Tell me who I am part 6
আয়সা ইসলাম মনি
কারান মিরার হাত ধরে ধীরপায়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
ফরিদকে সম্বোধন করে কারান বলল, “কাকা, ওদেরকে নিয়ে এসো।”
“জি স্যার, আনছি।”
কিছুক্ষণ পর ফরিদ কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে হাজির হলো।
কারান মিরার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হাসি দিয়ে বলল, “আজ থেকে ওরা সব কাজ করবে। আর আপনি শুধু হুকুম করবেন, বেগম সাহেবা।”
মিরা একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়ে বলল, “কিন্তু…”
কারান কথা কেটে বলল, “ওয়েট, আগে শোনো। তারপর তুমি বলবে।”
কারান আঙুল দিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করল।
“ও হচ্ছে রিধিতা, তোমার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। যখন যা প্রয়োজন হবে, মুহূর্তেই এনে দিবে।”
রিধিতা হাসিমুখে বলে উঠল, “হাই ম্যাম।”
“ও এ্যানা, তোমার ইয়োগা ট্রেইনার। তোমার শরীর ও মনের যত্নে ও সাহায্য করবে।”
এ্যানা বিনয়ের সাথে বলল, “হ্যালো মিস।”
মিরা বিস্মিত হয়ে কপাল কুঁচকে নিল।
কারান পুনরায় বলল, “ইনি মিসেস আঞ্জুমান খান, একজন ফেমাস শেফ। আজ থেকে রান্নাবান্নার যাবতীয় দায়িত্ব ওনার হাতে। গার্ডেনের জন্য আলাদা গার্ডেনার রেখেছি। আর ইনি নীলা, তোমার ফ্যাশন আর্টিস্ট। আর..”
মিরা বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “থামুন কারান। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই সবকিছু সামলে নিতে পারি।”
কারান শান্ত স্বরে বলল, “শোনো মিরা। আমি চাই না তোমার ওপর কোনো ধরনের চাপ আসুক। ওরা এখানে থাকবে যেন তুমি একটু নিশ্চিন্তে, শান্তিতে থাকতে পারো। আর আমি তো সবসময় তোমার পাশে আছিই।”
মিরা অবিশ্বাসের অতলে হারিয়ে এক দৃষ্টিতে কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অর্থাৎ হৃদয়ে বিষাক্ত বর্শা বিঁধিয়ে, এখন সযত্নে সেই ক্ষত মেরামতের নিষ্ফল চেষ্টা চলছে।
একটু পর মিরা চোখে-মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ রেখে সবার পানে তাকিয়ে বলল, “You’re all free to leave now, and I apologize for taking up your time by calling you here.”
কথা শেষ করে মিরা দ্রুত উপরে চলে গেল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কারান কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বলল, “ওকে, আআ…থ্যাংক ইউ ফর ইয়োর টাইম; ইউ মে টেইক ইয়োর লিভ ফর নাও। আই উইল রিচ আউট ইফ এভার ইয়োর অ্যাসিস্টেন্স ইজ নিডেড।”
“ওকে স্যার, আসসালামু আলাইকুম,” বলে তারা সবাই বিদায় নিল।
কিছুক্ষণ পর কারান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ফরিদ কাকা, আমি বাজারের লিস্ট করে রেখেছি। তুমি গিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে এসো।”
“জি স্যার, যাচ্ছি।”
“হুম।”
ক্ষণকাল পর কারান আচ্ছন্ন মুখ নিয়ে উপরে উঠে গেল। দরজার কাছে এসে থেমে গেল। তার সামনে মিরা পালঙ্কে স্থির বসে আছে, পায়ের আঙুলগুলো মেঝেতে স্থিরভাবে রাখা। ঘরের নিস্তব্ধতা মিরার নিঃশব্দ বেদনাকে আরো প্রকট করে তুলেছে।
কারান কিছুক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, গলার কাছে আটকে থাকা ঢোক গিলে হালকা গলায় বলল, “মিরা…”
মিরা হঠাৎ কারানের উপস্থিতি টের পেয়ে একটু নড়ে বসল। তার চোখে গভীর শূন্যতা ফুটে উঠলো। তার মন তো বহুদিন আগেই মরে গেছে, কেবল দেহটুকু চঞ্চল।
নেত্রপল্লব মেঝের পানে নিবদ্ধ রেখেই মিরা ভারী কণ্ঠে জবাব দিল, “হুম।”
কারান ধীরে ধীরে মিরার কাছে এসে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তারপর মিরার ডান হাতটা দুই হাতের মাঝে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। কারান কিছু একটা বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারছে না।
মিরা কারানের দিকে অস্বস্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিন্তু কারান অনুভব করল সেই নিঃশব্দ বেদনার গভীরতা। মিরার হাতটা ধরে থাকা অবস্থায়, তার চোখ দু’টি মিরার চোখে আটকে গেল।
কারান দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল, “আই…”
তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। একটু সময় নিয়ে আবার অস্থির কণ্ঠে বলল, “আ’ম… আ’ম সরি, মিরা। ক্ষমা করে দাও।”
কথাগুলো যেন কারানের ভেতর থেকে উঠে আসা গভীর আকুতি। একটু থেমে আবার ফিসফিসিয়ে যোগ করল, “প্লিজ।”
মিরার ঠোঁটের কোণে অবহেলাময় হাসি ফুটে উঠল। অর্থাৎ সেই হাসির মধ্যে সবকিছু বলা হয়ে গেছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে মৃদুস্বরে বলল, “কীসের জন্য ক্ষমা চাচ্ছেন?”
কারান একটু বিচলিত হয়ে বলল, “তুমি তোমার মতো করে যা ভাবতে চাও, তাই ভেবে নাও।”
এই কথাটা শুনে মিরা কারানের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করল, “একটা কথা বলবেন?”
কারান উদ্বিগ্নভাবে জবাব দিল, “বলো মিরা, বলো কী জানতে চাও?”
মিরা কণ্ঠে তীক্ষ্ণ তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলল, “নেশার ঘোরে কি আমি আছি, নাকি আপনি? নাকি আমি এখনো ঘুম থেকে জেগে উঠিনি?”
মিরার কথার শ্লেষে কারান থমকে গেল। অর্থাৎ প্রশ্নগুলো একসাথে তার ভেতরটা ভারী করে তুলছে, আর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কারান নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে।
কারান খানিক পরে কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে, তাই না?”
মিরা নির্বিকার গলায় জবাব দিল, “নাহ, একটাই প্রশ্ন। আল্লাহ কি আমার যন্ত্রণা দেখে এক রাতের মধ্যে আপনাকে পরিবর্তন করে দিলেন?”
কারান ঠোঁটের কোণে মসৃণ হাসি এনে আওড়াল, “আমিই… আচ্ছা, আমি তোমাকে বলি সবকিছু।”
মিরার চোখে উত্তেজনা ও অশান্তির মিশ্রণ ফুটে উঠলো। সে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “বলুন, সত্যিই বলুন। আমি শুনতে চাই।”
কারান নিজের বুড়ো আঙুল মুখে নিয়ে দাঁতের সহিত নখ কাটতে শুরু করলো। নখ কেটে মুহূর্তের মধ্যে সে নতুন একটা গল্প বুনতে শুরু করল। গল্পটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে লাগল, আর সেই গল্পের প্রধান চরিত্রে মিরাই ছিল। এরপর কারান নিজের কল্পনার জালে মিরাকে টেনে নিতে চাইল।
কারান কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমি… আসলে কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। (একটু থেমে) স্বপ্নে দেখলাম, আমি তোমার সাথে অসহ্য অন্যায় করছি। তুমি যন্ত্রণায় পীড়িত হয়ে কাতরাচ্ছো মিরা। তোমার চোখের গভীরতা থেকে বিচ্ছুরিত অশ্রু আমার আত্মায় ক্ষত তৈরি করছে। হঠাৎ তুমি আমাকে অভিশাপ দাও। আর সেই অভিশাপের ফলস্বরূপ, আমি একটা অদ্ভুত শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছি। কেউ চতুর্দিকে ঘিরে ধরেছে আমাকে, তাদের দৃষ্টি আমার প্রতি ঘৃণায় ভরা। তারা নৃশংসভাবে আমার শরীরকে ক্ষত করছে, আমি অনুভব করছি আঘাতের প্রতিটি মুহূর্ত। আর ছুরির আঘাত সরাসরি আমার অন্তরে ঢুকছে। আমি চিৎকার করছি, কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কান্না, আর ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার সমস্ত অস্তিত্ব সেই অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যেখানে কোন উদ্ধার নেই, শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। এরপর হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যায়। আর ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারি, আমি ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি এতদিন। স্বপ্নটা খুবই ভয়ংকর ছিল, কিন্তু আমি তোমাকে শর্টকাটে বললাম।”
কারানের কথাগুলো শুনে মিরা ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ফুটিয়ে মনে মনে আওড়াল, “আমি শুধু দেখবো, এই নাটক আপনি কতদিন চালাতে পারেন। না, আমি এখন কিচ্ছু বলবো না। যেভাবে আপনি আমার ভালোবাসাকে টুকরো টুকরো করে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন, আমিও সেভাবেই আপনার হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসার মায়াজাল বিছিয়ে দেব।”
একটি পরিকল্পনা মনে করে সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল।
“একদিন আপনার সামনে তুলে ধরবো সমস্ত স্মৃতির আয়না, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত আপনার হৃদয়কে আঘাত করবে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো। তখন বুঝবেন, প্রিয়জনের হাত থেকে পাওয়া আঘাতের বিষ কতটা গভীরে প্রবেশ করে, কতটা নিঃশব্দে হৃদয়কে রক্তাক্ত করে। এখন থেকে আমি আপনার প্রতি একজন সাধারণ স্ত্রীর মতোই ব্যবহার করবো। অভিমানের স্তরগুলো হৃদয়ে জমে থাকলেও, আমার চেহারায় রাগের কোনো ছায়া পড়বে না। (থেমে) আসুন, আপনার এই অভিনয়ের পরিসরটুকু আরেকটু এগিয়ে নিতে আমিও সামান্য সাহায্য করি।”
অর্থাৎ মিরা বুঝতে পারছিল, নিজের মনকে শক্ত রাখতে হবে, এই মিথ্যে অভিনয়ের জালে পুরোনো সবকিছু ভুলে গেলে চলবে না।
মিরা সন্দিহান দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “স্বপ্নটা কি এতই ভীতিকর ছিল যে আপনাকে অমানুষ থেকে মানুষে রূপান্তরিত করেছে?”
কারান এক পলক চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। কিন্তু মিরার কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপ করে না। অর্থাৎ যে মানুষটির সামনে স্বয়ং তার জন্মদাতা পিতাও গলা উঁচিয়ে পালটা জবাব দিতে পারেন না, আজ সেই মানুষটিকে কিনা একটি মেয়ে এমনভাবে অবমাননা করলো!
কারান কথার বেগ ঠিক রাখার চেষ্টা করে শব্দে জোর খাটিয়ে বলল, “অনেক ভয়ংকর ছিল। জানো, আর একটু হলে তো আমি মারাই যেতাম।”
মিরা তার কথায় কিছুটা বিচলিত হয়ে গেল। হঠাৎ তার হাত কারানের ঠোঁটে রেখে বলল, “এমন কথা কি কেউ বলে?”
মিরার স্পর্শে কারানের মনে স্নিগ্ধ অনুভূতি জাগে। তাদের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা হলো, যেখানে ভালোবাসা এবং বিদ্বেষ উভয়ই বর্তমান।
কারান মিরার চিন্তিত মুখশ্রী দেখে মনে মনে খুশি হলো। ঠোঁটে মিরার আঙ্গুলগুলো, কারানের ইচ্ছে তো করে আলতো করে একটা চুমু দিতে কিন্তু এখন সেই সময় নয়। সে মিরার দিকে অদৃষ্টের মতো তাকিয়ে থাকে।
কারানের এমন গভীর দৃষ্টি অবলোকন করে কিছুক্ষণ পরে অগত্যা, মিরা কারানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে একটু ইতস্তত বোধ করে।
সে সামনের কিছু চুল কানের পাশে গুঁজে নিয়ে বলল, “সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনার কাল রাতের অদ্ভুত কথাগুলোর মানে বুঝিনি।”
কারান সামান্য ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারোনি?”
তার কথায় একটা সূক্ষ্ম আভাস ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ সে বলতে চাইছে; সে যে মিরার নান্দনিক চেহারা দেখে আকর্ষিত হয়েছে, তা কি মিরা বুঝতে পারেনি।
মিরা শান্ত গলায় বলল, “বিশ্বাস করুন, আপনার কথাগুলো শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল আপনি নেশায় জর্জরিত। কিন্তু কাছে গিয়ে বুঝলাম, মদের গন্ধ নেই। তাহলে কেন ঐভাবে… আসলে কি হয়েছিল আপনার?”
নেশার কথা শুনে কারান নতুন বুদ্ধি আঁটে। সে চায়, মিরা যেন বুঝতে না পারে যে সে তার রূপে বিভোর হয়ে ঐসব বলেছে।
তাই স্বাভাবিক গলায় বলল, “আসলে কালকেও আমি অ্যালকোহল নিয়েছিলাম। কিন্তু পরিমাণে অল্প। বাসায় এসে প্রথমবার বউয়ের মুখ দেখে নেশায় কি বলেছি, আমি নিজেও জানি না,” বলেই চোখে-মুখে একবার হাত বুলিয়ে নেয়।
বলা বাহুল্য, এভাবে সজ্ঞানে মিথ্যে বলেছে বলে তার চোখে-মুখে অস্থিতিশীলতার ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মিরা মনে মনে আওড়ায়, “হুম, সেটাই। অবশ্যই আপনি নেশায় ছিলেন। নাহলে ঐ কথাগুলো অন্তত কারান চৌধুরি বলতে পারে না।”
কারান আত্মবিশ্বাসের সহিত বলল, “এসব এখন বাদ দেই। আগে বলো, তুমি তো আমাকে ক্ষমা করেছ, রাইট?”
কথাটা শুনে মিরার চোখের কোণে স্বল্প সংবেদ্য পানি জমে। সে নিজেকে সংবরণ করে বলে, “না করিনি। না আপনাকে ক্ষমা করতে পেরেছি, না আপনার হঠাৎ এই বিশাল পরিবর্তন মেনে নিতে পারছি। এখন আপনার কথার নেগেটিভ জবাব দিয়েছি বলে আপনি যদি আমার গায়ে হাত তুলতে চান, তো তুল…”
মিরার কথায় কারান বাধা দিয়ে বলে, “না মিরা। আর কখনো না। আমি স্বপ্নের মতো বাস্তবে অমন শাস্তি পেতে চাই না। তোমার গায়ে একটা ফুলের টোকাও পরতে দিব না।”
কারান মনে মনে আওড়ায়,
“যদি পৃথিবীও বিলীন হয়ে যায়, তবুও আমি তোমার সৌন্দর্যে একটুকু দাগও পড়তে দেব না মিরা। তুমি জানো না, তুমি আমার হৃদয়ের অমূল্য রত্ন, তোমার মাধুর্যে সারা বিশ্বও হেরে যাবে।”
আবার আকুতিভরে সে বলে, “মিরা, প্লিজ। আমি মনের গভীর অন্তঃস্থল থেকে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল বলো। অলসো, আমি তো তোমার স্বামী। আর তুমি চাও তো আমাকে শাস্তি দিতে পারো।”
শেষ কথাটা শুনে মিরা চোখ নামিয়ে ভারী গলায় বলে, “হ্যাঁ, এইটাই সবসময় মনে রাখি যে আপনি আমার স্বামী। তাছাড়া শাস্তি তো তাকে দেওয়া যায় যাকে ভালোবাসা বা ঘৃণা করা যায়। কিন্তু আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই,” বলেই বিছানা থেকে উঠে কারানের পাশ থেকে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
প্রথম বাক্যের ভাবার্থ এমন যে, এতদিন সবকিছু সহ্য করার কারণ একটাই; কারান তার স্বামী।
কারান মেঝে থেকে উঠে বিছানায় বসে দেয়ালে ঝুলানো সমুদ্রের একটি ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে অনাদর মুখে বলে, “কী করলে তোমার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারি মিরা? তোমার নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ চোখের গভীরে আমার অস্থিরতার অগ্নিশিখা জ্বলে উঠছে। কেন জানি না, আমার ভীষণ ভয় করছে, হয়ত অনুশোচনার ফল।”
হাওলাদার বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে এক ছটফটে স্বভাবের কণ্ঠস্বর। লোকটি আর কেউ নয় বরং তিনি মমতাজ বেগমের প্রিয় অনুজ কন্যা; ইলিজা আহসান মাহিমা। তার উচ্ছলতা চারপাশের নিস্তব্ধতাকেও জাগিয়ে তোলে।
নিভৃতে পায়চারি করতে করতে হাত পা ছুড়ে তেজোময় কণ্ঠে শুধায়, “আর পারবো না। অনেক সহ্য করেছি।”
মমতাজ মেয়ের পায়চারি দেখে স্থির কণ্ঠে বলে, “তুই আগে একটু শান্ত হ, তারপর কথা বল।”
মাহিমা তবু ক্ষান্ত হয় না। ফুলে ওঠা বেলুনের মতো আবেগে টইটুম্বুর হয়ে বলে, “মা, এবার তো আমি জেএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। এখন অন্তত মিরু আপুকে দেখতে যেতে পারি, আবার পড়া নিয়ে আমাকে আটকে রেখো না যেন! তুমি নিজেই তো বলেছিলে, এ প্লাস পেলেই যাবো।”
মমতাজ হেসে মেয়ের শরীর ছুঁয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলেন, “তুই এত উতলা হোস না, যাবো তো একদিন।”
“হ্যাঁ, যাবো যাবো বলে বছরটা কাটিয়ে দিলে। ভিডিও কলে কথা বলে আর ভালো লাগে না। কবে যে আপুকে সামনাসামনি দেখবো! ধুর ধুর!”
মমতাজ অভয় দিয়ে বলে, “আচ্ছা তুই আগে খেয়ে নে। আমি মিরুর সাথে কথা বলবো।”
এ কথা শুনে মাহিমা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে বলে, “ইয়াহু!”
মায়ের মুখে মিরার কথা শুনে মন শান্ত করে খাবার ঘরে চলে যায়।
অন্যদিকে, বাহির থেকে ঘরে ঢুকে আব্দুর রহমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শুধায়, “কী গো, আমার মা ফোন করেছিল?”
“হ্যাঁ, দুই-তিন দিন পরপরই তো কথা হয়। সুখে আছে আমার মেয়েটা, এটা শুনলেই বুকটা একটু শান্ত হয়। আর কি চাইবো বলো?”
আব্দুর রহমান স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলেন। মেয়ে যে সুখে আছে, এটুকু শোনার আশ্বাসেই তাদের কষ্ট কিছুটা প্রশমিত হয়। তবুও বুকের গহীনে একটা চাপা যন্ত্রণা রয়েই যায়। কতদিন হলো মেয়ের সাথে অবলোকন হয়নি। এ বেদনা জেগে থাকে কলিজায় দগদগে দাগ হয়ে অথচ মেয়ে সুখে আছে; এটুকুই তাদের ভাঙাচোরা মনটাকে সান্ত্বনার জলে ভিজিয়ে রাখে।
বিছানায় অনেকক্ষণ একা বসে কারান মনের গভীরে ডুবে আছে। হঠাৎ খেয়াল হলো; মিরা কোথায়? মনে প্রশ্ন জাগতেই নিচে নেমে এলো। চঞ্চল চোখে এদিক-সেদিক তাকে খুঁজতে লাগল।
বাড়ির প্রতিটি কোনা তন্নতন্ন করে খুঁজে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কারান বলে ওঠে, “এইরে, কোথায় গেল আমার বউটা?”
অবশেষে বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে দেখল, মিরা বাগানের ফুলগাছে নিবিড় যত্নে পানি দিচ্ছে। মুহূর্তেই তার ক্লান্ত হৃদয়, মনকাড়া বনলতাকে খুঁজে পেয়ে প্রশান্তিতে ভরে উঠল।
সে কিঞ্চিৎ হাসি নিয়ে মিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে থুতনিতে হাত রেখে অপলক চেয়ে থাকে।
মনে মনে এক অপার্থিব সৌন্দর্য অনুভব করে বলে উঠল,
“তুমি একটি জীবন্ত ফুল মিরা। তোমার ছোঁয়ায় হৃদয় শীতল পরশে ভরে ওঠে।”
মিরা গাছগুলোতে পানি দিতে দিতে হঠাৎ কারানকে দেখতে পেয়ে কৌতূহলী গলায় বলে, “সিইও সাহেব হঠাৎ বাগানে কি করছেন?”
কারান চোখে এক চপল হাসির ঝিলিক এনে বলে, “দেখতে এসেছি ফুল কীভাবে আরেক ফুলকে পানির জোয়ারে ভাসাচ্ছে।”
মিরা ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি এনে তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, সূক্ষ্ম কণ্ঠে বলে, “কেউ যদি বলত, পাথরের বুকে পদ্মফুল ফুটেছে, আমি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতাম না। বিজ্ঞানের জগতে কত কিছুই তো আজকাল সম্ভব! তবে এই রূপান্তরিত কারান চৌধুরিকে দেখে, বিশ্বাসের গভীরতম ভিত্তি অবধি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।”
কারান কিছু বলার জন্য মুখ খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই মিরা বলে উঠল, “আজ গাছগুলো বড্ড অভিমান করেছে। এত দেরিতে পানি দিতে এসেছি যে ওদের নির্বাক পাতাগুলোও নীরব অভিযোগে ভরে উঠেছে। মুখে কিছু বলার সাধ্য নেই ওদের, তবুও প্রতিটি ডালপালায় দুঃখের ভার স্পষ্ট ফুটে আছে।”
মিরার কথাগুলোর অর্থ অনেক গভীর। এক তীক্ষ্ণ বেদনাবোধ ছুঁয়ে যায় কারানের হৃদয়কে। গাছের তৃষ্ণার মাঝে মিরা নিজেরই অসীম ব্যথাকে কল্পনা করে এসেছে এতদিন। বাহিরের ক্ষত তো প্রকাশ করা যায়, কিন্তু মনের গভীর ক্ষত!
তাই কারান দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আর কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ চলে যায়। বুঝে নেয়, মিরার মনের বেদনাময় আবরণ এত সহজে সে ভেদ করতে পারবে না।
মধ্যাহ্নে খাবার বানানোর তোড়জোড়ে মিরা সবজিগুলো ধুতে ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় কারান এসে অবিলম্বে তার হাত থেকে টমেটোগুলো নিয়ে নিল।
মিরা চমকে উঠে তাকিয়ে বলে ওঠে, “কি করছেন কি আপনি? এমনভাবে টান দিয়ে নিলেন, যেন আপনার খুব প্রিয় জিনিস চুরি করেছি।”
কারান একটুখানি হাসির আভায় বলে, “চুরি তো করেছোই। বরং অনেক বড় একটা জিনিস চুরি করেছো।”
অর্থাৎ কারান চৌধুরির হৃদয়খানাই মিরা চুরি করেছে।
কারান পুনরায় বলে, “অবশ্য টমেটো আমার ফেবারিট।”
মিরা একটু রাগ মেশানো সুরে বলে, “তাই বলে এভাবে ছিনিয়ে নিতে হবে? টমেটোর কি অভাব পড়েছিল?”
কারান হেসে উত্তর দেয়, “অভাব পড়েনি। তবে লাঞ্চের বন্দোবস্ত তো কারান চৌধুরি করবে। তাই বেগম সাহেবা, দয়া করে একটু দূরে সরে দাঁড়ান।”
মিরা মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে শান্তভাব ধরে রেখে বলে, “কি শুরু করেছেন বলুন তো! একে তো ব্রেকফাস্ট বানালেন, আর এখন আবার…?”
কারান ঈষৎ হাসিতে বলে, “তো কি হয়েছে? আমেরিকা থেকে আসার পর তো কিচেনে আসা হয়নি। এখন একটু হাতটা চালু করা দরকার।”
“বুঝলাম। তার মানে আমেরিকায় আপনি নিজেই রান্না করতেন?”
“শুধু রান্না কেন, সব কাজই আমাকে করতে হতো। ওখানে সবাই নিজে নিজেই সব সামলায়।”
“হুমম। কিন্তু রান্নার পুরো দায়িত্ব নিচ্ছেন যখন, এতক্ষণ আমি কী করবো শুনি?”
কারান মিরার মুখের কাছে এসে খানিক মাথা ঝুঁকিয়ে স্বচ্ছ হেসে বলে, “ততক্ষণ আপনি আপনার হ্যান্ডসাম স্বামীকে দেখবেন।”
মিরা ভ্রুকুটি করে বলে, “আপনি নিজেকে একটু বেশিই মনে করেন। আসলে আপনি মোটেও অতটা সুন্দর নন।”
বউয়ের এমন তিরস্কার শুনে কারান হতচকিত হয়ে বলে, “আহ, এই ফার্স্ট টাইম, ফার্স্ট টাইম কোনো মেয়ে আমাকে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করলো! মানে সিরিয়াসলি?”
মিরা ঠোঁটে বাঁকা হাসি এনে বলে, “নয় তো কি! তবে আমি তো তখন থেকে একটা কথাই ভাবছি; মনুষ্যত্বহীন মানুষের মনে প্রেমের উদয় হলো কীভাবে? একটা স্বপ্নের এত ক্ষমতা?”
কারান মিরার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। এভাবেও কেউ অবজ্ঞা করতে পারে? নিজের ভেতর অপমানের অনুভূতি আবারও ঘনীভূত হয়। কিন্তু এ অপমানের জবাব দেওয়া নিরর্থক।
কারান ব্যথিত চেহারায় বলে, “আচ্ছা। বউদের দেওয়া প্রথম নিক নেইম অমানুষ, দ্বিতীয় মনুষ্যত্বহীন।”
থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলে, “ঠিকাছে। আপনি তাহলে বসে মুভি দেখুন বা যা খুশি মন চায় করুন। আমাকে দেখতে হবে না।”
“জি”
মনে মনে কারান বলে, “বিনা অস্ত্রে আমাকে পরাজিত করতে আপনার প্রতিটি তীক্ষ্ণ বাক্যই যথেষ্ট মহারানি ভিক্টোরিয়া। আপনার শব্দগুলো একেকটি তলোয়ারের মতো; মায়াবী অথচ নিঃশব্দে হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত হানে।”
অতঃপর অসহায় বিষণ্ন মুখ নিয়ে রান্না করতে চলে গেল।
অপরাহ্ণে বারান্দায় মিসেস মিরা আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে সন্তর্পণে শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ উপন্যাসটি পড়ছে।
কারান সঙ্গোপনে মিরার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, “আমাকে একটু পড়ে দেখো তো।”
মিরা ঘাড় ঘুরিয়ে নয়নগোচর করে বলে, “আবার শুরু হয়ে গেছে?”
কারান হেসে বলে, “ওপস! আচ্ছা আমাকে না হয় পরে পড়ে নিও। আচ্ছা মিরা তুমি সব সময় শাড়ি পড়ে থাকো কেন? না মানে আমি কিন্তু এমনটা বলতে চাইনি যে শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগে না। তোমাকে শাড়িতে ফ্যাব্যুলাস, ইনক্রেডিবল, আনবিলিভেবল, আউটস্ট্যান্ডিং সব লাগে সব। বাট মাই ডিজায়ার ইজ ফর ইউ টু কনস্ট্যান্টলি ফিল এ সেন্স অফ ইজ অ্যান্ড কমফোর্ট।”
মিরা বইয়ের পানে মুখ রেখে সরল গলায় বলে, “নাহ, শাড়িতে আমার সমস্যা হয় না। যদিও থ্রি পিসটা বেশি কমফোর্টেবল লাগে কিন্তু শাড়ি পড়তে আমার ভালো লাগে।”
“তুমি চাইলে কিছু না পড়েও থাকতে পারো, ঘরে তো শুধু আমিই।”
মিরা রসগোল্লার মতো চোখ করে কড়াভাবে কারানের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিহ?”
কারান দাঁতে জিভ কেটে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড় করে, “একটু বেশিই বলে ফেললাম। (আওয়াজ তুলে) আ.. আরেহ আমি.. আরকি বলতে চাইছি তুমি চাইলে অন্য কিছুও পড়তে পারো। মেয়েদের ড্রেসের তো অভাব নেই বলো?”
মিরা গোমড়া মুখে কারানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
কারান প্রশ্ন করে, “তোমাকে একটা কোশ্চেন করতে পারি?”
“করুন।”
“তুমি যে সবসময় ঘোমটা দিয়ে রাখতে, এটা কি কখনো তোমার বিরক্তির কারণ হয়েছে?”
“না।”
কারান অবাকের সাথে বলে, “না? কী বলছো?”
“আমার অভ্যাস আছে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে সবসময় মুখ ঢেকে যেতাম।”
কারান একটু বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করে,
“মুখ ঢেকে যেতে মানে?”
মিরা কিঞ্চিৎ পরিমাণে হেসে জবাব দেয়, “আমার নিতান্ত কোমল হৃদয়ের জননীর আদেশ ছিল, কাউকে মুখ না দেখানোর। আমি সবসময়ই ভদ্র সহজসরল বাচ্চা ছিলাম তো, তাই মায়ের কথা অমান্য করার সাধ্য আমার ছিল না। আবার আমিও কিছুটা ইনট্রোভার্ট টাইপের, তাই মানুষের সাথে খুব বেশি মেলামেশাটাও পছন্দ ছিল না।”
“আচ্ছা আচ্ছা। তার মানে তোমার মুখ কেউ দেখেনি?”
“দেখেছে তো। আপনি আর আপনার পরিবার। এর বাহিরে আর কারোর দেখার সুযোগ হয়ে উঠেনি।”
কারান এক ঝলক হেসে শয়তানি একটা ভাব নিয়ে মনে মনে বলে, “তুমি শুধু আমার মিরা, শুধুই আমার। পৃথিবীর আর কোনো দৃষ্টির অধিকার নেই তোমার অবিনাশী রূপের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার।”
এরপর মিরার দিকে একটু তাকিয়ে স্মিতহাস্যে প্রস্থান করে।
মিরা বই বন্ধ করে বলে, “ওকে আমি যতবারই দেখি ততবারই নতুন মনে হয়।”
সুদীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলে, “হৃদয়ের দাগ এত সহজে মুছে যাবে না কারান। আপনি যতই চেষ্টা করুন, তা কেবল ব্যর্থ হবে।”
রাতে মিরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াতে থাকে। তার অস্তিত্বে চাঁদের নরম আলো ঢেকে রাখা প্রতিটি অংশে অপরূপ দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়। কারান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিরাকে দেখতে থাকে। তার চোখ মিরার প্রতিটি নড়াচড়ায়, প্রতিটি সূক্ষ্ম অঙ্গভঙ্গিতে আঁকড়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে, পরে মিরার সন্নিকটে গিয়ে চিরুনিটা তার হাত থেকে নিয়ে মিরার চুল আঁচড়াতে শুরু করে।
মিরা কিছুটা অবাক হয়ে পিছনে ফিরতে চাইলে, কারান শীতল সংকোচহীন কণ্ঠে বলে, “পিছনে ফিরো না। আমি আঁচড়ে দিচ্ছি।”
মিরা আর পিছনে ফিরে না বরং তার বদলে কারানের স্পর্শে নিজেকে সমর্পণ করে। প্রতিটি আলতো আঁচড় অদৃশ্য সুরে গুঞ্জরিত হতে থাকে তার মনের গভীরে।
অকস্মাৎ চিরুনির মধ্যে দুটি চুল দেখে, কারান কিছুটা হতভম্ব হয়ে চিরুনিটা চেপে ধরে।
পরে কারান বিস্তর রেগে কপাল কুঁচকে মিরার চুলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তুমি চুলে কি শ্যাম্পু ইউজ করো?”
মিরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন? কি হয়েছে?”
কারান অস্থির হয়ে, চোখে ক্ষোভ নিয়ে বলে, “দুইটা চুল ছিঁড়ে গেছে!”
মিরা কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে বলে, “মাত্র দুইটা? আমি যখন আঁচড়াই, মিনিমাম পঞ্চাশটা চুল পরে!”
কারান ভ্রূকুঞ্চন করে, মুখে খুঁতখুঁতে গম্ভীরতা এনে বলে,
“কি? এটা কি ধরনের কথা? চুল কেন পরবে? দেখো মিরা, আমি কিন্তু একদম টেকো বউ সহ্য করতে পারবো না। স্টার্টিং টুমরো, ইউ’ল ইউজ দ্য ফাইনেস্ট অয়েল অ্যান্ড শ্যাম্পু। ইফ নেসেসারি, আই’ল গেট ইট কাস্টমাইজড জাস্ট ফর ইউ।”
তার কথা বলার ধরনে মিরা একটু অবাক হয়।
এরপর মিরা হেসে রাশভারী কণ্ঠে বলে, “আপনি পাগল হয়ে গেছেন। আমি যতই ভালো শ্যাম্পু আর তেলই দেই না কেন, চুল পড়বেই। এটাই তো স্বাভাবিক।”
কারান পিছন থেকে মৃদুস্বরে বলে, “তাই?”
মিরা ঈষৎ কপাল কুঁচকে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “হুম, তাই।”
কারান সম্মোহনী গলায় বলে, “তাই?”
“হ্যাঁ, আবার কি?”
মিরা আয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে কারান আস্তে করে মিরার এলো চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। নেত্রপল্লব বুঝিয়ে তার রেশমি কালো চুলের ঘ্রাণ নিতে থাকে।
মিরা আচমকা অজানা অনুভূতি অনুভব করে, কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলে, “কি… কি… কি করছেন আপনি?”
কারান চোখ বন্ধ করে ঈষৎ হাসি দিয়ে বলে, “তোমার চুলের ঘ্রাণ… উফফফ…”
এবার মিরা লজ্জা পেয়ে বলে, “ঐটা শ্যাম্পুর ঘ্রাণ, তাই এতো উন্মাদ হতে হবে না।”
কারান চোখ খুলে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “হোক শ্যাম্পুরই ঘ্রাণ, তবে ঐ চুলের ঘ্রাণ আমি আবারও নিতে চাই।”
মিরা তড়িঘড়ি করে কথাটা চাপা দিয়ে বলে, “ঘুম পেয়েছে। আমি গেলাম ঘুমাতে,” বলে দরজা থেকে বেরিয়ে যাবে, তখনই কারান দরজার সামনে এসে মিরার পথ আটকে দাঁড়ালো। যাওয়ার ফাঁকে মিরার ছেড়া চুল দুটো নিজের বুক পকেটে রেখে দিল।
কারান জোর খাটিয়ে বলে,”না যাবে না।”
“কি? আমি কি ঘুমোবো না নাকি?”
“হ্যাঁ মানে, তুমি আজ থেকে এই রুমে ঘুমাবে।”
“দেখুন, আমি মোটেও সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো সোফায় ঘুমাতে পারবো না।”
“বেড থাকতে সোফায় ঘুমাতে যাবে কেন?”
কারানের কথা মিরার বোধগম্য হলো না। বিস্মিত কণ্ঠে সে শুধালো, “বুঝিনি।”
কারান হেসে বলে, “এখন থেকে কারান আর মিসেস চৌধুরি একসাথে ঘুমাবে।”
মিরা কিছুক্ষণ অপলক দ্বিধাভরে তাকিয়ে থেকে, “ঠিকাছে। আমি যাচ্ছি বেডে ঘুমাতে,” বলে বিছানায় গিয়ে বালিশ ঠিক করতে থাকে।
কারান খুশিতে গদগদ হয়ে জলদি বিছানায় গিয়ে বসে। মিরার কাছে এগোবে, এরই মধ্যে মিরা বলে, “দেখুন, আমি কিন্তু ঘুমাতাম না এখানে; আপনি বলেছেন তাই ঘুমাচ্ছি। তাই আমি এই পাশটায় ঘুমাবো আর আপনি ঐ পাশে।”
কারান অসহায় স্বরে বলে, “এটা কি সিনেমা মনে হয় তোমার? আমি আমার বউয়ের সাথে ঘুমাবো।”
মিরা উত্তরে ভ্রূ কুঁচকায়। কারান কিছুটা বেসামাল হয়ে বলে,
“আরে, এত রেগে যাচ্ছ কেন? এখন ঘুমানোর কথা বলিনি তো! পরে, পরে আরকি। আচ্ছা গুড নাইট বেগম।”
এই বলে পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে। তার মুখের অদ্ভুত পেঁচার মতো অভিব্যক্তি দেখে মিরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। কিন্তু কিয়ৎক্ষন পর নিজেকে সামলে নিয়ে সেও শুয়ে পড়ে।
মিরা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে অথচ কারানের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে তার মনের মাঝে অসন্তোষ জমে উঠেছে।
কারান মনে মনে বলে, “ধুর, আজও মনে হয় আমার ঘুম আসবে না। আর আমার বউটাও কী রকম! স্বামী না ঘুমিয়ে এভাবে ছটফট করছে, আর তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু ওর ঐ পাশে মুখ ফিরিয়ে ঘুমানো লাগে?”
একটু থেমে বিড়বিড় করে বলে, “আই কান্ট ওয়েট টু সি ইওর ফেস বেবি।”
তারপর ধীর পায়ে চুপিসারে মিরার পাশে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। অর্থাৎ মিরাকে দেখে সমস্ত ক্লান্তি, অবসন্নতা মুহূর্তেই দূর হয়ে গেছে। মিরার শ্বাসের তালে তালে তার প্রশান্তি বেড়ে যায়।
কিছু চুল মিরার চোখে-মুখে পড়ায়, কারানের ভ্রূ কুঁচকে যায়। যেন সেই চুলগুলো তার ঘুমন্ত মহারাণীকে দেখার পথে এক বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সে মৃদু ফুঁ দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দেয়। এবার কারানের চোখে শান্তি ফিরে আসে এবং তার ঘুমকন্যা প্রেয়সীর পানে তাকিয়ে নিস্তব্ধ ভালোবাসা অনুভব করে।
সকালবেলা মিরা ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই দেখে কারান তার পাশে হাস্যোজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। মিরার হঠাৎ চোখে পড়তেই সে আচমকা লাফিয়ে উঠে, সজোরে চিৎকার দিয়ে বলে, “আআআআআ!”
তারপর বড় বড় শ্বাস ফেলে বিস্ময়ে বলতে থাকে, “আপনি, আপনি এখানে কি করছেন, হ্যাঁ?”
কারান একটু অবাক হয়ে আমতা আমতা করে আওড়ায়, “আমিই তো। তুমি এতটা চিৎকার দিয়ে উঠলে মনে হলো যেন ভূত দেখেছো!”
মিরা ভয়ার্ত গলায় বলে, “ভূত নয়, পিশাচ দেখেছি! আর একটু হলেই তো… উফফ! তা আপনি আমার এই পাশে কি করছেন?”
“জানি না, ঘুমের মধ্যে এখানে চলে এসেছি।”
মিরা সন্দেহভরিত কণ্ঠে বলে, “ঘুমের মধ্যে কি আমাকে ডেঙ্গিয়ে ঐ পাশ থেকে এই পাশে চলে এসেছেন?”
কারান মুচকি হেসে বলে, “হ্যাঁ আসতেও পারি!”
মিরা একটুখানি চুপ থেকে বলল, “তা আপনি ঘুম থেকে উঠলেন কখন?”
“এই তো, তুমি ওঠার খানিক আগে।”
মিরা এবার উঠতে যায়, কিন্তু কিছু একটা অনুভব করে আবার বসে পড়ে। কারানকে শান্ত গলায় বলে, “আপনি যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি আসছি।”
কারান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে, গুনগুন করে বলতে বলতে চলে যায়, “ঘুমালাম-ই না। কি আর ফ্রেশ হতে যাব?”
কারান চলে যাওয়ার পর মিরা শাড়ি ও বিছানা পরিবর্তন করে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে যায়।
পরে কারানকে দেখে শান্ত গলায় বলে, “আচ্ছা আপনার জন্য কফি বানিয়ে আনছি।”
“তুমি তো কাল বললে, আমার বানানো কফি ভালো হয়েছে।”
“হ্যাঁ, হয়েছে তো।”
“তাহলে আবার কি? আপনি বসুন মহারানি। আমি বানিয়ে আনছি,” বলে কারান হেসে কফি বানাতে চলে যায়।
মিরা আজকে আর তাকে আটকায় না। তার পিছনে অবশ্য একটা কারণ রয়েছে। মিরা চেয়ারে বসে ফোনের মধ্যে চোখ বোলাতে থাকে।
ক্ষণকাল পর কারান উচ্চবাচ্যে সম্ভাষণ করে, “মিরা!”
মিরা কান সজাগ করে, ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয়, “হুম?”
“তোমার কেমন ছেলে পছন্দ?”
মিরা অবাক হয়ে, চেয়ার ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে বিস্ময়ের চোখে বলে, “কেন?”
“এমনি। বলো না, জানতে ইচ্ছে করছে।”
মিরা ম্লান হেসে বলে, “কেন, আপনি কি আবার আমার বিয়ে দিবেন নাকি?”
কথাটা যদিও কারানের কাছে আপত্তিজনক লাগল, তাও শান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ। কারান চৌধুরির সাথে তোমাকে হাজার বার বিয়ে দিব। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দাও।”
কারানের কফি বানানো হয়ে গেছে। তাই মিরা চেয়ার থেকে উঠে কফির কাপটা নিয়ে সিঁড়ির এক খাপে পা দিয়ে বলে, “আমার দ্বীনদার ছেলে পছন্দ।”
কথা শেষ করে চলে যেতে শুরু করলে কারান ডাক দেয়, “মিরা!”
মিরা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “বলুন?”
“দেখো তো, এই কাপের কফিটা কেমন খেতে হয়েছে?”
মিরা ফের কারানের কাছে এসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে, “পারফেক্ট ব্ল্যাক কফি। আপনি তো এমনটাই খান,” বলে প্রস্থান করে।
কারান মৃদু হেসে, মিরার চুম্বনের চিহ্নটুকু যেখানে রয়ে গেছে, সেখানেই চুমুক দেয়। তার উদ্দেশ্যে ছিল মিরার ঠোঁটের ছোঁয়া নেওয়া। কারান ধীরে ধীরে সেই স্পর্শটুকু অনুভব করতে থাকে।
এরপর কারান কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “দ্বীনদার ছেলে? ওকেএএ। তার মানে মিরার মন জয় করতে হলে আমাকে নামাজ পড়তে হবে। শুধু মিরার কেন, আগে তো আল্লাহকে খুশি করতে হবে। নাহলে আমার মিরার মন গলিয়ে দিবে কে?”
গোধূলির আলো ম্লান হয়ে আসছে। মিরা বিছানায় নিস্তেজ হয়ে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে।
মাগরিবের নামাজ শেষে কারান তার ঘরে এসে বলে, “মিরা, তুমি নামাজ পড়বে না?”
মিরা মাথা তুলে কিছুটা ক্লান্ত হাসিতে জবাব দেয়, “আপনি পড়েছেন?”
কারান মুচকি হাসে, “হ্যাঁ, আজ যোহর, আসর, মাগরিব তিন ওয়াক্তই পড়লাম।”
মিরা প্রশংসাসূচক হাসি দিয়ে বলে, “মা শা আল্লাহ। অবশেষে সুমতি হলো। আর আজ আমার শরীরটা একদমই ভালো লাগছে না, তাই পড়তে পারিনি।”
Tell me who I am part 5
কারান তার কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে কাছে বসে বলে, “কি হয়েছে মিরা? দরকার হলে ডাক্তারকে ডাকব।”
মিরা শান্তভাবে বলে, “আরে না, তেমন কিছু না। সামান্য পেইন হচ্ছে, এই আরকি।”
কারান চোখে গভীর মমতা নিয়ে, হাস্কি কণ্ঠে বলে, “একবার আমার ঠোঁটের ছোঁয়া নাও বেগম; দেখবে, তোমার সমস্ত ব্যথা নিমেষে মিলিয়ে যাবে।”