মায়াকুমারী পর্ব ২৮
মেহেরিন আনজারা
ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাতেই আকস্মিক একের পর এক করাঘাত পড়তে লাগলো দরজায়। চমকায় দু’জন।
“ছাড়ো বলছি!”
ভীষণ রাগ হলো নিশুর।
“বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে তার কনসেন্ট ছাড়া জোর করে ইন্টিমেন্ট হওয়াকে ম্যাটেরিয়াল রেপ বলে। আমি ম্যাটেরিয়াল রেপের বিপক্ষে! আর তুমি এখনও ক্লিয়ার করোনি আদোও ডিভোর্স হয়েছে কি-না। এনিওয়ে,পারমিশন ছাড়া পার্টনারের সঙ্গে জোর করে ইন্টিমেন্ট হওয়া উচিত নয়! কন্ট্রোল ইওর সেল্ফ! তুমি এখন তোমার মধ্যে নেই। ক্ষুধার্ত হিংস্র হয়ে উঠেছো। এই মুহূর্তে তোমাকে নয় আমি একটা বন্য হিংস্র হায়েনাকে দেখতে পাচ্ছি!”
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো,মস্তিষ্ক টগবগ করতে লাগলো। হুট করে ছেড়ে দিলো। ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিশু।
“সাড়ে এগারো বছর আমার মুখ দেখতে চাওনি! এক মিনিট ফোন দিয়ে খোঁজখবর নাওনি,কথা বলোনি,আমার লাইফের বারোটা বাজিয়ে চলে গেলে। আমি কেমন আছি,কেমন ছিলাম একটুও জানার প্রয়োজন হয়নি। মানুষের ঘাড়ের উপর বোজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলে। এমন তো নয় যে তোমার কাছে আমাকে নেওয়ার সুযোগ ছিল না! ছিল কিন্তু তুমি নাওনি। অফার করেছিল তোমার বাবা কিন্তু তুমি রিজেক্ট করলে। এখন দেখা হওয়া মাত্রই বিছানায় নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছো! যে লোক আমার মুখটা দেখতে চাইতো না এখন সে বলে কিনা আয় বাসরটা সেরে ফেলি কেমন এত অপেক্ষা সয় না। তোমার প্রতি আরো ঘৃণা বেড়ে গেল। তুমি জাস্ট আমার শরীর চাচ্ছ মন না। তুমি ফিজিক্যাল রিলেশনকে প্রায়োরিটি দিচ্ছ আমার মেন্টালিটি না। আমি শারিরীক-মানসিক উভয় রকম ফিট আছি কি-না একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পড়লো না। আমি বুঝতে পারছি না এটা কেমন সম্পর্ক! এই সম্পর্কের ভিত্তি কোথায়?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বিছানা থেকে নেমে গেল ধ্রুব। রাগে-জিদে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বেরুতেই মুখোমুখি হলো রিনা খালার। ছাঁদ থেকে শুকনো কাপড়চোপড় তুলে এনেছেন তিনি। ধ্রুবকে দেখতেই ভ্যাবাচ্যাকা খায়। চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব। সন্ধ্যার আযান হচ্ছে চারদিকে। শাড়ি ঠিক করে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকলো। রুমে ঢুকলো দ্যুতি। হাত-মুখ ধুয়ে এলো নিশু।
“নিশু তোদের মধ্যে কিছু-মিছু হয়েছে?”
“না।”
“আবার ফিরিয়ে দিলি?”
“তো কী করবো!”
“কাজটা ঠিক হয়নি!”
“কোনো কনসেন্ট ছাড়াই সে বারবার পাগলামি করছে বিষয়টি আমার কাছে খুবই বিরক্তকর। আমি এখন এইসবের জন্য প্রস্তুত না।”
“কী আশ্চর্য রকমের কথাবার্তা!”
“তার সাথে আমার কোনো কথাবার্তাই হয়নি,আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি; এখানে ইনভলভ হওয়ার কথা কীভাবে এলো?”
“আজীবন এই রকম থাকবি তোরা?এই রকম টম এন্ড জেরির মতো দ্বন্দ্বে দ্বন্দ্বে কাটবে তোদের দিন? মানুষ হবি না তোরা?”
“বাসর রাত নিয়ে প্রতিটি মেয়েরই কমবেশ স্বপ্ন থাকে। আমি চাই আমার বাসর সুগন্ধিময় পুষ্পসজ্জিত বিছানায় হোক! কুকুর-বিড়ালের মতো চিপায়-চাপায়,অলিতে-গলিতে না। কারণ আমার ইজ্জ্বতেরও আত্মসম্মান আছে। তাকে ভালোবাসি ঠিক কিন্তু তার মানে এই না যে সে চাইলো আর আমিও আমার সম্ভ্রম তুলে দিবো! এতটাও সহজলভ্য আমি নই। বললাম তো,আমার সম্ভ্রমেরও আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আমার শ্রেষ্ঠ জিনিসটা আমি তাকেই উপহার দিতে চাই যে আমার যোগ্য! উলু বনে মুক্তো ছড়ানোর মতো মেয়ে আমি নই! আমার আত্মারও আত্মসম্মান আছে। আমার ভালোবাসারও আত্মসম্মান আছে। আর আত্মসম্মানবোধ আমার কাছে প্রেম-ভালোবাসার চাইতেও ভীষণ প্রিয়! রাগ-তেজ,জেদ,সাহস এবং সততা এগুলো আমার অলংকার,গর্ব! একজন নারীর অলংকার। আমি সহজে কারও কাছের হই না আবার নিজেকে সহজও বানাই না। মানুষকে যত্ন করি ঠিক কিন্তু বন্ধনে জড়াতে দ্বিধাবোধ করি; একশোবার ভাবি।”
“বউ সাজতে চাইছিস?”
“কেন বউ সাজবো না! মেয়েরা নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাজেই তো ওই বিয়ের দিন। প্রতিদিন মেয়েদের ওতো বউ সাজার সার্মথ্য কই! আর প্রতিটি মেয়েরই স্বপ্ন সে বেনারসি পরে লাল টুকটুকে বউ সাজবে,সানাই বাজবে,ফুলে ফুলে ভরা বাসর ঘরে মাথায় ঘোমটা টেনে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে। শেরওয়ানী পরে স্বামী আসবে,তারপর বউয়ের ঘোমটা তুলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে,তাকে দেখবে,প্রশংসায় ভাসাবে,টুকটাক কথা হবে। এরপর পুষ্পসজ্জিত বিছানায় দুজনের প্রথম মিলন হবে। এটা তো প্রতিদিন হবে না একদিনই।”
“বুঝতে পারলাম বাসর নিয়ে তোর অনেক প্ল্যান।”
“আর সে ডিভোর্সের বিষয়টি ক্লিয়ার করেনি। আমি মানসিক রোগী হতে পারি কিন্তু বিবেকহীন নই। সে যতক্ষণ না নিজ মুখে ক্লিয়ার না করছে ততক্ষণ অব্ধি আমি ধরা দিচ্ছি না। আর আমাকে সরি বলতে হবে। সাড়ে এগারো হাজারবার সরি বলতে বলেছি। ওতবার বলতে না পারলে তিনবার বললেই হবে।”
“তুইও তো দেখি কম না!”
“সে বুনো ওল হলে আমিও বাঘা তেঁতুল। সে পুরুষ বলে তার জিদ,ইচ্ছে বেশি প্রাধান্য পাবে তা তো হবে না। আমরা নারীরাও মানুষ।”
“এমন জিদ ধরে তুই না আবার হারিয়ে ফেলিস। পুরুষ মানুষ যেখানে সুখের সন্ধান পায় সেখানেই ছুটে যায়। তোর কপালে কী আছে আল্লাহ জানে।”
“আমি কি নিজেকে সামলে নিইনি সে-যে একবার আমাকে ভেঙে দিয়ে গেল? ঠকতে ঠকতেই দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন জিতে নেওয়ার কৌশলটাও রপ্ত করতে জানতে হয়।”
“আমি আর তোদের মধ্যে নেই বাপু! তোমরা দু’জন টম এন্ড জেরি খেলো। অনেকদিন কার্টুন আর টিভি দেখা হয় না মোবাইলের চক্করে। তোদের দু’জনের টম এন্ড জেরির খেলা দেখবো এখন থেকে। বাই দ্যা ওয়ে,যা করার ভেতরে ভেতরে কর। আব্বু-আম্মু যেন টের না পায়। হাসিখুশি থাকবি উনাদের সামনে। আর তোকে একটা আইডিয়া দিই।”
“কীসের?”
“এতদিন আড়ালে থাকতি। এখন তো প্রয়োজন নেই। তুই বরং এখন ওর সামনে বেশি বেশি থাকবি আর ভাইয়াকে জব্দ করার একটা টিকস শিখিয়ে দিই।”
“কীসের?”
“ভাইয়া ডাকবি। বেশি বেশি করে ভাইয়া ডাকবি। দেখিস তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। এরপর নিজেই স্বীকার হবে ডিভোর্স হয়েছে কি-না!”
“আমাদের ধর্মে স্বামীকে ভাই ডাকা নিষেধ।”
“তুই তো নিজেও শিওর না যে আদোও ডিভোর্স হয়েছে কি-না। তুই তো ধরেই নিয়েছিস ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। সবাইও এমনটা জানে। তাই তুই শিওর হওয়া অব্ধি ভাইয়া বলে ডাকবি। তারপর তার মুখের এক্সপেশন দেখবো দু’জন।”
“যদি ডিভোর্স না হয় তাহলে স্বামীকে ভাই ডাকার অপরাধে পাপ হবে।”
“তওবা করে মাফ চেয়ে নিস।”
দোনোমোনো করলো নিশু।
“আরে দু-তিনদিন টিকসটা ফলো কর। শীঘ্রই এরমধ্যে আমরা কিছু আবিষ্কার করে ফেলবো।”
সায় দিলো নিশু।
“চল নামাজ আদায় করি।”
“আমি অসুস্থ।”
“ও আচ্ছা,তাহলে আমি পড়ি।”
অযু করে দ্যুতি নামাজে দাঁড়ালো। রুম থেকে বেরিয়ে সবার জন্য চা-নাস্তা তৈরি করলো। ট্রের মধ্যে পায়েস,সেমাই,পিঠা,ড্রাই কেক,চকলেট প্রাইন্ড কেক,কুকিজ,দু-তিন রকমের ফলের টুকরো এবং চা নিয়ে ফুপির রুমে গেল। উনারা স্বামী-স্ত্রী নামাজ আদায় করে উঠেছেন সবে। নিশুকে দেখতেই খুশি হোন দিলরুবা খাতুন। কখন কী লাগবে সব বুঝে যায় মেয়েটা কিন্তু নিজের বেলায় একটু বেশিই অবুঝপনা আর পাগলামি করে এই আরকি! আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিলেন আসাদ সাহেব। নিশুর হাতের লেবুপাতা,লেবু,লবঙ্গের চা ভীষণ প্রিয় উনার। এই চা-টুকু পান করলে মন চাঙা থাকে।
“নিশু!”
“জ্বী।”
“সবাইকে লিভিং স্পেসে যেতে বল।”
“কেন আব্বু?”
“গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
“আচ্ছা।”
রুমে ঢুকে দ্যুতিকে বললো ধ্রুবকে বলে দিতে। আপাতত লোকটার সঙ্গে এখন দেখা করার ইচ্ছে নেই। ধূসরের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ডোর খোলা।
“ভাইয়া! ভাইয়া শুনছো!”
দেখলো রুমে নেই। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে ধূসর। সরল মনে এগিয়ে গেল নিশু।
“ভাইয়া আব্বু ডাকছে!”
নীরব রইলো ধূসর। হঠাৎ নাকে-মুখে ধোঁয়া ঢুকতেই কেশে উঠলো নিশু। সিগারেটটা ফেলে দিলো বাইরে।
“তুমি সিগারেট খাও?”
প্রতিত্তোর করলো না। কাশতে কাশতে চোখ জ্বালাপোড়া করে পানি বের হলো। পিছু ফিরে তাকাতেই আঁতকে উঠলো নিশু। নিশুর দিকে দৃষ্টি পড়তেই তাকিয়ে রইলো। খোলা চুল আর সুন্দর মুখটা একটা স্বপ্নিল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে!
“ভাইয়া কী হয়েছে তোমার?চোখগুলো এত লাল কেন? জ্বর এসেছে? তুমি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছো?”
নীরব রইলো ধূসর। আতঙ্কিত হয় নিশু।
“এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?তোমাকে তো সুস্থ দেখলাম!”
“কিছু হয়নি।”
“তুমি কি কেঁদেছো?”
“না।”
ধূসরের চোখ-মুখ কেমন শক্ত,লাল। মনে হচ্ছে কেঁদেছে! কেমন বিষন্ন,বিমর্ষ এবং বাউণ্ডুলে দেখাচ্ছে। বুঝতে পারলো না নিশু। এমনটা কখনো দেখেনি।
“আচ্ছা ডাকছে চলো।”
পা বাড়ালো ধূসর। পিছু পিছু যেতেই চোখ পড়লো টেবিলের উপর মেলে রাখা ডায়েরির উপর।
“এইভাবে কেউ বইখাতা খুলে রাখে নাকি! মায়েরা বলে শয়তানে পড়াশোনা করে।”
বন্ধ করতে নিতেই চোখ পড়লো গোটা গোটা অক্ষরে নয়নতারার মতো সুন্দর করে লেখা একটি উক্তির উপর।
“তোমায় না পাওয়ার এই যন্ত্রণা নিয়ে আমি কীভাবে বাঁচবো বিষাক্ত ফুল? আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশু। আচমকা কম্পন শুরু হলো শরীরের মধ্যে। এই বিষাক্ত ফুলটা আবার কে? আর সেই বিষাক্ত ফুলটা ধূসর ভালোবাসে! কে হতে পারে? আচ্ছা,ধূসর তো তাকেই বিষাক্ত ফুল অর্থাৎ ধুতরাফুলের সঙ্গে তুলনা করে। ডায়েরি হাতে থমকে রইলো নিশু। পিছু ফিরতেই চমকালো ধূসর। কয়েক কদম এগিয়ে আচমকা কেঁড়ে নিলো ডায়েরিটি। দাঁতে দাঁত চাপলো। ভড়কায় নিশু।
“ডায়েরি ধরলি কেন?”
আমতা আমতা করলো নিশু।
“পারমিশন ছাড়া কেন ধরলি?”
“আসলেই..”
“বল কেন ধরলি?”
অপ্রস্তুত হয় নিশু। অভিমানে বর্ষার ভরা বিলের মতো জলে টইটম্বুর হয়ে গেল চোখজোড়া। ধূসর কখনো তার সঙ্গে এইভাবে কথা বলে না। ভীষণ খারাপ লাগলো নিশুর। মলিন মুখে তাকালো।
“ডায়েরি ধরার রাইট তোর নেই!”
আমতা আমতা করলো নিশু।
“তোমাকে নরকের এই যন্ত্রণা কে দিলো ভাইয়া?”
“জানতে হবে না তোর।”
“বলছি,তাহলে এই দায়ভার থেকে তার মুক্তি মিলবে কীভাবে?”
“আমি চাই তার মুক্তি না মিলুক! আজীবন এমন থাকুক!”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো নিশু। নিশুর চোখ দুটি যেন ঝকঝকে তারা। যেন ইতিহাসের হারানো সভ্যতার মায়া জাগায়। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধূসর।
ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন বাতির আলোয় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে অনিক। সঙ্গী তার গ্যাংরা।
“দোস্ত কী হইছে চুপচাপ যে?”
“মন-মেজাজ ঠিক নাই। মুড সুয়িং হচ্ছে।”
“কেন?”
“আব্বা জুতা দিয়া পিটাইছে।”
“ব্যথা পাইছোচ?”
“আবার জিগায়!”
“সো স্যাড দোস্ত।”
“এখন মনে হইতাছে আরেকটা বিয়ে করতে পারলে ভালো লাগতো। যদিও প্রথম বিয়েটা এখনো হয় নাই।”
“তো কইরা ফালা।”
“না দোস্ত বিয়া করতে এখন ভয় পাই।”
“ভয় পাওনের কী আছে?”
“আরে দেখোস না কোপ খাইতে হয় কটও খাইতে হয়।”
“ঠিক কইছোচ দোস্ত! পুরুষ মানুষ যে কেমনে বাঁচবো বুঝবার পারি না। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করলাম ডিভোর্স এর পর মেয়েরা সেলিব্রিটি হইয়া যায়!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিফাত।
“হেইটাই! হ্লার পুরুষ মানুষ কেমনে যে বাঁচবো!”
“দোস্ত শুনবি আমার একটা কাহিনী?”
“তোর আবার কী হইছে?”
“আরে দোস্ত আর কইস না,আমার মামাতো বোনরে ফেইসবুক থেইকা ব্লক দিছি এখন আমগো বাসা আইসা আজই দুই দিন ধইরা আমারে শুনাইয়া শুনাইয়া আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনোই জান্নাতে প্রবেশ করবে না এইসব ওয়াজ বাজায়। এন সত্যি কইরা কওতো আমি কি বেহেশতে যাইতে পারুম না?”
“শালীরে জিগাইতি ও যাইবো কি না!”
“মন্দ কস নাই।”
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আঙ্গুল চালিয়ে চুলগুলো ব্রাশ করতে লাগলো।
“দোস্ত কী খোঁজোস?”
“হ্লার বাইক চালাইতে চালাইতে আজকাল এমন হইয়া গেছি এখন হাঁটার সময়ও লুকিং গ্লাস খুঁজি!”
“আরে ভাই সেদিন রাস্তা দিয়ে হাইটা হাইটা যাইতাছিলাম পুলিশ দেইখা অন্য রাস্তা দিয়া গেছি পরে দেখলাম আমার কাছে তো বাইকই নেই।”
“সব কপাল।”
লিভিং স্পেসে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো সবাই। গলা পরিষ্কার করে আসাদ সাহেব বললেন,”তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
নীরব রইলো সবাই।
“কথাটা হচ্ছে,তোমরা তো অবগত নিশুর পরিবার কেমন। নিশুর বাবা-মা তার খোঁজখবর নেয় না। ডিভোর্সের পর থেকে ওর মায়ের কোনো খোঁজ নেই। এগুলো বলার কারণ ওর পারিবারিক কোনো সাপোর্ট নেই। মেয়েটাকে আমরা নিজেদের সন্তানের মতো করে ছোট থেকে বড় করেছি এই অব্ধি। ওর উপর আমাদের একটা দূর্বলতা এবং মায়া রয়েছে।”
ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”আমি তোমার মায়ের হাতে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছি তোমরা সাইন করেছো কি না আমি জানি না। লেটারটা আমি আর পাইনি। লইয়্যারের সঙ্গেও কথা বলে বিশেষ কোনো তথ্য পাইনি। সে যাইহোক এখন আমরা জানি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তাই বলতে চাই,তুমি তো আর নিশুর সঙ্গে সংসার করবে না। অর্থাৎ তোমরা তিনভাই তিনটি বউ আনবে ঘরে। কার বউ কেমন হবে তা তো জানি না। নিশুর সঙ্গে বনিবনা নাও হতে পারে। ছোট করে দেখতে পারে আর খোঁচা দিয়ে কথা শোনাতে পারে। এখন নিশুকে যেহেতু আমরা পেলেপুষে বড় করেছি তাই ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি। তা হলো,নিশু-দ্যুতি দু’জনই মায়ের পেটের বোনের মতো চলাফেরা করে। আমি এখনও সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করিনি। তবে ওদের দু’জনের নামে একটি জায়গা কিনেছি এবং সেখানে বিল্ডিং তুলেছি। সেখানের গ্রাউন্ড ফ্লোরে মেডিসিন শপের একটি ব্রাঞ্চ ওপেন করেছি। আর এই ব্রাঞ্চটি ঢাকার বেশ কয়েকটি জায়গাও অলরেডি ওপেন হয়ে গিয়েছে।
অর্থাৎ মতিঝিল,গুলশান,বনানী,ধানমন্ডি ইত্যাদি। কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানের শপটিতেই মোট ১৫ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছি। বাকিগুলোতেও তেমন। আর এখানের বাকি ফ্লোরগুলো শপিংমল করার জন্য ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। তবে কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। কাল উদ্বোধন করা শেষে প্রতিটি ফ্লোরের কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর আমার আরো প্ল্যান আছে বিভিন্ন জেলায়ও এর ব্রাঞ্চ ওপেন করবো।”
কথাগুলো শুনতেই চমকান দিলরুবা খাতুন। নির্বিকার রইলো তিনভাই। তবে বিষয়টি সম্পর্কে ধূসর অবগত। বিল্ডিংটি তৈরি করতেই প্রায় সাড়ে সাত বছরের মতো লেগে গিয়েছে। তার বাবার এত বছরের অর্জিত সকল অর্থ এই বিল্ডিংটির পিছনেই গিয়েছে। কিছু অর্থ লোন নিয়েছেন। আর এজন্যই খুব বেশি ব্যস্ত থাকতে হতো উনাকে। যার জন্য পরিবারকে তেমন একটা সময় দিতে পারেননি। বাড়ির দিকটা ধূসর-ধীরাজ দুজনই সামলিয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়া তোলা,ভাড়াটিয়াদের সামলানো,সব বিল,কোন ফ্ল্যাটের কোন সমস্যা,বাড়ির কী সমস্যা হতে কিচেন থেকে ইত্যাদি সব দায়িত্ব তাদের উপর বর্তিয়েছিল। এদিকে নিশু আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিল,ওর ট্রিটমেন্ট সংক্রান্ত,স্টাডি কতশত ঝামেলা গেল!
মায়াকুমারী পর্ব ২৭
“দিলরুবা সহ তোমাদের তিনজনের কাছে অনুরোধ এটা আমি খুশিমনে নিশু-দ্যুতির জন্য করেছি। দু’জনেই আমার মেয়ে। ওদের ভবিষ্যতের কথা সারাক্ষণ ভাবতাম। তিন ছেলে বিয়ে করলে আদোও আমার মেয়েদের কে দেখবে! নিশুকে রাখতে চাইলাম আমার বাড়িতে তা বোধহয় স্বপ্নই থেকে যাবে। সে যাইহোক,তাই ক্ষমা চাচ্ছি তোমরা এই সম্পত্তির দাবি করো না। এটা সম্পূর্ণ আমার কষ্টের অর্জিত অর্থে করেছি। আমার কিছু হলে আমার মেয়েদের কী হবে,দিলরুবার কী হবে!”
দিলরুবা খাতুনের বুকটা কেমন আদ্র হয়ে গেল।