দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৫
তাসফিয়া হাসান তুরফা
দোলার চিন্তিত চেহারা দেখে আয়মান সাহেবের সন্দেহ গভীর হয়। তার বন্ধু ততক্ষণে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। আয়মান সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন,
—কি হলো চুপ করে আছো কেন? বলো।
দোলার একটু অবাক লাগলো এবার। মূলত এর আগে কখনো ওর শ্বশুর এভাবে নিজে থেকে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি কখনো। সেভাবে কথাই তো কোনোদিন হয়নি তাদের মাঝে! তাই এ প্রথম আয়মান সাহেব ওর কথা শুনতে এত আগ্রহ দেখানোতে দোলা একটু গলে গেলো। কিছুক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করলো নিশীথ এর কথা রেখে কালকে শ্বশুরকে সব জানাবে নাকি উনার আগ্রহ না দমিয়ে আজকেই জানিয়ে দেবে, মনের মাঝে কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা চললো! অবশেষে আবারো আয়মান সাহেব ডাকলে দোলা হুশে ফিরলো।
—দোলনচাঁপা? দেখো তুমি এভাবে চুপ করে থাকলে আর সময় ওয়েস্ট করার মানে হয়না। তুমিও বাসায় যাও আমিও চলে যাই। এমনিতেও আমার ইম্পর্ট্যান্ট কিছু কাজ আছে, কাল নিশান চলে যাচ্ছে। একটু আগে তো শুনলেই ওর জন্য মেয়ের কথা চলছে। ইয়ে…মানে এটা আবার যেন কাউকে জানিয়োনা এখনো! নিশীথকেও নয়!
—কেন, বাবা? ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখছেন এটা তো ভালো কথা। কাউকে জানালে কি হবে?
দোলা সরল মুখে বোকার ন্যায় জিজ্ঞেস করলো। ওর প্রশ্নে আয়মান সাহেব নিজেও বোকা বনে গেলেন। কি বলবেন না বলবেন ভেবে আমতা আমতা করে বললেন,
—এটা ভালো কথা আমিও জানি কিন্তু আমার ছেলেদের স্বভাব হয়ে গেছে বাপের বিপক্ষে কথা বলা। আগে ছোটোটা একাই এমন করতো এখন ওর দেখাদেখি বড়টাও ওমন হয়ে যাচ্ছে। এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় এদিকে আমার বন্ধু মেয়ে দেখানোর জন্য নাছোরবান্দা। আজকে তো আর এমনি এমনি দেখা করতে আসিনি, বাধ্য হয়ে এখানে দেখা করতে এসেছি। ওরা বলছিলো কাল….
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়মান সাহেব হঠাৎ থেমে গেলেন। দোলার সাথে কথা বলার তালে উনি এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিলেন কথাগুলো তার কাউকে বলার ছিলোনা কিন্তু একবার কথা শুরু করে তিনি আর থামতে পারেননি অনেকদূর চলে গেছেন তাই ইতস্তত হয়ে সেখানেই থামলেন। শ্বশুর হঠাৎ থেম যাওয়ায় দোলা বললো,
—কালকে কি, বাবা? বলুন না!
—এতকিছু তো আমি বলতে পারবোনা। যেটুকু শুনেছো ওটাই অনেক।
আয়মান সাহেব মুখ গম্ভীর করে বললেন। এবার দোলার খারাপ লাগলো। এতক্ষণ কি সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে ওর সাথে কথা বলছিলেন তিনি অথচ এখন আবার আগেকার মতো হয়ে গেলেন। ও মুখ ভার করে বললো,
—আমায় বললে কি এমন হবে? আমি কি কাউকে বলে দেবো নাকি? নিশীথ কেও বলবোনা। আমি তো আপনার মেয়ের মতোই হই, বাবা!
এবার আয়মান সাহেব চোখ তুলে তাকালেন ওর দিকে। মেয়েটার সরল মুখশ্রী ভার হয়ে আছে। ওর চোখে স্পষ্ট দুঃখের আভাস। আয়মান সাহেবের কি যেন হলো। বিশেষ করে, দোলা ‘মেয়ের মতো’ বলায় উনার ভেতরে পিতাসুলভ নমনীয়তা এলো। আসলেই তো, যদি নিশীথের পছন্দে বিয়ে না হয়ে দোলা তার পছন্দের মেয়ে হিসেবে এ বাসায় আসতো তবে অবশ্যই নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন তিনি ওকে! অথচ ভাগ্যের পরিহাসে মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে এসে তার দুর্ব্যবহার এর স্বীকার হচ্ছে যেখানে আদৌ ওর কোনো দোষ ছিলোনা। হঠাৎ করে এসব মাথায় আসার পর আয়মান সাহেবের মনে দোলার জন্য মায়া হলো। তিনি হাটতে হাটতে বললেন,
—বলছি। এসো কোথাও বসি। সব কথা কি দাঁড়িয়েই বলবো নাকি?
শ্বশুরের কথায় দোলার মুখে ৪৪০ ভোল্টের হাসি ফুটে উঠলো। আড়চোখে আয়মান সাহেব সে হাসি দেখলেন। মনে মনে নিজেও হাসলেন তবে দোলার সামনে তা ভুলেও প্রকাশ করবেন না। কিছুদূর হেটে বেঞ্চে বসার পর আয়মান সাহেব বললেন,
—তো যা বলছিলাম, আমার বন্ধু মাসুদের ভাইয়ের মেয়ে সাইমার জন্য ওরা নিশানকে চায়। আমার তো সমস্যা নেই কিন্তু নিশান রাজি না। এটা ওকে বলার পরেও ওরা নাছোড়বান্দা। জিদ ধরেছে নিশানকে নিয়ে আসতে মেয়ে দেখাতে। আমি বললাম কাল ও চলে যাচ্ছে সেটা শুনে ওরা বললো আমাদের বাসায় আসবে মেয়েকে নিয়ে।
দোলা সব শুনে মাথা নেড়ে বললো,
—এরপর ভাইয়ার মেয়ে পছন্দ হলে কি হবে?
—মেয়ে পছন্দ হলে নাকি কালকেই বাগদান করিয়ে রাখবে। চিন্তা করেছো কতটা যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলে হলে তার জন্য মেয়েপক্ষ এতটা পাগল হয়!
আয়মান সাহেব ছেলের প্রতি গর্বে বুক ফুলিয়ে বললেন। দোলা সবটাই দেখলো শুনলো বাবার কাছে। এবার ওর আরও খারাপ লাগলো। কতটা আশা নিয়ে আনন্দ নিয়ে ছেলের বিয়ের প্ল্যানিং করছেন লোকটা অথচ তার ছেলে কি করলো! সত্যিই হতাশাজনক।
আয়মান সাহেব লক্ষ্য করলেন দোলার চেহারায় বিষন্নতা। তিনি ভাবলেন, হয়তো নিশীথের সম্পর্কে কিছু না বলে নিশানকে নিয়ে ওভাবে বলেছেন দেখে দোলা কষ্ট পেয়েছে তাই তিনি অন্যদিকে চেয়ে বললেন,
—অবশ্য নিশীথও কম যায়না। একটু মাথা গরম বেশি তাছাড়া কাজেকর্মে ও মন্দ নয়। আমার পরে আমাদের কোম্পানি তো সে-ই দেখাশোনা করবে!
দোলা এবার আরেক দফা অবাক হলো। আয়মান সাহেব নিশীথের প্রশংসা করছেন, তাও আবার ওর কাছে? এমনটা কি কখনো দোলা ভেবেছিলো? মোটেও না! ও স্পষ্ট বুঝে, লোকটা বদলানোর চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, আসমা বেগমের ওই বাড়ি থেকে প্রস্থানের পর আয়মান সাহেব যেন অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছেন। দাদু এটা বলেছিলো নিশীথকে। নিশীথ পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আজ আয়মান সাহেবকে দেখে দোলা নিজে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে। তাই খুশিতে ওর চোখে পানি চলে আসে। আয়মান সাহেব সেটা লক্ষ্য করে অবাক হয়ে বলেন,
—তুমি কাদছো কেন? কি হয়েছে?
দোলা পলক ফেলে পানি লুকোনোর চেষ্টা করে বলে,
—ক,কই? কাদছিনা তো। চোখে কিছু গিয়েছে বোধহয়।
আয়মান সাহেব এর সন্দেহ এবার ফিরে আসে। উনি সন্দিহান কণ্ঠে আবারো শুধান,
—তখন তোমরা সবাই বাসায় কেন গিয়েছিলে আমার খোজে সেটা এখনো বললে না যে? কি হয়েছিলো বলো? একেবারেই সিরিয়াস কিছু না হলে নিশীথের আমার কাছে আসার কথা না!
আয়মান সাহেব ব্যথিত কণ্ঠে বললেন। তার কণ্ঠের খাজে লুকিয়ে থাকা কষ্ট দোলা বুঝতে পারলো। ওর সামনে এখন এক বাবা, যার ছোটছেলের সাথে তার সম্পর্ক ভালো নেই বললেই চলে। অন্যদিকে তার বড়ছেলে, যাকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন, মন থেকে ভালোবাসেন সেই ছেলেও কিনা তাকেই ধো’কা দিয়েছে! কতটা হতভাগা হলে একটা বাবার সাথে এমন হয়! আয়মান সাহেবের জন্য দোলার মনের গহীন থেকে কান্নারা এবার বেরিয়ে আসে। ও আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। হু হু করে ভেঙে পড়ে কান্নায়। ওকে এভাবে কাদতে দেখে এবার আয়মান সাহেব পুরোপুরি ভড়কে যান। কি করবেন না করবেন ভেবে অনেকটা বিচলিত হয়ে দোলার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় প্রশ্ন করলেন,
—কি হয়েছে, মা? তুমি কাদছো কেন? আমি তোমার বাবার মতোই। আমাকে বলতে পারো!
ব্যস! এ প্রথম আয়মান সাহেবের এত নমনীয় ব্যবহারে এবার আর দোলা নিজেকে আটকাতে পারেনা। ও কাদতে কাদতেই বলে,
—আপনি কাল মেয়েপক্ষকে বাসায় আসতে মানা করে দেন, বাবা। তাদের আসার দরকার নেই!
—ওমা! তা কেন? তুমি কি চাওনা নিশানের ভালো কোথাও বিয়ে হোক?
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৪
—আমাদের চাওয়া দিয়ে এখন আর কিছু করার নেই, বাবা। নিশান ভাইয়া অলরেডি বিয়ে করে ফেলেছে!
দোলা কান্না থামিয়ে বলে। সকাল থেকেই আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি, এ যেন বৃষ্টির আভাস। এরই মাঝে আশেপাশে কোথাও বিকট শব্দে মেঘ ডাকে। দোলার কথা শুনে আয়মান সাহেবের মনে হলো, বাজ-টা তার মাথায় পড়েছে!