প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫
আদ্রিতা নিশি
গত দুবছর আগের একটা ঘটনার জন্য চৌধুরীর দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়। ভেঙে যায় তাদের প্রায় ত্রিশ বছরের সুখের সংসার। সারহান সেসময় রাজশাহী ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে পুরো দমে রাজনীতিতে নিজের জায়গা পরিপক্ব করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পরিবার, আত্নীয় স্বজন সবাইকে যেন ভুলে গিয়েছিল । ভুলে গিয়েছিল বললে ভুল হবে, সে রাজনৈতিক জীবনে সম্পূর্ণ ভাবে জড়িয়ে যাওয়ায় কিছুটা ভীত ছিল নিজের পরিবারের সকলকে নিয়ে। সে নিজেকে সামনে রেখে পরিবারের প্রতিটা সদস্যকে সাবধানে রাখার জন্য নিজে বাড়ি থেকে দিনের পর দিন দূরে থেকেছে।
পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যদের নিয়ে প্রতিনিয়ত টেনশনে থেকেছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য যা কিছু করা লাগে সব কিছু করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, অকস্মাৎ এক ঘটনায় চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সারহানের প্রচেষ্টা। দিনটা ছিল শনিবার। রাজশাহীতে বড়সর সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সমাবেশের আয়োজন করেছিল সারহানের দল। সেইদিন সমাবেশ প্রাঙ্গনে জনতার ভীড় যেন উপচে পড়ছিল। চারদিকে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সারহান ছিল সেই সমাবেশের প্রধান। সে উক্ত দিনে ছাত্রনেতার প্রধান হিসেবে ভাষণ দিচ্ছিল মঞ্চে। সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব। তারা বেশ উচ্ছসিত ভঙ্গিতে তাদের বাড়ির ছেলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখতে এসেছিলেন এবং মাঠের পূর্ব পাশে প্রথমদিকে তারা বসেছিলেন। সারহানের ভাষণের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ হামলা হয় সমাবেশে। শোরগোল বেঁধে যায় সেই স্থানে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মানুষজন ছুটোছুটি করতে থাকে। সারহান বুঝতে পারে অপর পক্ষের দল সমাবেশে হামলা করেছে। সে ভাষণ অসমাপ্ত রেখে দ্রুততার সহিত বাবা আর চাচার কাছে দৌড়ে চলে যায়। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব সারহানের সাথে নিরাপদ স্থানে যাবে এমন সময় দূর থেকে একটা গুলি এসে লাগে আজমল সাহেবের বামপাশের বুক বরাবর। তিনি তৎক্ষনাৎ লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। র*ক্তে ভেসে যায় সেই স্থান। সারহান সেসময় মাথা ঠান্ডা করে শান্ত ভূমিকা পালন করে। তার দলের লোকজন আর সে মিলে আজমল সাহেবকে হসপিটালে এডমিট করে। সেই দিনটি ছিল চৌধুরী বাড়ির জন্য সবচেয়ে কুৎসিত দিন। সেদিন সমাবেশে হামলার জন্য বিরোধী দলের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু এর কোনো সুরাহা হয়নি। কয়েকদিন পরে তারা জামিনে মুক্ত পেয়ে যান। আজমল সাহেবের গুলির ক্ষত অনেকটা গভীর ছিল তাই অপারেশন সাকসেসফুল হলেও লাইফ রিস্ক ছিল। তিনি প্রায় একসপ্তাহ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চৌধুরী বাড়ির প্রতিটা সদস্য ভেঙে পড়েছিল।
আরশাদ সাহেব ছোট ভাইয়ের টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তানিয়া বেগম, সাদাত তারা দুজনের ভীষণ চিন্তিত ছিল। সাথী বেগমের অবস্থা প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তিনি স্বামীর অসুস্থতায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। তানিয়া বেগম, অরিত্রিকার ছোট ফুপি ইসমা বেগম সাথী বেগমকে সামলেছে। অরিন ও বাবার এমন অবস্থা দেখে কেঁদেকুটে নাজেহাল অবস্থা করেছিলেন। কিন্তু অরিত্রিকা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। বাবার এমন অবস্থা দেখে সে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে উঠল। একদম নিশ্চুপ, নির্জীব চোখে আইসিইউ রুমের দিকে তাকিয়ে থাকত। তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। অরিত্রিকা আজমল সাহেবকে ভীষণ ভালোবাসে। আজমল সাহেবও মেয়েকে তার থেকে বেশী ভালোবাসে। হঠাৎ একটা ঝড়ো হাওয়া যেন মেয়ের কাছ থেকে তার বাবাকে কেঁড়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সেই ঝড় থেকে বাঁচানোর জন্য অরিত্রিকা সৃষ্টিকর্তার কাছে আজমল সাহেবের সুস্থতার জন্য দিন রাত এক করে দোয়া চেয়েছে। সৃষ্টিকর্তা হয়ত দয়া করেছিলেন তাই আজমল সাহেব বেঁচে গেলেন।
হসপিটালে থাকাকালীন সময়ে সারহানের তেমন একটা দেখা মিলেনি সেসবসময় দূরে দূরে থেকেছে। কেন এমনটা করেছে তা সকলের অজানা।সপ্তাহ খানেক পর চৌধুরী বাড়িতে সবাই হাসিখুশি ভাবে ফিরলেও সেই সময় স্থায়ী হলো না। অরিত্রিকা সেদিন এসে বলেছিল তার বাবা, মা, বোন আর সে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। তারা অন্য জায়গায় থাকবে। হঠাৎ এমন কথায় চৌধুরী বাড়ির সকলে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অরিত্রিকাকে সবাই অনেক বোঝায় এমনটা যেন না করে। কিন্তু অরিত্রিকা ভীষণ জেদি মেয়ে সে যা বলেছে তা করবেই। আজমল সাহেব, সাথী বেগম মেয়েকে বুঝিয়েছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি বরং উল্টো অরিত্রিকা তাদের ব্ল্যাকমেইল করে একপ্রকার জেদ পূরণ করেছিল। সারহান বাড়িতে এসব দেখে অরিত্রিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু অরিত্রিকা বলেছিল শুধু মাত্র সারহানের রাজনীতির কারণে তারা বাড়ি ছাড়ছে। সে আর চায় না এই বাড়িতে থেকে নিজেদের জীবন হুমকিতে রাখতে। অরিত্রিকা সাহস সঞ্চার করে প্রথমবার উঁচু গলায় সারহানকে বলেছিল যদি রাজনীতি ছেড়ে দেয় সে তবেই এই বাড়িতে থাকবে তারা। সারহান রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলেছিল সে রাজনীতি ছাড়বে না। অরিত্রিকার দুচোখ বেয়ে পড়েছিল নোনা পানি। তা দেখেও সারহান তার ডিসিশনে অটল ছিল এবং কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল সপ্তদশী কিশোরীর রাগাশ্রয়ী মুখের পাণে। অরিত্রিকার চোখে ছিল জেদ, ক্ষোভ, আক্রোশ, অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। সেই চোখে ছিল লুকায়িত কিছু মুহুর্ত যা সারহানের চোখে পড়েনি আর অরিত্রিকাও না বলে লুকিয়ে গিয়েছিল। সারহান আর আটকায়নি তাদের। ত্রিশ বছরের সুখের সংসার একমুহূর্তে ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছিল। স্বার্থপরের মতো নিজেদের সুখের জন্য অরিত্রিকা চৌধুরী বাড়ির আরও চারটা সদস্যদের কথা না ভেবে চলে গিয়েছিল। আজও সেই ক্ষোভ সারহানের ভেতরে দাউদাউ করে জ্বলে।
সারহান এসব কথা ভেবে ব্যথিত হয়। তবে সেই ব্যথিত হৃদয়ের কথা মনের গহীনে লুক্কায়িত থাকে। সে স্বাভাবিক ভাবে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। তাকাতেই তার চোখ দুটো সংকুচিত হয়ে আসে। ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। অরিত্রিকা এক হাতে সুই সুতো নিয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য হাতে শার্টের বাটন কিন্তু দৃষ্টি তার সারহানের দিকে। সে একবার নিজের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সারহানের দিকে তাকাচ্ছে। সারহান অরিত্রিকার এমন ব্যবহারের মানে খুঁজে পেলো না। সে ভ্রু বাঁকিয়ে শুধালো;
“ চুপচাপ দাড়িয়ে আছিস কেন? দ্রুত শার্টের বাটন লাগিয়ে দে। আমার কাজ আছে বেরোতে হবে?”
অরিত্রিকা গোমড়া মুখে জিজ্ঞেস করল;
“আপনার হাইট কতো?”
সারহান এমন প্রশ্নে বিরক্ত হলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ হাইট জেনে কি করবি?”
অরিত্রিকা ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলল;
“ আপনি এতো লম্বা চওড়া আর আমি ছোট্ট একটা মানুষ কীভাবে বাটন লাগাবো। আমি বরং আম্মুকে ডেকে আনি। ”
অরিত্রিকা নিজের রুম থেকে বেরোতে গেলে সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে;
“ স্টপ ফাইরুজ। একদম পাকনামি করে চাচীকে ডাকতে যাবি না, তুই বাটন ছিঁড়েছিস তুই লাগিয়ে দিবি নয়ত তোর রুমের বেলকনি দিয়ে নিচে ফেলে দিবো। ”
অরিত্রিকা ভয়ে থেমে যায়। ভয় আড়াল করে গমগম করতে লাগে। বিগড়ে যাওয়া কন্ঠে বলল ;
“ তাহলে কীভাবে কি করব? আপনি অনেক লম্বা, ঠিকঠাক মতো আমি শার্টে বাটন লাগাতে পারবো না। ”
“ পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির লিলিপুট কোথাকার! মাথায় কি ব্রেন বাদে অন্যকিছু আছে? বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে কার্য উদ্ধার করলেই তো পারিস। ”
অরিত্রিকা সারহানের বিদ্রুপাত্মক কথায় ফুঁসে উঠল। রাগে গমগম করে বলল;
“ আমি মোটেও লিলিপুট নই সারহান ভাই। আপনার হাইট বেশী মানে আপনি একটা খাম্বা। ”
“ আমি খাম্বা?”
সারহানের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তার মন চাইছে এই বদমাশ মেয়েকে থাপ্পড় দিয়ে কান গরম করে দিতে। অবস্থা বেগতিক হতে পারে তাই অরিত্রিকা ধপ করে বিছানায় দাঁড়িয়ে গেল। সারহান কিছুটা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। অরিত্রিকা একপলক তাকাল সারহানের দিকে। দেখলো সারহান তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ যেন রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। অরিত্রিকা নিজেকে বাঁচাতে সাহস নিয়ে শার্টের বাটন লাগাতে শুরু করল। তার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। তরতর করে ঘামতে শুরু করেছে। মুখ চোখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করছে। আস্ত বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। কখন জানি এই খারুস বাঘ তাকে এক থাবা দেয়। তখন কি হবে তার! নিশ্চিত এক থাবায় চিৎপটাং হয়ে যাবে। তার মনে মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন ঘোরে এই বদমেজাজি, কাঠখোট্টা, হার্টলেস মানুষকে কে বিয়ে করবে? নিশ্চয়ই ওই মেয়ের কপালে শনি নাচছে। দুই দিন পর পর দাবাং চড় খেয়ে পড়ে থাকবে। আহারে! ভেবেই অরিত্রিকার ঘুম উড়ে যায়।
“ হাতের কী অবস্থা এখন? ”
সারহানের হঠাৎ প্রশ্নে অরিত্রিকার মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। সে চমকে উঠেও নিজেকে সামলে নেয়। বাটন লাগাতে লাগাতে মিনমিন করে বলে ;
“ একটু ভালো ছিল। কিন্তু আপনি আর থাকতে দিলেন কই? জোর শার্টের বাটন লাগিয়ে নিচ্ছেন। হাতে তো ব্যথা পাচ্ছি অথচ আপনি তো সেসব বুঝলেন না।”
“ থাক বাটন লাগাতে হবে না।”
সারহানের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে অরিত্রিকা হচকচিয়ে উঠে। ভয়ার্ত চোখে তাকায় সারহানের দিকে। শ্যামবর্ণের মুখাবয়ব যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। তা দেখে হাসার ভাণ করল। আমতা আমতা করে বলল;
“ ব্যথা কমে গেছে সারহান ভাই। এইতো বাটন লাগানো শেষের দিকে। ”
কথাটা কোনো মতো বলে মনোযোগী হলো সে। সারহানের রাগ কিছুটা কমে এলো। সে দৃষ্টিপাত করল অরিত্রিকার দিকে। চঞ্চল মেয়েটা কেমন অপরিপক্ক হাতে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বাটন লাগাচ্ছে। ঝুঁকে কাজটি করার কারণে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের সামনের দিকটায় এসে পড়েছে। অরিত্রিকার চঞ্চলতা, বোকামি, উদ্ভট কাজ কর্ম, দস্যিপনায় চৌধুরী বাড়ি আগে মেতে থাকত। আর এসবের সঙ্গি হতো সাদাত, অরিন আর ইশরা। সেই চৌধুরী বাড়ি বিগত দুইবছর ধরে কেমন থম মেরে গেছে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো। এসব ভেবে তপ্ত শ্বাস ফেলে সারহান।
“ সারহান ভাই আপনি গত দুই বছরে আমাদের বাসায় আসেননি হঠাৎ আজ কেন এলেন? ”
অরিত্রিকার সহজ-সরল প্রশ্ন। সারহান উত্তর দেয়;
“ চাচার সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে এসেছি। ”
“ ওহহ। উমম আব্বু তো নিচে ছিলো আপনি কেন উপরে আসছিলেন? ”
“ তোর হাড়গোড় ভাঙ্গতে। ”
অরিত্রিকা আড়চোখে তাকায়। মনে মনে সারহানকে গালি দিতে থাকে। এই মানুষটা এতো ত্যাড়া কেন? সে তো ভালোভাবে জানতে চাইলো কেন আসছিলো উপরে। আসলে আজ কাল ভালো মানুষের দাম নেই দুনিয়াতে। এই যে সে কতো ভালো মানুষ কিন্তু কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। অরিত্রিকা সারহানকে মনে মনে বদ দোয়া দেয় “ সারহান ভাই আপনার বউ যেন আস্ত একটা পাগল হয়। সারাদিন বকবক করে আপনার মাথা খায় আর আপনি এসবে অতিষ্ট হয়ে বনবাসে চলে যান।” এমন বেশ কয়েকটা দোয়া মনে মনে করে নিজেকে শান্ত করল। অরিত্রিকার বাটন লাগানো শেষ কিন্তু সুতো কাটবে কি করে! আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খোঁজার প্রয়াস চালালো কিন্তু আশাহত হলো। আইডিয়া তার দাঁত কি করতে আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। অরিত্রিকা সারহানের বক্ষ বরাবর ঝুঁকে এসে দাঁত দ্বারা সুতো ছিড়তে লাগে। অকস্মাৎ এহেন কান্ডে সারহান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে কপাল কুঁচকে অরিত্রিকার দিকে তাকায়। অরিত্রিকার গরম নিঃশ্বাস সারহানের শার্ট ভেদ করে বক্ষে অনুভব হচ্ছে। মেয়েটির চুলের গন্ধ তার নাসিক্যরন্ধে প্রবেশ করছে। সে কিছুটা নার্ভাস হয়ে যায়। অন্যত্র তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে থাকে।
“ কাজ সম্পূর্ণ করলাম সারহান ভাই। ”
অরিত্রিকা সুতো ছিড়ে হাসিমুখে বলল। সারহান যেন শুনেও শুনল না। সে দুরত্ব বজায় রেখে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। রুমটা ভালোভাবে পরখ করে দেখল বেশ গোছানো। অরিত্রিকা সারহানের কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বিছানা থেকে নামল। তারপর সুই টা জায়গা মতো রেখে এগিয়ে আসল সারহানে সামনে। নিচ থেকে ভেসে আসছে কিছু পরিচিত কন্ঠস্বর। অরিত্রিকা কান খাড়া করে শুনল। তারমানে সারহান ভাই একা আসেনি তার সাথে বড় মা, বড়বাবা, সাদাত আর ইশরা এসেছে। অরিত্রিকা যেন লাফিয়ে উঠল।
“ সারহান ভাই বড় মা, বড় বাবা, সাদাত আর ইশরা এসেছে। ”
অরিত্রিকার প্রফুল্লচিত্তে বলা কথায় সারহান দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“ হ্যা এসেছে। ”
অরিত্রিকা নেচে উঠল। তার মানে চৌধুরী বাড়ির সবাই আজ তাদের বাড়ির স্পেশাল গেস্ট। এই প্রথম সবাই একসাথে এসেছে ভাবতেই অরিত্রিকার মন আনন্দে ছেয়ে গেল। হঠাৎ তার অলস মস্তিস্কে একটা প্রশ্ন ঘুরতে লাগল। সে বলবে কি বলবে না ভাবতে লাগল। পেট থেকে কথা না বের করলে নিশ্চিত আজ ঘুম আসবে না।
“ সারহান ভাই হঠাৎ কেন সবাই আমাদের বাড়ি আসলো? ”
অরিত্রিকা একটু থামে। তারপর সন্দেহবাতিক কন্ঠে শুধালো ;
“ সারহান ভাই আপনি কি বিয়ে করছেন? এই জন্য বড় মা বড় বাবা আমাদের আপনার বিয়ের জন্য ইনভাইট করতে এসেছে?”
অরিত্রিকা মস্তিষ্কে চলা হযবরলটঠশ বলে ক্ষান্ত হলো। উত্তেজনায় সে কাঁপছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সারহানের উত্তর শোনার জন্য। সারহান এমন উদ্ভট প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হলো। এই মেয়ের মাথা আসলে ফাঁকা। সবসময় উল্টা পাল্টা কথা মাথায় ঘুরঘুর করে। সে ভেবে পায় না এই গর্দভটা ভার্সিটিতে কিভাবে চান্স পেল।
সারহান কাঠিন্যতা এঁটে প্রতিত্তোর করল ;
“ হ্যা আমার বিয়ের ইনভিটেশন দিতে এসেছি। ”
অরিত্রিকা কিছুটা বিস্মিত হলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল;
“ভাবির পিক দেখান সারহান ভাই। আমিও একটু কুট্টুমুট্টু কিউটি ভাবিকে দেখি। ”
অরিত্রিকার কথায় সারহানের মুখ কুঁচকে এলো। ভরাট কণ্ঠে বলল;
“ বিয়ের দিন দেখিস। ”
অরিত্রিকার রাগ হলো। ভাবির ছবি দেখালে কি এমন হবে? মনে হচ্ছে ছবি দেখালে সেই মেয়েকে নিয়ে নিজেই ভেগে যাবে। ভাবতেই হাসল অরিত্রিকা। হাস্যরত ওষ্ঠ চেপে বলল;
“ বুঝেছি ভাবি দেখতে ভালো না। এমন ভাব দেখানোর কি আছে! ”
সারহান এক মুহূর্তও আর এখানে থাকতে পারছে না। তার ধৈর্য্যের সীমা ভেঙে যেতে বসেছে। এ কী ধরনের অদ্ভুত পরিস্থিতি! এই মেয়ে এতটা কেন কেন বাজে বকে? তার মধ্যে যেন অব্যাখ্যাত ছটফটানি, যা সারহানের সমস্ত শান্ত মনোভাবকে চুরমার করে দিতে চাইছে।অরিত্রিকার প্রশ্নগুলোর ধারাবাহিকতায় তার মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। একের পর এক প্রশ্ন, একের পর এক বিরোধ সব কিছু যেন অজানা চাপ হয়ে পড়েছে তার উপর। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, তার মন শান্ত হতে চাইছে না। রাগ ও বিরক্তিতে অনুভূতি তাকে ক্রমশ প্রবলভাবে আঘাত করতে শুরু করেছে।সে নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টায় ব্যর্থ। এটা আর সম্ভব হচ্ছে না মনে মনে ভাবল সারহান। সে জানে, এই মুহূর্তে সে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। কিন্তু তাও সে তার মধ্যে জমে থাকা অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
সারহান রাগ সংবরণ করে ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হেসে বলল;
“ আমার না হওয়া বিবিজান যথেষ্ট সুন্দরী। একদম উল্টা পাল্টা বকবি না। ”
সারহান উক্ত কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর ভেসে আসলো ;
“ আমার না হওয়া বিবিজানের সাথে খুব শীঘ্রই দেখা করাবো তোকে। জানিস ওর কন্ঠ অসাধারণ। গতকাল রাতে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। ইউ নো আমি ওকে খুব বেশী মিস করছি। ”
অরিত্রিকা থম মেরে গেল। সারহানের কণ্ঠনালী থেকে নিঃসৃত ভরাট গভীর কণ্ঠস্বর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সেই শব্দ যেন তার গা থেকে সারা শরীর বয়ে চলা শীতল স্রোত হয়ে গেল। মুহূর্তে তার সব শরীর শক্ত হয়ে গেল এবং সে ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে।কানে বাজছে শুধু একটি শব্দ “না হওয়া বিবিজান।”এই শব্দের প্রতিধ্বনি যেন তার হৃদয়ের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। এক মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি মূর্ছিত হয়ে গেল। হঠাৎ সে ধরফর করে উঠল এটা কি সত্যিই তিনি বললেন? এই নিকনেমটা তো সে শুনেছিল গতকাল সারহান ভাইয়ের কণ্ঠ থেকে, ফোনে।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪
কিন্তু আজ… আজ সারহান ভাইয়ের কথার মানে কী? অরিত্রিকার মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত, আর এই বিভ্রান্তি যেন তাকে গভীর খেই হারানো অনুভূতির দিকে ঠেলে দিল। অরিত্রিকা বিস্ময় নিয়ে আওড়ালো ;
“ না হওয়া বিবিজান। ”
তার শরীর শিরশির করে উঠল। বিমূঢ় চাহনিতে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে।