আত্মার অন্তরালে পর্ব ৮
প্রীতি আক্তার পিহু
এক নিমেষে ইউভান তার কপাল ঠেকিয়ে দেয় আনায়ার কপালে। ঠান্ডা শীতল অনুভূতি শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে তাদের । ইউভানের নিঃশ্বাসের তীব্রতা গালের পাশে স্পষ্টভাবে অনুভব করে আনায়া।আনায়া ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে,
_”কষ্ট হচ্ছে ইউভান ভাই।”
ইউভান চোখ বন্ধ করে, একদম নিস্তব্ধ হয়ে, খুব আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বলে,
_”আমারও কষ্ট হয় সানসাইন।”
আনায়া ফুঁপিয়ে ওঠে।ঠোঁট চেপে ধরে কান্নায় আটকে আসা গলায় বলে,
_”ছেড়ে দিন”
ইউভান নড়ে না। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।গভীর শ্বাস টেনে বলে,
_” ছাড়বো না।”
আনায়া এবার শক্ত হয়ে যায়,
_”পালিয়ে যাব আমি!”
ইউভান ঠোঁটে এক চিলতে অদ্ভুত হাসি টেনে আনলো। ধীর কণ্ঠে বললো,
_”আবার ধরে নিয়ে আসবো।”
আনায়ার হৃদয় কেঁপে ওঠে। পুরো শরীর শীতল হয়ে আসে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
_ “মরে যাব আমি ”
ইউভান নিঃশব্দে তার মুখটা আনায়ার গালের সঙ্গে স্পর্শ করে। নিঃশ্বাস মিশে যায় দুজনের। গভীর স্থির কণ্ঠে বলে,
_”পরের জন্মে আবার বন্দি করে নিব।”
আনায়া চুপ হয়ে যায়। তার শরীর আর সাই দিচ্ছে না।ইউভানের হাত ধীরে ধীরে আগলা হয়ে আসে। আনায়া চোখ নিভু নিভু হয়ে যায় প্রায়। ইউভান কাঁচের টুকরাটা হাত থেকে বের করে ফলে রক্ত গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। দুজনের হাত থেকে রক্ত ঝরছে। আনায়ার শরীর সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যাচ্ছে আর সোজা হয়ে বসে থাকতে না পেরে ইউভানের কাঁধের ওপর মাথা ঠেকিয়ে দেয়। হাতের ব্যথা শরীরের ব্যথা তাকে সম্পূর্ণভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। কোন কিছু প্রতিবাদ করার মত শক্তি তার মধ্যে নাই। ইউভান এক হাত দিয়ে আনায়াকে আগলে নেয়। আনায়া প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে যাবে এমন সময়ও ঠোট দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলতে থাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
_”আপনি কি জানেন ইউভান ভাই? ভালোবাসার থেকেও ভয়ংকর এক জিনিস আছে তা হলো অস্পষ্টতা।
ইউভান চোখ বন্ধ করে আরুর চুলের সুবাস নেই। চুলের মধ্যে মুখ গুঁজে বলতে থাকে,
_ “অস্পষ্টতাই সবচেয়ে নিরাপদ সানসাইন। স্পষ্টতা কখনো কখনো মৃত্যু এনে দেয়।”
আনায়া আর কোন কথার উত্তর দিতে পারেনা সম্পূর্ণভাবে অচেতন হয়ে পড়ে ইউভানের শরীরের উপর। ইউভান অনুভব করতে পারে ছোট শরীরটি আর নড়াচাড়া করছে না সে এবার আনায়াকে পাজকোলে করে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে থামে একটি কাঠের তৈরি কুটিরের সামনে। । কুটিরটির কাঠের তৈরি পুরনো দরজাটি আধা খোলা। উপরের দিকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদের দিকে। যেখানে ছোট্ট একটি বারান্দা ঝুলছে। ইউভান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে কুটিরের ভেতর প্রবেশ করে। ঘরের এক কোণে কিছু পুরনো খর ছড়ানো ছিটানো ছিল। ওর উপরই আনায়াকে শুয়ে দেয়।ইউভান এক পলক আনায়ার মুখের দিকে চাই মুখটা ফ্যাকাশে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে, সাদা পোশাকের এক অংশ লাল হয়ে গেছে।
ইউভান দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় গাড়ির দিকে দৌড়ায়। গাড়ির দরজা খুলে ফার্স্ট এইড বক্সটা বের করে সে আবার কুটিরের দিকে ফিরে আসে। আনায়ার পাশে বসে দ্রুত তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে থাকে, ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দেয় সাবধানে।তার হাত যেন ব্যান্ডেজ করার সময় কেমন কেপে উঠছিল। তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে ইউভান । আনায়ার চোখের শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ সে এক আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে নিয়ে নিজের ঠোঁটে এনে আলতো করে স্পর্শ করে। গলায় ভারী একটা শ্বাস আটকে আসে। ফিসফিস কণ্ঠে সে বলে,
_”আই এম সরি সুইটি। আমি কন্ট্রোল করতে পারিনি।আমি চাইনি তোর চোখে কান্না আসুক কিন্তু কেন তোকে অন্য কেউ স্পর্শ করবে বল? ”
আনায়ার দিক থেকে কোন উত্তর আসে না সে তো সম্পূর্ণভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। ইউভান সে আনায়ার ছোট্ট শরীরটির উপর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
“ভাইয়া আনায়া এখনো বাসায় ফেরেনি তুমি কি জানো এই বিষয়ে কিছু? ”
আয়ান পিছন ফিরে রুহির দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে দৃষ্টি নিয়ে বলতে থাকে,
-“কথা হয়েছে আসলে ইউভানের ভাইয়ের কিছু জরুরী কাজ থাকাই আনায়াকে সেখানে নিয়ে গিয়েছে।একটু পরে চলে আসবে চিন্তা করার দরকার নাই। ”
রুহি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে উত্তর দিল,
_”ওহ আচ্ছা ঠিক আছে “।
বলেই পেছনদিকে ফিরে যখনই চলে যেতে লাগবে তৎক্ষণিক আয়ানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। রুহি থেমে যায়।
_”তোর না এক সপ্তাহ পরে পরীক্ষা।পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন। ”
_”হ্যাঁ ভাইয়া মোটামুটি ভালো”।
_”আচ্ছা ঠিক আছে যা। মন দিয়ে পড়াশুনা করবি বুঝলি?রেজাল্ট ভালো হওয়া চাই ডক্টর ম্যাম। ”
রুহি মুচকি হেসে উত্তর দিল,
_”উফফ দোয়া কর ভাইয়া। যেন খুব তাড়াতাড়ি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি “।
আয়ান কিছুটা হেসে বলে,
_”আমার দোয়া সবসময়ই তোদের উপর আছে। এবার যা গিয়ে পড়তে বস “।
রুহি চুপচাপ চলে যায়। আয়ান সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ তার চোখ যার ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে। সে সেটির উপর আলতো করে চুমু খেয়ে বলতে থাকে,
_”কিছু জিনিস গোপনেই সুন্দর ডক্টর ম্যাডাম “।
অন্ধকারে চোখ ধীরে ধীরে মেললো আনায়া। চারপাশটা ঘোলাটে লাগছে এখনো। মাথাটা ভারী মনে হচ্ছে। হাতটা ব্যথা করছে বুঝতে পেরে অন্য হাত দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করল মাথাটা। সে এবার উঠে বসে তার ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকায় তখনই মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগের ঘটনার কথা।
ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পায়ে হালকা কাঁপুনি লাগল। কোথায় আছে এখন? চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। একটা ছোট কুটিরের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামল সে। চারদিকে শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা। কারণ এখন রাত হয়ে গিয়েছে কিন্তু রুদ্ধ কোথায়? কোথাও দেখতে পাচ্ছে না তাকে।
বুকের মধ্যে ধুকপুকানি বাড়তে থাকে আনায়ার।
একটু সাহস করে সামনে পা বাড়াতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল রাস্তার ওপারে মেইন রোডের পাশে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আর গাড়ির ছাদে বসে আছে ইউভান। তার এক হাতে একটা বিয়ারের ক্যান, অন্য হাত গাড়ির ছাদে রাখা।
মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন গভীর কোনো ভাবনায় ডুবে আছে। রাস্তার হলুদ লাইটের আলোয় তার মুখটা স্পষ্ট দেখাচ্ছে। আনায়ার বুক ধক করে উঠল।আনায়া সাহসা কয়েক কদম সামনে এগুলো। তার হৃদয়ে এক আকাশ পরিমাণ অভিমান জমে পাথর হয়ে আছে। গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। তখনই ইউভান এক লাফে গাড়ি ছাদ থেকে নেমে আনায়ার সামনাসামনি এসে দাঁড়ায়। আনায়া হঠাৎ উপস্থিতে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে দু কদম পিছু হটে। ইউভান আনায়ার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলতে থাকে,
_”তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বস বাসায় ফিরতে হবে সবাই টেনশন নিচ্ছে। ”
আনায়া অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়।অবাক হয়ে বলে,
_”আপনি এসব কি ছাইপাশ খাচ্ছেন? ”
ইউভান এবার হাতে থাকা বেয়ারের ক্যান টা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর আয়েশ ভঙ্গিতে বলতে থাকে,
_”সবকিছুর কৈফত তোকে দেবো না চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বস। ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গিস না আমার আনু “।
আনায়া পাথর হয়ে যায় এতকিছুর পরেও এমন ভাবে কথা বলছে যেন কিছু হয়নি। সে অভিমানে বলতে থাকে,
_”কোথাও যাবনা আমি আপনার সঙ্গে। আপনি একা চলে যান আমি নিজে একা একা যেতে পারবো। ”
ইউভান চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল,
_”দেখ আনু আমি এখন তোর গায়ে হাত ওঠাতে চাচ্ছি না। আমার মেজাজ গরম করিস না চুপচাপ গাড়িতে উঠে বস। ”
আনায়ার চোখ ছলছল হয়ে উঠলো। কোন এক অজানা কষ্ট বুকে ভার করে বসে আছে তার। সে নাক টেন বলতে থাকে,
_”আপনি আমাকে মারলে আমি এবার বাসার মামনি কে বলে দিব যে তার ছেলে শুধু শুধু আমাকে মারে।”
ইউভানের কিছুটা কপাল কুঁচকে গিয়ে বলতে থাকে,
_”থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেবো বেয়াদপ।কলেজে গিয়ে যেগুলা করেছিস সেগুলো আমি চাচ্চুকে বলে দিই। তখন তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে কোন রিক্সাওয়ালার সঙ্গে খুব ভালো হবে। ”
আনায়া হতভম্ব হয়ে যায়।তারপর রেগে গিয়ে বলে,
_”আপনার যা মন চায় তাই করুন ইউভান ভাইয়া। আপনি খুব খারাপ কখনো আমার সঙ্গে একটু ভাল মত কথা বলেন না। একটু ভালোমতো কথা বলে কি হয় হুমম।সব সময় আমাকে চড় মারার হুমকি দেন আপনি। অথচ ওই তানহা আপুর সঙ্গে ঠিকই মিষ্টি করে কথা বলেন। শুধু আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার মুখের ভাষা তেতো হয়ে যায়।
ইউভান বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলে,
_”কারণ তুই এটার যোগ্য। এখন তুই গাড়িতে উঠবি নাকি আমি তোকে এখানে ফেলে চলে যাব। ”
আনায়া অবাক নয়নের ইউভানের পানে চায়। একে তো তাকে মেরেছে তার ওপর আবার তাকে একা ফেলে রেখে যাওয়ার কথা কিভাবে বলছেন ইউভান ভাই।কোথায় একটু নরম কথা বলে রাগ ভাঙ্গাবে তা না তার উপর আবার হুমকি ধমকানি দিচ্ছে। তার বড্ড অভিমান হয়।অভিমান বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে তার।
ইউভান কোন উত্তর না পেয়ে গাড়িতে উঠে বসে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। আনায়া এবার হতভম্ব হয়ে যায় সম্পূর্ণ তার প্রত্যাশার বাইরে ছিল এসব কিছু। ইউভান তাকে সত্যি সত্যি একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছে। আনায়া এবার হাউমাউ করে কান্না করে চারদিকে তাকায়। কেউ না এখানে পুরো নির্জন রাস্তা চারদিকে শুধু ঘন কালো গাছপালা জঙ্গল। সেবার উলটো পথে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে সারা শরীর কেমন যেন কাপছে। চারদিক তাকিয়ে নাক টেনে বলতে থাকে,,
_”অসভ্য বদমাশ বুইরা ফকস্টার কত বড় সাহস আমাকে একা ফেলে চলে যায়। আমি এর বিচার দিব বাসায় গিয়ে। সবকিছু বিচার দিব আমি আমাকে অবলা পেয়ে অত্যাচার করেছিস তুই। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে শালার অসভ্য ব্যডা।
অন্ধকার রাস্তায় একা একা হাঁটতে হাঁটতে আনায়া আপন মনে বকবক করছে। নিজের মনের ভয়কে ঢাকতেই এই কাজটি করা তার। চারদিকে সম্পূর্ণ অন্ধকার কিন্তু তাও সে এগিয়ে যাচ্ছে।যে করেই হোক একাই বাড়ি ফিরবে আজ।
কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে বিকট শব্দে দুইটা বাইক ফুল স্পিডে এসে তার পাশ কাটিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। গা শিরশির করে উঠল তার। বাইকের আলো চোখে লাগছিল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর মুখ ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। তবে তাদের হাসির ভঙ্গিটা ছিল স্পষ্ট। এরই মধ্যে একজন ছেলে বলে উঠলো,
—”এই যে ম্যাডাম, রাতের এই সময় একা একা কই যাও?
_”আরে মামা আজকে তো ফুলটুসি পেয়েছি আজকের রাত আমাদের। ”
সঙ্গে সঙ্গে আনায়ার শরীরটা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেল। ছেলেগুলোর কণ্ঠে উপহাস স্পষ্ট। একটার পর একটা বাজে কথা ছুঁড়ে দিতে লাগল তারা।
—”কী ম্যাডাম, গার্ডিয়ান নাই নাকি তোমার?”
—”আমরা একটু সাহায্য করতে পারি, একা একা রাস্তা পার হওয়া কষ্ট হবে তাই না?”
—”উফফ! কী ভয় পেয়েছো! ভয় পেলে কিন্তু মজাটা আরও বাড়বে কি বলিস তোরা? ”
আনায়া আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারল না। সহ্য করতে না পেরে দৌড় দিল উল্টো দিকে। এত জোরে দৌড়াচ্ছিল যেন মনে হচ্ছিল পা নাড়াতে দেরি হলেই কিছু একটা ভয়ানক ঘটে যাবে। কিন্তু ছেলেগুলোও সহজে ছাড়ার পাত্র না। বাইক স্টার্ট দিয়ে পেছন পেছন ধাওয়া করল।আনায়া এক মুহূর্তের জন্যও থামল না। দম ফুরিয়ে আসছে।পা ব্যথা করছে তবুও সে যতটা জোরে সম্ভব দৌড়াচ্ছিল। বাইকের শব্দ যত কাছে আসছিল, তত তার নিশ্বাস দ্রুত হচ্ছিল।
তবে হঠাৎই সামনে একটা গাড়ি ফুল স্পিডে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আনায়া আরেক পা ফেললেই হয়তো ধাক্কা লাগত, কিন্তু শেষ মুহূর্তে গাড়িটা ব্রেক কষে থেমে গেল।ধক করে উঠল আনায়ার বুক।কিছুটা আশার আলো দেখতে পেল। আতঙ্কে পেছনে তাকিয়ে দেখল বাইকও থেমে গেছে কিছু দূরে। এরপর ধীরে ধীরে গাড়ির দরজা খুলে ইউভান বেরিয়ে আসলো।
আনায়া সেদিকে তাকিয়ে ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। রুদ্ধর চোখ গুলো কেমন শীতল বোঝাই যাচ্ছে না রেগে আছে নাকি শান্ত রয়েছে। পেছনের ছেলেগুলো বাইক নিয়ে উল্টো পথে চলে যায় ইউভান একবার সেদিকে তাকায়। তারপর আবার দৃষ্টি স্থির করে আনায়ার দিকে।আনায়াকাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইউভান গর্জে ওঠে,
_”এখানে দাঁড়িয়ে আর একটা কথা বলে তোর কলিজা টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি বেয়াদব ”
আনায়া ফ্যল ফ্যল চোখে তাকায় ইউভানের দিকে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসে। সে এখন কোন মার খেতে চায় না ইউভানের হাতে। আজ বাড়ি গেলে এর একটা ব্যবস্থা করে ছাড়বে সে। ভয়ে তার সমস্ত শরীর কাঁপছে।
ইউভান একেবারে স্টিল হয়ে ড্রাইভ করছে, আধা ঘণ্টা ধরে একটা কথাও বলেনি। পাশে বসে থাকা আনায়ার মুখ গোমড়া। অবশ্য তার চেয়ে বেশি মনোযোগী এখন তার পেট। ইঁদুর, তেলাপোকা, ব্যাঙ সব একসাথে দৌড়াদৌড়ি করছে ভেতরে।সে বারবার গাড়ির সিটে নড়াচড়া করছে। একবার এদিক বসছে, একবার ওদিক বসছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট একটা গোঙানির মতো আওয়াজও বেরিয়ে যাচ্ছে তার গলা দিয়ে।
ইউভান অবশেষে বিরক্ত হয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
আনায়া সুযোগ হাতছাড়া করার মেয়ে না। সাথে সাথে একগাল হাসি দিয়ে বলে উঠল,
“ইউভান ভাই, আমার পেটে ব্যাঙের বাচ্চারা লাফাচ্ছে!”
ইউভান থতমত খেয়ে সন্দেহভরা চোখে পেটের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
_”শেষ পর্যন্ত ব্যাঙকেও ছাড়লি না! এবার একটা ব্যাঙের বাচ্চার মা হয়ে গেলি?
আনায়া ফ্যল ফ্যল চোখের ইউভানের পানে তাকায় ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত মুখে বলল,
_”ব্যাঙের মা না। আমি ক্ষুধার্ত বুঝলেন?”
ইউভান হালকা এক চিলতে হাসি লুকিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে বলল, “ওহ তার মানে তোর ব্যাঙের বাচ্চা গুলোর ক্ষুধা লেগেছে।আচ্ছা তাহলে তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করছি। ”
আনায়া এবার বুঝতে পেরেছে ইউভান তার সঙ্গে মজা করছে। সে নাটকীয় ভঙ্গিতে পেট চেপে বলল,
_”ততক্ষণে ব্যাঙের বাবা এসে আমার পাকস্থলীর দখল নিয়ে নেবে।”
ইউভান এবার সত্যিই একটু হাসল।তারপর ফোনে কাউকে যেন কিছু টেক্সট করলো ইউভান। হঠাৎ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামে তাদের বাড়ির সামনে। আনায়া গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এখন প্রায় রাত এগারোটা সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে।
তৎক্ষণিক চোখ যায় রান্নাঘরে খাবার নিয়ে বসে থাকা আয়ানের দিকে। ইউভান পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ায়। আয়ান ঘুমো ঘুমো চোখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
_”তোদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তোর নাকি ক্ষুধা লেগেছে নে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি বরং রুমে যাই সকালে অফিস আছে এখন না ঘুমালে দেরি হয়ে যাবে অফিসে যেতে। ”
আনায়া একবার ইউভানের দিকে তাকায়। তারপর ছোট্ট করে উত্তর দেয়,
_”ঠিক আছে ভাইয়া।”
আয়ান উপরে ওঠার আগে ইউভানকে কিছু একটা ইশারা দিয়ে বলে। যার কারণে ইউভান আয়ানের পেছনে পেছন উপরে উঠে যায়। আনায়া সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে খাবারে টেবিলে খেতে বসে। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য তার পেটের ভিতর ইদুর, বিড়াল, ব্যাং গুলোকে শান্ত করা।
রাতে খাবার শেষ করে সোজা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে আনায়া।পুরো দিনের কথা চিন্তা করে আজকে যা কিছু হয়েছে সবকিছু অপ্রত্যাশিত ছিল তার কাছে। ইউভানের এমন আচরণের কারণ স্পষ্ট ভাবে আনায়া বুঝতে পারেনা। তবে আনায়া এত সহজে সবকিছু ভুলে যাবে না।সে নিজেকে আটকে রাখবে ইউভানের কাছে যাওয়ার জন্য।ইউভান এখন অন্য কারোর কথাটা চিন্তা করতে আনায়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।পরমুহূর্তে তাচ্ছিল্য হেসে নিজের চোখের পানি নিজের মুছে নেয়।সে কেন কাঁদবে ওই পাষাণ লোকের জন্য। তার চোখের পানি তার কাছে অনেক মূল্যবান কাঁদবেনা সে। এসব চিন্তা-ভাবনা করতে করতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেয় আনায়া
গভীর রাতে মেঘের তীব্র গর্জনে আরুর রুমের জানালাগুলো কেঁপে ওঠে। পর্দাগুলো এলোমেলোভাবে উড়তে থাকে।বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার তীব্রতা অনুভূত হয়। আনায়া ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে চারদিকে তাকায়। আবছা অন্ধকারে চারপাশটা যেন আরও ভয়ঙ্কর লাগছে। আনায়া এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে বাইরে বৃষ্টি হবে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। ধীর পায়ে উঠে জানালাগুলো বন্ধ করে। এরপর বেলকনির দিকে এগোয়। দরজা লাগাতে গিয়ে কিছুটা থেমে যায়। বাইরে মৃদু বাতাস বইছে তার পরশ স্নিগ্ধ। চোখ বন্ধ করে বাতাসের পরশ অনুভব করে আনায়া। তার পরনে সাদা ফ্রক টপস, বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা পড়ে। আনায় হাত বাড়িয়ে দেয়, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো স্পর্শ করে। সেই মুহূর্তে তার চোখ আটকে যায় বাগানের এক পুরোনো কদম গাছের দিকে। গাছের ছায়ায় কিছু একটা রয়েছে। চারদিকে এত অন্ধকার তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন বসে আছে।
গাছের সঙ্গে ঝুলতে থাকা দোলনাটা হাওয়ায় দুলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকালো মুহূর্তের জন্য ছায়াটি স্পষ্ট হয়ে উঠল। এবং ঠিক তখনই, বৃষ্টি তীব্র হয়ে ঝরতে শুরু করল। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারে না সে। ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নামে। চুপি চুপি সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ বৃষ্টির শব্দে অন্য কিছু শোনা যাচ্ছিল না।কিন্তু এখন স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে গিটারের মর্মস্পর্শী সুর।গিটারের সুরে অষ্টাদশীর সমস্ত দুঃখ, সমস্ত সুখ একসাথে মিশে যায়।ঠিক যেমন বৃষ্টি মিশে যায় মাটির গন্ধে।
সে এবার ধীরে ধীরে এগোতে থাকে, পা রাখে ভেজা মাটিতে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার গা বেয়ে নেমে আসছে।সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ আটকায় সামনে থাকা মানবের উপর ইউভান গায়ে সাদা শার্ট, বৃষ্টিতে ভিজে তার শরীরে লেপ্টে গেছে। হাতের গিটার এখনো বাজছে। আনায়া না চাইতেও সামনের দিকে এগিয়ে আসে।
আজ তিনদিন যাবত গিটারের আওয়াজ তার কানে আসে না। অথচ সে প্রতিদিন রাতে জেগে থাকতো এই গিটারের আওয়াজ আর গানের গলা শোনার জন্য। ইউভানের থেকে সে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে। সঙ্গে সঙ্গে তার কানে ভেসে আসে সেই গানের কণ্ঠ,
কিউ এক পালকি, ভি যুদাই সাহি জায়ে না 🎶
কিউ আর সুভা তু, মেরে সাসোমে সামায়ে না🎶
আজানা তু মেরে পাসস,দুঙ্গা ইতনা পেয়ার মে 🎶
কিতনি রাত গুজারি হে, তেরে ইন্তেজার মে 🎶
কেসে বাতাউ জাজবাত এ মেরে🎶
মেনে খুদ সে ভি জাদা, তুঝে চাহা হে 🎶🎶
সব কুছ ছোড়কে আনা তু, সাবান আয়া হে🎶🎶
তেরে ওর মেরে মিলনে কা মসম আয়াহে 🎶
আনায়া চোখ এখনো বন্ধ। কদম ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ গিটারের আওয়াজ থেমে যায়। কেমন যেন সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়। এমন সময় কোমরে এক শীতল স্পর্শ পায়।সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যখন অনুভব করে কারোর গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড় ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার পিঠের সঙ্গে শক্ত একটা বুকের স্পর্শ টের পায়। শিহরণ বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।আনায়া কিছু বলার আগেই ইউভান হেচকা টান দিয়ে কোমর ধরে আনায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
আনায়া চোখ খিচে বন্ধ করে চারদিকে বৃষ্টির ঝিনঝিন আওয়াজ।। সবকিছু যেন মুহূর্তেই শীতল হয়ে যায়। পুনরায় ইউভান আনায়ার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে মিষ্টি কন্ঠে গান গাই,
ভিগে ভিগে তেরে 🎶
লাব মুজকো কুছ কেহতে হে 🎶
দিল হে খুশ মেরা🎶
কে খেয়াল লেকি জেসি হে🎶
আনায়ার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। সে হাত দিয়ে ইউভানের দূরে সরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু ইউভান শক্ত হাত তাকে একচুলও সরতে দিচ্ছে না। ইউভান আনায়াকে গানের তালের সঙ্গে সঙ্গে নাচাচ্ছে। এক হাতে আনায়ার গালের লেগে থাকা ভেজা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে পুনরায় ঘোর লাগানো ধীর কন্ঠে গেতে থাকে,
রো কোনা না আব খুদকো ইউ,🎶🎶
শুনলে দিল কি বাত কো 🎶🎶
ঢাল জানে দো শাম অর🎶🎶
আজানে দ ও রাত কো 🎶🎶
কিতনে হাসিন ইয়ে লামাহা হে 🎶🎶
কিসমাত সে মেনে চুরায়া হেহে🎶🎶
বৃষ্টির প্রতিটা ফোটা আনায়ার শরীর জুড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। অথচ এই শীতলতার ভেতর ইউভানের উষ্ণ স্পর্শ তার রন্ধে রন্ধে মিশে যাচ্ছে। হঠাৎ ইউভান আনায়ার কোমর ধরে কিছুটা উঁচু করে নিজের পায়ের উপর দাঁড় করায়।
আনায়া বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।সে শক্ত করে ইউভানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে।ইউভান আনায়ার দুই গাল আলতো হাতে ধরে মাথা ঠেকিয়ে দেয় তার সঙ্গে।বৃষ্টির শব্দ মিলিয়ে যায় তাদের নিঃশ্বাসের ভেতর। একে অপরের মুখের ওপর উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ে।তারপর, নরম স্বরে ইউভান আবার গান গাইতে শুরু করে,,
আজকি রাত না জানা তু সাবান আয়া হে🎶🎶
তেরে আর মেরে মিলনে কা মৌসাম আয়াহে 🎶🎶
সাবসে ছুপা কে তুঝে সিনেসে লাগানা হে🎶🎶
পেয়ার মে তেরে হাদ সে গুজার জানাহে 🎶🎶
ইতনা পেয়ার কিসি পে পেহলি বার আয়া হে🎶🎶
ওওওও ওওওওওও🎶🎶
চারপাশ স্তব্ধ। শুধু শোনা যায় বৃষ্টির তীব্র আওয়াজ। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকানো আলোতে ভেসে ওঠে দুটি মানব-মানবীর গভীর উত্তেজনায় মোড়া ছায়া।আনায়ার শরীর কাঁপছে। বৃষ্টির ফোঁটা তার চোখের পাপড়িতে জমে ভারী হয়ে আসছে।শ্বাস অগোছালো হয়ে পড়ছে।ইউভান গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি নিয়ে ভারী গলায় বলে,
_”আমার স্পর্শ তোকে এত কাঁপাচ্ছে কেন সানসাইন?”
আনায়া চুপসে যায়। বুকের ভেতর উত্তেজনার এক অজানা ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সে শক্ত করে দুই হাত দিয়ে ইউভানকে সামান্য ঠেলে দেয়। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে দাঁড়ায় শ্বাস ধরা গলায় বলে ওঠে,
_”আমাকে এভাবে ছোবেন না ইউভান ভাই।”
ইউভান প্রশ্ন করে ওঠে,
_”কেন ঝলসে যায় ”
আনায়া কাঁপা কণ্ঠে বলে,
_আ আমি জ জানি না।
ইউভান দু কদম এগিয়ে এসে বলে,
__ জানিস না? তাহলে তোর চোখ এত কথা বলছে কেন? তোর শ্বাস এত এলোমেলো কেন?
আনায়া নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলে,
_ এ এ ট টা শুধু বৃষ্টি শীত ক করছে তাই।
ইউভান আনায়ার চিবুক ধরে মুখটা নিজের দিকে তোলে,
_ তোতলাচ্ছিস কেন উমমমম।আমারে স্পর্শ এতটা কাবু করে ফেলেছে তোকে সানসাইন।
আনায়া পুনরায় চিবুক নামিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
_ আ আমি পালিয়ে যেতে চাই।
ইউভান গভীর দৃষ্টি নিয়ে বলে,
__ পালিয়ে যাবি? কোথায় যাবি? যেখানে আমি নেই? যেখানে আমার ছোয়া পৌঁছাবে না?
আনায়া চোখ খিচে বন্ধ করে বলে,
__ আমি কিছু জানি না শুধু এটুকু জানি আপনার স্পর্শ আমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
ইউভান গভীর কন্ঠে বলে শুধাল,
__ তাহলে পুড়ে যা।
আনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সবকিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
_ইউভান ভাই প্লিজ।
ইউভান এবার আনায়ার গালে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
_ প্লিজ কী? আমাকে থামাতে চাস? না কি চাস যে আমি তোকে আরও গভীরভাবে ছুঁই?
আনায়ার শ্বাস আটকে আসে,
_ আমি বাসায় যাব।
ইউভান কোমরে হাত রেখে আবার কাছে টেনে নিয়ে বলে,
_ যদি না দিই? যদি এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে তোকে বন্দি করে রাখি?
ইউভান খেয়াল করে আনায়ার পুনরায় কাঁপছে। আনায়ার জোরে চলা স্পন্দন এর আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে। সে অস্থির হয়ে বলতে থাকে,
_ “আমি তোকে ছুঁলে তুই কাঁপিস। অথচ তুই জানিস না, তোর একবার ছোঁয়াতে আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাই।”
এমন কথা কানে পৌঁছাতে আনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে অবাক নয়নে ইউভানের পানে চাই। ইউভান এবার তাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। আনায়া দম ছেড়ে বাঁচে গভীর নিঃশ্বাস নাই।
চারদিকে বৃষ্টিও কিছুটা কমে আসছে। আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে এক মুহূর্তে দৌড়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। রুমের দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সোজা আনায়া।আয়নার সামনে নিজের ভেজা শরীর দেখতে থাকে। কেমন যেন তার সমস্ত শরীরে এখনো ইউভানের স্পর্শ লেগে আছে আষ্টে পাস্টে ঘিরে। আনায়া আয়নার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলতে থাকে,
“আমি ছুঁয়ে দিলে আপনি কেন পুড়ে যান ইউভান ভাই।আমি না হয় আপনাকে ভালোবাসি বলে আপনার স্পর্শ আমাকে কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু আমার স্পর্শ কেন আপনাকে পরিবর্তন করবে কি হই আমি আপনার?”
আনায়া এক হাতে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। সবকিছু যেন ধোঁয়াশা লাগছে। ইউভান চাইটা কি সেটা আনায়ার কাছে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে ইউভানের ভিন্ন রূপের সঙ্গে মোকাবেলা করতে আর পারছে না আনায়া।
একটি অন্ধকার রুমে তিনটা ছেলেকে রিং এ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ছেলেদের মুখ বাধা চোখমুখে আতঙ্কের ছাপ। তারা আর কেউ না বরং আজকের বাইকের ওই তিনটি ছেলে যারা আরুকে উত্তপ্ত করেছে। ঘরে অন্ধকার কিছুক্ষণের মধ্যে আলোকিত হয়ে যাই। দরজা খুলে রুমের অন্ধকার কাটতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।পুরুষটি উঁচু লম্বা,প্রায় ছয় ফুটের বেশি উচ্চতা, সুগঠিত দেহ, চওড়া কাঁধ আর শক্তপোক্ত শরীরের অধিকারী।
ছেলেগুলো আতঙ্ক চোখে সামনে থাকা পুরুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার পরনে ওভার কালো কোট যা হাঁটুর নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে।কোটের কাঁধ ও বাহুর অংশে সূক্ষ্ম সিলভার স্টিচিং। তার বুকের এক পাশে একটি ছোট Signet Brooch বসানো। যার মাঝে হীরের উপর খোদাই করা “D.C” চিহ্নটি জ্বলজ্বল করছে।কিন্তু লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছিল না।সে একটি কালো রঙের ড্রাগন মাস্ক পড়েছিল, যার ডান দিকের চোয়াল ও গালের অংশ ঢাকা। এই মুখোশের উপরে সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা একটি ড্রাগনের মুখ।
লোকটি এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে ছেলেগুলোর দিকে। ছেলেগুলো আতঙ্কে কাঁপতে থাকে,তাদের নিঃশ্বাস তীব্র হয়ে উঠেছে।মুখোশধারী লোকটি এক ইশারায় গার্ডদের নির্দেশ দেয়।মুখোশধারী লোকটির পেছনে বিশ জন গার্ড সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মাথা নত করা। তাদের মধ্যে একজন দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে।ছেলেগুলোর মুখের কাপড়টি টেনে খুলে দেয়।
_ “প্লিজ! আমাকে ছেড়ে দিন! আমরা কিছু করিনি!”-একজন ফুঁপিয়ে ওঠে।
কিন্তু অন্যজন চোখে আগুন নিয়ে ফোঁস করে ওঠে,
_ “শুয়ো*** বা***চ্চা! পারলে আমাকে খুলে দে! তখন দেখ তোর কী অবস্থা করি!”
তার কথা শেষ হতে না হতেই মুখোশধারী লোকটি ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা হাসি ফেলে। সে কোনো উত্তর দেয় না, শুধু হাত তুলে এক ইঙ্গিত করে।এরপরই গার্ডদের একজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সামনে এসে ছেলেগুলোর পায়ের নিচে লালচে-কমলা আগুন জ্বালতে থাকে।তারপর কয়লা উল্টে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে পুড়তে থাকা কয়লাগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে-প্রচণ্ড উত্তাপে চারপাশ গনগনে হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলোর পায়ের নিচের চামড়া চিড় চিড় করে ফেটে যায়।
“আআআআআহহহহ!!”
গরম কয়লার অসহ্য দহন শরীরে ছড়িয়ে পড়তেই তারা একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে।এরই মধ্যে মুখোশধারী লোকটি উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। এই হাসির ঝিলিক দেখে ছেলেগুলা আরো বেশি ভয় পেয়ে যায়।যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একটি ছেলে বলে,
_”আমরা কি করেছি? আমাদের কেন এভাবে দূরে এনে মারা হচ্ছে?
মুখোশধারী লোকটি নিশ্চুপ। এবার একটি গার্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাথা নিচু করে বলে,
_”তোমরা বিশাল বড় ভুল করেছো। কিং অফ ডার্কনেস D.H এর জিনিসের উপর চোখ তুলে তাকিয়েছো। ”
ছেলেগুলো ভয়ে চুপসে যায়। আতঙ্ক চোখে মুখোশধারী লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
_”আমাদের দয়া করে ছেড়ে দিন। আমাদের এত বড়
শাস্তি দেবেন না দয়া করুন।”
নীরবতা কাটিয়ে মুখোশধারী লোকটি বলে,
_”ইউ ডেয়ারড টু লুক এট মাই গোল্ডমেরি, নাও ইউ মাস্ট বি পানিসড ফর দিস।এন্ড এজেএ পানিশমেন্ট আই নিড ইউর লাইভস।”।”
সঙ্গে সঙ্গে মুখোশধারী চোখ রক্তের মতো লাল হয়ে যায়। সে একটি গার্ডকে ইশারা করে সঙ্গে সঙ্গে গার্ড টি একটি বড় চাপটি নিয়ে আসে।এক মুহূর্ত দেরি না করে যে ছেলেটি গালি দিয়েছিল ওই ছেলেটির হাত বরাবর একটি কোপ মারে। সঙ্গে সঙ্গে হাত শরীর থেকে আলাদা হয়ে নিচে পড়ে। মেঝেতে রক্ত বিছিয়ে যায়।ছেলেটি গণহারে চিৎকার করতে থাকে। ছেলেটি আর তাকিয়ে থাকতে পারে না অজ্ঞান হয়ে যায়।
অপরজন পাগলের মতো বাঁধন ছুটিয়ে পিছু হটতে চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই করতে পারে না। তার পায়ের নিচের চামড়া পুড়ে গিয়ে কালো হয়ে যাচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে।
_ “প্লিজ! প্লিজ থাম ! আর পারছি না!”
ছেলেগুলোর এমন আর্তনাদ মুখোশধারি লোকটির তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। সে এবার উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে,
_”আরো আরো জোরে চিৎকার কর। আমি তোদের চিৎকারের আওয়াজ শুনতে চাই।”
তাদের একেকজনের শরীর শিউরে উঠছে, গরম কয়লার আঘাতে পায়ের মাংস আলগা হয়ে যাচ্ছে, ছিন্নভিন্ন চামড়া লেপ্টে থাকছে পোড়া কয়লার গায়ে।তখনই মুখোশধারী লোকটি আরেকজন গার্ডের ইশারা দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে গার্ডটি একটি বড় এসিড স্প্রে ক্যন নিয়ে আসে। ছেলেগুলো ভয়ে সে দিকে তাকায় তারা বুঝতে পারছে না তাদের সঙ্গে এখন কি হতে চলছে।আর দেরি না করে একটি ছেলের সমস্ত শরীরে স্প্রে মারতে থাকে গার্ডটি ।
সঙ্গে সঙ্গে এসিডের উত্তাপে ছেলেটির শরীর থেকে মাংস খসে খসে পড়ে। ছেলেটি জোরে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকে। এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে অপরজন আপনা আপনি স্তব্ধ হয়ে যায়।একজন ছেলে তো এক হাতে এখনো রক্ত পড়ছে এবং সে এখনো পর্যন্ত অজ্ঞান হয়ে আছে।
মুহূর্তের মধ্যে ছেলেটির শরীরে কিছু অবশিষ্ট থাকলো না মাংস পুরে খসে নিচে পড়ে গিয়েছে। এমন দৃশ্য দেখে অপর পাশের ছেলেটির প্রায় বমি চলে আসে। সমস্ত ফ্লোর রক্তে বিছিয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে একটি ছেলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মুখোশধারী লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ৭
_”কে তুমি? ”
মুখোশধারী লোকটির ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। সে এবার পাশে থাকা গার্ডের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকয়।এরপর ঠাড্না কন্ঠে বলে উঠলো,
_”আই এম দা কিং অফ ডার্কনেস ড্রেভেন হানটার।”