প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪
আদ্রিতা নিশি

পরিত্যক্ত গোডাউনের ভেতরের পরিবেশ সাধারণত খুবই নির্জন এবং গা ছমছমে। চারপাশে ধুলো জমে আছে। গোডাউন দীর্ঘদিন বদ্ধ অবস্থায় থাকায় বিদঘুটে গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে আর ভেতরের পরিবেশ কেমন স্যাঁতসেঁতে। ছাদ থেকে ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল এবং ভাঙা দরজা-জানালার কারণে সূর্যের আলো খুব কম প্রবেশ করছে। সকাল হয়েছে তো বোঝার উপায় নেই।বিদঘুটে গন্ধটা ধুলো-মাটির সাথে পুরোনো কাঠ আর স্যাঁতসেঁতে ভেপসা পরিবেশের মিশ্রণ। একপাশে পুরোনো মালপত্র বা ভাঙাচোরা বাক্স পড়ে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতা কাগজ কাচের টুকরো দৃশ্যমান। পরিত্যক্ত গোডাউনের স্যাতস্যাতে পচা কাঠের গন্ধে ভরা অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ছোট রুমের দেখা মিলছে।

সেখানে একটি ভাঙাচোরা চেয়ারে একজনকে শক্ত মোটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার দেহ আর চেয়ারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। ঘরের শীতল বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ, দেয়ালের ফাটলে জমে থাকা শ্যাওলা আর ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির ধারা পরিবেশকে গুমোট করে তুলেছে। ব্যক্তিটির চেহারা অর্ধেক অন্ধকারে ঢাকা। তবে যা দৃশ্যমান তা খুবই ভয়ানক। ব্যক্তিটির ফোলা চোখ, ফেটে যাওয়া ঠোঁট, আর মুখের পাশে জমে থাকা র*ক্তের শুকনো দাগ। কপাল বেয়ে মেঝেতে পড়ছে তাজা গরম র*ক্ত। মাথা নিচের দিকে হেলে গেছে। শরীর দুর্বল এবং নিস্তেজ। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। থেমে থেমে দীর্ঘ শ্বাস নিচ্ছে। হাত-পায়ের র*ক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে ফুলে উঠেছে এবং তার আঙুলগুলো মৃতের মতো নীলচে দেখাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শরীরের শার্ট ছেড়া,সেই ছেড়া অংশ দিয়ে শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কেমন কালসিটে দাগ পড়েছে। কিছু জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তার চোখের গভীরে তীব্র যন্ত্রণা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে ব্যক্তিটি। এখান থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। ব্যক্তিটি জানে সে গোডাউনে একা নয় আরও কয়েকজন লোক আছে। তারা গোডাউনের বাহিরে অবস্থান করছে।শুধু সময় আর অপেক্ষা, যা এখন তার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গোডাউনের মরিচীকা ধরা গেট খুলে প্রবেশ করল সারহান। লোহার গেটের কর্কশ শব্দে কেঁপে উঠল ভেতরে থাকা বন্দী। তার পেছনে আবির এবং ইনান সহ আরও দুজন দেহরক্ষী অনুসরণ করে প্রবেশ করল। আশে পাশে না তাকিয়ে দাম্ভিকতার সহিত শাণিত পায়ে এগিয়ে গেল চেয়ারে বেঁধে রাখা ব্যক্তিটির দিকে। ব্যক্তিটি কারো আসার আভাস পেয়ে দুর্বল চোখে সামনের দিকে তাকায়। ক্ষীণ আলোয় চোখে পরে কালো শার্ট প্যান্ট পরিহিত সুঠামদেহী পুরুষালী অবয়ব।পেছনের মানুষগুলোও চোখে পরল তার। ব্যক্তিটি জানে সে এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর কব্জায় বন্দি। এতোক্ষণ শান্ত থাকলেও অশান্ত হয়ে উঠল সে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। এতোটুকু জানে আজ তার জীবন শেষের পথে।

“ মেহমুদ রঈস। নয়ন তালুকদারের একান্ত বাধ্যগত সুপারী কি*লার গুড মর্নিং। ”
সারহানের দৃঢ় শান্ত স্বর মেহমুদকে বিচলিত করে তুলল। আতংকগ্রস্থ হয়ে নড়ে উঠল। দন্ডায়মান মানবটির দিকে নির্জীব চোখে তাকিয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে উত্তর দিল ;
“ গুড মর্নিং এমপি সাহেব। ”
সারহান হাসল। আবিরকে হাত দ্বারা কিছু একটা ইশারা করল। আবির তৎক্ষনাৎ একটা চেয়ার এনে রাখল সেই স্থানে। সারহান শার্টের হাতা গুটিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে শরীর এলিয়ে বসল। অতি শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর খাতির যত্ন কেমন লাগল? কোনো কিছুতে কম পড়েনি তো?”
মেহমুদ হচকচিয়ে উঠল। ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিতে বলল;

“ আমায় মাফ করে দিন এমপি সাহেব। আর কোনোদিন এই ভুল করব না। ”
সারহানের মুখশ্রী অস্বাভাবিক কঠোর হয়ে উঠে। তবুও স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয় মেহমুদ রঈস। ”
“ আপনার খাতির যত্নের কোনো কমতি ছিল না। ”
“ সারহান কখনো কারো খাতির যত্নের কমতি রাখে না। ”
“ আমায় যেতে দিন এমপি সাহেব। ”
মেহমুদ আকুতি মিনতি করে বলল। কিন্তু সারহানের মন নরম হলো না। বরং চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুরুষালি পেশীবহুল ইস্পাত-দৃঢ় হাত দ্বারা মেহমুদের গলা চেপে ধরলো। হিসহিসিয়ে বলল;
“ ইউ ব্লাডি বিচ! তোর সাহস কি করে হলো আমাকে শু*ট করার। তোর জন্য ফাইরুজ ম*রতে
ম*রতে বেঁচেছে। এতো বড় কাহিনী ঘটিয়ে বলছিস তোকে ছেড়ে দিতে ? ”
মেহমুদ রঈসের জিহবা বের হওয়ার উপক্রম। চোখ দুটো উল্টে আসার জোগাড়। চোখ বেয়ে নির্গত হচ্ছে অশ্রু কণা। মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে মৃত্যু ভয়। ছটফটিয়ে বলল;

“ আমি আপনাকে শু*ট করতে চাইনি। কিন্তু নয়ন তালুকদার আমাকে হুমকি দিয়েছিল আপনাকে না মা*রলে আমার ছোট্ট পাঁচ বছরের মেয়েটাকে মে*রে ফেলবে। আমার মেয়েটা এখনো ওই জানো*য়ারের কাছে আছে।কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে কাজটি করেছি।”
সারহান মেহমুদ রঈসের গলা ছেড়ে দিল। লোকটা ছাড়া পেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। কাশতে কাশতে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার জোগাড় প্রায়। সারহান আবিরকে আদেশ করল ;
“ মেহমুদ রঈসের মেয়েকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা কর। আর একে হসপিটালে এডমিট কর। হসপিটালে অবশ্যই আমার লোক সেট করে রাখবি। ”
আবির মাথা নাড়িয়ে বলল;
“ কাজ হয়ে যাবে। ”

সারহান একপলক মেহমুদ রঈসের দিকে তাকাল। লোকটির বয়স ত্রিশের ওপরে হবে হয়ত। উচ্চতা চলনসই, জীর্ণ শীর্ণ হ্যাংলা পাতলা শরীর। মুখভর্তি দাড়ি আর কপালের একপাশে ক্ষতের দাগ। লোকটির মুখে ফুটে উঠেছে একটু প্রশান্তির ভাজ। তা দেখে ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসল সারহান। কাঠিন্যতা এটে বলল;
“ সারহান ইদায়াত চৌধুরী এতো সহজে তোকে ছেড়ে দেবে ভাবলি কি করে? আমার ফ্যামিলি মেম্বারের শরীরে বুলেট লেগেছে মানে সেই বুলেট আমার শরীরে লেগেছে। আজ ছেড়ে দিচ্ছি বলে ভাবিস না তোর কার্যকলাপ মাফ করে দিয়েছি। আমার নজর একবার যার ওপর পড়ে তার আয়ু নির্ধারণ আমি করি। ”
মেহমুদ একদম স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, তার গলার কাছে যেন কোনো শব্দ আটকে গেছে। ঠোঁট কাঁপলেও তা থেকে কোনো বাক্য বের হলো না।

আবির আর ইনান অবাক দৃষ্টিতে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দুজন ভাবতে পারছে না, এতোকিছুর পরও সারহান এতটা শান্ত কীভাবে। সারহানের পরিচিত রাগ এবং তীক্ষ্ণ প্রতিশোধস্পৃহা তারা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু আজকের এই শীতল শান্ত স্বর এবং হাসি তাদের বিভ্রান্ত করছে।তারা একে অপরের দিকে একবার তাকাল। তাদের চোখে একই প্রশ্ন—এমপি সাহেব আজ কেন ধৈর্য ধরে মেহমুদকে এভাবে খেলাচ্ছেন? তারা দুজনই মনে মনে ভাবছিল, “আজই তো মেহমুদ রঈসের শেষ দিন হওয়ার কথা। তবে সারহান কেন এখনো দেরি করছে?”সারহান ততক্ষণে তার হাতের আঙুলগুলো একে অপরের সঙ্গে ফাঁসিয়ে রেখে আরেকটি ব্যঙ্গমাখা হাসি দিল
আবির মেহমুদ রঈসকে কটাক্ষ করে বলল;
“ কংগ্রাচুলেশনস মেহমুদ রঈস এই যাত্রায় সারহানের কবল থেকে বেঁচে যাওয়ার জন্য। ”
ইনান ও দাঁত কেলিয়ে বলল ;

“ শুভ কামনা রইল তোর ভাঙ্গা চোরা বেহুদা জীবনের জন্য। ”
সারহান দুজনের দিকে সূঁচালো দৃষ্টি ফেলতেই তারা হচকচিয়ে চুপ হয়ে গেল। সারহান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। মেহমুদ রঈসকে উদ্দেশ্য করে বজ্র কন্ঠে হুংকার ছাড়ে;
“ শুধু মাত্র তোর নিষ্পাপ বাচ্চাটার জন্য তোকে বাঁচিয়ে রাখলাম। নয়ত আজকেই তোর জীবনের দ্য এন্ড হতো। ”
মেহমুদ রঈস মাথা নিচু করল। নিষ্প্রাণ হয়ে বলল;
“ আপনি আমায় বাঁচিয়ে রাখলেও নয়ন তালুকদার আমাকে বাঁচতে দেবে না। এমপি সাহেব আমার একটা অনুরোধ রাখবেন ? ”

“ কি অনুরোধ? ”
“ জানেন এমপি সাহেব হৈমীর মা নেই। আমি আমার মেয়েকে মায়ের মতো আগলে রাখি। যদি আমার কিছু হয়ে যায় মা ম*রা বাচ্চাটাকে আগলে রাখবেন। বাবা হয়ে আমার আপনার কাছে অনুরোধ রইল এমপি সাহেব।”
সারহান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু বলল;
“ অপরাধের জগতে না জড়ালে আজ তুই নিজের মেয়েকে নিয়ে শান্তিতে থাকতি।”
একটু মৌন থেকে আদেশের স্বরে বলল;
“ গার্ডস মেহমুদ রঈসকে দ্রুত হসপিটালে এডমিট করো আর বাচ্চাটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করো। ”
সারহান ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। এগারোটা পঁচিশ বাজে। এখুনি বাড়িতে ফিরতে হবে। তানিয়া বেগমের আদেশ বারোটার মধ্যে চৌধুরী বাড়িতে যেন উপস্থিত থাকে। সারহান আবিরের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলল;
“ বিকেলের মিটিং ক্যান্সেল কর। আজ আর রাজনৈতিক কোনো কাজ করব না। ”
আবির ভদ্রছেলের মতো বলল ;
“ ঠিক আছে।”
সারহান পুরনো গোডাউনে সরু চোখে তাকিয়ে অবলোকন করল। তারপর পা বাড়ালো গোডাউনের বাহিরে। আবির আর ইনান ও পেছন পেছন গেল। দুজন দেহরক্ষী মেহমুদ রঈসের দড়ি খুলতে লাগল।

অরিত্রিকা সবে মাত্র দুপুরের গোসল সেরে উঠেছে। নতুন পরিপাটি জামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। আজ তার মন বেশ খুশি, আবার খানিকটা উত্তেজিতও। সকাল থেকে পুরো বাড়িতে এক ধরনের ব্যস্ততা চলছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধি মসলা আর মিষ্টির ঘ্রাণ যেন তাকে আরও কৌতূহলী করে তুলছে।সে বারবার জানতে চেয়েছে সাথী বেগম আর বড় বোন অরিনের কাছে “কে আসছে?” কিন্তু দুজনেই রহস্যময়ভাবে কিছু না বলে এড়িয়ে গেছে।শেষে বাধ্য হয়ে সে আমজাদ সাহেবের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিল। বাবার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটেছিল। তিনি শুধু বলেছিলেন, “স্পেশাল গেস্ট আসবে। তাদের সামনে ভদ্র মেয়ের মতো থাকবে, বুঝেছ?”
এমন অস্পষ্ট উত্তর শুনে অরিত্রিকার কৌতূহল যেন আরও বেড়ে গেল। স্পেশাল গেস্ট মানে কারা? পরিচিত কেউ নাকি একেবারে নতুন মুখ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলের স্টাইল ঠিক করতে লাগল। তার মনোযোগ বারবার দরজার দিকে চলে যাচ্ছে মেহমানদের কখন আসার কথা?

“ কিরে অরিত্রিকা হলো তোর?”
অরিন কিছুটা উচ্চস্বরে ডেকে রুমে প্রবেশ করল। অরিত্রিকা চিরুনি রেখে পেছনে তাকায়। অরিনকে ভালোভাবে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল;
“ এমন সাজ সেজেছিস মনে হচ্ছে আজ তোকে দেখতে আসবে। আসল কাহিনী কি বল তো। ”
অরিন রাগল না। উল্টো বিছানায় বসে পা দুলিয়ে হেসে বলল;
“ দেখতে আসবে না রে তার থেকেও বেশী কিছু অপেক্ষা করছে। ”
অরিত্রিকা কোমড়ে দুই হাত গুঁজে সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল ;
“ তোরা আমার থেকে কি লুকচ্ছিস?”
“ কই কি লুকাচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয় উনারা হয়ত এসে পড়েছেন। ”

অরিন কথাটি বলেই রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে মিটিমিটি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার এই অদ্ভুত আচরণ অরিত্রিকাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে দিল। সে খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর তার চতুর, পুলিশের মতো বিশ্লেষণী মন তাকে সতর্ক করল “কিছু একটা ঘাপলা আছে। এটা পরিষ্কার!”ঘাপলার সূত্র খুঁজে বের করার সংকল্পে অরিত্রিকা একেবারে তৎপর হয়ে উঠল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে ভালো করে দেখে নিল। খোলা চুল, হালকা সাজ সব মিলিয়ে মন্দ লাগছে না। হঠাৎ মনে হলো, যদি তার একটা বয়ফ্রেন্ড থাকত, সে হয়তো এখন তাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকত।এই ভাবনা মাথায় আসতেই সে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। নিজেরই ওপর হেসে উঠল।মুহূর্তেই তার মন হালকা হয়ে গেল। লাজুক হাসি সামলে সে নিজের মনের আনন্দে একটা গান গাইতে গাইতে ছুটল নিচতলায়। কারণ এই রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে!

❝আমি নষ্ট মনে নষ্ট চোখে দেখি তোমাকে,
মন আমার কি চায় বোঝাই কেমনে,
আপনি গুরু আমি শীর্ষ
বুদ্ধি আমার কম
আপনি বুঝাইয়া দিলে
বুঝিতে সক্ষম❞
অরিত্রিকা নেচে নেচে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ির সামনে আসতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেল। গান গাওয়া এক নিমিষে ফুরুত হয়ে গেল। সে পড়ে যেতে নিলে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করল। দুহাতে আঁকড়ে ধরল সামনে দন্ডায়মান মানুষটির পোশাক। চোখ বন্ধ করেই ভাবতে লাগল পড়ে গেলে কি হতো! এতোক্ষণ নিশ্চয়ই পটল তুলতো নয়ত কোমড় ভেঙে ঢেড়সের মতো লটকে যেত। তারপর একমাস বেড রেস্টে থাকতে হতো। কিন্তু কাকে ধরে আছে সে?চোখ বন্ধ করে হাতিয়ে দেখতে লাগল। কেমন ছেলেদের মতো শরীর, মসৃণ শার্ট, শক্ত বক্ষপেশী এসব হাতে বাঁধছে। তীব্র পারফিউমের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। অরিত্রিকা চমকে গেল। পিটপিটিয়ে চাইলো সামনের দিকে। গুরুগম্ভীর মানুষটিকে দেখে শিউরে উঠল। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহুর্তে।

“ আমার শার্ট ছাড়বি নাকি তোকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিব। ”
পুরুষালী ভরাট কন্ঠের হুমকিতে অরিত্রিকার অবস্থা বেহাল। সে দ্রুত মানবটির শার্ট ছেড়ে দিল। তটস্থ ভঙ্গিতে দাঁড়াল একপাশে। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল সে সারহান ভাইয়ের শার্টের বাটন ছিড়ে ফেলেছে। কালো শার্টের ওপরের দিকটা খোলা। সেখান হতে সারহানের প্রশস্ত বুক দৃশ্যমান। লজ্জায় হাসফাস করে অন্যত্র তাকাল। সে এখন কি করবে কোথায় পালাবে। কেন যে বদমেজাজি মানুষটার শার্ট ধরতে গিয়েছিল তার থেকে নিচে পড়ে কোমড় ভাঙলে ভালো হতো।
সারহান শার্ট টেনেটুনে ঠিক করল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ তোর চোখ কি তোর মনের মতো নষ্ট হয়ে গেছে? সামনে একটা মানুষ আসছে তা না দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার লন্ড্রি করা ব্যান্ডেড শার্ট খারাপ করে দিলি।”
অরিত্রিকা ফুঁসে উঠল ;

“ আমার মন নষ্ট? আপনি নষ্ট আপনার সম্পূর্ণ বডি পার্ট নষ্ট। ”
সারহান বাঁকা হাসল। এক কদম এগিয়ে গেল অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকা ভড়কে গেল। থতমত খেয়ে বলল;
“ দূরে যান, দূরে যান। হুস হুস। ”
“ আমি নষ্ট, আমার বডি পার্ট নষ্ট?”
অরিত্রিকা পড়েছে ফ্যাসাদে। কি ভুলভাল বলে ফেলল সে। এই মানুষটা কই থেকে টপকালো হঠাৎ। তাহলে কি বুঝতে পেরেছে সে ভার্সিটিতে চিরকুট দিয়েছি। আজ অরিত্রিকা তুই শেষ। এই বদলোক তোর জীবন নরক বানিয়ে দিবে। এখন কোনোমতো এখান থেকে পালাতে হবে তার।
অরিত্রিকা আমতা আমতা করে বলল;
“ আরে নাহ। আপনি ভালো, আপনার বডি পার্ট ও ভালো আমি তো গান বলছিলাম। ”
সারহান তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল;
“ তুই আগের মতোই রয়ে গেছিস। এতো বড় হয়ে গেছিস অথচ কিভাবে চলতে হয়, কোথায় কি বলতে হয় জানিস না। বয়স তো বিশ হয়েছে। বিয়ে দিলে তোর হাসবেন্ড দুইদিনে বাড়িতে রেখে যাবে। ”
অরিত্রিকা মিনমিন করে বলল;

“ বিয়ে করলে শান্ত, হাঁদা টাইপের ছেলেকে বিয়ে করব। তাহলে এমন কিছু করার সাহস পাবে না। ”
কথাটা বলে অরিত্রিকা সারহানের দিকে তাকাল। সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কঠোর মুখাবয়ব অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিগড়ে যাওয়া কন্ঠে বলল;
“ তোকে হাঁদা কেন কোনো পাগলে ও বিয়ে করবে না। ”
“ করবে করবে। হ্যান্ডসাম একটা বর হবে আমার তখন আপনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঘুরবো তাকে নিয়ে।”
“ হ্যান্ডসাম বর?”
“ হ্যা। সে দেখতে আপনার থেকেও হ্যান্ডসাম হবে। আমি তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকব আর আপনি দূর থেকে আমাদের দেখে জেলাস ফিল করবেন।”

“ থাপ্পড় চিনিস।”
অরিত্রিকা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে এবার চুপ হয়ে যায়। সে বাঘের থেকে নিজেকে বাঁচাতে ধীরে ধীরে পেছনে নিজের রুমের দিকে পেছাতে থাকে। গন্তব্য তার এক দৌড়ে রুমে চলে যাওয়া। এখানে থাকলে নিশ্চিত গর্দান যাবে তার। অরিত্রিকা দৌড়ে যাবে এমন সময় সারহান অমসৃণ হাতে হাত ধরে ফেলে। অরিত্রিকা এহেন কান্ডে স্তব্ধ হয়ে যায়।চোখ বড় বড় করে তাকায় মানুষটির দিকে। সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৩

“ আমার শার্টের বাটন ছিঁড়েছিস এবার নিজ হাতে বাটন লাগিয়ে দে।”
অরিত্রিকা কেঁপে উঠল। কম্পিত গলায় বলল ;
“ আমি?”
“হ্যা। তুই।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫