হামিংবার্ড পর্ব ২৪

হামিংবার্ড পর্ব ২৪
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।
ড্রইং রুমে বসে আছে অরা ও নয়না। বিদ্যুৎ নেই, তাই রিচার্জেবল একটি এলইডি লাইট জ্বলছে ঘরে। এই ধরনের বাতি বিদ্যুৎ থাকলে চার্জ হয়, আর বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে ওঠে। সাধারণত, এমন বাতিগুলো দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত আলো দিতে পারে।
” ভাইয়া এত বড়লোক, কিন্তু কারেন্ট গেলে তোমাদের এভাবে অন্ধকারে থাকতে হয় কেন আপু? ”
নয়নার প্রশ্নে থতমত খেলো অরা। ঠিকই তো বলেছে নয়না।
” এ বাড়িতে আসার পর কখনো লোডশেডিং হতে দেখিনি। তাই বিদ্যুৎ না থাকলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি-না সেটাও জানি না রে। ”

বিদ্যুৎ না থাকায় চারপাশটা কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে। রিচার্জেবল বাতির আলোয় পুরো ড্রইং রুমটা ঠিকভাবে আলোকিত হচ্ছে না। তার ওপর বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস বইছে। মনে হচ্ছে, ঝড় উঠতে যাচ্ছে বলেই বিদ্যুৎ নেই। আকাশে মেঘ করলেই যেন বিদ্যুতের সঙ্গে একটা অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়। ঝড়ের সময় বিদ্যুৎ থাকেই না প্রায়।
সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে দুই বোনের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসল আরিশ। তার হাতে ফোন, পরনে হাফপ্যান্ট আর কালো রঙের টি-শার্ট।
” তালহা? এই তালহা? কোথায় তুই? ”
আচমকা আরিশের গলা শুনে নড়েচড়ে বসল দুই বোন। বসার ঘরে দাঁড়িয়ে তালহাকে ডাকছে আরিশ, কিন্তু কোথাও তালহার সাড়া নেই। অরা চুপচাপ তাকিয়ে আছে আরিশের দিকে। হাফপ্যান্টে বেশ মানিয়ে গেছে ভদ্রলোককে – মুচকি হাসল অরা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এই ছেলেটা গেল কোথায়! কারেন্ট নেই, অথচ ওর কোনো হেলদোল নেই!”
কোমরে হাত রেখে চারপাশে সজাগ দৃষ্টি বুলিয়ে বলল আরিশ।
নয়নাও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” ভাইয়া আমি উনাকে গিটার হাতে দোতলায় যেতে দেখেছিলাম। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আরিশ। তালহা গিটার নিয়ে কোথায় যেতে পারে সেটাই ভাবছে হয়তো।
” ফোনে একবার কল করে দেখুন। নিশ্চয়ই ফোন সাথে আছে। ”
অরা বলল। আরিশ হাসল। মেয়েটার বুদ্ধি আছে।
” গুড আইডিয়া। ”
আরিশ তালহাকে কল করে ড্রইং রুমে আসতে বলল। মিনিট দশেক পর তালহা আসল, সাথে তামান্নাও ছিল। আরিশ তালহাকে নিয়ে কোথাও চলে গেল। অরা আর নয়নার সাথে এখন তামান্নাও যুক্ত হয়েছে। তিনজন একসাথে বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা বাড়ি আলোকিত হয়ে গেল—জেনারেটর চালু করা হয়েছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল নয়না। বোনকে বিদায় জানিয়ে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে গেস্ট রুমের দিকে অগ্রসর হলো সে। আরিশ ফেরার পর নয়নাও ড্রইং রুম থেকে নিজের রুমের দিকে এগোল। বসে রইলো কেবল অরা।

” কোলে তুলে নিয়ে যেতে হবে? ”
আরিশের প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো অরা। থেমে থেমে বলল,
” কী? কোথায় নিয়ে যাবেন ? ”
” রুমে! কোলে তুলে নিয়ে যাবো?”
” না, না, না। আমি যাচ্ছি। ”
অরার এমন হাবভাব খুব ভালো লাগে আরিশের। ভীষণ ইনোসেন্ট মেয়েটা। অরা বসা থেকে উঠে দ্রুত সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হতে চাইলে আরিশ তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দৃষ্টিতে প্রশ্ন, কী হয়েছে? আরিশ হুট করে অরাকে কোলে তুলে নিলো। অরা টাল সামলাতে দুহাত দিয়ে আরিশের গলা জড়িয়ে ধরেছে।
” লেটস গো, হামিংবার্ড। ”

অরা কিছু বলল না। আরিশ ধীরপায়ে তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।
ধীরে ধীরে আবহাওয়া আরো খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ ঠান্ডা বাতাস বইছিল, কিন্তু এখন হঠাৎ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বাতাসের সাথে মিশে চারপাশে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা তৈরি করছে। বৃষ্টির সাথে সাথে আকাশে গর্জন শোনা যাচ্ছে, যেন প্রকৃতি তার উত্তেজনা প্রকাশ করছে। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে গর্জন আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর মনে হচ্ছে এই গর্জন কোনো কালবৈশাখী ঝড়ের আগমনের সংকেত। বাতাসের প্রবাহ আরও তীব্র হয়ে উঠছে, আর বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে, যেন কোনো বড় ঝড় আসছে।
অরাকে কোলে নিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করলো আরিশ। ধীরে ধীরে অরাকে নিয়ে বিছানার দিকে যাচ্ছে সে। অরা শুধু আরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা নেশায় ডুবে যাচ্ছে অরা। রুমজুড়ে ডিম লাইটের মৃদু আলো যেন সেই নেশালো ভাবটাকে আরো তীব্র করে তুলছে।

আরিশ অরাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস পরে আছে সে, চুলগুলো মেসি বান করা। আরিশ গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে অরাকে। অরার কপাল, ভ্রু, চোখজোড়া, নাক, ঠোঁট, আকর্ষণীয় শরীর সবকিছুই! কোনোকিছু যেন আরিশের দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না আজ। অরা শুকনো ঢোক গিলল একবার। আরিশের চোখগুলো কেমন ঘোলাটে লাগছে। মনে হচ্ছে ওই চোখে অরার সর্বনাশ লুকিয়ে আছে আজ। আরিশ ঘরের দরজার দিকে এগোল, দরজা আটকানোর জন্য। অরা সেই ফাঁকে চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল কয়েকবার। কী হচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছে না সে। আরিশ দরজা আঁটকে দিয়ে, অরার মাথার কাছে বসল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে রইলো অরার মুখপানে। বাঁধা চুলগুলো খুলে দিলো। ডানহাতের আঙুলটা অরার কপালে ছুঁলো। শিউরে উঠলো অরা। আরিশের স্পর্শ বরাবরই তীব্র, কিন্তু আজ সেটা ছিল একটু ভিন্ন—কোমল, অথচ অনুভূতি প্রবল!

” আর ইউ ওকে, হামিংবার্ড?”
” হুম। ”
” শিওর? ”
” ইয়েস।”
মুচকি হাসল আরিশ। কপালে স্পর্শ করা আঙুলটা কপাল থেকে নাকে, নাক থেকে ঠোঁটের ওপর এনে থামাল আরিশ। অরা কাঁপছে, তার ভিতরটা কেমন অদ্ভুত লাগছে। আরিশের প্রতিটি স্পর্শ, পরবর্তী স্পর্শ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল করে তুলছে অরাকে। তারপর আরিশ আলতো করে অরার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল অরা। চোখ বন্ধ করতেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য ভেসে উঠল। আরিশের সেই হিংস্র আচরণ, প্রথম রাতের যন্ত্রণা, আকাশকে গুলি করা, সব… সবকিছু! অরার মন বদলে গেলো। চোখ মেলে তাকিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেলো সে। আরিশ বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল,

” কী হয়েছে? ”
” কিছু না। বাইরে ঝড় হচ্ছে, আমি এসব খুব ভয় পাই। ”
” আমি থাকতে ভয় কীসের? আমি আছি তোমার জন্য, পাখি৷ ভয় পেওনা। ”
অরার বুকটা কেমন মুচড়ে উঠলো। বাইরের ঝড়ে তার কিছু যায় আসে না, ভয়ও পায় না সে। কিন্তু সব ভয় তো আর কেবল আরিশকেই নিয়ে! যাকে নিয়ে ভয়, সংশয়—সে নিজেই বলছে, সে সবকিছু থেকে আগলে রাখবে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অরা।
” আচ্ছা। ঘুমাই? ”
ভ্রু উঁচিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আরিশ।
” ঘুমাতে ইচ্ছে করছে? ”
” হুহ্। ”
” ঠিক আছে। ”
আরিশ বিছানায় শুয়ে, দু’হাতে অরাকে আঁকড়ে ধরল। অরার দু-চোখ ছলছল করছে। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, বিয়ের পর থেকে এই লোকটার বুকের মধ্যে শুয়েই প্রতিটা রাত কাটে তার। অরা তো চায় এভাবেই আজীবন কাটুক, তবে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু আরিশের আচরণে হতাশ হয় সে। মাঝে মধ্যে যেনো আরিশ নিজের মধ্যে থাকে না। বদলে যায় হুটহাট।

সারারাত বিধ্বংসী ঝড়ের পর নতুন সকালের রোদ আকাশে একা একা উঠে আসছে, আর তা আস্তে আস্তে জানালার ফাঁক দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ছে। রোদের আলো মিষ্টি করে ছুঁয়ে যাচ্ছে নয়নার চোখেমুখে, যেন সে নতুন করে পৃথিবীকে অনুভব করছে। বাইরের বাতাসে ঠান্ডা, ঝড়ের পর এক অদ্ভুত শীতলতা যেন নেমে এসেছে। প্রাচীরের গাছগুলো ছেঁড়া পাতায় মোড়া, কিন্তু তাদের মধ্যে নতুন পাতা গজানোর সম্ভাবনা এক স্নিগ্ধ আশায় ভরপুর। সূর্যের প্রথম আলো সেই গাছগুলোর ওপর পড়লে যেন তারা নতুন করে জীবন পায়। চারপাশে কিছু দূরে জমাট বাঁধা কুয়াশা, যে কুয়াশা ধীরে ধীরে মধুর রোদে বিলীন হচ্ছে, প্রকৃতি যেন তার ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে।
রোদের আলো চোখেমুখে পড়তেই ঘুম ভাঙতে শুরু করল নয়নার। ঘুম ভেঙে মনে হলো, গতকাল রাতে তো জানালা বন্ধ করেই শুয়েছিল সে। তাহলে রোদ কীভাবে এলো? এসব ভাবতে ভাবতে চোখ মেলে তাকাল নয়না। অরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, পর্দাগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। অরাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নয়না। কালো থ্রিপিসে দারুণ লাগছে অরাকে।

” ঘুম ভেঙেছে?”
” উঁহু, ঘুমিয়ে আছি। ”
খিলখিল করে হেসে উঠলো দু’জন। নয়না শোয়া থেকে উঠে বসে, চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে বেঁধে নিলো। অরা ততক্ষণে নয়নার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
” ফ্রেশ হয়ে আয় আগে। তারপর ব্রেকফাস্ট করবি। ”
” তা ঠিক আছে। কিন্তু আমি কিন্তু নাস্তা করেই বাড়ি চলে যাবো। ”
অরা হেসে বলল,
” কেন? আজকেও থেকে যা। ”
” না আপু। আমি তো কালকেই চলে যেতাম। নেহাৎ ভাইয়া থাকতে বলল, না থাকলে যদি তোমাকে কিছু বলত, সেজন্য থেকে গেলাম।”
” ভালো করেছিস। আজ না হয় আমার কথায় থেকে গেলি? ”
নয়না ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসল। অরা নয়নার বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে।
” ঠিক আছে। জানো আপু, ভাইয়া যে এতটা ভালো আগে বুঝিনি। ”
” যেমন?”
” এই যে তোমাকে কত ভালোবাসে, সবকিছু খেয়াল রাখে। তবে হ্যাঁ উনার রাগটা একটু বেশি। তোমাকে বিয়ে করার জন্য যেসব করলো! ”

অরার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। সেইদিনগুলোর কথা মনে পড়লে অশান্তি লাগে ভীষণ। তবে নয়না কী বলল? ভালোবাসে? আরিশ তো ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না। আর না তো অরাকে ভালোবাসে…
” অনেক বলেছিস। পাকাবুড়ি একটা। চল, চল ফ্রেশ হয়ে নে। আমি গেলাম। কাজ আছে আমার। ”
অরা এসব বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নয়না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, ঠোঁটের কোণে প্রসস্থ হাসির রেখা। বোন সুখে আছে – এই ভেবেই মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে তার।
” এত আদিখ্যেতা ভাল্লাগছে না, মা। একে তো ওই মেয়েটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি, আর এখন এসে জুটেছে ছোটো বোন! ”

রাগে হিসহিসিয়ে বলল সাবিহা। নিজের ঘরে মায়ের সাথে বসে কথা বলছে সে। শুধুমাত্র আরিশের জন্য অরাকে কিছু করতে চেয়েও করতে পারে না সাবিহা। অরাকে একটুও সহ্য করতে পারে না সাবিহা। কবে যে মেয়েটাকে বাড়িছাড়া করবে সেই অপেক্ষায় আছে। তাসলিমা খাতুন মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
” শান্ত হ সাবিহা। সবুরে মেওয়া ফলে। এতো তাড়াহুড়ো করলে চলবে না৷ আর রাগ সামলে নিতে হবে। রেগে গেলে তোরই লস। ”
মায়ের কথায় যুক্তি আছে। সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
” ঠিক বলেছ, মা। ”

হামিংবার্ড পর্ব ২৩

” হ্যাঁ। শোন, ক্ষতি করতে গেলে কাছাকাছি থাকতে হয়। দূর থেকে কারো ক্ষতি করা যায় না। সেজন্য তোকে অরার কাছাকাছি যেতে হবে, ওর সাথে ভাব জমাতে হবে। বিশ্বাস অর্জন করলেই তো আঘাত করা যায়। ”
ক্রুর হাসল সাবিহা। মায়ের কথাগুলো বেশ মনে ধরেছে তার।
” ঠিক আছে, মা। আজ থেকে সাবিহার অন্য রূপ দেখবে সবাই। বিশেষ করে অরা। ওহ সরি! অরা ভাবি!”
সাবিহার কথা শেষ হতেই তাসলিমা খাতুন ও সাবিহা একসাথে হেসে উঠলো।

হামিংবার্ড পর্ব ২৫