নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৩

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৩
সিনথিয়া

“আপনাকে ভালো মানুষ ভেবে ছিলাম আমি! বিশ্বাস করেছিলাম। আপনার কথা ভেবে বিয়ে পর্যন্ত করে রাজি হয়ে গেলাম দু’দিনের পরিচয়ে! অথচ সেই বিশ্বাসের এই মূল্য দিলেন আপনি?”
আনত মুখে দাঁড়িয়ে আয়ান। জারার কথার প্রতিউত্তর দেয়ার মতো শব্দ ফুঁড়িয়েছে যেনো। তাকানোর সাহসটুকু পর্যন্ত পাচ্ছে না ও।
ফোঁস করে শ্বাস ফেললো মেয়েটা। পরপর বলল,
“এখন আমি আপনাকে একটা সাজেশন দেই?”
এবারটায় আয়ান চাইলো ওর দিকে। চোখগুলো ফুলে লাল। কেঁদেছে ভীষণ। কেনো কাঁদলো? জারা বকেছে বলে?
মেয়েটা গললো না তাতে। খ্যাঁক করে বলে উঠলো,
“এবার থেকে অন্য কাউকে মিথ্যে বলে সিমপ্যাথি আদায় করার আগে দুবার ভেবে নেবেন আয়ান হান্টার। সবাই কিন্তু জারা নয় যে এমনি এমনি আপনাকে ছেড়ে দেবে!”
অনুতাপে গলা ধরে আসলো আয়ানের। দু’কদম এগিয়ে আসলো জারার হাতটা ধরতে। কিন্তু অমনি পিছিয়ে গেলো মেয়েটা।
বরফ ঢাকা রাস্তায় তাকিয়ে বললো,

“একদম কাছে আসবেন না আমার। রাগের মাথায় কি করতে কি করে ফেলবো ঠিক নেই! জানের পরোয়া করে হলেও দূরে থাকুন আমার থেকে !”
থেমে গেলো মানুষটা। জারা ততক্ষণে হাঁটা শুরু করেছে উল্টো ঘুরে। আয়ান ডাকতে চাইলো মেয়েটাকে। গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদলে বোধ হয় হালকা লাগতো বুকটা।
কিন্তু পারলো না ও।
অমনি হাঁটু ভেঙে এলো ওর। বরফের ওপরই ধপ করে বসে পড়লো আয়ান। বুকের বা পাশে ভেঙেচুরে যাচ্ছে কিছু একটা।
নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হলো ভীষণ।
ছোটবেলা থেকেই বেশি কাঁদলে শ্বাস কষ্ট শুরু হতো ওর। তাই মা মারতো না। বাবা বকতো না। যদি ছেলে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যায়! আজ অনেকগুলো বছর হলো এমন করে ভাবে না কেউ ওর জন্য। যারা ভাবতো তারাই যে আর নেই এই পৃথিবীতে।
আর যাকে আঁকড়ে ধরে বাকিটা জীবন পার করবে ভেবেছিল, সে-ও যে ভুল বুঝে অনেকটা দূরে চলে গেলো!
এসব ভাবতে ভাবতেই বরফের ওপর শরীরটা হেলে পড়লো ওর। চোখ দুটো বোজবার আগে শুধু দেখলো একটা মেয়ে ছুটে আসছে কাছে। নিশ্বাস পড়ছে না হয়তো ওর। কিন্তু ইন্দ্রীয় গুলো বলছে জারা এসেছে। উদভ্রান্তের মতো; ছুটতে ছুটতে! তবে কি সে-ও একটু হলেও চিন্তা করে আয়ানের জন্য? অনেকগুলো বছর আগে যেমনটা ওর মা করতো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চাঁদের মতো উন্মুক্ত উরুর উপর থেকে ধ্যান সড়ছে না শেহজাদের। মন বলছে বেপরোয়া ভাবে ছুঁয়ে দিতে ঘুমন্ত শরীরখানা। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে অন্য কথা।
আরশির করা অভিযোগের উর্ধ্বে গিয়ে মনকে প্রশ্রয় দিলে যদি ভুল বোঝে মেয়েটা?
অভিমান-অভিনয়ের পাল্লাটা যদি আরো ভারি হয়ে ওঠে ওদের মধ্যে?
কিন্তু সমস্ত হিসেব নিকেশ ভুলে আজ যে বেহায়া হওয়ার পায়তারায় বেইমানী মনটা।জানালার কাঁচ ভেদ করে আসা নরম আলোয় ডানা মেলতে চাইলো নিষিদ্ধ কিছু ইচ্ছেরা।
শেহজাদের তেষ্টা মেটেনি এখনো। শুকনো ঢোকের সাথে এ্যাডম অ্যাপলটা ওঠানামা করলো কেবল। আস্তে-ধীরে বিবশ দেহটা ভর ছেড়ে দিলো আরশির ছোট্ট শরীরের ওপর। এতো ব্রিলিয়ান্ট মানুষটার মস্তিষ্ক শূন্যের দোরগোড়ায় এখন। কোনোকিছু আর কাজ করছে না সেখানে।
কিন্তু যে শেহজাদ আরশির চোখে রগচটা, রাগী, গম্ভীর! সেই শেহজাদের এই রূপের সামনে যে বড্ড নাজুক ওর প্রতিপক্ষ।

“এসব কিন্তু একদম মানাচ্ছে না তোমাকে প্রফেসর! কোথায় গেলো তোমার রুলস এন্ড রেগুলেশন? নিজের পুরোনো সত্তাটাকে এতো সহজে ভুলে বসলে ঐ একরত্তি মেয়ের কাছে?”
মানুষটার মনে হলো, কানের কাছে প্রহসনের সুরে কথাগুলো বললো কোনো এক সত্তা।
যে সত্তাটা যান্ত্রিক! হাসতে ভুলে গেছে সেই আঠারো বছর আগে। নিজের বোনের হারিয়ে যাবার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে আরশিকে বিয়ে করে। অবহেলা করেছে দিনের পর দিন।
সেই সত্তার খোলস ভেঙে বেরোতে কি আদৌ পারবে ও কখনো?
শেহজাদের ভারে নড়েচড়ে উঠলো আরশি।
ফর্সা কপালে ভাজ পড়লো। বন্ধ চোখের ওপরের ভ্রু জোড়া এক হতেই সোজা হয়ে বসলো শেহজাদ। অমনি মেয়েটারও নড়াচড়া বন্ধ হলো। তলিয়ে গেলো সুখ নিদ্রায়। তবে ঘুমের ঘোরেই বিরবির করে বলল,

“চুপচাপ থাকি বলে একেবারে মাথায় পেয়ে বসেছিস তাই না? তোর মতো একশটা জাম্বুবানের লিডার আমি! আয় কত ভাব দেখাবি আয়!”
ঠোঁট কামড়ে হাসলো শেহজাদ। আরশির কপালের ওপর পড়ে থাকা চুল গুলো আঙুল দিয়ে ঠেলে কানের পিছনে নিলো। অধর ছোঁয়ালো কপালের মাঝখানটায়।
পরপর আলগোছে বুকে তুলে নিলো ওকে। মেয়েটাকে বালিশে শুইয়ে ওর পাশে বসলো। আজ রাতে আর ঘুম হবে বলে মনে হয় না ওর? কি করবে তাহলে? আরশিকে দেখে দেখে পার করবে রাতটা?
তক্ষুনি প্রেমিক প্রমিক ভাবনাটা লুফে নিলো প্রফেসরের মন। বউকে দেখে রাত পার করার মতো এমন সু্যোগ মিস করার তো প্রশ্নই ওঠে না!

সকাল হতে দেরি নেই। ভোরের আলোয় তুষার গলতে শুরু করেছে রাতের গা বেয়ে। আয়ানও চোখ মেলেছে কেবল। শ্বাসের গতিও এখন অনেকটাই শিথিল।
কিন্তু যখনই উঠে বসতে যাবে তখনই ভার লাগলো হাতের ওপরটায়। সেখানে যে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে কেউ একজন।
মনে পড়লো রাতের কথা। ঐটুকু মেয়ে নিজের কাঁধে আয়ানের সবটুকু ভার ফেলে কিভাবে নিয়ে এসেছিল বাসায়।
ভাগ্যিস একটু হলেও জ্ঞান ছিল তখন ওর।
আয়ান আর ডাকলো না। সারারাত নিশ্চয়ই চিন্তায় ঘুম হয়নি জারার। তাই তো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে এখন।
তখনই তারস্বরে বেজে উঠলো আয়ানের মুঠোফোনটা। ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো জারারও। ও উঠতেই ফের চোখ বুঁজে ফেললো আয়ান। সুস্থ হয়ে গেছে দেখলে যদি আবারও ছেড়ে যাওয়ার কথা বলে মেয়েটা?
উঠেই একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আয়ানের দিকে তাকালো জারা। কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা দেখলো।

বুঝলো ডক্টরকে এখন আর ফোন করতে হবে না।
যদিও বাসায় আনার পরপরই ডক্টর একটা ‘সালবিউটামল’ ইনজেক্ট করে দিয়েছিল আয়নাকে শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল বলে। এখন শুধু একটু চোখে চোখে রাখতে হবে।
জারা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। উঠে দাঁড়াতে নিলেই কানে আসলো আয়ানের কন্ঠ।
“আ’ম সরি বাটারফ্লাই!”
মায়া হলো ভীষণ মেয়েটার। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন লাগছে?”
এবার উঠে বসলো আয়ানও। কন্ঠে অনুতাপের জোয়ার। গলায় মুখ গুঁজে বলল,
“যতক্ষণ না পর্যন্ত তুমি ক্ষমা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো লাগবে না!”
জারা থামলো কিছুক্ষণের জন্য। পরপর জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার কি এমন আগেও হয়েছে? আপনার ফ্যামিলি জানে আপনি যে এতোটা অসুস্থ?”
মানুষটা হাসলো নিচের দিকে তাকিয়ে।

“আগেও হয়েছে কি না? হ্যাঁ! অনেকবারই হয়েছে। আর মম-ড্যাড তো আমি ছোট থাকতেই এক্সিডেন্টে মারা যান। তাই আপতত ফ্যামিলি বলতে কিছু নেই আমার। তাই জানানোর প্রয়োজনও বোধ করি কাউকে!”
আয়ানের হেম চোখ চিকচিক করে উঠছে পানিতে। জারা বোঝে এই কষ্টটা। মা-বাবা না থাকার কষ্ট ওর থেকে ভালো আর কেউ জানে না হয়তো!
“আজ আর বের হবেন না প্লিজ! রেস্ট নিন বাসায় বসে!”
মানুষটা মাথা তুললো। দুদিকে ঘাড় নাড়িয়ে বললো,
“না না। কাজ যেহেতু আছে বাইরে তো যেতেই হবে। তাছাড়া একা একা বাসায় বসে থাকলে বোর হবো!”
মেয়েটার চোখ-মুখ জুড়ে দোটানা। তবুও যেনো হুট করে বলে ফেললো,
“চিন্তা নেই! আমিও বাসায় থাকবো আপনার সাথে আজকে!”

কিচেন কেবিনেটের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আরশি। পরনে রাতের মিকি-মাউস আঁকা টি-শার্ট আর প্লাজো। যেটার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেখেয়ালে উকিঁ মারছে কিশোরীর ফর্সা গতর।
ফোঁস করে শ্বাস ফেললো আরশি। সাইজে ছোট হওয়ার অন্যতম ঝামেলা এই উঁচু উঁচু কেবিনেটগুলো। কোনো কিছু নামাতে গেলে শেহজাদকে ডেকে আনা ছাড়া উপায় থাকে না ওর।
শেষমেষ কর্ণফ্লেক্সের বয়ামটা নামাতে দু’পায়ের আঙুলে ভর দিলো মেয়েটা। উঁচু হয়ে দাঁড়াতেই ভেবেছিল নামিয়ে ফেলবে; কিন্তু হলো না।
তখনই পিছন থেকে ওর কোমর জড়িয়ে ধরলো একজোড়া শক্ত হাত। হকচকালো আরশি। কিছু বলে ওঠার আগেই সেই হাত জোড়া শূন্যে তুললো ওকে। আরশি কেবিনেটের ওপর হতে বয়ামটা নিতেই পরপর নামিয়ে ফেললো ওকে শেহজাদ।

আরশির চোখ দুটো বিস্ময়ে ফুটবল। ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে মানুষটাকে দেখে। কালো ভেস্ট আর সাদা শার্টে শেহজাদের মুখাবয়ব নিরেট। গম্ভীর কন্ঠে আওড়ালো,
“ব্রেকফাস্ট করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসো। বেশি দেড়ি করলে পরে কিন্তু ট্রেন পাবে না !”
আরশির চোয়াল বিস্ময়ে ঝুলে আছে তখনও।কোমরের দু’পাশ জ্বলছে ভীষণ।
গাড়ির চাবি আর ব্লেজারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেদিকে তাকালো একবার লোকটা। আরশিকে ঈষৎ রাঙা গালদুটোকে পুরোপুরি টমেটো বানাতেই যেনো বলে উঠলো,
“সামান্য কোমর ধরতেই যদি লাল হয়ে যাও, অন্য কিছু করলে তো তাকানো যাবে না তোমার দিকে!”
কথাখানা বলে আর অপেক্ষা করলো না শেহজাদ। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে যেতেই তেঁতে উঠলো আরশি। লোকটার খোঁচা দেয়া কথার পিঠে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলল,
“অন্য কিছু করলে তো তাকানো যাবে না তোমার দিকে! এ্যাহ! নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছে কখনো? পুরো তো জাম্বুবানের ডিউপ ভার্সন আর আমাকে কি না আসে খোঁচা মারতে! কত্ত বড় সাহস এই বেটার!”

পেন স্টেশনে অপেক্ষা করছে নিউইয়র্ক ইউনির্ভাসিটির অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে। এখান থেকে অ্যামট্রাক ট্রেনে করে শিকাগো পৌঁছোবে ওরা। প্রায় পনেরো-ষোলো ঘন্টার রাস্তা। তাই সবার প্রস্তুতিও সেরকম। গ্রেন্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কে যেতে একেক জনের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই।
আরশি এসেছে মাত্র। তবে মনটা খারাপ ভীষণ। জারা শেষ মূহুর্তে প্ল্যান ক্যান্সেল করায় নিজেও আর ক্যাম্পিং এ যাওয়ার আগ্রহ পাচ্ছে না ও।
ভার্সিটির কয়েকজন প্রফেসর সবার জন্য টিকিট কাটতে ব্যস্ত। শেহজাদও রয়েছে সেখানে। কিন্তু একটু পরপরই চোরাচোখ ভীরের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দেখছে আরশিকে। কালো ওভারকোট আর জিন্সে আজ যেনো একটু বেশিই কিউট লাগছে মেয়েটাকে?

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১২

হাসলো ও। কিন্তু হুট করে রেজাকে আরশির কাছে দৌঁড়ে আসতে দেখে, একটু আগের সেই হাসিতে ভাটা পড়লো শেহজাদের। গলার টাই-টা এক হাত ঢিলে করলো নিজেকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে। মনে মনে ভাবলো, এই বিটকেল ছেলেটাকে কিছুতেই ট্রেনে ওর বউয়ের পাশে বসতে দেয়া যাবে না; কিছুতেই না!

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৪