আযদাহা পর্ব ১
সাবিলা সাবি
“আযদাহা” বিশাল ড্রাগন অথবা সরিসৃপ ভয়ংকর প্রাণীকে বলা হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি গল্পের আযদাহা ভিনগ্রহের এক ভয়ংকর প্রানী এক নিষ্ঠুর ড্রাগন। যার অনুভূতি ছিলো নির্মম,নির্ভীক আর নিষ্ঠুরতম। তার শিরা -উপশিরায় ভালোবাসা নামক কোনো কিছুই প্রবাহিত হতো না। ‘ডোপামিন’ ‘অক্সিটোসিন যাকে বলা হয় প্রেমের হরমোন।আর এই হরমোনগুলোর সংজ্ঞাও ছিল তার কাছে অজানা।কারণ সে ছিল আযদাহা—ভেনাস গ্রহের ড্রাগন প্রিন্স।যার জন্মের সময়ে তার মস্তিষ্ক থেকে ভালোবাসা নামক প্রযুক্তি সম্পুর্ন অপসারণ করা হয়ে থাকে।সে জানেনা ভালোবাসা কি? নারীর প্রেমে পড়া কাকে বলে? নারীর চোখে চোখ রেখে ব্যাকুলতা কিভাবে প্রকাশ করা যায়।
তার সৃষ্টিই হয়েছিল শাসনের জন্য, ধ্বংসের জন্য, যুদ্ধের জন্য কিন্তু ভালোবাসার জন্য নয়। কিন্তু ভাগ্য হয়তো তার জন্য লিখে রেখেছিল এক ভিন্ন পথ।
এক সাধারণ মানবী, পৃথিবীর এক কোণায় বেড়ে ওঠা এক কোমল, মিষ্টি, নাজুক মেয়েই তার হ্নদয়ে প্রথম জাগিয়ে তুলবে অনুভব। সেই মেয়েই হয়ে উঠবে তার অক্সিটোসিন হরমোন নিষ্ক্রিয়ের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। ড্রাগনের মতো ভয়ংকর প্রাণীর বুকে তোলপাড় করে দেয়া একমাত্র রমনী।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আর সেই কোমলমতি নারীর জন্যই আযদাহা ছিন্ন করবে ভেনাস গ্রহের কঠোর নিয়ম, যে নিয়মে রয়েছে ড্রাগন হয়ে সাধারণ মানবীর প্রেমে পড়া নিষিদ্ধ।কিন্তু সেই ড্রাগন প্রাণীই সকল বাধা নিয়তি আর সকল নিয়ম উপেক্ষা করে যুদ্ধ করবে মহাবিশ্বের বিরুদ্ধে।শুধুমাত্র তার প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য সে তছনছ করে দিবে পৃথিবী।
কিন্তু প্রশ্ন তবুও রয়ে যায়, ভয়ংকর এই ড্রাগন প্রিন্স কি পারবে পৃথিবী আর ভেনাসের কঠোর নিয়ম ভেঙে তার ভালোবাসাকে আপন করে নিতে? নাকি নিয়তি নিজেই তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। প্রকৃতি কি তাদের ভালোবাসার মর্ম বুঝবে? নাকি প্রকৃতি নিজেই তাদের আলাদা করে দিবে?
জানতে হলে চলুন ডুবে যাই এমন এক প্রেমের গল্পে —যেখানে প্রেম শুধুমাত্র আবেগ নয় প্রেম হচ্ছে অস্তিত্ব। যে অস্তিত্ব কোনোদিন বিলীন হয়ে যায়না। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে থাকে স্বর্ণাক্ষরে যে প্রেমিকযুগলের নাম।আসুন প্রবেশ করি সেই ফ্যান্টাসির দুনিয়া যেখানে আছে রুপকথার এক অসম্ভব ভালোবাসার গল্প।
ফিওনা জানালার ফিনফিনে সাদা পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। শহরজুড়ে উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। পথে পথে লোকজন বাঁশের পাত্রে করে জংজি কিনছে—জংজি চীনের একটি বিখ্যাত খাবার যা শুধুমাত্র ড্রাগন বোট উৎসবের দিন খাওয়া হয়।চারিপাশ থেকে বাঁশের পাতা আর চিপচিপে চালের সুগন্ধ ভেসে আসছে নাকে।
ড্রাগন বোট উৎসব ফিওনার প্রিয় উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। আজকের দিনটি নিয়ে সে দারুণ উৎফুল্ল।এই উৎসব উপলক্ষে তার বিশ্ববিদ্যালয়ও কিছুদিনের জন্য ছুটি দেয়া হয়েছে।
“এলিসন ফিওনা”—যার জন্ম হয়েছে গ্রিসের প্যাট্রা শহরে। ফিওনার বাবা এলিসন নিকোস যিনি ছিলেন গ্রিসের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী।কাজের সূত্রে তিনি একদিন চীনে আসেন আর তখনি তিনি বিবাহ করে নেন চীনের এক সুন্দরী নারীকে।
আর সেই সুন্দরী নারীই হচ্ছে ফিওনার মা, তার নাম লিন শাও। ফিওনার মা লিন শাও চীনের বেইজিং শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আর লিন শাও ছিলেন মিস্টার চেন শিং-এর একমাত্র কন্যা। চেন শিং যিনি প্রখ্যাত একজন বিজ্ঞানী এবং বেইজিং শহরের উচ্চবিত্ত সমাজের মধ্যে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।
ফিওনার বয়স যখন মাত্র আট বছর বয়স।
তখন এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘ*ট*নায় তার বাবা-মা উভয় মৃ*ত্যুবরণ করছিলেন। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল ছোট্ট ফিওনা। কিন্তু সেই মর্মা*ন্তিক দৃশ্য নিজের চোখের সামনে বাবা মায়ের মৃ*ত্যু আজও তাকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে যায় ক্রমাগত।
পিতৃহীন আর মাতৃহারা ফিওনাকে তার নানা চেন শিং রেখে দেন চীনে। তার নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করেন তিনি। ফলে ফিওনার জীবন বেড়ে ওঠে চীনের ঐতিহ্যবাহী বেইজিং শহরের মধ্যেই।
ফিওনা এখন ও জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে অসহায় দৃষ্টিতে। তার খুব ইচ্ছে করছে বাইরে বের হয়ে ড্রাগন বোট উৎসবের আমেজ উপভোগ করতে। দুই বছর আগেও,তার নানা মিস্টার চেন শিং তাকে প্রত্যেক উৎসবে নিয়ে যেতেন বাইরে। কিন্তু এখন, গত দুই বছর ধরে, ফিওনার জীবন যেন চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে । বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই তার জন্য।
ফিওনা বেইজিং শহরের পিকিং ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে।কিন্তু তার নানার এই আচরণের কারণটা এখন ও ফিওনার কাছে অজানা।ফিওনার মনে হয়,কোথাও কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে,যা সে কখনো জানতে পারছেনা।
হঠাৎ পেছন থেকে কারো উপস্থিতি টের পেতেই ফিওনা এক ঝটকায় ঘুরে তাকাল পেছনে। সে বুঝতে পেরে গেছে এই সময়ে তার রুমে কেবল একজনই আসতে পারেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফিওনা তারপর সে মৃদু কণ্ঠে বলল, “ওহ, গ্র্যান্ডপা! তুমি কখন এলে?”
মিস্টার চেন শিং সাদা ল্যাব কোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন কোটের নিচে পিনস্ট্রাইপ শার্ট আর ধূসর রঙের প্যান্ট, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা আর চোখেমুখে গাম্ভীর্যতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে।
ফিওনা একটু উদাস ভঙ্গিতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
অভিমানী স্বরে সে বলল,”গ্ৰ্যান্ডপা! আমার বন্ধুরা সবাই বেহাই লেকে চলে গেছে ড্রাগন বোট রেসিং দেখতে। আমার মন খুব খারাপ। আমাকে যেতে দাও, প্লিজ। আমি কথা দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফিরে আসব বাসায়।”
তার গ্ৰ্যান্ডপা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “দেখো ফিওনা,তুমি এখনো ছোট।আমি যা করছি, সব তোমার ভালোর জন্য।ওখানে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। তুমি চাইলে বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে নিতে পারো। আমার ল্যাবে যেতে দেরি হয়ে যাবে, না হলে আমিই তোমাকে নিয়ে যেতাম উৎসবে।”
এ কথা বলেই তিনি রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ফিওনা কয়েকবার ডাকল তাকে,কিন্তু তিনি ফিরেও তাকালেন না। ফিওনা তার গ্ৰ্যান্ডপাকে অসম্ভব ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা কর। তবুও তার মন খারাপ হয়ে গেল। কেন তার গ্ৰ্যান্ডপা তাকে কোথাও যেতে দেন না?কেন তাকে এই বন্দি জীবনে আটকে রাখা হয়েছে? এই প্রশ্নগুলো তার মনে গভীর দুঃখের ছাপ ফেললো।
তার গ্ৰান্ডপা মিস্টার চেন শিং, যিনি চীনের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় বিজ্ঞানের জগতে অসাধারণ অবদান রেখে কাটিয়েছেন। তার বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের নাম সারা দেশেই পরিচিত আর সম্মানিত।
মিস্টার চেন শিং-এর ল্যাবরেটরি ফিওনাদের বাড়ির পেছনেই অবস্থিত। বিপুল আকারের এই ল্যাবরেটরি আধুনিক প্রযুক্তিতে পূর্ণ। এর প্রতিটি কোণে চলতে থাকা গবেষণা প্রকল্পের বেশিরভাগই গোপন,যা কারো কাছে প্রকাশ করা হয় না। এখানেই চেন শিং তার বেশিরভাগ সময় কাটান, অজানা এবং বিপ্লবী সব প্রজেক্ট নিয়ে মনোযোগী হয়ে কাজ করেন।এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে তার নাতনির ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি নজর দেওয়ার সময়ও তার খুব কমই থাকে।
তবে ফিওনার কৌতূহল বরাবরই তার নানার ল্যাবরেটরির দিকে থাকে ।বাড়ির পেছনে থাকা এই রহস্যময় ল্যাবটি যেন তার কাছে এক মহাপৃথিবী,যার দরজা তার জন্য বন্ধ। কিন্তু চেন শিং ল্যাবের প্রকল্পগুলোর বিষয়ে এতোটাই সতর্ক যে তিনি ফিওনাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেন না। তবে ফিওনার মনে হয় তার নানার এই গোপন গবেষণা তার জীবনেও কোনো একসময় বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে সে পুনরায় জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে রইল। ড্রাগন বোট উৎসবের উল্লাস, মানুষের আনন্দের কল্পনা করে তার মন বিষণ্নতায় ভরে উঠল। গ্ৰ্যান্ডপা সবসময় তাকে যেন কোনো অজানা শঙ্কার কারণে আটকে রাখেন।
ঠিক এমন সময় তার ফোনে একটি নোটিফিকেশন এল। মেসেজটি খুলতেই দেখলো তার বান্ধবী লিন মেসেজ করেছে।লিন মেসেজে লিখেছে “আমি তোর বাড়ির বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি এক্ষনি বেরিয়ে আয় সময় নেই বেশি” মেসেজটা পড়তেই ফিওনার মনে এক প্রকার সাহস জন্মে যায়। সে মনে মনে ভাবলো, এখন সে বড় হয়েছে যথেষ্ট বড় নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারে এখন আর ছোট নেই সে।
তার বয়স আঠারো বছর আর কয়েকদিন পরেই উনিশে পা রাখবে। দু’বছর আগেও সে বেইজিং শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াত। তখন ছিল কলেজের দিন। কিন্তু ভার্সিটিতে ওঠার পর থেকেই তার জীবন যেন বদলে গেছে— বাসা থেকে ভার্সিটি আর ভার্সিটি থেকে বাসা এই বন্দি জীবন আর মেনে নিতে পারেনা!সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো এবার সে গ্ৰ্যান্ডপার আদেশ অমান্য করেই ড্রাগন বোট উৎসবে যাবে।
ফিওনা একটি উজ্জ্বল লাল চিপাও ড্রেস পরিধান করে নিলো যা আজকের উৎসবের জন্য একদম মানানসই।চিপাওটিতে সূক্ষ্ম সোনালি রঙের ফুলের নকশা, উঁচু কলার, শর্ট স্লিভস, আর সামনের দিকে হাঁটু পর্যন্ত কাটা রয়েছে। কোমরে একটি সোনালি রঙের বেল্ট পড়ে তাকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে। চুলগুলো আলতো করে ব্রাশ করে পেছনে বাধলো। সেই বাঁধুনিতে সোনালি পিন গুঁজে নিলো। তার মাঝারি লম্বা বাদামী চুল তার গ্রিক বংশের একমাত্র পরিচায়ক। এরপর,হালকা মেকআপের ছোঁয়ায় সে নিজেকে সজ্জিত করলো।
চোখে আইলাইনার, ঘন পাপড়িতে মাসকারার প্রলেপ, আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিলো শেষবারের মতো
তার প্রতিফলনে সে দেখতে পেলো এক অতীবও সুন্দরী,আকর্ষণীয় আর আত্মবিশ্বাসী অষ্টাদশী তরুণীকে।
সবশেষে সোনালি রঙের একটা ষহ্যান্ডব্যাগ কাঁধে নিয়ে সে নীরবে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। সে দেখতো পেলো বাড়ির সামনে লিনের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে লিন আর মুখে রয়েছে এক রহস্যময় হাসি।মৃদু হেসে লিন ফিওনাকে পাশের সিটে বসতে ইশারা করলো।ফিওনাও আলতো করে তার পাশেথ সিটে বসে পড়লো।
কালো গাড়িটা রাস্তা ধরে ছুটতে থাকলো, আর ফিওনার মনে একের পর এক প্রশ্ন আসতে থাকলো। পুনরায় সেই পুরাতন ভাবনারা হানা দিলো তার মনে “গ্র্যান্ডপা আমাকে কেন এত কড়া শাসনের মধ্যে রাখেন? তার কিসের এত ভয় আমাকে নিয়ে ?”সে জানে না, তার এই একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে আ্য তাকে এমন এক পৃথিবীতে নিয়ে যাবে, যা সে কল্পনাও করতে পারবেনা কোনদিন।
অবশেষে কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে ফিওনা আর লিন বেহাই লেকে এসে পৌঁছাল,সেখানে আগে থেকেই তাদের আরও বন্ধু-বান্ধবীরা অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। ফিওনা লেকের ধারের কাছে এসে দাঁড়িয়ে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল।ড্রাগন আকারের বোটগুলো রঙিন সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে আজ, এই দৃশ্য দেখে তার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল।রেস শুরু হওয়ার পুর্ব মুহুর্তের গুঞ্জন তার হৃদয় আনন্দ উৎফুল্ল আর উত্তেজনায় ভরিয়ে দিলো।
প্রতিযোগীরা সবাই যার যারা নৌকায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আর দর্শকরা লেকের দুই পাড়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছিল তাদের।লেকের জল সোনালী রোদে চিকচিক করছিল, যেন স্বর্ণের ছোঁয়া পড়েছে পানিতে।লিন আর অন্যান্য বন্ধুরাও ফিওনার পাশে এসে দাঁড়ালো,আর সবাই একসাথে ড্রাগন উৎসবের নৌকা রেস উপভোগ করতে লাগল।
ড্রাম বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে ড্রাগন বোটগুলো জলের উপর ছুটে চলতে শুরু করল। ফিওনা,লিন আর তাদের অন্যান্য বন্ধুরা চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছিল। প্রতিটি বোটের যোদ্ধারা পানির ছিটা ছড়িয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। ফিওনার হৃদয়ও যেন সেই সঙ্গে লাফিয়ে উঠছিল আনন্দে।
যখন রেস শেষ হয়ে গেলো, ফিওনা আর বাকিরা সবাই জংজি খেতে বসলো। বাঁশের পাতার মোড়কে গরম ধোঁয়া উঠছিল, আর সাথে ছিল টক-মিষ্টি চাটনি। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে লিনের হাত ধরে স্টলের দিকে এগিয়ে গেল,যেখানে কেউ কেউ গান গাইছিল আবার কেউ কেউ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাচছিল।
পুরো পরিবেশটাই প্রাণবন্ত আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর ছিল।ফিওনা জানতো, তার গ্ৰান্ডপা সবসময় তাকে এই উৎসবে নিয়ে আসতেন, কিন্তু আজকের মতো এত আনন্দিত সে কখনোই হয়নি। এই উল্লাসের অনুভূতি তার জন্য নতুন ছিল, যা তার সারাজীবন মনে থাকবে।
সে খুব মনোযোগ সহকারে নাচ গানের সুরে ডুবে ছিল।সন্ধ্যা শেষ হতে চলেছে, আকাশে নেমে এসেছে আঁধার রাত। সন্ধ্যার আকাশে শুধুমাত্র একটি তারা দৃশ্যমান, যা ‘সন্ধ্যাতারা’ নামে পরিচিত। এই নক্ষত্রটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের গ্রহ, ভেনাস গ্ৰহ(শুক্র গ্ৰহ)।ফিওনার মনে সবসময় এই গ্রহের প্রতি এক অচেনা আকর্ষণ কাজ করতো, যেন এই গ্রহটি তাকে হাত বাড়িয়ে ডাকে সবসময় কাছে।
হঠাৎ করেই ফিওনার চোখে পড়ল আকাশে অদ্ভুত এক সবুজ আলোররেখা,যা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী তারার দিকে থেকে আগমন করছিল পৃথিবীতে। প্রথমে সে তেমন গুরুত্ব দিল না, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তার মনে হলো এই আলোকরেখাটি যেন তার পুর্ব পরিচিত।
সে অনেকক্ষণ যাবত তাকিয়ে থাকার পর আচমকা আলোর রেখাটি কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল, আর তার হঠাৎ মনে হলো যে, এতক্ষণ সে কোনো ঘোরের মাঝে বিচরণ করছিল।আর এখনি তার সম্বিত ফিরল।
অদ্ভুতভাবে, তার মনে পড়ে গেল, এই সবুজ আলোকরশ্মি এর আগেও সে একবার দেখেছিল। এত বছর পর পুনরায় সেই একই আলোকরশ্মি ফিরে এসেছে। ফিওনার মস্তিষ্ক এখন একেবারে তীক্ষ্ণ অবস্থায় আছে, তার স্পষ্ট মনে আছে যে,এই আলোর রেখা তাকে পূর্বে কীভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
আকাশের সেই রহস্যময় আলোর রেখা তাকে নতুন কোনো অভিজ্ঞতার দিকে আহ্বান জানাচ্ছিল,যেন অতীতের কোনো ঘটনা আবারও ফিরে এসেছে তার জীবনে। সে বুঝতে পারছিল না,এই অভিজ্ঞতা তার জন্য কী রকম পরিবর্তন আনতে চলেছে, কিন্তু অন্তরে কৌতুহল আর উত্তেজনা অনুভব হচ্ছিলো।
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে……….
সেদিন ফিওনার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ দু”র্ঘটনা*র স্মৃতি যেন গতির দিক থেকে সময়ের বৃত্তে ফিরে আসছিল তার কাছে। সেদিন সন্ধ্যায় যখন ফিওনারা গাড়ি দুর্ঘ*টনায় পড়েছিল, তার আগের মুহূর্তগুলো আজও তার মনে একেবারে স্পষ্ট। সেই দিনও সে আকাশে দেখেছিলো একই রকম সবুজ আলোকরশ্মি।
তার মনে পড়ে যায়, ওইদিনেও ড্রাগন উৎসবের আয়োজন কার হয়েছিলো।মুলত এই উৎসব দেখতেই ফিওনার বাবা-মা আর সে একসাথে যাচ্ছিলো তার গ্র্যান্ডপা মিস্টার চেন শিং এর বাড়িতে। চীনের জিউলং হাইল্যান্ডের রাস্তায় হঠাৎ করে তাঁদের গাড়িটি খারাপ হয়ে যায়।ফিওনার বাবা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ঠিক করতে লাগলো আর ফিওনার মা গাড়ির ভেতরে বসে আছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ফিওনা অস্থির হয়ে পড়ে আর গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ে।চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে, হঠাৎ করে তার দৃষ্টি আকাশের দিকে চলে যায়।
সেদিনের সন্ধ্যার আকাশটি ছিল এক কথায় মায়াবী।সূর্য পশ্চিমের আকাশে ধীরে ধীরে ডুব দিচ্ছিল আর আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মেঘগুলো লাল, কমলা, আর গোলাপি রঙে রঞ্জিত ছিল।আকাশের রঙ পরিবর্তিত হচ্ছিল—গভীর নীল থেকে হালকা বেগুনি হয়ে কালচে ছায়ায় পরিণত হচ্ছিল।
সন্ধ্যাতারা ভেনাস ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছিল,যা পৃথিবীর বুকে আকাশের প্রথম প্রদীপ বলা হয়। চারপাশের প্রকৃতি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে আসছিল, আর হালকা ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ সেই নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর করে তুলছিল। গোধূলির আলো আর অন্ধকারের মাঝে সন্ধ্যার আকাশ এক রূপকথার জগতে পরিণত হয়েছিল।
তখনই তার চোখে পড়ে আকাশে অদ্ভুদ সেই দৃশ্যখানা। ভেনাস থেকে একটি সবুজ রশ্মি ছুটে আসছে পৃথিবীতে মনে হল অন্ধকার আকাশের বুকে কেউ আলোর তলোয়ার চালিয়ে দিলো।
কিন্তু হঠাৎ করেই সেই সবুজ রশ্মি আকাশ থেকে মিলিয়ে যায়,আকাশে তাকিয়ে মনে হলো সব স্বাভাবিক এমন আলোকরেখা যেনো কখনো ছিলই না মনে হলো।চারপাশ আবার গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়,আর তার মনে তখনই এক অদ্ভুত শূন্যতা ভর করে।মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেও আকাশ জুড়ে যে রহস্যময় আলোর খেলা চলছিল,তা এক ক্ষণিকের স্বপ্নের মতো ভেঙে গেলো।সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো, মনের মধ্যে হাজার ও প্রশ্নের ঝড়, কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পেলোনা সে।
হঠাৎ বাবার ডাক শুনে সে যেন ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসলো। বাবার কণ্ঠস্বর তাকে আবার বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে আনে। “ফিওনা,গাড়িতে বসো,” বাবার কণ্ঠে একটি অদ্ভুত তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করে সে, যেন সময় খুবই কম হাতে।
ফিওনা গাড়িতে ফিরে বসলো পুনরায় তবে তার মনে এখন ও সেই সবুজ আলোর স্মৃতি ভাসমান। বাবার উদ্বিগ্ন মুখ আর দ্রুতগামী গাড়ির শব্দ রাতের রহস্যকে আরও ঘনীভূত করে তুলছিল। গাড়ি অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় দ্রুত এগিয়ে চলছিল, চারপাশে শুধুই গাঢ় অন্ধকার আর নীরবতা। কিন্তু তার মনে তখনও সেই সবুজ রশ্মির রহস্য দোলা দিচ্ছিল।
হঠাৎ,ফিওনার বাবার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠলো।গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফিওনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটি রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে পাহাড়ের খাঁজে পড়ে যায়। সবকিছু যেন মুহূর্তের মধ্যে ঘটল—এক প্রবল ধাক্কা, বিকট ভয়াবহ শব্দ,আর তারপর প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। গাড়ি উল্টে পড়ে, কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো, আর ফিওনা নিজেকে অন্ধকারের গভীরে ডুবে যেতে দেখলো।চারপাশে সবকিছু স্থির, যেন পৃথিবী থেমে গেছে এক মুহুর্তে।
ফিওনার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল,শরীরের ব্যথা তীব্র হয়ে উঠছিল,আর তার মনে আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব একসাথে প্রবাহিত হচ্ছিল।কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় ছিল সেই মুহূর্তে তার বাবা মায়ের জন্য। বাবা মার কণ্ঠস্বর আর শুনতে পাচ্ছিল না সে। সবকিছু এক ভয়ানক স্বপ্নের মতো অনুভূত হচ্ছিল, যার থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।
ভাগ্যের অদ্ভুত পরিহাসে, সেই ভয়ানক দু*র্ঘটনার পরও সে বেঁচে যায়। তাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন সে প্রায় সংজ্ঞা*হীন অবস্থায় ছিল,শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষ*ত, র*ক্তে ভেসে যাচ্ছিল।হাসপাতালে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরে আসে,কিন্তু তার জীবন আর আগের মতো ছিল না।
ফিওনার বাবা-মা সেই দুর্ঘ*টনায় ঘটনাস্থলেই মা*রা যান। তাদের মৃ*তদে*হের স্মৃতি ফিওনার মন থেকে কখনোই মুছে যায়নি। সেই ক্ষণটি তার জীবনে চিরকালের জন্য গভীর ক্ষত তৈরি করে দিয়ে যায়।তার জীবনে নেমে আসে এক অসহনীয় শূন্যতা, একাকিত্ব, আর অপরাধবোধ,সে বেঁচে থেকেও কিছু হারিয়ে ফেলেছে।
তাদের হারানোর শোক, সেই ভয়াবহ স্মৃতি,আর তার জীবনের অজানা রহস্য একসাথে মিলে তার জীবনের গতিপথ চিরতরে পরিবর্তন করে দেয়। সেই সবুজ আলোর রহস্য আজও তাকে তাড়া করে, যা হয়তো সেদিনের ঘটনার সাথে কোনো সম্পর্ক রয়েছে, যা তার জানাটা গুরুতর।
বর্তমান………
লেকের উৎসব পরিবেশ থেকে ছিন্ন হয়ে অতীতের বেড়াজালে আটকে আছে ফিওনা কিন্তু হঠাৎ করে লিনের কণ্ঠস্বর তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে।
“ফিওনা, তুই কি নিয়ে এতক্ষণ এত গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলি?” লিনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর আবারও তার মনে আলো ফেলল।
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে লিনের দিকে তাকায়। সে জানে, লিন তাকে ভালোবাসে আর তার মনোভাব বুঝতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে ফিওনা কিছু বলতে পারছিল না। মনে মনে ভেবেছিল,“কীভাবে এই কষ্টের কথা বলব? কীভাবে সবাইকে বোঝাবো?”
“আমি… আমার বাড়ি চলে যাওয়া উচিত এই মুহূর্তে,” অবশেষে সে বলল, তার কণ্ঠে অস্থিরতা স্পষ্ট ছিল।
লিনের মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। “কিন্তু ফিওনা,কিছু সময় তো এখানে থাক, একটু বিশ্রাম নে।হয়তো কিছুক্ষণ বসে থাকলে তুই বেটার ফিল করবি,” লিন বলল, তার চোখে মৃদু আশা ছিল।
কিন্তু ফিওনার মনে তখন বাড়ির দিকে ছুটে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।কিছু না বলেই সে উঠে গিয়ে হাঁটতে শুরু করল, মনে মনে ভাবতে লাগল, “বাড়ি যাওয়া উচিত, সবকিছু থেকে দূরে সরে যেতে।”
লিন কিছু একটা মনে করলেও ফিওনাকে আটকানোর চেষ্টা করল না। সে জানত,ফিওনার এই অস্থিরতা আর অতীতের বোঝা তাকে মুক্ত হতে দিচ্ছে না।
“তবে কি এই কষ্টের ঊর্ধ্বে ওঠার কোনো উপায় নেই?” ফিওনার মনে চিন্তা চলছিল। লেক থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার মনে হচ্ছিল, তার জীবনের এতো দিন যে অন্ধকারকে সে ভেবেছে, তা কি কখনোই শেষ হবে?
লেকের শান্ত পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসার পর তার মনে এখনও সেই ভয়াবহ দু*র্ঘটনার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছিল। লিনের কণ্ঠস্বর তাকে বর্তমানের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও তার মনে গভীর দাগ রেখে গেছে অতীতের সেই বেদনা*দায়ক অধ্যায়।
বাসে উঠার পর,জানালার বাইরে তাকিয়ে তার চোখের সামনে কেবল ধূসর রাস্তা আর সুনসান পরিবেশ ভেসে উঠছিল। সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে, সেই সবুজ রশ্মির আকর্ষণীয় আলোটাও দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে।
“আজকে তো মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারব না এই পথ তো শেষ হচ্ছেই না,” মনে মনে চিন্তা করে সে বাসটি ধীরগতিতে চলছিল, আর তার হৃদয়ে অস্থিরতা আরো বিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে বাসা চলার পরও মনে হচ্ছিল যেন বাসটি কখনও পৌঁছাবে না।
তার মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল—”বাড়িতে গিয়ে কী বলব? মা-বাবার কথা মনে পড়লে কি আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারব?” সে জানে, সেই ক্ষ*ত এখনও শুকায়নি, আর হয়তো কখনোই শুকাবে না।
বাসের জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে সে চোখ বন্ধ করে নিলো ফিওনা। তার মনের গভীরে সেই মুহূর্তগুলি পুনরায় ভেসে ওঠে, যখন সে বাবা-মায়ের হাসি দেখে কেমন খুশি ছিল, কিন্তু সেই আনন্দ আর ফিরে আসবে না—অভি*শপ্ত দিনটি সবকিছু পরিবর্তন করে দিয়েছে।
যখন বাসটি শেষ পর্যন্ত তার গন্তব্যে পৌঁছায়, সে ধীরগতিতে নিচে নেমে আসে। বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর সময় তার মনে হচ্ছিল, সে আবারো সেই অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু আজকের দিনে তাকে অতীতের দায়ভার থেকে মুক্ত হতে হবে—এটাই তার সংকল্প।
এভাবে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলে তার মনে নতুন শক্তি জন্ম নেয়। সে জানে,তাকে আবারও নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে, যে আলো একদিন তার জীবনকে আলোকিত করবে। হয়তো একদিন সে সেই সবুজ রশ্মির রহস্য উন্মোচন করতে পারবে,যা তাকে তার অতীতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
“এবার এগিয়ে যেতে হবে,” মনে মনে বলে সে বাড়ির দরজায় পৌঁছানোর পর, সে দৃঢ়তার সাথে দরজা খুলে ঢুকে পড়ে বাড়িতে।