প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৪৫

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৪৫
Drm Shohag

দেখতে দেখতে দু’মাস পেরিয়েছে। মাইরা নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে। মেয়েটা নতুন কলেজে ভর্তি হয়ে ভীষণ খুশি। কলেজে টুকটাক যাতায়াত হয়। নিয়মিত যাওয়া আসা টা এখনো হয়নি। তেমন কোনো বন্ধু ও হয়ে ওঠেনি এখনো। কিন্তুুু মাইরার ভীষণ মন খারাপ হয় মাঝে মাঝেই। ইরফান কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ইরফান অনেক কথা বলে এমন তো নয়, কিন্তুু লোকটার এই চুপচাপের মাঝে তাকে নিয়ে ভাবনা খুঁজে পায় না মাইরা। মাইরা যখন ইরফানের অনুভূতি একটু একটু বুঝতে পারলো ঠিক তখন থেকেই ইরফান কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেল। তার কোনো কিছুতেই মাথা ঘামায় না। মাইরার নিজেকে মুক্ত পাখির ন্যায় মনে হয়। যে পাখি চাইলেই পুরো আকাশে উড়াল দিতে পারে। তাকে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই।

মাইরা ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে যায়। ইরফান তাকে কলেজ নিয়ে যায় না। তার আর খোঁজ নেয় না। লোকটা হঠাৎ বদলে গেল কেন? তাহলে আগে তার যে এতো খেয়াল রাখতো, সেসব কি ছিল? মাইরার মাঝে মাঝে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সে বলতেও পারে না, সইতেও পারে না। ইরফানের এমন নির্লিপ্ততা তাকে ইরফানের সেই প্রথম দিনগুলোর ব্যবহারের কথা মনে পড়ে যায়। তাকে একটুতেই থাপ্পড় মেরে দিত, আবার বলতো তাকে বউ হিসেবে মানে না। সেই কথাগুলো তাকে কষ্ট দিতো না, যদি না ইরফান মাঝখানে মাইরাকে নিয়ে এতো না ভাবতো। লোকটার কি হয়েছে? তাকে বকে না, কথা বলে না, কিচ্ছু বলে না। এর চেয়ে তো দিনে দু’চারটে থাপ্পড় খাওয়া ভালো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভাবতে ভাবতেই মাইরা ছাদের দরজায় পা রাখলে শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে পিছন দিকে পড়তে নেয়, তার আগেই ইরফান মাইরাকে আগলে নেয়। মাইরা চোখ বুজে চেঁচিয়ে ওঠে। আজ তো সে শেষ! কিন্তুু যখন বুঝল কেউ তাকে ধরে নিয়েছে, দ্রুত চোখ খুলে তাকায়। তার সামনে ইরফানকে গম্ভীর মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাইরা অবাক হয়ে তাকায়। ইরফান মাইরাকে টেনে ছাদের মেঝেতে দাঁড় করায়। চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
“ব্য’থা পেয়েছ?”
মাইরা ঢোক গিলে। কতদিন পর একটু কথা বললো এই লোকটা তার সাথে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“হুম, ব্য’থা পেয়েছি।”
ইরফান বিচলিত হলো। অতঃপর মাইরাকে কোলে নিয়ে ছাদের কোণায় চেয়ারে বসায়। এরপর হাঁটু মুড়ে বসে মাইরা দু’পা উল্টেপাল্টে দেখে। চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
“কোথায় ব্য’থা পেয়েছ?”
মাইরা চুপচাপ ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। কোনো কথা বলে না। ইরফান মাইরার কোনো এন্সার না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,

“স্টুপিট বলো, কোথায় লেগেছে?”
মাইরা আমতা আমতা করে বলে,
“জানি না তো।”
“হোয়াট?”
মাইরা মিনমিন করে বলে,
“আমি পা ফেলতে পারছি না। হাঁটতে পারছি না।”
ইরফান উঠে দাঁড়িয়ে মাইরাকে কোলে তুলে নেয়। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। ইরফান মাইরাকে নিয়ে তার বেডের উপর বসালো৷ এরপর ফ্রিজ থেকে বরফ এনে মাইরার দু’পায়ে দিয়ে দেয়। কোথায় ব্য’থা পেয়েছে তা তো বুঝতে পারছে না। মাইরা এবার ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে হেসে ফেলল ইরফানের কান্ডে। ইরফান মাইরার দিকে তাকালে মাইরা মুখ স্বাভাবিক করে নেয়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে তার দু’পা টেনে নিয়ে বলে,
“হয়েছে। আর ব্য’থা নেই।”
ইরফান মাইরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। হাতে থাকা বরফের টুকরোর মাঝ থেকে দু’টো বরফের টুকরো ইরফান তার মুখে পুড়ে নেয়। দৃষ্টি মাইরার পানে। মাইরার অদ্ভুদ চোখে তাকায় ইরফানের দিকে। এতোক্ষণ তার পুরো পায়ে এই বরফ ঘষে এখন তা মুখে পুড়ে নিল, কি অদ্ভুদ!
ইরফানের হাতে থাকা অবশিষ্ট আরও কয়েকটা বরফ ছুঁড়ে ফেলল। এরপর মাইরার পা ধরে একটান দিয়ে টেনে তার দিকে আনে। মাইরা চেঁচিয়ে ওঠে। ইরফান মাইরাকে তার কোলে বসিয়ে নিল। বা হাতে মাইরাকে টেনে কিছুটা বাঁকা করে নেয়।

ডান হাত গলার ভাঁজে নিয়ে রাখে। ঠাণ্ডা ভেজা হাত পেয়ে মাইরা কেঁপে উঠল। ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় মাইরার পানে। মাইরা সংকোচ ঠেলে ইরফানের দিকে তাকালো। ইরফান তার সাথে প্রায় দু’মাস হলো কথাই বলে না। সেখানে আজ এমন অভাবনীয় একটা কাজে মাইরা অবাক না হয়ে পারছে না। মেয়েটা ইরফানের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ইরফান বরফ মুখের ভেতর রেখে মাইরার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
“কোথায় যেন ব্য’থা পেয়েছিলে?”

মাইরা ঢোক গিলে। সে তো ব্য’থা পায়নি। এই লোক ধরে ফেলল না-কি! আমতা আমতা করে কিছু বলতে চায়, কিন্তুু ইরফান মাইরার কথার উত্তর না শুনেই এক টানে মাইরার গলা থেকে ওড়না সরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। এরপর তার মুখ নামিয়ে নেয়। মুখের ভেতর থেকে বরফ দু’টো বের করে মাইরার গলার নিচে মাঝ বরাবর রাখে। মাইরা কেঁপে ওঠে। বরফ দু’টো সরাতে চাইলো, তার আগেই ইরফান মাইরার দু’হাত চেপে ধরে। মাইরা নড়াচড়া করতে পারে না। ইরফান মাথা তুলে মাইরার গলায় দৃষ্টি রাখে। শরীরের তাপে বরফ গলে পানি হয়, গলা বেয়ে জামার ভেতর প্রবেশ করে। ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল সেদিকে। মাইরা মোচড়ামুচড়ি করে অসহায় কণ্ঠে বলে,
“ছাড়ুন আমায়। আমার ঠাণ্ডা লাগছে।”

ইরফান মাইরার মুখপানে তাকালো। মাইরার দৃষ্টির মানে ইরফান বুঝলো না। দু’টো বরফ পুরোটা গলে পানি হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইরফান দৃষ্টি মাইরার গলায় রেখেছে। মাইরা লজ্জায় হাসফাস করে। দূরে ছিল সেটাই তো ভালো ছিল। কোন দুঃখে যে কোলে ওঠার লোভে মিথ্যে বলতে গেল!
ইরফান মাইরাকে তার দিকে টেনে নেয়। মাইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে সূক্ষ্ম হেসে ফিসফিসিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“কোথায় ঠাণ্ডা লাগছে? টেল মি।”

মাইরা জমে গেল। বরফ গলে শরীরে লেগে যতটা ঠাণ্ডা লাগছিল, তার মাত্রা হাজারগুণ বেড়ে গেল মুহূর্তেই।
ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দিল। মাইরা ঢোক গিলে ইরফানের দিকে সিঁটিয়ে যায়। মাথা নিচু করে নেয়। ইরফান মাইরাকে দু’হাতে তার থেকে খানিকটা দূরে বসালো। এরপর মাইরার বডিতে দৃষ্টি বুলায়। মাইরা লজ্জায় হাসফাস করে। ইরফান হঠাৎ-ই এগিয়ে এসে মাইরার গলায় মুখ গুঁজে দেয়। মাইরা কেঁপে ওঠে। ইরফান মাইরার গলা থেকে মুখ উঠিয়ে মাইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
“এগেইন এক্টিং করলে থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলব তোমার। অ্যা’ম ওয়ার্নিং ইউ, আমাকে জ্বালাবে না। স্টুপিট গার্ল।”
কথাটা বলে বেড থেকে উঠে দাঁড়ায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
মাইরা দু’পা ভাঁজ করে মাথা নিচু করে বসল। ইরফান ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর সাথে সাথেই মাইরা দ্রুত বেড থেকে নেমে তার কাপড় বের করে জামা পাল্টে নেয়। ইরফান বের হওয়ার আগেই জামা পাল্টানো সম্পন্ন করতে পেরে মাইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

ইরফান শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে মাইরার দিকে একবার তাকালো। মাইরা ইরফানকে তার দিকে তাকাতে দেখে মাথা নিচু করে নেয়। ইরফান ধীরপায়ে মাইরার দিকে এগিয়ে আসে। মাইরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। এই লোকটার আজ কি হলো? মাইরা পিছিয়ে গিয়ে কাভার্ডের সাথে লেগে দাঁড়ায়। ইরফান খুব স্বাভাবিক ভাবে মাইরার সামনে দাঁড়িয়ে মাইরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিছনে কাভার্ড থেকে তার শার্ট, স্যুট, প্যান্ট বের করে আনে। এরপর নিঃশব্দে মাইরার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়।
ইরফান রেডি হয়ে নিল। মাইরা একজাগায় গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইরফান নিজেকে পরিপাটি করে নেয়। এরপর ডান হাতে হাতঘড়ি পরে নেয়। মাইরা আড়চোখে দেখল ইরফানকে। ইরফানের হাতঘড়ির গ্লাসের ভেতর (gucci) লেখা। মাইরা খেয়াল করেছে ইরফানের ওয়ালেট, হাতঘড়ি এর উপর এই লেখাটা সবসময় দেখে। মেয়েটা ঠিক বুঝতে পারে না, ইরফানের অধিকাংশ জিনিসে এই নাম লেখা থাকে কেন। কৌতুহল থেকে ইরফানকে প্রশ্ন করে বসে,

“গুচি কার নাম?”
ইরফান চুলগুলো ঠিকঠাক করে নেয়। মাইরার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে মাইরার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
“হোয়াট?”
মাইরা আমতা আমতা করে। ইরফান কি মনে করে তার হাতঘড়ির দিকে তাকালো। উল্টো ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ঠোঁট বাঁকিয়ে সূক্ষ্ম হেসে বলে,
“মাই ফার্স্ট ওয়াইফ।”
মাইরা তড়াক করে ইরফানের দিকে তাকায়। ততক্ষণে ইরফান ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। মাইরা বিরক্ত হলো। আসলেই কি এই লোকের প্রথম বউ ছিল? ইনায়া আপুকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ওই ঘরের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ফার্স্ট ওয়াইফ আছে, আবার সবখানে এই গুচি নাম লিখে রাখে। তার নাকি প্রথম বউয়ের নাম। বিড়বিড় করল,
“ওটা গুচি না বুচি হবে। কোন বুচি এই জ’ল্লা’দের গলায় ঝুলেছিল!”

ইরফান নাস্তা করছে। নাস্তা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। তারেক নেওয়াজ খাওয়ার মাঝে গলা ঝেড়ে ইরফানের উদ্দেশ্যে বলে,
“মাইরার কলেজ পাস করে তোমার ভার্সিটি যাও। মাইরাকে নিয়ে যাও না কেন? তোমার প্রবলেম টা বলো ইরফান।”
ইরফান মনোযোগ দিয়ে নাস্তা করায় ব্যস্ত। যেন কেউ কিছুই বলেনি। তারেক নেওয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ইরফান?”
ইরফান মাথা নিচু করেই বলে,
“বলো।”
“আমি তোমাকে কিছু বলেছি।”
ইরফান খাবার শেষ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে বলে,
“হুম, শুনেছি।”
তারেক নেওয়াজ বিরক্ত হলো ছেলের গা ছাড়া ভাব দেখে। অতঃপর বলে,

“মাইরাকে নিয়ে যাও। নয়তো আমাকে উল্টো পথে যেতে হয়।”
ইরফান ফোনে কিছু টাইপ করতে করতে গম্ভীর গলায় বলে,
“তোমার মেয়ে, তুমি এইটুকু কষ্ট কর।”
তারেক নেওয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ও তোমার বউ, তুমি কি ভুলে গেলে?”
ইরফান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। পকেটে ফোন রেখে হাতঘড়িতে একবার সময় দেখল। এরপর বাইরে যেতে যেতে বলে,
“আগে তোমার মেয়ে, বন্ধুর মেয়ে মানে তো তোমারই মেয়ে। কবুল বলতে বলেছিলে, বলেছি। এখন মেয়ের দায়িত্ব তুমি পালন কর।”
তারেক নেওয়াজ অবাক হয়ে ডাকে,
“ইরফান?”
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
“ছেলের বউ না ভেবে, ওকে ইনায়ার বোন ভাবো। তাহলে আর আমার উপর ওর কাজ চাপানোর ভূত তোমার মাথায় চাপবে না।”

তারেক নেওয়াজ বাকহারা হয়ে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি হতাশ! কি হচ্ছে এসব? মাঝে দুই-তিন মাস ইরফান যেমন আচরণ করেছে তারেক নেওয়াজ একদম নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, ভেবেছিলেন সব ঠিকঠাক। কিন্তুু গত দু’মাস যাবৎ ছেলেটা আবারও কেমন পাল্টে গেল।
মাইরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। তারেক নেওয়াজ আর ইরফানের পুরো কথাই মেয়েটা দাঁড়িয়ে শুনলো। সবশেষে বিস্ময় দৃষ্টিতে ইরফানের প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইল। ইরফানের কথাগুলোয় মাইরা সত্যিই কিছু বুঝলো না। আর না তো ইরফানের এই বিহেবগুলোর অর্থ সে বোঝে। মেয়েটার নিজেকে কেমন অসহায় লাগলো। তার দমবন্ধ লাগে। ইরফান এমন করছে কেন? সে তো জিজ্ঞেসও করতে পারে না। কি বলবে? কোনো কথাই তো খুঁজে পায় না। নিরবে উল্টো ঘুরে তার ঘরে চলে যায়। ভেবেছিল আজ কলেজ যাবে। কিন্তুু মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।

মাইরা ভেবেছিল কলেজ যাবে না। কিন্তুু কিছু সময় পেরোতেই এই বাসায় ইনায়া আর ফারাহ আসে। ইনায়াকে ফাইজ নিয়ে এসেছে। আবার সন্ধ্যার পর নিয়ে যাবে। আর ফারাহ বাড়ির ভেতরে এসেছে সবার সাথে টুকটাক কথা বলার জন্য। সে ভার্সিটি যাবে। মাইরা ইনায়ার সাথে টুকটাক কথা বলে সিদ্ধান্ত নিল সে কলেজ যাবে ফারাহ’র সাথে। ইনায়া নাকি বাসায় থাকবে না। ইনায়ার এক ফ্রেন্ড এর সাথে জরুরি দরকার আছে। মাইরা একা একা কি করবে? এর চেয়ে কলেজ যাওয়া ভালো। ঘরে একা একা বসে থাকলে ওই লোকের কথা বেশি মনে পড়ে। তার নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। তাই ঝটপট কলেজ ড্রেস বোরখা আর উপরে সাদা হিজাব বেঁধে রেডি হয়ে নেমে আসে।
মাইরা আর ফারাহ কে ফারাহ’র ভার্সিটিতে নামিয়ে দেয় ফাইজ। মাইরার কলেজ পাস করে এসেছে মূলত ফারাহ’র কথায়। ফারাহ বলেছে আজ মাইরাকে তাদের ভার্সিটি ঘুরিয়ে দেখাবে। মাইরা দ্বিমত করেনি। তার মন ভালো নয়, কলেজে তেমন কোনো বন্ধুও নেই। এর চেয়ে ফারাহ আপুর সাথে তার ভার্সিটি ঘুরলে বেশি ভালো লাগবে। ফারাহ মাইরার হাত ধরে ভার্সিটির ভেতর প্রবেশ করে। মাইরা চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছে। আগামাথাই খুঁজে পায় না ভার্সিটির। অনেক বড় এরিয়া। ফারাহ মাইরার হাত ধরে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে হাত নেড়ে ডাকে,

“নুসরাত?”
নুসরাত, জুই, সাজিদ, জামিল সহ আরও বেশ কয়েকজন একটা বেঞ্চের উপর কেউ মাঠেই বসে হাসাহাসি করছে। ফারাহ’র ডাকে নুসরাত আর জুই উঠে আসলো। তারা এক ইয়ার হলেও ফারাহ’র রুম আলাদা। নুসরাত ফারাহ’র উদ্দেশ্যে বলে,
“এতো লেট করলি কেন?”
ফারাহ তার হাতঘড়িতে টাইম দেখে বলে,
“লেট হয়ে গিয়েছে। আমার এখন ক্লাস আছে।”
নুসরাত মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“এটা কে?”
ফারাহ মাইরাকে দেখিয়ে বলে,
“ওর নাম মাইরা। আমার বোন বলতে পারিস।
ওকে রাখ কিছুক্ষণ। আমি এই ক্লাস শেষে এসে নিয়ে যাবো ওকে।”
নুসরাত মাইরার দিকে তাকিয়ে বলল,

“এটা তো কলেজ ড্রেস মনে হচ্ছে। তুমি কলেজে পড়?”
মাইরা মৃদুস্বরে বলে, “জ্বি আপু।”
জুই ফারাহ’র পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“ক্লাসে চল।”
জামিল ক্লাসের দিকে যেতে যেতে বলে,
“ফারাহ আয় রে। লেট করলে তোর আবার অ্যাটাক ফ্যাটাক হবে।”
ফারাহ পাত্তা দিল না জামিলের কথা। মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“মাইরা তুমি থাকো। আমি এক আওয়ার পর এসে তোমাকে নিয়ে ঘুরব। এখন বাই।”
মাইরা অসহায় চোখে তাকালো। তাকে অপরিচিত জায়গায় কার কাছে রেখে যাচ্ছে। ফারাহ’র সাথে জুই ও এগোয়। নুসরাত মাইরার হাত ধরে হেসে বলে,
“এসো মাইরা। তুমি আমার ফ্রেন্ডের আমানত। এসো।”
মাইরা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। নুসরাত মাইরাকে নিয়ে তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মাঝে নিয়ে যায়, যেখানে সাজিদ সহ আরও অনেক ছেলে মেয়ে গোল হয়ে বসে আছে। মাইরা ভীষণ অস্বস্তি ফিল করে। নুসরাতের উদ্দেশ্যে বলে,

“আপু তোমরা থাকো। আমি ওদিকে গিয়ে দাঁড়াই।”
নুসরাত মাইরার অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলে,
“ওহ হো মাইরা, সবার সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এসো।”
সাজিদ মাইরার দিকে একবার তাকায়। এরপর আবারও বইয়ে মুখ গুঁজে। নুসরাত মুখ কোঁচকায় সাজিদের দিকে তাকিয়ে। মাইরার উদ্দেশ্যে বলে,
“এটা হলো আমাদের কালা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ও তোমাকে একদমই ডিস্টার্ব করবে না। তুমি ওর কোলে উঠে বসলেও কিছু বলবে না।”
সাজিদ বিরক্ত চোখে তাকায় নুসরাতের দিকে। মাইরাকে আরও অস্বস্তি ঘিরে ধরে। সাজিদের পাশে বসে মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হাউ কিউট!”

মাইরা অদ্ভুত চোখে তাকায় ছেলেটার দিকে। বিরক্ত হলো মেয়েটা। ধ্যাত তার এখানে আসা একদম উচিৎ হয় নি। এর চেয়ে কলেজে যাওয়া ভালো। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপু আমি কলেজ যাচ্ছি। ফারাহ আপু আসলে বলে দিও।”
নুসরাত মাইরার হাত টেনে বলে,
“আরে না না, তুমি ছোট মানুষ। এজন্যই ফারাহ তোমার দায়িত্ব আমাদের উপর দিয়ে গেল। এসো বসো। তোমার গল্প শুনি।”
সবাই তাদের মাঝখানে জায়গা করে দিল মাইরাকে। মাইরা অবাক হয়ে তাকালো সবার দিকে। মাইরার সবাইকে খুব খারাপ লাগলো না। কিন্তুু সাজিদের পাশে বসা ছেলেটা তার দিকে হা করে চেয়ে আছে। মাইরা বিরক্ত হয়ে ডাকে,
“ভাইয়া?”
শাহেদ সহ সবাই মাইরার ডাকে অবাক হয়ে মাইরার দিকে তাকায়। মাইরার দৃষ্টি অনিসরণ করে বুঝল মাইরা শাহেদ কে ডেকেছে। মাইরা খুব সুন্দর করে হেসে বলল,

“আমি বিবাহিত!”
শাহেদ কেশে ওঠে। মাইরার কথায়, আর শাহের অবস্থা দেখে সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তবে সাজিদ এর হাসির আওয়াজ সবচেয়ে বেশি হয়। মাইরা একটু বিব্রতবোধ করে। শাহেদ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে তার ফ্রেন্ডদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সবাই হাসছিস কেন? আমি ছ্যাঁকা খেয়েছি। একটু তো সমবেদনা জানা।”
নুসরাত মাইরার গায়ে ঢলে পড়ছে। মাইরাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি তো ছক্কা মেরে দিলে ইয়ার!”
এরপর নুসরাত হাসি থামিয়ে বলে,

“আমরা সবাই আনম্যারিড। তুমি ম্যারিড। ভালো লাগলো। তাহলে তোমার হাসবেন্ড দিয়েই তোমার গল্প স্টার্ট কর।”
মাইরা আবারও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আসলে তার প্রবলেম হচ্ছে এখানে অনেকগুলো ছেলে। এরা না থাকলে মাইরা এতোক্ষণে হয়তো মেয়েগুলোকে তার বান্ধবী বানিয়ে ফেলতো। মাইরা কিছু বলার আগেই সাজিদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে স্যার সম্মোধন করে কাউকে সালাম দেয়।
সাজিদকে অনুসরণ করে সবাই সেদিকে তাকায়। নুসরাত আর মাইরা উল্টে ঘুরে ছিল, নুসরাত পিছু ফিরে ইরফানকে দেখে দ্রুত সামনের দিকে ফিরে ভদ্রভাবে সালাম দেয়। মাইরা নিজেও পিছু ফিরে তাকায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়েছিল। কিন্তুু ইরফানকে দেখে তার চোখেমুখে বিস্ময় ভর করে। ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে মাইরার দিকে তাকিয়ে আছে। নুসরাত নম্রভাবে জিজ্ঞেস করে,
“স্যর কিছু বলবেন?”
ইরফান মাইরার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
“ক্লাস ক্যান্সেল।”

ইরফানের কথায় সকলের মুখ চুপসে যায়। এই স্যার তো এই ভার্সিটিতে পা রেখেছেই তাদের জীবন প্যারাময় করতে। এই ক্লাস আবার ঠিক কোন সকালে দিবে, নয়তো রাতে। রাতে ভার্সিটি খোলা থাকলে হয়তো রাত দু’টোর দিকে কল করে বলতো,
‘সবাই ক্লাসে আসো।’ নুসরাত কথাগুলো ভেবেই হতাশ হলো৷ ইরফান সকলের দিকে তাকিয়ে বলে,
“জায়গা ফাঁকা কর।”
ইরফানের কথা সবাই মেনে নিল। নুসরাত মাইরার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“এই প্যারাময় স্যার আমাদের জীবন বরবাদ করে দিচ্ছে। তোমাকে এই গল্প শোনাবো এসো।”
নুসরাতের কথা শুনে মাইরা নুসরাতের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। ইরফান যে এই ভার্সিটির টিচার এটা সে জানতো না। এতোক্ষণে সবার কথা শুনে বুঝল ইরফান এই ভার্সিটির টিচার।
নুসরাত মাইরার হাত টেনে বলে,
“এসো মাইরা।”
মাইরা ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
“ও যাবে না।”
নুসরাত সহ সবাই অবাক হয়ে তাকায় ইরফানের দিকে। তারা বোঝার চেষ্টা করছে ইরফান কথাটা কার উদ্দেশ্যে বললো। সবার মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আসে। ফারাহ মাইরার কেউ একজন। ফারাহ’র সাথে শুদ্ধ স্যারের একটা সম্পর্ক আছে। শুদ্ধ স্যারের আবার ইরফান স্যার এর ভাই। কাহিনী হলো ঘুরে উল্টে মাইরা ইরফানের কেউ। নুসরাত ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আপাতত তার মাথায় যা আসলো সে ভাবনা থেকেই মাইরাকে প্রশ্ন করে,
“এটা তোমার বড় ভাই নাকি মাইরা?”

নুসরাতের কথা শুনে মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায় নুসরাতের দিকে। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে মাইরার দিকে চেয়ে। মাইরাকে সবাই চুপ থাকতে দেখে বুঝল নুসরাত ঠিকই ধরতে পেরেছে।
সবাই একটু অবাক হয় ইরফানের বোন মাইরা ভেবে।
তবে মাইরা ইরফানের আত্মীয় হতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তুু অস্বাভাবিক তো নুসরাতের কাছে লাগছে। সে যে এই স্যার এর নামে একটু আধটু বদনাম করে ফেলেছে মাইরার কাছে। কাঁদোকাঁদো মুখ করে মাইরার কানের কাছে গিয়ে আবারও ফিসফিসিয়ে বলে,
“তোমার ভাই নাম্বার ওয়ান ভালো মাইরা। এখন বাই।”

শাহেদ তো রীতিমতো ঘামছে। এই ডিপজলের বোনের দিকে তাকিয়েছিল জানলে তো তাকে এই স্যার চিবিয়ে খাবে। শাহেদ এদের রেখে দ্রুত পায়ে জায়গা টা প্রস্থান করে। একে একে সবাই চলে যায়। মাইরা ভ্রু কুঁচকে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে কলেজে নিয়ে আসেনি ভাবতেই মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। উদ্দেশ্য কলেজ যাবে। এই লোকটা এই ভার্সিটির টিচার জানলে তো জীবনে আসতো না এখানে।
ইরফান মাইরাকে কিছু বললো না। খুব সুন্দরভাবে মাইরার পিছু পিছু হাঁটে। মাইরা বুঝতে পারলো ইরফান তার পিছু পিছু আসছে। মাইরা পায়ের গতি বাড়ায়। তবে ইরফানকে পিছিয়ে ফেলতে পারে না। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই ইরফান মাইরাকে টেনে একটা ভেতরের দিকে রাস্তায় নিয়ে যায়। মাইরা চেঁচিয়ে উঠতে নিলে ইরফান মাইরার মুখ চেপে ধরে। সেকেন্ড পেরোতেই ইরফান মাইরার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। এটা রাস্তা। ফাঁকা হলেও মানুষ আছে। মাইরা নিজেও আর চেঁচালো না। ইরফানকে সরিয়ে তার কলেজের দিকে যেতে চায়, কিন্তুু ইরফান মাইরার হাত টেনে শক্ত কণ্ঠে বলে,

“এখানে এসেছ কেন?”
মাইরা বিরক্ত হয়ে বলে,
“আমার হাত ছাড়ুন। আমি কলেজ যাবো।”
ইরফান কিছু বললো না। হাত ছেড়ে বলে,
“গো।”
মাইরা ইরফানের দিকে তাকালো না। হাঁটতে লাগলো। ইরফান মাইরার পিছু পিছু হাঁটে। ইরফানদের ভার্সিটি থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই মাইরাদের কলেজ। মাইরা কলেজ গেইটের ভেতর ঢুকলে ইরফান সেখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। মাইরা দ্রুত পা চালায়। এখনো একটু সময় আছে, ফাস্ট ক্লাস হয়তো এখনো শুরু হয়নি। তাড়াহুড়োয় যেতে গিয়ে মাইরা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে দু’পা পিছিয়ে যায়।
সামনে তাকিয়ে দেখল তার এক মেডাম। জিভেয় কা’ম’ড় দিয়ে অনুতপ্ত স্বরে বলে,

“স্যরি ম্যাম!”
মাইরাদের বায়োলজি ক্লাস নেয় এই ম্যাম। অন্তরা নাম তার। এখন তো এই ম্যাম এর ক্লাস। কোথায় যায় তাহলে? মাইরা গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করে,
“ম্যাম আপনার কিছু লাগবে?”
মাইরা অন্তরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়৷ এই ম্যামকে খুব বেশি বয়স লাগে না। ভালোই ইয়াং লাগে। অন্তরার চোখেমুখে কিছুটা বিরক্তি। দ্রুত পায়ে বাইরে যেতে যেতে বলে,
“না। ক্লাসে যাও।”
মাইরা মাথা নেড়ে কলেজের মাঠ পেরিয়ে ক্লাসরুমের দিকে যায়৷

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৪৪

অন্তরার বাবা গ্রাম থেকে এসেছে। এজন্যই মূলত মেয়েটা তার বাবাকে বাসার চাবি দিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে। এরপর সামনে তাকিয়ে কলেজ গেইটের বাইরে এক পা রাখতে গিয়েও তার পা থেমে যায়। বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় গেইটের ডান পাশে দাঁড়ানো ইরফানের দিকে। ইরফান মাথা নিচু করে ফোনে কারে সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। অন্তরা গেইটের হাতল শক্ত করে ডান হাতে চেপে ধরে। চোখজোড়া পানিতে টইটুম্বুর। বিড়বিড় করে,
‘ইরফান?’

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৪৫ (২)