কখনো মায়ার অপেক্ষা নয়, বরং বাল্যবিবাহ করতো মায়াকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তীব্র বুক দহনে চোখ ভিজে উঠলো নাদিমের। মনের ভিতরকার অদৃশ্য কষ্টগুলো গলা চেপে ধরলো যাতনায়। ছেলেমানুষের নাকি কাঁদতে নেই মানুষ বলে। ছেলেদের কাঁদলে নাকি শোভা পায় না, অথচ হাসি-কান্না, ব্যথা ছেলে-মেয়ে উভয়ের সমান ফিল হয়, তাহলে এই সমাজ কেন বলে ছেলেদের কাঁদতে নেই? নাদিম বিষ পান করার মতোন নিজের কষ্টগুলো গিলে ফেলল। নিজেকে সংযম করে নমনীয় দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকাতে চোখ পড়ল মায়ার দু-হাতে সোনার দুটো বালার দিকে। বিবাহিত মেয়েরা এসব সোনার চুরি পরে স্বামীর মঙ্গলের জন্য। এই কথার কতটুকু সত্যতা আছে সেটা জানা নেই নাদিমের, তবে মায়ার হাতে সোনার বালা, আঙুলের মাঝে ডায়মন্ড রিং দেখে নাদিম মায়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক পলক দৃষ্টি বুলাল।

মায়ার ফর্সা পায়ে চকচকে দুটো নুপুরও দেখল সোনার। স্বামীর ঘরে বউদের এভাবেই সাজিয়ে রাখে। নাদিমও রাখতো যদি মায়া তার বউ হতো। কিন্তু নাদিমের আফসোস হয়তো সারাজীবনের। সে প্রিয় মানুষকে এতকাল চোখে চোখে রেখে তিলে তিলে বড়ো করেও অবশেষে হারিয়ে ফেলল। নাদিমের এই ব্যর্থতা কাকে শোনাবে? কে বুঝবে তাঁকে? নাদিম হাহাকার বুকে মায়াকে বুঝাতে চেয়ে বলল…
“তুমি অস্বীকার করলে কোনো কিছু মিথ্যে হয়ে যাবে না মায়া। তোমার কবুল বলাতে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল আমাদের। তাছাড়া আমাদের বিয়েতে শুধু তুমি আর আমি একা ছিলাম না, বরং আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতে এই বিয়ে হয়ে…”

নাদিমের কথা শেষ করার আগে পুনরায় মায়া তপ্ত আক্রোশ মেজাজ দেখিয়ে বলল…
“আপনি কি পাগল? বললাম না, আমি আপনাকে বিয়ে করিনি। তারপরও কেন বারবার একই কথা বলছেন? আমি একজন বিবাহিত মেয়ে। আমার স্বামী জীবিত আছে। আল্লাহ না করুক, যদি আমি বিধবাও হতাম, তারপরও আপনাকে বিয়ে করতাম না। বরং আমি বিধবা হয়ে আমার স্বামীর অপেক্ষা করতাম। ইহকালে না হোক পরকালে তাকে আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নিতাম। আমার স্বামী আমার। তার অংশীদার আপনাকে কেন এই জীবনে অন্য কোনো পুরুষকে বানাতাম না। তারপরও আপনার সুবিধার জন্য বলে রাখি, সেদিন আমি নয়, আমার বান্ধবী রাফা আপনাকে কবুল বলেছে। যদি আপনার মতে এই বিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে রাফার সাথে হয়েছে, আপনার আমার সাথে নয়। বুঝেছেন আপনি?

মায়ার আত্মবিশ্বাস, স্বামীর প্রতি অসীম ভালোবাসার প্রখরতা দেখে নাদিমের মন অসংখ্য টুকরোয় খন্ডিত হলো। আজ মায়ার এতো ভালোবাসা নাদিমের জন্য হতে পারতো। মায়ার বিশ্বাস, ভরসা সবকিছু নাদিমের জন্য হতো যদি নাদিম আরও আগে মায়াকে নিজের করে নিতো, অপেক্ষায় না থেকে। নাদিমের মায়াকে হারানোর আফসোস ইহকালে আর যাওয়ার নয়। তারপরও নাদিম মায়াকে শুধিয়ে রাফা সম্পর্কে জানতে চাইলো…
“রাফা কে? কার কথা বলছো তুমি?
নাদিমের কথায় মায়া বিরক্ত চোখে পাশে তাকাল নত মস্তিষ্কের রাফার দিকে। নাদিমের রাফার নাম মনে নেই, বিষয়টা রাফার কান পর্যন্ত যেতেই সে নীরবে অশ্রু ঝরাল। রাফা নত মস্তিষ্কে নিজের কান্না আটকাতে চাইলে মায়া রাফাকে কটাক্ষ করে বলল…
“তুই যারে স্বামী মানিস, সে তোর নাম জানে না। এই লোককে ভালোবেসে তুই আমার সাথে বেইমান…
মায়ার কথা শেষ করার আগে মাঝে ফোঁড়ন কাটল নাদিম। খানিকটা উত্তেজিত গলায় শুধাল…
“স্বামী? কিসের স্বামী? কার কথা বলছো তুমি মায়া?”
মায়া রাফাকে দেখিয়ে নাদিমকে বলল…

“আমার জায়গায় ওহ আপনাকে কবুল বলেছিল সেদিন। প্রশ্ন যদি আপনার করতেই হয়, তাহলে ওকে করুন। ওর নাম রাফা। আমার বান্ধবী। আপনার বিয়েতে কবুল বলা নারী রাফা।
মায়ার কথায় বেশ চমকালো নাদিম। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল নত মস্তিষ্কের রাফার দিকে। চট্টগ্রামে মায়ার সাথে দেখা করতে এসে যে নাদিম এমন সত্যের মুখোমুখি হবে সেটা জানা ছিল না ওর। মায়ার সঙ্গে নাদিমের দেখা করার পিছনে রাফার হাত ছিল। রাফার সাথে বিগত কয়েকদিন ধরে ফোনে কথা হচ্ছিল মায়াকে ঘিরে। নাদিম চাচ্ছিল মায়ার সাথে দেখা করতে। কিন্তু রিদ খানের জন্য সরাসরি মায়ার সাথে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছিল না বলেই রাফার সাথে যোগাযোগ করেছিল নাদিম। তবে এখানে নাদিম রাফাকে খুঁজে বের করেনি, বরং রাফা মায়া-নাদিমের বিয়ের পর থেকে নাদিমের খোঁজ নিতো প্রায়। এমনকি নাদিমকে রিদ খান মারার পর প্রায় বিশদিন সে হসপিটালে ছিল। নাদিমের হসপিটালে থাকাকালীন সময়ে রাফাই গিয়েছিল নাদিমকে দেখতে হসপিটালে। সেদিনের পর থেকে রাফা প্রায় নাদিমকে কল দিয়ে বা মেসেজ করে খোঁজ খবর নিতো। তবে নাদিমের জানা ছিল না রাফা নাদিমকে পছন্দ করে বা মায়ার জায়গায় কবুল বলা মেয়েটি রাফা ছিল। নাদিম খানিকটা অস্থির, উত্তেজিত হলো মায়ার কথায়। অধৈর্য্যে নেয় মায়াকে শুধিয়ে উত্তেজনায় বলল…

“একজনের বিয়েতে অন্যজন কবুল বললে বিয়ে হয় কিভাবে মায়া? এটা পাপ। তিন শব্দে কবুল বললেই বিয়ে হয়ে যায় না। তাছাড়া বিয়ের খুৎবা আমার আর তোমার নামে ছিল মায়া, এখানে তৃতীয় ব্যক্তি কবুল বললেও সেই বিয়ে গ্রহণযোগ্য হবে না। এই বিয়ের সম্মতি না ধর্মের আছে আর না আইনে। বিয়ে শুধু কবুল বলা নয়, এখানে পাশাপাশি আরও অনেক কিছুই থাকে, যার কিছুতে রাফার নাম উল্লেখ ছিল না। তাছাড়া কবুল যদি রাফা বলে থাকে, তাহলে বিয়ের রেজিস্টার পেপারে কে সাইন করেছিল মায়া? রেজিস্ট্রার পেপার তো তোমার আমার ছিল।
“আমি এতোকিছু জানি না। শুধু জানি আমি সেদিন কবুলও বলিনি, রেজিস্ট্রার পেপারে সাইনও করিনি।
“তুমি না জানলে তো হবে না মায়া। আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে, এখন তুমি সবকিছু থেকে সহজে ছাড়া পেয়ে যাবে, তা তো হবে না। তোমার অসুস্থতার দোহাই দেওয়ায় আমি বিয়ে করতে বসেছিলাম সেদিন। আমার কাছে তুমি আর তোমার সুস্থতা কাম্য ছিল প্রথমে, কিন্তু এখন তুমি আমাকে নিঃশেষ করে স্বার্থপরের মতোন পালিয়ে যাবে, সেটা তো আমি হতে দিব না।

নাদিমের কথায় মায়ার রাগ বাড়ল। জেদি গলায় বলল…
“আপনারা যা করার করুন। আমি গেলাম।
নাদিম মায়াকে থামিয়ে বলল…
“মায়া প্লিজ বাড়াবাড়ি করো না। আমি তোমাকে যেতে দিব না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমি শুধু তোমাকে চাই মায়া, রাফাকে নয়।
নাদিমের পরপর কথায় গা জ্বলে উঠলো মায়ার। রাগে, ক্ষোভে মায়া তৎক্ষণাৎ রাফার হাত চেপে ধরলো চলে যাওয়ার জন্য। নাদিমের সম্মুখে থাকলে পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে। তাছাড়া মায়া রিদকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে, সেজন্য মায়া ঝামেলা না বাড়িয়ে চুপচাপ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে চাইল। কারণ নাদিম এই মুহূর্তে কোনো কিছু বুঝার পরিস্থিতিতে নেই। সে এক প্রকার জেদ ধরে বসে আছে মায়াকে চাই বলে। তাই এই মুহূর্তে কেউ নাদিমকে বুঝাতে চাইলেও সে বুঝবে না। কারণ এই মুহূর্তে নাদিম সত্যিটা মানতে চাচ্ছে না। হয়তো একদিন ঠিকই মেনে নিবে সত্যিটা। মায়া রাফার হাত চেপে নাদিমকে এড়িয়ে বের হতে চাইলে মায়ার পথ পুনরায় আটকে দাঁড়ালো নাদিম। মায়াকে বাঁধা দিয়ে বলল…

“কোথায় যাচ্ছো?
মায়া শক্ত গলায় বলল…
“পথ ছাড়ুন ভাইয়া।
“আমার তোমার সাথে কথা শেষ হয়নি মায়া।
“আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।
নাদিম মায়াকে অনুনয় করে বলল…
“মায়া প্লিজ আমার কথা শোনো। একটু বসো। আমি তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলছি।
নাদিমের অনুনয়ে মায়া রাফার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল…
“আপনি পথ ছাড়বেন ভাইয়া? আমার আপনাকে অসহ্য লাগছে। আমি আপনার কোনো কথা শুনতে রাজি নই। আমার পথ ছাড়ুন প্লিজ! যেতে দিন আমাদের।
নাদিমের কন্ঠে অনুনয় পরিবর্তে জেদি সুরে বলল…

“তুমি কবুল না বললে এই বিয়ে হবে মায়া। ইসলাম মেয়েদের নীরবতাকেও সম্মতির লক্ষণ ধরে নেওয়া হয়।
নাদিমের মনগড়া কথায় মায়ার রাগে কটমট করলো। রাফার অশ্রুসিক্ত অপরাধী মুখটার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়া কিছু বলবে তার আগেই বিকট শব্দে ছিটকে দূরে সরে গেল মায়া আর রাফা। কারণ ততক্ষণে রিদ দক্ষ হাতে নাদিমের ঘাড় চেপে ধারাম শব্দে টেবিলের উপর ভারি মারতেই আর্তনাদের চিৎকার করলো নাদিম, ফ্লোরে লুটিয়ে পরে। নাদিমের কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে আহাজারি চিৎকার করে উঠলো রাফা। রিদ রাগে রি রি করে গর্জে উঠে বলল…

“হারামির বাচ্চা, কলিজা বড়ো হয়ে গেছে তোর না? রিদ খান থাকতে তাঁর বউয়ের সাথে সংসার করার স্বপ্ন দেখিস? জানে মায়া নাই না? বারবার মরতে আমার বউয়ের পিছনে আসিস?
রিদ গর্জনে পাশ থেকে চেয়ার উঠালো নাদিমকে মারতে। ততক্ষণে রাফা চিৎকার করে লুটিয়ে বসল নাদিমের মাথাটা কোলে চেপে। রাফার চিৎকারে বিস্ময়ে স্তব্ধতায় জমে গেল আসিফ। রাফার নাদিমকে নিয়ে প্রতিটা আর্তনাদের চিৎকারে যেন আসিফের বুক ব্যথার কারণ হলো। আসিফের জানাশোনা হিসাবে কোথায় যেন অমিলের দেখা দিলো। ভয়ার্ত মায়া দু’হাতে মুখ চেপে কম্পিত শরীরে দাঁড়িয়ে সিটিয়ে। রিদ রাফাকে উপেক্ষা করে হাতের চেয়ারটা মাথার উপর উঠিয়ে ফ্লোরে ফেলতে ফেলতে গর্জনের চিৎকারে বলল…
“হারামির বাচ্চারে মানা করেছিলাম আমার বউয়ের পিছনে আসতে, তারপরও আসলো। আসিফ আমার বন্দুক দে!”
রিদের কথায় ভয়ার্ত মুখে তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠলো রাফা। রিদের কাছে আকুতি মিনতি করে কাঁদতে কাঁদতে বলল…

“ভাইয়া প্লিজ নাদিমকে আর মারবেন না। উনি এমনিতেই অনেক অসুস্থ। মায়ার সাথে বিয়ের বিষয়টা ক্লিয়ার হতে এসেছিল। এখানে আমার ভুল, আমি মায়াকে ডেকেছিলাম। প্লিজ ভাইয়া নাদিমকে আর আঘাত করবেন না। উনি সত্যি অসুস্থ। প্লিজ ভাইয়া।
রাফার হু হু শব্দে কান্নায় আসিফ পাথর নেয় জমে দাঁড়াল। তার মনে হলো সে খুব পছন্দের কিছু হারিয়ে ফেলেছে হয়তো। নাদিমকে ঘিরে রাফা আহাজারি চিৎকার করছে, রাফা রক্তাক্ত নাদিমকে শুধু পছন্দ নয়, তার থেকেও গভীর কিছু ফিল করে। ক্ষিপ্ত রিদ রাফাকে উপেক্ষা করে নাদিমের কাছে পৌঁছাতে চাইলে মায়া দৌড়ে আসে। রাফার কিছু হোক মায়া চায় না। মায়া খুব ভালোবাসার মানুষদের মধ্যে রাফা একজন। মায়া রিদকে আটকানোর আগে আসিফ রিদকে পিছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে বলল…
“ভাই প্লিজ শান্ত হোন। আশেপাশে আমাদের লোক আছে। বড়ো স্যার এই রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় আছেন। আপনি নিচ তলায় ঝামেলা করলে বড়ো স্যারের নাম খারাপ হতে পারে। বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করুন। প্লিজ শান্ত হোন, সামনে নির্বাচন।

আসিফের কথায় রিদ রাগে দাঁতে দাঁত পিষল। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কটমট করে আসিফ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল…
“ছাড় আমারে!
আসিফ ছেড়ে দিতেই রিদ পাশের চেয়ারটায় লাথি মারতে মারতে বলল…
“শালার জিন্দেগি, বিয়া কইরাও শান্তি নাই। সব হারামি বাচ্চারা মরার জন্য আমার বউয়ের পিছনেই আসে।
কথাটা বলতে বলতে রিদ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ার দিকে তেড়ে গেল। শক্ত হাতে মায়ার গাল চেপে রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলল…
“মানা করছিলাম না বাড়ি থেকে বের হতে? তারপরও কেন বের হলি? আমাকে মানুষ মনে হয় না তোর? নাকি স্বামী থেকে নাগর বেশি প্রিয়? এই নাগরের জন্য বারবার আমার অবাধ্য হোস? এতো ভালোবাসা তোর নাগরের জন্য? তাহলে আমার সাথে আছিস কেন? যাহ চলে যা আমার জীবন থেকে। তোর মতো নারীর প্রয়োজন আমার নাই। রোজ একটা করে কাহিনি আর ভালো লাগছে না। না থাকবে বউ আর না থাকবে অশান্তি। যাহ বের হ আমার জীবন থেকে বেয়াদব।

কথাটা বলেই রিদ মায়াকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল। যে হিংস্রতায় রেস্টুরেন্টে ঢুকে ছিল ঠিক একই রাগের তোপে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। মায়া বিষণ্ণতায় দাঁড়িয়ে। ঠিক তার মিনিট যেতে না যেতেই রেস্টুরেন্টের দোতলা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো রাদিফ। ভাঙচুর আর নাদিমের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে রিদের রাগের কারণটা বুঝল রাদিফ। রাদিফ মায়ার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সূক্ষ্ম নজরে সবকিছু অবলোকন করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আসিফকে বলল…

“আসিফ ভাই, আপনি ছেলেটিকে হসপিটালে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করুন। আমি ভাবিকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।
আসিফ নিজের অসহনীয় ব্যথাগুলো বুকে চাপল। রাফার কোল হতে নাদিমকে উঠাতে গিয়ে দু’হাত কাঁপল আসিফের। অস্থির রাফা আসিফকে দেখলো না, বরং সে বেহুঁশ নাদিমের জন্য কাঁদতে ব্যস্ত। আসিফ লোক লাগিয়ে নাদিমকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই রাদিফ মায়াকে নিয়ে গাড়িতে বসল। উদ্দেশ্য মায়াকে খান বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সে পুনরায় এই হসপিটালে ফিরে আসবে। কারণ সকাল হতে তাঁরা আজকের বৈঠকের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছিল। রিদ শেষ রাতের দিকেই চট্টগ্রামে ফিরেছিল, তারপর থেকে রিদও এখানেই ছিল। মায়ার এখানে আসার খবরটি রিদের ছেলেদের মধ্যে কেউ দিচ্ছিল তখন। আলোচনা ছেড়ে রিদকে রাগান্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যেতে দেখে রাদিফ বুঝতে পেরেছিল হয়তো বড়ো কোনো ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু রাদিফ নিজেও বুঝতে পারেনি মায়া নাদিম ছেলেটির সঙ্গে দেখা করতে খান বাড়ি থেকে দূরে এতটা পথ চলে আসবে। রাদিফ গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে নত মস্তিষ্কের মায়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে ড্রাইভিং করতে করতে বলল…

“এখানে কেন এসেছিলেন ভাবি?
মায়া অপরাধীর ন্যায় বলল…
“আমি আমাদের বাসায় যেতে চেয়েছিলাম আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। মাঝে রাফা যে আমাকে এখানে নাদিম ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে আসবে বুঝতে পারিনি।”
রাদিফ মায়ার কথায় বলল…
“রিদ ভাই আপনাকে নিয়ে খুব সেনসিটিভ ভাবি। আপনাকে ঘিরে রিদ ভাইয়ের পাগলামি আমরা সবাই দেখেছি। সেজন্য বলবো প্লিজ আপনি কোথাও যাওয়ার আগে অন্তত ভাইকে একটা নক করে যাবেন কেমন?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে দিতে বলল…

“আচ্ছা।
রাদিফ পুনরায় ড্রাইভিংয়ে মনযোগী হলো। তক্ষুনি রাদিফের ফোনে কল আসল সুফিয়া খানের। রাদিফ ড্রাইভিং অবস্থায় সুফিয়া খানের কল রিসিভ করলো না। বরং কলটি কেটে দিয়ে ছোট মেসেজ পাঠালো যে, সে ড্রাইভিং করছে। ফ্রি হয়ে কল দিবে। রাদিফের মেসেজ পেয়ে সুফিয়া খান আর কল না করায় মায়া সেদিকে তাকিয়ে রইল। রিদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো এক মুহূর্তের জন্য ভুলে রাদিফের উদ্দেশ্যে বলল মায়া…
“ভাইয়া একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?
“জ্বি, অবশ্য!
মায়া খানিকটা সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বলল…
“আমি আম্মুকে খান বাড়িতে ফিরাতে চাচ্ছিলাম।
মায়ার কথাটা বেশ স্বাভাবিকভাবে নিয়ে রাদিফ বলল…

“সমস্যা নেই ভাবি, আপনি আনতে পারেন। এতে কেউ কিছু বলবে না আপনাকে, বরং সবাই খুশি হবে আপনার আম্মু আসলে। দরকার হলে আমি গাড়ি পাঠাবো আপনাদের বাড়িতে, আন্টিকে নিয়ে আসবে ড্রাইভার।
রাদিফের কথায় মায়া তৎক্ষণাৎ অসম্মতি জানিয়ে রাদিফকে শুধিয়ে বলল…
“আমি আমার আম্মুর কথা বলিনি ভাইয়া। আপনার আম্মুর কথা বলছিলাম। আপনারা সবাই এখানে একত্রে আছেন, অথচ আম্মু একা ঢাকা থাকেন। আম্মুর সাথে কেউ নেই থাকার মতোন। সেজন্য ভাবছিলাম আম্মুকে আমাদের সাথে খান বাড়িতে নিয়ে আসতে। তাছাড়া আব্বুও তো একা থাকেন। দুজনকে একত্রে করলে…
মায়া কথাগুলো বলতে বলতে থেমে যায় সংকোচে। রাদিফ মায়ার কথায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং রাদিফ বেশ ভাবলেশহীনভাবে বলল…

“আমার আম্মু-আব্বু এক হবে না ভাবি। আব্বুর কথা বলতে পারি না, তবে আমার আম্মু বেশ জেদি মানুষ, রিদ ভাইয়ের মতোন। কখনো কারও কথা শুনে নিজেদের ডিসিশন চেঞ্জ করে না। আমি ছোটবেলায় অনেক চেয়েছিলাম আম্মু-আব্বুকে একত্রে করতে, কিন্তু দুজনের কেউ রাজি হয়নি। এজন্য প্রথম প্রথম অনেক কান্নাকাটি করতাম, কিন্তু বড়ো হতে হতে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছি। আপনি হয়তো আমার মতো একদিন সবকিছু মানিয়ে নিবেন। একটু ধৈর্য্য ধরুন।
রাদিফের কথায় মায়া বেশ খারাপ লাগলো। তবে কোথায় যেন একটা ভরসা পেল রাদিফের কথায়। মায়া বেশ স্বতঃস্ফূর্ততায় বলল…

‘ তখন আপনি একা ছিলেন ভাইয়া, আজ আমি আপনার সাথে আছি। প্লিজ ভাইয়া চলুন না শেষ একটা বার চেষ্টা করি আম্মু-আব্বুকে একত্রে করার। প্লিজ ভাইয়া না করবেন না। কারণ আমি আম্মুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, উনার শক্ত খোলসের ভিতরে নরম একটা মন আছে। এতোকাল আপনারা সবাই আম্মুকে বলছেন আব্বুর সাথে একত্রে থাকতে, কিন্তু আব্বু কখনো আম্মুকে এটা বলেনি উনার কাছে ফিরে আসতে। এজন্য হয়নি আম্মুর ফেরা, হয়নি, তবে আমার বিশ্বাস আব্বু বললে নিশ্চয়ই আম্মু ফিরে আসবেন খান বাড়িতে। আমরা কি পারি না ভাইয়া শেষ একটাবার আব্বুকে দিয়ে আম্মুকে খান বাড়িতে ফিরাতে?

মায়ার কথাগুলো বেশ যুক্তিসঙ্গত মনে হলো রাদিফের। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভাবলো মায়ার কথাগুলো। রাদিফের মনে যেন হঠাৎই মায়ার কথায় আশার আলো খোঁজা পেল। মায়ার কথাটা আসলেই সত্যি, সুফিয়া খানকে এতোকাল পরিবারের মানুষ বলছিল খান বাড়িতে ফিরতে, কিন্তু কখনো নিহাল খান বলেনি বা আনতেও যায়নি সুফিয়া খানকে। সেজন্য হয়তো সুফিয়া খানের রাগ দীর্ঘ পনেরো বছরেরও কাটেনি। রাদিফ চট করে মায়ার কথায় সম্মতি দিয়ে বেশ উৎফুল্লতা দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল…
“চলুন ভাবি, শেষ একটা চেষ্টা না হয় করেই ফেলি। তবে আব্বুকে কিভাবে রাজি করাবেন এসবের জন্য?
মায়া রাদিফের কথায় খানিকটা চিন্তিত স্বরে বলল…
“আপাতত জানি না ভাইয়া, তবে রাতের ভিতরে কোনো একটা প্ল্যান করে ফেলব ইনশাআল্লাহ।
মায়ার কথায় রাদিফও তৎক্ষণাৎ বলে উঠল…
“ইনশাআল্লাহ।

খান বাড়িতে উল্লাসে আয়োজন চলছে মায়ার প্রেগন্যান্সিকে ঘিরে। মায়া প্রেগন্যান্ট, এই বিষয়টা সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে খান বাড়িতে। হেনা খান আর আরাফ খানের খুশি দেখার মতোন ছিল। হেনা খান তো খবরটা পেয়েই তিনি পুরো খান বাড়ির আত্মীয়দের মাঝে সুসংবাদ পাঠিয়ে দিলেন। আরাফ খান তো আরও একধাপ এগিয়ে। তিনি ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের সকল মিষ্টির দোকান খালি করে সকলের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করাও শেষ। নিহাল খানের দলের লোকদের মাঝেও সেই মিষ্টি বিতরণ করা শেষ। মিষ্টি ভাগ অবশ্য রিদও পেয়েছে। ডায়বেটিসের সমস্যা হওয়ার পরও তাঁকে নিহাল খান খুশিতে দু-দুবার মিষ্টি খাওয়ালেন। একের পর এক লোকজন এসে রিদকে সাদুবাদ জানাচ্ছে বাবা হওয়ার। অথচ রিদ তাতে হু হা কিছুই বলেনি। মূলত রিদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না এই বিষয়ে। বউ না ছুঁয়েও যদি সে বাবা হতে পারে?

তাহলে সে সত্যিই বাবা হতে চলেছে। এমন অদৃশ্য সন্তানের খুশিতে একটা মিষ্টি নয়, বরং কয়েক প্যাকেট মিষ্টি খেলেও রিদের ডায়বেটিস বাড়বে না, আর না প্রেশার হাই হবে। এইতো দুপুরের দিকে বউয়ের সাথে রাগারাগি করে রিদ রাদিফকে দিয়ে মায়াকে বাড়িতে পাঠালো, আর সন্ধ্যা হতে না হতেই তার কাছে মিষ্টি আসে, সে বাবা হতে চলেছে। তার বউ কি প্যাঁচ লাগিয়েছে সেটা রিদ জানে না, তবে রিদ যে বাবা হতে চলেছে এটাই সত্যি। এমনিতে সে একজন বদনাম পুরুষ। বউয়ের জন্য নাহয় আরেকটু বদনাম হলো। রিদ কাজ শেষ করে ক্লান্তিতে ঘরে ফিরলো প্রায় রাত একটার পর। সঙ্গে রাদিফ আর নিহাল খানও ছিল। মধ্য রাত হওয়ায় বাড়িতে তেমন কেউ জেগেছিল না, হেনা খান ছাড়া। আরাফ খান অনেকটা রাগ জেগে বসেছিল রিদের আশায়, কিন্তু রাত বেশ হওয়ায় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন একটা সময় পর।

এতে রিদ সে যাত্রায় বেঁচে যায় আরাফ খানের হাত থেকে, নয়তো মায়াকে ঘিরে দু-চারটে খোঁচাখোঁচি তো করেই ফেলতো আরাফ খান রিদকে। হেনা খান রিদ, রাদিফ, নিহাল খানকে তিনজনকে একত্রে বাসায় ফিরতে দেখে তিনি দৌড়ে ফ্রিজ হতে রিদদের জন্য তোলা মিষ্টি নিয়ে আসেন। একে একে সকলের মুখে অল্প মিষ্টি তুলে দিতেই রিদ সেই মিষ্টি আর মুখে তুলল না। বরং গম্ভীর রিদ মুখটা আরও গম্ভীর করে হনহনিয়ে চলে গেল নিজের রুমের দিকে। রিদকে বেশ কয়েক বার পিছন থেকে ডাকলেন হেনা খান। রিদ হেনা খানের ডাকে উত্তর না করে নিজের অন্ধকার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালো। বিছানায় এলোমেলো মায়াকে শুয়ে থাকতে দেখে রিদের গম্ভীরতা আরও বাড়ল।

একেতো মায়া রিদকে না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছে, দ্বিতীয়ত নাদিমের সঙ্গে দেখা করেছে যে ছেলেকে ঘিরে রিদ-মায়ার সম্পর্কে ফাটল ধরতে বসেছিল। তৃতীয়ত রিদ রেগে আছে সেটা জানার পরও মায়া কেন রিদের অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়লো, তাতে রিদের ভেতরের রাগ বাড়ল। বউ হিসাবে রিদ চায় মায়া রিদের আশেপাশে থাকুক। রিদের ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো পূরণ করুক বাকি বউদের মতো। অথচ মায়া তার কিছুই করছে না। রিদ ব্যস্ততায় মায়াকে সময় দিতে না পারলেও মায়া রিদের অপেক্ষায় বসে থাকে না, রিদকে সময় দেয় না। রাগান্বিত রিদ গম্ভীর থেকে আরও গম্ভীর হলো। গোসল সেরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লো।

অথচ রিদের রাতের মেডিসিন ছিল। সারাদিনের ব্যস্ততায় রিদ মাথার টনটনে ব্যথা নিয়ে শুয়ে পড়লে তার খানিকটা সময় পরই মায়ার ঘুম ভাঙলো হঠাৎই। আবছায়া অন্ধকারে রিদকে পিঠ মুড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া উঠে বসল। রিদের অপেক্ষা করতে করতে কখন জানি চোখ লেগে গিয়েছিল ঘুমে মায়ার। রিদকে পিঠ মুড়ে শুয়ে থাকতে দেখে মায়া এগিয়ে গেল রিদের দিকে। রিদের পিঠে হাত রেখে ডাকতে চাইলে রিদের গায়ের গেঞ্জিটা স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা পেল। রিদ ভেজা জিনিস পরে থাকতে পারে না। অথচ আজ ভেজা শরীরে শুয়ে পড়েছে, বিষয়টা মায়ার ধারণাতে আসতেই বুঝতে পারলো রিদের অভিমানে কারণটা। মায়া রিদের পিঠ ঘেঁষে বসে রিদের মাথায় ভেজা চুলে হাত চালিয়ে খুবই ধীর গলায় ডাকল রিদকে…

“এই যে শুনছেন? ঘুমিয়ে গেছেন? এই যে?
রিদ উত্তর করলো না। ঠায় সেভাবে জেদ করে শুয়ে থাকল। মায়া পুনরায় একই ভাবে ডাকল রিদকে…
“এই যে শুনছেন? উঠুন। ভেজা মাথায় কেন শুয়েছেন? আপনার না ভেজা মাথায় জ্বর আসে? উঠুন, মাথা মুছবেন?
কথাটা বলতে বলতে রিদকে অল্প ধাক্কা দিয়ে নড়াতে চাইল মায়া। কিন্তু রিদ নড়লো না। মায়া বুঝতে পারলো রিদ সবেমাত্র গোসল করে শুয়েছিল, তাই রিদ এতো অল্প সময়ে ঘুমিয়ে যায়নি। অন্ধকারে মায়া বিছানার পাশ হতে নিজের ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াল। বিছানা হতে নামতে নামতে দীর্ঘ কালো চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে হাত খোঁপা করতে করতে এগোল সুইচবোর্ডের দিকে। অন্ধকার রুমের আলো জ্বালিয়ে বিছানার দিকে পুনরায় এগিয়ে গেল। রিদের সম্মুখে ফ্লোরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে রিদের বাহু টেনে রিদকে বসাতেই, রিদ রাগে মেজাজ দেখিয়ে বলল…
“কি সমস্যা? টানাটানি করছো কেন? কি চাই?

মায়া রিদের রাগের পাত্তা না দিয়ে গায়ের ওড়নাটা চালাল রিদের মাথায়। রিদের ভেজা মাথা মুছতে মুছতে বলল…
“আপাতত আপনাকে চাই। আপনি হলেই চলবে। হবেন আমার?
রিদ মায়ার হাতসহ ওড়নাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল…
“নাহ! সামনে থেকে সরো। ঘুমাব আমি।
মায়া পুনরায় একই ভাবে রিদের মাথায় নিজের ওড়নাটা চেপে মুছতে মুছতে বলল…
“সরা যাবে না। এতক্ষণ আপনি বাহিরে ছিলেন, আমি কিছু বলেছি? এখন ঘরে এসেছেন মানে আমার কথা শুনতে হবে আপনার।

রিদ জেদি গলায় বলল…
“আমি কি বাধ্য তোমার কথা মানতে? মানব না আমি, যাও সামনের থেকে।
মায়া পুনরায় রিদের কথার অপেক্ষা করে বলল…
“রাতে কিছু খেয়েছেন? নাকি এমনিই শুয়ে পড়েছেন?
নিশ্চুপ রিদ মায়ার উত্তর করলো না। রিদের গম্ভীর নীরবতায় মায়া বুঝতে পারলো রিদ না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। মায়া রিদের মাথা মুছে, কর্বাট হতে রিদের জন্য একটি টি-শার্ট বের করে আনলো। রিদের হাতে দিতে দিতে বলল…
“আপনার গায়ের ভেজা টি-শার্টটি চেঞ্জ করে এটা পড়ুন। আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।

কথাটা বলে মায়া রিদের হাতে টি-শার্টটি তুলে দিতে রিদ সেটি বিছানায় ফেলে দিল। মায়া চলে যেতে গিয়েও রিদের কান্ডে ফিরে এলো। রিদের কোমরের দুপাশে কাপড় চেপে মায়া টেনে খুলল রিদের মাথা দিয়ে। মায়ার আনা রিদের জন্য টি-শার্টটির ভাঁজ খুলে রিদকে পরাতে গিয়ে মায়ার দৃষ্টি থামে রিদের প্রশস্ত বাহুর দিকে তাকিয়ে। রিদ সত্যি আগের থেকে অনেকটা প্রশস্ত হয়েছে। শরীর ফিকড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে রিদের বাহুর মাংসপেশি। মায়া ঘোর লাগা দৃষ্টি রিদের প্রশস্ত শরীরে আটকে যেতে, মায়ার মনে হলো রিদ আগের থেকে আরও সুদর্শন হয়েছে খানিকটা মোটা হওয়ায়। মায়া ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিদকে টি-শার্টটি পরালো। মায়ার কর্মকাণ্ডে রিদের সাথেও মায়ার বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো। মায়ার চুরি করার পরার ন্যায় তৎক্ষণাৎ পালিয়ে গেল রুম হতে রিদের জন্য খাবার আনার বাহানা বানিয়ে। মিনিট দশকের মাথায় ফিরে এলো রিদের জন্য ট্রে-তে খাবার সাজিয়ে। রিদের সম্মুখে খাবার ট্রে রেখে মায়া আবদার করে বলল…

“আমি আপনাকে খাইয়ে দিই?
মায়ার কথা শুনেই রিদ মুখ হাঁ করলো। যেন রিদ এই অপেক্ষাতেই বসে ছিল। রিদকে হাঁ করতে দেখে মায়া তৎক্ষণাৎ ট্রে হতে খাবারের প্লেট উঠালো। রিদের বংশগত ডায়বেটিসের সমস্যা থাকায় তাঁকে প্রায় রুটি খেতে দেখা যায়। তাই মায়া রিদকে এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে সিদ্ধ সবজির সঙ্গে রিদের মুখে দিতে সেটি রিদ মুখে নিয়ে চিবোতে লাগল। মায়া বেশ সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে রিদকে খাওয়ালো। খাওয়া শেষে রিদের মেডিসিনের বক্সটাও রিদের হাতে তুলে দিতে রিদ সেখান থেকে নিজের রেগুলার মেডিসিনগুলো প্যাকেট হতে ছাড়িয়ে হাতে নিলো। মায়া রিদের হাতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই রিদ সম্পূর্ণ পানিটা পান করে মায়ার হাতে খালি গ্লাস তুলে দিতে মায়া সেটি খাবার ট্রে-তে পুনরায় রাখতে রাখতে বলল…
“দুপুরের জন্য সরি। আপনাকে না বলে ঐভাবে বের হওয়ার জন্য আবারও সরি। আসলে আমি একটু আমাদের বাসায় যেতে চেয়েছিলাম, রাফাকেও বলেছিলাম আমাদের বাসায় যেতে, কিন্তু রাফা আমাকে ঐভাবে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে সেটা ভাবিনি। প্লিজ আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আর আপনাকে না বলে কোথাও যাব না, প্রমিস।
রিদ মায়ার কথা উত্তর না দিয়ে বরং পাল্টা প্রশ্ন করে বলল…

‘ তুমি প্রেগন্যান্ট হলে কিভাবে?
রিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়া খানিকটা ইতস্ততবোধ করে বলল…
‘ সবাই যেভাবে হয় সে-ভাবে হয়েছি।
‘ সবার মতো কি এমন করেছি যে তুমি প্রেগন্যান্ট হলে?
রিদের কথায় মায়া হঠাৎ লজ্জা পড়ে গেল। রিদের প্রহর দৃষ্টি এরাতে পিঠ মুড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মিনমিন গলায় বলল…
‘ এমনই এমনই হয়েছি আরকি!

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৭

রিদ মায়ার বাহু টেনে নিজের দিকে ফিরাতে ফিরাতে বলল…
‘ এমনই এমনই কিভাবে হয় সেটা বুঝাও আমাকে। আমিতো আজ পযন্ত শুনলাম না কেউ এমনই এমনই বাবা হতে। আমার কঠোর পরিশ্রম করার আগেই ফল পেয়ে গেলাম। এমন চমৎকার কিভাবে হলো সেটার ব্যাখা দাও।

রিদ মায়ার প্রেমগাঁথা পর্ব ৬৮