আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২
সাবিলা সাবি
পাঁচ মাস কেটে গেছে…………আর ফিওনার জীবন আবারো নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে।ডক্টর লিউ ঝানের সঙ্গে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। ষএনগেজমেন্টের সময় তার বাবা-মা আসেনি, কিন্তু বিয়েতে তারা আসবে বলে জানা গেছে।চীনে ডক্টর লিউ ঝানের আপনজন বলতে তার দাদু ওয়াং লি ছিলেন,তবে তার মৃত্যু*র পর লিউ ঝান যেন একাই হয়ে গেছেন।ওয়াং লির মৃ*ত্যুর রহস্য কেউ জানে না,শুধু চেন শিং আর জ্যাসপার সেই রহস্যের গভীর সত্য জানেন।
রাত ঘনিয়ে আসছে।পুরো বাড়িতে এক অদ্ভুত নীরবতা,যেন চারপাশের বাতাসে এক অচেনা গন্ধ মিশে আছে।আজ ফিওনার জন্মদিন,তার জীবনের ১৯তম বছর শুরু হওয়ার দিন।তবে এই দিনটি যেন শুধুই একটি আনুষ্ঠানিকতা। ফিওনার মনে কোনো উচ্ছ্বাস নেই,কোনো প্রত্যাশা নেই।
ডাইনিং টেবিলে মিস ঝাং নিজের হাতে চকলেট কেক তৈরি করছেন।প্রতি বছরই তিনি এই কাজটি করেন,ফিওনার মনের দুঃখ মুছে দিতে চাইলেও সফল হন না।মিস্টার চেন শিং ফিওনার পছন্দের গিফটটি তার স্টাডি রুমে লুকিয়ে রেখেছেন,ঠিক রাত ১২টায় সেটা উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা।
ফিওনা নিজের রুমে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। আকাশে এক বিশাল চাঁদ উঁকি দিচ্ছে,আর তার পাশেই সেই উজ্জ্বল সন্ধ্যা তারা।এই তারাটার দিকে তাকালেই তার মনে হয়,যেন কেউ তাকে ডেকে বলছে,“তুমি আমাকে ভুলে গেছো,কিন্তু আমি এখনো তোমার আছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার হাতে একটি পুরোনো ছবি,যেখানে তার বাবা-মা তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে।তার ছোট্ট বেলায় এই দিনটি ছিলো কতটা আনন্দের।বাবা কেক কেটে তার মুখে তুলে দিতেন,মা আলতো করে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতেন।এখন এসব শুধুই স্মৃতি।
এদিকে,বিয়ের প্রস্তুতিও চলছে।লিউ ঝানের পরিবারও আসার পথে।যদিও ফিওনার সঙ্গে লিউ ঝানের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ,তবুও সেই গভীর ভালোবাসার অভাব যেন ফিওনার মনকে খালি করে রাখে।
রাত ১২টা বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট।মিস ঝাং কেকটি সাজিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেন।মিস্টার চেন শিং ফিওনাকে ডেকে আনেন।
“ফিওনা,জন্মদিনের কেক কাটতে আসো,”চেন শিং বলেন। তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস,যেনো তিনি ফিওনার আনন্দ ফিরিয়ে আনার জন্য সব করতে প্রস্তুত।
ফিওনা ধীরে ধীরে নেমে আসে।তার মুখে এক ছায়াময় হাসি, যেন সে উপস্থিত থাকে,কিন্তু মন অন্য কোথাও।
“শুভ জন্মদিন,ফিওনা!” সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে।ফিওনা কেক কাটে,আর মিস্টার চেন শিং তার হাতে একটি ছোট বাক্স তুলে দেন।
“এটা তোমার জন্য,”তিনি বলেন।
ফিওনা বাক্সটি খুলে দেখে একটি অপূর্ব নেকলেস। নেকলেসটির মাঝখানে একটি রত্ন,যা দেখলেই মনে হয়,এর মধ্যে কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।ফিওনা সেটা গলায় পরার সময় বুঝতেই পারেনি যে এই জন্মদিন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ল।ডক্টর লিউ ঝান এসে উপস্থিত হলো।ডক্টর লিউ ঝান যখন ঘরে ঢুকলো,তখন কেক কাটার পরের মুহূর্ত।তার হাতে একটি ফুলের তোরা আর একটি সুন্দর প্যাকেটে মোড়ানো গিফট।মৃদু হাসি নিয়ে ফিওনাকে শুভ জন্মদিন জানালো।ফিওনা বিনীতভাবে ধন্যবাদ দিলো,কিন্তু তার চেহারায় তেমন উচ্ছ্বাস নেই।
লিউ ঝান চেষ্টা করলো পরিবেশটা হালকা করার।
কিছুক্ষণ পর,মিস্টার চেন শিং আর মিস ঝাং ইশারায় বললো,“তোমরা দু’জন একটু সময় কাটাও,” তারপর ধীরে ধীরে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।ঘরটা হঠাৎ যেন খুব বড় আর নিস্তব্ধ লাগছিল।
লিউ ঝান ফিওনার পাশের চেয়ারে বসে তার হাতটা আলতো করে ধরলো। “ফিওনা,জানো,আমি তোমার জন্য কতটা চিন্তিত থাকি?তোমার হাসিটা দেখার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি,” বলে সে মৃদু হাসলো।
ফিওনা কিছু বললো না,চুপচাপ তার কথা শুনছিল।লিউ ঝান আরও কিছুক্ষণ নানা কথাবার্তা বলতে থাকলো।তার চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল,যা ফিওনাকে একটু অস্বস্তিতে ফেলছিল।
হঠাৎ,লিউ ঝান তার হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বললো, “ফিওনা,আমি তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসি।যেদিন তোমাকে হসপিটালে প্রত্যয় দেখেছিলাম সেদিনই আমি তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করি।আমার মনে হয় তুমি জানো না,কিন্তু আমি তোমার জন্য কতটা পাগল।”
এরপর কোনো অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে লিউ ঝান নিজের ঠোঁটজোড়া ফিওনার ঠোঁটে চেপে ধরলো।সেই মুহূর্তে ফিওনার সারা শরীর শিউরে উঠলো।সে যেন বাস্তব আর কল্পনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
অবিলম্বে ফিওনা শক্তি দিয়ে লিউ ঝানকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলো।লিউ ঝান হঠাৎ ব্যালান্স হারিয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেলো।ফিওনার চোখে আগুনের মতো রাগ, আর শরীর থরথর করে কাঁপছিল।
“আপনি কী মনে করেন?এভাবে আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে চুমু দেয়ার সাহস কি করে হয় আপনার ?” ফিওনা রাগে গর্জে উঠলো।
লিউ ঝান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর বললো, “আমি ভাবিনি তুমি এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। আমি সত্যি-ই তোমাকে ভালোবাসি,ফিওনা।আমি শুধু…”
“আপনার এই ভালোবাসার নামে আমার অস্বস্তিবোধ হবে এমন কিছু করার অধিকার আপনার নেই।।আমি আপনাকে সম্মান করতাম,কিন্তু……..
পর মুহূর্তেই ফিওনার মাথায় একটা ঝটকা লাগে।সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে,লিউ ঝান তার বাগদত্তা—তার উপর কিছু অধিকার তো থাকেই।সে অবাক হয়ে নিজের হাতে তাকায়, কী করে এমন আচরণ করলো সে?লিউ ঝানের চোখে তখন এক ধরনের আহত বিস্ময়।
ফিওনা দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “সরি,মিস্টার লিউ ঝান।আমি আসলে… আমি আসলে বুঝতে পারিনি আমি কী করেছি।প্লিজ,আমাকে ক্ষমা করবেন।”
লিউ ঝান কিছু বললো না,শুধু এক দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইলো।ফিওনা এবার নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলে,“আমি সত্যিই দুঃখিত।আপনি যা করেছেন তা আপনার অধিকার।কিন্তু…আমি এখনও এসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নই।আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন,কিন্তু প্লিজ আমাকে একটু সময় দিন।আমি আস্তে আস্তে সব মেনে নেব।”
লিউ ঝান গভীর শ্বাস নিলো,যেন তার ভিতরের হতাশাকে চাপা দিচ্ছে।সে মৃদু হেসে বললো,“ফিওনা,আমি বুঝি। তোমার সময় লাগবে,আর সেটা আমি দিতে প্রস্তুত।
তুমি যখনই প্রস্তুত হবে,আমি তোমার কাছে আসবো।”
ফিওনা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো।তার মনে হল,লিউ ঝান সত্যিই তাকে বোঝার চেষ্টা করছে।সে মৃদু মাথা নাড়লো আর নিজের জায়গায় ফিরে বসল।কিন্তু তার মনটা তখনো অস্থির ছিল।লিউ ঝান আর কিছু না বলে কেকের দিকে তাকিয়ে বললো, “চলো,ইয়াম্মি কেকটা একটু কেটে খাই,আজ তোমার জন্মদিন।এই দিনটা আমাদের আনন্দে কাটানো উচিত।”
ফিওনা কিছু না বলে কেক কাটার জন্য ছু*রি তুলে নিলো। তবে তার মনে একটা অদ্ভুত চাপ কাজ করছিল।
লিউ ঝানকে সরানোর মুহূর্তটা যেন তার মনে আটকে আছে।
রাত গভীর।ফিওনা বিছানায় শুয়ে আছে,জানালার বাইরে চাঁদের আলো ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে।চারিদিক নিস্তব্ধ।ফিওনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
হঠাৎ তার স্বপ্নের মধ্যে অদ্ভুত একটা দৃশ্য ভেসে উঠল।এক আবছা,রহস্যময় ব্যক্তির কণ্ঠ ভেসে আসছে—গভীর, হিমশীতল সেই কণ্ঠ যেন তার আত্মার ভিতর প্রবেশ করেছে।
“তোমাকে চুমু দেয়ার সাহস সে কোথায় পেল?সে জানে না, তুমি আমার!ওকে আমি শেষ করে ফেলবো!”
ফিওনার সামনে হঠাৎই সেই আবছা ব্যক্তির অবয়ব স্পষ্ট হতে শুরু করল।তার চোখে যেন আগুনের শিখা জ্বলছে।সে মুহূর্তেই লিউ ঝানের দিকে এগিয়ে গেল।লিউ ঝান ফিওনার দিকে কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু সেই রহস্যময় ব্যক্তি কোনো সুযোগ দিল না।এক ঝলক বিদ্যুৎ যেন আকাশ ফুঁড়ে পড়লো, আর লিউ ঝান মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।তার শরীর নি*থর।
ফিওনা চিৎকার করে উঠলো,“না!এটা কী হলো?থামো! প্লিজ,থামো!”
চিৎকার করতে করতে তার ঘুম ভেঙে গেল।ফিওনা বিছানায় উঠে বসল,ঘামছে।তার বুক ধুকপুক করছে,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখলো,কেউ নেই।চারিদিক শান্ত,শুধু তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ।
সে নিজের মাথা দুই হাতে ধরে বিছানার পাশে বসে থাকলো। স্বপ্ন এতটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল,যেন সে সবকিছু নিজের চোখে দেখেছে।কণ্ঠটা,সেই চিৎকার,লিউ ঝানের নি*থর দেহ—সব যেন এক দুঃস্বপ্ন নয়,কোনো এক বাস্তবতা।
ফিওনার চোখে পানি চলে এল।সে নিজের মনে বললো,
“এটা কেন দেখলাম আমি?কার কণ্ঠ ছিল সেটা?আর লিউ ঝান…ও কি ঠিক আছে?”
তখনই ঘরের জানালার পর্দা একটু নড়লো।বাতাসের মতো হালকা কিছু যেন কক্ষের ভেতর দিয়ে চলে গেল।ফিওনার মনে হলো,কেউ যেন তাকে দেখছে।কিন্তু কক্ষে কেউ নেই।
এই রাতটা আর ফিওনার জন্য স্বাভাবিক রইলো না।সে জানত,কিছু একটা বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে।কিন্তু কী,সেটা এখনো অজানা।
পরদিন সকালে ফিওনা নিজের বিছানায় শুয়ে ছিল।শরীর কেমন যেন গরম লাগছিল।কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে দুর্বলতা বা ক্লান্তি অনুভব করছিল না।তাপমাত্রা যেন ভেতর থেকে আসছিল,শরীরের প্রতিটি কোষ যেন উত্তাপ ছড়াচ্ছে।সে কপালে হাত রাখল,তীব্র গরম।
ফিওনা আর দেরি না করে মিস্টার চেন শিংকে খবর দিল। চেন শিং তড়িঘড়ি করে ফিওনার কপালে থার্মোমিটার রাখলেন।থার্মোমিটার দেখে তিনি হতভম্ব—১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট!কিন্তু ফিওনার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে এত জ্বরে ভুগছে।
“ফিওনা,তুমি ঠিক আছো তো?কোনো অস্বস্তি লাগছে না?” মিস্টার চেন শিং উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“না গ্ৰান্ডপা,আমার তো দুর্বল লাগছে না।বরং আমি একদম স্বাভাবিক বোধ করছি,”ফিওনা শান্ত কণ্ঠে বলল।
এত তাপমাত্রা থাকা সত্ত্বেও ফিওনা কীভাবে এত স্বাভাবিক থাকতে পারে,সেটা চেন শিংয়ের কাছে সম্পূর্ণ রহস্য।তিনি আর সময় নষ্ট না করে ডক্টর লিউ ঝানকে ফোন দিলেন।
লিউ ঝান অল্প সময়ের মধ্যেই ফিওনার বাসায় উপস্থিত হলো।সে পেশাদারভাবে ফিওনার পুরো চেকআপ করলো—তাপমাত্রা,পালস,রক্তচাপ—সবই পরীক্ষা করলো।তার মুখ ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল।
“অদ্ভুত…,”লিউ ঝান চেন শিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললো। “তাপমাত্রা এত বেশি,কিন্তু ফিওনার শরীরে কোনো জ্বর নেই। তার পালস একেবারে স্বাভাবিক।এমনকি,সে সম্পূর্ণ সুস্থ। এটাতো কোনো সাধারণ বিষয় নয়।”
চেন শিং চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“তাহলে এটা কী হতে পারে,লিউ ঝান?তার শরীর এত গরম কিন্তু কোনো রোগের লক্ষণ নেই।এটা তো অসম্ভব!”
লিউ ঝান কিছুক্ষণ চুপ থাকলো,তারপর বললো,“এটা আমার সাধারণ চিকিৎসা জ্ঞানের বাইরে তবে এমন কিছু হতে পারে যা আমরা বুঝতে পারছি না।হয়তো তার শরীরের ভেতর কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।আমি আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই কিছু বলতে পারব।”
ফিওনা লিউ ঝানের কথাগুলো শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেল।তার নিজের শরীরের ওপরও এখন আর তার আস্থা নেই।অদ্ভুত সেই স্বপ্ন আর শরীরের এই পরিবর্তন যেন কোনো ভিন্ন রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
চেন শিং ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন,“ফিওনা,আমরা তোমার পাশে আছি।চিন্তা কোরো না। কিন্তু হ্যাঁ,তোমার শরীর নিয়ে কোনো অদ্ভুত কিছু অনুভব করলেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবে।ঠিক আছে?”
ফিওনা নীরবে মাথা নাড়ল।কিন্তু তার ভেতর একটা অদ্ভুত অস্বস্তি জন্ম নিচ্ছিল।তার মনে হলো,এই অস্বাভাবিক উত্তাপের পেছনে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা এখনো তার সামনে আসেনি।
ফিওনা ভার্সিটির ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে খুব ক্লান্ত ছিল।সে শাওয়ার নেয়ার জন্য গোসলখানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করল। জামাকাপড় খুলতে গিয়ে তার চোখ হঠাৎ নিজের গলার দিকে পড়ল।গলার ত্বকে বাদামি রঙের একটি আশের মতো দাগ!প্রথমে ভেবেছিল এটা ময়লা বা হয়তো ধুলো জমে আছে।কিন্তু যখন হাত দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল, তখন বুঝতে পারল দাগ মুছছে না।
ভয় পেয়ে সে নিজের হাত আর বুকের দিকে তাকাল।একই রকম দাগ হাতের ওপরের অংশ আর বুকেও।তার দম বন্ধ হয়ে এলো,আর মনে হলো তার ত্বক যেন সাপের মতো আশ ধরে আছে।ফিওনা ভয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আরেকবার নিজের শরীর পরীক্ষা করতে লাগল।
হঠাৎ করেই তার চোখ ঘাড়ের পেছনে পড়ল।সেখানে চুলের নিচে গাঢ় কালো রঙের লম্বা একটি ট্যাটুর মতো কিছু দেখা গেল।সেটা স্পষ্টতই ড্রাগনের মতো আকৃতির!এটা দেখে তার গলা দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এলো।
“গ্ৰান্ডপা!মিস ঝাং!তাড়াতাড়ি আসুন!”
চিৎকার শুনে চেন শিং আর মিস ঝাং দ্রুত গোসলখানার দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।চেন শিং দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ফিওনাকে জিজ্ঞেস করলেন,“ফিওনা!কি হয়েছে? তোমার কিছু হয়েছে নাকি?”
ফিওনা কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিল,“গ্ৰান্ডপা,মিস ঝাংকে ভেতরে আসতে বলো।আমার…আমার শরীরে কিছু অদ্ভুত হচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি!”
চেন শিং মিস ঝাংকে ইশারা করলেন ভেতরে ঢোকার জন্য। মিস ঝাং দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।ফিওনার চোখে আতঙ্ক আর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল।মিস ঝাং তার হাত ধরলেন,“ফিওনা,আমাকে দেখাও।কী হয়েছে?”
ফিওনা তার গলা,বুক আর হাতের দাগ দেখাল।মিস ঝাং প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না।তিনি কাছে গিয়ে ফিওনার ঘাড়ের দিকে তাকালেন।হঠাৎই তার চোখ পড়ল সেই ড্রাগন আকৃতির ট্যাটুতে।
“এটা.. এটা কীভাবে সম্ভব?”মিস ঝাং চিৎকার করে উঠলেন। তার হাত কাঁপতে লাগল।
“কি হলো,মিস ঝাং?ফিওনার কী হয়েছে?” চেন শিং বাইরে থেকে চিৎকার করে জানতে চাইলেন।
মিস ঝাং দরজা খুলে বললেন,“চেন শিং,আপনি এখানে আসুন।ফিওনার শরীরে যা হচ্ছে তা স্বাভাবিক নয়।তার ঘাড়ে একটা ড্রাগনের মতো ট্যাটু দেখা যাচ্ছে,যা তার চামড়ার অংশের মতো!”
চেন শিং দরজার সামনে থেমে গেলেন।তার মুখের রং সাদা হয়ে গেল।তিনি জানতেন,ফিওনার এই পরিবর্তন কোনো সাধারণ ঘটনা নয়।
মিস্টার চেন শিং বিকেলে ফিওনাকে তার ল্যাবে ডাকলেন। চীনের বেইজিং শহরের ব্যস্ত রাস্তার পাশে বাড়ির বাগানে লুকিয়ে থাকা এক গোপন ল্যাব,যা কিছুদিন আগেই জ্যাসপার ধ্বংস করে দিয়েছিলো,চেন শিং পুনরায় তাঁর ল্যাব সজ্জিত করেছেন।সেখানে,অগণিত যন্ত্রের টিকটিক শব্দ আর স্টিলের দেয়ালের ঠান্ডা প্রতিচ্ছবিতে ডুবে ছিল পরিবেশ।মিস্টার চেন শিং নিজের ডেস্কে বসে আছেন।তার সামনে রাখা একটি ছোট বাক্স।ফিওনা তার সামনে বসে আছে—ক্লান্ত,বিভ্রান্ত।তার চোখে দেখা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়া প্রশ্নের ঝড়।
চেন শিং ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।ফিওনা চেয়ারে বসে অস্থিরভাবে হাত মুঠো করছিলো।তার চোখে হতাশা,আর চেন শিং তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।কিছু সময় নীরব থেকে তিনি ধীরে ধীরে বললেন,“ফিওনা,তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্যগুলো তোমার জানার সময় হয়ে এসেছে।আমি জানি,এগুলো শোনার পর তোমার মনের অবস্থা কী হবে,কিন্তু এখন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”
ফিওনা তার দিকে অবিশ্বাস আর প্রশ্নের চোখে তাকিয়ে বলল,“কী সত্য,গ্ৰান্ডপা?এতদিন ধরে তুমি কী লুকিয়ে রেখেছিলে?প্লিজ,আমাকে বলো!”
চেন শিং একটু থেমে বললেন,“ফিওনা তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন থেকেই তোমার জীবনের অনেক কিছু ভিন্ন ছিল। প্রথমত,তোমার বাবা-মা যাদের তুমি তোমার আপন বাবা মা মনে করতে,সেই গাড়ি দু*র্ঘটনায় মা*রা গেছেন,তারা আসলে তোমার জন্মগত বাবা-মা ছিলেন না।আঠারো বছর আগে এক প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে,তোমাকে তারা চার্চের সামনে পায়।তুমি তখন একেবারে নবজাতক,একটি কম্বল মোড়ানো অবস্থায়।তোমার আসল বাবা-মা কারা,তা আমরা কখনোই জানতে পারিনি।”
ফিওনার মুখ বিস্ময়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “কী?তুমি বলছো, তারা আমার আসল বাবা-মা ছিলো না?তাহলে আমি কে? আমার আসল বাবা-মা কোথায়?”
চেন শিং আবার বলতে শুরু করলেন,“আমি জানি না, ফিওনা।তবে তোমার জন্মের সাথেই হয়তো ড্রাগনদের কোনো সুত্র আছে।বছরখানেক প্রায় তার আগে তোমার জীবনে বড় একটি ঘটনা ঘটে।
তুমি হয়তো জ্যাসপারের কথা মনে করতে পারবেনা,কারণ তোমার সেই স্মৃতিগুলো লকেটে ক্যাপচার করে রাখা হয়েছে। জ্যাসপার,যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে,সেই ড্রাগন প্রিন্স।সে তোমাকে কি*ডন্যাপ করেছিলো কারণ আমি তার ভাই এথিরিয়নকে ব*ন্দি করেছিলাম।জ্যাসপার তখন তার ভাইকে উদ্ধার করতে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলো।”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে বলল, “কি*ডন্যাপ?আমাকে? জ্যাসপার?ড্রাগন প্রিন্স?ভালোবাসা?কিন্তু… তুমি এথিরিয়নকে কেন বন্দি করেছিলে?”
চেন শিং বললেন,“কারণ আমি ড্রাগনদের ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করছিলাম।এথিরিয়ন ছিল সেই গবেষণার একটি অংশ।তবে সেই সময়,জ্যাসপার তোমাকে মাউন্টেন গ্লাস হাউজে নিয়ে যায়।আমি ভেবেছিলাম সে তোমার ক্ষতি করবে,কিন্তু ধীরে ধীরে তোমরা দুজন একে অপরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলে।সেই ভালোবাসাই তোমাদের ভাগ্যকে বদলে দেয়।”
ফিওনার শ্বাস ভারী হয়ে গেল। “আমি… আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।গ্ৰান্ডপা তুমি বলছো আমি একজন ড্রাগন প্রিন্সকে ভালোবেসেছিলাম?এটা কীভাবে সম্ভব?”
চেন শিং মাথা নিচু করে বললেন,“তোমার মনে হয়ত কিছুই নেই,কারণ সে সব মুছে ফেলেছে।আমি তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম।কিন্তু এখন তোমার শরীরে ড্রাগনের চিহ্নগুলো দেখা দিচ্ছে।আমি ভয় পাচ্ছি, তুমি ধীরে ধীরে ড্রাগনে রূপান্তরিত হচ্ছো।আর এটাই তোমার আসল পরিচয়।”
ফিওনার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতে লাগল। “আমার জীবন পুরোটাই মিথ্যা ছিল…আমি জানতাম না, আমি আসলে কে।এখন আমি কী করব,গ্ৰান্ডপা?আমি তো এসবের জন্য প্রস্তুত নই।”
চেন শিং তার হাত ধরে শান্তভাবে বললেন,“তোমাকে নিজের ভেতরের শক্তিকে গ্রহণ করতে হবে,ফিওনা।আর জ্যাসপার… সে তোমার জীবনের একটি বড় অংশ।আমি জানি,তুমি একদিন সব সত্য মনে করতে পারবে।তবে তার আগে, তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।কারণ আরও বড় বিপদ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ফিওনা ভেঙে পড়লেও মনে একটা শক্তি অনুভব করল।তার জীবনের রহস্যের পর্দা উঠতে শুরু করেছে,কিন্তু সামনে কী অপেক্ষা করছে,তা নিয়ে তার মন দুশ্চিন্তায় ভরে গেল।
মিস্টার চেন শিং ফিওনার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জল আটকে রাখতে পারলেন না।তার কণ্ঠ ভারী হয়ে গেল।তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “ফিওনা,আমি জানি এটা তোমার জন্য কতটা কষ্টের।কিন্তু সত্যিটা এড়ানো সম্ভব নয়। তুমি যদি সম্পূর্ণ ড্রাগনে রূপান্তরিত হও,তাহলে তোমার পৃথিবীতে থাকা আর সম্ভব হবে না।ড্রাগনের শক্তি আর পরিবেশ মানুষের জগতের জন্য বিপজ্জনক।ভেনাসই তোমার জন্য নিরাপদ।আর…”
তিনি থেমে গিয়ে চোখ মুছলেন। “আর হয়তো আমি তোমার কাছে থাকতে পারব না।এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে তোমাকে।এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় শা*স্তি।”
ফিওনা মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।তার কান্নায় সমস্ত ঘর ভারী হয়ে উঠল। “না,গ্রান্ডপা!আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। আমি পৃথিবী ছেড়ে যাব না।আমি ভেনাসে যেতে চাই না। তুমি আমার সবকিছু,আমি তোমাকে ছেড়ে কীভাবে বাঁচব?”
চেন শিং তার হাত ফিওনার কাঁধে রাখলেন।“ফিওনা,আমার ছোট্ট নাতনীটা…আমি চাই না তোমার জীবনে এমন কিছু ঘটুক যা তোমার সুখ কেড়ে নেয়।কিন্তু তুমি যদি সত্যিই ড্রাগনে রূপান্তরিত হও,তাহলে তোমার নিয়তি পাল্টানো সম্ভব নয়।তুমি এমন এক জগতের যা এই পৃথিবীর চাইতে আলাদা।আমি শুধু চাই,তুমি নিজেকে ভালোবাসতে শেখো।নিজের সত্যকে গ্রহণ করো।”
ফিওনা মাথা নাড়তে লাগল। “আমি জানি না আমি কে। আমি জানি না আমার সত্যটা কী।কিন্তু আমি জানি,আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।আমি আমার আসল বাবা মাকে চিনিনা,যাদের বাবা মা হিসেবে জেনেছি তারা মা*রা গেছেন,এবার তোমাকে ছেড়ে যেতে হলে আমি একা হয়ে যাবো গ্ৰান্ডপা!!কিছু একটা উপায় নিশ্চয়ই আছে।প্লিজ, আমাকে পৃথিবীতে থাকার কোনো পথ দেখাও।”
চেন শিং নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,“আমি চেষ্টা করব,ফিওনা। আমি আমার সমস্ত জ্ঞান,সমস্ত গবেষণা কাজে লাগাব।কিন্তু মনে রেখো,এই যাত্রাটা সহজ হবে না।তোমাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে।নিজের ভেতরের শক্তি আর ভালোবাসার ওপর ভরসা রাখো।কারণ,তোমার জন্য একদিন কেউ আসবে,যে তোমাকে সাহায্য করবে।সে হয়তো জ্যাসপার হতে পারে…কিংবা অন্য কেউ।”
ফিওনার চোখে জল ঝরতে ঝরতে ম্লান হাসি ফুটল।
“আমি জানি না ভবিষ্যতে কী আছে,কিন্তু আমি তোমার কথা শুনব।আমি লড়ব।আমি এই পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাই না,গ্ৰান্ডপা।”
চেন শিং মাথা নাড়লেন।“আমি তোমার পাশে আছি ফিওনা।”
ল্যাবটা নীরব হয়ে গেল।তবে সেই নীরবতায় এক নতুন আশা মিশে ছিল,এক নতুন পথের সূচনা।
রাতের আকাশে তারাগুলো যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ফিওনার শরীর প্রচণ্ডভাবে কাঁপছিল।তার মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতরে যেন কোনো দানব আটকে আছে,বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।বাড়ির মধ্যে থেকে টিকে থাকা অসম্ভব মনে হলো তার।
সে দ্রুত জানালা খুলে বাইরে লাফিয়ে পড়ল।রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করল। হঠাৎ করেই তীব্র ব্যথা অনুভব হলো।ফিওনা হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল।তার চিৎকার যেন পুরো রাস্তাকে প্রকম্পিত করে তুলল।
মুহূর্তেই তার হাত,পা,পিঠ থেকে শক্তি বেরিয়ে আসতে শুরু করল।তার ত্বক বাদামি রঙের আঁশে ঢেকে গেল।ফিওনার শরীর থেকে যেন এক বিশাল ড্রাগনের রূপ বেরিয়ে এলো। চোখ দুটো আগুনের মতো লাল,বিশাল পাখা,আর শক্তিশালী লেজ।
ফিওনা তখন আর মানুষ নেই—সে এখন ড্রাগন।
বাধ্য হয়ে সে পাখা মেলে আকাশে উড়ে গেল।চীনের পাহাড়ের এক নির্জন জায়গায় এসে সে নেমে পড়ল।ফিওনা বুঝতে পারছিল,এই শক্তি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।বিশাল গর্জনে পাহাড় কেঁপে উঠল।পাথর গড়িয়ে পড়তে লাগল।চারপাশে পাখিরা ভয়ে উড়ে পালিয়ে গেল।
ফিওনা সেই পাহাড়ে দাঁড়িয়ে একের পর এক গর্জন করে যাচ্ছিল।তার ভেতরে জমে থাকা অজানা ক্রোধ,যন্ত্রণা,আর শক্তির বিস্ফোরণ হচ্ছিল যেন।তার ড্রাগনের রূপে দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যটা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর—পাহাড়ের চূড়ায় এক বিশাল বাদামী ড্রাগন,রাতের আকাশে তার শরীর থেকে ঝলমলে আভা ছড়াচ্ছে।কিন্তু তার চোখে ছিল এক ধরনের শূন্যতা।ফিওনা জানত না কীভাবে সে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।
পুনরায় মানব রুপে আসতেই ফিওনা কাঁদতে লাগলো। ভোরবেলা ফিওনা বাড়িতে ফিরে ঘুমিয়ে যায়।ভোরের আলো ফিওনার মুখে পড়তেই সে ঘুম থেকে উঠে।তার চোখে গত রাতের ঘটনার ধাক্কা স্পষ্ট।ফিওনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল।”এটা আমি কী হয়ে যাচ্ছি?” নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।
আলতো করে চোখ মুছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হতে হবে,কিন্তু আয়নায় নিজেকে দেখে ফিওনার পা থমকে গেল।তার ত্বক যেন আগের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল,একেবারে তুষারের মতো সাদা।হালকা বাদামী চোখ দুটো এখন হ্যাজেলের গভীরতায় মিশে গেছে।ঠোঁট আরও বেশি গোলাপি,আর চুল?একদম গাঢ় বাদামী,কোমর পর্যন্ত ঘন চুল যেন আগের থেকে আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে।হঠাৎ করে তার হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেল।ফিওনা চমকে উঠল।সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তার শরীরের এই পরিবর্তনগুলো কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
“আমি কি স্বাভাবিক থাকছি না?” তার কণ্ঠে এক ধরনের ভয় আর উদ্বেগ।
সে দ্রুত নিজের ড্রেস ঠিক করে ভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হতে থাকে,কিন্তু আয়নার প্রতিফলনে সে এক নতুন ফিওনাকে দেখছে—একটা অচেনা মানুষ,যে নিজের সম্পর্কে কিছুই জানে না।
সকালটি ছিল অদ্ভুত এবং নীরব।মিস্টার চেন শিং ডাইনিং টেবিলে বসে চা পান করছিলেন,আর মিস ঝাং কিচেনে নাশতার ব্যবস্থা করছিলেন।সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ফিওনা। চেন শিংয়ের চোখ মুহূর্তেই ফিওনার দিকে আটকে গেল।
ফিওনার চেহারার পরিবর্তন এতটাই স্পষ্ট যে মিস ঝাং হাতের কাজ থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“ফিওনা,তুমি কি ঠিক আছো?” মিস্টার চেন শিং জিজ্ঞেস করলেন,কণ্ঠে উদ্বেগ।
ফিওনা কোনো উত্তর না দিয়ে ধীর পায়ে এসে চেন শিংয়ের পাশে বসলো।তার মুখে এক ধরনের ক্লান্তি আর চোখে বিষণ্নতার ছাপ।
মিস ঝাং কিছু বলতে চাইলেন,কিন্তু ফিওনার অদ্ভুত চেহারা দেখে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।চেন শিং বুঝতে পারলেন যে কিছু একটা ঘটেছে,কিন্তু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলেন না।
সেদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই হলো না ফিওনার। সে পুরো দিন নিজের ঘরে কাটাল,এক অজানা আতঙ্ক আর পরিবর্তনের ধাঁধায় আটকে।
রাত গভীর হলে ফিওনা আবার সেই অস্থিরতা অনুভব করল।বুক ধড়ফড় করছে,শরীরে যেন অদ্ভুত এক শক্তি জমা হচ্ছে।তার মনে হলো,আর রুমে থাকা সম্ভব নয়।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ফিওনা।ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই শরীরে আগুনের মতো কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার পুরো শরীর বদলে গেল।
সে আর মানুষ নেই,বিশাল বাদামী ড্রাগন রূপে ফিওনা আকাশে উড়ে গেল।তার ডানা দুটো রাতের আকাশে ছায়ার মতো বিস্তৃত।
ড্রাগনের রূপে ফিওনা কোনোভাবেই নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিল না।তার ভেতরে জমে থাকা শক্তি বেরিয়ে আসতে চাইছিল।সে এক পাহাড়ের ওপর গিয়ে গর্জন করল,আর তার গর্জন পুরো উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হলো।
তবে বিপদ ঘটে গেল যখন এক পথচারী সেই গর্জন শুনে উপরে তাকাল।সে ফিওনাকে দেখে ফেলে।ফিওনার চোখ তখন আগুনের মতো জ্বলছে,আর তার ভেতরের ড্রাগন-শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
বিস্ফোরণের মতো এক আগুনের গোলা ছুড়ে দেয় ফিওনা। সেই লোকটি পালানোর সুযোগ পায়নি।মুহূর্তের মধ্যে সে অগ্নি ভ*স্মে পরিণত হয়।
ফিওনা তখনো নিজের মধ্যে নেই।তার ড্রাগনের শরীর হাওয়ায় ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে।
পুনরায় মানব রূপে ফিরে আসার পর ফিওনা সেই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল।সে কী করল?
তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।“আমি কীভাবে একজন নিরীহ মানুষকে হ*ত্যা করলাম?”তার গলার স্বর কাঁপছিল।
সকাল হওয়ার আগেই সে বাড়ি ফিরে এল।ভোরের আলো ফোটার আগেই সে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল,কিন্তু তার মন কিছুতেই শান্ত হলো না।
সে জানত,তার শক্তি আর তার ভেতরের ড্রাগনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আরও বড় বিপদ ঘটবে।
সকালটা শুরু হয়েছিলো এক বিষণ্ন নীরবতায়।ফিওনা নিজের ভেতরের যন্ত্রণা নিয়ে ল্যাবের দিকে হাঁটছিল।মনে হচ্ছিল,প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ল্যাবে পৌঁছেই সে তার গ্ৰান্ডপার সামনে দাঁড়াল।মিস্টার চেন শিং তখন তার ডেস্কে বসে গবেষণায় ডুবে ছিলেন।কিন্তু ফিওনার মুখের দিকে তাকাতেই তার কাজ থেমে গেল।
“গ্ৰান্ডপা…”ফিওনার গলা কাঁপছিল। “আমি সম্পুর্ন রুপে ড্রাগনে রুপান্তরিত হয়েছি,আর আমি একজন নিরীহ মানুষকে হ*ত্যা করেছি।আমি এটা কীভাবে করলাম?”
তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।মিস্টার চেন শিং উঠে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন।
“ফিওনা,তোমার শক্তি এখনো তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই।তুমি জানো না কীভাবে তা ব্যবহার করতে হয়।এটা কোনো দোষের নয়,তবে…” তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
“তোমাকে ভেনাসে ফিরে যেতে হবে।”
ফিওনা স্তব্ধ হয়ে গেল।“ভেনাসে?”
“হ্যাঁ,” চেন শিং গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন। “ওখানেই তুমি শিখতে পারবে কীভাবে তোমার ড্রাগন-শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।এটা তোমার জন্যও ভালো,আর সবার জন্যও।”
ফিওনা বুঝতে পারছিল,তার গ্ৰান্ডপার কথা ঠিক।কিন্তু ভেতরে এক ভয় কাজ করছিল।ভেনাসের সেই অজানা জগত,সেই রহস্যময় পরিবেশ—সে কীভাবে সেখানে যাবে?
“কিন্তু গ্ৰান্ডপা,তুমি … তুমি একা থাকবে?”
চেন শিং মৃদু হাসলেন,যদিও তার চোখের কোণে অশ্রুর আভা ছিল। “তোমার ভালো থাকার জন্য আমি সব করতে পারি। তুমি যদি এখানে থাকো আর বারবার এই বিপর্যয় ঘটে,তবে সেটা তোমার জন্যও কষ্টকর হবে,ফিওনা। আর আমি… আমি সবদিক সামলে নেব।”
ফিওনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।সে চেন শিংয়ের বুকের দিকে ঝুঁকে কেঁদে উঠল।
“আমি যেতে চাই না…কিন্তু আমি জানি,আমাকে যেতে হবে।”
চেন শিংও তার আদরের নাতনিকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু ফেলে দিলেন।দশ বছর ধরে তিনি তাকে লালন-পালন করেছেন। সেই ছোট্ট মেয়েটি,যে একদিন তার হাত ধরে স্কুলে গিয়েছিল, আজ সেই নাতনীকে তিনি দূরে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
“তোমাকে শক্ত হতে হবে,ফিওনা।এটা আমাদের দুজনের জন্যই কঠিন,কিন্তু তোমার নিজের জন্য এটা সবচেয়ে জরুরি।”
দুজনেই দীর্ঘক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল।
বিকেলের দিকে ফিওনা তার কিছু দরকারি জিনিস গোছাতে শুরু করল।মিস ঝাং কেঁদে ফেললেন যখন শুনলেন ফিওনার ভেনাসে যাওয়ার কথা।
“তুমি নিজেকে সামলাও,মিস ঝাং,” চেন শিং বললেন। “ফিওনা ঠিক থাকবে।ওর নতুন জীবনের দরজা খুলে গেছে।”
সন্ধ্যায়,চেন শিং তার ল্যাবের গোপন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভেনাসে যাওয়ার পথের ম্যাপ তৈরি করলেন।আর একটা প্রযুক্তি ব্যাবহার করে পথের নির্দেশনা তৈরি করলেন।
রাতের আকাশে একটি উজ্জ্বল আলো দেখা দিল।
“যাও,ফিওনা,” তিনি বললেন। “এই আলো তোমাকে তোমার গন্তব্যে নিয়ে যাবে।” ফিওনা একবার পেছন ফিরে তাকাল।তার গ্ৰান্ডপা,মিস ঝাং—তার এই পৃথিবী।
“আমি আবার ফিরে আসব গ্ৰান্ডপা,” সে বলল,আর তার কণ্ঠে ছিলো এক অদম্য দৃঢ়তা।
চেন শিং মৃদু হাসলেন। “আমি জানি। তোমার জন্য আমরা অপেক্ষা করব ফিওনা।”
ফিওনা সেই আলোর পথে উড়াল দিলো।তার গলা ভারী হলেও মন থেকে এক শক্তি জেগে উঠছিল।এই বিদায় ছিলো তার যাত্রার শুরু।
ফিওনা চলে যাওয়ার পর বাড়ির পরিবেশটা যেনো আরও ভারী হয়ে গেলো।এক অদ্ভুত নীরবতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল,যেনো সময়টা থমকে গেছে।মিস ঝাং চুপচাপ বসে আছেন।চেন শিং তার ল্যাবের দিকে চলে গেছেন,যেখানে তিনি ফিওনার স্মৃতির প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রেখেছেন।
কিন্তু অন্যদিকে বাড়ির এক কোণে,লিউ ঝান নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।
তার মাথায় যেন বজ্রপাত ঘটে গেছে।ফিওনার ড্রাগন হয়ে যাওয়া,তার ভেনাসে ফিরে যাওয়া—এই সবকিছু একসঙ্গে শুনে লিউ ঝানের হৃদয়টা যেনো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
সে নিজের বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল।চোখের পাতা ভারী, কিন্তু চোখের জল আটকাতে পারল না।তার হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
“কীভাবে এটা সম্ভব?কীভাবে ফিওনা…ও তো আমার ফিওনা!মানুষ হোক আর ড্রাগন,আমি তো ওকে ভালোবাসি…”
সে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল,কিন্তু ভালোবাসার যন্ত্রণা তাকে ঘিরে ধরছিল।বিয়ের স্বপ্নগুলো যেন এক মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
লিউ ঝান মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। “তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না,ফিওনা।আমি জানি,তুমি ড্রাগন—কিন্তু তাতে কী আসে যায়?আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।তোমার শক্তি,তোমার রূপ—এসব কিছুই আমার কাছে কোনো বিষয় নয়।তুমি যেই হও না কেন,আমি শুধু তোমাকেই চাই।”
তার কণ্ঠ ক্রমে আরও দৃঢ় হয়ে উঠল।সে নিজের চোখ মুছে নিল এবং চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল।
“যদি ফিওনা আবার ফিরে আসে…”লিউ ঝানের চোখে একধরনের অদ্ভুত জ্বলন্ত প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠল। “যদি সে পৃথিবীতে আবার আসে,আমি তাকে বিয়ে করব।ও মানুষ হোক আর ড্রাগন,তাতে আমার কিছু যায় আসে না।আমি তাকে ভালোবাসি,এবং আমি তাকে হারাব না।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১
তার চোখে এখন আর জল নেই,কিন্তু হৃদয়ের গভীর দহন তাকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছে।সে জানে,এই ভালোবাসা শুধু তার একার নয়;এই ভালোবাসার মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি আছে,যা কোনো প্রকার বাধাকে মানবে না।
লিউ ঝান এবার ফিওনার জন্য অপেক্ষার প্রতিজ্ঞা করল।সে জানে,হয়তো এই অপেক্ষা সহজ হবে না,কিন্তু ফিওনা তার জীবনের কেন্দ্রে ছিল এবং সবসময় থাকবে।