তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৯
ফারহানা নিঝুম
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নরম আর কোমল। আকাশ ঢেকে আছে মেঘে, হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে চারপাশে। ছোট ছোট ফোঁটা মাটিতে পড়ে এক ধরনের স্নিগ্ধ শব্দ তুলছে টুপটাপ, টুপটাপ। গাছের পাতা ভিজে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, পথঘাট সিক্ত হয়ে চিকচিক করছে। দূরে কোথাও একলা পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে, গাছের পাতার ফাঁকে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। বৃষ্টির স্পর্শে মাটির গন্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে, যেন মন ভরে ওঠে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে।মিটামিটা বৃষ্টি। বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস টেনে নেয় তাশফিন। ল্যাপটপ হাতে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসলো।আপাতত মেইল গুলো চেইক করতে হবে তাকে।নাইদের অনেক গুলো মেইল এসেছে এবং কি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে অফিসিয়ালি মেইল পাঠানো হয়েছে। যেখানে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে তাকে ফিরতে হবে।
তাশফিন কিছু দিন পূর্বেই আরো কিছুদিন ছুটির জন্য লিভ অ্যাপ্লিকেশন জমা পাঠিয়েছিল। কিন্তু নেভাল হেডকোয়ার্টার থেকে ছুটিটা বাতিল করা হয়েছেন।তাকে যথা সম্ভব দুদিনের মধ্যে ডিউটিতে জয়েন করতে হবে।
কাল তার বিয়ে, ফিরতে হবে রাতের দিকে।তার মানে তার হাতে দু’দিন আছে,পুরো একদিন চলে যাবে এসব বিয়ে এবং বাড়িতে ফেরার ঝামেলায়। পরে মাত্র একটি দিন পাবে ফারাহর সঙ্গে সময় কা’টানোর।পর পর রাতেই তাকে ব্যাক করতে হবে। ল্যাপটপের শাটার অফ করে উঠে গেল তাশফিন, এগিয়ে গেল জানালার কাছে। বিরক্ত সে, বড্ড বিরক্ত। আচ্ছা এই মূহুর্তে যদি সে ফারাহর কাছে যায় তাহলে কি অন্যায় হবে? কিসের অন্যায়?তার স্ত্রী সে, অধিকার তো আছেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাতাসে জানালার কাছে লাগানো সফেদ পর্দা গুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে।লাইট জ্বা’লিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল ফারাহ।হাত ভর্তি মেহেদি লাগানো তার। বিয়ের মেহেদি যে,খুব শখ করে আঁ’কা।কোথাও একটা লুকানো রয়েছে তাশফিনের নামের অক্ষর।যা খুঁজে বের করবে সেই পুরুষ। এলোমেলো করে রাখা বিছানার উপর বিয়ের লেহেঙ্গা, জুয়েলারি সব কিছু।কাল সকাল সকাল পার্লার থেকে লোক আসবে তাকে সাজাতে,তাই তো আগে থেকেই স্নেহা, নূপুর এগুলো বের করে রেখেছে।
দরজায় টোকা পড়ল, যষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ হয় ফারাহর।এখন কে এসেছে?গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল সে। ভেতরে প্রবেশ করে তাশফিন।চমকায় ফারাহ, লজ্জিত হয় খানিকটা।দু হাত পকেটে গুঁজে টান টান হয়ে দাঁড়ালো তাশফিন। দৃষ্টি তার সামনের মেয়েটির থুতনিতে।কালো তিলটা চুম্বকের ন্যায় টানছে তাকে।এদিক সেদিক তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এগিয়ে গেল আলগোছে।হাত স্পর্শ করে ফারাহর।
“কথা আছে।”
বারান্দায় গেল ফারাহ সহিত তাশফিন।দেয়াল ঘেঁষে বসলো নিচে,অবাক নেত্রে চেয়ে রইল ফারাহ।হাত টেনে নিজের কাছে বসায় তাকে। ফারাহ চুপচাপ বাধ্য বালিকার ন্যায় বসলো। আইঢাঁই করে শুধোয়।
“কিছু বলবেন?”
“ভালো লাগছে না।”
অকস্মাৎ এমনতর কথায় অবাক হয় ফারাহ। পল্লব ঝাপটায় অবুঝের ন্যায়।হাসলো তাশফিন, সূক্ষ্ম সেই হাসি।
“হাত দেখাও।”
বলতে দেরী দুহাত মেলে ধরতে দেরী হয়নি ফারাহর।
“এই দেখুন মেহেদি দিয়েছি বিয়ের। আপনার নামের অক্ষর আছে খুঁজে দেখুন।”
চঞ্চল ফারাহর অধর পানে দৃষ্টি তাশফিনের, কথা গুলো বলে স্থির হলো সে।অধর জুড়ে রয়েছে প্রাণবন্ত হাসিটুকু।
হাতে হাত ছোঁয়ায় তাশফিন,খুব সূক্ষ্মভাবে খুঁজে বের করে নিজ নামের প্রথম অক্ষরটি। আলগোছে ছুয়ে দেয় অধর দুটি, কম্পিত হয় ফারাহর সর্বাঙ্গ।
“মিসেস শেখ আপনাকে আমি ব্যতিত অন্য কিছু দেওয়ার নেই। আপনাকে আমাকে নিতে হবে, মানতে হবে, স’হ্য করতে হবে।হোক সেটা কঠিন, কিন্তু দিন শেষে আমি আপনার মাঝে সুখ খুঁজে নেব। আপনার কর্তব্য আমাকে আপনার সুখ থেকে সামান্য সুখটুকু দেওয়া।ঠিক আছে?”
তাশফিনের মোলায়েম কন্ঠে শোনা কথা গুলো ভীষণ ভাবে ভালো লাগলো ফারাহর নিকটে।সে কথা গুলো কতটা বুঝতে পেরেছে তা সঠিক জানা নেই তবে যতটা পেরেছে তাতেই খুশি। অর্থাৎ তার মাঝেই তাশফিনের সুখ লুকিয়ে রয়েছে।
“লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তাশফিন শেখ আপনার লজ্জা লাগে না রাতবিরেতে আমার ঘরে আসছেন?”
দুষ্টুমির ছলে আওড়ালো ফারাহ, কাঁধে মাথা হেলিয়ে দেয় তাশফিন। অসম্মতি জানায়।
“একটুও লজ্জা লাগে না মিসেস তাশফিন শেখ। আপনার কাছে কিসের লজ্জা?”
সহসা হেসে ফেলল ফারাহ।
“আপনি আমাকে আপনি বললে হাসি পায়।”
ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয় তাশফিন।
“তাই?”
“হুঁ।”
“নাকটা কাল খালি রাখবে ঠিক আছে, কাউকে কিছু পড়াতে দেবে না।”
হাত চলে গেল নাকে ফারাহর।খালি রাখবে কেন?রুবেনা শেখ যে তাকে নাকফুল দিলো সেটা?
“ওমা আপনার আম্মু তো আমাকে নাকফুল দিলো… আহ্..
ব্যথিত কন্ঠে আ’র্ত’নাদ করে ফারাহ।
“আমার আম্মু কি? তোমার আম্মু হয়।”
“স্যরি ভুল হয়ে গেছে।”
“যা বললাম মনে থাকে যেনো,নাকটা খালি রাখার দায়িত্ব তোমার।”
মহা বিপাকে পড়ল ফারাহ। এদিকে রুবেনা শেখ বলেছেন নিজ হাতে নাকফুল পড়াবেন, এদিকে উনার ছেলে বলছেন নাক খালি রাখতে।এখন ফারাহ কোথায় যাবে?উঠে বসলো তাশফিন, এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। ফারাহ উঠে গেল সহসা। অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটি হাতে তুলে নিল তাশফিন।চলে গেল গ্যালারিতে।বউ বোধহয় গ্যালারিতে ছবি দেখছিল তাই তো ফোন অন করা মাত্র সেখানে পেলো।স্কল করে নিচের দিক যেতেই একটি ছবিতে দৃষ্টি আটকায় তার,বউ সাজে সেলফি নিয়েছে।কি নিষ্পাপ চাহনি, বাচ্চা সুলভ ছাপ মুখশ্রী জুড়ে স্পষ্ট।তাকে দেখে নিজেকে সংযত করা বড্ড দায় তাশফিনের নিকটে।মুখ ফিরিয়ে এক পলক দেখে ফারাহ কে।
“এটা গত বারের ছবি,যখন আপনার জন্য বউ সেজে ছিলাম। ভেবেছিলাম কখনো দেখা হলে মুখ ঝামটা দিয়ে বলব দেখুন মিস্টার আমাকে দেখতে কেমন? নায়িকা না?”
ফিচলে হাসে তাশফিন, আঙ্গুলের ভাঁজে ফের আঙ্গুল গুঁজে।
“না আপনি নায়িকা নন, আপনি অভিনেত্রী।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ফারাহ। অভিনেত্রী আর নায়িকার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
তাশফিন শেখ আর ফারাহর বিয়ের দিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। নরম বাতাস বইছে, মাঝে মাঝে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। এই রোমান্টিক পরিবেশ যেন তাদের গল্পেরই অংশ। ফারাহ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখে, আর মনে মনে ভাবছে এতদিনের স্বপ্ন আজ সত্যি হতে চলেছে।
ফারাহ আজ স্বপ্নের মতো সাজে। সে পরেছে হালকা গোল্ডেন ও লালের এমব্রয়ডারি করা লেহেঙ্গা, যার ওপর গোল্ডেন জরির কাজ। গা ভর্তি গয়না,সব কিছু রুবেনা শেখ এবং আরিফা আহমেদের দেওয়া।তাশফিন পরেছে ক্লাসিক সাদা শেরওয়ানি, যার কলারে নীল অ্যাকসেন্ট। তার চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, যেন আজকের দিনের অপেক্ষায় ছিল চিরকাল। বন্ধুরা তার চারপাশে জড়ো হয়ে ঠাট্টা করছে।কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই তাদের বিয়ে।বৃষ্টি কমে আসছে, চারপাশ সোনালি আলোয় ভরে যাচ্ছে।
বৃষ্টির শব্দের মাঝেই কাজী সাহেব ধীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“কবুল?”
ফারাহ হালকা কাঁপা কণ্ঠে বলল, “কবুল…”
তাশফিনের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। তিনবার কবুল উচ্চারিত হওয়ার পর দুই পরিবারের উল্লাসধ্বনি মিলল বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দের সাথে।
বিয়ে মানে হাজারো নতুন সম্পর্ক। ফারাহ কি পারবে সব গুলো সম্পর্কে অটুট থাকতে?
নূপুরের হাত ধরে রুমে এলো ফারাহ। এই তো কিছুক্ষণ পর তারা ফিরবে ঢাকার উদ্দেশ্যে।তার পূর্বে একটুখানি রেস্ট প্রয়োজন ফারাহর। ছোটখাটো শরীরটার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝ’ড়। বারান্দায় এসে দাড়ালো ফারাহ, আঁখিদয় ভরে উঠে অশ্রু কণায়। চিরচেনা সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে অচেনা জায়গায়।বুকটা ভারী হয়ে আসছে তার। নেত্র পল্লব কাঁপছে বারংবার।স্নেহা টাকে কে দেখবে? দুজন তো একসাথে কলেজে যেতো,এখন কী হবে মেয়েটার?
কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসছে ফারাহর।
যষ্ট ইন্দ্রিয় সজাগ হলো ফারাহর,তড়াক করে জ্ব’লে উঠল মস্তিষ্ক। বারান্দার কাছে আরো একজন আছে। সাইফুল! চমকালো ফারাহ। এগিয়ে এলো সাইফুল। অপরাধী কন্ঠে বলল।
“ফারাহ আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি আবারো।দেখো সেদিন রাতে যা হয়েছে সবটাই হুট করে! আমি নূপুর কে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে… আমি সত্যি খুব লজ্জিত। বিষয়টা আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে! আমি তোমাকে কাছে ক্ষমা চাইছি ফারাহ।”
স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ। সাইফুলের চোখে অনুশোচনা দেখতে পাচ্ছে সে। সাইফুল ফের বললো।
“দেখো তুমি আমার ছোট বোনের মত, আমি জেনে বুঝে তোমার কোনো রকম ক্ষতি করব না।আর আজকের পর থেকে তো তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো ফারাহ, মৃদু স্বরে বলল।
“এসব বলবেন না ভাইয়া, আমি তো ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি ভুলবশত.. আপনি এভাবে আর ক্ষমা চাইবেন না।”
বুক থেকে ভারী কিছু সরে গেল বোধহয় সাইফুলের।
“তুমি জানো না আমি কতটা অনু’শোচনায় ভু’গছিলাম। অবশেষে মুক্তি পেলাম।”
মৃদু স্বরে ফের বললো ফারাহ।
“এই যে আপনি ছোট বোন বলেছেন, তাহলে কি করে ভাইয়া কে দোষারো’প করি বলুন তো?”
নৈঃশব্দ্যে হাসলো সাইফুল।হাত রাখলো ফারাহর মাথায়।
“ভালো থেকো সবসময়।”
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ফের শুরু হলো। বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। টুপটাপ টুপটাপ শব্দ হচ্ছে।বাইরের টিনের চালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দটি প্রগাঢ় হচ্ছে।জানালার পর্দা হালকা দুলছে, ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির গন্ধ। ফারাহ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে , দু’হাত গুটিয়ে রাখা। ঠান্ডা বাতাস গালে এসে লাগছে, কিন্তু শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল। কারণ, ঠিক সেই মুহূর্তে কারও হাত ধীরে এসে ছুঁয়ে দিল ফারাহর হাতের পেছনটা।
ফারাহর শিরদাঁড়া বয়ে একটা শিহরণ নেমে গেল। খুব হালকা একটা স্পর্শ, কিন্তু তাতে যেন একটা অদ্ভুত উষ্ণতা লুকিয়ে আছে। অন্ধকারে তাকানোর চেষ্টা করে,তার চোখ দেখতে পারছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে সে খুব কাছেই আছে।তাশফিন, ছুঁয়েছে তাকে,কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে বাড়ির পথে। তবে একটুখানি তো বউকে ছোঁয়া ফরজ। তাকে একটু হলেও ছুঁতে হবে তার পবিত্র বউটা কে। দেখতে হবে পবিত্র মুখ খানা।অধিক দিনের অপেক্ষায় থাকা একটি সুপ্ত ইচ্ছেরা জেঁ’কে বসেছে তার মস্তিষ্কে। থুতনিতে থাকা টকটকে লাল তিলটা।বুড়ো আঙ্গুলে ছুঁয়েছে তাশফিন, শিরশিরানি অনূভুতি। কাঁপছে ফারাহ, বুঁজে এসেছে আঁখিদয়।
“চুমু খেলাম,সব কিন্তু হালাল।”
তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ১৮
অপেক্ষা করলো কি তাশফিন ফারাহর উত্তরের বা সম্মতির? উঁহু করেনি,তার অধর ছুঁয়েছে ফারাহর থুতনি। তিলক এঁকে চুম্বন, খা’মচে ধরেছে তাশফিনের শেরোয়ানি।ছাড়েনি তাশফিন, গভীর ভাবে ছুঁয়েছে তার থুতনি তবে তা ক্ষণিকের জন্য। পরক্ষণেই ছাড়তে হলো, দরোজায় ঠকঠক শব্দ হলো। প্রাণ ফিরে পেলো ফারাহ, নিঃশ্বাস নিচ্ছে পর পর।চোখ দুটো মেলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছে সে।এবারে তাকাবে কি করে তাশফিনের পানে?