ছায়ার মুখোশ পর্ব ১৩
তাজরীন খন্দকার
উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলো ফয়সালই ফাইজাকে নিয়ে পালিয়েছে। এতক্ষণ ধরে ফয়সালের মা এটার বিরুদ্ধে ঝগড়া করছিলো, তার বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার ছেলে এটা করতে পারে। সবার গলার আওয়াজ নিচে নেমে গেলে কিন্তু আরিদার শাশুড়ীর আওয়াজ এবার দ্বিগুণ বেড়েছে। আঙুল উঁচিয়ে উঁচিয়ে বলছে,
‘ আমার মাইয়ারে আজকার মইধ্যে ফেরত না দিলে তোদের চৌদ্দ গোষ্ঠীরে অপহরণের মামলা দিমু।
ফয়সালের মা আইরিনকে ডেকে বললো,
‘ আইরিন মোবাইলডা ঘরতে লয়া আয়, আমি দেহি হে করতে চাইতাছেডা কি? আমারে কয় ওইটা দুষমনের বাড়ি, আর হে নিজে গিয়া ওই বাড়ির মাইয়ারে লইয়া পালায়। আবার অনেক বাচ্চা লওনের কথাও কয়,বাচ্চা লইয়া হে প্রতিশোধ লইবো? গাধা জন্ম দিছি একটা।
আইরিন ফোন এনে কল দিলো কিন্তু রিসিভ হলোনা৷ বারবার কল দিলো, একবারও ধরলোনা। আরিদার শাশুড়ী নিরুপায় হয়ে ফয়সালের ঠিকানা জানতে চাইলো কিন্তু তারা দিলোনা, বললো মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তারা দ্রুত করবে। কারণ বিয়ে করলে বাড়ি আসা ছাড়া তার উপায় নাই।
কিন্তু আরিদার শাশুড়ী তা মানতে রাজী নন, এতক্ষণে যা বুঝেছে তিনি মারাত্মক ঝগড়াটে মহিলা। আরিদা টেনেও সেখান থেকে আনতে পারছেনা,তার এক্ষুনি তার মেয়েকে লাগবে। কোনো রকম সবাই ধরেটরে নিয়ে রাস্তায় গেলো, তারপর আরিদা তার শাশুড়ী ঠেলে গাড়ীতে উঠিয়ে এই জায়গা প্রস্থান করলো। কিন্তু গাড়ীতে উঠেও মহিলা বলতেছে,
‘ আমার পুতেরে মামলা দিয়া হেনস্থা করছত, তোর পুতেরেও দেইখা লমু দেখিস। হের সাহস কদ্দুরা? ফয়েজী বাড়ির মাইয়ারে লইয়া ভাগে! ভালা কইরা স্কুল পাশ করে নাই,গণ্ডমূর্খ কোনখানের। আমার কলেজে পড়া মাইয়ারে নিয়া কোন যোগ্যতায় গেলি?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরিদা তার শাশুড়ির কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘ আম্মা উনারা কেউই তো আর এইখানে নাই,কারে এইগুলা কন? থামেন একটু।
তারপর আরিদার দিকে তাকিয়ে আবারও শুরু করে দিলো,
‘ তুমি জানোনা, ওরা কিরম মানুষ -,এই করছে,সেই করছে…. –
তারপর যা মুখে আসে তা বলতেই আছে। এতো ঝগড়া করেও বেচারির রাগ কমতেছেনা। আরিদা ওইবাড়ির বদনাম গালিগালাজের মধ্যে মধ্যে দিয়ে বললো ,
‘ আপনি তো কইছেন রাফির মা ভালা মানুষ আছিলো, সেও তো ওই বাড়ির। সবাই খারাপ হইলে উনি ভালা কেমনে?
আরিদার সমর্থন পাবার বদলে এমন কথায় তার শাশুড়ীর কথা আটকে গেলো, ভ্রু কুঁচকে গেলো তিনি গাড়ির সীটে নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসে বললেন,
‘ হাতের পাঁচ আঙুল যেরম সমান হয়না, শিরিনও সেইডা। হে একাই ভালা আছিলো। তাছাড়া ঘরের সবডি কালপ্রিট। হেরার মাইয়ার লাইগা আমার পোলা কি না করছে, উল্টা হেরে কয় দোষী। কতদিন আমার পোলা এই মিছা মামলা টাইনা অহনে খালি সোজা হইছে।
‘ আমার তা মনে হইতাছে না। (আনমনায় বলে উঠল আরিদা)
‘ কি মনে হইতাছেনা?
‘ অঅঅ অই আরকি, ফয়সাল ফাইজার সাথে খারাপ করবে সেইটা। মনে হয় ওরা দুজন দুজনরে বিয়া করলে ভালোই থাকবো।
‘ কোনো ভালার দরকার নাই আমার, আমার মাইয়ার লাইগা কতো ভালা ভালা জায়গা থেইকা বিয়া আইতাছে দেইনা, হের কাছে দিমু?
‘ কিন্তু আম্মা ওরা তো বিয়া কইরা ফেলতেছে। এইভাবে কি জোর কইরা আলাদা করন ঠিক হইবো?
‘ জানিনা আমি, চিন্তায় মইরা যাইতাছি আমি আমার পোলারে কি কমু? তুমি আছো আলাদা না করন নিয়া!
হে জানলে সত্যি সত্যি এইবার খুনের মামলায় ফাঁসিতে ঝুলবো, ফয়সালরে মাইরাই জেলে যাইবো রাশেদ।
‘ আপনার পোলা মোটেও এতো রক্ত গরম পুরুষ না।
‘ হুহ্ দুইদিনে আইয়া আমার পোলা কেমন আমারে বুঝায়!
আরিদা জবাব দিলোনা আর। আসলে আরিদার কাছে কিছুই স্বাভাবিক লাগছেনা, আবার অস্বাভাবিকও লাগছেনা। মানে একবার ভীত হচ্ছে আরেকবার মনে হচ্ছে এসব কিছুই না, একবার অস্থিরতায় ভেতর মুচড়ে উঠছে আবার সবকিছু গা ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার মতন লাগছে।
রাশেদ আসলেই কি এমন কথা শুনলে খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আরিদার মনে হচ্ছে রাশেদ তো ঠান্ডা মেজাজের মানুষই,ওইদিনও তো তার সামনে ফয়সালের এতো রাগারাগিতেও ভালো আর শান্ত ছিলো, শান্তভাবে সব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলো, যদি উগ্র বলতে হয় সেটা হলো ফয়সাল। আজকে ফোনে তাকে কেমন তুই তুই করে বলছিলো,বলছিলো তোরে জামাইরে কইস তার বইনরে একটার পর একটা বাচ্চা দিয়া পাগল বানায়া মারুম।
ফয়সালরা কি শিরিনের এই এলোমেলো হয়ে যাওয়ার পেছনে বাচ্চাদের দায় ভাবে নাকি? আর এই বাচ্চাদের জন্য দায় ভাবে রাশেদকে, যার জন্য এতো ক্ষুদ্ধ! নাকি আরো কোনো ব্যপার আছে এখানে? সবকিছু বেশ ঘোলাটে।
বাড়িতে এসে আরিদা শান্তির নিঃশ্বাস নিলেও আরিদার শাশুড়ী মারাত্মক চিন্তিত। শুধু এদিক ওদিক পায়চারি করছে। আরিদা বাচ্চাদের একে একে গোসল করিয়ে খাবার দিয়েছে। আরিদা রাহাদকে ঘুম পাড়িয়ে রাইসাকে ঘুমানোর জন্য বিভিন্নভাবে বুঝাচ্ছে,এই রুম থেকে ওইরুম রাইসার পেছন পেছন যাচ্ছে, কিন্তু রাইসা দুষ্টামি করছে, একটা সময় তাকে ধরে কোলে তুলে নিলো। তার মধ্যে তার শাশুড়ী এসে বললো,
‘ শুনো বউ রাশেদ যদি অন্যভাবে জাইনাও যায় ফয়সালের লগে ফাইজা গেছে, তবুও স্বীকার করবা না যে বিষয়ডা আমরা জানতাম। আর তাদের বাড়িতে যে গেছি সেইটা তো ভুলেও কইবা না।
‘ আম্মা এতো ডর পাইতাছেন ক্যান সেইটাই বুঝতাছিনা। আমি তো জানতাম আপনার পোলা আপনারে ডরায়। এখন তো দেখি আপনিও আপনার পোলারে ডরান!
‘ বিপদ যার ডর তার। হের বিপদে হে ডরায়, আমার বিপদে আমি ডরাই!
‘ আম্মাহ্ আপনাদের কথা শুনলে ভালা মানুষও পাগল হইয়া যাইবো। রাফিদের মা এমনে এমনে মারা যায় নাই তা আপনাদের আচরণে বুঝতে পারতাছিই,আমারও একই দশা হইবো। কই যে সংসার করতাছি, এখনো কাউরে বুঝতেই পারিনা। একবার পোলায় মারে ডরায় আরেকবার মা পোলারে ডরায়,কিন্তু ক্যান ডরায় সেইটাই বুঝিনা।
‘ কি বুঝোনা বউ? সবই তো জানছো।
‘ না আম্মাহ আমার জানার বাইরে আরো অনেককিছু আছে। যা খালি এড়ায়া যান।
‘ মুখে মুখে কথা কও! ভালা ভাবছিলাম তোমারে।
বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো।
আরিদা বিরবির করে বললো এই যে আবার সেই পল্টি!
এদিকে রাইসাকে কোলে নিয়ে এতক্ষণ ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে রাইসার চোখ ধীরে ধীরে ঘুমঘুম হয়ে এলো। তাকে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে আবারও পিঠে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে পুরোপুরি ঘুম নিশ্চিত করে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে আবারও ফোন দিলো ফয়সালকে। দেখা যাক কোনো সমাধান করতে পারে কিনা! কিন্তু ফোনই আর ধরছেনা।
৫-৬ বার ফোন দেওয়ার পর ফয়সাল ফোন বন্ধই করে দিলো। আরিদা বিছানা ছেড়ে উঠে রুম থেকে বের হতেই যাবে তখন পেরেশানি অবস্থায় রাশেদ ঘরে ঢুকলো। আরিদাকে দেখতে পেয়েই বলতে লাগলো,
‘ ফাইজার খোঁজ পাইছি। এক্ষনি বের হমু, আম্মা কই?
‘ আম্মা তো ঘরেই, কেমনে খোঁজ পাইলেন, কই আছে কিছু জানেন নাকি?
‘ আম্মা ঘরে নাই, আব্বা কইছে আম্মা আবার নাকি বোরকা পইরা বাইর হইছে, আম্মা কই যাইতাছে বারবার?
‘ আম্মারে তো আমি এক্ষন বাইর হইতেই দেখি নাই। আমি কিছু জানিনা কই গেছে না গেছে!
‘ আম্মা মনে হয় শিরিনদের বাড়ি যাইবো।
আরিদা চমকে উঠলো। নিজের চমকপ্রদ চেহেরা আর কণ্ঠ লুকিয়ে কিছু না জানার মতো বললো,
‘ ওখানে ক্যান?
‘ কারণ ফয়সাল একটু আগে ফাইজারে বিয়া কইরা ফেলছে। ফয়সালই ফাইজারে নিয়া ভাগছে। আম্মা মনে হয় জানছে কোনোভাবে তাই গেছে। কিন্তু আমার আম্মায় আমারে কিছু কইলোনা, পরিস্থিতি সামলাইয়া নিই এরপর সবকিছুর হিসাব নিমু।
আরিদা স্তম্ভিত স্বরে বললো,
‘ কিসের হিসাব? আর আপনারা কি করতাছেন এইগুলা? বিয়া হওনের পরে তারে স্বামীর থেইকা আলাদা করন কি ঠিক? এইটা কইরেন না, থাকুক এরা এদের মতন। সবারই তো ভালোবাসা পাওনের অধিকার আছে!
রাশেদের অশান্ত চেহেরাটা মূহুর্তে কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলো। আরিদার দিকে দৃষ্টি প্রেমময় করে বললো ,
‘ আমারও তো আছে!
আরিদা রাশেদকে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে দিলো,
‘ আমার কথাই কথা! আপনারে আমার সন্দেহ লাগে সাংঘাতিক। আগে চিইনা নিই আপনি মানুষটা আসলে কি এরপর অধিকার নিয়া চিন্তা করুম।
‘ আইচ্ছা যাও তুমি চাইলে এদের মধ্যে বাঁধা হমুনা, ওরা বিয়া করলে করুক।
আরিদা চলে যাওয়ার মধ্যে এই কথা শুনে তার পা একটু স্থির হয়ে গেলো। তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো। এই হাসি ফাইজা-ফয়সালের জন্য নাকি রাশেদ তাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ঠিক বুঝতে পারছেনা। কিন্তু এই হাসি যে প্রকাশ করা যাবেনা তা বুঝতে পারছে। এতে রাশেদের ভাব পেয়ে বসবে! তাই হাসি লুকিয়ে ভ্রু বেঁকে বললো,
ছায়ার মুখোশ পর্ব ১২
‘ সত্যি তো?
‘ তোমার কসম!
‘ দূর আমার উপর কসম টসম খাইবেন না তো! ভরসাই করতে পারিনা, আবার কসম খায় আমার উপ্রে, আমারেও মারার বুদ্ধি!