আযদাহা পর্ব ২৯
সাবিলা সাবি
ফিওনা টলতে টলতে সামনের দিকে এগোচ্ছিল,কিন্তু হঠাৎ করেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল। মাথা ঘুরতে শুরু করল,আর মাটি পায়ের নিচ থেকে সরে যেতে লাগল।পড়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে,এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়ে ওকে আঁকড়ে ধরল।
জ্যাসপারের হাতে ফিওনা ধরা পড়ল, ওজনহীন একটি পাখির মতো। তার শক্তপোক্ত বুকের উষ্ণতার মধ্যে ফিওনা ক্ষণিকের জন্য নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেল।শক্তপোক্ত পেশীগুলো ফিওনাকে ঘিরে রেখেছিল এমনভাবে,পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে আঘাত করতে না পারে।
জ্যাসপার তার বাহুতে থাকা ফিওনার অবসন্ন শরীরটিকে আলতোভাবে ধরে উপরের দিকে তুলে ধরল।তার গভীর সবুজ জ্বলজ্বলে চোখ ফিওনার ক্লান্ত মুখের দিকে নিবদ্ধ হলো,সবকিছু পড়ে ফেলতে চাইলো ।নিজের ভয় আর উদ্বেগের আভাসটুকু লুকাতে পারল না।
“ফিওনা, কি হয়েছে তোমার?” তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগের মিশেল। তীব্র অথচ কোমল। “তোমার শরীর খারাপ লাগছে?”
ফিওনা সামান্য কাঁপা গলায় কিছু বলতে চাইছিল,
কিন্তু শব্দগুলো আটকে যাচ্ছিল।তার ধীরে ধীরে ওঠা-নামা করা নিশ্বাস জ্যাসপারের বুকের গভীর তাপ অনুভব করছিল।
জ্যাসপার আলতোভাবে তার আঙুল দিয়ে ফিওনার চিবুক ধরে মুখটা নিজের দিকে তুলল। তার চোখে এক অনন্ত দিগন্তের গভীরতা।সেখানে দুশ্চিন্তা ছিল,আবার কিছু অদ্ভুত মমতা।
ফিওনার দুর্বলতা মুহূর্তেই ছাপিয়ে উঠল এই শক্তি আর উষ্ণতায়।য়তার চারপাশের দুনিয়া অস্পষ্ট হয়ে গেল, কেবল অনুভূত হলো জ্যাসপারের সেই অদ্ভুত শক্তি আর নিরাপত্তা।মনে হলো,এই মুহূর্তে সে শুধু জ্যাসপারের।
তার শক্ত হাতের আলিঙ্গন আর গভীর কণ্ঠের নীরব প্রতিশ্রুতি ফিওনাকে বলে দিল “যতক্ষণ আমি আছি,তোমার কিছু হবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখনি ফিওনা মুখ তুলে তাকাল।তার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত মাদকতা ছড়িয়ে পড়েছে—একটা গভীর শূন্যতা,আবার একসঙ্গে অসম্ভব তীব্র কিছু।
জ্যাসপার সেই চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ফিওনার দৃষ্টি এমন ছিল, সে প্রচণ্ড অ্যালকোহল পান করেছে আর বাস্তবতার সঙ্গে সমস্ত সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে।
হঠাৎ করেই,ফিওনা জ্যাসপারের কাঁধে ছোট ছোট মৃদু ধাক্কা দিতে শুরু করল। তার গলার স্বর একেবারে বাচ্চাদের মতো অভিমানী হয়ে উঠল। “আপনি…আপনি অনেক পচা!”
জ্যাসপারের ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেল। এমন আচরণে সে কিছুটা বিভ্রান্ত,আবার খানিকটা মুগ্ধ। ফিওনা ততক্ষণে অভিমানের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
“গ্র্যান্ডপার মতোই আপনি!সেও আমাকে কখনো কোথাও যেতে দিতেন না।সবসময় ঘরে আটকে রাখতেন।আর এখন আপনিও..আপনিও আমাকে আটকে রেখেছেন!” ফিওনার কণ্ঠস্বর ভাঙল। অভিমানের জড়তা চোখের কোণায় জমে থাকা অশ্রুতে তার কথাগুলো আরও আবেগময় হয়ে উঠল।
তারপর,কাঁদার ভান ধরল সে।মুখ গোঁজ করে জ্যাসপারের বুকের দিকে মাথা নিচু করে নিজের ছোট ছোট মুষ্টি দিয়ে তার শক্ত কাঁধে ধাক্কা দিতে লাগল।তার পুরো শরীর ভরে উঠল এক ধরনের শিশুসুলভ অভিমান আর নাটুকেপনায়।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ নীরব রইল।তার মুখের কোণে এক অদ্ভুত মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল—হাসি চাপার চেষ্টা আর মৃদু বিরক্তি। সে গভীর এক শ্বাস নিয়ে ফিওনার দিকে তাকাল।
“তুমি কি ড্রিংকস করেছো?” তার কণ্ঠস্বর কঠোর, তবুও অদ্ভুতভাবে কোমল। “তোমাকে আটকে রেখেছি,কারণ তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে না।এই পৃথিবী তোমার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক।আর তুমি যদি নিজেকে বিপদে ফেলো,সেটা আমি সহ্য করতে পারব না।”
ফিওনা হঠাৎ থেমে গেল।তার অভিমানী অভিব্যক্তি বদলে গিয়ে এক ঝলক নরম আলো ফুটল।সে চুপ করে রইল,কিন্তু তার অভিমানী সুরে মুখ গোঁজার ভানটা টিকে রইল। “তার মানে আপনি আমাকে নিয়ে চিন্তিত?”
জ্যাসপার কিছু বলার পুর্বেই ফিওনা পুনরায় জ্যাসপারের কাঁধে ধাক্কা দিতে শুরু করল।তার ক্ষীণ অথচ দৃঢ় ধাক্কাগুলো জ্যাসপারের ভারসাম্য নষ্ট করছিল।প্রতিবার ধাক্কায় জ্যাসপার এক পা,দু’পা করে পেছিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে,এক মুহূর্তের জন্য তার শক্তিশালী উপস্থিতি একটু দুর্বল হয়ে গেল।সে ইজি চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল।
তবে এখানেই থেমে থাকল না ফিওনা তার মাদকতাময় অভিমান এক অন্যরকম সাহস এনে দিল। হঠাৎই, সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল।জ্যাসপারের এক পায়ের ঊরুর ওপর নিজের এক হাঁটু ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল তার দিকে।সেই আকস্মিক ভঙ্গির কারণে ইজি চেয়ারটি খানিকটা পেছনের দিকে হেলে গেল।
আর সেই মুহূর্তে—সমস্ত আবেগ,মাদকতা আর পরিস্থিতি এক বিন্দুতে এসে মিলল।ফিওনার মুখ জ্যাসপারের মুখের এতটাই কাছে চলে এলো যে তাদের নিশ্বাসের উষ্ণতা একে অপরকে স্পর্শ করতে লাগল।
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ।তার ঠোঁটের খুব কাছে ফিওনার ভেজা,গোলাপী ঠোঁটগুলো থরথর করে কাঁপছে।ফিওনার গভীর চোখে এক ধরনের অভিমানী অথচ অপ্রকাশিত আবেগ ফুটে উঠছে।মনে হচ্ছে তার ভেতরের সমস্ত ঝড়-তুফান এখন এই মুহূর্তেই থেমে গিয়েছে।
জ্যাসপারের কণ্ঠ আটকে গিয়েছে,তার দেহ শক্ত হয়ে গিয়েছে,তবু এক অদ্ভুত টান তার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে। “ফিওনা,তুমি …?” জ্যাসপার সম্পুর্ন কথা শেষ করার পুর্বেই ফিওনা বলে বসলো। ফিওনার কণ্ঠে যে অভিমান আর ক্ষোভের ঝাঁঝ ছিল,সেটি মিশে গেল এক অদ্ভুত মাদকতায়,যখন তার কথাগুলো উচ্চারণ হলো।
“আপনি অনেক নিষ্ঠুর,পাষাণ ড্রাগন!আমাকে শুধু অত্যাচার করেন—মানসিক,শারীরিক সব ধরনের।
তার প্রতিটি শব্দ শোনা যাচ্ছিল মর্মাহত অন্তরের গভীর থেকে।জ্যাসপার তার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎই থেমে গেল।তার তীক্ষ্ণ চোখ ফিওনার দিকে স্থির হয়ে গেল,তার কণ্ঠ গম্ভীর হয়ে উঠল।তার মনোযোগ কেবলমাত্র সেই গন্ধে—এক ঝাঁঝালো ফুলের গন্ধ,যা ফিওনার মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিল।গন্ধটা ছিল তীব্র।
জ্যাসপার বুঝতে পারল,তার সামনে যে এতোক্ষণ চাহনি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,সে আর সেই স্নিগ্ধ ফিওনা নয়।তার স্নায়ুতে প্রবাহিত হচ্ছে এমন কিছু যা তাকে একধরণের অস্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য করছে।
“ফিওনা,তোমার শরীর ঠিক নেই। এই গন্ধটা—এটাতো লুসিড ব্লুম বিষাক্ত ফুলের প্রভাব।”তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ ছিল,তবে তাতে এক ধরনের কঠোরতা ছিল।
ফিওনা কিছুটা হোঁচট খেতে গিয়ে চোখ তুলে তাকালো। “বিষাক্ত ফুল?আপনি কী বলছেন?আমি তো ঠিক আছি…” তার কণ্ঠে ছিল কিছুটা অস্পষ্টতা,তবে তার কথার সাথে শরীরের প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে,তার চোখে অস্থিরতা ফুটে উঠছিল।
জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল তাকে আরও একবার মাটিতে পড়তে না হয়।তার গলা গভীর হয়ে উঠল,তবে খুব নরম সুরে সে বলল,”এই ফুলগুলো সাধারণ ফুল নয়,ফিওনা।এগুলো এমন এক প্রজাতির ফুল যা মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে গভীর প্রভাব ফেলে।তোমার শরীরে এটা প্রবাহিত হচ্ছে,আর তা তোমার অনুভূতিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিচ্ছে।”
ফিওনার চোখগুলো তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল,তবুও তার ঠোঁট থেকে মৃদু আওয়াজ বের হলো,”আপনি…সবসময়…আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান…”
এখন,জ্যাসপার আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে তাকে নিজের বাহুতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। “তোমার প্রতি সম্পুর্ন অধিকার আমার যেটা আমি আর কাউকে দিতে পারবো না,ফিওনা।তার জন্য যদি আমাকে নিষ্ঠুর আর পাষাণ হতে হয়,তবুও।”
লুসিড ব্লুম ফুলটি এতটাই সুন্দর আর আপাত নির্দোষ,আসলে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে প্রবাহিত হয়ে সে মানবিকতা,অনুভূতি আর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
জ্যাসপার তার অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ চেপে রেখে,নরম গলায় প্রশ্ন করল,”আচ্ছা ফিওনা,তুমি আমাকে সব খুলে বলো।তুমি কি পাহাড়ের বাগানে গিয়েছিলে?আর কোনো ফুলের ঘ্রাণ নিয়েছিলে?”
ফিওনার মুখে এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ের ছাপ দেখা দিল।তারপর, তাঁর সমস্ত অভিমান আর ক্ষোভ একসাথে তলিয়ে গেল,ফিওনা আর কোনো কথা না বলে,ধীরে ধীরে জ্যাসপারের এক পায়ের ওপর বসে পড়ল।তার চোখে এখন আর কোনো অস্থিরতা নেই,বরং এক ধরনের শান্তি আর অভ্যস্ততা ফুটে উঠছিল।
“হ্যাঁ,গিয়েছিলাম তো,” ফিওনা আস্তে আস্তে নিজের মাঝে কিছু খুঁজতে গিয়ে,কথা বলতে শুরু করল। “অ্যাকুয়ারা আর আপনার ভাই রিয়নের সাথে গিয়েছিলাম।তারা আমায় অনেক ঘুরিয়েছে।আর তখনি বাগানে.. এরকম ফুল দেখলাম—এত সুন্দর!আমি নিজেকেই সামলাতে পারিনি।খেয়ে নিয়েছি সেটা।খুব টেস্টি ছিল।আর জানেন,ওটা খাওয়ার পর প্রথমবার মনে হচ্ছে আমি পুরোপুরি রিল্যাক্স লাগছে,নিজেকে শান্ত লাগছে।”
ফিওনার কণ্ঠে তখন এক ধরনের শান্তি,এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি ছিল,সেই ফুলের প্রভাবে তার সমস্ত উদ্বেগ,ভয়,আর অস্থিরতা মুছে গিয়ে এক নিঃসঙ্গ স্থানে তাকে নিয়ে এসেছে।
ফিওনা ধীরে ধীরে তার মুখটি জ্যাসপারের দিকে ঝুঁকে দিল।তার চোখে এক অদ্ভুত অনুরাগ ছিল, যদিও অভিমান আর ক্ষোভের ছায়াও স্পষ্ট ছিল। কিন্তু সে আর নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না।
“জানেন,আমি চাই আপনাকে ঘৃণা করতে,” ফিওনা তার কণ্ঠে আবেগের দোলা এনে বলল, “আপনি তো আমাকে কিডন্যাপ করেছেন,অত্যাচার করেছেন… তবুও পারি না।কেনো,জানি না।আপনার সবুজ চোখ দুটি দেখলে আমি কোথায় হারিয়ে যাই… ডুবে যাই।ওই চোখে কি এমন আছে,যা আমাকে এমনভাবে টানে?”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল। তার চোখে ছিল এমন এক গভীর দৃষ্টি,সে ফিওনার প্রতিটি কথা,প্রতিটি আবেগ অনুভব করতে পারছিল।
তারপর জ্যাসপার সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে ফিওনার দিকে তাকাল, সে শুধু তার অনুভূতিটুকু বুঝতে চায়, আর কিছু নয়।তার কণ্ঠ ছিল মধুর,তবে গভীর,”আর কি কি দেখলে ডুবে যাও,হামিংবার্ড?” ফিওনার বুকের মধ্যে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।সে কেমন শিহরিত হয়ে উঠলো।জ্যাসপারের কণ্ঠে এমন একটা মাধুর্য ছিল,যা তার সমস্ত বিক্ষিপ্ত মনোভাবকে একাকার করে ফেলেছিল।ফিওনার চোখ দুটো আবার একদৃষ্টিতে জ্যাসপারের চোখে আটকে গেল।তার স্নায়ু গলতে শুরু করেছিল।
ফিওনা তখন হালকা চোখে তাকিয়ে,ধীরভাবে প্রশ্ন করল,”আপনি আমাকে গতকাল কেনো স্পর্শ করেছিলেন?আর কেনোই বা আমায় আমার বাসায় যেতে দিচ্ছেন না?কেনো আটকে রাখছেন?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ নীরব ছিল, তার মনের গহীনে ঘুরপাক খাচ্ছিল হাজারো অনুভূতি।তারপর,ধীরে ধীরে সে তার চোখ তুলে ফিওনার দিকে তাকাল।তার মুখাবয়ব ছিল সেই অচেনা গম্ভীরতা দিয়ে মোড়া, তার হৃদয়ের সবচেয়ে গোপন কথা বের হয়ে আসছে।” কারণ” জ্যাসপারের কণ্ঠে গভীর এক সুর ছিল,”আমার হৃদয়ের খাঁচায় তোমাকে সারাজীবনের জন্য বন্দি করে নিয়েছি।তাই।”
ফিওনার শরীরে এক ঝিমঝিম অনুভূতি বয়ে গেল।তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে উঠল,যসে এই মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল।এক চিলতে ক্ষোভভরা কন্ঠে ফিওনা বললো,”আমি অ্যকুয়ারার কাছে সব শুনেছি।আপনার বিয়ে তো ঠিক করা আছে, ওই—ভেনাসের একটা ড্রাগন, অ্যালিসা।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ নীরব ছিল তার চোখে এক অদ্ভুত রকমের কষ্ট মিশে গিয়েছিল।কিন্তু তারপর সে শান্তভাবে বলল,”ওটা তো সফটওয়্যারের মাধ্যমে ঠিক করা।হৃদয় কি সফটওয়্যার দিয়ে হয়? তার কণ্ঠে এক ধরনের গভীরতা ছিল,তার কথাগুলো শুধুই যুক্তির কথা নয়,কিছু ব্যক্তিগত বেদনা থেকেও বেরিয়ে এসেছে।
ফিওনা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বুঝতে পারছিল না ঠিক কী বলতে চাচ্ছে সে।তবে জ্যাসপার আরও একটি ধাপ এগিয়ে গেল,তার চোখে একটু মৃদু তীব্রতা ছিল,”আমার ভেতরে তো লাভ ফাংশনাল ডিলিট ছিলো—তুমি সেটা সক্রিয় করেছো।আমি তো অ্যালিসাকে ভালোবাসি না,হামিংবার্ড।”
ফিওনার চোখে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি ছিল—একদিকে হতাশা,অন্যদিকে অবাক করা এক অনুভূতি।তার পুরো দেহ অস্বস্তিতে চঞ্চল হয়ে উঠল,তবে তার বুকের মধ্যে এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করতে শুরু করল।
জ্যাসপারের পায়ের ওপর কোলে বসা অবস্থাতেই ফিওনা হঠাৎ করেই নিজের শার্টের বাটান খুলতে শুরু করলো।তার এই আচরণে জ্যাসপার দ্রুত এগিয়ে এসে তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো।চোখে তীক্ষ্ণ উদ্বেগ আর অবাক ভাব ছিল,”কি করছো তুমি?”
ফিওনা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল, তার কণ্ঠে হালকা বিরক্তি,”উফ,আমার অনেক গরম লাগছে,অস্থির লাগছে।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল, কিন্তু তারপর তার চোখে এক দৃঢ় মনোভাব ফুটে উঠলো। সে ধীরে ধীরে ফিওনার হাত ধরে তাকে স্নিগ্ধভাবে শান্ত করার চেষ্টা করল।এক হাত দিয়ে ফিওনার হাত আটকে রেখে, অন্য হাতে পাশের টেবিল থেকে এসির রিমোট তুলে নিল।
রিমোটটি সামঞ্জস্য করে,এসি একদম বাড়িয়ে দিলো, আর ঘরটা মুহূর্তেই শীতল হয়ে গেল।কিন্তু ফিওনা বুঝতে পারল,তার শরীরে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা কিছুই কমেনি।এসির ঠান্ডা বাতাস,আর জ্যাসপারের উপস্থিতি সব কিছু আরও বেশি অনুভূতি বাড়াচ্ছিল।
ফিওনা এক অবচেতন গতিতে জ্যাসপারের গলার টাই খুলতে শুরু করলো।তার হাতের স্নিগ্ধ স্পর্শে টাইটি একে একে নরম হয়ে পড়ছিল।তার চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টির মাদকতা,সে নিজেই বুঝতে পারছিলেন না কেন এমন করছে।
“কি করছো?” জ্যাসপার তার কণ্ঠে কিছুটা কঠোরভাবে প্রশ্ন করল,কিন্তু তার চোখের মৃদু অবাক ভাব আর শারীরিক দূরত্ব দূরে সরে যাচ্ছিল,সে এক অজানা টান অনুভব করছিল। তার মন অস্থির হয়ে উঠেছিল, এই অদ্ভুত নেশার প্রভাবে কিছুই আর স্বাভাবিক লাগছিল না। ফিওনা তার সজীব অভিমানে বলল, “আপনাকে শার্টের বুকের কাছের বাটান খোলা রাখলেই বেশি ভালো লাগে।” তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত মৃদুতা ছিল সে নিজেও জানত না কেন এমন কথা বলছে,তবে শব্দগুলো সরাসরি বেরিয়ে যাচ্ছিল তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে,একটি মধুর আর আকর্ষণীয় নিঃশ্বাসের মতো।
জ্যাসপার জানত,ফিওনা এখন যে অবস্থায় আছে,তার কথাগুলো মানে খুব একটা নয়।লুসিড ব্লুম,মানব মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে।এর পাপড়ির গন্ধ মস্তিষ্কে এমন এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে, মানুষ তার অজান্তেই নিজের গোপন কল্পনা,আবেগ আর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে থাকে।এটি এক ধরনের স্নায়ুবিক বিষাক্ত ফুল,যার মিষ্টি গন্ধ অতি দ্রুত মানুষের ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে আর চিন্তাভাবনার সীমা মুছে দিয়ে এক পাগলাটে নেশায় পরিণত করে।আর এটার ঘ্রান নেয়ার আধা ঘন্টার মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় আর প্রায় তিন ঘন্টা পর্যন্ত এটার প্রতিক্রিয়া থাকে।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার গলা থেকে টাইটি খুলে ফেলল,তারপর বুকের কাছে থাকা তিনটি বাটান একে একে খুলে দিলো।তখনি তার গশার লকেট আর ঘাড়ের ট্যাটু উন্মুক্ত হলো।তার এই চলনে এক ধরনের নিষ্কলঙ্ক শীতলতা ছিল,সে এক পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে ছিলো।কিন্তু ফিওনার চোখে সে স্থিরতাই অস্থিরতার সৃষ্টিকারী।তার হাতের মৃদু নড়াচড়ায় এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল,যা তাকে আরও কাছে টেনে এনে পাগল করে দিচ্ছিল।
ফিওনা আবার নিজের আঙুল জ্যাসপারের ঠোঁটের দিকে রেখেই বলল,”আপনার ঠোঁটজোড়া এতো আকর্ষণীয় কেনো?এমন একবারে ড্রাগন ফ্রুটের মতো ঠোঁট,পৃথিবীর কাউকেই দেখিনি।সত্যি অদ্ভুত সুন্দর ইচ্ছে করে সবসময়…”
জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর চোখে বলল, “কি, সবসময়?”তার কণ্ঠে এক ধরনের গভীরতা ছিল,সে ফিওনার মনের গভীরে থাকা কথাগুলো বুঝতে পারছে,কিন্তু সে নিজেই তার অনুভূতিগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারছিল না।
ফিওনা মৃদু হাসল,তার চোখে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাছে অনুভূতির শব্দ ছিল সবচেয়ে মিষ্টি।”কিছু না,” সে বলল,নিজের মধ্যে কিছু লুকিয়ে রেখেছে,”কিছুই না।”
তবে তার মনের মধ্যে এক স্নিগ্ধ অথচ উত্তপ্ত অনুভূতির ঝড় বয়ে যাচ্ছিল,যে অনুভূতি জ্যাসপার একে একে অনুভব করতে শুরু করল।
“তোমার কি বাই এনি চান্স চুমু খেতে ইচ্ছে করছে?” জ্যাসপার তার দিকে ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি নিয়ে প্রশ্ন করল।
ফিওনা একটু হেসে বলল, “না,আপনার চুমুতে মিষ্টি স্বাদ,আমার ডায়াবেটিস হবে।”
এটা শুনে জ্যাসপার তার কণ্ঠে এক লাস্যময় হাসি এনে বলল,”নো,হামিংবার্ড।ওটা গ্লুকোজের মিষ্টি,এটাতে ডায়াবেটিস হবেনা।”
ফিওনা এখনো জ্যাসপারের উরুর ওপর বসে রয়েছে,জ্যাসপার তার এক হাত দিয়ে ফিওনার কোমরের চারপাশ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে,আর অন্য হাতে ফিওনার গালে।জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে যায়,তার চোখে এক গভীর আকর্ষণ আর এক অদৃশ্য টান।তার প্রতিটি পদক্ষেপ সময়কে থামিয়ে দেয়,আর ফিওনার হৃদপিণ্ড দ্রুত বেগে ধ্বনিত হতে থাকে।যখন তাদের ঠোঁট মাত্র এক ইঞ্চি দূরত্বে পৌঁছায়,সারা দেহে এক শিহরণ বয়ে যায়।
ফিওনা হঠাৎই সজাগ হয়ে উঠল মুহূর্তের আকর্ষণ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে জ্যাসপারের ঠোঁট প্রায় তার ঠোঁটের ছোঁয়ার কাছাকাছি চলে এসেছিল,কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ফিওনা তার কৌশল থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে জ্যাসপারের হাত ধরে টান দিয়ে বলল,”চলুন না,ডান্স করি,কাপল ডান্স।” তার কণ্ঠে একধরনের খেলার ছোঁয়া ছিল,নিজেকে আর তাকে অন্য এক অভিজ্ঞতায় প্রবাহিত করার জন্য প্রস্তুত।
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য কিছুটা হতবাক হয়ে গেছিল,কিন্তু তারপরই তার মুখে এক রোমান্টিক মুচকি হাসি দেখা দিল।তার চোখে নতুন রকমের ইচ্ছা জেগে উঠল,আর সে ফিওনার হাত শক্ত করে ধরল।
“আমি কখনো ডান্স করিনি,পারিনা,” জ্যাসপার বলল,তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ছিল।
ফিওনা তখন আরও উৎসাহিত হয়ে বলল,”আমি দেখিয়ে দিবো।আমি জানি আপনি শিখে যাবেন।”
জ্যাসপার আর ফিওনা একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ালো।ফিওনা নিজের কোমরে জ্যাসপারের হাত টেনে রাখল,আর নিজের দু’হাত আলতো করে জড়িয়ে দিল জ্যাসপারের গলায়।যেন মুহূর্তটি সময়ের বাইরে, যেখানে কেবল তাদের নিঃশ্বাস আর হৃদস্পন্দনের তাল বেজে চলেছে।
ঠিক তখনই জ্যাসপারের প্রযুক্তিগত স্পিকার থেকে একটি সফট মিউজিক ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঘরে।সুরটি ছিল মৃদু,কিন্তু মুগ্ধকর—তাদের জন্য যেন বিশেষভাবে তৈরি। ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য মিউজিক শুনে চোখ বন্ধ করল। সুরের তালে সে নিজেকে আরও নিঃশব্দে জ্যাসপারের জড়িয়ে ধরে মিশিয়ে নিল।সঙ্গীতের তাল ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে বাতাসে।জ্যাসপারের চোখ ফিওনার গভীর চোখের দিকে স্থির। সেই চোখে ছিল অনন্ত কাহিনী,এক অদৃশ্য আকর্ষণ,যা তাকে বাধ্য করছিল আরও কাছে টেনে নিতে।
এক সময় ফিওনা নিজের হাত দিয়ে জ্যাসপারের আঙুল ধরল। মিউজিকের তালে তালে সে নিজের শরীর ঘুরিয়ে নিল,কিন্তু ফিওনার ঘোরানো শেষ হওয়ার আগেই জ্যাসপার তাকে এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে নিল।তার শক্ত হাতে ফিওনাকে নিজের বুকের কাছে ধরে রাখল, যেন তাকে ছাড়ার আর কোনো ইচ্ছা নেই।
“তোমাকে আর কিছু শেখাতে হবে না,”জ্যাসপার মৃদু হাসি দিয়ে বলল।”তুমি আমার সঙ্গে ডান্স করতে পারছ,মানে আমিও শিখে গেছি।”
আযদাহা পর্ব ২৮
এরপর আর কোনো পরিকল্পনা বা কৌশল প্রয়োজন হয়নি।জ্যাসপার নিজেই প্রতিটি স্টেপ নিখুঁতভাবে ফিওনার সঙ্গে মিলিয়ে নিল।তাদের প্রতিটি নড়াচড়া যেন সঙ্গীতের স্রোতে মিশে এক রোমাঞ্চকর কবিতা তৈরি করছিল।
ফিওনার মুখে হাসি,আর জ্যাসপারের চোখে ছিল এমন এক গভীরতা,যা বলে দিচ্ছিল—এটাই তাদের গল্পের নতুন অধ্যায়ের শুরু