আযদাহা পর্ব ৪৩

আযদাহা পর্ব ৪৩
সাবিলা সাবি

রাত গভীর,কক্ষের চারপাশে নিস্তব্ধতা।আজ দুদিন বাদে ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেল।মাথার পাশেই দেখতে পেল জ্যাসপার, বেডের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।তার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট,যেন অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে।
ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে বসল,তার মনেই হলো জ্যাসপার এতটা ক্লান্ত কেন।তার হাত আলতো করে জ্যাসপারের গালে ছুঁয়ে দিল।স্পর্শের সাথে সাথেই জ্যাসপারের ঘুম ভেঙে গেল। তড়িঘড়ি করে সে চোখ খুলল,আর ফিওনাকে জেগে বসে থাকতে দেখে যেন তার চোখে বিস্ময় আর স্বস্তি একসাথে ফুটে উঠল।
জ্যাসপার কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফিওনাকে জাপ্টে ধরল।তার শক্ত আলিঙ্গনে ফিওনার শরীর প্রায় পিষে যাচ্ছিলো।তবুও ফিওনা কিছু বলল না,বরং জ্যাসপারের উষ্ণতা অনুভব করছিল।
জ্যাসপার কাঁপা কণ্ঠে বলতে শুরু করল,”হামিংবার্ড,তোমার জ্ঞান ফিরেছে!অবশেষে!তুমি ঠিক আছো?শরীর ভালো লাগছে এখন?”

ফিওনা কিছুটা অবাক হয়েও মৃদু হাসল,তার গলার স্বরে ক্লান্তি আর শান্তি মিশে ছিল।সে কোনো উত্তর না দিয়ে আলতো করে মাথা নাড়ল।জ্যাসপার তখনও তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল,যেন আর কখনো তাকে হারানোর ভয় সে পেতে চায় না।
কক্ষের মধ্যে তখনও একটা নীরবতা বিরাজ করছে,কিন্তু এই নীরবতার ভেতরেই যেন এক গভীর সংযোগ তৈরি হচ্ছিল, তাদের দুজনের মধ্যে।
ফিওনা জ্যাসপারের এমন উদ্বিগ্ন মুখ দেখে মৃদু হেসে বলল, “আমি ঠিক আছি, প্রিন্স।আপনি এতটা চিন্তা করেছন কেন? আমি তো কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিলাম না।”
জ্যাসপার তার বাঁধা কণ্ঠে বলল,”তোমার কিছু হলে আমি কী করতাম,হামিংবার্ড?তোমার দেহ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে তোমাকে বাঁচাতে ডক্টর আগ্নিসের সাহায্য নিতে হয়েছিল। আমি কখনও এতটা অসহায় বোধ করিনি।”
ফিওনা তার কথা শুনে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন।আমি জানি না কীভাবে আপনার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছি,কিন্তু আপনার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।আপনি সব সমস্যা ঠিক করে দেবেন।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপার তার চোখে দৃঢ় সংকল্পের ছায়া ফুটিয়ে বলল,”তুমি শুধু আমার।আমি তোমাকে রক্ষা করব,যেকোনো মূল্যে।”
ফিওনা তার শক্ত আলিঙ্গনে নিজেকে সুরক্ষিত অনুভব করছিল।তার হাত আলতো করে জ্যাসপারের বুকের ওপর রাখল,যেন বলতে চাচ্ছে,”আপনার এই শক্তির ভেতরেই আমি নিরাপদ।”
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জ্যাসপার তার কণ্ঠে কোমলতা এনে বলল,”তুমি এখন বিশ্রাম নাও।আমি এখানে আছি, হামিংবার্ড।তুমি আমার চোখের আড়াল হবে না আর।”
ফিওনা মৃদু মাথা নাড়ল।তার ক্লান্ত শরীর আবারও ঘুমিয়ে পড়ল,কিন্তু এইবার তার মনে শান্তি ছিল।জ্যাসপার তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল,যেন এই পৃথিবীর কোনো বিপদই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
ফিওনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে অবশেষে প্রশ্ন করল, “কিন্তু আমার আসলে কী হয়েছিল,প্রিন্স?আমি জ্ঞান হারালাম কেন?আর হঠাৎ করে জ্বর এলো কীভাবে?”

জ্যাসপার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ রইল।ডক্টর আগ্নিস যা বলেছিল,তা মনে পড়তেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল।ফিওনাকে সত্যি জানালে সে ভয় পাবে—এটা সে চাইছিল না।তাই গভীর একটা শ্বাস নিয়ে সে ফিওনার প্রশ্নটা এড়িয়ে দিল।
“আমার রোমান্সের তাপে তোমার জ্বর এসেছিল,হামিংবার্ড,” সে মৃদু হেসে বলল।তার কণ্ঠে ছিল হাস্যরসের আবরণ,কিন্তু চোখে লুকিয়ে ছিল অন্যরকম ভাবনা।
ফিওনা কিছুটা লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল।তার মনে পড়ল সেদিনের মুহূর্তগুলোর কথা—তাদের অন্তরঙ্গ সময়,তাদের মিলনের গভীর অনুভূতিগুলো।নিজের মনে সেই স্মৃতির ঝলক খেলতেই ফিওনা মুখ লুকিয়ে রাখল জ্যাসপারের প্রশস্ত বুকের ভেতর।
জ্যাসপার ফিওনার সেই প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝে গেল তার ভাবনা।সে মৃদু হেসে ফিওনার মাথায় হাত রাখল,আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে তার চুলে বিলি কাটতে লাগল।মনে মনে বলল, “তোমাকে এসব থেকে দূরে রাখতে পারলেই আমি শান্ত।”

রাত তখন আরও গভীর।কক্ষের নিস্তব্ধতা তাদের একে অপরের আরও কাছে নিয়ে আসছিল।কিন্তু জ্যাসপারের চোখের গভীরে একটা চিন্তা থেকে যাচ্ছিল—ফিওনাকে রক্ষা করার চূড়ান্ত দায়িত্ব তার নিজের।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ ফিওনার পাশে বসে ছিল,কিন্তু হঠাৎ যেন কিছু একটা মনে পড়ল।সে নীরবে ফিওনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,”তোমার এখন খাবার খাওয়ার আর ঔষধ নেওয়ার সময় হয়েছে হামিংবার্ড।”
এটা বলেই সে ধীরে ধীরে ফিওনাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।ফিওনা কিছু বলতে চাইলেও জ্যাসপারের দৃঢ় চাহনি দেখে কিছুই বলতে পারল না।
জ্যাসপার দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করল।তার ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল,কিন্তু সে সেটা প্রকাশ না করেই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।কিছুক্ষণ বাদে ফিওনার কক্ষে অ্যাকুয়ারা এসে পৌঁছাল।তার হাতে ছিল সুস্বাদু খাবারের ট্রে আর একপাশে রাখা ছিল ফিওনার ঔষধ।

অ্যাকুয়ারা ফিওনার সামনে খাবার রাখল আর নরম গলায় বলল, “এখন কেমন আছো ফিওনা ? এইযে তোমার খাবার আর ঔষধ নিয়ে এসেছি। প্রিন্স আমাকে বিশেষভাবে বলেছে,এখন থেকে তোমার খাবার আর যত্নের দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার ওপর।”
ফিওনা অবাক হয়ে বলল, “অ্যাকু!সে নিজে এল না কেন?”
অ্যাকুয়ারা একটু হাসল,যেন সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অনুমতি নেই।”প্রিন্স তোমাকে বিশ্রাম নিতে বলেছে।তোমার যত্ন নেওয়াই ওনার সবচেয়ে বড় চিন্তা এখন,” বলেই সে চুপ হয়ে গেল।
ফিওনা খাবার খেতে বসে মনেমনে ভাবল,জ্যাসপারের আচরণে কিছু একটা বদল ঘটছে,কিন্তু সেটা কী,সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না।

জ্যাসপার নিজের কক্ষে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা বাড়াচ্ছিল, কিন্তু দরজার সামনে এসে অ্যালিসার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেল।অ্যালিসার চেহারা স্পষ্টতই রাগে ফেটে পড়ছিল।
অ্যালিসা কোনো ভূমিকা না করেই সরাসরি প্রশ্ন করল, “আপনি সেদিন আমাকে কক্ষে বসিয়ে রেখে কোথায় গিয়েছিলেন প্রিন্স?”
জ্যাসপার তার স্বাভাবিক গম্ভীর ভঙ্গিতে উত্তর দিল,”একটা জরুরি কাজ ছিল,তাই বের হতে হয়েছিল।”

অ্যালিসার চোখ আরো সংকুচিত হয়ে গেল।তার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতা যুক্ত হলো।”জরুরি কাজ?আপনি আমাকে একবার বলেও যেতে পারতেন।আমাকে ওভাবে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়া আমার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক ছিলো,প্রিন্স।”
জ্যাসপার তার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “অ্যালিসা, ড্রাগন প্রিন্সদের জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন কাউকে কিছু ব্যাখ্যা করার সময় থাকে না।আর আমার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তোমাকে অপমান করার।তুমি যদি বিষয়টাকে ব্যক্তিগতভাবে নেও,তবে আমি দুঃখিত।তবে আমার কাজটা আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।”
অ্যালিসা তার জবাবে আরো রেগে গেল,”আপনার কাছে কি আমি এতটাই অপ্রয়োজনীয়,প্রিন্স?”
জ্যাসপার এবার সোজাসুজি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার অপ্রয়োজনীয় হওয়া বা না হওয়ার প্রশ্ন নয়, অ্যালিসা।আমি যা করেছি,সেটি পরিস্থিতির প্রয়োজনেই করেছি।আশা করি তুমি এটা বুঝবে।”
অ্যালিসা তার জেদী স্বরে আবার প্রশ্ন করল,”আপনি তো এখন ফিওনার কক্ষ থেকে বের হলেন তাই না?এই মানব কন্যার কক্ষে আপনি একা কী করছিলেন?”

জ্যাসপারের পা থেমে গেলো।ধীরে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে তার গভীর চোখে অ্যালিসার দিকে তাকাল।তারপর শান্ত গলায় বলল,”ফিওনা অসুস্থ।এটা তুমি জানো নিশ্চয়ই।তার খোঁজখবর নিতেই গিয়েছিলাম।কারণ সে আমার প্রয়োজনীয় জিনিস।তাই তাকে সুস্থ হতে হবেই,বুঝলে?”
অ্যালিসা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রতিক্রিয়া দিল,”একটা সাধারণ মানব কন্যা,আর কিছুই না।সে কীভাবে আপনার জন্য এতটা প্রয়োজনীয় হলো,সেটাই এখনো বুঝতে পারলাম না।”
জ্যাসপার এবার কোনো জবাব দিল না।তার চোখের গভীরতা যেন আরও গভীর হলো,যেন কোনো কিছু বলার চেয়ে নীরবতাই বেশি শক্তিশালী।স্লাইডিং দরজা খুলে নিজেকে কক্ষে প্রবেশ করাল।
অ্যালিসা দাঁড়িয়ে রইল,তার মুখভঙ্গিতে হতাশা আর ঈর্ষার ছাপ স্পষ্ট।কিন্তু জ্যাসপার আর একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।

অ্যালিসা আর দাঁড়িয়ে রইল না।রাগে গজগজ করতে করতে সে সোজা লিভিং রুম পেরিয়ে মাউন্টেন গ্লাস হাউজের বাইরে বেরিয়ে এলো।বাইরে রাতের ঠান্ডা বাতাস বইছিল আর চারপাশের পাহাড়ের শিখরে জমে থাকা হালকা কুয়াশা যেন তার মনের মেঘমালা প্রতিফলিত করছিল।
সে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল,যেখানে তারা ঝলমল করছিল।তার মুখে দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল। অ্যালিসার মনে ক্রোধ,অভিমান আর অপমানের এক অদ্ভুত মিশ্রণ খেলা করছিল।
নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল,”এই মানব কন্যা কীভাবে প্রিন্স জ্যাসপারের এতটা মনোযোগ পায়?আমি এখানে তার জন্যই এসেছি,অথচ সে…” কথাটা শেষ না করেই সে এক ঝটকায় ঘুরে হাঁটা শুরু করল,যেন কোনো দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
অ্যালিসার মন একটাই স্থির ছিল—সে জ্যাসপারকে হারাতে দেবে না,বিশেষ করে এমন এক সাধারণ মানবীর কাছে।

তিন‌দিন পেরিয়ে গেলো,তিন দিন ধরে ফিওনা জ্যাসপারের এক ঝলক দেখারও সুযোগ পাচ্ছে না।এই হঠাৎ দূরত্ব যেন ফিওনাকে ভেতরে ভেতরে আরও ব্যাকুল করে তুলেছে। জ্যাসপার সবসময় তার কাছাকাছি থাকত,তার যত্ন নিত, আর এখন যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে।
ফিওনা বারবার নিজের মনে প্রশ্ন করে,”হঠাৎ জ্যাসপার এভাবে দূরে সরে গেল কেনো?তার তো কোনো মিশন নেই, তাহলে এমন আচরণ কেনো করছে?”
এদিকে ফিওনা জানতেও পারে না,গভীর রাতে যখন সে গভীর ঘুমে থাকে,জ্যাসপার তখন চুপিসারে গ্লাস হাউজে আসে।ফিওনার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখে,যেন নিজের সমস্ত ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা ভুলে যায়।তার নির্ঝঞ্ঝাট ঘুমন্ত মুখ দেখে জ্যাসপারের হৃদয়ে অজানা আবেগ খেলে যায়।

কিন্তু ভোর হওয়ার আগেই সে নিজের কক্ষে ফিরে যায়,যাতে ফিওনা বুঝতে না পারে।জ্যাসপারের কক্ষের পাসওয়ার্ড এখন একদম প্রাইভেট করে রেখেছে,যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
ফিওনা যতই চেষ্টা করে,জ্যাসপারের হঠাৎ এই ব্যবহারের কারণ খুঁজে পায় না।সে আরও চিন্তিত হয়ে পড়ে।তার মন বলছে,”এই দূরত্বের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কিন্তু জ্যাসপার কি সত্যিই আমাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে, নাকি অন্য কিছু লুকোচ্ছে?”
এদিকে জ্যাসপারও নিজের ভিতরে এক কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।ফিওনার প্রতি তার টান দিনে দিনে বেড়েই চলেছে,কিন্তু সে জানে,এই টান তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে,আর ফিওনার জন্য আরও বেশি।তাই সে নিজেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করছে,যদিও তার হৃদয় তাকে বারবার ফিওনার কাছে টেনে নিয়ে যেতে চায়।

আজ ফিওনার মনটা খুব খারাপ।বিষন্নতা যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।সেই কারণেই সে অ্যাকুয়ারাকে বললো,”আমাকে আজকে বাইরে নিয়ে চলো।একটু মুক্ত বাতাসে যেতে ইচ্ছে করছে।”
অ্যাকুয়ারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”দুঃখিত,ফিওনা। প্রিন্সের স্পষ্ট আদেশ রয়েছে,তার অনুমতি ছাড়া তোমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”
ফিওনা হতাশ হয়ে মনে মনে ভাবলো,”জ্যাসপার তো আমার সামনে আসছে না।তাহলে অনুমতি চাইব কীভাবে?আমাকে এভাবে ব*ন্দি করে রাখার কোনো মানে হয় না।”
তবু ফিওনা আশা ছাড়েনি।সে এরপর এথিরিয়নের কাছে গেলো,ভেবেছিলো হয়তো সে সাহায্য করবে।কিন্তু এথিরিয়নও জ্যাসপারের কড়া আদেশের কথা মনে করিয়ে দিলো। “দুঃখিত,ফিওনা।জ্যাসু ভাইয়া স্পষ্ট করে বলেছে, তার অনুমতি ছাড়া তুমি গ্লাস হাউজের বাইরে যেতে পারবে না।আমি কোনো নিয়ম ভাঙতে পারবো না।”
এ কথায় ফিওনার মন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো।সে বুঝতে পারছে না কেন জ্যাসপার এমন আচরণ করছে।তার তো কোনো অপরাধ নেই।কেন তাকে এই গ্লাস হাউজে আটকে রাখা হচ্ছে?ফিওনার মনে প্রশ্নের পাহাড় জমতে লাগলো,আর সেই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর সে খুঁজে পাচ্ছিলো না।

ফিওনা অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলো কীভাবে তার বিষণ্ন মনটা একটু ভালো করা যায়।বাইরে যাওয়া অসম্ভব,কিন্তু গ্লাস হাউজের ছাদ তো তার জন্য উন্মুক্ত।এই ভেবে সে একা একাই ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
বিকেল তখন প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি।নরম আলো ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে,আকাশে সূর্যের শেষ রশ্মি মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে।ফিওনা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো।
ছাদে পৌঁছে চারদিকে তাকিয়ে তার মনে একটু প্রশান্তি এল। ছাদের চারপাশে কাচের দেওয়ালের বাইরে দেখা যাচ্ছিলো বিশাল জলপ্রপাত,আর দূরে ঘন সবুজ অরণ্য।বিকেলের ঠাণ্ডা হাওয়া ফিওনার চুল এলোমেলো করে দিলো।
সে কাঁচের দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো,দু’হাত দিয়ে কাঁচটা স্পর্শ করলো আর নিচে দূরের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো।প্রকৃতির এই নীরব সৌন্দর্য তার ভেতরের ভারাক্রান্ত মনকে কিছুটা হলেও হালকা করে দিলো।
ফিওনা গভীরভাবে শ্বাস নিলো,আর মনে মনে বললো, “এমন জায়গায় যদি সবসময় মুক্ত থাকতে পারতাম!এতটা বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না।”

তারপর একটু হাসি ফুটলো তার মুখে।প্রকৃতির এই সৌন্দর্য যেন তাকে নতুন করে সাহস যোগাচ্ছে।তবে সে জানতো না, দূর থেকে কেউ একজন তাকে দেখছে।
ফিওনা নানারকম ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে লাগলো,আর মাথার ওপর মেঘগুলোও যেন সেগুলোকে একবার ছুঁয়ে দিল। ফুলের কোমল পাপড়ি এবং তাদের মিষ্টি গন্ধে সে মুহূর্তটি উপভোগ করছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে, ফিওনার মনে হলো যেন কেউ তাকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। এ অনুভূতিতে তার মনে একটু সন্দেহের সঞ্চার হলো, আর সে অদ্ভুতভাবে তার চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, যেন নিশ্চিত হতে চাচ্ছে কারা তাকে দেখছে।
হঠাৎ করেই,আকাশ থেকে একটি বিশাল সোনালী ড্রাগন উড়ে এলো,তার পাখা মেলে দিয়ে সূর্যের আলোতে ঝলমল করতে লাগলো।ড্রাগনের সোনালী রঙ যেন সেই মুহূর্তে পুরো পরিবেশকে আলো ঝলমল করে তুলেছিল।ফিওনার চোখে এই দৃশ্য দেখার মুহূর্তে এক অদ্ভুত মিশ্রণ অনুভূত হলো—একদিকে বিস্ময়,অন্যদিকে আতঙ্ক।সে ভাবলো,সম্ভবত এটি জ্যাসপারের আরেক ড্রাগন সদস্য,যে কোনো বিশেষ কাজে এসেছে।

কিন্তু যখন ড্রাগনটি কাছে আসতে লাগলো,ফিওনার মনে একটি অসাধারণ শঙ্কা উদয় হলো।মুহূর্তেই ড্রাগনটি তার দুই পায়ের বড় বড় নখ দিয়ে ফিওনার কাঁধে খামচে ধরলো। ফিওনার বুকের মধ্যে এক দারুণ চাপ অনুভব হলো,সে মনে মনে ভাবলো—কি হচ্ছেটা কি?
পলকেই,ড্রাগনটি তাকে তুলে নিয়ে উড়াল দিল।ফিওনা তখন জোরে চিৎকার করতে লাগলো,‘কে তুমি ?কোথায় নিয়ূ যাচ্ছো আমাকে?আমাকে ছেড়ে দাও!’ কিন্তু তার চিৎকারের আওয়াজ গ্লাস হাউজের মধ্যে কোথাও পৌঁছাচ্ছিল না।সে তার পা দুটো ছোটাছুটি করেনিচে নামার জন্য চেষ্টা করলো, কিন্তু সেই শক্তিশালী ড্রাগনের নখের চাপে তার সারা শরীর অস্থির হয়ে উঠলো।
বাতাসে উড়তে উড়তে ফিওনার মনে হচ্ছিল,সে যেন স্বপ্নের মতো এক অভিজ্ঞতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে—একদিকে অবিশ্বাস্য আর অন্যদিকে ভয়ঙ্কর।তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল,আর মনে এক ভয়াবহ আশঙ্কা ছিল—সে কি সত্যিই কিড*ন্যাপ হতে যাচ্ছে?ড্রাগনের অদ্ভুত শক্তি আর অবরুদ্ধ অবস্থায়,ফিওনা বুঝতে পারছিল না সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে।”

বিকেলে জ্যাসপার ল্যাবেই ছিলো,তার মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছিল।আজকের দিনটি সে কাটিয়েছিল ল্যাবে, থারিনিয়াসের সঙ্গে কাজ করে।ফিওনা অসুস্থ থাকায় সংগ্রহ করার উপাদান ভেনাসে পাঠানো হয়নি,তাই আজকের কাজটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জ্যাসপার তার পরিকল্পনাটি পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছিল।সে থারিনিয়াসকে সব বুঝিয়ে দিয়েছে আর আগামীকালই তাকে উপাদানগুলো পাঠাতে হবে—এটাই ছিল তাদের মধ্যে করা আলোচনা।দ্রুত কাজটি অবিলম্বে শেষ করতে হবে,যাতে কিছুতেই সময় নষ্ট না হয়।
ল্যাবের,জ্যাসপার বসলো একটি টেবিলের সামনে।তার মনে ছিল ফিওনার জন্য চিন্তা,কিভাবে সে দ্রুত সুস্থ হবে।কিন্তু সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে সে তার কাজের দিকে ফিরে আসলো।ল্যাবের নথি আর উপাদানগুলো সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে লাগলো।সবকিছু গুছিয়ে নিলে,সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে যে,ভেনাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
এখন তার মন শুধুই কাজের প্রতি নিবদ্ধ।সে জানে, থারিনিয়াসের সঙ্গে তার আলোচনা অতি দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।একদিকে তার তীব্র কামনা আর অন্যদিকে ফিওনার জন্য চিন্তা—দুটোই তাকে দ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছিল।কিন্তু সে জানতো,তার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত না হলে সবকিছু অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।

রাতে যখন জ্যাসপার গ্লাস হাউজে ফিরলো,তখন তার প্রথম গন্তব্য ছিল ফিওনার কক্ষ।কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে দেখলো, ফিওনা নেই।তার হৃদয়ে অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়লো।সে দ্রুত বাকিদের কক্ষে খোঁজ করতে লাগলো,কিন্তু তাদের মধ্যে কোথাও ফিওনাকে পাওয়া গেল না।কিচেন এবং লিভিং রুমের পাশ দিয়েও এসেছিল,কিন্তু সেখানে কেউই ছিল না।

অথচ,ফিওনার অদৃশ্যতা জ্যাসপারের মনে উদ্বেগের জন্ম দিল।সে ভাবতে লাগলো,কোথায় চলে গেলো ফিওনা?তার অসুস্থতার কারণে সে চিন্তিত ছিল আরএমনিতেই উদ্বিগ্ন।
অবশেষে,সে অ্যাকুয়ারার কক্ষে পৌঁছাল।সেখানে গিয়ে অ্যাকুয়ারাকে প্রশ্ন করলে,সে জানালো,“আজ বিকেল থেকে আমি ফিওনার কক্ষে যাইনি।তবে এখন আমি খাবার আর ঔষধ দিতে যাচ্ছিলাম।”
জ্যাসপার পুরো গ্লাস হাউজটি তন্ন তন্ন করে খুঁজলো,কিন্তু কোথাও ফিওনার কোনো খবর নেই।বাকিরাও—অ্যাকুয়ারা, এথিরিয়ন,থারিনিয়াস—সবাই মিলে তাকে খুঁজতে বের হলো। কিন্তু ফলস্বরূপ,তাদের প্রচেষ্টা বিফল হলো।ফিওনা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে,আর এই ভাবনা জ্যাসপারের মাথায় অশান্তির সঞ্চার করছে।
আবেগে কেঁপে উঠা জ্যাসপার,যখন অবশেষে আবার ও অ্যাকুয়ারার কাছে পৌঁছালো,তখন তার ক্রোধ আর উদ্বেগের মিলিত অনুভূতিতে সে অ্যাকুয়ারার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরলো।

“আমি তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম ফিওনার!এই তোমার দায়িত্ব পালন ?কোথায় আমার ফিওনা?” তার গর্জন প্রায় পুরো গ্লাস হাউজে প্রতিধ্বনিত হলো।
জ্যাসপারের এমন আচরণ দেখে অ্যাকুয়ারার চোখে বিস্ময় উদয় হলো।সে ভাবলো,“এটা কী হচ্ছে?কেন সে এত রেগে আছে?”অ্যাকুয়ারার জন্য এটি এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল—জ্যাসপার এমনভাবে ধমকাচ্ছে,যেন সে একজন ড্রাগন নন,বরং একটি পাগল প্রেমিক।
তখন পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আলিসা সিলভা,পরিস্থিতি দেখে খুবই আশ্চর্য হয়ে গেলেন।“প্রিন্স,এটা কি ঠিক হচ্ছে?আপনি অ্যাকুয়ারাকে এভাবে ধমকাচ্ছ কেন?সে তো আপনার জন্য সবকিছু করছে!”
একের পর এক চিন্তা ও অনুভূতি ঝড়ের মতো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছিল।জ্যাসপারের মনে ফিওনার জন্য গভীর উদ্বেগ ছিল,কিন্তু তার এই উত্তেজনা যেন সবকিছুকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। এখন সে চাইছিল যে,যেভাবেই হোক ফিওনাকে খুঁজে বের করতে হবে।
“আমার ফিওনা কোথায়?”—এটা ছিল তার একমাত্র চিন্তা, যেন পুরো গ্লাস হাউজের পরিবেশে একটি সংকটের চিত্র তুলে ধরছে।

অ্যালিসা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,“ আর হ্যাঁ প্রিন্স,আপনার ফিওনা মানে?”
জ্যাসপার তখন রাগান্বিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,“জাস্ট সাট আপ!তোমার এসব অহেতুক প্রশ্ন করা বন্ধ করো এই মুহূর্তে।নাহলে ফল খুব খারাপ হবে।”তার চোখে যেন আগুন জ্বলছিল।
তারপর,আরও দৃঢ়তার সঙ্গে সে ঘোষণা করলো,“আমি সবাইকে বলে দিচ্ছি,যদি ফিওনার কিছু হয়,আমি পুরো গ্লাস হাউজ জালিয়ে দিবো!”
এ কথায় সেখানকার সবাই অবাক হয়ে গেল।থারিনিয়াস আর অ্যাকুয়ারার কাছে এটি পরিচিত ছিল,কারণ তারা জানতো জ্যাসপার ও ফিওনার সম্পর্কের গভীরতা।কিন্তু বাকিদের কাছে,যারা এই সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই জানত না, তাদের জন্য এটি এক বিস্ময়কর আর ভয়ংকর ঘোষণা ছিল।
তারা ভাবছিল,“কী ঘটছে এখানে? প্রিন্স কেন এমন রেগে আছে?ফিওনা কোথায়?” তাদের মনে অসংখ্য প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো।

জ্যাসপারের এই উত্তেজনা আর আতঙ্কের মধ্যে, বাকিদের মধ্যে শঙ্কা ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।সবাই বুঝতে পারলো,ফিওনার অনুপস্থিতি শুধুমাত্র একটি ছোট সমস্যা নয়;এটি একটি বৃহত্তর সংকটের সংকেত।
এই সময়,জ্যাসপারের মনোভাব ছিল যেন সে পুরো বিশ্বকে অগ্নিদগ্ধ করতে প্রস্তুত,যদি তার হামিংবার্ড ফিওনার কিছু হয়ে যায়।
এথিরিয়ন তখন প্রশ্ন করলো,“জ্যাসু ভাইয়া,ফিওনা আজকে আমাকে বলেছিলো সে একটু বাইরে যেতে চায়,কিন্তু আমি তো তোমার আদেশে মানা করেছিলাম।তাহলে কি সে বাইরে গেলো?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“ও একা কিভাবে বাইরে যাবে?মেইন দরজায় প্যানেল কোড ওর জানা নেই।যদি না তুই ওকে সাহায্য করিস।”

এথিরিয়ন মাথা নিচু করে বললো,“কিন্তু ভাই,আমিতো ওকে সাহায্য করিনি!”
জ্যাসপারের মুখে ক্রোধের ছাপ ছিল।হঠাৎই তার মাথায় কিছু একটা ঢুকলো।“কী?!তুই সত্যিই ওকে সাহায্য করিসনি?”এই প্রশ্নের উত্তরে এথিরিয়নের মুখ থেকে কোনো উত্তর বেরোলো না।
তখন,জ্যাসপার হঠাৎ করে দ্রুততার সাথে ছাদে দৌড়ে গেলো।তার মনে একটি আতঙ্কের অনুভূতি ছিল।ফিওনা যদি সত্যিই বাইরে চলে যায়,তাহলে তার নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জন্ম নিচ্ছিল।
ছাদের দিকে ছুটে যাওয়ার সময়,জ্যাসপার নিজের অজান্তেই ভাবতে লাগলো,“ও যদি সত্যিই বাইরে চলে যায়, তাহলে আমি কীভাবে তাকে রক্ষা করবো?”তার মনে তখন কেবল ফিওনার চিত্র ভাসছিল,আর সেই সঙ্গে তার অসহায়তা।

এথিরিয়ন,জ্যাসপারের ছাদে যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবছিল,“তাহলে কি সে সত্যিই চলে গেছে?আমি কিছুই জানি না।” তাদের মধ্যে চলছিল এক আতঙ্কের খেলা,আর জ্যাসপার নিজেকে প্রস্তুত করছিল,যেন কিছু ঘটলে তার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে ফিওনাকে রক্ষার।
জ্যাসপার ছাদে উঠেই চারপাশ ভালো করে দেখতে লাগলো। তার হৃদয়ে একটি অজানা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছিল।হঠাৎ, তার চোখে পড়লো কিছু একটি।দ্রুততার সঙ্গে সেটি তুলে নিয়ে তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল—ফিওনার কানের দুল।
ড্রাগন যখন ফিওনার কাঁধে ধরে নিচ্ছিলো,তখন একটি কানের দুল পড়ে যায়।জ্যাসপার সেটি হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো।এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো,“এখনই ফিওনা ছাদেই ছিলো!” কিন্তু এর পরেই মনে হলো,“তাহলে সে কোথায় গেলো?”

এই চিন্তায় জ্যাসপার ছাদের ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কানের দুলটা হাতে নিয়ে,বিষণ্ণ গলায় বললো,“হামিংবার্ড, কোথায় চলে গেলে তুমি?তোমার কোনো বিপদ হয়নি তো? যদি তোমার কিছু হয়ে যায়,আমার সব দোষ।তিন দিন তোমার থেকে দূরে থাকাই আমার উচিত হয়নি।”
তার কথায় গভীর উদ্বেগ আর প্রেমের উষ্ণতা ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন ফিওনার অনুপস্থিতি তার সমস্ত সুখকে কেড়ে নিয়েছে। জ্যাসপার অনুভব করছিল,এই মুহূর্তে তার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ফিওনার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
জ্যাসপার কানের দুলটি তার কাছে ধরে আরও একবার ফিওনাকে ডাকার চেষ্টা করলো, “হামিংবার্ড,আমি তোমাকে খুঁজে বের করবোই।ফিরে এসো আমার কাছে তুমি,আমি তোমাকে হারাতে দেবো না।”

জ্যাসপার আর অপেক্ষা করতে পারলো না।ছাদ থেকে দ্রুত নেমে এসে পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়াল।মুহূর্তের মধ্যে,সে নিজের ড্রাগন রূপ ধারণ করলো।বিশালাকৃতির, সবুজ আঁশের মধ্যে বিদ্যুতের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগলো তার দেহ।ড্রাগন হিসেবে তার শ্বাসে গর্জন আর হৃদয়ে একটানা উত্তেজনা ছিল।
পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আকাশে উড়াল দিলো।তার পাখার প্রতিটি টানে যেন বাতাসও কেঁপে উঠলো।পুরো পুষ্পরাজ পাহাড় এখন তার সামনে।সেখানে সে ফিওনাকে খুঁজে বের করার জন্য তন্নতন্ন করে দেখতে লাগলো।প্রতিটি জায়গা, প্রতিটি কোণ,যেখানে ফিওনার পদচিহ্ন পড়তে পারে—সেই সব জায়গায় নজর রাখছিল।
জ্যাসপারের হৃদয়ে ছিল এক অদম্য ইচ্ছা।সে জানত, ফিওনা যদি বিপদে পড়ে থাকে,তাহলে তাকে উদ্ধার করতে হবে।সে কল্পনা করছিল,কিভাবে ফিওনাকে আবার ফিরে পাবে ,কিভাবে তারা আবার একসাথে ফিরে আসবে।
“হামিংবার্ড,তুমি কোথায়?”—অন্ধকার আকাশে গর্জন করে উঠলো জ্যাসপার।তার ড্রাগন রূপের শক্তি আর সাহস যেন তাকে আরও উজ্জীবিত করছিল।পাহাড়ের প্রতিটি অংশে পৌঁছানোর জন্য সে প্রস্তুত ছিল।ফিওনাকে খুঁজে বের করতে, সে এখন আর কোনো বাধা মানতে চায় না।

টানা দু’দিন ধরে জ্যাসপার পাহাড় আর চীনের শহর দুটিতে ফিওনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত,সে কোথাও তাকে খুঁজে পায়নি।তার মনে হচ্ছে,ফিওনার পক্ষে একা এই বিশাল পাহাড়ে থেকে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।এই পাহাড় পাড়ি দিতে হলে মহাসমুদ্রের বিশালতা পার করতে হবে আর তাও কেবল পাখি কিংবা ড্রাগনের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।
জ্যাসপার পাহাড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখ-মুখে দৃঢ়তা রয়েছে,কিন্তু মনে মনে অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে।তার হৃদয়ে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া পানির মতো দেখতে কিছু,কিন্তু এটি পানির ফোঁটা নয়—এটি র*ক্ত।ড্রাগনরা সাধারণত কাঁদে না,কিন্তু যখন তারা কাঁদে,তখন তাদের চোখের পানি হয় র*ক্ত।এক ফোঁটা রক্ত হাজার হাজার পানির ফোঁটার সমতুল্য।

জ্যাসপারের হৃদয়ে ব্যথা,উদ্বেগ আর অস্থিরতা একত্রে জড়ো হয়েছে।“কোথায় তুমি,হামিংবার্ড?”—তার মুখে হঠাৎ উচ্চারিত এই প্রশ্ন,যেন আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে তার শোক ও হতাশা।সে জানে,তাকে এই বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে হবে।
জ্যাসপারের র*ক্তাভ চোখগুলোতে সংকল্প জেগে ওঠে। সে এবার আর থামবে না,তাকে এই পাহাড়ের কোণে থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।সে জানে,ফিওনার জন্য তার প্রেম আর ভালোবাসাই তার বড় শক্তি।
অবশেষে জ্যাসপার একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছালো।সে জানে, এভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।দ্রুত সে ল্যাবে গেলো, যেখানে সে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।তার মনে হঠাৎ করে ফিওনার গলায় থাকা লকেটটির কথা মনে পড়লো—যেটা সে ফিওনাকে দিয়েছিল।এই লকেটের মাধ্যমে ফিওনার অবস্থান জানা সম্ভব,কিন্তু কেবলমাত্র তখনই যখন ফিওনা লকেটের পাথরে আঙুল স্পর্শ করবে।

জ্যাসপার ল্যাবের দিকে দ্রুত পা বাড়ায়,তার হৃদয়ে আশার একটি নতুন আলো জ্বলে ওঠে।সে জানে,ফিওনা যদি সত্যিই লকেটটি স্পর্শ করে থাকে,তাহলে সে তার অবস্থান সনাক্ত করতে পারবে।ল্যাবে পৌঁছার পর সে দ্রুত লকেটটির প্রযুক্তিগত দিকটি খতিয়ে দেখতে লাগলো।
অভ্যন্তরে থাকা ডিভাইসটি চালু করতে গিয়ে,জ্যাসপার তার মনে আশার সঞ্চার করে।সে লকেটের ফাংশনগুলো পরীক্ষা করতে থাকে,তার মুখে একটি উজ্জ্বল আশা দেখা দেয়। ফিওনার জন্য তার ভালোবাসা তাকে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে বাধ্য করছে।
“তোমাকে খুঁজে বের করবোই আমি হামিংবার্ড,” সে নিজের মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে।”তোমার কোন বিপদ হলে আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না।”

সুতরাং,প্রস্তুতি সম্পন্ন করে,জ্যাসপার লকেটটির সক্রিয়করণের জন্য প্রস্তুত হল,আশা করে যে ফিওনা শীঘ্রই লকেটের পাথর স্পর্শ করবে আর সে তার অবস্থান খুঁজে পাবে।
জ্যাসপার যখন ল্যাবের ডিভাইসের স্ক্রীনে “ইরর” লেখা দেখলো,তখন তার হৃদয়ে এক বিষণ্ণতা নেমে এল।ফিওনা একবারের জন্যও লকেটের পাথর স্পর্শ করেনি।এটাই তো তার জন্য একমাত্র আশা ছিল।মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল—কোথায় থাকতে পারে ফিওনা?তার কি কোনো বিপদ হয়েছে?

অসহ্য হতাশায় ভেঙে পড়ে,জ্যাসপার ল্যাবের সমস্ত কিছু উল্টে-পাল্টে দিতে শুরু করলো।কম্পিউটার স্ক্রীনগুলো, গবেষণার উপকরণ,এমনকি যন্ত্রপাতিগুলো—সবকিছু ভা*ঙচুর করতে লাগলো।তার চিৎকারগুলো ল্যাবের দেয়ালগুলিকে প্রতিধ্বনিত করে। “কেনো তুমি রকেট স্পর্শ করছো না হামিংবার্ড?কোথায় তুমি, কিভাবে আছো?”
ল্যাবের মাঝে এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক পরিবেশ তৈরি হল। সমস্ত প্রযুক্তির শোকরূপে,সে যেন নিজের ভেতরের ক্রোধকে বাইরের জগতের প্রতিফলন করছিল।প্রিয় মানুষটির জন্য, সে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলীন করতে চাইছিল।
কিন্তু যতই সে ধ্বংসাত্মক আচরণ করুক,ফিওনার জন্য তার ভালোবাসা তাকে বাধা দিচ্ছিল।“এভাবে কিছু হবে না,” সে নিজেকে মনে করালো। “জ্যাসপার শান্ত হো তোকে এই মুহূর্তে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে,ফিওনাকে খুঁজে বের করতে হবে,তাকে বাঁচাতে হবে।”

একটু শান্ত হয়ে,জ্যাসপার এক মিনিটের জন্য থেমে গেলো। গা থেকে রাগের উত্তাপ বের করতে সে চোখ বন্ধ করলো। ধীরে ধীরে,সে ল্যাবের গ্লাসের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলো,যেন তার ভেতর থেকে অন্য কোনো জগতের দিকে তাকাচ্ছে। সে জানে,তাকে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে।
অবশেষে,জ্যৈ প্রতিজ্ঞা করলো,“আমি তোমাকে খুঁজে বের করব,হামিংবার্ড।আমি কোনওভাবে তোমাকে আমার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে দিবো না।”

আযদাহা পর্ব ৪২

এখন,ভাঙা যন্ত্রপাতিগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে,জ্যাসপার তার চিন্তা পরিষ্কার করতে লাগলো।ফিওনার অবস্থান সনাক্ত করতে কিছু নতুন উপায় বের করার চেষ্টা করবে।কারণ সে জানে,এই যুদ্ধ তার জন্য শেষ নয়,বরং নতুন একটি শুরু।

আযদাহা পর্ব ৪৪