আযদাহা পর্ব ৩৮
সাবিলা সাবি
রাতের বেলা অ্যকুয়ারা ফিওনার ঘরে প্রবেশ করে। কয়েকদিন ধরে ফিওনার সাথে আড্ডা দেয়ার তেমন সুযোগ পাচ্ছিল না,তাই আজ চলে এসেছে।তারা বেশ কিছুক্ষণ গল্প করতে থাকে,হাসি-ঠাট্টা চলতে থাকে।
শেষে,হঠাৎ অ্যকুয়ারা প্রশ্ন করে,”ফিওনা,একটা সত্যি কথা বলো,তুমি কি প্রিন্সকে ভালোবাসো?”
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ থাকে,কোনো উত্তর দেয় না।অ্যকুয়ারা আবার বলে,”প্রিন্স তোমাকে অনেক ভালোবাসে।আমি এই কয়েকদিনে সবকিছু লক্ষ্য করেছি।কিন্তু তুমি,তুমি কি তাকে ভালোবাসো?”
ফিওনা তখন মাথা নাড়িয়ে ওপর নিচ করে।
“এভাবে না,মুখে বলো,” অ্যকুয়ারা বলে।
ফিওনা একটু সংশয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ,আমি তাকে ভালোবাসি।তবে আমি তাকে জানাবো না।কারণ,আমি এখনো তাকে ভালোবাসি বলিনি।তাতে সে যা করে আর বললে তো…”
এ কথা বলার পর ফিওনার মুখে একটা সংকোচের ছায়া দেখা যায়।অ্যকুয়ারা ফিওনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,বুঝতে পারে তার অনুভূতি কতটা গভীর।
অ্যাকুয়ারা ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি না বললেও প্রিন্স জানে।কারণ,সে হচ্ছে ড্রাগন প্রিন্স।তার সিক্স সেন্স অনেক বিচক্ষণ। সে আগেই বুঝে গেছে,নাহলে তোমার এত কাছে আসতো না।”
ফিওনার মুখে একরকম বিষণ্ণতা ঝরে পড়ে।সে মাথা নিচু করে থাকে।অ্যকুয়ারা তার এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
“কী হয়েছে ফিওনা?তুমি কেন এত চিন্তিত?তুমি যদি তাকে ভালোবাসো,তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
“জানি,” ফিওনা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,”কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মধ্যে অনেক বাধা আছে।আমি নিশ্চিত নই যে এই প্রেমের শেষ কোথায় যাবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কিন্তু যদি তুমি তাকে সত্যি ভালোবাসো,তাহলে এগিয়ে যাও,”অ্যকুয়ারা উৎসাহ দেয়।”ভালোবাসা সবসময় শক্তিশালী। তুমি কীভাবে জানবে,যদি তুমি চেষ্টা না করো?”
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবে,তার মনে জাগে কিছু দ্বিধা ও আশঙ্কা। “তুমি ঠিক বলছ,কিন্তু পরিস্থিতি এত সহজ নয়। আমি চাই না,সে বা আমি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই।”
“কিন্তু প্রেমই তো সবকিছু সমাধান করতে পারে,”অ্যকুয়ারা বলে। “তুমি যদি প্রিন্সকে সত্যি ভালোবাসো,তাহলে সাহসী হয়ে ওঠো।”
“কিন্তু অ্যাকুয়ারা,” ফিওনা বলে “ড্রাগন আর হিউম্যান কি একসাথে সারাজীবন থাকতে পারবে?তাদের মধ্যে তো এত পার্থক্য।”
অ্যাকুয়ারা কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে।সে জানে এটার উত্তর তার কাছে নেই। “আমি জানি,ফিওনা।তুমি এবং প্রিন্সের ভালোবাসায় অনেক বাধা আসবে।কিন্তু আপাতত তুমি ভয় পেয়ো না এসব নিয়ে।”
“তাহলে কী করতে হবে?” ফিওনা হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে।
“তুমি যা অনুভব করো,তা বিশ্বাস করো,” অ্যকুয়ারা বললো। “ভালোবাসা সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।যতক্ষণ তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে,ততক্ষণ কিছুই অসম্ভব নয়।”
“কিন্তু পরিস্থিতি?” ফিওনা প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ,পরিস্থিতি কঠিন।কিন্তু তুমি যদি সত্যিই তাকে ভালোবাসো,তাহলে সাহসী হও।একসাথে মিলেমিশে চলার চেষ্টা করো।সম্পর্ক তৈরি করতে সময় লাগে,আর তোমাদের মাঝে যে প্রেম তা অসাধারণ,”অ্যকুয়ারা উৎসাহ দেয়।
ফিওনার চোখে আশার কিছু আলো জ্বলে ওঠে।
“তুমি সত্যিই মনে করো,আমরা একসাথে থাকতে পারব?”
“আমি মনে করি,যদি তোমরা দুজন একসাথে পাশপাশি থাকো,” অ্যকুয়ারা উত্তর দেয়। “তাহলে সব বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।”
“কিন্তু আমার না,তাকে ভয় হয়,অ্যাকুয়ারা।”
“কেনো?” অ্যাকুয়ারা জানতে চায়।
“আরেহ,ওনাকে নয় ওনার রোমান্সকে আমি ভয় পাই,” ফিওনা একটু সংকুচিত হয়ে বলে।
“কেনো?সে কি এমন করেছে?” অ্যাকুয়ারা প্রশ্ন করে।
ফিওনা কিছু বলার আগেই মনে মনে ভাবতে থাকে,এতোটা ব্যক্তিগত কথা বলার প্রয়োজন নেই।তারপর সে বললো,
“না, আসলে ড্রাগন তো আর ড্রাগনের রোমান্স হিউম্যানদের থেকে আলাদা।ভয়ংকর হবে তাই।”
এটা শুনে অ্যাকুয়ারা হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যায়।তার হাসি দেখে ফিওনাও অগত্যা হাসে।”তুমি এতটা ভাবছো কেন? প্রেমে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক,”অ্যাকুয়ারা বলে।”কিন্তু কখনো কখনো ভয়কে পেছনে রেখে সামনে এগোতে হয়।”
“হ্যাঁ,হয়তো তুমি ঠিক বলছো,” ফিওনা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। “আমি বুঝি,কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে একটু সময় লাগবে।”
“তুমি যা অনুভব করো,সেটা গ্রহণ করো।সবকিছু খুব সহজে হবে না,কিন্তু তুমি একা নও।আমি সবসময় তোমার পাশে আছি,” অ্যাকুয়ারা তার বন্ধুর হাতে হাত রেখে সমর্থন দেয়।
“ধন্যবাদ, অ্যাকুয়ারা।” ফিওনা বললো, “তোমার কথা আমার সাহস বাড়ায় আর তুমি আছো বলেই আমি এতোটা নিশ্চিন্তে থাকি সব বিষয়ে।”
এথিরিয়ন হন্তদন্ত হয়ে মাউন্টেন গ্লাস হাউজে প্রবেশ করল। দ্রুত পায়ে অ্যাকুয়ারার কক্ষের দিকে গেল,কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখল,কক্ষ ফাঁকা।এথিরিয়ন সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল, অ্যাকুয়ারা নিশ্চয় ফিওনার কক্ষে রয়েছে।
ফিওনার কক্ষের সামনে গিয়ে সে দেখল,স্লাইডিং দরজা খুলছে না। ্বিরক্ত হয়ে সে কাচের ওপর হাত ছোঁয়াল,আর সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে সিগন্যাল চলে গেল।
ফিওনা আর অ্যাকুয়ারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝল, কেউ এসেছে।অ্যাকুয়ারা উঠে গিয়ে স্লাইডিং দরজাটি খুলে দেয়।দরজার ওপাশে এথিরিয়ন দাঁড়িয়ে আছে,মুখভরা উদ্বেগ আর চোখেমুখে অস্থিরতা।
“এথিরিয়ন!কী হয়েছে?” অ্যাকুয়ারা জিজ্ঞেস করল।
এথিরিয়ন ঘরে ঢুকে বলল,”আর বলো না!ড্রাকোনিস থেকে ইমেল এসেছে।ওই অ্যালিসা ভাবি আর সিলভা আসছে পৃথিবীতে!”
অ্যাকুয়ারা খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলল,”তা হলে কী হয়েছে?তুমি এতটা অস্থির কেন?”
“অ্যালিসা ভাবিকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই,” এথিরিয়ন ধীর স্বরে বলল।”কিন্তু সিলভা?ওই মেয়েটা এতটা ‘চিপকে চিপকে’থাকবে আমার সঙ্গে যে আমার সহ্য হবে না! প্লিজ,আমাকে বাঁচাও!”
অ্যাকুয়ারা হেসে উঠল।”তুমি তো একদম ভয়ে পেয়ে বসেছ! সিলভা আসছে বলে তোমার এমন দুঃখ কেন?”
“দুঃখ নয়,অ্যাকু!এটা পুরোপুরি ভয়!তোমাকে বলে রাখি, সিলভা এমন যে প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে ‘ট্র্যাক’ করবে,যেন আমি কোনো রাজপরিবারের গুপ্তধন!”
অ্যাকুয়ারা অবাক হয়ে হাসতে লাগল। “তুমি তো দেখছি সিলভার আগমন নিয়ে রীতিমতো একটা রোমাঞ্চ গল্প বানিয়ে ফেলেছো!”
“গল্প না অ্যাকুয়ারা।এটা আমার জীবনের বাস্তবতা। আর তাই অ্যাকু,আমি তোমার সাহায্য চাই।তুমি আমাকে কোনো একটা উপায় বলো যেন ওর কাছ থেকে পালাতে পারি!”
অ্যাকুয়ারা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,”চিন্তা করো না। সিলভাকে সামলানোর জন্য আমাদের কিছু একটা করতেই হবে!”
এথিরিয়নের চোখ হঠাৎ ফিওনার দিকে পড়ল,আর তার মুখে খেলে গেল এক চটপটে হাসি।”এই তো পেয়ে গেছি উপায়!” সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল। “ফিওনা,প্লিজ,তুমি আমাকে সাহায্য করবে।সিলভা যখন আসবে,তখন আমি তোমার সাথে সাথেই থাকব।এতে ও কোনোভাবেই আমার কাছে আসার সুযোগ পাবে না!”
ফিওনা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে চুপ করে রইল।এত দ্রুত ঘটনাপ্রবাহের অর্থ বুঝে ওঠা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল।
অ্যাকুয়ারা তখন এথিরিয়নের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলল, “চল,বাইরে গিয়ে কথা বলি।ফিওনাকে এতটা হঠাৎ করে এই সব চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না।”
অ্যাকুয়ারা এথিরিয়নকে নিয়ে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তাদের চলে যাওয়ার পর কক্ষটা যেন হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
ফিওনা কাঁচের দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।বাইরে রাতের আকাশ তারাভরা,কিন্তু তার মন ভীষণ ভারাক্রান্ত।
“অ্যালিসা আসছে…” ফিওনা মনেমনে বলল।তার বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল।”তার মানে জ্যাসপারের বাগদত্তা এখানে আসছে।”
তার হৃদয়টা যেন অদৃশ্য আগুনে পুড়তে লাগল।যতবারই সে এই সম্পর্কের কথা ভাবছে,নিজের অনুভূতিগুলোকে সামলানোর চেষ্টা করেও সে পারছে না।
ফিওনা গভীর শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল।নিজেকে বারবার বোঝাতে চাইল—জ্যাসপার একজন ড্রাগন,আর সে একজন সাধারণ মানবী।তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হওয়া সম্ভব নয়। তবুও,তার হৃদয়টা কেন যেন এই বাস্তবতাকে মানতে চায় না।
ল্যাবের এক কোণে গম্ভীরভাবে বসে আছে জ্যাসপার। ড্রাকোনিস ইমেল পাঠানোর পর থেকে ওর মন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে।অ্যালিসার আসার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই ওর চিন্তা গাঢ় হয়েছে।
ড্রাকোনিসের সঙ্গে কলে আলাপের সময় সে বলেছিল, “ওদের এখন এখানে আসাটা ঠিক হবে না।আমরা সবাই একটা গুরুত্বপূর্ণ মিশনে আছি ড্রাকোনিস।ওরা আসলে পুরো পরিবেশটা কেমন হবে?এই সময়ে তাদের উপস্থিতি খুবই বিভ্রান্তিকর।”
ড্রাকোনিস হালকা স্বরে জবাব দিয়েছিল,”ও তোমার বাগদত্তা,জ্যাসপার।অনেকদিন হলো তোমাকে দেখেনি।আর ওরা তো তোমার মিশনে কোনো বাধা দিচ্ছে না।কয়েকদিনের ব্যাপার।সামলে নাও।”
ড্রাকোনিস কলটি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই জ্যাসপার চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা ধরে বসে পড়ে।চিন্তার ভারে ওর মনের গভীরে একটা চাপা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
“অ্যালিসা আসলে কি হবে?” জ্যাসপার মনে মনে প্রশ্ন করে। “ফিওনা কি বুঝতে পারবে আমি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?যদি অ্যালিসা আর ফিওনার মাঝে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়… তখন আমি কী করব?”
জ্যাসপারের চোখে ভাসছে ফিওনার চেহারা—তার ছোটখাটো হাসি,তার মৃদু ভয় আর দুর্বলতা।সে জানে,এই পৃথিবীতে ফিওনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন তার।কিন্তু অ্যালিসার উপস্থিতি কীভাবে তার আর ফিওনার মধ্যে তৈরি হওয়া অদ্ভুত সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে,সেটাই তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে।
“আমাকে এখনই কিছু একটা পরিকল্পনা করতে হবে,” জ্যাসপার মনস্থির করল।কিন্তু ফিওনার অনুভূতিগুলোকে আঘাত না করে কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেবে,সেটাই এখন তার সবচেয়ে বড় চিন্তা।
পরের দিন কার্বনের মিশন থেকে ফিরে জ্যাসপার, থারিনিয়াস,আলবিরা আর এথিরিয়ন গ্লাস হাউজে একত্রিত হয়।তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে,আর মাত্র দুটি মিশন বাকি।এই উপাদানগুলো ভেনাসে পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
হঠাৎ থারিনিয়াস জ্যাসপারের কাছে একান্তে কথা বলতে এগিয়ে আসে।
“প্রিন্স অরিজিন,একটা কথা ছিল।”
জ্যাসপার গভীর মনোযোগে তাকিয়ে বলল,”বলো।”
থারিনিয়াস একটু ইতস্তত করে বলল,”প্রিন্সেস অ্যালিসা আসছেন।আমি আপনার আর ফিওনার ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি।এই মুহূর্তে অ্যালিসা আসলে পরিস্থিতি কেমন হবে,ভেবে দেখেছেন?”
জ্যাসপার শান্ত গলায় উত্তর দিল,”কি হবে?কিছুই হবে না। আমি অ্যালিসাকে সত্যিটা জানিয়ে দেব।ও আমার সফটওয়্যারের মাধ্যমে সিলেক্ট করা পার্টনার,এর বাইরে ওর কোনো জায়গা নেই আমার জীবনে।আমার হৃদয়ে ফিওনা ছাড়া আর কারো স্থান নেই।”
থারিনিয়াস চোখ বড় বড় করে জ্যাসপারের দিকে তাকাল। “প্রিন্স,দয়া করে এসব করবেন না।ড্রাকোনিস যদি জানতে পারে,তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছেন?অ্যালিসাকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না।ওরা কয়েক দিনের জন্য আসছে। সামান্য এই সময়টা সামলে নিন।”
জ্যাসপারের মুখে কিছুটা বিরক্তি ফুটে উঠল।”তোমার কি মনে হয়,আমি ওর সামনে নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখতে পারব?আমি যদি ওকে ফিওনার প্রতি কোনো অনুভূতি এমনটা বোঝাই তাহলে সেটাই মিথ্যা হবে।”
থারিনিয়াস নরম গলায় বলল,”প্রিন্স,আমি বুঝি আপনি যা বলছেন।কিন্তু এখন আপনাকে কৌশলী হতে হবে।আমাদের মিশন প্রায় শেষের পথে।অ্যালিসা চলে গেলে যা খুশি করুন, কিন্তু এখন শান্ত থাকুন।”
জ্যাসপার একটু থেমে থারিনিয়াসের দিকে তাকাল। “তোমার পরামর্শ আমি মাথায় রাখব।কিন্তু সত্যিটা বেশিদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”
থারিনিয়াস হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।”আমি কেবল চাইছি, এই ক’টা দিন আমাদের কাজ আর পরিবেশ স্বাভাবিক থাকুক। ড্রাকোনিস এবং ফ্লোরাস রাজ্যের মধ্যে কোনো বিবাদ আমরা চাই না।”
জ্যাসপার আর কিছু বলল না।কিন্তু তার ভেতরে অস্থিরতা বেড়েই চলল। অ্যালিসার আগমনের পর কি হবে,সেই চিন্তাই তার মনের গভীরে তোলপাড় করতে লাগল।
গভীর রাত।ফিওনা শান্ত ঘুমে তলিয়ে আছে,ঘরের নিস্তব্ধতা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।তন্দ্রাছন্ন অবস্থায় হঠাৎ তার মনে হলো কেউ গভীরভাবে তাকে দেখছে।সেই অজানা অনুভূতিতে তার শরীরে শিহরণ খেলে গেল।
ঘুমঘুম ভাবটা কাটতেই ফিওনা বুঝতে পারল,উষ্ণ নিঃশ্বাস আর ভেনাসিয়ান পারফিউমের মৃদু ঘ্রাণ তাকে ঘিরে আছে। ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখে,জ্যাসপার তার ঠিক ওপর ঝুঁকে আছে।তার চোখে কোনো হুমকি নেই,বরং গভীর এক রহস্য।
ফিওনা কিছু বলতে যাবার আগেই জ্যাসপার আলতো করে তার মুখে হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,”হুশ্…আস্তে, হামিংবার্ড।”
তার সেই নরম গলার স্বরে যেন রাতের বাতাসও থমকে গেল। ফিওনার হৃৎপিণ্ড দ্রুততর হয়ে উঠল।সে কিছু বলতে চাইলেও কথা হারিয়ে ফেলল।জ্যাসপার তাকে ছায়ার মতো গভীরতায় মোড়া এক দৃষ্টিতে দেখছিল,যেন তার মনের প্রতিটি কোণ খুঁজে নিচ্ছে।
“আপনি এতো রাতে… এখানে আমার কক্ষে?” ফিওনার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল,কিন্তু তার চোখে বিস্ময়ের পাশাপাশি অজানা এক আকর্ষণ।
জ্যাসপার তার হাত সরিয়ে ধীর স্বরে বলল, “তোমার কাছে আসার জন্য আমার কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই, হামিংবার্ড।”
ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে বসল।তার চোখে একধরনের দ্বিধা, যেন বুঝতে পারছে না সামনে কী ঘটতে চলেছে।জ্যাসপার তার ঠিক সামনে বসে পড়ল,গম্ভীর মুখে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।”তোমার আমার প্রতি কেমন ফিলিং?”
ফিওনা চমকে উঠল।তার চোখে বিস্ময় মাখা প্রশ্ন,
“মানে কিসের ফিলিং?”
জ্যাসপার এবার একটু ঝুঁকে এসে বলল,”তুমি আমাকে ভালোবাসো,না?”
ফিওনা তাকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল।তার মন চিৎকার করে বলছে,”হ্যাঁ,আমি আপনাকে ভালোবাসি!”কিন্তু মুখে সে কথাটা কোনোভাবেই আসছে না।অবশেষে সে ধীরে জবাব দিল,”না।”
জ্যাসপারের চোখ মুহূর্তে আগুনের মতো জ্বলে উঠল।তার রাগ যেন ঘরের পরিবেশ ভারী করে তুলল।ফিওনা বুঝতে পারল,সে যা বলেছে,তা জ্যাসপারকে আহত করেছে।
জ্যাসপার ফিওনাকে বসা অবস্থায় থেকে এক ঝটকায় বাহু শক্ত করে ধরে টেনে তুলল।ফিওনা হতবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল,কিছু বলার সাহস পেল না।
জ্যাসপার তাকে গ্লাসের দেয়ালে ঠেসে ধরে গভীর,প্রখর চোখে বলল,”তুমি কি সত্যি মনে করো আমি এতটাই বোকা? তোমার চোখে যা দেখি,তা কি মিথ্যে?”
ফিওনার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে গেল।তার ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু সে কোনো উত্তর দিতে পারল না।
জ্যাসপার তার মুখের আরো কাছে এনে একদম নিচু স্বরে বলল,”তোমার মুখ যা-ই বলুক,তোমার হৃদয়টা আমি পড়তে পারি,হামিংবার্ড।আর নিজের প্রতি মিথ্যে বলার চেষ্টা করো না।”
ফিওনা জড়সড় হয়ে বলল,”কিন্তু আপনার তো অ্যালিসার সাথে সম্পর্ক আছে,আর অ্যালিসা তো আসছেও।”
জ্যাসপারের চোখে তীব্র একটা ঝিলিক ফুটে উঠল।সে দ্রুত ফিওনার ঠোঁটের কাছে হাত তুলে বলল,”হুশ!একদিন মানা করেছিলাম না,অ্যালিসার কথা বলবে না?ওর বিষয় ভাবা তোমার কাজ নয়,হামিংবার্ড।ওটা আমি সামলে নেব।”
ফিওনা চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।তার হৃদয়জুড়ে হাজারো প্রশ্ন,কিন্তু মুখ ফুটে আর কিছুই বলতে পারল না।
জ্যাসপার তার গলার স্বর নরম করে বলল,”তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসবে।ব্যাস।বাকিটা আমি দেখব।”
তার কথায় এমন একধরনের আত্মবিশ্বাস ছিল যে ফিওনার মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি এল।কিন্তু তবুও তার মনে এক অজানা আশঙ্কা লুকিয়ে রইল।
ফিওনা বললো, “ঠিক আছে, আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো এখন।”
জ্যাসপার বললো, “ঠিক আছে তুমি ঘুমাও, তার আগে একটা চুমু দাও।”
ফিওনা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁট থেকে কোনো শব্দ বের হলো না।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে আরও ঝুঁকে এলো। সে এক হাত দিয়ে ফিওনার কোমর শক্ত করে ধরে আরেক হাতে আলতো করে ফিওনার চিবুক তুলে নিলো।
“আচ্ছা, তোমাকে দিতে হবে না,” জ্যাসপার নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল। “আমি দেই।”
এরপর কোনো কিছু না বলে, এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার চোখে গভীরভাবে তাকাল।
জ্যাসপার ফিওনার কোমড় ধরে শক্ত করে কিছুটা আলগা করে ফেললো, ফিওনার পা কিঞ্চিৎ শুন্য ভাসছিল।আর তার দেহ জ্যাসপারের শক্ত বাহুর ওপর নির্ভরশীল।
এরপর, কোনো কথা না বলে, সে ফিওনার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকল। ফিওনা চোখ বন্ধ করার আগেই জ্যাসপার নিজের ঠোঁট তার ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিল। সেই চুম্বন গভীর, দৃঢ়, এবং স্পষ্ট ছিল।
ফিওনার শরীর শীতল হয়ে গেল,কিন্তু তার হৃদয় যেন আগুনের মতো জ্বলতে লাগল।সেই মুহূর্তে সময় যেন থেমে গেল।সমস্ত কিছুর মধ্যে একমাত্র তাদের নিঃশ্বাস আর হৃদয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ফিওনা তার হাত জ্যাসপারের বুকের ওপর রাখল,যেন ঠেলে দিতে চায়।কিন্তু তার হাত শক্তি হারিয়ে ফেলল।জ্যাসপারের চুম্বনে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলল,তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত অনুভূতি যেন জেগে উঠল।
একটি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনাকে মাটি স্পর্শ করাল,কিন্তু তার হাত এখনো ফিওনার কোমরে ছিল।ফিওনার চোখে তখনো বিস্ময় আর আবেগ।
“এবার ঘুমাও,”জ্যাসপার হাসল। “তোমার স্বপ্নে আমিই থাকব,গুড নাইট হামিংবার্ড।”
তারপর জ্যাসপার ফিওনাকে সেখানেই রেখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো। ফিওনা নিজের ঠোঁটের ওপর হাত রেখে অনুভব করতে চাইলো কিছুক্ষণ আগের চুম্বন। তার হৃদয়ে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল; সেই মিষ্টি মুহূর্তের স্মৃতি মনে আসতেই তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো।
আযদাহা পর্ব ৩৭
ফিওনা নিজের ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট ভিজাতে শুরু করলো। জ্যাসপারের চুমুর সেই গ্লুকোজের স্বাদ এখনো লেগে আছে ঠোঁটে আর জিভে। সে অনুভব করলো যেন সে স্বাদ মিষ্টি নয়, বরং এক অদ্ভুত নেশা, যা তাকে আরও বেশি জ্যাসপারের কাছে টানছে। মনে পড়লো সেই মুহূর্তের উষ্ণতা, যা তার পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।