ছায়ার মুখোশ পর্ব ৯
তাজরীন খন্দকার
বেলাগাম মানুষের উড়াউড়ি চলে ধরা পড়ার আগ পর্যন্তই! ধরা পড়লেই তাদের উড়ার পাখাদুটো ধসে পড়ে। তারপর ছটফট করে মরে,আর সেই লাগামহীন কর্মকাণ্ডের জন্য কাতরে মরে!
এই যেমন, এই মূহুর্তে ফাইজা যেভাবে তার ভাবির সহানুভূতি পেতে কাতরে মরছে, দুচোখ জুড়ে অসহায়ত্বের ছাপ!অথচ কিছুক্ষণ আগেও তার এতো ক্ষমতা ছিলো যে তার ভাবিকে দেওয়া ফোন তার নিজের দখলে নেওয়ার কথা ভেবে বসেছিলো।
আরিদা ফাইজার পাশে থেকে নিজের ফোনটা তুলে নিলো। আর ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে ফোনটাকে আবার নিজের পাশে রাখলো, আর রাগ রাগ স্বরে বললো,
‘ ফয়সালের সাথে তোমার সম্পর্ক কতোদিন?
ফাইজা জবাব দিলো,
‘ ৫ মাস৷
আরিদা তার কপালে হাত দিয়ে অস্থিরতার সাথে বলে উঠলো,
‘ উফফ! তুমি বেকুব? ছেলেটা ইচ্ছা কইরা তোমারে প্রেমের ফাঁদে ফালাইলো, এখন অব্দি সেইটাও বুঝলা না?
ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
‘ কিয়ের ফাঁদ? ফয়সালভাই আমারে অনেক চায়। বিয়া করনের লাইগা পাগল হইয়া আছে,তাহলে ফাঁদ হবে ক্যান? অন্য পোলাপানের মতো দুইদিন পর ছাইড়া চইলা যাওয়ার পোলা না।
বলেই চোখের পানি মুছতে লাগলো।
আরিদা আরেকটু রাগী হয়ে বললো,
‘ হ্যাঁ বিয়া তো করতে চাইবো অই! কারণ ওর প্রতিশোধটা বিয়ার পরেই দরকার।
কথাটা বলেই আরিদা থামলো, সে ফাইজার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ ফাইজা তোমার ভাবি কেমনে মারা গেছে?
ফাইজা নড়েচড়ে বসলো। আরিদার থেকে একটু দূরে যাওয়ার চেষ্টা করে বললো,
‘ ভাবির অনেক জ্বর ছিলো, এরপর….
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ মিথ্যা বইলোনা ফাইজা। আমারে তুমি সত্যি কওনের ওয়াদা দিছো।
‘ মিথ্যা হইবো ক্যান? আপনারে কেউ কিছু কইছে? ভাবি তো এমনেই মরলো, কারোর হাত নাই৷
‘ হ্যাঁ ফয়সাল কইছে তোমার ভাই দায়।
ফাইজা থতমত করে বললো,
‘ ফয়সালভাই এটা কইতেই পারেনা। আমার ভাইরে ক্যান দোষ দিবো? আর কিসের ফাঁদ কনতো? উনার উদ্দেশ্য হইতে পারে আমার সাথে প্রেম কইরা দুই পরিবারের সম্পর্ক ঠিক রাখন, যেন উনার ভাইগ্না ভাগ্নিরে দেখনের সুযোগ পায়। কোনো প্রতিশোধ টতিশোধ না৷ বুঝছেন?
আরিদা চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘ তাহলে আমি ফয়সালরে কেমনে চিনি?ফাইজা শুনো আমরার লগে আজকাই ফয়সালের দেখা হইছে, তোমার ভাইরে অনেএক হুমকি দিছে। আমাদের পরিণতি খারাপ করে ছাড়বে। আচ্ছা আমাদের দেখা হওনের ব্যপারে কিছু কইছে তোমারে?
‘ না তো এসব নিয়া কখনোই কিছু কয়না। আমাদের মাঝখানে পরিবারের কোনো ঝামেলা নাই ভাবি। ফয়সালভাই অইরকম ছেলে না।
ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
‘ তাহলে তুমি এইডাও জানোনা তোমার ভাইয়ের নামে মামলা কে করছিলো?
ফাইজা হাত উঁচিয়ে বললো,
‘ আবার বইলেন না যে ফয়সালভাই করছে৷ এইডা কইলে আপনার কোনো কথাই বিশ্বাস করুম না।
আরিদা ফাইজার বিছিয়ে রাখা হাতের উপর আলতো একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
‘ বিশ্বাস দিয়া আমার কোনো কাজ নাই, আমার এখন উচিত তোমার ভাইরে বিষয়ডা জানানো। যা করনের উনিই করবে।
ফাইজা খপ করে আরিদার হাত ধরে ফেললো আর বললো,
‘ আপনি কি চান?
আরিদা ফাইজার ফোনটা টান দিয়ে নিজের কব্জায় এনে বললো,
‘ আমি চাইনা তুমি আর ফয়সালের লগে কথা কও। আজ আর এক্ষণ থেইকা সব যোগাযোগ বন্ধ আর মন থেইকাও মুইছা ফেলো।
ফাইজার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে৷ সে নিরুপায়। ফয়সাল আগে ভালো ছিলোনা, উগ্র আচরণের জন্য তার ভাই কখনোই ফয়সালকে পছন্দ করেনা। তার বোনকে ভালোভাবে কখনোই ওই ছেলের হাতে তুলে দিবেনা যআ ফাইজা জানে। কিন্তু ফয়সাল তো এখন ভালো হয়ে গেছে, সে খারাপবন্ধুদের ত্যাগ করেছে, উল্টাপাল্টা জিনিস খাওয়া ছেড়েছে,এমনকি সিগারেটও ছেড়ে দিয়েছে। ফাইজার জন্য সে খারাপ অভ্যাসকে তুড়ি মেরে ছেড়ে দিতে পারে তাইতো বলেছিলো! ফয়সাল মিথ্যা বলতে পারেনা, হয়তো তাকে ফয়সালের থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করছে। ফয়সাল তাকে কথা দিয়েছে, তার কিছু কাজ গুছিয়ে তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে, ততদিন পর্যন্ত সম্পর্কের কথা গোপন রাখতে হবে। পরে সবাই এমনি মেনে নিবে।
এই মূহুর্তে তার ভাবির কথা মেনে নেওয়াই ভালো, জেনে গেলে সবকিছু কঠিন হয়ে যাবে।
আরিদা ফাইজার সামনে রাশেদকে ফোন দিয়ে বললো,
‘ বাচ্চাদের এই রুমে নিয়া আইয়েন।
ফাইজা বললো,
‘ ওরা সবাই আমার লগে থাকবো? আম্মা কইছে নাকি?
আরিদা বললো,
‘ আমি কইছি। আর আমি যা বলুম তুমি তাই করবা বলেছিলা, আম্মারে এই নিয়া কিছু কওনের দরকার নাই।
ফাইজা মাথা নাড়লো। এদিকে রাশেদ সব বাচ্চাকে একে একে নিয়ে আসতে লাগলো, রাইসার ৫ বছর, আর রাহাদের ৭ বছর, অন্যদিকে রাফির ১০ বছর। এতো এতো বড় বড় বাচ্চা আনতে গিয়ে রাশেদ হাঁপিয়ে গেলো। সবাইকে রেখে সে হনহনিয়ে রুমে চলে গেলো। আরিদা কিছুক্ষণ থেকে তাদেরকে ভালোভাবে শুইয়ে মশারী টানিয়ে দিয়ে ফাইজাকে বললো,
‘ ঘুমাইয়া যাও। ফোন ছাড়া ঘুম ভালা হইবো আশা করি! শুভ রাত!
ফাইজা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। উপরে অসহায়ত্বের ছাপ থাকলেও ভেতরে ভেতরে মনে হয় গালি দিচ্ছে।
কিন্তু আরিদার মজা লাগছে, সাথে একটা ছন্দ মনে পড়ছে ‘পাখি করেনা কোনো শব্দ, কারণ হয়েছে সে জব্দ’।
আরিদা খাওয়ার জন্য টেবিলের উপরে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরতে ভরতে রুমের দিকে খেয়াল করে দেখলো রুমের লাইট অফ।
রাশেদ কি ঘুমিয়ে গেলো নাকি? আরিদা পানি খাওয়া শেষ হলে আস্তে আস্তে রুমে প্রবেশ করে দেখলো টি টেবিলে একটা মোমবাতি জ্বলছে, অল্প আলো। মেঝেতে রাশেদ বসে আছে। আরিদা আস্তে আস্তে গিয়ে রাশেদের অপরপাশে বসে টেবিলে খেয়াল করে দেখলো স্বরমালাই রাখা। ঘাঢ় দুধের ঘ্রাণে চারদিক মৌমৌ করছে উফফ! রাশেদ কি করে জানে আরিদার এসব মিষ্টান্ন পছন্দ? কখন আনলো?আরিদা আবছা আলোতেই কাঁটা চামচে দুধে জবজবা একটা মিষ্টি মুখে পুরে দিলো। রাশেদ হেসে বললো,
‘ কেমন?
আরিদা খাওয়ার মধ্যে অস্পষ্ট করে বললো,
‘ দাউন দাউন!
শেষ হওয়ার আগেই আরেকটা মুখে দিলো। তখনি হেঁচকি উঠে গেলো। রাশেদ আরিদার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিলো।
আরিদা মুখে নিয়ে দেখলো এটা কোলড্রিংস। গলায় আটকে যাওয়ারোধ হওয়ার পর আরিদা খাওয়া থামিয়ে কোলড্রিংসের দিকে তাকালো। তারপর রাশেদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দৃষ্টিনন্দন একটা সুন্দর মূহুর্তে আরিদা বলে উঠলো,
‘ এই কোকে তাইলে আজ জন্মনিরোধের ওষুধ মিশাইছেন? এই লাইগাই এতো আয়োজন?
বলেই আরিদা উঠে আলো জ্বেলে দিলো। রাশেদ ভেবাচেকা খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ কি কও এইসব?
আরিদা এগিয়ে গিয়ে রাশেদের হাত টেনে তার মাথায় রেখে বললো,
‘ মাথায় হাত রাইখা কন তো? মিশান নাই?
রাশেদ সাথে সাথে হাত নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। আরিদা পিছিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘ ক্যান? আমি কি অবুঝ? আমার সাথে কথা কওন যায়না? বিরুদ্ধে গেছি কোনোবার?
রাশেদ এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
‘ না, আম্মা মানা করছে কইতে।
আরিদা রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
‘ আমার বাচ্চা হইলে সম্পত্তিতে ভাগ বসাইবো তাই? কারণ গরীবের মাইয়া আনছে কেবল দাসীবান্দী হইয়া থাকতে,খায়বো থাকবো এইটাই ঢের। নাকি আগের বউয়ের বাচ্চাদের কদর করবোনা সেইজন্য? কোন উদ্দেশ্যে বিয়ের পর থেইকা জামাইয়ের লগে থাকতে দেয়না? আবার থাকতে দিলে লুকাইয়া ওষুধ খাওয়াইতে কয়? আপনাদের উদ্দেশ্য ভালো কইবেন না, ভালো হইলে আলোচনা করা যাইতো। আমি বাচ্চার লাইগা উতলা হইয়া যাই নাই!
রাশেদ গিয়ে আরিদার বাহুতে হাত রেখে বলতে চাইলো,
‘ উদ্দেশ্য ভালাই, শুধু তুমি কেমনে নিবা সেইটা ভাইবা…
‘ ধরবেন না। ধরলে হাত কাইটা গলায় ঝুয়ালা দিমু। কি রংচঙ মাখায়া কাজটা করে চিন্তা করন যায়?!
বলতে বলতে আরিদা পেছন ঘুরে গেলো। রাশেদ আবারও কিছু বলার জন্য আরিদাকে ছুঁতে গেলেই আরিদা ঘাড় বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
ছায়ার মুখোশ পর্ব ৮
‘ আমি বারেবারে সন্দেহ কইরাও আবার বিশ্বাস করছি। মনে হইছে আপনার দোষ থাকতে পারেনা,অপবাদ হইতে পারে। কিন্তু আপনি যেই নাটক জানেন তাতে সেই ভুল ভাইঙা গেছে। আপনি নির্দোষ হইতেই পারেন না।
এই কথার মধ্যে রাশেদ বলে উঠলো,
‘ ফাইজার মোবাইল তোমার হাতে ক্যান?