Tell me who I am part 4

Tell me who I am part 4
আয়সা ইসলাম মনি

এই বিব্রতকর প্রশ্নে মিরা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পিছনে ঘুরে কথা এড়িয়ে অন্য কথায় নিয়ে বলে, “আপনাকে ভাবি ডাকলে হবে?”
রোমানা ভ্রূ কুঁচকে কণ্ঠে বিদ্রূপের সুর নিয়ে বলে, “তুমি আমাকে কিছু না ডাকলেই বরং বেশি খুশি হবো। হতে পারো অনেক সৌন্দর্যের অধিকারী। কিন্তু মনে রেখো, আমি এই বাড়ির বড় বউ। তাই এই বাড়িতে আমার কথাই শেষ কথা। ভুলেও রাজত্ব নেওয়ার চেষ্টা করলে, তোমার সামনে আমি এমন ভয়ংকর রূপে আসবো, যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
মিরা অবাক দৃষ্টিতে রোমানার পানে তাকিয়ে রইলো। এমন সময় আসাদ চৌধুরির আবির্ভাব ঘটল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে তিনি বললেন, “কী ব্যাপার? ভালোই তো, সকাল সকাল আমার দুই বৌমার আলাপ-আলোচনা জমে উঠেছে।”

মিরা মাথার কাপড় টেনে নিয়ে বিনম্রভাবে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”
আসাদ চৌধুরি হেসে বললেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, মা। তা আমার ঘরের লক্ষ্মী এত সকালে উঠে পড়েছে কেন?”
রোমানা ফুঁসতে ফুঁসতে মনে মনে বলে, “আদিখ্যেতা! কই, আমার বিয়ের পর তো এসব কিছু বলেনি।”
মিরা বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিল, “বাবা, নামাজের পর আর ঘুমাতে পারিনি। অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই ঘুম আসে না। আমি আপনার জন্য খাবার তৈরি করছি, আপনি বসুন।”
মিরার কথায় রোমানার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। তখনই সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকা ইসহাক ও তার স্ত্রী আশমিনিও মুখ চেপে হাসতে লাগল। আশমিনি কটাক্ষের সুরে বলল, “এত বড় বাড়ির বউ হয়েছো, একটু তো ভাব রাখতে শেখো। শুধু রূপের জৌলুস থাকলেই হবে? এই বাড়ির বউরা কাজকর্ম করে না। তাহলে এতগুলো মেইড রাখা হয়েছে কীসের জন্য?”
মিরা বিনয়ের সঙ্গে চোখ নামিয়ে বলল, “ক্ষমা করবেন, বুঝতে পারিনি। তবে নিজের কাজ নিজে করতে ভালো লাগে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আশমিনি কঠিন স্বরে বলল, “তোমাকে এত কাজ করতে হবে না। তুমি বরং আমার ছেলে কারানের যত্ন নাও। তা কাল রাতে আমার ছেলেকে খুশি করতে পেরেছো তো, নাকি শুধু রূপ দেখিয়েই রাত পার করে দিয়েছো?”
আশমিনির এই অশালীন কথায় মিরা অবাক হয়ে কিছুটা লজ্জিত হলো। মনে মনে ভাবল, “এ বাড়ির সবাই-ই কি এমন অদ্ভুত? একে তো কাল রাতে স্বামীর রূপের প্রমাণ পেলাম, এখন আবার এরা!”
ইসহাক তখন আশমিনির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এসব কী বলছো? চুপ করো।”
আসাদ দ্রুত বিষয়টি সামলাতে বললেন, “হয়েছে হয়েছে। সবাই খেতে বসো এবার। পিউ, সবার খাবার রেডি করো।”
“জি স্যার, রেডি টেবিলে।”
সবাই টেবিলে খেতে বসে গেল। আরিয়ান ও আয়াশও এসে যোগ দিয়েছে। আরিয়ান বসেই তক্কে তক্কে মিরার দিকে তীর্যক নজরে বার বার তাকালো, মিরার প্রতিটি নড়াচড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছে সে। মিরার চোখ তার চোখে পড়তেই, সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে খাওয়ায় মন দিল।
আয়াশ আশমিনির হাত নাচিয়ে বলে, “আম্মু, ভাবিকে আমার সাথে নিয়ে যাই? প্লিজ প্লিজ। স্কুলের সবাই দেখুক আমার ভাবি কত্তগুলো সুন্দর!”

আশমিনি কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, “কথা কম বলে খাওয়া শেষ করো।”
মায়ের রাগী কথায় আয়াশের হাসিমুখটি মলিন হয়ে গেল। আসাদ জিজ্ঞেস করলেন, “কারান কি অফিসে চলে গেছে?”
আরিয়ান গম্ভীর স্বরে জবাব দিল, “ও তো সবসময়ই আগে আগে যায়। বললাম আমি এই দিকটা সামলাতে পারবো। কখনো শুনেছে আমার কথা?”
“খাওয়া শেষ করে তুইও রওনা দে।”

ঘড়ির কাঁটা রাত ৯টা ছুঁয়েছে। মিরা বিষণ্নতার গভীরে ডুবে গিয়ে রুমের কোণায় নির্বাক হয়ে বসে আছে। নিস্তব্ধ অন্ধকারে তার মন ভারী হয়ে উঠেছে।
নিজের মনে বলে উঠল, “সবাই কি আর স্বামীর সুখ পায়?”
কথাগুলো বলা মাত্রই তার ঠোঁট থেকে একটি গভীর, আহত নিশ্বাস বেরিয়ে এলো।
চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু সামলাতে না পেরে ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠল, “মা, জানো খুব একা লাগে। এই বাড়ির সবাইকেই কেমন যেন অপরিচিত মনে হয়। একমাত্র বাবার সাথেই কথা বললে একটু স্বস্তি পাই। তাও যদি তোমার মেয়ে মিশুক হতো, তাহলে হয়ত এই নিঃসঙ্গতাটাও কিছুটা কম হতো।”
অকস্মাৎ দরজার বাইরে ভেসে আসা পায়ের শব্দে মিরা চমকে উঠল। মুহূর্তেই সে আঁচলটা মাথায় টেনে নিল। তার হৃদয়ে অজানা শিহরনের ঢেউ বয়ে গেল।

কারান যখন কক্ষে প্রবেশ করল, মিরার দেহজুড়ে জমে থাকা সংশয়ের মেঘ কিছুটা কেটে গেল। একরাশ নিঃশ্বাস ফেলে সে নিজেকে সামলে নিল। এই বাড়িতে কাউকে চেনে না সে, অচেনা কারো আগমন হলে হয়তো আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে আসত। যদিও কারান নিজেও তো মন জোগানোর মানুষ নয়, তবুও সে স্বামী। সেই সম্পর্কের নিরিখে হয়তো ভয়টা একটু কম অনুভূত হয়, কিংবা মিরা নিজেকে খানিকটা নিরাপদ মনে করে।
কারান আড়চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে শুধালো, “বারো হাত কাপড়, তেরো হাত ঘোমটা দিয়ে রেখেছে।”
এদিকে কারান গায়ের কোটটি খুলে পাশে রেখে দিল। মিরা অজ্ঞাত কথার কোনো প্রত্যুত্তর দিল না। কারান দাম্ভিক চেহারায় একবার মিরার দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর মিরা কোটটি হাতে নিয়ে সঠিক জায়গায় রেখে দিল। এরই মধ্যে কারান তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কক্ষে ফিরে এল। ভারী কণ্ঠে বলল, “আমি ড্রেস চেঞ্জ করবো। চলে যাবে নাকি তোমার সামনেই চেঞ্জ করবো?”

মিরা লজ্জা পেয়ে মিনমিনে গলায় বলল, “আপনি কি এমনই?”
কারান কিঞ্চিৎ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন?”
“না, কিছু না। আমি যাচ্ছি,” বলে মিরা পাশের সংযুক্ত কক্ষে চলে গেল।
কারান বাঁকা হেসে আওড়াল, “আমি কেমন সেটা আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন না, মিসেস চৌধুরি। আমি এক অদৃশ্য শক্তি; কেবল আপনার কল্পনার সীমানায় সীমাবদ্ধ নই। সেই সীমা পেরিয়ে, আমি নীরবে গভীর প্রভাব ছড়িয়ে দেই, যেমন অদেখা ঢেউ আঘাত হানে শান্ত জলে।”
এরপর দরজা আটকে জামাকাপড় পরিবর্তন করে একরঙা টিশার্টের সাথে বরাবরের মতো ট্রাউজার পরে নিল। এরই মধ্যে পিউ দরজায় ঠকঠক শব্দ করে।

কারান দরজা খুলে দিলে পিউ কুর্নিশ করে মাথা নীচু করে আহ্বান জানাল, “স্যার, ডিনারের টাইম হয়ে গেছে।”
কারান ভাবলেশহীন ভঙ্গিমায় বলল, “যাও, আসছি।”
পিউ একটু আমতাআমতা করে বলল, “স্যার, ম্যাম?”
কারান আর পিউয়ের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে দরজা থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। পিউ কিছু একটা সন্দেহ করলেও চুপচাপ মিরাকে সম্বোধন করল, “মিরা ম্যাম।”
মিরা দরজা খুলে দিল। পিউ নতজানু হয়ে ফের বলল, “ডিনারের টাইম হয়ে গেছে, ম্যাম। নিচে আসুন।”
মিরা হেসে কোমল গলায় বলল, “আচ্ছা তুমি যাও, আমি আসছি।”
মিরা নিচে নেমে দেখল, ইতিমধ্যে সবাই খেতে বসে গেছে। কিন্তু সে খেতে না বসে চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
তৎক্ষণাৎ আশমিনি মিরাকে দেখে খেতে খেতেই ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল, “তা, নতুন বউ কি পর্দা করা শুরু করেছ নাকি? এত বড় ঘোমটা দিয়ে রেখেছ কেন?”

মিরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে কী বলবে ভেবে না পেয়ে কারানকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সে তার বউকে কাউকে দেখাতে চায় না। তাই ঘোমটা দিয়ে রাখতে বলেছে।”
এমন কথা কারানের কর্ণধার হতেই সে মিরার দিকে কটমট করে তাকালো। ততক্ষণে তার গলায় খাবার বাজতে শুরু করেছে, আর বাকিরা খাবার খাওয়া রেখে অভূতপূর্ব বিস্ময়ে তার পানে তাকিয়ে থাকে। কারানের এমন অদ্ভুত আচরণে সবাই হতবাক; সে যে এমন কাজ করতে পারে এটা তাদের কল্পনাতীত।
রোমানা খেতে শুরু করে মুখ টিপে হাসতে থাকে। এদিকে কারান কাশতে কাশতে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে, “পানি দেও কেউ।”
পিউ তাকে পানি দিলে, সে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল। আরিয়ান বাঁকা হেসে বিদ্রূপের ছলে মন্তব্য করে, “হ্যাঁআআ, বউ যদি অধিক সুন্দরী হয়, ঘরের মানুষের সামনেও পর্দা করতে বলে। যদিও আমি হলেও তাই-ই করতাম।”
আরিয়ানের কথায় রোমানার চোখ-মুখ ক্রোধে লাল হয়ে যায়। রোমানা খাবার রেখে উঠে আরিয়ানের কাছে গিয়ে তেজস্বী কণ্ঠে বলে, “কি বলতে চাও তুমি? আমি কি সুন্দরী নই?”
আসাদ তখন কথার মোড় ঘুরিয়ে বলেন, “খাওয়ার মধ্যে বেশি কথা বলা হচ্ছে।”

রোমানা আর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে গম্ভীর মুখে আরিয়ানের দিকে একবার তাকালো, আরেকবার মিরার পানে ফিরলো। অর্থাৎ বাড়ির বড়রা পাশে আছে বলে রাগের বহিঃপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে না সে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রোমানা ক্রোধে দাউদাউ করে জ্বলছে। আসাদ চৌধুরি ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে কারান, কি ঠিক করলি? হানিমুনে কোথায় যাবি?”
কারান ইয়র্কশায়ার পুডিংয়ের টুকরো মুখে পুরে বলতে থাকে, “ভাবছি, এখন থেকে কে.ছি হাউসে থাকবো। অফিসে যেতে সুবিধা হবে।”
আসাদ কারানের এই গা ছাড়া ভাব দেখে মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও শান্তভাবে বলেন, “তোকে তো হানিমুনের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তবে যাই হোক, তুই যা ভালো মনে করিস। যাচ্ছিস কবে?”
“কালকেই।”
আসাদ মিরার দিকে তাকিয়ে বলেন, “ও তাহলে প্যাকিং করা শুরু করুক।”

কারান চামচটি প্লেটে নামিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর গলায় বলল, “কেন? ও কি আমার সঙ্গে যাবে?”
কারানের কথায় মুহূর্তে ঘরে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। বিস্ময়ের অদৃশ্য ছায়া উপস্থিত সবার মুখচ্ছবিতে ছড়িয়ে পড়ল। তবে রোমানার এসব কথায় কান নেই, তার মনোযোগ পুরোপুরি খাবারের প্রতি নিবদ্ধ।
ওদিকে মিরা ভ্রূকুটি করে তাকাল তার দিকে। অর্থাৎ চোখের গভীরে খুঁজে নিতে চাইছে কারানের কথার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা। মুহূর্তেই মনে প্রশ্ন জাগল—সে তো তার স্ত্রী, তার সঙ্গে না গেলে তবে কোথায় যাবে? শ্বশুরবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে সারাজীবন এক অলিখিত বন্দিত্বে বন্দি হয়ে থাকবে?
ইসহাক আশমিনির পাশেই বসে। একবার তাকিয়ে দেখে আশমিনির চোখেও প্রশ্নের ছায়া। সে একটু এগিয়ে এসে ধীর স্বরে বলল, “তুমি যা ভাবছ, আমিও তাই ভাবছি। কাজ করে করে কারানের মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বুঝলে?”
তিনি একটু আড় হেসে নেন। কিন্তু আশমিনি বুদ্ধিমতী। তার মনে কিছুটা খটকা লেগে যায়। সে মুখের খাবার ধীরে ধীরে চিবাতে চিবাতে ভাবনায় ডুবে যান।
“উঁহুঁ, কারান না ভেবে কিছু বলে না। তাহলে এই বিয়েতে ঘাবলাটা কি?”
এদিকে আরিয়ান হাসতে হাসতে বলে, “কে.ছি হাউসে তো যাচ্ছিস ছোটোখাটো হানিমুনের জন্যই। তা হানিমুন কি তুই একা একা করবি?”

সে আবার হাসতে থাকে। আরিয়ান কিছুটা নির্বোধ, হুটহাট রেগে যাওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত। কখন কি বলতে হয়, সেটাও সে জানে না। আবার কোন কথার কি মানে, তা বুঝতেও তার মাথায় জট পাকিয়ে যায়। অর্থাৎ কারান যেখানে বলেই দিয়েছে, সেখানে সর্বদা থাকার জন্য যাচ্ছে, তাও সে মধুচন্দ্রিমা নামক উলটো অর্থ বুঝে বসে আছে।
কারান আরিয়ানের কথার জবাব না দিয়ে শয়তানি হাসি হেসে মনে মনে আওড়ায়, “ও যদি আমার সব কিছু মেনে নিতে পারে, তবে যাক।”
এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে পুনরায় মনে মনে বলে, “ম্যারিং মি উইল টার্ন আউট টু বি দ্য বিগেস্ট রিগ্রেট অফ ইয়োর লাইফ। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ইউ’ল সি।”
এর মধ্যে আসাদ মিরার পানে তাকিয়ে বলে উঠে, “মা, তুমি খেতে বসলে না?”
মিরা নরম গলায় বলে, “এইতো বাবা, খাবো। আপনারা উঠুন, তারপর।”
আশমিনি খাওয়া শেষ করে মিরার কাছে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলেন, “এসব নিয়মকানুন এখানে খাটিও না। তোমারই ক্ষতি। যাও, খেতে বসো।”

কথা শেষ করে তিনি উপরে চলে গেলেন। একে একে বাকিরাও আহার সমাপন করে নিজ নিজ কক্ষে চলে গেল।
মিরা এবার ঘোমটা খুলে মুখে জোরালো কঠোরতা আর অভিমান নিয়ে চুপ রইলো কয়েক মুহূর্ত। তার চোখ ভাসিয়ে আসা অশ্রু ধরে রেখে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “যে স্বামী বাসররাতে স্ত্রীর সঙ্গে অমন আচরণ করতে পারে, তাকে মুখ দেখানোর ইচ্ছা আমারও নেই। আপনার প্রথম আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। আপনি যদিও স্বামীর কর্তব্য পালন করেননি, কিন্তু আমাকে তো আমার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতেই হবে। কারণ প্রত্যেকের পাপের ফল তাকে নিজেকেই ভোগ করতে হয়।”
কষ্টমিশ্রিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এরপর মিরা খাওয়ার জন্য প্লেট সাজাতে লাগলো। এর মধ্যেই পিউ রান্নাঘর থেকে হুড়মুড়িয়ে এসে বলে, “আরে, ম্যাম ম্যাম! কি করছেন? আমি বেড়ে দিচ্ছি। আপনি প্লিজ বসুন।”
মিরা হেসে বলে, “তোমার খাওয়া হয়েছে? আর তনিমা খেয়েছে?”
পিউ মাথা নীচু করে সরল কণ্ঠে বলে, “ম্যাম, আমরা মেডরা সবার শেষে খাই। আপনি খেয়ে নিন। দেন আমরা খাবো।”

মিরা হেসে বলে, “ওকে ডাকো। আজকে আমরা তিনজন একসাথে খাবো।”
“কিন্তু, ম্যাম…”
“কোনো কিন্তু না, যেটা বলছি সেটা শোনো।”
পিউ হাসতে হাসতে কুর্নিশ করে তনিমাকে নিয়ে আসলো। মিরা চেয়ার থেকে উঠে নিজে ওদের খাবার বেড়ে দিল। তারা যদিও বারণ করেছে, এবং বেশ ইতস্তত বোধও করেছে। কিন্তু মিরার এই সুন্দর ব্যবহারে তারা অবাকের সাথে খুশিও হলো। খাওয়া শেষ করে তিনজনে হাতে হাতে ডায়নিং টেবিল গুছিয়ে রাখলো। মিরা কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে তাদের সাথে কথা বলে অনেকটা পরিচিত হয়ে নিল।

অন্যদিকে আরিয়ান কক্ষে গিয়ে বিছানায় বসে ফোন টিপতে মনোযোগী হলো। রোমানা ডিভানে বসে অনেকক্ষণ আরিয়ানের দিকে ক্রোধে অগ্নিমুখী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আরিয়ানের হেলদোলহীন মনোভাব দেখে সে বেশ বিরক্ত হলো।
পরে আরিয়ানের কাছে গিয়ে, আরিয়ানের মাথার পিছনের চুল ধরে মাথা তুলে নিজের মুখশ্রীর দিকে তাক করল। ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে বলে, “ভালো করে দেখে বলো, আমি কি সুন্দরী নই?”
আরিয়ান রোমানার এমন আচমকা আচরণে আশ্চর্য হয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, “দিনে দিনে বেশ বেয়াদব হয়ে গেছো, রোমানা। চুল ছাড়ো।”
রোমানা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, “আমাকে ভালো কবে দেখলে তুমি? আর যা বলেছি, তার আনসার দাও।”
আরিয়ান টান দিয়ে রোমানাকে কোলের মধ্যে বসিয়ে রোমানার ঠোঁটে কামড় বসিয়ে বলে, “সুন্দরী না হলে কি আর এতদিন আরিয়ানের সাথে থাকতে পারতে? কিন্তু রহস্যটা আসলে অন্য জায়গায়; কীভাবে তুমি তার মনটাকে নিজের দিকে বেঁধে রেখেছ?”

সে হেসে রোমানার গলায় মুখ ডুবাতে থাকে। কিন্তু রোমানা সেদিকে অনুভূতিহীন, চোখ-মুখ কঠিন করে মনে মনে আওড়ায়, “তুমি যতই আমার কাছে এসে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করো, আমি কিন্তু তোমাকে গভীরভাবে চিনি। তোমার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, প্রতিটি কথার ভেতরে যে সূক্ষ্ম রেখা নিহিত, তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। আর আমার অগোচরে তুমি কী করো, তাও আমার অজানা নয়। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে তোমার মুখোশের নিচে যে চেহারা, তা আমার কাছে রহস্যের মতো। এই রহস্য আমাকে গভীর চিন্তার অতলে টেনে নিয়ে যায়, আরিয়ান।”

রাত প্রায় সাড়ে ১২ টার কাছাকাছি। ইসহাক মনোযোগী হয়ে কিছু রিপোর্ট দেখায় ব্যস্ত। আশমিনি কক্ষে ঢোকার পর থেকেই অস্থির, তিনি কিছু একটা গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। বিছানায় বসে বারংবার পা নাড়িয়ে যাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে ইসহাক কাজ করতে করতেই বলল, “কয়টা বাজে, কোনো খেয়াল আছে? ঘুমাচ্ছ না কেন?”
কথাটা আশমিনির কর্নকূহরে পৌঁছাতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। মুখের প্রকাশভঙ্গি পালটে গম্ভীর হয়ে সে প্রশ্ন করল, “তোমার কি কারান মিরার বিয়েটা স্বাভাবিক মনে হয়?”
ইসহাক ঠান্ডা গলায় বলল, “বুঝিনি।”
আশমিনি নড়ে চড়ে বসে ইসহাকের দিকে খানিকটা মাথা ঝুঁকে বলে, “সবসময় এত যে মাথা খাটাও, এসব নিয়ে কিছু ভাবলে না?”

ইসহাক কাজ করতে করতেই কপাল কুঁচকে বলল, “কি সব যা তা বলছো? কি বলতে চাও, সোজাসাপটা বলো।”
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই বিয়ের ব্যাপারটায় ভাইয়ার কোনো উদ্দেশ্য আছে। তুমিই বলো, যেখানে চৌধুরি বাড়ির সবার বিয়ে এত ধুমধামে হয়েছে, সেখানে ওনার আদরের সন্তান কারানের বিয়েই এভাবে কোনো প্রোগ্রাম ছাড়া, রিলেটিভস ও ফ্রেন্ডসদের ইনভাইটেশন ছাড়াই বিয়েটা দিয়ে দিল? তাও কিনা এত জলদি জলদি!”
ইসহাক কাজ বন্ধ করে আশমিনির কাছে গিয়ে বলল, “কি বলতে চাইছো তুমি?”
“দেখো, ভাইয়া যতই বলুক, ইসলাম অনুসারে ধুমধামে বিয়ে দেওয়া উচিত নয় বা কারানের কাজের এক্সকিউজই দিক, তোমার কি কিছু সন্দেহ হয় না? আবার কারানের ব্যবহারটাও কেমন দেখেছো? যেন এই বিয়েটা করে ওর কোনো মাথা ঘামতি-ই নেই। অর্থাৎ বিয়ে করেছে, এই পর্যন্তই। আবার হানিমুনেও যাবে না। তোমার কি কিছুই অন্যরকম মনে হচ্ছে না?”

এবার ইসহাক দাড়িতে হাত বোলাতে থাকলো। কপালে কয়েকটা চিন্তিত তরঙ্গরেখা দৃশ্যমান। আশমিনির পানে তাকিয়ে ইসহাকও বিয়েটা নিয়ে একটু সন্দেহবোধ করলো।
আরেকদিকে সব ঠিকঠাক করে মিরা কক্ষে প্রবেশ করে দেখে ইতিমধ্যে কারান নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মিরা গভীর একটা শ্বাস ছেড়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে পাশের সংযুক্ত কক্ষে চলে যায়।

এতটুকু বলে মিরা থেমে গেল। কারণ এখন থেকেই তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। শারমিন অধীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ম্যাডাম, থেমে গেলেন কেন? তারপর কী হলো, প্লিজ বলুন।”
মিরা একটু দম নিয়ে বলল, “এক গ্লাস পানি দিতে পারবেন? গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে।”
শারমিন তড়িঘড়ি করে পানি এনে দিল। মিরা পানি খেয়ে ঢোক গিলে বলল, “ধন্যবাদ। একটা কথা জানতে পারব? কারান চৌধুরি কি বেঁচে আছে? থাকলে এখন তার অবস্থা কেমন?”
তবে কথাটা বলতে গিয়ে গলায় বেশ একটা ধাক্কা খেল।
শারমিন মনে মনে সন্দেহ করে ভ্রূ কুঁচকে নেয়। শারমিন নিজেই নিজেকে বোঝায়, “এই গল্পের অন্তিম রহস্যের মোড়, যেভাবেই হোক আমাকে শুনতেই হবে। যে নারী কিনা নিজের হাতে স্বামীকে আঘাত করেছে, সেই-ই আবার এত উদ্বেগ নিয়ে তার বর্তমান অবস্থা জানতে চাচ্ছে? ব্যাপারটা স্বাভাবিক খুনের ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না।”
এমন সময় আমান ঢুকে কাঠখোট্টা কণ্ঠে বলে উঠল, “বলা যাচ্ছে না বাঁচবে কিনা। কারান চৌধুরি এখন আইসিইউতে, লাইফ সাপোর্টে আছেন। বাঁচার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি।”

এ কথা শোনার পরই মিরার শ্বাস ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে লাগল। তার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হতে শুরু করল। মনে হলো অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে আসছে, আর সে সেই অন্ধকারে ডুবে যাবে। কারান বেঁচে আছে, এই কথা শোনার অপেক্ষায় ছিল মিরা। কিন্তু আইসিইউ; এই কথাটা শুনেই তার মনের ভিতর মৃত্যু হিমশীতল স্পর্শ নিয়ে এলো। মিরা জানে, আইসিইউতে সেইসব মানুষদেরই রাখা হয় যারা বেঁচে থাকার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।
আমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় বলে, “তবে কারান চৌধুরি যদি মারা যায়, ফাঁসির হাত থেকে আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না, এটা নিশ্চিত।”
অথচ শারমিন মিরার গতিবিধি দেখে বলে, “স্যার, ম্যাডামের কি যেন হয়ে…”
কিন্তু শেষ করার আগেই মিরা মেঝেতে ঢলে পড়ল, তার চেতনা হারিয়ে গেল। শারমিন চিৎকার করে উঠল, “ম্যাডাম! মিরা ম্যাডাম!”

দ্রুতই শারমিন মিরাকে মেঝেতে শুইয়ে দিল। আমান সামান্য উত্তেজিত হলেও কঠোর কণ্ঠে বলল, “তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনুন।”
কিছুক্ষণ পর জেলের ডাক্তার এসে মিরাকে পরীক্ষা করে বলল, “তেমন কোনো গুরুতর সমস্যা নেই। মানসিক চাপের জন্য এমনটা হয়েছে। ওনার বিশ্রামের প্রয়োজন।”
তিনি চলে গেলেন। শারমিন চিন্তিত স্বরে বলল, “স্যার, উনি কাল রাতে ঘুমাননি। আবার খাওয়াদাওয়াও করেননি। তাই হয়ত এমন হয়েছে।”
আমান চোখে হিংস্র দৃষ্টি নিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকাছে, আপনি বাহিরে যান। এই রুমে আর কেউ আসবেন না, আমি আছি।”
“জি, স্যার।”
শারমিন স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ঘড়িতে রাত ১১টা ১২ মিনিট। মিরার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। আমান টেবিলের সামনে বসে মিরার দিকে একটানা তাকিয়ে থেকে, ডেস্কের ওপর থাকা কাগজচাপা অস্থিরভাবে ঘুরিয়ে চলেছে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ছুরির মতো মিরার দিকে বিঁধে আছে; অর্থাৎ চোখ দিয়েই মিরাকে খেয়ে ফেলতে চায়।
অবশেষে আমান নিজের মধ্যে থাকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। চেয়ার থেকে উঠে মিরার কয়েদখানায় প্রবেশ করল। হিংস্র দৃষ্টিতে মিরার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে গভীরভাবে পরখ করল। আনমনে বলে, “এত সৌন্দর্য কি কারান চৌধুরি একাই ভোগ করবে? এমন ভয়ংকর সুন্দর ফিগার দেখলেই তো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

বাঁকা হাসলো সে। আমান চারপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো কেউ দেখছে না। এরপর মিরার দিকে আরও এক পা এগিয়ে এলো। তার দৃষ্টি মিরার রক্তমাখা মুখের ওপর স্থির হয়ে গেল। মুখাবয়বের প্রতিটি কোণে রক্ত ছড়িয়ে থাকলেও, সেই লালাভ আবরণ ভেদ করে উজ্জ্বল ও গোলাপি ওষ্ঠাধর তার মনে বিষাক্ত সাপের ফণা তুলছে। রক্তাক্ত চেহারা আমানের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু যা তাকে নাড়িয়ে দিল, তা হলো এই ভয়াবহতার মাঝেও লুকিয়ে থাকা অভিনব, দুর্নিবার সৌন্দর্য। যা এর আগে কখনো সে দেখেনি। আমান ঠোঁটের কোণে হিংস্র হাসি ফুটিয়ে মিরার দিকে এগিয়ে গেল। চুম্বনের উদ্দেশ্যে মিরার ঠোঁটের একদম কাছে চলে গেল। কিন্তু হঠাৎ করেই কাল সন্ধ্যার সেই ভয়াবহ মুহূর্ত তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠল। যখন মিরা রক্তমাখা ছুরি হাতে থানার বাইরে দাঁড়িয়েছিল। এমনটা মনে পড়তেই আমানের হৃদয়ে আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি হলো। এই ভয়ের কারণে সে দুই পা পিছিয়ে গেল।
হাঁপাতে হাঁপাতে ঢোক গিলে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, “এ আমি কি করতে যাচ্ছিলাম?”

নিজের গালে কয়েকটি সপাট সপাট থাপ্পড় মারল। কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা জমা হয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছে নিয়ে বলল, “যে মেয়ে কিনা কারান চৌধুরীর মতো মানুষকে ঐভাবে আঘাত করতে পারে…”
মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “নাহ, না না। ও আমাকেও শেষ করে দিবে!”
তড়িঘড়ি করে কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে এলো সে। বেরিয়েই টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতল তুলে এক শ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। এরপর বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল, “রফিক, রফিক!”
রফিক দ্রুত কক্ষে প্রবেশ করে স্যালুট দিয়ে বলল, “ইয়েস, স্যার।”
“তুমি এখানে থাকবে। সাথে আলেয়াও থাকবে। আমি অন্য কয়েদিদের দেখতে যাচ্ছি।”
আমান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত কক্ষ থেকে প্রস্থান করল।

প্রভাতের আলো ক্রমশ কারাগারের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। মিরা ধীরেসুস্থে চোখ মেলে তাকায়, কিন্তু তার দেহ যেন জীবিত হলেও মনটা মৃত। শারমিন মিরার কক্ষে প্রবেশ করে প্রথমেই তার ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মিরাকে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর হাতের ইশারায় একজনকে খাবার আনতে নির্দেশ দিল। খাবারের প্লেটটা মিরার সামনে রেখে শারমিন নরম স্বরে বলল, “ম্যাডাম, কিছু খেয়ে নিন। তারপর আমাকে সব ঘটনা বলুন।”
কিন্তু মিরার চেহারায় এমন গভীর বিষাদ, মনে হয় কোনো মৃতপ্রায় মানুষ বসে আছে। ক্লান্ত চোখ, বিবর্ণ মুখশ্রীর পেছনে লুকিয়ে থাকা ভাঙ্গা মনের কাহিনি বুঝতে কারোরই কষ্ট হবে না।
শারমিন ধৈর্য ধরে বারবার খাওয়ার কথা বলছে, কিন্তু মিরা তার কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছে না; সে যেন একদম দিন-দুনিয়ার বাইরে। শারমিন শেষমেশ বিরক্ত হয়ে গেল। হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে তার মনে হলো, মিরার যে অবস্থা সে মুখ দিয়ে কিছু বললেও হয়ত সেটা শূন্যতায় হারিয়ে যাবে।
তাই সে থামল না। মিরাকে খাওয়ানোর চেষ্টায় শেষবারের মতো অনুনয় করল, “ইনশাআল্লাহ, স্যার বেঁচে থাকবেন। আপনি খেয়ে নিন, ম্যাডাম।”

শারমিনের এই কথা শুনেই মিরার শুকনো চোখে জল ছলছল করে উঠল, অর্থাৎ সেই এক টুকরো আশার বাণী মিরার ভেতরের অবসন্নতাকে সামান্য হলেও প্রাণ দিয়েছে। শারমিন বুঝতে পারল মিরার দুর্বল জায়গা কোথায়, তার ভাঙা মন কোথায় ধাক্কা খায়। শেষ পর্যন্ত জোরাজুরির পর সে একমুঠো খাবার মুখে তুলল।
কিছুটা শান্তি ফিরে পেয়ে মিরা নিশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করল।

পরদিন খুব ভোরেই মিরা কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। শাড়ি পরিবর্তন করে নতুন শাড়ি পরে নিল। আর অন্যদিকে কারান কেবল ট্রাউজারটা বদলে একটা প্যান্ট পরে নিল। নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাবে বলে সেজেগুজে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি সে। তাই সাদামাটাভাবেই বেরিয়ে পড়ল। কোনো ব্যাগও নিল না।
কারান নিচে নামতেই মিরা ঘোমটা দিয়ে তাকে অনুসরণ করে নিচে এলো। ইসহাক কাজের উদ্দেশ্যে ঘরের বাহিরে রয়েছে। তাই বৈঠকখানায় ইসহাক বাদে বাড়ির বাকি সবাই উপস্থিত থাকায়, কারান চাইলেও মিরার সাথে খারাপ ব্যবহার করার সুযোগ পেল না। ভদ্রতার খাতিরে গম্ভীর মুখে মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “এসো।”
এরপর আর কিছু না বলে বাহিরের পথে পা বাড়াল। মিরা আসাদ এবং আশমিনিকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিল।

এরপর দুজনেই মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ‘কে.ছি হাউজ’ নামক বাংলো বাড়িতে পৌঁছাল। কারান গাড়ি থেকে নেমেই ড্রাইভারের দিকে চাবি ছুড়ে দিয়ে বলল, “পার্ক করে রেখো।”
এরপর গুপ্ত কোড দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। মিরা গাড়ির দরজা খুলতেই তার চোখে পড়ল বিশাল এক শিশমহল; অর্থাৎ কাঁচের তৈরি একটা সুবিশাল বাড়ি। বাড়িটির চারপাশে কয়েক একরজুড়ে কোনো বসতি নেই। লম্বা কংক্রিটের বাউন্ডারি দিয়ে পুরো বাড়িটি আবিষ্ট। প্রবেশপথের পাশেই খোদাই করা নামফলক, তাতে লেখা ‘কে.ছি হাউজ’। বাড়িটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকা সত্ত্বেও নামফলকটা পুরোনো যুগের কারুকার্যে গড়া। বোধ হয় এটাই কারানের পছন্দকে আলাদা করে তুলেছে।

বাড়ির প্রবেশদ্বারের সামনে দুইজন রক্ষী দাঁড়িয়ে। ভিতরে ঢুকতেই এককোণায় একটি মাঝারি আকারের বৃত্তাকার সাঁতারকুন্ড দেখা গেল। আর গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় পৃথিবীর নামি-দামি গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
মিরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর বোলাল। ঠিক তখনই মধ্যবয়সী একজন লোক এগিয়ে এসে মিরাকে সালাম জানিয়ে বলল, “ম্যাডাম, ভিতরে আসুন। আমি এই বাড়ির কেয়ারটেকার ফরিদ মিয়া। আপনি গিয়ে রেস্ট নিন, আমি জিনিসপত্র নিয়ে আসছি।”

লোকটার সরল কথায় মিরার মন খুশি হয়ে উঠলো। হেসে বলল, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আঙ্কেল। গাড়িতে শুধু একটা ব্যাগ আছে, সেটা আমি নিজেই নিতে পারবো। আর আমাকে ম্যাডাম বলতে হবে না, আমি আপনার মেয়ের বয়সী। মিরা বলে ডাকলেই আমি বেশি খুশি হবো।”
কেন যেন মিরার কথায় ফরিদ মিয়ার মুখ বিষণ্ন হয়ে উঠলো। তবুও সে বিনম্র কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা, মিরা ম্যাডাম। আমি ব্যাগটা নিয়ে আসছি।”
“আবার ম্যাডাম? বললাম তো, আমি নিজেই নিতে পারবো, আঙ্কেল। খুব বেশি কিছু হলে আপনার থেকে সাহায্য নিতাম। আপনি যান, আমি আপনাকে অনুসরণ করছি।”
ফরিদ মিয়া হালকা হেসে সামনে পা বাড়াল। মনে মনে গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে বলল, “এমন একটি মেয়ে কারান স্যারের কপালে না পড়লেই ভালো হতো। জানি না, এই দুই বিপরীত মনের মানুষ কীভাবে একসঙ্গে থাকবে।”
মিরা তাকে অনুসরণ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। ফরিদ মিয়া দোতলার একটি ঘর দেখিয়ে বলল, “এটাই কারান স্যারের রুম।”

মিরা ঘরে ঢুকতেই দেখল কারান ইতিমধ্যে পোশাক বদলে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। আড়চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসো।”
মিরা শান্তভাবে বলল, “একটু অপেক্ষা করুন, ফ্রেশ হয়ে এনে দিচ্ছি।”
কারান কপাল কুঁচকে কড়া কণ্ঠে বলল, “আমি যখন যা চাইবো, ঠিক তখনই দিতে হবে। আমার মুখের উপর কথা বলা আমার পছন্দ না।”
মিরা কিছুটা বিস্মিত হলেও কোনো রা না করে নিচে নেমে গিয়ে ফরিদ মিয়ার থেকে রান্নাঘর কোথায় জেনে নিল। ক্ষণকাল পর কফি বানিয়ে উপরে চলে গেল।

কারান কফি হাতে নিয়েই রাগান্বিত চেহারায় মিরার দিকে তাকালো। আচমকাই কফির পুরোটা মিরার গায়ে ঢেলে দিল। মিরা গরম অনুভব করে দ্রুত কাঁধে হাত দিয়ে স্পর্শ করল। কারানের এই অদ্ভুত আচরণে মিরা নির্বাকের মতো তাকিয়ে রইল। কারান বাঁকা হেসে বলল, “আমি ব্ল্যাক কফি খাই।”
তারপর মিরার দিকে ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে গিয়ে কঠিন স্বরে বলল, “আমার সম্পর্কে আগে থেকে জেনে, তোমার আমাকে বিয়ে করা উচিত ছিল। এরপর থেকে যেন কোনো ভুল না হয়। আবার বানিয়ে আনো। যাও।”
কফিটা খুব বেশি গরম না হওয়ায় মিরার শরীর পুড়ে যায়নি, তবে কিছুটা লাল হয়ে গেছে। মিরা ঘোমটার নিচে মুখ লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলার চেষ্টা করল। কান্নাভেজা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি মানুষ?”
কারান শয়তানি হাসি হেসে উত্তর দিল, “না তো। আমার চেহারা তো কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর মতো।”
তারপর চিৎকার করে বলল, “এসব নেকামি বন্ধ করে কফি বানাও, যাও।”

কারানের সেই হুংকারে মিরা বিদ্যুৎগতিতে কেঁপে উঠল। বুঝতে পারল, এমন এক পুরুষের সাথে তার বিয়ে হয়েছে যার মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই। মর্মাহত মনে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “আচ্ছা, নিয়ে আসছি।”
কারান আড় হেসে নিজেকে বলল, “মাত্র তো শুরু, বেবি। আগেহ আগেহ দেখো হোতাহে কেয়া।”
মিরা নতুন করে কফি বানিয়ে উপরে আসল, কিন্তু কারান তখন কক্ষে নেই। মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আবার কোথায় গেল?”
দশ মিনিট পর কারান বাথরুম থেকে ফিরে এসে বলল, “কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার বানিয়ে আনো।”
মিরা আবারও বানিয়ে আনল। কিন্তু কারান বলল, “ফ্রেশ হয়ে এসো, নোংরা শরীর দেখলে আমার অস্বস্তি লাগে।”
মিরা ফ্রেশ হতে চলে গেল, আর সুযোগে কারান সেই কফি ডাস্টবিনে ফেলে দিল। মিরা ফিরে আসার পর কারান আবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কফির টেস্ট ভালো ছিল না। আবার বানিয়ে আনো।”
এভাবে বারবার কফি বানিয়ে আনাল, কারানের আসল উদ্দেশ্য ছিল মিরাকে কষ্ট দেয়া। অবশেষে মিরা বিরক্ত হয়ে জোরে বলল, “আপনি কি আমাকে রোবট মনে করেন নাকি?”
কারান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “ওহ! তুমি তাহলে চেঁচিয়েও কথা বলতে পারো? কারান চৌধুরির সামনে প্রথমবার কেউ গলা উঁচু করল। (কঠিন স্বরে) এই ফার্স্ট টাইম ভুল করেছো, এটাই যেন লাস্ট হয়। এখন যাও, আবার বানিয়ে আনো।”

মিরা ভীত হলেও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পুনরায় কফি বানিয়ে আনল। কফির কাপ কারানের হাতে দিয়ে বলল, “এবার টেস্ট করে দেখুন। ইউটিউব দেখে বেস্ট ব্ল্যাক কফিটা বানিয়েছি।”
কারান এবার আর বাহানা করতে পারল না। মিরা সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় বাধ্য হয়ে কফি চেখে দেখল। তার মুখে কফির স্বাদ বেশ ভালো লাগল, তবে সে তা মিরাকে বুঝতে দিল না। মুখের ভাব পরিবর্তন না করে বলল, “সকাল আর রাতে এভাবে কফি বানাবে। এখন বেরিয়ে যাও।”
মিরা নিরুত্তর বেরিয়ে গেল। হয়ত চেয়েছিল, কারান অন্তত কফি খেয়ে একটুখানি প্রশংসা করবে। কিন্তু সেটা নিছকই বোকাসোকা স্বপ্ন। মিরা বেরিয়ে যাওয়ার পর, কারান কফিতে চুমুক দিতে দিতে মৃদুস্বরে বলে উঠল, “আর যাই হোক, কফি তো আপনি দারুণ বানান মিসেস চৌধুরি।”
তার কণ্ঠে শয়তানি হাসি ফুটলো। অর্থাৎ মিরাকে কষ্ট দিয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু মনের গভীরে কফির প্রশংসা করতে বাধ্য হলো।
রাত গভীর হতে থাকল। যে যার কক্ষে নিজের মতো করে সময় কাটালো। কারান নিঃশব্দে নিজের কক্ষে শুয়ে পড়ল, মাথার ভেতর কেবল বিজয়ীর হাসি, মিরার মনোবল ভেঙে দিয়ে পরিতৃপ্তি পেয়েছে সে। আর মিরাকে আলাদা ঘরে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলেও, সে নির্জনতায় চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু আর বুকের ভেতর অগণিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

পরেরদিন ঘর পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে কারানের কক্ষে ঢুকতেই যে দৃশ্য দেখল, তাতে মিরার নিশ্বাস আটকে গেল। দেখে কারান গোসল করে এসে তোয়ালে পরিধানে আলমারি থেকে কাপড় বের করছে। মিরাকে দেখামাত্রই দাঁড়িয়ে গেল। মিরা এক নজরে কারানকে পরখ করে নিল।
ছয় ফুট লম্বা সুঠাম দেহের প্রতিটি পেশি নিখুঁত ছাঁচে গড়া। ভেজা কেশলয়ে হালকা পানি ঝরছে, আর তার তীক্ষ্ণ নীল চোখ মিরার মনের গভীরে এক অপার আকর্ষণ খুঁজে ফিরছে।
কারানের বক্ষদেশে জলকণাগুলো সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। আর তার শক্ত মসৃণ পেশিবহুল বাহুগুলোই মিরার দৃষ্টিকে আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট। সেই চাপদাড়ির নিচে সুগঠিত চোয়াল, আর কালচে গোলাপি ঠোঁটের নিখুঁত ভঙ্গি তাকে মোহময় করে তুলেছে। তার মসৃণ ফরসা শরীরের প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি শিরা সৌন্দর্যের অদ্ভুত সংমিশ্রণ।
মিরার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল। কারানের শরীরের সৌন্দর্য তাকে পুরোপুরি বশীভূত করে ফেলেছে।
কারান দেয়ালে হেলান দিয়ে কাটখোট্টা গলায় বলল, “তুমি এই রুমে কি করছো?”

কারানের কথাটা কানে আসতেই মিরার এতক্ষণকার ঘোর ভেঙে গেল। কারান গম্ভীর কণ্ঠে আবার বলল, “এভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছো কেন? আগে কি ছেলে দেখোনি? নাকি আমার নতুন করে চেহারা খুলেছে?”
কারানের এমন লজ্জাজনক কথা শুনে মিরার কান লাল হয়ে গেল। সাথে যে অনেকটা অপমানিতবোধ করেছে সেটা যদি ঘোমটার আড়াল থেকে কারান মিরার লজ্জায় আরক্ত হয়ে কুঁচকে যাওয়া মুখশ্রী দেখতো, তাহলেই টের পেয়ে যেত। একটা মেয়ে হয়ে একটা ছেলের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল, আবার সেই ছেলেই ওভাবে কতগুলো লজ্জালু প্রশ্ন করলো, এই পরিস্থিতিতে পড়ার থেকে তো পটল তোলা ভালো ছিল।
মিরা অপ্রস্তুত হয়ে চোখের পলক বুঝিয়ে দাঁত দিয়ে কিঞ্চিৎ জিভ কেটে নিল। সাথে সাথে পিছন ফিরে নিজেকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “সরি সরি। আমি তো আসলে রুম গুছাতে এসেছিলাম।”
এরপর কারানের দিকে পালটা আঙুল ছুড়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কিন্তু আপনার কি লজ্জা নেই নাকি? এভাবে একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।”

মিরার এই বক্তব্য শুনে কারান বিস্মিত হলো। অর্থাৎ সে নিজের কক্ষে যেমন খুশি থাকবে, তাতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে! কারান ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল, “হিউমারাস (হাস্যকর), আমার কেন লজ্জা করবে? আর আমার তো সমস্যা নেই এভাবে থাকতে।”
“কিহ! কি সব বলছেন, হ্যাঁ? যান, অন্য রুমে গিয়ে জামাকাপড় পড়ে আসেন।”
কারান মিরার লজ্জা দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেও এখন বেশ মজা পাচ্ছে। এরপর তীর্যক হেসে ধীরে ধীরে মিরার দিকে অগ্রসর হলো। মিরার কানের কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলল, “কেন, তোমার কি লজ্জা লাগছে? ইফ ইউ ওয়ান্ট, আমি টাওয়ালটাও খুলে ফেলব।”
এতক্ষণ লজ্জার পরিমাণ সাধারণ পর্যায়ে থাকলেও এবার মিরার লজ্জা সপ্তম আকাশ ছুঁলো। হোক তারা স্বামী-স্ত্রী, কিন্তু এখন তো তাদের মধ্যে সাধারণ পতিপত্নীর মতো সম্পর্ক নেই। মিরা এক পলক নেত্রপল্লব বুঝিয়ে ফের খুলে, মিনমিনে গলায় বলল, “ছিঃইই, আল্লাহ! আপনার কি বিন্দুমাত্রও লজ্জা নেই?”

মিরার লজ্জা আর অস্বস্তি দেখে কারানের মনে খোশমেজাজি উন্মাদনা দেখা দেয়। তার হাস্যরসাত্মক মুখাবয়বের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়, এই মুহূর্তে সে গভীর আনন্দ অনুভব করছে। হঠাৎ করেই একটি খুকি কাশির শব্দ তুলে, অধর প্রসারিত করে কিছুক্ষণ হেসে বলল, “না, নেই। তাছাড়া তোমার তো রাইট আছে তোমার হাসবেন্ডকে সম্পূর্ণ দেখার। আমি না হয় টাওয়ালটা খুলেই ফেলি, তারপর তুমি তোমার হট সে’ক্সি হাসবেন্ডকে দেখো।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! একটা মানুষ এতটা লজ্জাহীন কীভাবে হতে পারে! আমি অন্য রুমে গেলাম। আপনি তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করুন প্লিজ,” বলেই মিরা দ্রুত দরজা থেকে বের হতে যাবে, তৎক্ষণাৎ কারান মিরার সামনে দাঁড়িয়ে, দুই হাত ছড়িয়ে তার যাওয়ার পথ আটকে দিল।
এরপর হেসে বলল, “উঁহুঁ, আমি তো তোমার সামনেই চেঞ্জ করবো, সুইটহার্ট।”
মিরা ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল, “দেখুন, এবার কিন্তু অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার মোটেও আপনাকে ঐভাবে দেখার ইচ্ছা নেই।”

“তোমাকে দেখতেই হবে, সোনা। আমি কিন্তু খুললাম।”
কারান তোয়ালেতে হাত দিতেই মিরা কারানের হাতের নিচে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আমি গেলাম, বাবা।”
মিরা প্রস্থান করার সঙ্গে সঙ্গে কারান খিলখিল করে হাসিতে ভরে উঠল। এটা তার গম্ভীর চেহারার পেছনের গাঢ় আবেগের দুর্লভ প্রকাশ।
ক্ষণকাল বাদে কারান পোশাক পরিবর্তন করে সাধারণ ঘরোয়া ধড়াচূড়া পরিধান করে সিঁড়ি থেকে নিচে নামতে থাকলো। কারানকে নজরে পড়তেই মিরা মনে মনে ভেংচি কেটে বলল, “নির্লজ্জটায় আসছে।”
কারান উচ্চস্বরে সম্ভাষণ করে, “ফরিদ কাকা।”

ফরিদ রান্নাঘর থেকে বৈঠকখানায় এসে নরম গলায় বলল, “জি, স্যার।”
কারান মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ফরিদ কাকা বাহিরের সব কেনাকাটা করে আনবে। আর এখন থেকে ঘরের সব কাজ তোমাকে করতে হবে। ঘর ঝাড় দেওয়া, ক্লিন করা, রান্না করা, ডিসেস ওয়াশ করা, গার্ডেনে পানি দেওয়া; এভ্রিথিং তোমাকে করতে হবে। (মনে মনে) যদি সম্মানহানির ব্যাপার না থাকতো…”
মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাজারটাও তোমাকে দিয়ে করাতাম।”
মিরা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার এমনিতেও কাজ করতে ভালো লাগে।”
কারান ম্লান হেসে বলল, “তাহলে তো ভালোই। (আপনমনে) আমিও দেখি কয়দিন আপনার ভালো লাগে। আমাকে বিয়ে করার শখ যদি না মিটিয়েছি বেবি, নিজে থেকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হবে।”
এরপর মিরা কারানকে কফি তৈরি করে দিতে গেল। কারান কফি খেয়ে, উপরে উঠে অফিসের পোশাক পরে, প্রভাতের নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। কারান বেরোতেই মিরার সারাদিনের নিরবচ্ছিন্ন কাজ শুরু হয়ে গেল। এ কাজের অন্ত নেই; একেকটি কাজ আরেকটিকে ধাবিত করে নিয়ে যাচ্ছে। দিনভর বিরতিহীন কাজ করতে করতে মিরার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

ঘড়ির কাঁটা রাত ৯টা পেরিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই কারান অফিস থেকে ফিরে এলো। পোশাক পরিবর্তন করে রাতের খাবার খেয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করল। মিরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন পাশের কক্ষে যেতে উদ্যত, তখনই কারান ঠান্ডা গলায় বলে উঠল, “একটা ফ্রেশ, স্পাইসি চাইনিজ পাস্তা বানিয়ে আনো।”
মিরা তৎক্ষণাৎ পিছনে ফিরে তাকাল, “চাইনিজ? কিন্তু চাইনিজ তো কখনো বানাইনি।”
“সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। যাও, তাড়াতাড়ি আনো।”
মিরা ইউটিউবের সাহায্যে পাস্তা বানিয়ে ফিরে এলো। কারান খাবার খেতে খেতে বলল, “এসির টেম্পারেচারটা কমাও।”
মিরা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো, চাপা ক্ষোভ তাকে নিঃশব্দে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু তাও টেম্পারেচার কমিয়ে দিল। কিন্তু কারান খাবার চিবাতে চিবাতে আবার বলল, “আরও।”
মিরা আবার টেম্পারেচার কমালো।

“টিভি অন করো।”
মিরা বিস্মিত হয়ে বলল, “কিন্তু আপনি তো ল্যাপটপে কাজ করছেন।”
কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “তোমাকে বেশি কথা বলতে বারণ করেছিলাম।”
মিরা কারানের দিকে তাকিয়ে অগত্যা টিভি অন করল। কিন্তু দেখলো, কারান টিভির দিকে চোখই তুলে তাকাচ্ছে না।
“চ্যানেল চেঞ্জ করো। আর এক গ্লাস পানি দাও।”
এবার মিরা বুঝতে পারল, কারান ইচ্ছে করেই এমন করছে। পাশে রাখা পানির গ্লাস তার হাতের কাছে রয়েছে, অথচ সে গ্লাসের জন্য আলাদা করে আদেশ করল। পানির গ্লাস হাতে দিয়ে মিরা কটমট করে তার দিকে তাকাল।
কারান পানি খেয়ে ভাবলেশহীনভাবে পায়ে চাপ দিতে দিতে বলল, “পায়ে প্রচুর পেইন হচ্ছে, ম্যাসাজ করে দাও তো।”

এবার মিরা বিরক্ত হয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, “আপনার কি আমাকে চাকরানী মনে হয়?”
কারান তাচ্ছিল্যের হাসিতে বলল, “স্বামীর সেবা করা যে স্ত্রীর ধর্ম, সেটাও কি জানো না? শেইম অন ইউ।”
মিরা মনে মনে বলল, “আপনি কি স্বামীর ধর্ম পালন করছেন?”
কিন্তু সে মুখের ওপর কথাটা প্রকাশ করতে পারলো না। এমন বদমেজাজি, রগচটা পুরুষকে পালটা উত্তর দেওয়ার মানসিকতা তার ছিল না। কারান ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ভারী গলায় বলল, “আর তোমার যদি এতই সমস্যা হয়, দরজা খোলা আছে। ইউ ক্যান গো।”
এই কথা শুনে মিরার মন খানিকটা বিষম খেল। অবশেষে সে নিশ্চুপ হয়ে ম্যাসাজ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর কারান বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল।
মিরা ল্যাপটপ অফ করে কারানকে শুইয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল। যেখানে তার ত্রুটি ও তীব্রতার মাঝেও একটি অব্যক্ত প্রেমকে অনুভব করতে চায়।

মিরা কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “ইশ, কী সুন্দর লাগছে ওকে! তবে দেখতে যতটা সুদর্শন, তার ব্যবহার ততটাই তিক্ত। (একটু থেমে) এত রাগ? কিন্তু আমি তো আপনাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবেসে ফেলেছি, কারান। বিয়ের আগে থেকেই আপনার সঙ্গে সম্পর্কিত হাজারো স্বপ্নে ভেসেছি। বলুন, আমি কী করব? একবারও কি আমাকে ভালোবাসা যায় না?”
এই সব প্রশ্ন মিরার মনে ভিড় করতে লাগল, প্রতিটি কৌতূহল তাকে আরও গভীর গহনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সহসা ঘুমের মধ্যে কারান মিরাকে শাঁসালো, “ম্যাসাজ করছো না কেন, হুম? ম্যাসাজ করো।”
মিরা সারা রাত না ঘুমিয়ে, পরিশ্রান্ত শরীরে মালিশ করতে থাকলো। একই সঙ্গে কারানকে নিয়ে নানা প্রশ্নের জালে ভাসতে লাগল। তার মনে প্রেমের অনুভূতি ও হতাশা, দুটি একই সরলরেখায় অবস্থান করছে।

মিরা সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। শরীরটাও ক্লান্তির ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। তার খুব ইচ্ছে করছে, বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমের আলিঙ্গনে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। কিন্তু কারানের অফিসে যাওয়ার জন্য নাস্তা বানাতে হবে, তারপর ঘর পরিষ্কার করা, ঝাড় দেওয়া; অসংখ্য কাজ অপেক্ষায় আছে।
মিরা ক্লান্ত দৃষ্টিতে বলে, “উফ! সারারাত একটুও ঘুমাইনি, মনে হচ্ছে শরীর থেকে সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। চোখের সামনে সবকিছু যেন ঝাপসা লাগছে। বাকি কাজগুলো পরে হবে। আগে ওর কফি আর নাস্তা বানাই।”
মিরা নাস্তা তৈরি করে। কারান ভোরের নরম আলোয় অফিসের পোশাকে গা গলিয়ে দিয়ে খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। মিরা তখন ঘুমের ক্লান্তিতে টলমল করছে, শরীরটা আর ভার ধরে রাখতে পারছে না। অবশেষে কক্ষে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

তিন ঘণ্টা পর, হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ঘুমটা ভেঙে যায়।
মায়ের ফোন দেখে মিরার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
খুশিতে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “আসসালামু আলাইকুম মা! কেমন আছো?”
মমতাজ হেসে উত্তর দিলেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস, আর জামাই বাবা কেমন আছে?”
মমতাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বলেন, “কতদিন মেয়েটাকে দেখিনি! বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তবুও তোর সুখের কথা ভেবে কিছু বলি না।”
এটা ভাবতেই মমতাজের চোখের কোণে জল জমে উঠল।
এদিকে মিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। ‘জামাই’ শব্দটা তার ভেতর গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করল। মিরা বোঝে, স্বামীর সাথে সম্পর্কের জটিলতা মাকে জানানো যাবে না, সেই অব্যক্ত বিষাদে মুখোশ পরেই থাকতে হবে। যে মা এত ভালোবাসা দিয়ে তাকে লালন করেছে, নিজের বুকের সমস্ত আবেগ চেপে রেখেও জগৎ-সংসারের নিয়মে মেয়েকে অন্য ঘরে পাঠিয়েছে, সেই মায়ের কোমল হৃদয়কে আঘাত করার মতো ক্ষমতা তার নেই।
মমতাজ উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, “কই মা, কথা বলছিস না কেন?”
মিরা একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল, “ভালো আছি মা, খুব ভালো। খুব খুশি আছি। (একটু থেমে) আর সে তো সবসময়ই ভালো থাকে।”
মমতাজ খুশিতে হাসলেন।

“আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ! এটাই তো চাই।”
অথচ মিরা মুখ নীচু করে, মায়ের হাসির উচ্ছ্বাসের বিপরীতে নিজের বিষণ্নতা চেপে ধরে বসে থাকে।
মমতাজ পুনরায় স্বচ্ছ স্বরে বললেন, “শোন মা, তোকে কিছু কথা বলতে ফোন করেছি। তুই আমার আদরের মেয়ে, জীবনের প্রতিটি ধাপে তোর পাশে ছিলাম। উপদেশ দিয়েছি, তুই কখনো আমার কথা ফেলিসনি। আজ তুই সংসারী হয়েছিস, তাই কিছু কথা বলা দরকার।”
মিরা কণ্ঠ নীচু করে বলল, “হ্যাঁ মা, বলো।”
মমতাজ একটুখানি থেমে গম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “তুই মুসলিম ঘরের মেয়ে। জানিসই তো, ইসলামে স্বামীর স্থান কতটা পবিত্র। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক রক্তের বাঁধনে বাঁধা, যেখানে হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন হয় একে অপরের জন্য। এই সম্পর্কের মহিমা এতটাই গভীর যে, তা শুধু ভালোবাসা দিয়েই পূর্ণ হয় না, ত্যাগ আর সহমর্মিতার মূলে গড়ে ওঠে। তোর স্বামী এখন থেকে তোর জীবনের সবচেয়ে আপনজন। তোর বাবা-মায়ের জায়গাও ওর জন্য উৎসর্গ করবি।

জীবনের পথে চলতে গিয়ে অনেক কষ্ট, অনেক রাগ-অভিমান আসতে পারে; কিন্তু মনে রাখিস, যত ঝড়ঝাপটা আসুক না কেন, তুই সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখবি। স্বামীর শান্তি তোর ভালোবাসাতেই নিহিত। ওর মন খারাপ হলে তুই শান্ত থাকবি, তাকে বুঝবি। তর্কে জড়াস না বরং ভালোবাসা দিয়ে ওর মনের দুয়ার খুলে দিবি। সেই নারীই প্রকৃত বিজয়ী, যে স্বামীর হৃদয়কে ত্যাগ আর ভালোবাসার শক্তি দিয়ে জয় করে নেয়। যতটা পারিস, তাকে আদর দিবি, যত্নে রাখবি। স্বামীর সুখেই স্ত্রীর সুখ নিহিত;এই সত্যটুকু কখনো ভুলে যাস না। তোদের জন্য সবসময় দোয়া করি। সুখী হ মা। ‘ভালোবাসা হলো সেই পবিত্র ফুল যা যত্ন পেলে চিরকাল ফুটে থাকে। ভালোবাসা হলো সেই পবিত্র বন্ধন, যা সম্পর্ককে মৃত্যুর পরও বেঁধে রাখে।’ বুঝতে পারলি?”

মায়ের কথাগুলো শুনে মিরার চোখ জলে ভরে উঠল। সে যেন চিৎকার করে বলতে চায়, ‘মিথ্যা মা, যা দেখানো হয় সবই মিথ্যা। তুমি যে সুখের কথা বলছো, তা আমার জীবনে নেই। কতদিন তোমার কোলে শুতে পারি না, তোমার মমতামাখা হাতের স্পর্শ পাই না। আমার ক্লান্ত, অশান্ত মনের ভার তুমি ছাড়া আর কে বুঝবে মা?’ মিরার ভেতর থেকে এসব কথা বেড়িয়ে আসতে চায়, কিন্তু বের হতে পারে না। মাকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার তার নেই।
মিরা শান্তভাবে বলে, “মা, আমি তোমার সব কথা মেনে চলার চেষ্টা করবো। তুমি চিন্তা করো না।”
মমতাজ স্মিতহাস্যে বেশ খুশি হলেন।
মিরার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। হাতের উলটো পাশের সহিত মুছে নিয়ে প্রশ্ন করল, “বাবা আর মাহি কেমন আছে? বললে না তো।”
“সবাই ভালো আছে রে। মাহি তো সারাদিন বলে আপুকে দেখতে যাবো, আপুকে দেখতে যাবো। এখন ওরও কিছুতে মন বসে না। মাঝে মাঝে এসে অভিযোগ করে, কেন তোকে বিয়ে দিলাম।”

কথাটা শুনে মিরার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মাহিমা, বাবা-মায়ের কথা তারও যে খুব মনে পড়ে। ইতোমধ্যেই তার চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরতে লাগল। গলাও ভারী হয়ে উঠেছে, এখন কোনো কথা বললেই কান্না ছুটে যাবে। মায়ের সামনে কষ্টগুলো প্রকাশ করার সাহসও নেই। মমতাজও ফোনের ও প্রান্ত থেকে মিরার অশান্তি অনুভব করতে পারছে না। মেয়ে ভালো আছে ভেবে নিশ্চিন্ত থাকছেন। অর্থাৎ মিরার নিখুঁত অভিনয় তাকে এড়িয়ে রাখছে।

মমতাজের আবেগপূর্ণ কথা এড়ানোর জন্য মিরা হঠাৎ বলে উঠল, “মা, ঘরের কিছু কাজ বাকি আছে। জানো, তোমার জামাই আমাকে কোনো কাজই করতে দেয় না। শুধু বলে, সার্ভেন্টরা করবে। কিন্তু আমার সময় কাটে না, তাই নিজে থেকে কিছু কাজের দায়িত্ব নিয়েছি। আর তোমাদের কল দিতে না পারলে অভিমান করো না প্লিজ। আসলে কারান এটা ওটা করে সবসময় সাথে থাকে, তাই সময় হয়ে উঠে না মা।”
অথচ বলে না যে কাজের ভারে আর সময় থাকে না।
মিরার কথায় মমতাজ খুশি হয়ে বলে উঠলেন, “এটা তো ভালো কথা, তুই সুখে আছিস শুনে মনটা ভরে গেল। আচ্ছা মা, তুই কাজ কর। আল্লাহ হাফেজ সোনা।”
কলটা কেটে যেতেই মিরার মন ভারী হয়ে গেল, কিন্তু কাঁদারও সময় নেই। ঘরের এত কাজ, সবকিছু যে প্রতীক্ষা করে আছে।

মিরা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাটিয়েছে। রাতের আঁধার ক্রমশ নেমে এসেছে। নয়টা বাজলেই একরোখা কারানের আগমন ঘটবে, এই আশায় টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে বসে আছে সে। কিন্তু কারান এসেই দ্রুত পায়ের আওয়াজে উপরে চলে গেল। মিরা ক্ষণিকের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে তার চলে যাওয়া দেখল। মনে মনে ভেবেছিল, কিছুক্ষণ পরই ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসবে সে।
কিন্তু অবিরাম অপেক্ষার পরও কারান আসছে না দেখে মিরা উপরে চলে গেল। সে দেখল, কারান বিছানায় বসে দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। মিরা বুঝতে পারছিল না, কীভাবে কারানকে ডাকা যায়। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করলেও, হেডফোনের কারণে সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। অতঃপর আরও কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করলেও কারানের পূর্বের মতোই কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। শেষপর্যন্ত, উপায়ন্তর না দেখে হাত দিয়ে কারানকে ছুঁতে যাবে, তখনই কারান চোখ খুলল।
কারান বিচক্ষণ গলায় বলল, “সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে এসেছো?”
মিরা তার এমন কথায় বেশ লজ্জায় পড়ল। পরে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “আজব! আমি তো আপনাকে ডিনারের জন্য ডাকতে এসেছি।”
“জানি জানি। তোমার মতো মেয়ে তো, ভালো করেই চেনা আছে। আর আমি খেয়েই এসেছি। তাছাড়া এত পতি-ভক্তি দেখাতে হবে না।”

কারানের তিরস্কার শুনে মিরার বক্ষঃস্থল চুরমার হয়ে গেল, তবুও মুখে কোনো কথা বলল না। কারণ সে আগে থেকেই অবগত, কারানকে কিছু বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা।
পরবর্তীতে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই, কারান মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, “ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা দাও।”
শুনেই মিরার মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কারান যে সিগারেট খায়, এটা তার জানা ছিল না।
মিরা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসে, “সিগারেট?”
কারান শ্বাস টেনে বলে, “তুমি আগে ওটোল্যারিংগলজিস্ট (কানের ডাক্তার) দেখাও।”
এবার ক্ষুব্ধ হয়ে চেঁচিয়ে বলে, “একবার বললে বুঝো না নাকি?”
মিরা মাথা নত করে রিনরিনে গলায় বলে, “সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। তাই আপনাকে জাস্ট অ্যাডভাইস দিচ্ছি, ওগুলো খাবেন না।”

কারান হালকা হেসে বলে, “ব্লাডি ড্রামা গার্ল। আমাকে এক্সজোরটেশন (উপদেশ) দিতে এসেছে।”
এবার চোখ রাঙিয়ে কটমট করে দ্বিরুক্তি করে, “সিগারেটের প্যাকেটটা দাও, এক্ষুনি।”
তথাপি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিরা ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে কারানের হাতে তুলে দিল। কারান প্যাকেট খুলে একটি সিগারেট ঠোঁটে রাখল, আগুন জ্বালিয়ে দীর্ঘ টান দিল। আর ধোঁয়ার ঘন কুণ্ডলী বাতাসে মিশে যেতে থাকল। মিরা এ দৃশ্য অপছন্দ করলেও নিজেকে শান্ত রাখল। মনে মনে ভাবল, আজকালকার ছেলেরা এসব খাবেই। কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে কারানের দিকে তাকিয়ে দেখল, তার প্রতিটি নিশ্বাস ধোঁয়ার আবরণে হারিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে একগাদা শ্বাস ফেলে, নিচে নেমে এসে খাবার টেবিলে বসল। কিন্তু যতই সান্ত্বনা খুঁজতে চাইল, খাবার তার গলায় আটকে রইল। কারানের এমন রূপ মিরার ভালো লাগছে না। যদিও সে তার স্বামী, তবু ভালোবাসার মধ্যেও কিছু অপছন্দের জায়গা থাকে। যখন প্রিয় মানুষটিই সেই পছন্দগুলো উপেক্ষা করে, তখন ভালোবাসার সঙ্গে এক অদ্ভুত বিরোধ শুরু হয়।
মিরা মন ভার করে আপনমনে বলে, “নিজেকে ক্ষতি করে আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন?”
এরপর কোনো মতে দুই লোকমা মুখে দিয়ে শুতে চলে গেল।
মনের গভীরে অজানা যন্ত্রণা চেপে বসেছে, যার সুরাহা সে করতে পারছে না। কারানের ধোঁয়াভরা নিশ্বাস তার ভালোবাসার পৃথিবীকে ঢেকে দিচ্ছে।

আজকের দিনটি কারানের ছুটির দিন। সূর্য কিঞ্চিৎ অলসভাবে ওঠার পর, সে ঘরের কোণায় বসে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। পাশের কক্ষে মিরা তার বইয়ের শেলফ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। সেই শেলফে স্থান পেয়েছে বাংলা সাহিত্যের নন্দিত রচনাগুলি।
আরেক পাশের শেলফে কালজয়ী ইংরেজি সাহিত্যের বই রাখা। দ্বিতীয় শেলফে রাখা নামজাদা বিজ্ঞানীদের কিতাব, আর তৃতীয় শেলফে কিংবদন্তি দার্শনিকদের গ্রন্থ। কিছু ঔপন্যাসিকদের জীবনীও রয়েছে সেখানে। এই বইগুলো সবই কারানের প্রিয় সংগ্রহের অংশ। কিছু বইয়ের মাঝের পাতা ভাঁজ করা। হয়ত ভবিষ্যতে পুনরায় সেই পাতাগুলোয় ফিরে আসার জন্য ভাঁজ রেখে গেছে।

বাইরে স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। সকালে সূর্যের ম্লান রোদ কারানের কক্ষের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বিছানার চাদরে এসে পড়েছে। বেলকনির জানালার পাশে টবে সাজানো রয়েছে কিছু মনোমুগ্ধকর গাছ। লাল গোলাপের ভিড়ে শোভা পাচ্ছে চন্দ্রমল্লিকার সৌন্দর্য। আরেকধারে রয়েছে মানিপ্লান্ট, যার লতাগুলো জানালার গ্রিল বেয়ে নিচে চলে গেছে।
মৃদু অনিলে সব গাছগুলো আলতোভাবে নড়ছে। কাচের বেলকনি থেকে বাইরের পরিবেশটি অপরূপভাবে দৃশ্যমান।
কিছুক্ষণ পর কারান ল্যাপটপ বন্ধ করে গিটারটি হাতে তুলে নিল।
শীতলতম মসৃণ আবহাওয়ার মধ্যে গিটার বাজাতে বাজাতে সে গান ধরল,
“ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়াআআ।
ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া।
বন্দি হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে কান্দে রইয়া রইয়াআ।
বন্দি হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে কান্দে রইয়া রইয়া।
কাছের মানুষ দূরে থুইয়া মরি আমি ধরফড়াইয়া রেএএএ
কাছের মানুষ দূরে থুইয়া মরি আমি ধরফড়াইয়া রে।”

মিরা কারানের গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে কারানের আলয়ের দরজার কাছে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। কারান জানত না, মিরা পাশের কক্ষে নিঃসীম মনোযোগে কাজ করছে। তাই সে নিজের কণ্ঠের সবটুকু সুর ঢেলে গান গেয়ে যেতে থাকে। এদিকে মিরা চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে গভীর তন্ময়তায় সেই সুরের মায়ায় ডুবে যায়।
“দারুণ জ্বালা দিবানিশি, দারুণ জ্বালা দিবানিশি অন্তরে অন্তরে।
আমার এত সাধের মন…”
এর মধ্যে কারান হঠাৎ থেমে গেল। সামনে মিরাকে দেখে তার চোখ বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল।
মিরা ধীরগতিতে চোখ মেলে তাকাল। তার কণ্ঠস্বরে অমৃতের সুধা ঝরে পড়ল, “থেমে গেলেন কেন?”
কারান একটু বিব্রত হয়ে নিজেকে সামলে নিল।
অপ্রস্তুত গলায় বলল, “তুমি? তুমি কখন এলে এখানে?”

মিরা একটু হেসে নরম স্বরে বলল, “আমি তো পাশের ঘরেই ছিলাম। আপনার গান শুনে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। শুধু শুনছিলাম আর শব্দের মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম। এত মুগ্ধতায় আপনি বাংলা গান গাইতে পারেন, ভাবতেও পারিনি। আপনার কণ্ঠে এমন সুর, এমন মাধুর্য; মনে হচ্ছিল, অন্য কোনো জগতে হারিয়ে যাচ্ছি। যদি আপনার কোলে মাথা রেখে এই গানটা আরেকবার শুনতে পেতাম, তবে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মনে করতাম।”
মিরার কথাগুলো কারানের মনে বিষের মতো বেজে উঠছিল। যাকে জীবন থেকে উপচে ফেলার পাঁয়তারা করছে, তার মুখে এত সুখের কথা শুনতে চায়নি সে।
কিছুক্ষণ পর স্বরকে কঠোর করে বলল, “When I am in the room, no one may enter without my explicit permission.”
এই কথা বলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গিটারটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে, হাতে সানগ্লাস তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কারান যাওয়ার পর মিরা গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। সে ভাবতে শুরু করল, কী এমন ভুল করেছে যে কারান এভাবে চলে গেল। সত্যিই কি তার কোনো অন্যায় ছিল?
মিরা বিছানায় বসে মন বেজার করে আওড়াল, “আপনার মুখে গান শোনাও কি আমার দোষ? এখন কি কানে তালা দিয়ে রাখব? সবকিছুতেই এত রাগ করার কি আছে? মনে হয় জন্মের সময় তাকে নিমপাতার রস খাওয়ানো হয়েছিল, তাই সারা দিন অদ্ভুত অভিব্যক্তি নিয়ে থাকে।”
ভেংচি কেটে ফের বলে, “আমি ভাবছি, তার সাথে প্রেম করা যায় কিনা। কিন্তু সে সুযোগ তো দেবেই না, উলটো সাপের মতো ফোঁস করে উঠবে। নিশ্চয়ই এটার সাথে সাপের কোনো কানেকশন আছে, তাই কিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। মাঝে মাঝে তো ভয়ই পেয়ে যাই, কখন না সাপটা কামড় দিয়ে বসে। বেটা একটা কালনাগ।”
এরপর অযাচিত ভাবনায় সে ঘরের কাজ করতে চলে গেল।
অথচ কারান বাইরে বের হয়ে ফুঁসতে থাকল। মিরার কথাগুলো তার মনে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কী দরকার ছিল তার গান শোনার? মনের সুখে গানটাও গাইতে দিল না। যদি মিরার মাথাটা ধরে আছাড় মারতে পারত, তাহলে হয়ত কিছুটা ক্ষোভ কমতো।
সে দ্রুত তার বন্ধুকে ফোন করল, “Abid. I’ll be heading to your place. And just so you know, we’re going to the nightclub tonight.” বলেই ফোন কেটে দিল।

কারান রাতে মাতাল অবস্থায় বাসায় ফিরল। দরজায় একের পর এক প্রবল আঘাত করতে থাকলে মিরার মনে অজানা ভয় দানা বাঁধল। কলিংবেল থাকা সত্ত্বেও এমনভাবে কে ধাক্কা দিচ্ছে? দ্বিধা ও আতঙ্কে দরজা খুলে দেখল, কারান দেয়ালের পাশে হেলে দরজায় ক্রমাগত আঘাত করছে।
কারান চেঁচিয়ে বলে, “এত সময় লাগল দরজা খুলতে?” বলেই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
মিরা স্তব্ধ হয়ে দেখল, কারানের দৃষ্টি ঝাপসা; সে নেশায় বুঁদ। কারান সিঁড়িতে পা দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে নিচে বসে পড়ল।

মিরা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরতে চাইলে, কারান ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠল, “এই মেয়ে, হাউ ডেয়ার ইউ হ্যাভ দি অড্যাসিটি টু টাচ মি? অ্যান্ড লিসেন, আই ক্যান গো এ্যালোন, আমার কারোর সাহায্যের দরকার নেই।”
কারানের কথার সাথে সাথে তার মুখ থেকে উদ্ভট, গা গোলানো দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
মিরা নাকের কাছে হাত দিয়ে বলল, “ছিঃ! আপনি কি অ্যালকোহল নিয়েছেন?”
কারান দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মিরার দিকে তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, নিয়েছি। আমি সিগারেট খাই, মদ খাই, গাঁজা খাই, জুয়া খেলি, ইভেন বারেও যাবো। যা ইচ্ছা তাই করবো। তোর বাপের কি রে?”
কারানের এমন কুশ্রী বাক্য শুনে মিরার মাথা রাগে তেঁতিয়ে উঠল।
ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“Mind your words! Have you no sense of decency (শিষ্টাচার)? Who gave you the nerve to insult someone’s parents like that?”

কথাটি শুনে কারানের মাথা রাগে দিম্মা হয়ে উঠল। তার চোখে জ্বলজ্বলে ক্ষোভের আগুন দেখা দিল। মুহূর্তের মধ্যে সে সপাটে জোরে মিরার গালে প্রহার করলো। মিরার গালে তার পাঁচটি আঙ্গুলের দাগ গভীরভাবে চিহ্নিত হলো।
কারান ফুঁসতে ফুঁসতে প্রবল আক্রোশে বলল, “My entire life has crumbled for your sake. I loathe (ঘৃণা করা) you.”
তারপর মিরাকে ধাক্কা দিয়ে পুনরায় বলল, “সরে যা আমার সামনে থেকে।”
কারানের ধাক্কায় মিরা নিচে বসে পড়ল। কারান টলতে টলতে দেয়াল ধরে উপরে চলে গেল। কিছুক্ষণ মিরা গালে হাত দিয়ে ফোঁপাতে থাকল। তার অশ্রুতে শাড়ির একপাশ ভিজে গেছে, আর ব্যথায় গালদুটি ফুলে উঠেছে।
অনেকক্ষণ পর, কারানের অন্দরে গিয়ে দেখল, কারান সুজুতো পরেই শুয়ে পড়েছে। স্ত্রীর দায়িত্বের প্রতি মায়া ও সমর্পণের ভাবনায়, হাজারো যন্ত্রণার মধ্যে সে কারানের জুতো খুলে দিল। এরপর ক্ষণকাল তার দিকে কান্নামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে রইল। অর্থাৎ তার গলায় বলার জন্য অনেক কিছু জমে রয়েছে, কিন্তু তা কণ্ঠনালি অতিক্রম করতে পারছে না।

সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আপনমনে বলে উঠল, “আমি শুধু দেখব, আপনি আর কতভাবে আমাকে কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারেন। সহ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করব, শুধু একবার আপনার ভালোবাসার স্বরূপ দেখার আশায়। তারপর… তারপর হয়তো কোনোদিন আপনি মিরাকে চিনবেন। সেই মিরা, যাকে এতদিন নরম, কোমল আর দুর্বল ভেবেছেন। অথচ আমি যতটা নরম, তার চেয়েও বেশি ভেতরে কঠিন আমি। আমি কোমল হতে পারি, কিন্তু ভঙ্গুর নই। সময় হলে আমি আমার কঠিন রূপও আপনাকে দেখাব।”
সে ধীরে পেছন ফিরে অন্য কক্ষে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার এক কোণে স্থির হয়ে বসে রইল। তার মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখেও নেই কোনো অভিব্যক্তি। কিন্তু নিঃশব্দে ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দুগুলো যেন হাহাকারের ভাষা হয়ে বুকে গেঁথে যাচ্ছে।
এভাবেই প্রতিদিন সকালে কারান অফিসে যায়, আর রাতে নেশায় মাতাল হয়ে ফিরে আসে। মিরার জন্য এই পরিস্থিতি এখন সহ্য হয়ে গেছে। স্বামী বলে তার কিছুই করার নেই; সেই সঙ্গে জননীর কঠোর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে।
অথচ মনের গভীরে অপমানের আঁচড় প্রতিটি মুহূর্ত তার আত্মায় ছুরির মতো আঘাত করে চলেছে।

আজও কারান মাতাল অবস্থায় দরজা ধাক্কাচ্ছিল। মিরা দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলতেই তার সামনে উপস্থাপিত হলো একটি বিব্রতকর দৃশ্য।
কারান নিজের গায়ে এবং মিরার গায়ে বমি করে দিল। মিরা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল, কয়েকদিন ধরে টানা স্ট্রং অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে কারানের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে।
যতটা সম্ভব সাহস জোগাড় করে কারানের বাহু ধরে তাকে বাথরুমে নিয়ে গেল। পানি দিয়ে তার শরীর ধোয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কোট ও শার্টটি খুলে পাশে রেখে মিরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কারানের নগ্ন ঊর্ধ্বাংশের দিকে তাকিয়ে মিরা এক পলকও চোখ সরাতে পারছে না।
মিরার অন্তরে যে বেদনার বন্যা বয়ে চলছিল, তা এই মুহূর্তে আরও প্রবল হয়ে উঠল। সে জানত না, এই পরিস্থিতি আর কতদিন সহ্য করতে হবে, তবুও তার হৃদয়ে গভীর সহানুভূতির অনুভূতি ছিল।
কারানের ফরসা গায়ে পানি পড়ার ফলে আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

মিরা মনে মনে ভাবল, “আমি বারবার আপনার থেকে দূরে থাকতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছি। আপনার এই চমৎকার নীল চোখগুলো বারংবার আমাকে টেনে নেয়। জানেন, আপনার আচরণে মাঝে মাঝে আমার মনে এত কষ্ট জন্মায় যে মনে হয়, আপনাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিলে হয়ত শান্তি লাগতো। কিন্তু আপনি তো আমার স্বামী। কখনো বোঝানোর সুযোগও দেন না। কিন্তু আমি যে আপনাকে আগলে রাখতে চাই, যত্ন করতে চাই, ভালোবাসতে চাই। আপনার প্রতি আমার আকর্ষণ অবিরাম, কিন্তু এর মানে খুঁজে পাই না। আপনাকে ঘৃণা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার এই নীল চোখগুলো বারবার আমাকে জানান দিচ্ছে, ‘অপেক্ষা করো মিরা, একদিন না একদিন কারানের সমস্ত হৃদয় জুড়ে তুমি থাকবে।’ কিন্তু সেই দিনটি কবে আসবে কারান?”

মিরা এসব ভাবতে ভাবতে কারানের শরীর ধুতে থাকে। এর মধ্যেই হঠাৎ কারান তার হাত ধরে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এভাবে প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে মিরা সহসা শিউরে উঠল। যাকে নিয়ে এত প্রত্যাশার সঞ্চয়, তার ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া অনুভব করে সে মুহূর্তে নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। কারানের গায়ে পানি দেওয়া ছেড়ে সোজা হয়ে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। স্বামীর উষ্ণ আলিঙ্গনে মিরার অন্তর কেঁপে উঠলো। চোখের কোন থেকে একফোঁটা অশ্রুসিক্ত নোনাজল ঝরে পড়ল।
কারান মিরার ঘাড়ের চুল সরিয়ে তার চোয়াল মিরার ঘাড়ে কিছুক্ষণ ঘষে, আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল, “মিরা, তুমি আমাকে কেন বিয়ে করলে বলো তো?”
মিরার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। কারানের উষ্ণ নিশ্বাস মিরার কাঁধে পড়ছে, আর তার পুরো শরীরে এক অবিরাম স্রোত কম্পন দিয়ে উঠছে। তার হৃদয়ের স্পন্দন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
কারান আবার গুনগুনিয়ে বলে, “তুমি তো কোনো ভালো ছেলেকে বিয়ে করতে পারতে। (খানিকটা থেমে) তোমাকে একটা মজার কথা বলি। কালকে বাবা ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মিরা কেমন আছে? আমি কি উত্তর দিয়েছি জানো?”

মিরা ঢোক গিলে আস্তে করে বলল, “কিহহ?”
কারান ঠোঁটের কোণে স্বচ্ছ হাসি ফুটিয়ে জবাব দেয়, “আমি বলেছি, ‘কে মিরা?’ তখন বাবা বলেছে, ‘কে আবার, তোর বউয়ের কথা জানতে চাইছি।'”
তারপর কিছুক্ষণ থেমে কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “তখন আমি বুঝলাম, আমার বউয়ের নাম তাহলে মিরা।”
কথাটি মিরার কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই তার চোখ ছলছল করে উঠলো। প্রথমবারের মতো কারান নিজেই স্বীকার করলো, মিরা তার বউ। এর মানে, সে সত্যিই কারানের মনে একটি বিশেষ জায়গা করে নিতে পেরেছে। মিরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল; আজ তার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। কিছুক্ষণ আগেও সে যে ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তা হঠাৎই সত্যি হয়ে গেল। অর্থাৎ এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হওয়ার মতো অবস্থা।
কারান আবার গুনগুনিয়ে বলে, “আমি বিয়ের আগে তোমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না। তোমার নামটাও কখনো জানতে চাইনি। (একটু থেমে) মিরা।”

কথাগুলো মিরার অন্তরে এক নতুন আলোর প্রদীপ জ্বেলে দেয়। সে অতীতের সমস্ত শঙ্কা ও দ্বিধাকে কাটিয়ে উঠে, আজকের এই বিশেষ মুহূর্তে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলো। তার মনে হচ্ছে, ভালোবাসা তার কাছে আসতে শুরু করেছে, আর তার হৃদয়ে একটি গভীর আনন্দের অনুভূতি উদ্ভাসিত হচ্ছে।
মিরা ঢোক গিলে বলে, “হুমম।”
“আমার মাঝে মাঝে তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, সত্যিই কি আমার তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে?”

কারানের এই প্রশ্নটি মিরার অন্তরে অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করে। কি কঠিন প্রশ্ন! মিরা জানে, এসব কথা কারান নেশার ঘোরে বলছে। কিন্তু তবুও, এই শব্দগুলো শুনতে তার হৃদয়ে গভীর সুখের রেশ জাগায়।
মিরা নিজের মনে ভাবতে থাকে, “স্বামীর সুখ কি এমনই হয়? এত কিছু পার হওয়ার পরও কেন যেন আমি ওকে অতিকাঙ্ক্ষিত মনে করছি। ওর শিশুসুলভ প্রশ্নগুলো শুনে আমার আনন্দ হচ্ছে। এতটা খুশি কেন হচ্ছি? যেন বুকের জমে থাকা সমস্ত কষ্ট ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! কেবল ওর একবার জড়িয়ে ধরার এত ক্ষমতা?”

Tell me who I am part 3

কারান সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করে, “মিরা, তুমি এত বড় ঘোমটা দাও কেন? তুমি কি দেখতে খুব খারাপ, হ্যাঁ?”
মিরা শীতল কণ্ঠে জবাব দেয়, “জানিনা। স্বামীর আদেশ। সে আমার মুখ দেখতে চায় না।”
কারান সামান্য হেসে বলে, “স্বামীর আদেশ! (একটু থেমে) তোমার কাছে একটা আবদার করতে পারি?”
“বলুন।”
“তোমাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।”

Tell me who I am part 5