Tell me who I am part 5
আয়সা ইসলাম মনি
কারানের এই কথাটি মিরার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোকে তোলপাড় করে তোলে। তার মনে মিশ্র আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ে। হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে, ঠোঁট তিরতির করে কেঁপে ওঠে। দীর্ঘশ্বাসও ক্রমশ গভীরতর হচ্ছে।
এরই মধ্যে কারান ঝরনা ছেড়ে দেয় এবং দুজনের গায়ে ঝরনার স্নিগ্ধ পানি পড়তে শুরু করে। এই পানি মিরার শরীরে নতুন একটি প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করে। কী অদ্ভুত অনুভূতি! মিরার চোখে অশ্রুবিন্দুর উপস্থিতি ভাসে।
কারান আরও শক্ত করে নিবিড়ভাবে মিরাকে জড়িয়ে ধরে। আবার প্রশ্ন করে, “করবো কিস?”
এর মধ্যেই কারান হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল। মিরা বিস্মিত, এমন কি ঘটল যে তার এতো বেদনা?
মিরা শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “কি হয়েছে কারান? আপনি কাঁদছেন কেন?”
কারান তাকে আরও গভীরভাবে কাছে টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদল। ক্ষণকাল পর অকস্মাৎ মিরাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল।
মিরার মুখ থেকে চাপা আর্তনাদ নিসৃত হলো, “আহ!”
বাথটবের কোনায় আঘাত লেগে মিরার কপাল ফেটে গেল। তৎক্ষণাৎ রক্ত ঝরতে শুরু করলে সে হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরল।
কারান রূঢ় স্বরে চিৎকার করে উঠল, “Step back from me! I can’t bear to be around you any longer. Goofy (বোকা) girl!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথা শেষ করেই সে দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেল। পরে কাপড় পরিবর্তন করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
অন্যদিকে, মিরা বাথটবের পাশে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজের অসহায় শরীরটাকে টেনে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিল। যাকে ঘিরে এত স্বপ্ন বুনেছিল, এক মুহূর্তে সে সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিল।
সারারাত ঝর্ণার ধারা গড়িয়ে পড়ল তার নিস্তব্ধ শরীরে, আর সাথে সেই সিক্ততা ধীরে ধীরে তাকে ঠান্ডা করল, ঠান্ডা থেকে জ্বর।
পরেরদিন মিরা বিছানায় শুয়ে জ্বরে কাঁপছে। তার শরীর এবং মন দুটোই ভেঙে পড়েছে। কিন্তু কারানের চোখে এসব ধরা পড়ল না। এমনকি মিরার জ্বর দেখলেও হয়ত তার হৃদয়ে কোনো ঝড় উঠত না।
কারান দূর থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, “মিরা!”
কিন্তু মিরা নিস্তব্ধ, চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। অর্থাৎ শব্দ তার কানে পৌঁছালেও, সাড়া দেওয়ার ইচ্ছে আর নেই।
কারান ক্রোধে তেতে উঠে চিৎকার করে বলে উঠল, “ফরিদ কাকা! এতবার ডাকছি, কোনো সাড়া পাচ্ছি না কেন?”
ফরিদ মিয়া কিছুটা সংকোচ নিয়ে এগিয়ে এল, “স্যার, ম্যাডামের অনেক জ্বর হয়েছে। আপনি বললে আমি কাজ..”
“কেন, তুমি কেন করবে? তোমার যতটুকু কাজ, ততটুকুই করবে। জ্বর হয়েছে, মরে তো যায়নি! মেডিসিন নিয়ে আমার রুমে আসতে বলো,” কারানের কণ্ঠে বিরক্তি ও অবজ্ঞা মিলেমিশে ঝরে পড়ল।
ফরিদ মিয়া মালিকের কথা ফেলতে পারে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সে বাধ্য হয়ে মিরার কক্ষে গিয়ে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তুলে বলল, “মিরা ম্যাডাম, ওষুধ এনেছি। খেয়ে নিন।”
মিরার কোনো সাড়া না পেয়ে ফরিদ মিয়া আস্তে করে কক্ষের ভেতরে পা রাখল। দেখল, মিরা ললাটে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ফরিদ মিয়া মিরাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। কখনো কখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। যদিও জানেন, কারানের মতো মানুষের সামনে সে সাহস দেখানো কঠিন। কারানের আচরণে তারও মনের মধ্যে চাপা কষ্ট জমে থাকে, কিন্তু মালিকের সামনে সে অসহায়।
ফরিদ মিয়া শান্ত গলায় বলল, “মিরা মা, কিছু খেয়ে নাও। আমি তোমার জন্য খাবার আর ওষুধ এনেছি। (মনে মনে) খাবার এনেছি ঠিকই, কিন্তু জোরে বলার সাহস পাইনি। যদি স্যার শুনে ফেলে যে আমি তোমার প্রতি এতো মায়া দেখাচ্ছি, আমায় আস্ত রাখবেন না!”
মিরা ক্লান্ত দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি যান কাকা। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
মিরার চোখের ভাষা সব না বলা কথা বলে দিচ্ছে। যাকে ঘিরে কাল কিছু মুহূর্তের জন্য ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিল, সেই মানুষই তার বুক ভেঙে তিরস্কারের বিষ ছুড়ে দিয়েছে। এই খাবার কি আর কোনো গলা দিয়ে নামবে?
ফরিদ মিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে খাবারটা টেবিলে রেখে, আর কিছু না বলে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
এরপরের দিনগুলো কারানের ব্যথাতুর তিরস্কারের মাঝেই মিরার জীবন অতিবাহিত হতে থাকল।
কারান গোসলখানায় গোসল করছে। আর মিরা তখন তার কক্ষে বিছানা ঠিক করতে ব্যস্ত। রোজকার কাজের মতো সবকিছু সে গুছিয়ে রাখছিল। এমন সময় কারানের ফোন থেকে আচমকা একটি টুং শব্দ ভেসে এলো। মিরার হাতের কাজ থেমে গেল। ফোনের দিকে চোখ পড়তেই বুঝল, কেউ একটা মেসেজ পাঠিয়েছে।
কৌতূহল ভরা পায়ে ধীরেসুস্থে ফোনের দিকে এগোল। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই দেখল, একটি নাম ভেসে উঠেছে ‘রাশা’। নামটা অপরিচিত, কখনো শোনেনি মিরা। এর মধ্যেই মেসেজের কয়েকটি টুং টুং শব্দ মনে হালকা চিন্তার ধারা এনে দিল। কে এই রাশা? কারানের জীবনে এই নামের উপস্থিতি কীভাবে এল?
মিরা কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল, মনে একরকম অদ্ভুত দ্বিধা। হাত কি এগিয়ে যাবে ফোনের দিকে, নাকি থেমে যাওয়া উচিত?
এরপর দ্বিধা হটিয়ে কারানের ফোনে আসা মেসেজটি পড়তে শুরু করল।
“Hey darling, I can’t stop thinking about you. You really need to come to my place soon. I’m waiting for you. Sending you all babe.”
মেসেজের প্রতিটি অক্ষর মিরার হৃদয়ে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল। যাকে সে অন্তর থেকে ভালোবাসে, সেই মানুষটি কি সত্যিই অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছে? মিরার মন দুঃসহ সন্দেহে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল, আর কপাল কুঁচকে গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত হলো।
একটু পর কারান গোসল শেষ করে বেরোতেই মিরার মুখ রাগে কঠোর হয়ে গেল।
উত্তপ্ত স্বরে সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “রাশা কে?”
কারান তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে একটু বিস্মিত স্বরে বলে, “কেন?”
মিরার কণ্ঠ আরেক ধাপ তীক্ষ্ণ হলো, “এই মেয়ে কীভাবে আপনাকে ওর বাসায় যেতে বলে? ও কি জানে না আপনি ম্যারিড।”
কারানের মুখে ক্রোধের ছাপ ফুটে উঠলেও সে শান্ত কণ্ঠে বলল, “নিজের লিমিটে থাকো। আই শ্যাল নট প্রোভাইড ইউ উইথ আ জাস্টিফিকেশন। আর এত জেলাস?”
একটা তির্যক হাসি ফুটে উঠল কারানের ঠোঁটে। তারপর একটু থেমে আবার বলল, “আমি ওর বাসায় যাব না…”
কারানের কথায় শীতলতা না থাকলেও, মিরার মনে এই মুহূর্তে আশার আলো ফুটে উঠল। যতই হোক, তার স্বামী অন্তত অন্য মেয়ের কাছে যাচ্ছে না; এই ভেবে খানিকটা স্বস্তি পেল সে।
মিরা কিঞ্চিৎ পরিমাণে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আমি জানতাম, আপনি এতটা নিষ্ঠু…”
মিরার কথাটা শেষ করার আগেই, কারানের কণ্ঠ কঠিন ও শীতল হয়ে উঠল, “ও আমার বাসায় আসবে।”
এই কথা শুনে মিরার মনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার আগেই কারান রাশাকে ফোন তুলে বলল,
“রাশা, মেক ইয়োর ওয়ে টু মাই হাউজ অ্যাট ওয়ান্স।”
ফোনটি রেখে কারান একবার মিরার দিকে তীক্ষ্ণ নজর দিল। এরপর সে অন্য আলয়ের দিকে ধীরে অগ্রসর হল।
অথচ মিরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
“কি? মানে কি? আসলেই কি সেই মেয়ে এখানে আসবে?”
তার হৃদয় কাঁপতে লাগল।
কলিংবেল বাজতেই কারান দরজা খুলে দিল। মিরাও দ্রুত পা বাড়িয়ে নিচে চলে গেল।
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি লাল ড্রেসে সজ্জিত। হাঁটুর উপরে শর্ট টপের সৌন্দর্য তার উন্মুক্ত শ্যাম-ফর্সা পা-টিকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। পিছনের দিক থেকে তার পোশাকের খোলামেলা গঠন চোখে পড়ে। তার হাতে ঝলমলে ব্র্যান্ডেড একটা ঘড়ি ঝকঝক করছে, আর ঠোঁটে চড়া লাল লিপস্টিকের আবহ। মুখে মেকআপের সূক্ষ্ম আস্তরণ মেয়েটির রূপকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কাঁধ অবধি চুলের নিচের অংশ বেগুনি রঙে রাঙানো। কাঁধের ওপর ধরে আছে একটি কালো জ্যাকেট।
রাশা কারানের সঙ্গে একসঙ্গে আমেরিকায় পড়াশোনা করেছে, কিছুদিন হলো বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।
কারানকে দেখেই রাশা দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তার কণ্ঠে অশ্লীল উচ্ছ্বাস, “আই লাভ ইউ মেরি জান। বহঅঅত মিস কিয়া তুমহে।”
কারানও রাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মিস ইউ টু বেবি। রুমে চলো।”
কিন্তু সামনে এগোতেই মিরা তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে গেল। ক্ষুব্ধতা তার চোখে স্পষ্ট, চোয়াল শক্ত করে বলল, “ও কোথাও যাবে না।”
মিরার কথা শুনে রাশা কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে, কারানের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, “নাইনটি’স এর মতো এত বড় ঘোমটা দেওয়া মেয়েটা কে কারান? (তাচ্ছিল্যের সহিত হেসে) তোমার বাড়ির মেড নয়তো?”
কারান তৎক্ষণাৎ উত্তরে বলল, “হ্যাঁ, অমনই। বাদ দাও।”
তারপর মিরার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে স্বগতোক্তি করল, “And you, make sure to bring us some champagne.”
মিরা তৎক্ষণাৎ কটমট করে বলল, “আপনি কোথাও যাবেন না এই মেয়ের সাথে। আমি যেতে দিব না।”
এ কথা শুনে কারান রাগে উন্মত্ত হয়ে মিরার গলা চেপে ধরল। তার শ্বাস আটকে যাচ্ছে। মিরা খুক খুক করে কাশতে লাগল। মিরার অবস্থার দিকে তাকিয়ে কারান অবশেষে ছেড়ে দিয়ে রাশাকে নিয়ে অন্দরে চলে গেল।
এদিকে মিরার মনে প্রবল চিন্তার তরঙ্গ আঘাত হেনে গেল। কী হতে চলেছে? তার স্বামী কি সত্যিই অন্য মেয়ের সঙ্গে রাত কাটাবে? এ যে চরম পর্যায়ের গর্হিত কাজ।
ছটফট করতে করতে মিরা দ্রুত উপরে উঠে, কারানের কক্ষের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করল। কারান অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দরজা খুলেই মিরার গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিল। এ আঘাত মিরার আত্মসম্মানের উপর প্রবল আঘাত হয়ে উঠল।
কারান ঝাঁঝালো চোখে ক্রোধে ফেটে পড়ে, রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলে, “তুমি আমার শুধু খারাপ রূপটাই দেখেছো, কিন্তু আমার নিষ্ঠুরতা এখনো দেখাইনি। তাই আমাকে রুড হতে বাধ্য করো না,” বলেই দরজা আটকে দিল।
মিরা আর্তনাদ করতে থাকে। তার স্বামীর সাথে একই রুমে অন্য একটি মেয়ে; এ যেন মৃত্যু যন্ত্রণার থেকেও ভয়াবহ। তার বুকটা তলিয়ে যাচ্ছে অজস্র কান্নায়।
সুনামিতে ভেসে গেলে মানুষ যেমন নিঃস্ব বাস্তুহারা হয়ে পড়ে, আগ্নেয়গিরির লাভা যেমন সবকিছু পুড়িয়ে দেয়, ভূমিকম্পের তীব্রতা যেমন পৃথিবীকে ধূলির সাথে মিশিয়ে দেয়, আজকের দিনে মিরা তেমনভাবেই পীড়াদায়ক তীব্র ব্যথায় ধস্তাধস্তি করছে। এ শুধু শাস্তি নয় বরং এক সর্বনাশী ধ্বংসের অভিজ্ঞতা।
কারান কক্ষের মধ্যে রাশাকে ফিসফিস করে বলে, “Generate some sound. Make it appear as though we’re engaged in a physical moment.”
রাশা নেশামাখা গলায় শুধালো, “উফ বেবিইইই।”
ফের কারানের গালে চুম্বন দিয়ে বলে, “You know, today is set to be remarkably special for us, wouldn’t you agree babe?”
কারান তীক্ষ্ণ হেসে বলে, “ইয়েস বেবস। খাম-অন।”
এদিকে মিরা ওদের কথার শব্দ শুনে আর থাকতে পারল না। তার বুকটা ফেঁটে পড়ছে, কলিজা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায় সে আবার দরজা ধাক্কাতে শুরু করল।
কারান দরজা খুলে প্রবলভাবে রেগে বলে, “কি সমস্যা তোমার? আমাদের মোমেন্টটাকে কেন নষ্ট করছো?”
এক মুহূর্ত থেমে পুনরায় বলল, “নিজেতো কখনো আমাকে কিছু দিতে পারোনি, যদিও তোমার মতো মেয়ের থেকে এক্সপেকটেশনও রাখি না।”
“প্লিজ কারান। প্লিজ, এমনটা করবেন না। স্বামী আপনি আমার। প্লিজ আপনার পায়ে পড়ি,” বলে মিরা তৎক্ষণাৎ বসে কারানের পা জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু কারান তাকে লাথি দিয়ে ফেলে দিল। তারপর রাশার কাঁধে হাত রেখে বলল, “ওর যখন এতই ইচ্ছা আমাদের ফিজিক্যাল মুহূর্ত দেখার; ঠিকাছে, দরজা আটকাবো না। এখন যা হবে, ওর চোখের সামনেই হবে।”
এই বলে রাশার কোমরে হাত বিচরণ করে তাকে অল্প কাছে টেনে নিল এবং রাশার ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে নিল। দুজনেই চোখ বন্ধ করে চুম্বনের রসাস্বাদন করতে থাকল। চুম্বনরত অবস্থাতেই কারান অতি নিভৃতে, মিরার দিকে তাকাল। মিরার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে; আর দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।
এরপর কারান রাশার গলায় চুমু দিতে শুরু করল। দুইটি চুমুর পরই মিরা সজোরে কারানকে ধাক্কা দিল। সে হাত জোড় করে কারানের পায়ে পড়ে গেল। এই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দৃষ্টিহীনতায় বিভোর হওয়া অনেক বেশি কাম্য।
মিরা কেঁদে কেঁদে বলল, “কারান প্লিজ।”
কারান হঠাৎ জ্বলে উঠে বলল, “খুব লাগছে না তোর? তোর বারবার বাঁধা দেওয়া আমাদের বিরক্তি বাড়িয়ে তুলেছে। তোকে থামানোর ব্যবস্থা করছি,” বলেই মিরার হাত শক্ত করে ধরে এক ঝটকায় তুলে নিল।
অন্য হাতে শাড়ির ভেতর দিয়ে পিছন দিক থেকে কোমর এমনভাবে চেপে ধরল, যেন কারানের প্রতিটি আঙুল মিরার কোমরের মাংসে গেঁথে যাচ্ছে। এক হেঁচকা টানে সে মিরাকে ঠোঁটের কাছে এনে দাঁড় করাল।
পরে সম্মোহনী স্বরে বলল, “এবার কারান চৌধুরীর ৪৪০ ভোল্টের বেস্ট চুমু খাবে সুইটহার্ট।”
এই বলেই মিরার ঘোমটার ওপর থেকে অত্যাচার শুরু করল। তার ঠোঁট মিরার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল; কাপড়ের বাঁধা না থাকলে সে মিরার ঠোঁট পুরোপুরি নিজের দখলে নিয়ে নিত। মিরা বিস্ময়ে তাকিয়ে ঢোক গিলে নিল। মনে হচ্ছে, তার চোখ দুটি কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসবে।
কারান তার শরীর চেপে ধরেছে; সরানোর উপায় নেই। এটি মিরার জীবনের প্রথম চুম্বন। কিন্তু এ চুম্বন সুখের নয় বরং যন্ত্রণার, কাতরতার।
কারান দীর্ঘ পাঁচ মিনিটের চুম্বন শেষ করে মিরাকে ছেড়ে দিতেই সে অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
কারান ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “এই সামান্য কিস এই তোমার সহ্যশক্তি এভাবে ভেঙে পড়ল। আর তুমি কিনা কারান চৌধুরীর লাইফ পার্টনার হতে এসেছো?”
এদিকে রাশা দুই হাত কারানের দুই কাঁধে রেখে বলল, “Leave her behind beloved. Let us conjure a moment that will be truly unforgettable.”
কারান কাঁধ থেকে রাশার হাত দুইটা সরিয়ে দিয়ে বলল, “You should return home now; I’m feeling overwhelmed by all of this.”
রাশা একটু বিরক্ত হয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানেটা কী? তাহলে তুমি আমাকে ডাকলেই বা কেন?”
কারানের হাত ধরে আবার বলল, “চলো না বেবি। আরেকবার চান্স নেই। এখন তো ও সেন্সলেস হয়ে গেছে, আর আমাদের কেউ ডিস্টার্বও করতে পারবে না।”
কারান তার হাত ছাড়িয়ে মুখে কাঠিন্য বজায় রেখে বলল, “বললাম তো, ভালো লাগছে না। বুঝো না নাকি? তুমি যাও, আমার মুড নেই।”
এটা শুনে রাশা হতাশাগ্রস্ত নেতিয়ে পরা এক প্রচ্ছন্ন চেহারা নিয়ে বেরিয়ে গেল। এগুলো সবই কারান মিরাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য করেছে। মিরা যখন অজ্ঞানই, তখন এসব করেও বা কি হবে!
পরে কারান ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিল। তারপর ঘরে এসে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।
রাত গড়িয়ে পড়তেই মিরার জ্ঞান ফিরে আসে। সে মেঝে থেকে উঠে দৌড়ে কারানের কক্ষে গেল। কারানকে ল্যাপটপে কাজ করতে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“ঐ..ঐ মেয়েটি কখন চলে গেছে? (কাঁদো কাঁদো স্বরে) আর বলুন না আপনি কিছুই করেননি।”
কারান ল্যাপটপে চক্ষু নিবদ্ধ রেখেই ঠান্ডা গলায় শুধালো, “আমার ফুরফুরে মনটাকে বিষণ্ন করতে এসো না। আর ওর সাথে আমার সবকিছু হয়ে গেছে।”
হালকা স্মিতহাস্যে আবার বলল, “ইউ কান্ট ইমাজিন, যে কি কি হয়েছে।”
শেষ দুই বাক্যে মিরার সর্বশেষ আশাটুকুও নিভে গেল। কষ্টের ভারে ন্যুব্জ হয়ে মিরা আর একটি টু শব্দও না করে, নিশ্চল পায়ে অন্য রুমের দিকে চলে গেল। মনে কষ্ট নিয়ে আজ অশ্রুরুদ্ধ সে। তার হাত ব্যথায় টনটন করছে, কোমরে কারানের আঙ্গুলের চাপে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেছে; কিছু জায়গায় গর্তেরও সৃষ্টি হয়েছে। সারাদিন কিছুই খায়নি, তবুও উদরে ক্ষুধার কোনো অনুভূতি নেই। ব্যথার দিকেও তার মন নিবদ্ধ নয়। অর্থাৎ আজ সে অনুভূতিহীন।
সেখানে রয়ে গেছে শুধু কিছু অজানা আবেগ। তার মন তিক্ততায় ভরে গেছে। অসহ্য অন্ধকারের মাঝখানে সে একা। মিরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে, গ্রিল ধরে ফুল গাছগুলোর দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলো। মিরার চোখে এখন আর পানি নেই, শুষ্ক চক্ষুর গভীর অন্তঃস্থল থেকে একমাত্র আফসোস জড়িত একটি বাক্য ভেসে আসে, ‘কেন কারানকে বিয়ে করলো?’
একটি ক্ষণস্থায়ী সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতি, যা আজ তার সমস্ত সুখের আলোকে নষ্ট করে দিয়েছে।
এভাবে প্রতিদিন কারান নতুন নতুন মেয়েদের নিয়ে কক্ষে ঢোকে। কিছুদিন মিরা তাকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে, কিন্তু শেষে সে বুঝতে পারে, এসবের মধ্যে কোনো লাভ নেই। মিরা এখন সয়ে গেছে, অবশ হয়ে গেছে।
কারান মিরাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ধূমপান করে, মদ খায়, মেয়েদের সঙ্গে আলয়ে ঢুকে যায়। কিন্তু মিরা নিশ্চুপ, স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কারানের একটাই ইচ্ছে; মিরা যেন তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। কিন্তু মিরা এ হেন কাজ করবে না। গাছের শিকড় যেমন পচে যায়, কিন্তু মাথা নোয়ায় না, ঠিক তেমনি সে। মাকে কথা দিয়েছে স্বামীকে ভালো রাখার। তাই নদীর জল শুকিয়ে খাক হয়ে গেলেও, জায়গাটা ধরে রাখতে হবে।
যখন যন্ত্রণার তীব্র ঝড় বয়ে গেল, অসহায়ের মতো কারানকে একবার বলেছিল যে, কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু স্বামীর মুখ থেকে বেরোনো একটি বাক্যের কারণে, মনের এই অবাধ্য বাসনাকেও মাটি চাপা দিতে বাধ্য হয়েছে। বাক্যটি ছিল, ‘যদি তুমি একবারও কে.ছি হাউজের বাহিরে পা রাখো, সেদিন থেকেই মিরার জন্য কে.ছি হাউজের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।’
অর্থাৎ মা-বাবার সম্মান রক্ষার্থে, কষ্টগুলো অভ্যন্তরে ধারণ করে রাখতে হয়েছে।
কারান মাঝে মাঝে বিরক্তির সুরে বলে, “ওর মন কি পাথরের? এতকিছুর পরও কেন ছেড়ে যায় না? ভাঙবে তবু মচকাবে না। আমি যদি ডিভোর্সটা দিতে পারতাম! শুধু বাবাকে দেওয়া কথার খেলাপ করতে পারছি না। উফফফফহহ।”
আবার এটাও বলল, “এই মেয়ে ডিভোর্স দেয় না কেন? আমি তো মরবোই, সাথে এও।”
আজকে সন্ধ্যায় কারান বাড়িতে ফিরে আসতেই বাইরে প্রকৃতি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাণ্ডবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, দমকা বাতাসে চারপাশের গাছপালা নত হয়ে কাঁপছে। দূরে বজ্রপাতের চিল্লিক কখনো কখনো আকাশকে বিদীর্ণ করছে। বাতাসে জানালার পর্দাগুলো উত্তালভাবে উড়ছে। অর্থাৎ ঝড়ের আগমনি বার্তা বহন করছে।
কারান রুমে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ অন্ধকারে ডুবে গেল।
কারান বিরক্তি স্বরে বলে, “হোয়াট দা হেল? লোডশেডিং হওয়ার আর সময় পেল না। ড্যাম।”
রেগে ক্রুদ্ধ হয়ে পরিধেয় কালো কোটটা খুললো। গলার টাইটাকে নাড়িয়ে সামান্য ঢিলে করলো।
ওষ্ঠ কুঞ্চিত করে বলে, “হেইনাস (জঘন্য)।”
এবার সাদা শার্ট খোলার পালা।
এরই মধ্যে অন্ধকারে মিরা কারানকে দেখতে না পেয়েই পাশের রুম থেকে অন্য দরজা দিয়ে এসে জানালা বন্ধ করবে বলে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার ধারণা, কারান নয়টার আগে ফিরবে না। আজ তাই নিজেকে ঘোমটার আড়ালে লুকানোর প্রয়োজন মনে করেনি। জানালার কাছে আসতেই বৃষ্টির প্রথম বিন্দুগুলো বাতাসে ভেসে এসে মিরার চোখ, ঠোঁট আর মুখ স্পর্শ করল।
সন্ধ্যার আবছা আলোয় জানালার পাশে কারো ছায়ামূর্তি দেখে কারান কিছু বলার নিমিত্তে মুখ খুলতে উদ্যত হয়, কিন্তু হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে মিরার মুখটি মুহূর্তের জন্য আলোকিত হলো।
প্রকৃতির সুনিপুণ হাতে আঁকা শিল্পকর্ম কারানের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলো। মুহূর্তেই কারানের শরীরে অজানা স্রোত বয়ে গেল। সেই মুখ দেখে তার সমস্ত অস্তিত্ব স্তব্ধ হয়ে গেল। তার বুকের ধুকপুকানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে, দৃষ্টি আটকে আছে মিরার দিকে। মনে হলো, আকাশের চাঁদ যেন মাটিতে নেমে এসেছে।
একটু পর বিদ্যুৎ ফিরে এলে কারান বাস্তবে ফিরে এল। কারান এখন মিরার সর্বাঙ্গ দেখছে। মিরার কালো রেশমের শাড়ির মধ্যে তার ফরসা মুখশ্রী আরও বেশি দ্যুতিময় মনে হলো। এক ভুবনমোহিনী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে; পূর্ণিমার রাত্রির ন্যায় উজ্জ্বল, অথচ তাতে রহস্যের কোনো কমতি নেই। মিরার চোখের গভীরে সমস্ত জগতের মাধুর্য বন্দী।
এমন সৌন্দর্য এতদিন আড়ালে ছিল! কীভাবে এই শুকতারা আজ ভূমিতে অবতীর্ণ হলো!
কারানের চোখ যেন মুগ্ধ হয়ে বলে উঠে,
“তুমি স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক, মুগ্ধনয়নবিহারিণী।
তোমার চোখ রহস্যময় সবুজ বনানীর মতো।
তোমার কেশ ঢেউ খেলানো সাগরের মতো।
তোমার ত্বক মাখনের মতো মসৃণ।
তোমার ঠোঁট গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল।
তুমি সুস্নিগ্ধা, সুভাষিনী, এক অনন্যা; তোমার সৌন্দর্যে প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য একত্র হয়েছে।
তুমি জীবন্ত কবিতা, অপরূপ রূপের আলোকচ্ছটা।”
মিরার গালে, ঠোঁটে, গলায় বৃষ্টির বিন্দুগুলোও মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে। ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু মৃদু অনিলে মিরার খোলা এলোমেলো চুলগুলো ঢেউয়ের মতো উড়ছে। লম্বা, চিকন গড়নের মেয়েটি হঠাৎ কারানকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। অথচ এদিকে মিরার প্রতিটি শিরা-উপশিরা কারানের অনুভূতিগুলোকে স্পর্শ করে জাগিয়ে তুলছে। কারান বাকরুদ্ধ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক দৃষ্টিতে মিরাকে দেখেই যাচ্ছে।
প্রায় অনেকটা সময় পর, কারানের মুখ থেকে শ্বাসরুদ্ধকর স্বরে বেরিয়ে এলো, “কে তুমিহহ?”
মিরা বিস্ময়ে নরম গলায় জবাব দেয়, “মিরা।”
‘মিরা’ শব্দটি বাতাসের কণাগুলোকেও চিরে গিয়ে
তীরের মতো সরাসরি কারানের বুক ভেদ করে তার হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছায়। মনে হলো, কেউ যেন সত্যি সত্যিই কারানের বুকে একটি তীর ঢুকিয়ে দিল।
কারান চোখ শক্ত করে বন্ধ করে, এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে অসহায়ভাবে বলে উঠল, “তুমি প্লিজ ঘোমটাটা দাও মিরা। প্লিজ। আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছে, আমি আর তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি না। তোমার রূপের আগুন আমার দৃষ্টিকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। প্লিজ, মুখ ঢেকে রাখো মিরা।”
মিরা দ্রুত মুখে ঘোমটা টেনে নিয়ে রাশভারী কণ্ঠে বলল, “আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি বুঝতে পারিনি আপনি আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন, তাই ঘোমটা দেইনি।”
তারপর কারানের দিকে এগিয়ে এসে, চিন্তিত কণ্ঠে জানতে চাইল, “কিন্তু কী হয়েছে আপনার? এমন কেন বলছেন?”
কারান গভীর শ্বাস টেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এরপর ভাঙা গলায় বলল, “কিচ্ছু হয়নি মিরা। কিচ্ছু না। তুমি আমার কাছে এসো না, প্লিজ… আমি নিঃশেষ হয়ে যাব।”
মিরা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল। তার মনে অজানা ভাবনা জাগল, “কারান তো আজ মদও খায়নি। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর এত অন্যরকম কেন শোনাচ্ছে?”
মিরার মনের ভেতর প্রশ্নগুলোর ভিড় বাড়তে থাকে। আর কারানের দুর্বোধ্য আচরণ এক অমীমাংসিত রহস্যের মতো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
কারান তাড়াহুড়ো করে গোসল করতে চলে গেল। তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে। ঝর্ণার তীব্র ধারা ছাড়তেই ঠান্ডা পানি তার তপ্ত শরীর ছুঁয়ে গেল। চোখ, ঠোঁট, সমস্ত শরীর ভিজে একাকার হয়ে গেলেও মনের উত্তেজনা এক বিন্দুও কমল না। সামনে টেম্পারড কাঁচের ঝাপসা পর্দায় বারবার মিরার মুখটাই ভেসে আসছে। সেই মুখ, যা আজ তার সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। প্রতিটি পানির ফোঁটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কারান নিজেকে পুনরায় ডুবিয়ে রাখছে মিরার স্মৃতির স্রোতে, তাকে ভুলতে চাইছে অথচ পারছে না।
গোসল শেষ করেও কারানের মনে শান্তি মিলল না। শরীরের ক্লান্তি মুছে গেলেও মনের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা থামানো অসম্ভব। প্রতিটি মুহূর্তে মিরার মুখ, তার ঠোঁট, তার চোখের গভীরতা; সবকিছুই কারানকে গ্রাস করে ফেলেছে।
বিছানায় শুয়ে থেকেও কারান বারবার মিরার কথা ভাবছে। তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত পুলক ছড়িয়ে আছে, যা তাকে কাবু করে ফেলেছে।
সেই মায়াবিনী, অসম্ভব সুন্দরী তরুণী; কারানের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তার চেহারার সৌন্দর্য, তার উপস্থিতি কারানের মনের গভীরে ছাপ ফেলেছে। কারান চোখ বন্ধ করলেই মিরার অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠে, আর সেই রূপ তাকে রাতের নিস্তব্ধতার মাঝেও অশান্ত করে রেখেছে।
মিরা ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ঘোমটা দিয়ে নিচে আসতেই দেখে কারান রান্নাঘরে রান্না করছে।
মিরা বিস্মিত হয়ে কারানকে প্রশ্ন-বৃত্ত করে বসলো, “একি, আপনি কিচেনে কি করছেন? এখনই এদিকে আসুন। আমার একটু দেরি হয়ে গেল বলে আপনি রান্না করতে শুরু করে দিলেন! আমার বেশি সময় লাগবে না আপনি সরে আসুন।”
কারান কিঞ্চিৎ হেসে মিরার কাছে এসে তার মুখের ঘোমটা তুলে দিল। সকালবেলার প্রথম রোদ যেন মিরার রূপে লুকিয়ে থাকা অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি। কিছুক্ষণ তারা অপলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই অতি সাধারণ মুহূর্তটিও তাদের হৃদয়ে গভীর আবেগের স্রোত প্রবাহিত করছে।
কারান ঢোক গিলে ঈষৎ হেসে বলে, “এই নিন কফি, আমার মহারানি ভিক্টোরিয়া।”
মিরা অতিরিক্ত আশ্চর্য হয়ে কিঞ্চিৎ হা করে কারানের দিকে তাকিয়ে রইলো। যে মানুষটি তাকে এতকাল ধরে অশান্তি ও অত্যাচারে জর্জরিত করেছে, হঠাৎ করে তার আচরণে এ কেমন পরিবর্তন? তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কারান যেন অপরিচিত এক সত্তা।
কারান মৃদু হাসি মুখে মিরার থুতনি ধরে তার মুখ বন্ধ করে দিয়ে বলল, “মশা ঢুকে যাবে তো মহারানি। আর এখন থেকে আপনার ঘোমটা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই চাঁদকে আমি রাতের পাশাপাশি দিনের আলোতেও দেখব। তোমার ঐ কাজল কালো চোখ; (বুকে হাত রেখে) হায়য়, মে মারজাউঙ্গা!”
কারানের এই উচ্ছ্বাস দেখে মিরা লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেলেও, কাটকাট গলায় বলল, “কিন্তু আমি তো কাজল দিইনি।”
কারান খানিকটা হেসে বলে, “প্রয়োজন পড়বে না।”
তারপর মিরার দিকে খানিক তাকিয়ে, হঠাৎ করে জন ডনের একটি উক্তি উচ্চারণ করল,
“For God’s sake, hold your tongue
and let me love!”
বাক্যটি শুনে মিরার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। অর্থাৎ একটি অভিমানী পাখি তার ন্যূনতম স্বাধীনতা ফিরে পেয়ে আনন্দে উড়তে শুরু করেছে। সেই অনুভূতির রেশ তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
কারান আবার বলল, “যাও যাও, ডাইনিং টেবিলে বসো। আজকের ব্রেকফাস্ট কারান চৌধুরীর তরফ থেকে,” বলে হাত পেটের কাছে এনে মাথা নীচু করে মিরাকে কুর্নিশ করল।
কিন্তু মিরা জানে, কারান বিচিত্র মানুষ। তার কথাবার্তা এবং আচরণ মুহূর্তেই পরিবর্তিত হতে পারে। তাই এতদিন যেভাবে চলে এসেছে, আজও মিরা সেভাবেই এগোচ্ছে।
মিরা মুখের প্রকাশভঙ্গি পরিবর্তন না করে কঠোর স্বরে বলে, “আপনি বসুন টেবিলে। আমি করে আনছি এক্ষুনি। আচ্ছা, আপনার কি অফিস নেই আজকে?
“আছে, কিন্তু না গেলেও চলবে। আজকের অফিস যে আমার ঘরেই,” কারান হেসে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দেয়।
মিরা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে কথাটি এড়িয়ে যায়, “কফিটা দারুণ মজার হয়েছে। আপনি কীভাবে জানলেন আমি এমন কফি খাই?”
“সিক্সথ সেন্স মহারানি,” বলে মিরার হাত ধরে পুনরায় বলে, “এবার আসুন আসুন, চেয়ারে বসুন।”
কারানের এমন আচরণে মিরা অদৃশ্য স্রোতে ভাসতে শুরু করে। তার চোখের দৃষ্টি টেবিলের উপর স্থির হয়ে থাকে, অথচ মনের ভিতর দোলাচল।
কারান চেয়ারটি টেনে ধরলো। মিরা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ঠান্ডা চেহারায় বসে রইলো। কারান মুচকি হেসে রসুইঘরে রান্না করতে চলে গেল। মাঝে মাঝে রান্নার ফাঁকে হাসতে হাসতে মিরার দিকে তাকাচ্ছিল। মিরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এক রাতের মধ্যে একজন মানুষ কীভাবে এত পরিবর্তন হতে পারে! গত এগারো মাসে সে কারানের এমন রূপের সঙ্গে কখনো পরিচিত হয়নি; এ যেন এক অলৌকিক ঘটনা।
কারান আমেরিকান কিছু ডিশ প্রস্তুত করে নিয়ে আসে। স্বর্ণালী বাদামি রঙের ভাজা পেঁয়াজ, নরম চিকেনের টুকরোগুলো একদম সূক্ষ্ম করে রান্না করা হয়েছে। রঙ-বেরঙের সবজি; মিষ্টি মরিচ, গাজর এবং ব্রোকোলি একত্রে মিশে একটি শিল্পকর্মের রূপ নিয়েছে।
কারান সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে মিরার প্লেটে পরিবেশন করে।
মিরা কারানের দিকে দৃষ্টিপাত করে অবলীলায় বলে, “এইগুলা কি বাস্তব নাকি আমার অব্লিকনেস (ভ্রম)?”
কারান ব্রান্সউইক স্টু চামচে উঠিয়ে মিরার মুখের সামনে ধরলো।
“খেয়ে নাও। তারপর বলছি।”
এখন তো মিরার কাছে সবকিছু এলোমেলো লাগছে। এ কীভাবে সম্ভব? এগুলো কল্পনা নয় তো? নাকি বাস্তবের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করে গেছে সে?
মিরা ক্রূর হেসে নরম স্বরে বলে, “আমি বোধ হয় স্বপ্ন দেখছি।”
কারান মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “হুম, স্বপ্নই। এখন খেয়ে নিন বেগম।”
তার হাসিতে আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া আছে, যা মিরার দ্বিধা এবং বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে তুলে।
মিরা কারানের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করে। এখন নিশ্চয়ই সবার মনে প্রশ্ন ঘুরছে, এতকিছুর পরও একটি মেয়ে ক্ষুব্ধতা না দেখিয়ে কেন খেয়ে নিচ্ছে। আসলে মিরার মনে কারানের জন্য কোনো অনুভূতি কাজ করছে না; বরং তার মন একটি ঠান্ডা হ্রদের মতো, যেখানে কেবল নিস্তব্ধতা বইছে। আরেকটি কারণ হলো, সে দেখছে কারান এই ভালো সাজার খেলা কতদিন চালাতে পারে।
কারান আকস্মিকভাবে বলে, “আমার বউ তো দেখছি খুব স্বার্থপর। একবার আমাকে খাওয়ার কথা জিগ্যেসও করলে না।”
Tell me who I am part 4
মিরা ভ্রূ উঁচিয়ে নীরস তাকিয়ে রইলো। কারান তখন মিরার ঠোঁটের পাশের এঁটো টিস্যু দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, “চলো, খাইয়ে দাও আমাকে,” বলে নিজেই মিরার হাতে চামচ ধরিয়ে খেতে শুরু করে।
খাওয়া শেষ করে কারান একটু উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে ওঠে, “তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। এসো।”
মিরার মনে তখন এক রকম কৌতূহল দোলা দিতে থাকে, যদিও তার মুখাবয়বে কোনো প্রতিফলন নেই। সারপ্রাইজের টান তাকে নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়, তবে সে এখনো কারানের আসন্ন পরিকল্পনার রূপরেখা আঁকতে পারছে না।