হামিংবার্ড পর্ব ২৬

হামিংবার্ড পর্ব ২৬
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

“ আমি কীভাবে বলব! আমি কীভাবে বলব, আমার চোখের সামনে ওই জানোয়ারগুলো আমার ভালোবাসার মানুষটাকে খুবলে খেয়েছে! কীভাবে বলব, আমারই চোখের সামনে আমার স্ত্রীর গলা টিপে হত্যা পর্যন্ত করেছে! “
ইন্সপেক্টর রুহুল আমিন থমকে গেলেন। রাশেদের কথাগুলো উনার রুহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। একজন পুরুষের সামনে তার স্ত্রী’র সঙ্গে এমন কিছু ঘটতে দেখলে কেমন অনুভব হতে পারে – তা কল্পনাও করতে পারছেন না রুহুল। রাশেদ ঠুকরে কেঁদে উঠে ফের বলল,

“ আমিও গিয়েছিলাম আপনাদের আইনের কাছে। কিন্তু টাকার সামনে সেই আইন টিকতে পারেনি স্যার। “
ব্যথাতুর দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকালেন রুহুল আমিন ।
“ সবকিছু খুলে বলো রাশেদ। আমি তোমার কথা শুনবো। “
রাশেদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বসা থেকে উঠে ধীরে ধীরে গিয়ে দেয়ালের পাশে দাঁড়াল।
“প্রেমের বিয়ে ছিল আমাদের। পাঁচ বছর প্রেম করার পর পারিবারিকভাবেই বিয়ে করি আমরা। সবাই খুশি মনে আমাদের বিয়ে দিয়েছিল। তখন আমার একটা মার্কেটিংয়ের চাকরি ছিল। সব সময় দৌড়ঝাঁপের মধ্যে কেটে যেত দিন। নীলাকে নিয়ে বিয়ের এক বছরেও কোথাও ঘুরতে যেতে পারিনি। তাই ঈদের ছুটিতে দু’জন মিলে বান্দরবান চলে গেলাম। নীলা ভীষণ খুশি ছিল। এত খুশি, বলে বোঝাতে পারব না। সারা বিকেল পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আমরা যখন প্রায় রিসোর্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, ঠিক তখনই চার-পাঁচজন ছেলে পথ আটকে দাঁড়ায়। নীলা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি ভেবেছিলাম, ওরা ছিনতাইকারী। টাকাপয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু না- তাদের টার্গেট ছিল নীলা। ওরা প্রথমেই আমাকে ধরে হাত-পা বেঁধে দিল, মুখও শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তারপর নীলার মুখও বাঁধা হলো।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলোয় নীলার ছটফটানি দেখছিলাম আমি, অথচ কিছুই করতে পারছিলাম না। কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছিল।
আমার নীলাকে… ক্ষতবিক্ষত করল ওরা।
সবকিছু শেষ করে আমাদের দু’জনকেই ছুরি দিয়ে আঘাত করে ফেলে রেখে গেল। স্থানীয় লোকজন আমাদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। আমি কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম জানি না। হয়তো নীলাকে ওরা যে পাশবিক নির্যাতন করেছিল, তার ফলেই ওর মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু আমি বেঁচে থেকেও যেন প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছিলাম। সুস্থ হয়ে থানায় গিয়েছিলাম। ওরা প্রমাণ চাইলো। ততদিনে নীলাকে কবর দেওয়া হয়ে গেছে।
হাসপাতাল থেকে আমার সুস্থ হয়ে বের হতে চারদিন লেগেছিল। ততদিনে সব প্রমাণ মুছে গেছে। হাসপাতালের ডাক্তার পর্যন্ত মিথ্যে কথা বলল– কোনো ধর্ষণের প্রমাণ নাকি নেই, শুধু ছুরিকাঘাত হয়েছে।

পুলিশ ধর্ষণের মামলা নিল না। শুধু এটেম্পট টু মার্ডার হিসেবে নিল। কিন্তু ওরা কাউকে গ্রেফতারও করল না। পরে বুঝলাম, টাকা দিয়ে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে ওরা। হতাশা আমাকে গ্রাস করে ফেলল। আমি এক অক্ষম স্বামী – নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারিনি, তার সম্মান রাখতে পারিনি। আর না পারিনি তাকে বাঁচাতে। দিন-রাত পাগলের মতো কাঁদতাম।
প্রতি রাতে নীলার সেই অসহায় কণ্ঠের চিৎকার আমার ঘুম কেড়ে নিত, আমাকে পাগল করে তুলত।”
একটু থামল রাশেদ। রুহুল আমিনের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
“ তারপর? “

“ তারপর একটা সময় মনে হলো এই সমাজে ধর্ষকদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। যখন আইন তাদের সাজা দিতে পারেনি, তাদেরকে আমি শাস্তি দেবো। ব্যস! প্রথমেই ওই জানোয়ারগুলোকে খু*ন করলাম। তবে আলাদাভাবে। পাথর দিয়ে সাড়া শরীর থেঁতলে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিয়ে মেরেছি তাদের। সেজন্য ওখানকার পুলিশ বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। ভেবেছিল সবাই পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে, সেজন্য শরীর থেঁতলানো। কিন্তু পরবর্তীতে মনে হলো এতো কম শাস্তি পেয়ে মরলে তো হবে না। ওদেরকে আরো কঠিন শাস্তি পেয়ে মরতে হবে। এমনভাবে মরতে হবে যেন নিজে থেকেই মরার জন্য ছটফট করে।”
“ বুঝতে পেরেছি। আমি আসছি এখন৷ যেহেতু তুমি সবকিছু স্বীকার করেছ এবং তোমার সাথে অন্যায় হয়েছে – তাই তোমার হয়ে আমি সুপারিশ করবো। “

“তারপর এক সময় মনে হলো – এই সমাজে ধর্ষকদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। যখন আইন তাদের সাজা দিতে পারল না, তখন ঠিক করলাম, শাস্তি আমি নিজেই দেবো। ব্যস! প্রথমেই ওই জানোয়ারগুলোকে খুন করলাম। তবে আলাদাভাবে। পাথর দিয়ে তাদের সারা শরীর থেঁতলে, তারপর পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। সেজন্য ওখানকার পুলিশ বিষয়টা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। ভেবেছিল, সবাই পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে – তাই শরীর থেঁতলে গেছে। কিন্তু পরে মনে হলো, এত কম শাস্তি পেয়ে ওদের মরলে তো চলবে না। ওদের এমন শাস্তি দিতে হবে, যেন মরার জন্য নিজে থেকেই ছটফট করে।”
“বুঝতে পেরেছি। আমি এখন আসছি। যেহেতু তুমি সবকিছু স্বীকার করেছ এবং তোমার সঙ্গে অন্যায় হয়েছে – তাই তোমার হয়ে আমি সুপারিশ করবো।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল রাশেদ। ইন্সপেক্টর রুহুল আমিন লকআপ থেকে বেরিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তার মন পড়ে রইল রাশেদের কাছে।

“ আজ আমিও তোমাদের সাথে রান্না করব ভাবি। “
আচমকা সাবিহার এমন আচরণে বেশ চমকে গেল অরা। যে মেয়ে তিন বেলা খাওয়া ছাড়া কিছু করে না, আজ সে নিজে থেকেই রান্না করতে চাইছে! অরা কেউই সাবিহার আচরণটা ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। সবাই জানে, সাবিহা সাধারণত রান্না করার জন্য আগ্রহী নয়। বাড়ির অন্যান্য কাজেও সে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। শুধু খাওয়া ছাড়া, বেশিরভাগ সময় তার সমস্ত সময় টিভি দেখা কিংবা ঘোরাঘুরি করতেই চলে যায়। কিন্তু আজ কী যেন হলো, যেন এক নতুন রূপে আবির্ভূত হল সাবিহা।
তামান্না আড়ালে ভেংচি কেটে বলল,
“ আপনি কি রান্না পারেন, আপা?”
সাবিহা হেসে বলল,

“ পুরোপুরি না পারলেও অল্পবিস্তর তো পারি৷ অরা ভাবিও তো সব রান্না পারে না। আমিও ভাবির মতো সবকিছু শিখে নেবো। কী বলো ভাবি? “
অরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“ হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই শিখে নিবেন৷ শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তো রান্নাবান্না করতেই হবে। “
মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো সাবিহার। বিয়ে! আরিশকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না সে৷
“ হুম। “
সাবিহাকে জব্দ করতে পেরে অরা আর তামান্না বেশ খুশি। ওরা নিজেদের মধ্যে ইশারায় হাসাহাসি করছে। সাবিহা আপাতত অরার কোনো কথা গায়ে না মাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রান্নাঘরে ঢুকে নিজে থেকেই কিছু পেঁয়াজ কাটতে শুরু করে সে। অরা ইলিশ মাছে লবণ, মরিচ আর হলুদ মাখাচ্ছে। তামান্না কড়াইয়ে তেল দিচ্ছে।
“ আচ্ছা ভাবি আমরা সবাই মিলে ছাঁদে পিকনিক করলে কেমন হয়?”
তামান্না সাবিহার কথা শুনে অরার দিকে তাকাল। অরা মুচকি হাসল। মেরিনেট করা মাছগুলো এক এক করে তেলে ছাড়তে ছাড়তে বলল,

“ ভালোই হয়। “
“ তাহলে তালহা ভাইয়া, বাসায় ফিরলে তোমার সাথে কথা বলে সবকিছুর ব্যবস্থা করবে। আরিশ তো এসব আয়োজন করবেই না কখনো। “
“ না, না! তালহা ভাইকে আমার কাছে পাঠানোর দরকার নেই। “
অরা বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল। সাবিহা ঠিক বুঝতে পারছে না, তালহা অরার সঙ্গে দেখা করলে এমন কী হতে পারে– যার জন্য অরা এমন রিয়াক্ট করলো? তবে এতটুকু বুঝেছো, এটা অরার জন্য বেশ অস্বস্তিকর।
“ কেনো ভাবি? তালহা ভাই কি তোমাকে কিছু বলেছে? মানে তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে? “
“ আরে না। “
অরার চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। তালহার সাথে কথা বলেছে শুনলেও আরিশের ক্রোধের মাত্রা বেড়ে যাবে। সাবিহা অরাকে আরকিছু বলার আগেই তামান্না বলল,
“ আরিশ ভাই কি আপনার থেকে ছোটো, সাবিহা আপা?”
তামান্নার প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো সাবিহা। অরা ঠোঁট টিপে হাসছে।

“ কেনো বলো তো?”
“ না মানে তালহা ভাইকে, ভাই বলে ডাকেন। অথচ আরিশ ভাইকে, নাম ধরে…. তাই আরকি!”
কপাল কুঁচকে ফেলল সাবিহা। ইচ্ছে করছে, এই তামান্নার গালে সজোড়ে একটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু কিছু করা যাবে না এখন। সাবিহা মেকি হাসল।
“ এমনি। আচ্ছা আমি আসছি এখন৷ তোমরা তো সব কাজ করেই ফেলেছ৷ “
“ ওকে আপু। “
সাবিহা আরকিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। তামান্না ও অরা হাসছে, সাবিহার অবস্থা দেখে।
সন্ধ্যাবেলা সাবিহা তালহাকে পিকনিকের সব পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল। তামান্না, অরা, সাবিহা আর তালহা মিলে একসাথে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিলো। ঠিক হলো–ছাদে বসে পিকনিক হবে। আলাপচারিতা শেষ হতে হতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। অরা নিজের রুমের দিকে চলে গেল। তামান্নাও রাতের খাবার গরম করতে রান্নাঘরের দিকে এগোল। ড্রইংরুমে এখন শুধু সাবিহা আর তালহা বসে আছে। দু’জনে কিছুক্ষণ পিকনিক নিয়ে কথা বলছিল।
এরমধ্যে সাবিহা কয়েকবার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তালহা টিভি দেখছে আর মাঝে মাঝে বোনের সঙ্গে কথা বলছে। হঠাৎ সাবিহা এগিয়ে এসে বলল,

“ভাইয়া, অরা ভাবি আপনাকে ডাকছে।”
তালহা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভাবি? কোথায় ডেকেছে? ”
টিভির দিকে তাকানো অবস্থায়ই শুধালো তালহা। সাবিহা তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ হ্যাঁ ভাবি, রুমেই ডেকেছে। বলল, কী একটা জরুরি কথা আছে। তুমি এখুনি যাও। “
“ ওকে। “
অরা জরুরি কথা বলবে শুনে তালহা আর সময় নষ্ট করলোনা। দ্রুত অরার রুমের দিকে এগোল।
বিছানা গোছগাছ করছিল অরা। এমন সময় ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ফিরে তাকাল সে।
“ ভাবি মা, তুমি ডেকেছ?”
তালহাকে বেডরুমে দেখে গলা শুকিয়ে গেল অরার। মাত্র আরিশের গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেয়েছে সে। তারমানে আরিশ যেকোনো মুহুর্তে রুমে চলে আসবে! অরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তালহাকে যে ঘর থেকে চলে যেতে বলবে সেটাও পারছে না। তালহা অরাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে বলল,

“ তুমি ঠিক আছো? “
ঘোর কাটলো অরার। তালহার দিকে এগিয়ে কণ্ঠে অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“ আমি ঠিক আছি ভাইয়া। আপনি ড্রই রুমে গিয়ে বসুন। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি, কেমন মাথা ব্যথা করছে। “
“ আমি তামান্নাকে দিয়ে বাম পাঠিয়ে দিচ্ছি রুমে। নিচে যাওয়ার দরকার নেই। তারচে বরং তুমি রুমে বসেই আরাম করো। “
“ কী হয়েছে তালহা? আরাম করার কথা হচ্ছে যে?”
আরিশের গলা শুনে রীতিমতো কেঁপে উঠল অরা।দরজার দিকে তাকাতেই তাকে দেখতে পেল – কালো ফরমাল শার্ট আর প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো লালচে হয়ে গেছে, মুখটা কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। আরিশ ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। তালহা বলল,

“ ভাবি মা, ডেকেছিল আমাকে। কিন্তু রুমে এসে শুনি মাথা ব্যথা করছে। তাই বললাম রুমে থেকে আরাম করতে, এখন ড্রইং রুমে যাওয়ার দরকার নেই । আমি গিয়ে বাম পাঠিয়ে দিচ্ছি। “
অরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কোনো কথা বলছে না। শুধু আরিশের দিকে তাকিয়ে আছে।
“ কোনো ঔষধ লাগবে না, তালহা। লাগলে আমি দিয়ে দেবো। চিন্তা করিস না। তুই যা, আমি দেখছি তোর ভাবি মা’কে। “

হামিংবার্ড পর্ব ২৫

“ ঠিক আছে ভাইয়া। গুড নাইট। “
“ হুম, গুড নাইট। “
তালহা অরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

হামিংবার্ড পর্ব ২৭