আযদাহা পর্ব ২

আযদাহা পর্ব ২
সাবিলা সাবি

ফিওনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই দেখলো বরাবরের মতই বাড়িতে শান্ত আর স্তব্ধতা বিরাজমান।
সে লবি হতে সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠতে লাগলো,সিঁড়িটি স্বচ্ছ কাঁচের ধারা তৈরি,গোলাকার হয়ে ওপরের দিকে মোড় নিয়েছে,সুগঠিত ঘূর্ণন সিঁড়ির দুপাশের সোনালী হাতল ধরে ধীরে ধীরে সে দোতলায় চলে আসে।
-করিডোর পার করে মিস্টার চেন শিং এর রুমের সামনে চলে আসে সে,রুমে প্রবেশের উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই থমকে যায়,রুমের দরজা বাহিরে থেকে লক তার মানে গ্ৰান্ডপা বাড়িতে নেই,কেননা মিস্টার চেন শিং যতক্ষন বাড়িতে থাকেন ততক্ষন নিজের রুমের মধ্যেই থাকেন।

ফিওনা হতাশ হয়ে পড়ে,গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে হাঁটে,করিডোরের একপাশ জুড়ে স্বচ্ছ কাঁচের প্যানেলে তৈরি সোজা রেলিং রয়েছে,সেই রেলিং এর সামনে যেয়ে দাঁড়ায়,সেখান থেকে নিচের হলরুম স্পষ্ট দেখা যায়।
সে ওভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল,হঠাৎ হলরুমের কিচেন হতে একটা শব্দ ফিওনার কানে ভেসে আসে,সে জানে এই মুহূর্তে কে রয়েছে কিচেনে,সে পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে,কিচেনে প্রবেশ করেই দেখতে পায় মিস ঝাং কিচেনের এক কোনে দাঁড়িয়ে খাবার প্রস্তুত করছেন।
ফিওনা নিঃশব্দে মিস ঝাং এর সামনে যেয়ে দাড়ালো, মিস ঝাং ফিওনাদের একমাত্র বিশ্বস্ত পুরনো সার্ভেন্ট, যিনি ফিওনার দেখাশোনা করেছেন ছোট থেকেই,যখন ফিওনার নানা চেন শিং ফিওনাকে এখানে নিয়ে আসেন তখন থেকে ফিওনার সবকিছুর দেখভাল মিস ঝাং করেছেন।
ফিওনাকে দেখেই মিস ঝাং স্বভাবত হাসলেন।
আদুরে কন্ঠে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ফিওনা মামনি কখন এলে তুমি??”
কিন্তু ফিওনা উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,,,
মিস ঝাং, গ্ৰান্ডপা কোথায়?‌ তিনি কি এরমধ্যে বাড়িতে এসেছিলেন?
মিস ঝাং,ফিওনার অভিব্যাক্তিতে বুঝতে পারলেন, ফিওনা কতোটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আর হতাশ হয়ে আছে।
মিস ঝাং শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, সদয় ভঙ্গিতে প্রশ্নের জবাব দিলেন,
“মিস্টার চেন শিং,কিছুক্ষণ আগেই একবার বাড়িতে এসেছিলেন,পুনরায় তিনি বের হয়ে যান,সম্ভবত তিনি ল্যাবে থাকতে পারে।
মিস ঝাং এর জবাব শোনা মাত্রই ফিওনা আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না,দ্রুত কিচেন থেকে বের হয়ে যায়,বাড়ি থেকে বের হওয়ার পদক্ষেপ নেয়,বাড়ির মেইন‌ দরজা দিয়ে বের হয়ে সোজা বাগান ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় বাড়ির পেছনের দিকটায়।

সে ইতিমধ্যে বাড়ির পেছনে ল্যাবের সামনে পৌঁছে যায়,কিছু একটা ভেবে কিছুক্ষণ থ মেরে রইলো সেখানেই,তার সামনেই রয়েছে তার গ্ৰান্ডপার ল্যাবরেটরি।
বাইরে থেকে ল্যাবটি আধুনিক,উজ্জ্বল ও সুরুচিপূর্ণ স্থাপনাকে ধারণ করে।
বিশাল কাচের জানালা দিয়ে ল্যাবের ভিতরকার দৃশ্য দেখা যায়,যা ভবনের একাধিক তলায় বিভক্ত।
ল্যাবের বাইরের দেওয়ালগুলি মসৃণ ধাতুর তৈরি,
যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে।
ল্যাবের প্রবেশদ্বারটি মার্বেল পাথরের ধাপে,যা দৃঢ় আর পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত।বড়,ভারী কাচের দরজা দুটি স্লাইডিং গ্লাসের প্যানেল দিয়ে তৈরি,যা উজ্জ্বল আলোকে ভিতরে প্রবাহিত হতে দেয়।
ল্যাবের চারপাশে সঠিকভাবে কাটা কিছু গাছপালা ও পরিপাটি করা ঝোপঝাড় রয়েছে।
ল্যাবের সামনে আধুনিক সাইনবোর্ড রয়েছে,যা ল্যাবের নাম ও পাসকোডের নির্দেশিকা প্রদর্শন করে।এর পাশে একটি ইন্ট্রকম প্যানেলও রয়েছে,যা ভিতরে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ফিওনা নিঃশব্দে হেঁটে ল্যাবের প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়,পাশেই একটি প্যানেল রয়েছে যা টাচস্ক্রিন, সে ‌সেখানে পাসকোড বসায়।

ফিওনার নানা ফিওনার বার্থডের সাথে ম্যাচ করে ল্যাবের পাসকোড দিয়ে রেখেছেন।
পাসকোডটি দেয়ার সাথে সাথে স্ক্রিনে ভেসে উঠে এক্সেস গ্রান্টেড,তার মাথার ওপরের লেড লাইটটি সবুজ বাতি প্রদর্শন করে সিগন্যাল দিয়ে জানান দেয়, দরজা খোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে,ইলেকট্রনিক দরজাটা সয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায় ফিওনা ধীরপায়ে ভেতরে প্রবেশ করে,সে সচরাচর এই ল্যাবে প্রবেশ করেনা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া,আর যখনি এই ল্যাবে প্রবেশ করে তখনি সে ভীত হয়ে যায়।
সে ল্যাবের ভেতরে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়,ল্যাবের ভেতরের পরিবেশ খুবই অন্ধকারছন্ন সুনসান নীরবতা।
মাথায় ওপর কয়েকটা বাতি নিভু নিভু আলোতে জ্বলছে।

ল্যাবের ভেতরে ডানপাশে রয়েছে একটা বড় আকৃতির রুম,ফিওনা সেই রুমে প্রবেশ করে,সেখানে প্রবেশ করতেই সে আরেক দফা হতাশ হয় কেননা সেখানে তার গ্ৰান্ডপা উপস্থিত নয়।ল্যাবের ভেতরের এই রুমটাই চারিপাশের দেয়াল ফকফকা সাদা রঙের এতে করে রুমটায় উজ্জলতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রুমের কেন্দ্রস্থলে বিশাল স্টেশন রয়েছে যা বিভিন্ন ধরনের পরিক্ষা মুলক যন্ত্রপাতি আর ডিভাইস দিয়ে সজ্জিত।
স্টেশনের চারপাশে বড় বড় আর্কাইভ ক্যাবিনেট রয়েছে যেখানে গবেষণার ফাইলপত্র সযত্নে সংরক্ষিত করা।রুমের এক কোনায় একটি বড় ডাটা মনিটর আর কম্পিউটার সেট‌আপ করা যার স্ক্রিনে কিছু ডেটা প্রদর্শন চলমান।অন্যদিকে কিছু মাইক্রোস্কোপ আর সেন্ট্রিফিউজ মেশিন ও রয়েছে।‌
তবে মনিটরের ডাটা প্রচলন দেখে সে নিশ্চিত হয় তার গ্ৰান্ডপা ল্যাবেই আছেন কিন্তু তার কক্ষে তো তিনি নেই।
হঠাৎ পেছন থেকে একটি ভরাট পুরুষালী কন্ঠে সে কিছুটা চমকে যায়,পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পান ওয়াং লি কে,ওয়াং লি তিনিও চীনের একজন বিখ্যাত সাইনন্টিস,আর ফিওনার নানার একমাত্র পার্টনার,
এক অজানা প্রকল্প বাস্তবায়নে মিস্টার চেন শিং আর ওয়াং লি একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি ফিওনাকে এই মুহূর্তে ল্যাবে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রত্যাশিত মনোভাব ব্যাক্ত করেন।
তীক্ষ্ণ কন্ঠে তিনি প্রশ্ন করেন,

“‌ফিওনা তুমি হঠাৎ এই সময়ে ল্যাবে?”
ফিওনা হতাশা কন্ঠ জবাব দেয়,
“গ্ৰ্যান্ড লি,আমার গ্ৰান্ডপা কোথায়?তিনি বাড়িতে‌ নেই, এই মুহূর্তে ওনাকে আমার দরকার তাই ল্যাবে দেখা করতে এসেছি।।
মিস্টার ওয়াং লি,কম্পিউটারের সামনে এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসতে বসতে জবাব দেন,
” চেন শিং একটু বাহিরে গেছেন একটা বিশেষ কাজে, কয়েকজন বিভিন্ন দেশের সাইন্টিসদের সাথে মিটিং এ বসেছে,ফিরতে রাত হবে তুমি বাড়িতে ফিরে যাও ফিওনা।
মিস্টার ওয়াং লি খুবই ব্যাস্ততার সাথে কথাগুলো বলে,তার কন্ঠে স্পষ্ট তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে আপতত ব্যাস্ত আর তার মুখাবয়ব স্পষ্ট অবসন্ন।
তাই ফিওনা আর কথা বাড়ায় না,উল্টো পায়ে হতাশ হয়ে হাটা ধরে।
সে যখনি রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্য দরজার বাইরে পা রাখে তখনি তার কানে একটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক আওয়াজ কানে ভেসে আসে।

তার পা সেখানেই থমকে যায়,আরো ভালো করে শব্দটা পরিষ্কারভাবে শুনতে সে নিজের সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল,তার শ্রবণ ইন্দ্রিয় যেন আরো জাগ্রত হয়ে উঠল,তখনি সে পুনরায় সেই একই শব্দ পায় শব্দটা এক প্রকার এমন যে কোনো ভয়ানক জন্তুর গোঙানির আওয়াজ,গড়গড় জাতীয় এক প্রকার শব্দ।
সে আর স্থির থাকতে পারলো না,ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে তাকালো,শব্দের উৎস খুঁজতেই তার চোখ গেলো সেই সিক্রেট রুমের দিকে,ল্যাবের এই রুমে আরো একটি সিক্রেট রুম রয়েছে,আর এই সিক্রেট রুমের পাসকোড সে জানেনা,তার গ্ৰান্ডপা কখনোই তাকে এই রুমে প্রবেশের অনুমতি দেন নি।তার সবসময় ইচ্ছে হতো এই রুমে কি আছে তা একবার প্রদর্শন করার।

ফিওনা শব্দের উৎস খুঁজতেই তার চোখ যায় সিক্রেট রুমের দিকে,খুব বেশি ভুল‌ না হলে শব্দটা সেখান থেকেই আসছে ভেবেই সে আরেকটু সতর্ক হলো আরো ভালো করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলো,হঠাৎ তার চোখ যায় দরজার নিচের ফাঁকা অংশে,সিক্রেট রুমের দরজাটা ভারী ইস্পাতের তৈরি,দরজার ওপরে পাসকোডের‌ একটি ডিসপ্লে আর দরজার চারপাশে উন্নত প্রযুক্তির সিকিউরিটি প্যানেল,দরজার নিচে একটা সরু ফাঁক রয়েছে আর সেখান থেকেই এক প্রকার নীল আলোকরশ্মি আভা ছড়িয়ে আছে।
সে নিজের দৃষ্টিকে আরো তীক্ষ্ণ করে সেদিকে পা বাড়ায়,হঠাৎ ওয়াং লির গম্ভীর কন্ঠে তার ধ্যান ভাঙ্গে।
ওয়াং লি নিজের চেয়ারটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে,
তীব্র উদ্বিগ্ন কন্ঠে ফিওনাকে প্রশ্ন করে।
” কি হলো ফিওনা,তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?
ফিওনা একটু স্তম্ভিত হয়ে জবাব দেয়,

“গ্ৰান্ড লি’ আমি একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেয়েছি, আর এই শব্দটা এই সিক্রেট রুম হতেই আসছে,আর দরজার ফাঁক দিয়ে এমন নীল আলোক রশ্মি এটা কিসের??”
ওয়াং লি,তার কথায় কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন।
ওয়াং লি,নিজের চেয়ার ছেড়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসে।
ওয়াং লি কিছুটা শান্ত ভঙ্গিতে,দৃঢ় কন্ঠে তাকে আস্বস্ত করর প্রচেষ্টা চালায়।
“ফিওনা,আমি নিশ্চিত তুমি ভুল শুনেছো,এখানে অনেক গবেষনার কাজ চলছে যা মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ তৈরি করে,তুমি চিন্তা করোনা সবকিছু ঠিক আছে,এখন তুমি বাড়িতে ফিরে যাও,তোমার এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।
ফিওনা আর কোনো প্রকার কথা না বাড়িয়ে,
ল্যাব থেকে বের হয়ে যায়।

পথে হাঁটতে হাঁটতে সে কিছুটা চিন্তিত, তার এখনো সেই অস্থিরতা কমছেনা,সে শতভাগ নিশ্চিত শব্দটা সে শুনছে আর নীল রশ্মিটাও দেখতে পেয়েছে,এতোটা ভ্রম কি করে হতে পারে তার।
সে বাড়ির দিকে ফিরে আসে তবুও তাকে বরবার ভাবাচ্ছে সেই মৃদু গর্জনের শব্দ আর নীল আভা, ওয়াং লি যখন তাকে আস্বস্ত করছিলো তখনও তার মুখাবয়বে আতঙ্ক আর কিছুটা ভীতি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সে।
ফিওনা‌ নিজেকে যতই শান্ত রাখতে চেষ্টা করছেনা কেনো ওর মনের অস্থিরতা ওকে অশান্ত করে তুলছে, তাই সে শতভাগ নিশ্চিত হতে গ্ৰান্ডপার সাথে কথা বলবে এই বিষয়ে মনঃস্থির করে নেয়।
সে বাড়িতে ঢুকে সোজা নিজের কক্ষে চলে আসে। কুইন সাইজের বেডের মধ্যে,বড় ফোলাভাযুক্ত বালিশে ওপর ধপ করে শুয়ে পড়ে,যেন সমস্ত শরীরের শক্তি শেষ হয়ে গেছে।
সে আজ খুবই ক্লান্ত;দিনের ঘটনাগুলো তাকে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছে।
চোখদুটো ভারী হয়ে আসে,আর নিজের ক্লান্তির সঙ্গে লড়াই করতে পারে না।
চোখের পাতা একবারের জন্য বন্ধ হতেই যেন মুহূর্তেই তন্দ্রার জালে জড়িয়ে পড়লো,ধীরে ধীরে গভীর ঘুমের দিকে ঢলে যায় সে।

ফিওনা হঠাৎ গভীর ঘুমের মধ্যে একটি স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে,সে দাঁড়িয়ে আছে একটা অত্যন্ত সুন্দর পাহাড়ের চূড়ায়।
চারপাশে যতদূর চোখ যায়,পাহাড়ের ঢালগুলো নানা রঙের ফুলে ছেয়ে আছে—লাল,নীল,হলুদ,আর বেগুনি ফুলের সমারোহ যেন প্রকৃতির এক বিস্ময়কর চিত্রকলা ফুটে উঠেছে,তার মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে।
বাতাসে ফুলের মৃদু সুবাস ভেসে আসছে,যা তার চুলে হালকা করে দোলা দিচ্ছে।সবকিছু এত শান্তিপূর্ণ আর মনোমুগ্ধকর ছিলো যে মনে হচ্ছে সময় থমকে গেছে।
কিন্তু হঠাৎই,এই শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
দূর থেকে এক ভয়ানক গর্জন ভেসে আসে,যা পুরো পরিবেশটিকে কাঁপিয়ে তোলে।
ফিওনা আতঙ্কিত হয়ে পেছনে তাকায়,তার হৃদয় এক মুহুর্তে থমকে যায়।তার চোখের সামনে হাজির হয় এক বিশাল আকৃতির সবুজ প্রাণী—সে একবার দেখতেই চিনে ফেলে প্রানীটি ড্রাগন মনস্টার।
ড্রাগনটির শরীর সবুজ রঙে ঢাকা,আর তার বিশাল পাখাগুলো আকাশকে ঢেকে দিচ্ছে।তার সবুজ রঙের মনির চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে জ্বলজ্বল করছে,সেই চোখের মধ্যে এক ভয়ানক শক্তি আর রহস্য লুকিয়ে আছে।
ড্রাগনটি হঠাৎ করে তার মুখ খুলে,আর মুহূর্তের মধ্যে একটি বিশাল আগুনের গোলা ছুড়ে মারে ফিওনার দিকে।আগুনের তীব্র তাপে বাতাস যেন জ্বলে উঠছে। সে ভয়ে চিৎকার করে আর দ্রুত তার হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে।আগুনের শিখা তার দিকে ধেয়ে আসে,আর তার চিৎকারে মনে হয় যেন তার শরীর আর মন উভয়ই ভয়ে জমে যাচ্ছে।

ঠিক তখনই সে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠে,
ফিওনা তন্দ্রা ভেঙে উঠে বসে,স্বপ্নের ভয়ে হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে ধুকপুক করছে।
পরক্ষনেই সে নিজেকে ধাতস্থ করে আর বুঝতে পারে এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।শুধু একটা স্বপ্ন,কিন্তু সেই ভয়ানক গর্জন আর আগুনের শিখা এখনও তার কানে বাজছে।
বিছানার পাশে রাখা টেবিল ল্যাম্পের সাথে ঘড়িটার দিকে চোখ যায়।ঘড়ির স্ক্রিনে সময়টি জ্বলজ্বল করছে—রাত প্রায় ৩টা ছুঁই ছুঁই।
এই গভীর রাতে,চারপাশের নীরবতা আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে,আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ তার মনের ভেতরের অস্থিরতাকে আরও তীব্র করে তুলছে।
হঠাৎ ফিওনার মনে পড়ে যায়,তার গ্র্যান্ডপা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
চিন্তা মনে হতেই, সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়।সজাগ চোখে আর দ্রুত পদক্ষেপে সে মিস্টার চেন শিং-এর রুমের দিকে পা বাড়ায়।তার হৃদয়ের মধ্যে অদ্ভুত উত্তেজনা,আশার ঝলক ফুটে উঠেছে।
কিন্তু মুহূর্তেই তার আশার আলো নিভে যায়।

রুমের দরজার বাইরের এখনো অবধি লক দেখে তার হৃদয়ে শূন্যতার অনুভূতি চলে আসে।দরজার উপর চেকলিস্টের মতো লকগুলির তীক্ষ্ণ সিলভার চমক তার কাছে নিস্তব্ধতা আর নিরাশার প্রতীক হয়ে ওঠে।
ফোনও করতে পারবেনা কেননা সে জানে গ্র্যান্ডপা কখনোই ফোন ধরেন না যখন তিনি বাইরে ব্যস্ত থাকেন।তার মনটা পুনরায় হতাশা ছড়িয়ে পড়ে মনে হলো সমস্ত আশা এক নিমিষে দূর হয়ে গেছে।
সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে,তারপর ধীর পায়ে আবার নিজের কক্ষে ফিরে আসে।
ফিওনা নিজের কক্ষে ফিরে এসে বেডে বসে থাকে, কিন্তু এখন আর ঘুম তাকে কোনোভাবেই গ্রাস করতে পারছেনা।তাই রুম থেকে বের হয়ে,সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে,এক কাপ কফি বানিয়ে পুনরায় রুমে এসে রুমের বা পাশের বেলকনিতে দাঁড়ায়।কক্ষের বা পাশের বেলকনি হতে সরাসরি রাস্তা দৃশ্যমান।
ফিওনা বেলকনিতে এসে কফির কাপ হাতে ধরে,ধীরে ধীরে বাইরে তাকায়।

রাতের হালকা ঠাণ্ডা বাতাস ওকে সতেজ করে তুলছে, আর কফির ভাপে গরম অনুভূতি শরীরটা কিছুটা প্রশান্তি দিচ্ছে।শহরের নৈসর্গিক দশ্য,রাত্রির নীরবতা, আর কফির মিষ্টি গন্ধে তার সমস্ত চিন্তাগুলি একত্রিত হতে শুরু করলো।
বেলকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে,সে গভীরভাবে চিন্তিত চোখে দূরের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে,যেখানে মেঘের ফাঁক দিয়ে লুনার আলো মৃদুভাবে পড়ছে।আর মনে মনে তখনকার ঘটে যাওয়া ঘটনা আর স্বপ্নের কথা ভাবতে থাকে।

ফিওনা চিন্তায় ডুবে থাকা অবস্থায় হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ যায়,রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে কারো উপস্থিত টের পায় সে,ল্যাম্পপোস্টের সাথেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে,লম্বা মতোই একজন, দেহের গঠন আর পোশাক দেখে বোঝাই যাচ্ছে কোনো একজন পুরুষ তবে এই সুনসান নিরব রাস্তায় এ সময় কে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে,অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্কে তাই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার প্রচেষ্টা চালায় সে।
লোকটা কালো রঙের হুডি পরিহিত,হুডি দিয়ে মুখ আর মাথা সম্পুর্ন ঢাকা,কালো জিন্স আর পায়ে কালো স্নিকার্স পড়ে আছে,এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছে এই অপরিচিত লোকটি।
ফিওনা লোকটির দিকে উদ্বিগ্ন আর সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,বাতাসের হালকা ঠান্ডা অনুভবে তার মনোযোগ আরো নিবিষ্ট হয়ে উঠেছে সেই অচেনা অদ্ভুত লোকটির উদ্দেশ্য বুঝতে।

আচমকা সেই আগুন্তক বেলকনিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।ফিওনা কিছুটা চমকে যায়।সেই অপরিচিত লোকটির চোখে সানগ্লাস পরিহিত যা তার চোখের দৃষ্টিকে লুকিয়ে রেখেছে,কালো রঙের মাস্ক দিয়ে মুখের অর্ধেকাংশ ঢেকে রাখা।
লোকটির সানগ্লাস আর মাস্ক থাকলেও,তার দৃষ্টির দিকে কিছুটা নজর দিলেই বোঝা যায় যে সে ওপরের বেলকনির দিকেই তাকিয়ে আছে।
লোকটার উপস্থিতি আর দৃষ্টির তীব্রতা,তার মনে এক ধরনের অস্বস্তি ও উদ্বেগ তৈরি করলো।
সে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সেখান থেকে তীব্র আতঙ্কে রুমের ভেতরে ফিরে আসে।সে বেলকনির দরজা সজাগভাবে লক করে তাড়াতাড়ি পর্দা টেনে দেয়।
তারপর নিজেকে শান্ত করার জন্য নিজের সাথেই নিজে সংগ্রাম করতে থাকে,কিন্তু চেষ্টা করে শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য।

আযদাহা পর্ব ১

এক ধরনের উদ্বেগময় চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়।
“কে ছিলো লোকটি?” আগে তো কোনোদিন এখানে দেখেনি,‌ এতো রাতে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কি করছে লোকটি?‌ কেনো‌ এসেছে???

আযদাহা পর্ব ৩